কোয়ান্টাম মেকানিক্স , স্ট্রিং থিওরি গুলে খাওয়া সমসাময়িক পদার্থ বিজ্ঞানী Edward Witten এর কথা দিয়ে এই লেখা শুরু করি,"I have much easier time imagining how we understand the Big Bang than I have imagining how we can understand consciouness."
চেতনা যদি অনন্তপ্রবাহ হয় তবে চেতনার অনুপস্থিতি মৃত্যু ছাড়া সম্ভব কি ? কোমা আক্রান্ত মানুষ কি তবে চেতনারহিত নয় ? নিউরোসায়েন্টিস্টদের মতে চেতনাকে পর্যবেক্ষণ করার দুটো রাস্তা রয়েছে । এক , তার মেন্টাল স্ট্যাটাস এক্সামিনেশন বা মানসিক অবস্থানকে বিভিন্ন প্রশ্নাবলী ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে পরিমাপ করা । যেমন কোন ব্যক্তি যদি তার নামধাম, বর্তমান অবস্থান, বর্তমান সময় তারিখ ও দিন ঠিকঠাক বলতে পারে , তার মনোযোগ স্মৃতি ইত্যাদি ঠিকভাবে কাজ করে তবে বলা যাবে ব্যক্তি 'Alert and Oriented times four' (A&Ox4) এবং তাকে পুরোপুরি চেতনা সম্পন্ন বলে পরিগণিত করা হবে । আর দ্বিতীয়টি হলো , হাসপাতাল সেটিং এ রেখে তার বিভিন্ন নিউরোলজিক্যাল পরীক্ষা নিরীক্ষা করা,তার সংবেদীয় পেশীগত প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বোঝা । Glasgow Coma Scale এর মাধ্যমে ব্যক্তির চেতনার পরিমাপ করা হয় , যা কোমা স্তর থেকে পুরোপুরি চেতন অবস্থা পর্যন্ত বিস্তৃত । অর্থাৎ এই স্কেলে ব্যক্তির স্কোর যত বেশি তাকে তত ' সচেতন ' বলে ধরা হবে ।
চেতনার অনুপস্থিতি বোঝাতে কেউ কেউ বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে থাকেন । যেমন ঘুমন্ত অবস্থা । কারো কারো মতে NonRem Sleep স্তরে যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ব্যক্তি স্বপ্নহীন অবস্থায় থাকে তখন আসলে সে অচেতন অবস্থা অতিক্রান্ত করে । চেতনা বা awareness তখন থাকে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত । এছাড়াও আরো কিছু সময় যেমন দিবাস্বপ্ন শিশুর জন্মদান দীর্ঘসময় নিদ্রাহীনতা, যৌন উত্তেজনা অথবা প্যানিক স্টেট অতিক্রম করার সময় চেতনপ্রবাহে ছেদ আসতে পারে । একে Altered State of Consciousness (ASC)বলেও আখ্যায়িত করা হয় । সচেতন জাগ্রত অবস্থা থেকে ASC অবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা । ১৮৯২ সালে হিপ্নোসিসের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এই শব্দটি প্রথম উত্থাপিত হয় । হিপ্নোসিস এবং এপিলেপ্সির ক্ষেত্রে চেতনার ব্যতয় পরিলক্ষিত হলেও ,এসকল অবস্থাই কিন্তু ক্ষনস্থায়ী । চেতনার পরিবর্তিত দশা হলো অভিজ্ঞতার এক বিকল্প প্যাটার্ন যা গুনগত ভাবে আমাদের মৌলিক মানসিক উপাদান থেকে ভিন্ন । অতিরিক্ত ড্রাগ বা অ্যালকোহলের নেশা আসক্ত অবস্থায় অথবা চিকিৎসার স্বার্থে কোন ওষুধ প্রয়োগের ফলেও এই ASC অবস্থা তৈরি হয় । Absence Seizure বলে একটি বিশেষ শারীরিক অসুখ রয়েছে যেখানে চেতনারহিত হয়ে ১০ সেকেন্ড বা তারও কম সময় ব্যক্তি থাকতে পারে এমনকি পূর্ব শারীরিক অবস্থান একটুও পরিবর্তন না করে ! শিশুদের ক্ষেত্রেই Absence Seizure বেশি দেখা যায় ।
আবার ফিরে আসি ঘুমের কথায় । ঘুম সাধারণত দুটি স্তরের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয় । NonREM বা চোখ অনড়া ঘুম আর REM বা চোখ নড়া ঘুম । চোখের তারার নড়াচড়ার হার দিয়ে এর নির্ধারণ হয়েছে । NREM এ রয়েছে আবার তিনটি ভাগ । এই স্তরগুলি চক্রাকারে আসতে থাকে , প্রথম দ্বিতীয়, তৃতীয় আবার প্রথম ইত্যাদি । একটি নিদ্রাচক্রে গড়ে ৯০ থেকে ১১০ মিনিট সময় যায় , যার মধ্যে এক একটি স্তরের স্থায়িত্ব হলো ৫ থেকে ১৫ মিনিট । NREM sleep এর একদম প্রথম স্তরে চোখ বন্ধ থাকবে , কিন্তু বাইরের জগতে কি ঘটছে তা সম্পর্কে প্রায় সম্পূর্ণ অ্যাওয়্যারনেস থাকবে । জাগ্রত ও সুপ্ত অবস্থার দোলাচলে আচ্ছন্ন এই স্তরের অভিজ্ঞতায় hynic myloclonia ঘটতে পারে । অর্থাৎ হঠাৎ করে শরীরের কোন পেশীতে ঝাঁকুনি , আকস্মিক হতচকিত (আমাদের ত্রিপুরার বাংলায় ' ছ্যাবড়া খাওয়া ' 😃) হয়ে আবছা ঘুমের মধ্যে চমকে ওঠা ইত্যাদি হতে পারে । অনেক ইনসমনিয়ার রুগীর এই ঘটনাটির জন্য ঘুমে অচেতন হওয়া হয়ে ওঠে না । ৯০ শতাংশ লোকই জীবনে কোন না কোন সময় এই অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হয়েছেন । আর বাকি ১০ শতাংশ রয়েছেন যাদের প্রতিদিনই এমন হয় । বিশেষত যারা উদ্বেগ ও স্ট্রেসে ভোগেন , যারা বেশি চা কফি খান বা ধূমপান করেন তাদের এই অভিজ্ঞতা বেশি হয় । আমরা অনেকেই বিশেষত অল্পবয়সে ঘুমের মধ্যে হাল্কা বায়ুর মতো উঠে ধপ করে পড়ে যাওয়ার ও ঘুম ভেঙে যাওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি । এই অভিজ্ঞতা এই স্তরেই ঘটে থাকে !
ঘুমের দ্বিতীয় স্তরটিও NREM ঘুম স্তর । এখানে এসে মস্তিস্কের ওয়েভ ধীর হয়ে যায়, হৃদস্পন্দন ও শরীরের তাপমাত্রা হ্রাস পায় , পেশী রিল্যাক্সড হয়ে যায় । এসময় হাল্কা স্বপ্ন আসতে পারে, তবে ঠিক স্বপ্ন নয় যেন ভাবনা । কোন লোককে এসময় জাগিয়ে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সে বলবে , ' স্বপ্ন দেখছিলাম না , একটু ভাবছিলাম ! '
তৃতীয় NREM স্তরটি গভীর নিদ্রার স্তর । এই সময় রক্তচাপ আরো কমে যায় । নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নির্দিষ্ট ছন্দ অনুসরণ করে চলতে থাকে শরীরের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায় , হজম ও বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় হরমোনগুলি নিঃসরণ হতে থাকে । বাইরের জগতের সঙ্গে চেতনার সংযোগ সবচেয়ে কম থাকে এ ঘুম দশায় । Sleep Walking , বাচ্চাদের বিছানা ভিজানো , nightmare দেখা এসব অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার স্যাপার এই সময়ই ঘটে ।
একদম শেষ স্তর হলো REM ঘুম বা চোখ নড়া ঘুম । চোখ নড়া ঘুমে যেন শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও পেশী অবশ হয়ে যায় । নিঃশ্বাস অনিয়মিত হয় , হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ আগের অবস্থা থেকে বেড়ে ওঠে । আর এ সময়ই স্বপ্নসমূহ আসে । পরীক্ষায় দেখা যায় আশি শতাংশ স্বপ্নই REM স্তরের । এই স্বপ্নসমূহ অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের এপিসোডিক মেমোরি বা জীবনকাহিনীর সঙ্গে যুক্ত স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত । সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাও এর বিষয়বস্তু ।
REM ঘুম এর সঙ্গে সৃজনশীলতার সম্পর্ক রয়েছে । REM ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে উঠলে মানবমস্তিস্ক hyperassociative হয়ে ওঠে , ফলতঃ শব্দের সঙ্গে শব্দের সম্পর্ককরণ , সমস্যামূলক কাজের সমাধান , শব্দকে বিভিন্ন ফর্ম এ পুনর্বিন্যাস তার কাছে সহজ হয় । নিদ্রার প্রায় নব্বই মিনিট অতিবাহিত না হলে REM ঘুমে উপনীত হওয়া যায় না । যত বয়স বাড়ে , REM ঘুম কমে যায় । তাই বাচ্চারাই বেশি স্বপ্ন দেখে !
কোন কোন মনোবিদ বলেছেন গভীর ঘুম চেতনাহীন । আবার অন্যদল বলেন স্বপ্নহীন ঘুমের মধ্যেও চেতনা অবলুপ্ত হয় না । তাঁরা বলেন , আসলে চেতনা কখনোই অবলুপ্ত হয় না । তার অবস্থার পরিবর্তন হয় মাত্র । গভীর ঘুমে চেতনা মূলতঃ তিনটি অবস্থানের যে কোন একটিতে থাকতে পারে :
১) কোন অনুভূতিহীন , নিমজ্জনহীন হাল্কা চিন্তাস্রোতের ও অভিজ্ঞতা স্রোতের মধ্য দিয়ে ভেসে চলা ।২)শারীরিক সংবেদন বা প্রত্যক্ষণসমূহের অভিজ্ঞতা অর্জন -সেটা অভ্যন্তরীন বা বাহ্যিক দুইই হতে পারে । যেমন ঘুমের মধ্যেও অ্যালার্ম বেজে উঠলে সেই শব্দ শুনতে পাওয়া ।৩) স্বপ্নহীন গভীর ঘুম , তবুও তার সঙ্গে এই চেতন অভিজ্ঞতা (awareness) যে ' আমি এখন নিদ্রামগ্ন ' আছি ।
সোমনামবিউলিজ্ম বা sleep walking এর ক্ষেত্রে সাধারনতঃ আমরা বলে থাকি , ব্যক্তি চেতনাহীন ছিল । যদি এ অবস্থায় সে কোন অপরাধ করে ( হরর ফিল্মে যেমন দেখা যায় ) তবে মনে করা হয় সম্পূর্ণ অচেতন ভাবে সে কাজটি করেছে । কিন্তু এই ' সম্পূর্ণ অচেতন ' কথাটার মধ্যে একটা fallacy রয়েছে ! আসলে সেই অবস্থায়ও তার মধ্যে চেতনা সক্রিয় ছিল । আর তা ছিল বলেই সে হাঁটতে পেরেছে , পথঘাট ঠিক রেখে চলাচল করেছে, ভিক্টিমকে চিণ্হায়িত করেছে, অস্ত্র প্রয়োগ করেছে !
তবে অবশ্যই এই চেতনা জাগ্রত স্বাভাবিক চেতনা নয় । Altered State of Consciousness
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন