।। সুশান্ত কর ।।
(C)Image:ছবি |
সেদিন শিলচরের এক শিক্ষিকা নিজের দেয়ালে দীর্ঘ গদ্য লিখলেন। বেশ শেয়ার
হয়েছে। লাইকও পড়েছে প্রচুর। তাঁর প্রথম কথাগুলোই ছিল 'ফেসবুক বিপ্লবী'দের
নিন্দে করে। তিনি ধরে নিয়েছেন যারা ফেসবুকে খুব প্রতিবাদটাদ করেন, তারা
সবাই বাইরে কিছুই করেন না। যারা করেন বাইরে, তাদেরও অনেকের ধারণা আছে,
তারাই করেন, আর কেউ কিছু করেন না। তা সেই লেখিকা লিখছিলেন, সেই সব 'বিপ্লবী'দের ফেসবুক লেখাতে বুঝি খুব একটা লাইক টাইক পড়ে না। শেয়ার টেয়ার
হয় না। তাঁর নিজের দেয়ালে প্রচুর সাহিত্য শিল্প থাকে। যেন পরিপূর্ণ
ম্যাগাজিন। তা তিনি প্রতিবাদটাদ করেন না। দেশে যখন লোকে না খেতে পেয়ে মারা
যাচ্ছে, তিনি তখন নিজের কুকুরের জন্মদিন পালন করে,কেক কেটে ফেসবুকে ছবি
দিয়ে পশুপ্রেমও দেখাতে পারেন। সেদিক থেকে নিজের কাছে সৎ। কিন্তু আমি
ভাবছিলাম অন্য কথা। আমাদেরও তবে সেরকম অসংবেদনশীল হওয়া দরকার? যাতে প্রচুর
লাইক শেয়ার মেলে? অর্ণব গোস্বামীর খুব টি আর পি। আই টি সেলের যে কোনো
পোষ্ট খুব ভাইরাল হয়---তাহলে ভক্ত হওয়াই মঙ্গল। কিছু দিন আগে দীপিকা
পড়োকনের "ছপাক' ছবি সওদা ভালো করেনি, অজয় দেবগণের 'তানহাজি' করেছে। তা
হলে ধরে নিতে হয় 'ছপাক' বাজে ছবি ছিল। এই মাত্র আমার দেয়ালে রাহুল বিশ্বদ্বীপ ভট্টাচার্য
একটি পোষ্ট করে জানালেন, দশ বছর ধরে গাইছেন কৃষ্ণকলি ইসলাম। অথচ চিনতেন
না। আমি নিশ্চিত শিলচরের সেই শিক্ষিকাও চেনেন না। তাহলে কৃষ্ণকলি মন্দ গান
করেন। তাঁর থেকে বহু ভালো শিল্পী সম্প্রতি ভাইরাল নন্দী বোনেদের গান। কী
বলেন? সেদিন দেবলীনা সেনগুপ্তর
একটি গল্প পড়লাম। এক লেখক লকডাউনে ভাবলেন, সবাই গল্প লিখে লাইক পাচ্ছে
ভেবে নিজেও ভাবলেন লিখে ফেলবেন... এটা সেই চরিত্রের কথা--- দেবলীনাদির না।
লেখকটিকে তিনি "বিপ্লবী' বলুন, দেশদ্রোহী বলুন---সেরকম করেই এঁকেছেন। এবং
এমন লোকেরও অভাব নেই---কথাটা আমাকে ভাবাচ্ছিল। সত্যিকার অর্থে 'ফেসবুক
বিপ্লবী' বা "ফেসবুক লেখক চরিত্র' এরা। লাইক শেয়ার দেখে মান মাপেন। এই মোহে
আজকাল ফেসবুকে হোয়াটস এপে বহুজন সক্রিয়। অনেকেই এতে বিরক্ত। আমি সেই দলেও
নেই। আমি ভাবি, আন্তর্জাল এই সুযোগ করে দিয়েছে। সব্বাইকে লেখক বানিয়ে
দিচ্ছে। যার লেখক শিল্পী হবার স্বপ্ন নেই---তিনিও দিনে পড়েন কম,লেখেন
বেশি। এর ভালো দিক আছে। লেখা পড়ার থেকে সব সময়েই অগ্রপদক্ষেপ।বুদ্ধির
বিকাশে এর ভালো অবদান দেখতে আমাদের আরেক দশক লাগবে। আমি এই সবকে হতাশ করি
না। আমি বিশ্বাস করি বড় বটগাছকে কেউ আদর করে বাড়ির ব্যলকনিতে সাজায়
না---মানে লাইক শেয়ার করে না। কোথাও গাছ গজালে ছেঁটে ফেলে। কিন্তু বট গাছ
তো দরকার। আর বটগাছ সেখানেই সম্ভব যেখানে তৃণগুল্ম প্রচুর গজায়---যেগুলো
খুব লাইক শেয়ার করা যায়। ফলে এই সব চলুক। জমি তৈরি হোক। সম্প্রতি যেমন
লাইভের 'আমফান' ছুটছে। এও ভালো। প্রযুক্তিকে যারা এড়িয়ে যেতেন তারাই বেশি
সক্রিয় হয়েছেন। এই সেদিন যিনি ঘোষণা দিলেন, ফেসবুক থেকে গেলাম! সেরকম
ব্যক্তিও দেখছি, লাইভ সংগঠিত করছেন। তিনি করছেন না। তাঁকে দিয়ে পরিস্থিতি
করাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মানুষ পরিস্থিতির দাস নন। মানুষ পরিস্থিতির
প্রভুও। নিজের দেয়ালে বা গোষ্ঠীতে গুটিয়ে থাকলে আপনি করছেন বটে লাইক
শেয়ারের জন্যে---আমরা ছোট বৃত্তের বাইরে তা ছড়াচ্ছে না। না স্থানে, না
কালে। এমনিতেও আন্তর্জালের কাল ভ্রমণ নিয়ে একটি সমস্যা আছে। তবু কিছু জায়গা
আছে কাল ভ্রমণ বেশি করবার ক্ষমতা রাখে স্থানের সঙ্গেও। যেমন ফেসবুকে ভিডিও
করবার চাইতে ইউট্যুবে করা বা সেখানে রাখা ভালো। ফেসবুকে লেখার চাইতে ব্লগে
লেখা ভালো... দশ বছর পরেও পাঠক দর্শক সহজে পেতে পারেন। সেই জন্যে দেখুন
অসমিয়া নতুন অনুবাদ গোষ্ঠী তাদের একটি ব্লগও করে ফেলেছেন। এই সব অনেকে
ভাবেন না। আপনি যে ভিড়ের মধ্যে বিশ্বভ্রমণ করছেন বলে কল্পনা করছেন, কিন্তু
আসলে ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছেন---সেই ভাবনা আছে কি? ফলে আমার বলবার কথা অতি
সামান্য--- পূর্বোত্তরের যারাই যেখানে লিখুন, অন্তত ঈশানেও আসুন। নিয়েও
আসুন। নিজেও অন্যের ভালো জিনিস শেয়ার করুন। আর বাকি বাংলার কাছে যেতে হলে
আমি বলব, একটি ভালো গোষ্ঠী আছে গুরুচণ্ডালী---আপনারাও সেরম কিছু ভেবে নিন।
তাহলে কী হবে --- হাওয়া চলাচল বাড়বে। ব্যলকনি থেকে নেমে কখন বোটানিক্যাল
গার্ডেনে ঢুকে গেছেন টেরও পাবেন না। সামান্য লাইক শেয়ারের মদের নেশাতে
সীমাবদ্ধ থাকলে সম্ভবত আপনার ক্ষতি কিছু হচ্ছে না, সামুহিক লাভ কিছুও হচ্ছে
না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন