“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৫

সুরমা গাঙর পানি --- ভাটি পর্ব ১

  (দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই ইপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসবে। আজ প্রথম অধ্যায় দিয়ে শুরু হলো ---সুব্রতা মজুমদার।)     
                  ভাটি পর্ব ১
 সাপিখুপির ভয়ডর নেই বৈতল ওঝার । মানুষকেও ভয় পায় না বৈতল । শত্রুর মুখোমুখি সে হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর ।

 ছলচাতুরিতেও কম যায় না ।

ইচ্ছাধারী সাপ হয়ে দংশন করতে পারে । ওঝা হয়ে ঝাড়তে পারে ।

বইয়াখাউরির পাটনির পুত বৈতলের জলকেও ভয় নেই । জল দেখলে দুরন্ত হয়ে ওঠে মাছুয়ার পরাণ ।

তখন বাল্যকাল 

বাপ বলে,

--- হেই বৈতল, পানিত লাম ।

নেমে যায় বৈতল অগাধ জলে । জলের অতল থেকে তুলে আনে আধমণি বোয়াল । বাপ দেয় সাবাশ । বলে,

--- অউ না অইলে মাইমলর পুত !

মাছশিকারি বাপকে দুচোখে দেখতে পারে না মা ।

ক্ষণরাগী মানুষটা যখন তখন রাগে । বাপের রাগ যে চণ্ডাল ।

খুনখারাবিও করে । লাশ গুম করে ফেলে দেয় জলের নিচে ।

মাকেও মারে । দগ্ধে দগ্ধে মারে । বলে,

--- মারমু, কিন্তু মারতাম নায় ।

কী যে বলে, কী তার অর্থ শিশুবৈতল কিছুই  বোঝে না ।

ওরা মা বাপ । ওদের নির্যাতন ওরাই বুঝে নেয় ।

আশঙ্কা আর  ভয় মিলিয়ে একটা আতঙ্ক মায়ের মনে ।

বাপের রাগ আর মায়ের ভয়ের মাঝখানে কিছু একটা তো আছে, যা বৈতল বোঝে না । অকথিত বিড়ম্বনার ইতিহাস নিয়ে ওরা ঘাটাঘাটি করে না ।

দুজনে অতীত উদযাপন করে দুরকম ।

একজনের ক্রোধে , অন্যজনের উচাটনে ।

মাঝখানে বৈতল বাড়ে ফনফনিয়ে । বৈতলকে বাড়তে দেখে মা বলে,

--- তুই দেখি কেরাইয়া গাছর লাখান বাড়রে!

   বৈতল রেগে গিয়ে বলে মাকে ,

--- আমি কিতা অত কালা নি ।

‘কেরাইয়ার ইত কালা পিত কালা পাত কালা’ ।

বৈতলের মা আদর করে সংশোধন করে তাকে মূর্তা গাছের সঙ্গে তুলনা করে, --- ‘গাছ কালা তার ধলা ফুল’ ।

 জঙ্গলের পাতালতা খুব চেনে তার মা । পেট খারাপ হলে হেলাইঞ্চার পাতা সেদ্ধ করে দেয় । সুকতানি রাঁধে কাঁচকলা কয়ফল দিয়ে । আইগগাজাল বা রুজন্ট পাতার স্বাদ ও গন্ধ দুটোই থাকে ।

   পেট তো ভাল হয়, মন ভাল হয় না কিছুতেই । শিশু বয়সটাই এমন মেঘলা মেঘলা কাটে বৈতলের ।

   বাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে না বৈতল ।

   বাপকে ভয় করে না । নির্ভয় হওয়ার , ডাকাবুকো হওয়ার পাঠ তো বৈতল বাপের কাছেই পায় ।

মাও যে কখনও অনুযোগ করে না । মা শুধু ভয়ে ভয়ে থাকে । অদ্ভুত বৈপরীত্য । চড়, থাপ্পড়, ছিংলার বাড়িকে ভয় করে না মা । বৈতলের ক্ষীণা জননীর ওসব শরীরসওয়া । দা, কুড়ুল , কুচা, সরিয়ে রাখে চোখের সামনে থেকে । বাপ বোঝে সব । তাই আরো হিংস্র হয় কথায় । বলে,

--- রক্ত বার করতাম নায় , বিনা রক্তে মারমু তরে ।

 বাপের কথার ইশারা বোঝে মা । আরো সিঁটিয়ে যায় বৈতলের দুখিনি আই । মা বাপের এই নিত্যদিনের ঢলানি জিয়ানি আর ভাল লাগে না ।

 বাচ্চা ছেলে বৈতল মাকে জড়িয়ে ধরে । সাহস যোগায় । বলে,

--- বাপ ত তরে আদরও করে বেটি ।

 আদরের কথায়ই হয়ত মায়ের দুর্বল শরীর কাঁপতে থাকে ভর লাগা আই মনসার মতো। কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়ে যায় চুনাপাথরের টিলা ।  বৈতলের মা আর সব পাটনি মাইমলের বৌ- ঝিদের মতো না । মায়ের বরণ কথামালি ফুলের মতো নরম সাদা । মা তাকে তার রং দেয়নি ।

  মা বলেছে জন্মের পর তার রং এমন ছিল না । তার জন্মের আগে কালো রঙের এক কাফনা পেয়েছিল মা । বুকের ভিতর লুকিয়ে রেখেছিল যত্ন করে । কাফনার ভিতর ছিল ধবধবে মুক্ত মানিক । তার ছাওয়াল । দেখার হাওরের রোদে জলে পুড়ে গেছে ওপর ওপর ।

   মাতা পুত্রের সুখের কথা চালাচালির সময় সূর্যঠাকুর পশ্চিমপাটে রওয়ানা হওয়ার পর । উঠোনের রোদে মা তার দীর্ঘ কেশরাশি ছড়িয়ে বৈতলকে ডাকে পানের বাটা নিয়ে আসার জন্য । উৎসাহী পুত্র মাকে পান সাজিয়ে দেয় মুখে । গ্রামের বাড়িতে তাদের পান সুপারি কিনতে হয় না । সুপারি গাছ বেয়ে ওঠে পান – লতা । পাহাড়ে উঠলেই খাসিয়া চুন । খুশির মেজাজে মা মজার ডিটান শোনায়,

--- ক চাইন দেখি, এক্কউগাছো পান সুপারি এক্কউ গাছো চুন, কিতা ?

  বৈতলের মা তার মুখের পানে মিষ্টি ঝাঁঝ মিশিয়ে শিশু বৈতলের মুখে দেয় । বলে,

---খা ।

    ধাঁধাও ভাঙিয়ে দেয় । মার মুখ থেকে বারবার শুনে বৈতলের মুখস্থ । বৈতল জানে সুপারি গাছ বেয়ে ওঠা পানপাতায় কাকের বিষ্ঠা লেগে ডিটানের চুন হয় । তবু মার মুখ থেকে আবার শোনে চিবোনো পানের সুস্বাদ লোভে । মায়ের গাত্রবর্ণ নিয়েও গর্ব  বৈতলের । মিছিমিছি পান সাজে বৈতল আর গায় ,

--- পান দিলাম, সুপারি দিলাম আর দিলাম চুন ।

     মার সাদা রঙের হাতকে চুনের কৌটো ভেবে অলৌকিক  চুন নিয়ে পানে ঘসে । আর মা রাগে । বলে,

--- রং দিয়া কিতা করতে রে পুত, মনটারে সাদা রাখিছ ।

মন সাদা রাখার কথা বলে কিন্তু মা নিজে থাকে না ।

মা- বাপের সম্পর্কে পুত্রের সালাশি মার পছন্দ নয় । তখন সাদা রং আর সাদা থাকে না । তিনদিনের বাসি কড়কড়া ভাতের মতো ফ্যাকশে হয়ে যায় । ফুল আর ফুল থাকে না । সৌরভ চলে যায় মুখ থেকে । পাথর হয়ে যায় বৈতলের আনন্দময়ী মা ।

পাথর মা চুপ করে চেয়ে থাকে তার চোখে । কী যে বলতে চায় কে জানে ? চেয়ে থাকতে থাকতে ভুল বকে । বলে,

--- ভাত দে, জাল দে । ভাত দে, জাল দে ।

চুল মাথা ঝাঁকিয়ে বারবার একই কথা বলে ভৈরবী জননী । দূরে সরিয়ে দেয় বৈতলকে । বলে,

--- যা যা দূর যা , বেইমান বেটির পুত, দূর যা ।

                                    
                                                                                              পড়ুন ভাটি পর্ব ২ >

কোন মন্তব্য নেই: