॥ অর্পিতা আচার্য ॥
১৯৪০ সালের ৩রা নভেম্বর অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়ারাঙ্গাল জেলায় তিনি জন্ম নেন । একটি ছোট্ট গ্রাম পেণ্ডিওয়ালায়। তেলেগু সাহিত্যের প্রখ্যাত সমালোচক , কবি সাংবাদিক ও নাগরিক অধিকার কর্মী ভারভারা রাও। ১৯৫৭ সাল থেকে কবিতা লিখছেন । প্রথম কবিতার বই ১৯৬৮ সালে প্রকাশ হয়, নাম 'চালি নেগালু ' (ক্যাম্প ফায়ার) । অর্ধ শতক ধরে লিখে গেছেন কবিতা । শেষ বই 'বীজ ভূমি' বেরোয় ২০১৪ সালে। তেলেগু ভাষার প্রখ্যাত পত্রিকা 'স্রুজন'এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক তিনি। দীর্ঘ দিন ধরে কারান্তরীণ এই কবি গত ২৯শে মে অসুস্থ হয়ে অচেতন হয়ে পড়লে তাকে মুম্বাইয়ের জে জে হসপিটালে স্থানান্তরিত করা হয় । গত পয়লা জুন একটু সুস্থ হয়ে উঠলে এই অশীতিপর কবিকে পুনরায় নবি মুম্বাইয়ের তালোজা সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয় । কোভিড নাইনটিন এর এই প্রকোপের সময় তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবার ,বারবারই আবেদন জানাচ্ছেন মুক্তির । বিষয়টি আদালত বিবেচ্য।
(C)Image-ছবি |
কে. বালাগোপাল অনূদিত 'The Butcher ' কবিতাটির বক্তব্য এক কসাইয়ের । প্রতিদিন মাংস কেটে ও রক্ত স্পর্শ করেও যার হৃদয় আন্দোলিত হয় নি, রাষ্ট্র যন্ত্রের অত্যাচারে এক তরুণের একতাল মাংসপিণ্ডে পরিণত হওয়া দেহকে দেখে তার হৃদয় সংকুচিত হয়ে উঠেছিল ঘৃণায় ।
'আমার এই হাত দিয়ে রোজ পশু হত্যা করি
রক্ত আমার হৃদয়কে স্পর্শ করেনি কোনদিন
কিন্তু সেই দিন রক্ত রাজপথে গড়িয়ে পড়ে নি
পড়েছিল আমার হৃদপিণ্ডে
তুমি কি ধুয়ে দেবে সেই রক্ত'
বারবার রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি । বিপ্লব , আন্দোলন আর প্রতিবাদের আগুনে বারে বারে জ্বলে উঠেছে তাঁর কবিতা । পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন অগ্নিস্রাবী।
"পুলিশের হাতে ধরা বন্দুকগুলো জনগণকে রক্ষার জন্য নয়
বরং তাদের ধরে নিয়ে গুলি করবার জন্যে
অন্ধের সাদা ছড়ি
পুলিশকে লাঠি চার্জের ফন্দি আঁটতে শেখায়
শেখায় না তাদের পথ দেখাবার রাস্তা "
আজ যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নে পুলিশী নির্যাতনে সারা পৃথিবীতেই অসংখ্য মানুষ আহত বিধ্বস্ত , তখন এসব কবিতা বারবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে । সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকায় ঘটে যাওয়া পুলিশি নির্যাতনের ভয়ঙ্কর চিত্র ভাইরাল হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে । ভারভারা রাওয়ের কবিতার ঘৃণিত চিৎকার যেন সত্য হয়ে উঠেছে অসহায় মানুষের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর হয়ে ।
আসলে কবিতা ভারভারার কাছে আত্মপরিচয় স্থাপনের সোপান নয়, কবিতা তাঁর কাছে অস্ত্র । গণ আন্দোলনের হাতিয়ার । কবিতা তাঁর কাছে রোম্যান্টিকতার মোহময় গন্ধপুষ্প নয় , পচে যাওয়া সমাজকে ফালফালা করে দেওয়া ক্ষুর । তাঁর নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল বিপ্লবী লেখক সংগঠন 'বিপ্লব রচয়িতলা সংঘম' আর কবিদের সংগঠন 'থিরুগুবাতু কাভুলু' । আবার একই সঙ্গে তথাকথিত বিপ্লবী কবিদের মতো অন্দর মহলের সুখ শয্যায় বসে জ্বালাময়ী কবিতার ভাষণে আবদ্ধ থাকা এ কবির স্বভাব ছিলো না । সারা অন্ধ্র প্রদেশের আনাচে কানাচে নিজের আদর্শকে রূপায়নের জন্য পরিভ্রমণ করেছেন তিনি । মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আদর্শে কবিতা লিখেছেন,
'মানুষের মৃত্যু আমাকে বিচলিত করে
হয়তো বলবে সে তো অমর হল
তারা হয়ে ফুটবে
তবু মানুষের মৃত্যুর অর্থ তো মনুষ্যত্বেরও দুর্দশা'
তথাকথিত ছদ্ম বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে তীব্র পরিহাস ছুঁড়ে দিয়েছেন তিনি তাঁর 'মেধা ' কবিতায় । বিপ্লবের নামে যারা ঠাণ্ডা ঘরে বসে ' সৃষ্টিশীল ভাবে রূপক মিছিল ' সাজায় , যারা 'ধনীদের বিয়েশাদিওয়ালা বাড়িগুলিতে' জেলখানায় কাটায়, যারা সাংবাদিক বৈঠকে জেল ভরার ডাক দেয় অথচ প্রকৃত শোষিতদের ছিটকে দেয় পূতিগন্ধময় নরকে, তাঁদের বিদ্রূপ করে তিনি লিখেছেন,
' আমরা জন্মাই
মৃত্যুতে বিলীন হয়ে যাই
দারিদ্রে, দারিদ্রের কারণে
তুমি অবতীর্ণ হও
ধর্মের সংকটে
কাজ শেষ হলে
ত্যাগ কর অপ্রয়োজনীয় অবতার
তুমি তো সেই সূত্রধার
তুমি ভাগ্যবান
তুমি মেধার আকর '
জেলে বসে অনুবাদ করেছেন কেনিয়ার সাহিত্যিক নগুগি ওয়াথিংগোর লেখা 'উপন্যাস ডেভিল অন দ্য ক্রস ' ও ' জেল ডায়েরি ডিটেইনড ' । নিজের কারাবাস জীবনের 'রোজনামচা ক্যাপটিভ ইমাজিনেশান'(সহচরলু) লিখেছেন জেলে বসেই ।
জীবনের দীর্ঘ সময়ই তো তাঁর অতিবাহিত হয়েছে জেলে। কিন্তু এর মধ্যেও কখনো চির খায়নি আত্মবিশ্বাসে । নিজস্ব আদর্শে অবিচল কবি সবসময়ই স্বপ্ন দেখে গেছেন আগত সকালের । ক্ষুধা দগ্ধ অসভ্য দেশ পেরিয়ে কোন একদিন থৈ থৈ সকালে উপনীত হবে পৃথিবী, এই স্বপ্ন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি তাকে তাঁর বাস্তব জীবনের সংগ্রাম । তাই লিখেছেন:
'যে দীর্ঘ সেতু পার হয়ে
তুমি হেটে চলেছো
আসলে তা একটা বাঁকা তলোয়ার
শুরুটা যার এই ক্ষুধা দগ্ধ অসভ্য দেশ
শেষটা যত দূরই হোক
ওই নির্ভার থৈ থৈ সকালের দিকে'
(শুধু সামনে পিছনে কিছু নেই, অনুবাদ: সুজিত দাশ)
তাঁর কবিতার মান কবিতা উত্তীর্ণতাকে ছুঁতে পেরেছে কিনা, এ নিয়ে প্রশ্ন যে ছিলো না বা নেই তা নয় । আসলে কাব্য নির্মিতির ছক বাঁধা পথে হাঁটেননি তিনি । কবিতাকে সব সময়ই দেখেছেন এক হাতিয়ার হিসাবে , সংগ্রামের হাতিয়ার, যুদ্ধের শস্ত্র । নির্মেদ ধারালো অস্ত্রের মতো সে সব কবিতা তথাকথিত অর্থে কবিতা না হয়ে ভাষ্য হয়ে উঠেছে মাঝে মাঝেই । এখানেই তাঁর কবিতার উত্তরণও । নিছক কাব্যের বাইরে এসব কবিতা হয়ে উঠেছে আক্রমণের ধারালো তির, বিদ্রূপের উচ্চ হাস্য বা অগ্নি স্ফুলিঙ্গ ।
কবি বিভাস রায়চৌধুরী তার কবিতায় ভারভারা রাওকে নিয়ে লিখেছেন :
' ভার ভারা , আপনার কবিতা পড়েছি
কবিতা কোথায়? দূর!
রাজনীতি করেছেন শুধু !
জঙ্গলে জঙ্গলে অস্ত্রে 'হ্যাঁ' বলা কি ঠিক?
কবি নন , কবি নন ...সাচ্চা দেশদ্রোহী...
এক কথায় কবির অধিক!'
তাই, এককথায় তিনি ' কবির অধিক ' । তাঁর কবিতা তাই কবিতার কিছু বেশি , এক চারণ কবির গান , যে কবি শ্বাস ফেলছেন জনতার মাঝখানে । তাঁর কবিতার অনুবাদ করেছেন কবি শঙ্খ ঘোষ । এই অনুবাদের অংশ বিশেষ দিয়ে শেষ করব এই লেখা :
'গান যখন হয়ে ওঠে যুদ্ধেরই শস্ত্র
কবিকে তখন ভয় পায় ওরা
কয়েদ করে তাকে , আর
গর্দানে আরো শক্তি করে জড়িয়ে দেয় দাস
কিন্তু তারই মধ্যে কবি তার সুর নিয়ে
শ্বাস ফেলছেন জনতার মাঝখানে'
আরো বেশি দেরি হওয়ার আগে - এ গান ছড়িয়ে পড়ুক পৃথিবীর জেগে থাকা মানবতার যাত্রাপথে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন