।। অশোকানন্দ রায়বর্ধন ।।
মানুষ তার
জাত্যাভিমানটাকে সরিয়ে ফেলতে পারলে তার হৃদয় প্রসারিত হয় ৷ ভাষা কোন বিষয়ই নয় ৷
অন্তরের ভাষা সবারই এক ৷ এন আর সি, লিগ্যাসি
কী করতে পারে ৷ কোনো ভাঙন ধরাতে পারে অন্তরমহলে?
না পারে না? এমনটাই মনে হয়েছে আমাদের এ যাত্রায় ৷
মানুষ ৷ মানুষই আমার সন্ধান ৷ মানুষের ভেতরের মানুষটাকে কোনদিনই খুঁজে পেলামনা ৷
খুঁজি সেই মানুষকে ৷ যে দূর করে দিতে পারে মনুষ্যনির্মিত ব্যবধান ৷ 'সেই মানুষে খুঁজে বেড়াই দেশ বিদেশে' ৷ দেখাও হয়ে
যায় পথে পথে ৷
উত্তরবঙ্গের ইসলামপুর সন্নিহিত আলুয়াবাড়ি রোড
স্টেশন থেকে ফেরার যাত্রা শুরুর কথা আটাশ তারিখ বিকেল চারটে কুড়িতে ৷ স্টেশনে এসে
প্রথমেই শুনলাম অবধ-অসম এক্সপ্রেস দশ ঘণ্টা লেট ৷ আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি ভীষণ ৷
আমাকে নিয়ে গোবিন্দ, গোপাল
দৌড়াল নার্সিং হোমে ৷ সেখানে চিকিৎসায় পেলাম এক মহা-মানবিকতার পরিচয় ৷ সেটা অল্প-কথায়
বলার নয় ৷ তাই আমার হৃদয়নিসৃত সেই অনুভব যত্ন সহযোগে
তুলে ধরার আশায় এখন আর অবতারণা করছিনা ৷
সময় যতো এগুচ্ছে ট্রেনের বিলম্বের
মাত্রা ততো বাড়ছে ৷ শেষ পর্যন্ত ঊনত্রিশ তারিখ সকাল দশটায় যখন ট্রেনের নাগাল
পেলাম তখন সে উনিশ ঘণ্টা পিছিয়ে চলছে ৷ আমরা পরবর্তী ট্রেনের সংযোগ পাব কী পাবনা
দুশ্চিন্তার মধ্যে ট্রেনে চাপলাম ৷ দুপুরের মধ্যে এন জে পি পৌঁছুলাম ৷ খাওয়া
দাওয়ার পর গোবিন্দ ব্যাঙ্কের উপর শয়ান হল ৷ আমি,গোপাল, সঞ্জীব, অভীক নিচে ৷ এক
অসমিয়া তরুণী আমাদের কামরায় এলেন ৷ যেহেতু আমরা চারজন নিচে ৷ ফাঁকা আসন দেখে অত্যন্ত
বিনয়ের সঙ্গে আমাকে বললেন,
ইয়াত বহি পারিম? বললাম,
বহক ৷ গোপাল সরে এসে আমার পাশে বসলেন ৷ মহিলাকে প্যাসেজের পাশে
জায়গা ছেড়ে দিলেন ৷ কথায় কথায় জানা গেল তিনি দ্বাদশ স্তরের ভূগোলের শিক্ষিকা ৷ দু
হাজার চৌদ্দতে টেট দিয়ে চাকরি পেয়েছেন ৷সপ্তম পে কমিশন বিন্যস্ত বেতন পাচ্ছেন ৷ নাম
মইনু গগৈ ৷ বঙ্গাইগাঁওতে পোস্টেড ৷ তাঁর স্বামীও শিক্ষকতা করেন ৷
রঙ্গিয়াতে আছেন ৷ সেখানে যাচ্ছেন ৷ সাহিত্য ভালোবাসেন ৷ কথাবার্তার
মধ্যে জানলাম আমাদের ত্রিপুরার অনেক খবর রাখেন ৷আমরা সপ্তম বঞ্চিত ৷ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী
, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী
উভয়ের সম্বন্ধেই ভালো খোঁজ খবর রাখেন ৷ অসমের সমকাল, সংকট, সমাজ সব নিয়ে স্পষ্ট ধারণা রয়েছে ৷ অসমের
বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষিক পরিবর্তন সম্বন্ধে আলোকপাত করলেন ৷ যতক্ষণ ছিলেন কবিতা শুনলেন
আমাদের ৷ বাংলাকবিতা হলেও তিনি শুনছেন ৷ আমার সঙ্গীরা বাংলায় কথা বলছেন ৷ তিনি
অসমিয়া ও হিন্দিতে বলছেন ৷ আমার সঙ্গে অসমিয়াতে ৷ একবারের জন্যেও আমাদের মনে হয়নি
আমরা ভিন ভাষাভাষী মানুষ কথা বলছি এতোক্ষণ ৷ আমাদের কারো কথা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে
৷ একটা আন্তরিক ঘরোয়া পরিবেশে যেন প্রতিবেশীর সুখদুঃখের কথা বলছি আমরা ৷
রঙ্গিয়া
স্টেশনে ট্রেন ঢোকার পর তরুণী উঠলেন ৷ বললেন,
ময় যাম এতিয়া ৷ ভাল লাগিল আপুনালোকর লগতে ই সময়টো ৷ আমার সঙ্গীরা
বিদায় জানালেন ৷ তরুণী আমাকে বললেন, আহক স্যর ৷
আমিও বললাম, কেনেকা সময়টো শেষ হল ৷
তরুণী মইনু গগৈ ট্রেন নেমে ছুটলেন তাঁর
প্রিয়পুরুষের সান্নিধ্য লাভের তৃষ্ণায় ৷ সে প্রিয়জনটির নাম জানা হয়নি আমার ৷ ট্রেন
ছেড়ে দিয়েছে ৷ আমি চেয়ে আছি সেই তরুণীর গমনপথের দিকে ৷ যে কিছুক্ষণের জন্যে একটা
আত্মীয়তার বাতাবরণ তৈরি করে গেল ৷যার খোঁজে থাকি আমরা ৷ যার তৃষ্ণায় আমাদের যাপন ৷
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন