“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ২৩ মে, ২০২০

চেতনা প্রবাহ


কোয়ান্টাম মেকানিক্স , স্ট্রিং থিওরি গুলে খাওয়া সমসাময়িক পদার্থ বিজ্ঞানী Edward  Witten এর কথা দিয়ে এই লেখা শুরু করি,"I have much easier time imagining how we understand the Big Bang than I have imagining how we can understand consciouness."

      চেতনা যদি অনন্তপ্রবাহ হয় তবে চেতনার অনুপস্থিতি মৃত্যু ছাড়া সম্ভব কি ? কোমা আক্রান্ত মানুষ কি তবে চেতনারহিত নয় ? নিউরোসায়েন্টিস্টদের মতে চেতনাকে পর্যবেক্ষণ করার দুটো রাস্তা রয়েছে । এক , তার মেন্টাল স্ট্যাটাস এক্সামিনেশন বা মানসিক অবস্থানকে বিভিন্ন প্রশ্নাবলী ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে পরিমাপ করা । যেমন কোন ব্যক্তি যদি তার নামধাম,  বর্তমান অবস্থান,  বর্তমান সময় তারিখ ও দিন ঠিকঠাক বলতে পারে , তার মনোযোগ স্মৃতি ইত্যাদি ঠিকভাবে কাজ করে তবে বলা যাবে ব্যক্তি 'Alert and Oriented times four' (A&Ox4) এবং তাকে পুরোপুরি চেতনা সম্পন্ন বলে পরিগণিত করা হবে । আর দ্বিতীয়টি হলো , হাসপাতাল সেটিং এ রেখে তার বিভিন্ন নিউরোলজিক্যাল পরীক্ষা নিরীক্ষা করা,তার সংবেদীয় পেশীগত প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বোঝা । Glasgow Coma Scale এর মাধ্যমে ব্যক্তির চেতনার পরিমাপ করা হয় , যা কোমা স্তর থেকে পুরোপুরি চেতন অবস্থা পর্যন্ত বিস্তৃত । অর্থাৎ এই স্কেলে ব্যক্তির স্কোর যত বেশি তাকে তত ' সচেতন ' বলে ধরা হবে ।

           চেতনার অনুপস্থিতি বোঝাতে কেউ কেউ বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে থাকেন । যেমন ঘুমন্ত অবস্থা । কারো কারো মতে NonRem Sleep স্তরে যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ব্যক্তি স্বপ্নহীন অবস্থায় থাকে তখন আসলে সে অচেতন অবস্থা অতিক্রান্ত করে । চেতনা বা awareness তখন থাকে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত । এছাড়াও আরো কিছু সময় যেমন দিবাস্বপ্ন শিশুর জন্মদান দীর্ঘসময় নিদ্রাহীনতা,  যৌন উত্তেজনা অথবা প্যানিক স্টেট অতিক্রম করার সময় চেতনপ্রবাহে ছেদ আসতে পারে । একে Altered State of Consciousness (ASC)বলেও আখ্যায়িত করা হয় । সচেতন জাগ্রত অবস্থা থেকে ASC অবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা । ১৮৯২ সালে হিপ্নোসিসের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এই শব্দটি প্রথম উত্থাপিত হয় । হিপ্নোসিস এবং এপিলেপ্সির ক্ষেত্রে চেতনার ব্যতয় পরিলক্ষিত হলেও ,এসকল অবস্থাই কিন্তু ক্ষনস্থায়ী । চেতনার পরিবর্তিত দশা হলো অভিজ্ঞতার এক বিকল্প প্যাটার্ন যা গুনগত ভাবে আমাদের মৌলিক মানসিক উপাদান থেকে ভিন্ন । অতিরিক্ত ড্রাগ বা অ্যালকোহলের নেশা আসক্ত অবস্থায় অথবা চিকিৎসার স্বার্থে কোন ওষুধ প্রয়োগের ফলেও এই ASC অবস্থা তৈরি হয় । Absence Seizure বলে একটি বিশেষ শারীরিক অসুখ রয়েছে যেখানে চেতনারহিত হয়ে ১০ সেকেন্ড বা তারও কম সময় ব্যক্তি থাকতে পারে এমনকি পূর্ব শারীরিক অবস্থান একটুও পরিবর্তন না করে ! শিশুদের ক্ষেত্রেই Absence Seizure  বেশি দেখা যায় ।
            আবার ফিরে আসি ঘুমের কথায় । ঘুম সাধারণত দুটি স্তরের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয় । NonREM বা চোখ অনড়া ঘুম আর REM বা চোখ নড়া ঘুম । চোখের তারার নড়াচড়ার হার দিয়ে এর নির্ধারণ হয়েছে । NREM এ রয়েছে আবার তিনটি ভাগ । এই স্তরগুলি চক্রাকারে আসতে থাকে , প্রথম দ্বিতীয়, তৃতীয় আবার প্রথম ইত্যাদি । একটি নিদ্রাচক্রে গড়ে ৯০  থেকে ১১০ মিনিট সময় যায় , যার মধ্যে এক একটি স্তরের স্থায়িত্ব হলো ৫ থেকে ১৫ মিনিট । NREM  sleep এর একদম প্রথম স্তরে চোখ বন্ধ থাকবে , কিন্তু বাইরের জগতে কি ঘটছে তা সম্পর্কে প্রায় সম্পূর্ণ অ্যাওয়্যারনেস থাকবে । জাগ্রত ও সুপ্ত অবস্থার দোলাচলে আচ্ছন্ন এই স্তরের অভিজ্ঞতায় hynic myloclonia ঘটতে পারে । অর্থাৎ হঠাৎ করে শরীরের কোন পেশীতে ঝাঁকুনি , আকস্মিক হতচকিত (আমাদের ত্রিপুরার বাংলায় ' ছ্যাবড়া খাওয়া ' 😃) হয়ে আবছা ঘুমের মধ্যে চমকে ওঠা ইত্যাদি হতে পারে । অনেক ইনসমনিয়ার রুগীর এই ঘটনাটির জন্য ঘুমে অচেতন হওয়া হয়ে ওঠে না । ৯০ শতাংশ লোকই জীবনে কোন না কোন সময় এই অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হয়েছেন । আর বাকি ১০ শতাংশ রয়েছেন যাদের প্রতিদিনই এমন হয় । বিশেষত যারা উদ্বেগ ও স্ট্রেসে ভোগেন , যারা বেশি চা কফি খান বা ধূমপান করেন তাদের এই অভিজ্ঞতা বেশি হয় । আমরা অনেকেই বিশেষত অল্পবয়সে ঘুমের মধ্যে হাল্কা বায়ুর মতো উঠে ধপ করে পড়ে যাওয়ার ও ঘুম ভেঙে যাওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি । এই অভিজ্ঞতা এই স্তরেই ঘটে থাকে ! 

          ঘুমের দ্বিতীয় স্তরটিও NREM ঘুম স্তর । এখানে এসে মস্তিস্কের ওয়েভ ধীর হয়ে যায়, হৃদস্পন্দন ও শরীরের তাপমাত্রা হ্রাস পায় , পেশী রিল্যাক্সড হয়ে যায় । এসময় হাল্কা স্বপ্ন আসতে পারে, তবে ঠিক স্বপ্ন নয় যেন ভাবনা । কোন লোককে এসময় জাগিয়ে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সে বলবে , ' স্বপ্ন দেখছিলাম না , একটু ভাবছিলাম ! ' 
তৃতীয় NREM স্তরটি গভীর নিদ্রার স্তর । এই সময় রক্তচাপ আরো কমে যায় । নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নির্দিষ্ট ছন্দ অনুসরণ করে চলতে থাকে শরীরের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায় , হজম ও বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় হরমোনগুলি নিঃসরণ হতে থাকে । বাইরের জগতের সঙ্গে চেতনার সংযোগ সবচেয়ে কম থাকে এ ঘুম দশায় । Sleep Walking , বাচ্চাদের বিছানা ভিজানো , nightmare দেখা এসব অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার স্যাপার এই সময়ই ঘটে ।

           একদম শেষ স্তর হলো REM ঘুম বা চোখ নড়া ঘুম । চোখ নড়া ঘুমে যেন শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও পেশী অবশ হয়ে যায় । নিঃশ্বাস অনিয়মিত হয় , হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ আগের অবস্থা থেকে বেড়ে ওঠে । আর এ সময়ই স্বপ্নসমূহ আসে । পরীক্ষায় দেখা যায় আশি শতাংশ স্বপ্নই REM স্তরের । এই স্বপ্নসমূহ অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের এপিসোডিক মেমোরি বা জীবনকাহিনীর সঙ্গে যুক্ত স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত । সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাও এর বিষয়বস্তু ।

           REM ঘুম এর সঙ্গে সৃজনশীলতার সম্পর্ক রয়েছে । REM ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে উঠলে মানবমস্তিস্ক hyperassociative হয়ে ওঠে , ফলতঃ শব্দের সঙ্গে শব্দের সম্পর্ককরণ , সমস্যামূলক কাজের সমাধান , শব্দকে বিভিন্ন ফর্ম এ পুনর্বিন্যাস তার কাছে সহজ হয় । নিদ্রার প্রায় নব্বই মিনিট অতিবাহিত না হলে REM ঘুমে উপনীত হওয়া যায় না । যত বয়স বাড়ে , REM ঘুম কমে যায় । তাই বাচ্চারাই বেশি স্বপ্ন দেখে ! 
      কোন কোন মনোবিদ বলেছেন গভীর ঘুম চেতনাহীন । আবার অন্যদল বলেন স্বপ্নহীন ঘুমের মধ্যেও চেতনা অবলুপ্ত হয় না । তাঁরা বলেন , আসলে চেতনা কখনোই অবলুপ্ত হয় না । তার অবস্থার পরিবর্তন হয় মাত্র । গভীর ঘুমে চেতনা মূলতঃ তিনটি অবস্থানের যে কোন একটিতে থাকতে পারে :
১) কোন অনুভূতিহীন , নিমজ্জনহীন হাল্কা চিন্তাস্রোতের ও অভিজ্ঞতা স্রোতের মধ্য দিয়ে ভেসে চলা । 
২)শারীরিক সংবেদন বা প্রত্যক্ষণসমূহের অভিজ্ঞতা অর্জন -সেটা অভ্যন্তরীন বা বাহ্যিক দুইই হতে পারে । যেমন ঘুমের মধ্যেও অ্যালার্ম বেজে উঠলে সেই শব্দ শুনতে পাওয়া । 
৩) স্বপ্নহীন গভীর ঘুম , তবুও তার সঙ্গে এই চেতন অভিজ্ঞতা (awareness) যে ' আমি এখন নিদ্রামগ্ন ' আছি । 

         সোমনামবিউলিজ্ম বা sleep walking এর ক্ষেত্রে সাধারনতঃ আমরা বলে থাকি , ব্যক্তি চেতনাহীন ছিল । যদি এ অবস্থায় সে কোন অপরাধ করে ( হরর ফিল্মে যেমন দেখা যায় ) তবে মনে করা হয় সম্পূর্ণ অচেতন ভাবে সে কাজটি করেছে । কিন্তু এই ' সম্পূর্ণ অচেতন ' কথাটার মধ্যে একটা fallacy রয়েছে ! আসলে সেই অবস্থায়ও তার মধ্যে চেতনা সক্রিয় ছিল । আর তা ছিল বলেই সে হাঁটতে পেরেছে , পথঘাট ঠিক রেখে চলাচল করেছে, ভিক্টিমকে চিণ্হায়িত করেছে, অস্ত্র প্রয়োগ করেছে !
 তবে অবশ্যই এই চেতনা জাগ্রত স্বাভাবিক চেতনা নয় । Altered State of Consciousness 

কোন মন্তব্য নেই: