“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১২

বলি প্রদত্ত...


ঠিক এই মুহূর্তে আকাশটা একটু লালচে নীল। আমি বসে আছি রাঙ্গামাটির ভুবনেশ্বরী মন্দিরে। নীচে দিয়ে বয়ে চলেছে মজা গোমতী। অসম্ভব শান্ত জল,শ্যাওলা সবুজ। আশেপাশে শুধু টুপ টুপ করে শিশির পড়ার শব্দ। অনেকদূরে কোথাও মাইকে বাজছে, ও লো সই, তোর চোখ কেন ছলছল... আজ জয়ের মালা কাকে দিবি বল...!

একটা সময় এই ভুবনেশ্বরী মন্দিরে নরবলি হতো। শোনা যায় শরীরে কোন ক্ষত নেই এমন মানুষদের ধরে এনে বলি দিত রাজরাজারা। কখনও কখনও যুদ্ধে পরাস্ত সেনাকেও দেয়া হতো বলি রাজার কল্যাণে।এই রক্তের স্রোত উঁচু টিলা গড়িয়ে গোমতীর জলে মিশে যেত। রবীন্দ্রনাথের বিসর্জনের পটভূমিও নাকি ছিল এই ভুবনেশ্বরী মন্দির। রাঙ্গামাটিতেই ছিল ত্রিপুরার পুরনো রাজবাড়ী। পরবর্তী সময় রাজা এই রাঙ্গামাটি থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যান আগরতলায়। একসময় আগরতলায় প্রচুর আগর গাছ ছিল। তাই নাম আগরতলা। আজ সেই গাছ নেই, আগরতলা আছে অবশ্য।
        আগরতলার রাজবাড়ীর দুর্গাপূজার বয়স প্রায় আড়াইশ বছর হবে। তবে এনিয়ে মতভেদ রয়েছে। রাজবাড়ীর পুজায় এখনও মহিষ বলি হয় নবমী পুজার দুপুরে।রাজচন্তাই স্বর্ণ পৈতা পরে মহিষ বলি শেষে মদ, আদা আর ডিম বলি দেন। এটাই রাজণ্য প্রথা। অথচ দেবী শুনেছি বলি চান না। পুরাণে কথিত আছে রামচন্দ্র পশু বলির পরিবর্তে ১০৮ টি নীল পদ্ম দিয়ে দেবীর আরাধনা করেছিলেন রাবণকে পরাস্ত করতে।
রাজা সুরথ শত মহিষ আর পাঠা বলি দিয়েও দেবী কৃপা না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। শেষে দেবী স্বপ্নাদৃষ্ট হয়ে আদেশ দিলেন, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ আর মাৎসর্য বলি দেয়ার।

           বলছিলাম ত্রিপুরার রাজবাড়ির দুর্গাপুজার কথা। এই রাজবাড়ীর দুর্গা ঠাকুরের দুই হাত প্রসারিত। কার্ত্তিক ঠাকুরের মাথায় পাহাড়িদের সাদা গামছার পাগড়ি আজও দর্শনীয়। মিষ্টি মুখ ঠাকুরের। এই সবই রাজণ্য প্রথা মেনে। জানা যায় ত্রিপুরার মহারাণী সুলক্ষণা দেবী দেবীর দশ হস্ত আর মহিষাসুর মর্দিনীর রূপ দেখে ভয় পেয়ে মূর্ছা যান মহারাণী। এই অবস্থায় দেবী স্বপ্নে আদেশ দিলেন দুই বাহু দৃশ্যমান করতে। বাকি আট হস্ত ছোট আকারে অদৃশ্য রাখতে দেবীমূর্তির পেছনে।এখনও সেই রীতি মেনেই ঠাকুর গড়া হয় দুর্গাবাড়ির।
          ত্রিপুরার পুজা মানেই একটা মিশ্র সংস্কৃতির উৎসব। এখানে দেবী কখনও রাজনন্দিনী, কখনও লাল বেনারসীতে আবার কখনও রিয়া আর পাছড়া পরিহিতা। উপজাতি আর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ভীড় করেন দুর্গোৎসবে। মনে হয়না একবারও গত কয়েক দশক ধরে চলা বাঙালি আর উপজাতিদের মধ্যেকার কোন বৈরিতার কথা।
        সরকারি পরিসংখ্যান বলছে গত দুই দশকেই প্রায় হাজার দুয়েক মানুষ নিহত হয়েছে এই হানাহানিতে। এবারও পুজা হচ্ছে, কিন্তু কোথায় যেন একটা আশংকা, সন্দেহ। সামনেই নির্বাচন বলে হয়তো! কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা ঠিক এই সময়টাকেই বেছে নিলেন তাদের প্রচারের জন্য। কেউ বলেন উনারা দিচ্ছে উগ্রপন্থীদের মদত, কেউ বলছেন তিনি নিজেই উগ্রপন্থী। হামলা, পাল্টা হামলা হতে পারে যেকোন সময়! মাথা পিছু নিরাপত্তারক্ষী রাজপথে।

                আমার আশেপাশে কিছু ছাগ শিশু এই মাঝরাত্তিরের স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। আসলে এরা জানে তারা বলি প্রদত্ত। মানুষের কল্যাণে। তাই শেষবারের জন্য হয়তো জিবনভিক্ষা চাইছে মানুষের কাছে।মানুষের কল্যাণে পশু, ডিম, আদা সবই বলিপ্রদত্ত। এই সময়ে পৃথিবীকে বাঁচাতে গেলে দরকার পশু আর জীবের বেঁচে থাকা। কিন্তু রীতি এটাই। নিধন চাই উৎসবেও যুদ্ধেও।
       মানুষ কি করবে বিনিময়ে! কিছুই না উৎসব, শুধু উৎসব।
      কিছু কুমারী মেয়ে গত কদিন ধরে কৃচ্ছসাধন করে চলেছে। মহাষ্টমীতে তাদের পুজা হবে তাও মানুষেরই কল্যাণে! তৈরি হচ্ছে এই বালিকা হৃদয় কাল সারাদিনের জন্য উপোস থাকার। সবই উৎসব।আরও বিসর্জন চাই!! না এবার মানুষের ঘুরে দাঁড়ানো দরকার! একবার অন্তত বলি প্রদত্ত হতেই পারি আমরা সবাই ঐ পশু আর শিশুদের জন্য! ছাগ শিশু আর ঐ কুমারী দেবীরা আজ সারাদিন কাঁদছে, খিদেয়। উপোষ না করলে বলি প্রদত্ত হওয়া যায়না যে!

কোন মন্তব্য নেই: