স্কুলে ২০১৭র জানুয়ারিতে |
৮ মার্চ, ২০২০ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ‘বর্ণালি শিশু কল্যাণ সংস্থা, তিনসুকিয়া’র আমন্ত্রণে গিয়ে সংস্থার ৩৮ তম প্রতিষ্ঠা দিনে পৌষালি গাইল ‘চিৎকার কর মেয়ে’ , এই সুবিখ্যাত গানটি ! তো আমিও বলছিলাম পৌষালি করের কথা । উজান অসমের একেবারে প্রান্তীয় শহর তিনসুকিয়াতে বিগত কয়েক বছর ধরে সাহিত্য শিল্প সঙ্গীত এসব চর্চার একটি নিয়মিত বহমানতা এসেছে , যদিও একে স্রোত বা উচ্ছ্বাস বলা চলে না সে অর্থে ! এর কারণ অবশ্যই বহুমুখী । বাণিজ্য প্রধান সমাজ, প্রকৃত অর্থে অল্প-সংখ্যক সচেতন ব্যক্তি, রাজনৈতিক উদাসীনতা, নিজস্ব ভাষাশিক্ষার দুর্বল পরিকাঠামো, সাম্প্রদায়িক সমস্যা ইত্যাদি এই শহরকে মাখামাখি ভাবে জড়িয়ে রেখেছে । তো এই অবস্থায় গান বাজনা তো হয়, কবিতা লেখাও যায়, নাটক মঞ্চস্থ হয় , আবৃত্তি আওড়ানোও চলে ; যতক্ষণ না সেই গান মানুষের অন্তরমহলে সুচের মতো আঘাত হানে, যতক্ষণ না সেই কবিতা পড়ে অনেকের ভ্রূ কুঁচকে আসে দেশদ্রোহিতার সন্দেহে, যতক্ষণ সেই নাটক সমাজ ব্যবস্থার নগ্ন রূপকে মঞ্চে আছড়ে ফেলে অনেকের বিরাগভাজন না হয়, যতক্ষণ না সেই আবৃত্তি কানের অলিগলিতে গলিত সীসার মতো ঢেলে দিতে থাকে সত্য ও সংগ্রামের শাশ্বত বাণী ! পৌষালি কর শহর তিনসুকিয়ায় এক ব্যতিক্রমী শিল্পীর মতো মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে ! ওর গানে, আবৃত্তিতে , আঁকায় ছড়িয়ে রয়েছে সেই বহুমুখী শিল্প প্রতিভা যা মানুষকে ভাবায়, নতুনকে আলিঙ্গন করে নেবার শিক্ষা দেয় ! যুগ পাল্টাচ্ছে দ্রুত । সেই সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে সাহিত্য সংস্কৃতি সঙ্গীত এসবের আঙ্গিক । এসেছে নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা ! এবং সমস্যাটা ঠিক এখানেই ! পুরাতন অনেকেই একে সাদরে, সদরে নিতে পারেননি বা পারছেন না ! ফলে দুখঃজনকভাবে তারা ছিটকে যাচ্ছেন আধুনিক পরিমণ্ডল থেকে।
একটা উদাহরণ দি । গায়কের কাজ কি? গান গেয়ে পয়সা উপার্জন করা , না সেই সঙ্গে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা রেখে জনসচেতনতা বাড়ানোতে সঙ্গীতকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা ? এই দুটো দিক একসঙ্গে থাকলেই তাঁকে প্রকৃত শিল্পী বলা চলে। সেজন্যই জোন বেজ, বব ডিলান, হ্যারি বেলাফন্ট, ভূপেন হাজরিকা, কবির সুমনরা আন্তর্জাতিক স্তরে শিল্পীর সম্মান ও স্বীকৃতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পেয়েছেন অসংখ্য জনতার মরমী হৃদয় আসনটি , যেখানে তাঁদের অবস্থান চিরকালীন হয়ে থাকবে ।
ঠিক তেমনি বহু আবৃত্তিকার ঠাণ্ডা নরম প্রেম পিরিতির ও প্রকৃতি বর্ণনার কুসুম কোমল পথে গলার সুধা ঢেলে পুরো ক্যারিয়ার যাপন করেছেন, শোনাননি সবহারাদের, দুর্গতদের ও শোষিতদের আর্তি তার আবৃত্তিতে ! তো এরাও শিল্পী , তবে ইতর ভাষায় আলুভাতে মার্কা !
২০শে মে, ২০১৮ শিলচর রেলস্টেশনে |
এই তো বিগত দীপাবলির সন্ধ্যায় হিজুগুড়িতে পৌষালি গাইল ‘কী ঘর বানাইমু আমি’ এই হাছনের গান ! ‘সে জানে আর আমি জানি’ এই লালনের গানটিও ! আয়োজক ছিল প্রগতি গোষ্ঠী !
২০১৭র জানুয়ারিতে স্কুলে |
২১শে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পৌষালিকে আবৃত্তি করতে শুনি অসম ও উত্তর পূর্বের বাংলা ও বাঙালির সবহারানোদের কথা তুলে ধরা কবি শিলচরের শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর বিখ্যাত কবিতা ‘উদ্বাস্তুর ডায়েরি’, অথবা ডিব্রুগড়ের কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাসের কবিতা ।
তিনসুকিয়াতে এসব গান বেশির ভাগ শিল্পীরা গান না, আবৃত্তিকারেরা করেন না । সুতরাং বোম্বাইয়া আমের মতো হিন্দি গান ছাড়া যে আমাদের শেকড়ের বাংলা গান আছে , আছে বিশ্বজনীন শ্রেণিহীন শোষিতদের কান্না, বাস্তুহারার মাটির প্রেমের গান, এসবের সঙ্গে এই ছোট শহরের শ্রোতা পরিচিত হচ্ছিলেন না, থেকে যাচ্ছিলেন ব্রাত্য । এই কাঁচা বয়েসে পৌষালি সেই দায়িত্বটুকু পালন করে প্রকৃত শিল্পী সচেতনতার পরিচয় দিচ্ছে । প্রসঙ্গত উল্লেখ করি ইংরেজি মাধ্যমেই কিন্তু পড়াশুনা পৌষালির । সুতরাং যেমন বলেছিলাম শুরুতে, প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে কিন্তু তা প্রকৃত শিল্পীর গতিকে প্রতিহত করে না ।
যারা পৌষালিকে চেনেন না , শোনেন নি তাঁদের জন্য আন্তর্জালে সক্রিয় মেয়েটির সূত্র নিচে দিয়ে ওর ইউট্যুব, ব্লগ ইত্যাদিতে যাবার পথ বাতলে রাখলাম। ঘুরে আসুন, ভালো লাগবে !
সকল শহরবাসীর পক্ষ থেকে এই নাগরিক শিল্পীর নিজের, ওর অভিভাবকের, শিক্ষকদের শুভ কামনা জানাই । এগিয়ে চলো মেয়ে !
https://www.youtube.com/c/MusicalDiariesPoushali
https://poushalikar.blogspot.com
https://www.facebook.com/poushali.kar.75
পৌষালির ভিডিওগুচ্ছ ০১
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন