“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ২৯ মে, ২০২০

চ ক্ষে আমার তৃ ষ্ণা

।। অশোকানন্দ রায়বর্ধন ।।


       মানুষ তার জাত্যাভিমানটাকে সরিয়ে ফেলতে পারলে তার হৃদয় প্রসারিত হয় ৷ ভাষা কোন বিষয়ই নয় ৷ অন্তরের ভাষা সবারই  এক ৷ এন আর সি, লিগ্যাসি কী করতে পারে ৷ কোনো ভাঙন ধরাতে পারে  অন্তরমহলে?  না পারে না?  এমনটাই মনে হয়েছে আমাদের এ যাত্রায় ৷ মানুষ ৷ মানুষই আমার সন্ধান ৷ মানুষের ভেতরের মানুষটাকে কোনদিনই খুঁজে পেলামনা ৷ খুঁজি সেই মানুষকে ৷ যে দূর করে দিতে পারে মনুষ্যনির্মিত ব্যবধান ৷ 'সেই মানুষে খুঁজে বেড়াই দেশ বিদেশে' ৷ দেখাও হয়ে যায় পথে পথে ৷
 উত্তরবঙ্গের ইসলামপুর সন্নিহিত আলুয়াবাড়ি রোড স্টেশন থেকে ফেরার যাত্রা শুরুর কথা আটাশ তারিখ বিকেল চারটে কুড়িতে ৷ স্টেশনে এসে প্রথমেই শুনলাম অবধ-অসম এক্সপ্রেস দশ ঘণ্টা লেট ৷ আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি ভীষণ ৷ আমাকে নিয়ে গোবিন্দ, গোপাল দৌড়াল নার্সিং হোমে ৷ সেখানে চিকিৎসায় পেলাম এক মহা-মানবিকতার পরিচয় ৷ সেটা অল্প-কথায় বলার নয় ৷ তাই  আমার হৃদয়নিসৃত সেই অনুভব যত্ন সহযোগে তুলে ধরার আশায় এখন আর অবতারণা করছিনা ৷
           সময় যতো এগুচ্ছে ট্রেনের বিলম্বের মাত্রা ততো বাড়ছে ৷ শেষ পর্যন্ত ঊনত্রিশ তারিখ সকাল দশটায় যখন ট্রেনের নাগাল পেলাম তখন সে উনিশ ঘণ্টা পিছিয়ে চলছে ৷ আমরা পরবর্তী ট্রেনের সংযোগ পাব কী পাবনা দুশ্চিন্তার মধ্যে ট্রেনে চাপলাম ৷ দুপুরের মধ্যে এন জে পি পৌঁছুলাম ৷ খাওয়া দাওয়ার পর  গোবিন্দ ব্যাঙ্কের উপর শয়ান হল ৷ আমি,গোপাল, সঞ্জীব, অভীক নিচে ৷ এক অসমিয়া তরুণী আমাদের কামরায় এলেন ৷ যেহেতু আমরা চারজন নিচে ৷ ফাঁকা আসন দেখে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আমাকে  বললেন,  ইয়াত বহি পারিম?  বললাম, বহক ৷ গোপাল সরে এসে আমার পাশে বসলেন ৷ মহিলাকে প্যাসেজের পাশে জায়গা ছেড়ে দিলেন ৷ কথায় কথায় জানা গেল তিনি দ্বাদশ স্তরের ভূগোলের শিক্ষিকা ৷ দু হাজার চৌদ্দতে টেট দিয়ে চাকরি পেয়েছেন ৷সপ্তম পে কমিশন বিন্যস্ত বেতন পাচ্ছেন ৷ নাম মইনু গগৈ ৷ বঙ্গাইগাঁওতে পোস্টেড ৷ তাঁর স্বামীও শিক্ষকতা করেন ৷  রঙ্গিয়াতে আছেন ৷ সেখানে যাচ্ছেন ৷ সাহিত্য ভালোবাসেন ৷ কথাবার্তার মধ্যে জানলাম আমাদের ত্রিপুরার অনেক খবর রাখেন ৷আমরা সপ্তম বঞ্চিত ৷ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী , বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী  উভয়ের সম্বন্ধেই ভালো খোঁজ খবর রাখেন ৷ অসমের সমকাল, সংকট, সমাজ সব নিয়ে স্পষ্ট ধারণা রয়েছে ৷ অসমের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষিক পরিবর্তন সম্বন্ধে আলোকপাত করলেন ৷ যতক্ষণ ছিলেন কবিতা শুনলেন আমাদের ৷ বাংলাকবিতা হলেও তিনি শুনছেন ৷ আমার সঙ্গীরা বাংলায় কথা বলছেন ৷ তিনি অসমিয়া ও হিন্দিতে বলছেন ৷ আমার সঙ্গে অসমিয়াতে ৷ একবারের জন্যেও আমাদের মনে হয়নি আমরা ভিন ভাষাভাষী মানুষ কথা বলছি এতোক্ষণ ৷ আমাদের কারো কথা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে ৷ একটা আন্তরিক ঘরোয়া পরিবেশে যেন প্রতিবেশীর সুখদুঃখের কথা বলছি আমরা ৷ 
           রঙ্গিয়া স্টেশনে ট্রেন ঢোকার পর তরুণী উঠলেন ৷ বললেন, ময় যাম এতিয়া ৷ ভাল লাগিল আপুনালোকর লগতে ই সময়টো ৷ আমার সঙ্গীরা বিদায় জানালেন ৷ তরুণী আমাকে বললেন,  আহক স্যর ৷ আমিও বললাম, কেনেকা সময়টো শেষ হল ৷
         তরুণী মইনু গগৈ ট্রেন নেমে ছুটলেন তাঁর প্রিয়পুরুষের সান্নিধ্য লাভের তৃষ্ণায় ৷ সে প্রিয়জনটির নাম জানা হয়নি আমার ৷ ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে ৷ আমি চেয়ে আছি সেই তরুণীর গমনপথের দিকে ৷ যে কিছুক্ষণের জন্যে একটা আত্মীয়তার বাতাবরণ তৈরি করে গেল ৷যার খোঁজে থাকি আমরা ৷ যার তৃষ্ণায় আমাদের যাপন ৷

কোন মন্তব্য নেই: