“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ৭ জুন, ২০২০

সম্ভাবনা-র শনবিল



।। পার্থঙ্কর চৌধুরী ।।

এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম বিল, শনবিল বরাকবাসীর অনেকের কাছেই এ তথ্য অজানা যেমনটা অজানা বাওয়া বিলবা বরাক নদীর বুকে থাকাখৈরাকপা-ইরেলনামের ক্ষুদ্রতম নদী দ্বীপ দীপর-বিলবা মণিপুরের  ‘লোকতাক’-এর নাম যেভাবে মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়, তাদের বিপরীতে বাওয়া বিল’-এর নাম কজন জানেন? বরাক উপত্যকার কোথায় রয়েছে বলতে পারবেন? পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম নদী-দ্বীপ সবাই জানেন, উমানন্দ তার চাইতেও ক্ষুদ্র নদী-দ্বীপ যে এই বরাকের বুকেই রয়েছে, সেটা কি কোনদিন প্রচারের আলো  পেয়েছে?
আমাজন অরন্যের দাবানল নিঃসন্দেহে অনভিপ্রেত কিন্তু এ নিয়ে তাবড় তাবড় বিজ্ঞ-জনের হোয়াটস-এপ আর মুখবই-এ আক্ষেপ আর দুঃখের বহিরপ্রকাশের মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষনের প্রতি আন্তরিকতা কতটুকু রয়েছে, সেটা যথারীতি গবেষণা  না করে বলা অসম্ভব কথাগুলো প্রাসঙ্গিক এই কারনেই যে, অনাদরে আর অবহেলায় উজাড় হয়ে যেতে বসা উপত্যকার বনজ সম্পদের প্রতি আমাদের সংবেদনশীলতা অনেক টা মৎস্যের মায়ের পুত্রশোকের মতই !
চারপাশের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি বিশাল প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন অনেক মানবিক প্রতিভাই প্রায়শঃই দেখা যায় বিকাশের অভাবে অন্ধকারের গেঁড়াকলে পড়ে থিতিয়ে যেতে ! উত্তর পূর্বের অনান্য জলভুমির মত শনবিল ঐ ভাবে প্রচারের আলোয় আসে নি! রামকৃষ্ণনগর হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে চাকরি করার সুবাদে বর্তমানের আসাম বিস্ববিদ্যালয়ের জীব-বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডঃ দেবাশিস কর প্রায় চার দশক আগে শনবিলের মাছ ও মৎস্যজীবীদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে গবেষণা করে পি এইচ ডি ডিগ্রী পেয়েছিলেন, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রামকৃষ্ণনগরে বসতবাড়ি থাকার সুবাদে ঐ বিভাগেরই অপর এক শিক্ষক, অধ্যাপক মানবেন্দ্র দত্ত চৌধুরী শনবিল এলাকার সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট চেষ্টাচরিত্র করেছিলেন যদিও, তৎকালীন সরকারের ঔদাসিন্যতায় সে প্রচেষ্টা দু দশক ধরে ফাইল চাপাই থেকে গেছে !
সিংলা নদী শনবিলবাসীদের কাছে আশীর্বাদ এবং অভিশাপ, দুটোই এই নদী বৃষ্টির মরশুমে  গোটা মিজোরামের পাহাড়ি এলাকা থেকে জল এই সিংলা নদীর অববাহিকা দিয়ে এসে পড়ে শনবিলকে স্ফীত করে তোলে বিশাল পরিমান এই জলরাশির বেরিয়ে যাওয়ার একটাই পথ, কচুয়া নামক সরু একটা নদী, যার জল শোষে নেওয়ার ক্ষমতা সীমিত ফলে ফি বছর বর্ষাকালে শনবিল ফুলে ফেঁপে ওঠে ভ্রমনপিপাসুদের আগমনের জন্য তাই বর্ষাকালটাই মোক্ষম সময় মে থেকে জুলাই-আগস্ট মাস
এ বছর গ্রীষ্মের এক দুপরে (৩রা আগস্ট, ২০১৯) বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, জৈব-প্রযুক্তি এবং জীবাণু-বিজ্ঞান বিভাগের প্রায় শখানেক শিক্ষক-গবেষক- ছাত্রছাত্রী মিলেল্যাব-টু-ল্যান্ডঅর্থাৎ সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের হাল-হকিকত  অনুধাবন করার উদ্দেশ্যে একদিনের সফরে হাজির হয়েছিলাম স্থানিয়দের সঙ্গে কথা বলে তাদের রোজনামচার দুঃখের পাঁচালী শুনে সত্যি সত্যিই করুণ অনুভুতি জেগে উঠে দশকের পর দশক ধরে শনবিলবাসীরা যে স্বপ্নের ফেরিওয়ালার অপেক্ষায়, সেই ফেরিওয়ালার দেখা আজ অবধি মেলে নি! ইতিমধ্যে যদিও একদিকে ইতিহাসের অনেক পালাবদল হয়েছে আর হচ্ছে, আর ওদিকে, বছরের পর বছর  গোটা মিজোরাম থেকে ধেয়ে আসা পলিমাটি দিয়ে শনবিলের বুক দ্রুত ভরাট হচ্ছে!
এবারের সফরে গিয়ে একটা খবর পেয়ে মনটা বিষণ্ণ হয়ে  উঠল শীতের মরশুমে  সাময়িককালের  জন্য প্রচুর রকমের পরিযায়ী পাখি এই শনবিলে এসে কাটায় একাংশ দুষ্ট চক্র বিশাল জাল পেতে এই পাখিদের শিকার করে উদ্দেশ্য একটাই, ‘বুশ-মিট আশপাশের স্থায়ী বাসিন্দা এবং বরাক উপত্যকার কমিশনার তথা বিখ্যাত সংরক্ষণবিদ ডঃ আনোয়ার উদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে জানা গেল, বেশ কয়েক বার এদের বিরুদ্ধে তিনি পদক্ষেপ নিয়েছেন, কিন্তু আড়ালে আবডালে প্রতি বছরই ঐ দুষ্ট চক্র তা করে আসছে
বিস্তর এলাকা নিয়ে শনবিল-রাতাবিল এলাকা নগেন্দ্রনগর, গোপিকানগর, অর্জুননগর, ভৈরবনগর, বসন্তপুর, শান্তিপুর, শ্রীরামপুর, বাংলাটিল্লা, শৈল নগর, বাগান টিল্লা, ফাকুয়া ছাড়াও আশে পাশের অনেক গ্রাম রয়েছে এই শনবিল এলাকা ঘিরে  দীর্ঘদিন থেকে এলাকায় বাস করে আসছেন যদিও  কিন্তু এলাকার বাসিন্দাদের অধিকাংশদেরই বাস সরকারি জমির উপর ভোটার তালিকায় নাম থাকলেও নিজেদের নামে দাগ-পাট্টা অধিকাংশেরই নেই যে কোনও মুহূর্তে সরকারি উচ্ছেদের শিকার হওয়ার আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না! গোটা এলাকায় বসবাসকারীদের অধিকাংশই কৈবর্ত মৎস্যজীবী শনবিলবাসীদের জীবিকা দুরকমের, এবং তা মরশুম নির্ভর বর্ষা আসার আগে আগে বোরো ধানের চাষ, এবং বর্ষার পরপরই মাছ ধরা অনেক বছর এরকমও হয়, ক্ষেত ভর্তি পাকা সোনালি ধান, যাওয়ায় কথা ছিল, কৃষকের গোলায়, সিংলা নদীর বদান্যতায় পড়ে থাকে বিশ বাঁও জলের তলায়! স্থানিয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এ বছর বৃষ্টি কম হওয়ার দরুন মাছ কম মেলছে   অন্যান্য বছর এ মরশুমে শনবিলের মাছ স্থানীয় বাজারে বিপুল চাহিদার যোগান দেয়, কিন্তু এ বছর তা হচ্ছে না ওদের একজন বললেন, যেভাবে কাঠফাটা রোদ ঝরছে, তাতে আশঙ্কা করছেন যে কার্ত্তিক মাসের আগেই গোটা বিলটা শুকিয়ে খাঁ খাঁ হয়ে যাবে 
মোকাম কালীবাড়ি শনবিলের মাঝে থাকা বেশ পুরনো যৌথ-ধর্মস্থান দুটি ধর্মাবলম্বী লোকেদের সহাবস্থানে গড়ে ওঠা অপূর্ব প্রতীকী পীঠস্থান বছর কয়েক আগে করিমগঞ্জ জেলাশাসকের উদ্যোগে বেশ সুন্দর একটি অতিথিশালা নির্মিত হয়েছে ছোট খাট ভ্রমন পিপাসুর যে কোনও দলের অনায়াসে দু-চার নিশি যাপনের সুবন্দোবস্ত সেখানে করা রয়েছে  তবে সাথে করে খাবার এবং আনুসঙ্গিক সামগ্রী নিয়ে যাওয়াটা আবশ্যক
সংরক্ষনবিদরা প্রচুর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যদিও, কিন্তু সরকারি প্রত্যাহবান এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত এবং অতি শিগগিরই আবশ্যক প্রতি বছর শনবিল থেকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ রাজস্ব পাচ্ছেন কোটি কোটি টাকা সুপরিকল্পিত সরকারি পদক্ষেপে এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন একদিকে যেমন সম্ভব, অন্যদিকে শনবিলের পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাটাকে সার্থক রূপ দেওয়া হলে, সরকারের রাজস্ব যে হাজার গুন বৃদ্ধি পাবে, সেটা হলফ করে বলা যায় সেদিনটার সফরের বিকেলে উপেক্ষিত শনবিলের সূর্যাস্ত ক্যামেরাবন্দি করতে গিয়ে মনে হল সে যেন  উপেক্ষিত!  কেমন যেন এক বিষণ্ণতার প্রতীক বহন করছে !  
সামুহিক প্রচেষ্টায় এই বিষণ্ণতাকে প্রকৃতির বিরল এবং সুন্দরতম রূপের রুপান্তরিকরন প্রক্রিয়া সরকারি পদক্ষেপে অতি সত্বরই হয়ে উঠতে পারে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এমনটা ভাবা কি নিছক অমুলক?  


অধ্যাপক,
বাস্তু  পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগআসাম বিশ্ববিদ্যালয়শিলচর। 
মুঠোফোন - ৯৪৩৫০৭৮২৯৬

1 টি মন্তব্য:

দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য বলেছেন...

পড়ে ভালো লাগলো। অনেক শুনেছি। কখনো যাইনি। শনবিলের অতিথিশালায় থাকার জন্য কোথায় যোগাযোগ করতে হবে লিখে দিলে ভ্রমণপিপাসুরা উপকৃত হতেন।