“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১২

শুধু কবিতার জন্য ভুবন পেরিয়ে এই হিম সন্ধ্যেবেলা


স্বপন সেনগুপ্ত 

              কবিতার বাইরে অমরত্ব চাননি কখনও সুনীল। তাঁর বন্ধুত্বের পরিধি যেমন ছিল বিশাল, লিখিত গ্রন্থও প্রায় তিন শতাধিক। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পর সুনীলই  ছিলেন সব্যসাচী লেখক। যদিও কবি হওয়াই একান্ত বাসনা ছিল তাঁর, কিন্তু তাঁর গদ্য সত্তার কাছে চপা পড়ে গিয়েছিলেন কবি সুনীল। আমাদের যৌবনে, সবে যখন লেখালেখি শুরু করি, তখন দুটি নামেই আমরা ছিলাম নেশাগ্রস্ত। শক্তি-সুনীল। যেন আমাদের যৌবনের দেবদূত। একটু সজাগ কালে শক্তি-সুনীল ঝাপসা হয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন সুভাষ, শঙ্খ ঘোষ। এখন তো কতজনের লেখা ভালো লাগে। ভালো লাগে সুবোধ সরকার থেকে ভাস্কর চক্রবর্তী হয়ে রণজিৎ দাশ এবং আরো অনেকের কবিতাই।

           একবার গুয়াহাটিতে বিশিষ্ট গবেষক ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্যের বাড়িতে বসে আলোচনা হচ্ছিল, বাংলা সাহিত্যে এই সময়ের সৃষ্টিশীল কথা-সাহিত্যিকদের মধ্যে কার লেখা কালজয়ী হয়ে থাকবে ? ঊষাবাবু প্রয়াত গবেষক সুজিত চৌধুরীর কথা টেনে বলেছিলেন, শীর্ষন্দু মুখোপাধ্যায়। সুনীলের নাম উচ্চারণও করেননি। শক্তি-সুনীলরা জাত বহেমিয়ান হলেও লেখার টেবিলে প্রচন্ড শৃঙ্খলাপরায়ণ। রোজ নিয়ম করে ভোরবেলা লেখার টেবিলে তাঁরা বসতেন, পড়তেন। শীর্ষেন্দুও লেখেন ভোরবেলা বাড়ির অন্যরা সব জেগে উঠার আগে। সবাই জেগে গেলে তিনি বদলে যান, হয়ে ওঠেন ঘোর বৈষয়িক। সুনীল নাস্তিক, শীর্ষেন্দু আস্তিক। দু’জনের বন্ধুত্ব ছিল নিবিড়, কর্মক্ষেত্রও ছিল একই জায়গায়। তবে সুনীল যে রকম লোকপ্রিয়, শীর্ষেন্দু ততোটা নয়। জীবনানন্দও তো জীবদ্দশায় একশো টাকার বেশি কোনও পুরস্কারই পাননি।

             প্রতিষ্ঠান-বিরোধী সুনীল কিন্তু শেষে নিজেই হয়ে ওঠেছিলেন একটা প্রতিষ্ঠান। কলকাতাকে উদ্দাম যৌবনকালে শক্তি-সুনীল-সন্দীপনরাই তো শাসন করে গিয়েছেন। সাহিত্যের সব শাখাতেই তিনি ছিলেন সাবলীল। ১৯৬০-এ ‘আত্মপ্রকাশ’ দিয়েই তাঁর উপন্যাসের সূচনা। ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’, ‘রাণুভানু’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’ যেমন তাঁর স্মরণীয় হয়ে তাকবে, আবার অনেক আবোল তাবোল লেখাও লিখেছেন প্রচুর। বেশি লিখলে বোধহয় এমন হয়। দেশে ধারাবাহিকভাবে যখন তাঁর ‘অর্ধেক জীবন’ প্রকাশিত হচ্ছিল গোগ্রাসে গিলছিলাম, দেশের পাতা কেটে কাটিং রাখতাম। পড়ে বই হয়ে প্রকাশ হলে আনন্দ থেকে সংগ্রহ করি। যেমন পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম, অশোক মিত্রের ‘আপিলা চাপিলা’। ভাবতাম বাকি অর্ধেক জীবনটাও বোধহয় লিখে পূর্ণ করে যাবেন। কিন্তু তা করেননি। কারণ ৫০ বছরের পরবর্তী জীবনকাল নিয়ে তো রবীন্দ্রনাথও লেখেননি।

            বুদ্ধদেব বসুর মতো প্রথম দিকে ছিলেন ঘোর ‘রবীন্দ্র-বিরোধী’, পরে অকান্ত রবীন্দ্র-অনুরাগী। একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন, যেন একজন পূর্বসুরি অন্যজন উত্তরসুরি। রবীন্দ্রনাথের কোনও কবিতাই পচ্ছন্দ ছিল না সুনীলের। বরং তুলনায় ছোটগল্পগুলোকে বলতেন, মন্দের ভালো। এধরণের বিরোধিতার নজির তো সব কালেই দেখা যায়, বুদ্ধদেব বসুর কবিতাকে অপাঠ্য বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তেমনি বুদ্ধদেব বসু সুনীলের কবিতাকে বলেছিলেন দুর্বোধ্য। উগ্র বিরোধিতাই পরবর্তীকালে মোড় নেয় অনুরাগে। সুনীলও ক্রমে হয়ে ওঠেন রবি-অনুরাগী। রবিগানের প্রেমিক। রবীন্দ্রনাথের কবিতা অপছন্দ হলেও গান ভালবাসতেন, আপন মনে গাইতেন।

         জীবনানন্দের বনলতা আর সুনীলের নীরা। ভালোবাসার মানুষ চলে গেলেও এদের কিন্তু বয়েস বাড়ে না, তারা অনন্ত যৌবনা। জীবনানন্দ দাশ বনলতার আংশিক উৎসের সন্ধান দিলেও সুনীলের নীরা কিন্তু অ্যাবস্ট্রাক্ট। সুনীল কিন্তু তাঁর যৌবনে একদল লেখককে নিয়ে একটা বৃত্ত রচনা করেছিলেন। যাঁরা ছিলেন ‘কৃত্তিবাস’-এর অশ্বারোহী। শক্তি-শরৎ-তারাপদ-সন্দীপন-আনন্দ বাগচী সহ এই কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর মধ্যমনি ছিলেন সুনীল। কৃত্তিবাসে ছাপা হতো তরুণ কবিদের কবিতা এবং প্রবীণদের গদ্য। নিঃসন্দেহে সুনীল খুব খোলা মনের সাহসী কবি। সাদা জুলপির অর্ধেক জীবন। দিলখোলা, পরিশ্রমী ও আড্ডাবাজ। একসময় বিস্তর হইচই পড়েছিল, ‘তিন জোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্র রচনাবলি লুটোয় পাপোষে’ পঙক্তি নিয়ে। আসলে তিন বন্ধু শুয়েছিল খাটে, ঘুমন্ত তিনজনের পায়ের আঘাতে রবীন্দ্র রচনাবলিই পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। অথচ তিনিই শেষ বয়সে লিখছেন, ‘কয়েকদিন ধরে মনটা ভারি আনন্দে ভরে আছে। শুধু রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ছি’। ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে পরিচয় ঘটেছিল অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে। তখন তরুণ কবিদের সর্দার সুনীল। হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে যুক্ত। শৈলেশ্বর ঘোষ, মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী সহ অনেক তরুণই ওই আন্দোলনের পথিক। ‘হাউল’ দিয়ে জগৎসংসার মাতিয়ে গিন্সবার্গ তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কলকাতা-বারাণসী, মিলেমিশে গিয়েছেন ‘কৃত্তিবাস’-এর কবিদলের সঙ্গে। অ্যালেনের মূলভাষ্য ছিল, যা কিছু তুমি অনুভব করো তাকে ঠিকঠাক বলে যাওয়াটাই হল কবিতার কাজ। যেখানে ধরা পড়বে তুমি ঠিক কেমন। ‘একা এবং কয়েকজন’-এর কবি তাই হয়ে উঠলেন, ‘আমি কী রকম বেঁচে আছি’-র কাহিনিকার। সুনীলের কবিতা তাঁর বেঁচে থাকার যেন ধারভাষ্য। তিনি বামপন্থী, কী নকশালপন্থী, কী হাংরি—এসব বাহ্য বিষয়, তাঁর কবিতা আর কিছু নয়, তাঁর আত্মস্বীকারোক্তি। এবং তাই স্বাভাবিক। তাঁর এই বেঁচে থাকা তো একার বেঁচে থাকা নয়, চারপাশের মানুষজন এবং চারপাশের পৃথিবীকে নিয়েই বেঁচে থাকা। ঘুরেছেন দেশবিদেশ। আমেরিকার আইওয়া শহরে এক বছর প্রবাসজীবন কাটিয়ে যখন ফিরে এসেছেন তখন গাঢ় পরিচয় ঘটেছে সমসাময়িক বিশ্ব কবিতার সঙ্গে। অনুবাদ গ্রন্থ বের হয়েছে ‘অন্যদেশের কবিতা’। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পল এঙ্গেলের আমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক লেখক কর্মশালায় যোগ দিয়েছিলেন সুনীল। তখনই সালভাদর দালির সঙ্গে পরিচয়। ফেরার পথে ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে বিলেত। স্টিফেন স্পেন্ডার এবং টি এস এলিয়টের সঙ্গে পরিচয়, ফরাসি বান্ধবী মার্গারেটের সঙ্গে প্যারিস ভ্রমণ। লিরিকের পথে নয়---গদ্যপন্থায়, কখনও কাহিনি কখনও নাটকীয়তায় চলেছে তাঁর কবিতা। তিনি চিহ্নিত হয়ে উঠেছিলেন ব্যাক্তিকেন্দ্রিক, রবীন্দ্রবিদ্বেষী ও অতিযৌনকাতর কবি হিসেবে। ক্ষুৎকাতর কবি গোষ্ঠীর সঙ্গে পরে তাঁর অনেকটা যেন স্বার্থপর দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। যৌনতা তাঁর কবিতার প্রধান ভর কেন্দ্র হলেও তাঁর কবিতায় নিবিড়ভাবে তাকালে ভেসে ওঠে এক আর্ত-মুখচ্ছবি। সুনীলের কবিতার ছত্রে ছত্রে তো ভালবাসার কথাই ছড়ানো। অর্থাৎ ‘আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি’। আসলে ওর বিদ্রোহ তো রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে নয়, ছিল তথাকথিত রাবীন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে। মধ্যবিত্তসুলভ কূপমণ্ডূকতা তাঁর মধ্যে বিরল। জাহাজের খালাসি হৌয়ার স্বপ্ন ছিল ছোটবেলায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরিণত মননের নীললোহিতকে আমরা পেয়েছি। যিনি ছিলেন দিকশূন্যপুরের যাত্রী। বইপড়ার নেশা তাকে ধরিয়েছিলেন মা, মীরা দেবী।

            ডি-কের পরামর্শ ও সহযোগিতায় যখন ‘কৃত্তিবাস’ (শ্রাবণ ১৩৬০) প্রকাশিত হয়, কলকাতায় রাজনৈতিক আবহাওয়া তখন উত্তাল। কৃত্তিবাসের তরুণ ব্রিগেডই তখন  দাপিয়ে বেড়াতো মধ্যরাতের কলকাতায়। ওই তরুণ কবিদের বহু পঙতি তখন যেন প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে দেশে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’। এরপর বের হয় ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘প্রতিদ্বন্ধী’। আশির দশকে লেখা বৃহৎ উপন্যাস ‘সেই সময়”। ক্রমান্বয়ে ‘পূর্ব পশ্চিম’ থেকে ‘প্রথম আলো’। তাঁর ভাষা সুখপাঠ্য, ঘরোয়া, কথনভঙ্গি জনপ্রিয়। কবিতা এবং গদ্যের ভাষায় ছিল নিখাদ তফাত। কবিতার জন্য তিনিই পারেন অমরত্বকে তাচ্ছিল্য করতে। তাঁর লেখা কালের রাখাল হবে কিনা তিনি ভাবতেন না, সমকালের পাঠক যদি পড়ে আনন্দ পায়, ভাবে, তাহলেই খুশি। বিবেকানন্দ-নিবেদিতাকে নিয়ে তাঁর কাঙ্খিত উপন্যাস আর লেখা হয়ে ওঠেনি। তিন ছদ্মনামের আড়ালে তিনি বিচিত্র স্বাদের নীললোহিত, নীল উপাধ্যায়, সনাতন পাঠক। ইন্দিরা গান্ধিকে নিয়ে সামনাসামনি দেখার পর তাঁর শুষ্ক ওষ্ঠ, অপ্রেমের চিবুক নিয়ে লেখা বিতর্কিত অথচ বিখ্যাত কবিতাটির কথাও কী ভোলা যায় সহজে। সুনীল একমাত্র সুনীলেরই তুলনা।
(C) Picture:ছবি

1 টি মন্তব্য:

বিডি মোটিভেটর বলেছেন...

চমৎকার লেখা। খুব ভাল লেগেছে।