“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৫

সুরমা গাঙর পানি - ভাটি পর্ব ২

           (দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার দ্বিতীয় অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)                                

  খন মা চলে যায় অনেক দূরে ।
 মাকে কাছে ডাকতে পারে না । সত্যকে কোনো সমঝোতায় আনতে পারে না । খাওয়ার সময় ভাত দে, হাওরের জলে যাওয়ার সময় জাল দে , এছাড়া বাপ কোনো কথা বলে না মার সঙ্গে । রুদ্ধ সম্পর্কের পাথর সরাতে পারে না বৈতল । অপরিচিত অসহায় মার দুঃখে কাতর বৈতলও বাড়ি ছেড়ে চলে যায় অনেক দূর । কাউকে শাস্তি দেওয়ার জন্য হাত নিশপিশ করে তার, মন উচাটন হয় । বাপ নয়, অন্য কিছু, অন্য কাউকে খোঁজে বৈতল । শাস্তি না বিচার , কী চায় অসহায় সন্তান ।
     সম্পর্কের জটিলতায় ডুবতে ডুবতে অসহায় বৈতল ভুসভুসিয়ে আকাশ দেখে । ভাবে, এত সুন্দর , এত বিশাল এই হাওরের জল । এত সুখী চারপাশের সব গাছপালা, জলের স্তরে স্তরে মাছেদের সুখী সংসার । শুধু তার মা আর বাপের মনে কেন এত কষ্ট ?
   মায়ের সঞ্চয় দু-চার পয়সা ছিকির ভিতর নারকেল মালায় থাকে বড়ঘরের মাড়ইলএ । বৈতল ঠালি ভেঙে পয়সা নিয়ে বেরিয়ে যায় যেদিকে দুচোখ যায় ।
 জৈন্তেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে মাথা কোটে । কানা পয়সা দুই পয়সা এক আনা সব সম্বল ছুঁড়ে দেয় বিগ্রহের গায়ে । বলে,
  --- দে মিল করি দে ।
    ধূলায় ধূসর ইজের আর ছিন্ন নিমা পরিহিত  বৈতলকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় পুরোহিত । পাগলার দাম বাড়ির সুখী বৌঝিরা এসেছে যে মানতের ডালা নিয়ে । লালপেড়ে শাড়ির ঘোমটার উপর সাজানো ডালায় চাল ডাল ফল মূল ফুল ও নতুন গামছা কাপড় । সোনালেপা শরীরের গরিমাই আলাদা । পেছনে সিঁদুর মাখিয়ে জবাফুলের মালা পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ম্যাঁ ম্যাঁ ডাকের কালো নধর বলির পাঁঠা । কতদিন পাঁঠা খাসি খায়নি  বৈতল । আড়গড়ার কাছে সিঁদুর টিপে সাজিয়ে রাখা তেল চকচকে রাম – দার চোখ  বৈতলকে ডাকে । এক কোপে নামিয়ে ধড়টা নিয়ে চম্পট দিলে আর ধরে কে তাকে । ছিনা , গর্দান নিয়ে  বৈতলের এত লোভ নেই, মাথার তেলের বড়ায় তেল লাগে কম, মা রাঁধে ও ভাল । তবে মাথার কথায় বৈতলের মাথাও ঘোরে । ব্রাহ্মণের মুণ্ডুটাও তার চাই । কালো রঙের কৈবর্ত বলে তাকে হেনস্থা করবে চাল- কলার পুরোহিত । দেবতার কাছে নিবেদন করতে দেবে না তার মায়ের মনোকষ্ট  । রাগে তার বাচ্চা চোখ দুটো জলজল করে । প্রণামীর থালি থেকে এক খাবলা খুচরো পয়সা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য হাত বাড়ায় । আর তখনই  ‘এই সর’ বলে এক সোনালেপা হাত প্রণামীর থালায় ফেলে তামার দুয়ানি, টং । ক্রোধে   বৈতল তার সিঙি মাছের শরীরে তাকায় আর তাকায় বালিগড়া , দাঁড়কিনার মতো রুপোলি নারীশরীরে , শরীরের আভরণে । কে শিখিয়ে দেয় জানে না, নিপুণ এক ঝটকায় সাদা শরীর থেকে নামিয়ে নেয় এক বিছেহার । পুণ্যার্থী নারীপুরুষ কিছু বুঝে উঠার আগেই  বৈতল পালায় । সোনার হার যতক্ষণ হাতে ততক্ষণ বৈতল ঠিক করতে পারে না সোজা ছুটবে বা এঁকেবেঁকে ছুটবে । তাই, কামিনী – বিলের জলে ঝপাং করে ছুঁড়ে ফেলে বড় বিদ্যায় তার হাতে খড়ির প্রথম রোজগার । শিশু বৈতলের পিছনে লোক ছুটছে বাবুর বাড়ির । বৈতলকে ধরা কি এত সোজা । বৈতল ছোটে সোজা ,  বৈতল ছোটে কোণাকুণি । দৌড়তে দৌড়তে বৈতল দেখে দেখার হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশি । দেয় ঝাঁপ, আর হাওর জলের নাগাল পেলে বৈতল যে হয়ে ওঠে মহাবীর । হয় ভয়ঙ্কর । সাপের মতো ছোবল মারতে পারে তখন মোক্ষম । তাই মনে মনে সর্পপটে মা মনসাকে নম করে  বৈতল । বলে, জয় আই। মা-ও বলে আই, বলে ঠাকুর । বলে,
   --- ঠাকুর আমার বৈতলরে রক্ষা করিও ।
বৈতলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় । বলে,
--- ই পটর ঠাকুর আমরার কুল – দেবতা । আমরার আই । তানে মানিয়া চলিও বাপ । তাইন তুমার লগে লগে আইছইন ই বাড়িত । ছয়ত্রিশ বাংলার গুলাত  তাইন ভাইয়া ভাইয়া আইছইন । এর লাগি রঙ উঠি গেছে ।
    মায়ের বিবরণীমতো বারো বছর বয়সে বৈতল প্রথম ঘরছাড়া হয় ।
বাউরবাগ থেকে ফিরে আসে  বৈতল । আবার যায় । লংলার পিরতলায় গিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে খুব রাগারাগি করে পিরের মাজারে । নিরুত্তর মাজার ছেড়ে আসে মিরতিঙ্গা । বৈতলের মামার বাড়ি । বইয়াখাউরির মতো না মিরতিঙ্গা । মিরতিঙ্গার মাটি শুকনো আর সবুজ । বড় মায়াধারী মিরতিঙ্গার বন টিলা ঝর্ণা ।  বইয়াখাউরি বার মাস ভিজে । সর্বক্ষণ জল আর জল । মা আছে বলে মায়াও আছে মমতাও আছে । মামা  বৈতলের কথা শুনে হাসে। বলে,
  --- আমরার আদিবাড়ি আরো শুকনা । আমরা আছলাম সিঙ্গুর । সায়েব আইল, চা বাগান বানাইল , আমরারে খেদাই দিল মিরতিঙ্গা । যাইমুনে তরে লইয়া একদিন ।
      মার ছোট, এক মামা বৈতলের । মাটির সরা কলস বানায়, মূর্তি বানায় আর হাটে বাজারে বিক্রি করে । বৈতল মামাকে প্রশ্ন করে ,
   --- অতদূর বিয়া দিলায় কেনে তুমরা । কিতা দেখি । উত্তর থাকি দক্ষিণো । তুমরা কুমার আমরা কৈবর্ত মাছুয়া ।
   --- ইতা আমি জানি না , তর দাদিরে জিগাইছ ।
    মামা এড়িয়ে গেছে । মামা মনসার মূর্তি বানায় , সর্পপট বানিয়ে রাখে , শ্রাবণ মাসে বিক্রি হয় । মাটির কলসি ঘট সরা পাতিল কুজা কলকিও মটকা বানিয়ে রাখে ঝিক্কইর । এছাড়াও পুতুল বানায় ছোট ছোট হাতি ঘোড়া ননীচোরা সুভাষ বোস আর রবি ঠাকুরের । তারের স্প্রিং দিয়ে হুঁকো হাতে বুড়ো বানায় , মুখে তুলোর দাড়ি । হাত দিলেই মাথা নড়ে দাদুর মতো । দাদুর মাথা খারাপ । কিন্তু গাঞ্জা খায় আর মাথা নাড়ে । উদ্ভট উদ্ভট প্রবাদে কথা বলে। বৈতলকে দেখলেই ফোকলা মুখ হাসিতে ভরে যায় । বিচিত্র সম্ভাষণে বলে,
   ---- অউ আইছইন চুংটির বান্দির পুত হুলতান খাঁ । ভালা নি ? যাইরায় গি কই ভকা বেটা ? কেনে ? ছেরাগু দেখিয়া ডরাইরায় নি ? কামড়াইতাম নায় । আও । দিতায় নি একটান চিলিমো ?
    নাতিকে চেনে কি চেনে না বোঝা যায় না । কিন্তু খুশি হয়    বৈতলকে দেখলে । গান গায় মনের সুখে ,
  --- গাইঞ্জা চিরল চিরল পাত । গাইঞ্জা খাইয়া মত্ত হইয়া নাচে ভোলানাথ । নাচ নাচ রে বেটা ভকার জামাই । নাচতে নায় ? দেখবে নে তর কিতা হয় । পাপে বাপরেও ছাড়ে না কই দিলাম ।
   দাদি বৈতলকে দেখলেই কাঁদে । তাই কোনও কথা বলা হয় না । দাদি শুধু সাবধান করে । বলে,
--- মামীর সামনে মামারে কিচ্ছু কইছ না । মামী তো পরর বাড়ির বেটি । কী লাভ কইয়া ?
    দাদির সাবধানবাণীর অর্থ বুঝতে বুঝতে বৈতলের বয়স বাড়ে । বোঝে, তার দুঃখ তারই । কেউ নেই সমব্যথী । তবু মিরতিঙ্গা তার প্রিয় । ওখানে অন্তত তিনটি প্রাণী তাকে আর তার মাকে ভালবাসে । পাগলাদাদু কী সব বুঝেও পাগলামি দিয়ে মেয়ের দুঃখ ঢেকে রাখে। মামীকে বোঝে না বৈতল। মিরতিঙ্গার বাঁশঝাড় কিত্তার জঙ্গল মেঠোপথ সব আলাদা । পিশাচ গাছের গন্ধেও মায়ের শরীর পরশ । দণ্ডকলস দুধফুলের মধুও এখানে মিঠে বেশি । ফুচুক ফুচুক টানতে বেশ । মা বলে,
--- ফুল না দেখিয়া মধু টানিছ না পোকা থাকে ফুলো ।
      বৈতল মাকে নিয়ে গেছে তার টিলারাজ্যে । পাটপাথরে বসিয়ে দেখিয়েছে তার আপন দেশ । সব টিলায় তো আর চা বাগান নেই । জঙ্গলের অনেক গভীরে ঢিবির উপর বসে বৈতল চালায় তার রাজ্যপাট একা একা । অগুনতি পাখ- পাখালি আর তার একান্ত বানরসেনা । বানরের জন্য গ্রাম থেকে কলা আর সফরি চুরি করে আনে । পাখিদের জন্য আনে ধান চাল আর খুদ । সব দেখে মা খুব হাসে । বলে,
--- তর দাদু সব সময়র পাগল আসলা না, গাউর মাইনষে তান কাছে রামায়ণ মহাভারত শুনত । শুনিয়া শুনিয়া আমারও মুখস্ত অই গেছিল । ঠিক অলাখান এক পর্বতো দেখা অইছিল সুগ্রীব আর হনুমানর লগে । ঋষ্যমুখ পর্বত । ইখানো থাকিয়াউ অলা বান্দরসেনা যুগাড় করছিলা তারা । 
                 ‘যুড়িয়া আকাশভুমি কপি ঝাঁকে ঝাঁকে
                  দশ দিনে তথা এল সবে থাকে থাকে ।’
দশদিন থাকা হয় না কখনই । দু তিন দিন রাজ্যপাট চালিয়ে মন ভাল করে আবার ফিরে যায় বৈতল । পাগলার বৈতল পাগলায় ফিরে যায় । বিল হাওয়র আর নদীর গ্রাম বইয়াখাউরি ।
যাওয়ার সময় দাদি দেয় চালপড়া জলপড়া । বৈতল খাইয়ে দেয় মাকে । মার মুখে নীরব হাসি দেখে আনন্দ হয় বৈতলের ।
 বেড়ে ওঠা সন্তানের মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড় করে আই বিষহরীর মন্ত্র জপ করে বৈতলের মা,
--- ‘জয় জয় বিষহরি শিবের কুমারি
     বন্দম চরণে তোমার মাতা পদ্মাবতি ।’
জপশেষে বলে,
--- আর কিচ্ছু চাই না গো ।
  কিছুই চায় না আবার বলে আর কিছু চাই না ।
  বৈতল বোঝে তার মাথায় যেন মায়ের হাত থাকে সর্বদা ।

চলবে
< ভাটি পর্ব ১ পড়ুন                                                                                ভাটি পর্ব ৩ পড়ুন >

কোন মন্তব্য নেই: