“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১২

উপন্যাস ‘কমলিনী উপাখ্যান’: একটি সহজ পাঠ

“এই মেয়েটিরে লইয়া তাহার ভিতরে ময়ূরপঙ্খের তুল্য আকাশ; বৃষ্টির বিন্দুমাত্র চিহ্ন নাই, অথচ কান্দিতে আছে—যা এই হাৎকা হইয়া উঠা নাগরেরা চোখের নাগালে পায় না। তাই মস্করা ইত্যাদি, মণ্টু ঘোষের দোকানে, বিপ্রকে স্পর্শে না। গ্যাঁজাইবার বিষয় অভাব হইলে , যদিও ইয়েনান বক্তৃতা হইতে লোডশেডিং পর্যন্ত হাজার বিষয়, তবু মেয়েটির বৃত্তান্ত একা ঘুরিয়া বেড়ায়। এবং গ্যাঁজাইবার আবেগ ক্ষীণ হইলে, বিপ্র ভূমিকাহীন প্রস্থান করে। ঘোষের দোকানে ইহা নিত্য ঘটনা, বিশদে বলিবার কিছু নাই। যদিও পরবর্তী ঘটনা সকলের গোচরে ঘটেনা, উহা কমলিনীর পাঠক্রম।”—এভাবেই শুরু হয়েছে পল্লব ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘কমলিনী উপাখ্যান’ । উপন্যাসটি কমলিনীর পাঠক্রমই বটে। আশির দশকের মাঝামাঝি ১৯৮৫-৮৬তে পল্লব যখন সদ্য কৈশরোত্তীর্ণ তরুণ, তখন লেখা এই উপন্যাস ছেপে বেরিয়েছে এই সেদিন ফেব্রুয়ারি, ২০১২তে। বের করেছেন ত্রিপুরার বিখ্যাত প্রকাশক ‘অক্ষর’। কিছু কিছু লেখা আছে লোককথার সেই কচ্ছপের মতো এগিয়ে গিয়ে পাঠকের দরবারে পৌঁছোয়। আর আমাদের পূর্বোত্তরের কোনো প্রকাশনা হলেতো আর কথাই নেই।সবারই প্রায় ভাগ্য সেই একই। পল্লবের উপন্যাসটি তাই। খুব পরিচিত নয়, কিন্তু আমি নিশ্চিত যারা পড়ে ফেলেছেন একবার কমলিনীর প্রেমে পড়ে গেছেন, নিশ্চিত। কমলিনীর তাঁর ভাবনাকে গ্রাস করবে, এবং ‘বৃত্তান্ত একা’ ঘুরে বেড়াবে। আমাদেরও তাই হয়েছে। কেন, বলছি।
                  তার আগে জানিয়ে দিই, পল্লব ত্রিপুরা নিবাসী। পূর্বোত্তরের বাংলা কথা এবং কবিতা সাহিত্যে তিন দশক ধরে এক পরিচিত এবং সম্মানিত নাম। যারা সাহিত্য পাঠ করেন নিত্য, তাঁরা পল্লবের লেখা না পড়ে ফেলে রাখেন না। নিত্য পাঠ যাদের অভ্যাসে নেই তাঁরা হয়তো তাঁর নাম জানেন না তেমন, কেননা পল্লব প্রচার যেদিকে-- হাঁটেন তাঁর উল্টো পথে। যে পথে কমলিনী হাঁটে । একা নিঃসঙ্গ।
                  কী নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস? ওই যে লিখেছেন ‘উহা কমলিনীর পাঠক্রম।” এইটেই উপন্যাসের বিষয় বটে।কমলিনীর পাঠক্রম। ‘...তবু মেয়েটির বৃত্তান্ত একা ঘুরিয়া বেড়ায়।’ সেই বিপ্র আর কমলিনীর প্রেমের কথাতে কথাতে আসছি পরে। কিন্তু এ মন্টু ঘোষের চায়ের দোকানে বসে যে আড্ডা, সেই আড্ডার কাহিনিও বটে। আড্ডার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা, আড্ডার থেকে বেরিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জীবন বৃত্তান্ত। পড়তে পড়তে মনে হয় যেন, এই জীবন এক বৃহৎ আড্ডাশালা। আমাদের কোন অসুবিধে নেই যদি পাঠকের মনে পড়ে যায় সেই বিখ্যাত শব্দটি , ‘মধুশালা।’ হরিবংশরাই বচ্চনের সেই বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থটির নাম। সেই আড্ডাতে ‘গ্যাঁজাইবার আবেগ ক্ষীণ হইলে’ বিপ্রের মতো কেউ কেউ কমলিনীর সন্ধানে ‘ভূমিকাহীন প্রস্থান করে’ মাত্র। উপন্যসের শেষে বাসে চড়ে বিপ্র সেই বৃহৎ আড্ডাশালা থেকে তাই করে।
                এবারে, আড্ডার কাহিনি লেখক লিখবেন কী করে? আড্ডার কি আর কোনো পুনরুপস্থাপন সম্ভব? সেতো এক মহা বিশৃঙ্খল ব্যাপার। আড্ডাতে বসে আমরা করি বটে গল্প। কিন্তু সে গল্পের কি আর কোনো শুরু আছে, না শেষ? দ্বিতীয় ব্যক্তিটি এসে কথা বলতে শুরু করলেই শুরু, এবং শেষ ব্যক্তিটি উঠে গেলেই শেষ। মাঝের খেই কে কবে ধরতে পেরেছে? সেখানেতো কথা হয় ‘ইয়েনান বক্তৃতা হইতে লোডশেডিং পর্যন্ত হাজার বিষয়’ নিয়ে। সেই অসাধ্য সাধনের এক পরীক্ষা করেছিলেন সদ্য কৈশরোত্তীর্ণ তরুণ লেখক। এবং আমাদের অভিমত তিনি আশ্চর্যরকম সফল হয়েছিলেন।আড্ডার সমস্ত রং রূপ এনে এই উপন্যাসে তিনি হাজির হয়েছেন। এমনকি তার ভাষাটিও। তাই কিছু কিছু পাঠকের মনে হবে বড় বিশৃঙ্খল বয়ন এর। সে অর্থে কোনো কাহিনি নেই। চরিত্রগুলো গল্পের টানে গড়ে উঠেনা, লেখকের সৃজনী ইচ্ছার টানে গড়ে উঠা চরিত্রগুলো যখন খুশি তখন এসে হাজির হয় এসে । লেখকও যদি আড্ডা দিতেন পাঠকের সঙ্গে তবে তিনি যে বিশৃঙ্খলার সূত্র মেনে চলতেন, পল্লব তাই করেছেন। ফলে যে পাঠক আড্ডার মেজাজে না বসবেন , তিনি বইটা হাতে নিয়েও মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিতে পারেন। তাই বলে, সত্যিই কিন্তু বিশৃঙ্খল নয় এই উপন্যাস। এমনটা হয় না, যদি লেখক পাকা হন। কেউ কেউ আজকাল কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে বলেন বটে, জীবন বড় বিশৃঙ্খল, সুতরাং সাহিত্যও হবে সেরকমই। কিন্তু সে হচ্ছে অর্ধবিজ্ঞান এবং অর্ধ সাহিত্য তত্ত্ব। বিশৃঙ্খলার যে তত্ত্বটি রয়েছে বিজ্ঞানে, ইংরেজিতে যাকে বলা হচ্ছে ‘কেওস থিয়োরি’, সে কিন্তু শেষ অব্দি এক শৃঙ্খলার কথাতে এসেই শেষ হয়, না হওয়া অব্দি তৃপ্ত হয় না। পল্লবের উপন্যাসটিরও রয়েছে সেরকম শৃঙ্খলা। তাঁর এক চরিত্র অশেষ গুপ্ত এক জায়গাতে বলছিলেন, “ তত্ত্বের সৌন্দর্য বড়ো কথা নয়। পরীক্ষার সঙ্গে না মিলিলে সেটা ভুল তত্ত্ব।” আমরা জানিনা, পল্লব সেরকম কিছু তত্ব্ব নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন কিনা, কিন্তু তার উপন্যাস ‘বিশৃঙ্খলা’র তত্ত্বকে সত্য প্রমাণিত করে যেন। বস্তুত তাঁর উপন্যাসটি জীবনের সেই শৃঙ্খলারই সন্ধানের গল্প। কমলিনী সেই শৃঙ্খলারই নাম। আমরা কমলিনীর কথাতে আসব পরে। সেটি থাক শেষ পাতে আকর্ষণের মতো। আপাতত আড্ডার মানুষগুলোকে চেনা যাক। আড্ডা বলেই কথা। একে ধরতে গেলে আমাদেরকেও পল্লবের পথেই বুঝিবা হাঁটতে হবে, বহু কথা ধরা দেবে, বহু কথা নয়।
             কারা আসেন মন্টু ঘোষের দোকানে? বিপ্র আসে সেতো জানাই গেল। আসে যুধিষ্ঠির, হিমাদ্রি, শ্যামল, পার্থ, সৌরীন আরো অনেকে। অবনীমোহন যেমন বিপ্রের বাবা, লাবণ্য মা--তেমনি নানা চরিত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যাদের দেখা মন্টু ঘোষের দোকানে পাওয়া যাবে না। কিন্তু উপন্যাসে রয়েছেন। যেমন, প্রসন্ন চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী দীপালি, উপপত্নী মীনারানি, অখিল, বিনয় মন্ডল, অশেষ গুপ্ত, রঞ্জন, জবা, নুনু, গরিবা, নিরাপদ, প্রতিমা, আব্বাস আলি ইত্যাদি। এরা কোথাকার লোক, কোন শহর কিম্বা প্রদেশের কোনো তথ্য নেই। কিন্তু অধিকাংশ চরিত্র পাহাড় ঘেরা সমতলের এক আধাশহরের বাসিন্দা বলে মেনে নিতে কোনো অসুবিধে নেই। তার উপর, ভাষাতে ওমন পূর্বোত্তরীয় প্রচুর নাম-ক্রিয়াপদের অনুপ্রবেশ দিয়েও লেখক নিজেই ইঙ্গিতটি দিয়ে রেখেছেন যে এটি আসলে ত্রিপুরারই গল্প।
              “মণ্টু ঘোষের দোকানের যা হাল, তাহাতে কীই বা বেচিবার থাকে। আর এই দোকানে যাহারা কিনিতে আসে তাহাদেরও যে হালৎ, তাহাতে কেনাবেচা দুটোই হাস্যকর চেষ্টা। যুধিষ্ঠির তাই বলে, ঘোষের দোকানে তো কাস্টমার নাই, সব কাস্টকুমার” এই হলো সেই দোকান যেখানে আড্ডাটি বসে। বিপ্র এই আড্ডার পার্শিক চরিত্র, কিন্তু উপন্যাসের কেন্দ্রীয়। সে অবনীমোহন লাবণ্যের চতুর্থ সন্তান। তাঁর বড় ভাই ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করে। বাড়িতে থাকা না থাকার সময় অসময় নেই। মেজো ভাই দূরে কোথাও থেকে ব্যক্তিগত কোম্পানিতে কাজ করে। ব্যস্ততা এতোই যে অবনীমোহনের মৃত্যুতেও বাড়ি আসার ছুটি পায় নি। আর সেজোটি অনেক কিছুই করে, কী –সেটি কেউ জানে না, মা লাবণ্যও না। তবে টাকা বানাচ্ছে এটা বোঝা যায়। কিন্তু বিপ্র বৈষয়িক অর্থে কিছু করে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার ছাত্র ছিল এখন চিন দেশের লংমার্চের কাহিনি পড়ে। আর কমলিনীর সন্ধান করে। বিপ্র কী করে খাবে, ভেবে মায়ের চোখের জল ঝরে। বাবা অবনীমোহন কিছু একটা চাকরি করতেন, তিরিশ বছর চাকরি করে লোয়ার থেকে আপার ডিভিশনে উঠেছিলেন। কিন্তু শ্বাস ফেলে টের পেলেও বেঁচে যে ছিলেন সেটি টের পেতেন না। বিড়িতে তেতো টান দিতেন, মানে খুব একটা স্বচ্ছল জীবন ছিল না। তাঁর শেষ জীবনে বেকার বিপ্র যখন ভাতের গ্রাস মুখে তুলত মনে হতো বাবার হাড় চিবুচ্ছে। নিজেকে মানুষ ভাবতে ঘেন্না করত। লেনিনের ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে কী করিতে হইবে?’ পড়তে পড়তে বিপ্রের মনে হয়, কোথায় পৌঁছুবেন না জেনেও বাবা কিন্তু বেঁচে থাকতে চান। না চাইলেই কি আর অনর্থক মরে যাওয়াটাও উচিত? এর মধ্যে কি আছে কোনো বীরত্ব? এই সব প্রশ্ন তাকে কিম্বা লেখকে তাড়া করে। ওদিকে গোপন বিপ্লবী দলের কর্মী কবি অশেষ গুপ্তের লাস যখন পথের পাশে পড়ে থাকতে পাওয়া গেল, তখন তাঁর প্রতি সমস্ত শ্রদ্ধা নিয়েও কৃষ্ণসুন্দরের মনে হয়, এও এক অর্থহীন অপরিপক্ক মৃত্যু। দেশের জন্যেও মরবার সঠিক মুহূর্ত সেটি ছিল না। তবে কিনা বিপ্রের এই জিজ্ঞাসা উত্তরাধীকার সূত্রেই পাওয়া। কোন এক মুহূর্তে অবনীমোহনের মনেও প্রশ্ন জাগে, ‘মায়া যাহাকে জড়ায় সে অবনীমোহন হয়। অবনীমোহন হইয়া কী পাওয়া গেল?’ তাঁর আক্ষেপ, ‘...ফুরাইবার আগে একবার দপ করিয়া জ্বলাও হইল না।’। সেই জ্বলার আশাপ্রদীপ, তিনি বিপ্রের মধ্যে জ্বলে উঠবে বলে মনে করেন। বিহারি গরিবা গাঁজাও বিক্রি করে। তার সঙ্গে বিপ্রকে দেখে তাঁর সন্দেহ হচ্ছিল, তিনি যে তাকে স্বপ্নের সফরি ভেবে নিশ্চিন্ত থাকতে চাইছিলেন, সে চাওয়া কি ভুল ছিল? এ তাঁর সন্দেহ ছিল মাত্র। বিপ্র বস্তিবাসীদের জীবনের আঁচ নিতে গিয়ে গাঁজাতে টান দিয়েছিল বটে, হাত জোড় করে গরিবাই মানা করেছিল। যাতে করে নিজেকে তার মনে হয়েছিল, সে গরিবারও সন্তান। সেই গরিবাই পথে পেয়ে তাকে একদিন বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার সংবাদ দিয়েছিল।
                কৃষ্ণসুন্দর বয়সে প্রবীণ। খুব যে বয়স তা নয়, ছেচল্লিশ। এই বয়সেই যেন মনে বুড়িয়ে গেছেন। শ্মশানে দাঁড়িয়ে অবনীমোহনের শরীরে পুড়ে যাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল, ‘কত কিছু হইতে চাওয়া আর না পারা একটি শরীর ধোঁয়াতে মিশিয়া যাইতেছে...পুড়িয়া যাইতে আছে। মনে মনে তিনিও পুড়িতেছেন।’ বিপ্রের ভাবগুরু কি অনেকটা? না হলেও পরিপুরক। মানে তাঁর জিজ্ঞাসা যেখানে থৈ পাচ্ছে না, সেখান থেকেই বিপ্রের শুরু। মন্টু ঘোষের দোকানের ধুলিকালির বেড়াতে বহুদিন ধরে ঝুলন্ত উড়ন্ত এরোপ্লেনের ছবি ওয়ালা ক্যালেণ্ডারের দিকে তাঁকালে তাঁর বিষন্নতা বাড়ে। গতির এমন স্থির চিত্র এ জীবনে আঁকা হবে না ভেবে, পাক ধরা চুলে হাত বুলিয়ে তিনি আন্মনে বলে উঠেন, “যৌবন যায়...” । ছেলেবেলা কিচ্ছু না বোঝে ‘ভুলো মৎ, ভুলো মৎ’ স্লোগানে গলা মিলিয়ে জেঠার হাতে মার খেয়েছিলেন। বোধকরি, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ স্লোগানের দিকে লেখকের ইঙ্গিত। রাতে বিধবা মা তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, ‘সত্য কথা কহিতে নাই।’ ছোটবেলার স্বাধীনতা মানেই রিফিউজি কলোনির স্কুলে চকলেটের দিন। বন্দেমাতরম বলে চিৎকার করবার দিন। স্বাধীনতার মানে বুঝবার দিন নয়। বোঝেনও নি । জেঠার গলগ্রহ হয়ে বড় হয়েছেন। বড়বেলাতে বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়া দেখেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার যে মানে তিনি বোঝেছেন, তা দেখেন নি কোথাও। কলকাতাতে (নামটি নেই, মহাকরণের উল্লেখ থেকে আমাদের অনুমান) কলেজ পড়া কৃষ্ণসুন্দরের জীবন থেকে একে একে চলে গেছে বন্ধুরা, উৎপল, ত্রিদিব, খুকু, শুভেন্দু...। কেমিস্ট্রির ছাত্র ত্রিদিব সত্তরের নকশাল আন্দোলনে সময়ের আগে বোমা ফোটাতে গিয়ে ‘ঠুণ্ডা জগন্নাথ।’ বোমা ফুটুক, কিন্তু সমস্ত প্রস্তুতির পর --এই ছিল কৃষ্ণসুন্দরের মনের বাসনা, যা তিনি এখনো মনে মনে লালন করেন। তাই জীবনের সমস্ত শ্লোগান মুছে ফেলে উৎপলের শেক্সপিয়র পড়াতে ফিলাডেলফিয়া চলে যাওয়া, তাঁকে ম্লান করে। খুকু ভালো গান করত, এখন হারমোনিয়ামে , ‘কিচেনের ভারে, গয়নার ধারে’ ধুলো জমেছে বহুদিন। শুভেন্দু করে মানবাধিকার সংগঠন সি আর পি সি। কৃষ্ণসুন্দর কোথায় তারা কেউ জানে না। তাঁর ধারণা, জানে হয়তো জবা। জবাকে নিয়ে রঞ্জনে তাতে এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। এবং জবাকে নিয়ে গেছিল রঞ্জন। সেই রঞ্জন যে তাঁকে প্রথম বুঝিয়েছিলেন, ‘তাড়াহুড়া করে,বাইরে থেকে চাপ দিয়ে কিছু পাল্টানো যায় না...ভেতর থেকে পাল্টানোর জন্যে সময় দিতে হয়। ঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হয়।’ বোঝাই যায় এই তর্ক তাঁর যৌবনের মার্ক্সবাদী কম্যুনিষ্ট দলের দুই লাইনের তর্ক। এবং রঞ্জনের পক্ষ কিছুদিন পরেই শাসনে বসেছিল। তার জন্যে কোনো সময়ের অপেক্ষা করে নি। ‘কী এক কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হইয়া সেই রঞ্জন দত্ত, আজকাল তাহার সাদা অ্যাম্বাসেডরের ভিতরে বসিয়া কালো কাচ দিয়া বাহির দেখে।” জি-কে পরীক্ষাতে পাঁচ নম্বর ছেড়ে দিয়ে ছেলে সন্তানটি তার সমস্ত পরিশ্রমে জল ঢেলে দিয়েছে বলে লিপস্টিকে কদাকার ঠোঁট উল্টে জবা এখন দুঃখ করে। এখন সকাল থেকেই তিনি ‘জর্ডনের বিশুদ্ধ জল’ গলায় ঢালেন, এই কৃষ্ণ সুন্দরের নিত্য সঙ্গী। ‘সকল কিছুর পর উহাতেই মুখ দেখিতে হয়।’ অথচ এক কালে ইনি ভালো বাঁশি বাজাতেন। এখন মদ্যপানও তাঁকে উদাস করে। জীবনের নদী এখন মরে গেছে, মাছ দূরেই থাক , কাদাখোঁচাও আসবে না। শুধু ‘ঘুম আসিবে মৃত্যুতুল্য আচ্ছন্নতায়...।’ ভাবতে ভাবতে কান্না পায় তাঁর কখনো...অধ্যাপক বুদ্ধিজীবি প্রশান্ত কুমার দেবের সভাতে বক্তৃতা শুনে পার্থ যখন কাগজের খবর পড়ে বোমা মারবার ইচ্ছেতে উত্তেজিত হয়, তাঁর তখনো মনে হয় নিজেকে পুড়িয়ে আলো হতে চেয়েছিলেন। এখন পড়ে আছে শুধু ছাই আর ধ্বংসস্তূপ। পিকেডি-র বক্তৃতা শুনতে শুনতে তার মনে পড়ে কলেজের দিনগুলোর সেই মূর্তিভাঙার বিপ্লবীআনার রাজনীতির কথা। বাস্তবতার বাইরে যা আজও মনকে লোভায় তেমনি এক অন্যতর মূর্তি যেন আজ আবার তৈরি করছেন পিকেডি আটটি খণ্ড দলিল জুড়ে জুড়ে। পাঠকের বুঝতে অসুবিধে হয় না, চারু মজুমদারের আটটি দলিলের কথা হচ্ছে। সেই বক্তৃতা শুনতে শুনতে তাঁর মনও যে আবার এতোদিন সামান্য উত্তেজিত হচ্ছিল না তা নয়। কিন্তু আবার মনে পড়ে যায় সৌরীণদা এখন পাগলা গারদে। নির্বাক। তিনি যেন সেই ভেজা দিয়াশলাই কাঠি যাতে আর কোনো অগ্নিগুণ থাকে না। ‘পুনরায় যদি রৌদ্র হইতে উষ্ণতাপ সংগ্রহ করা যায়, তবে জ্বলিলেও জ্বলিতে পারে এক আধটা কাঠি।’ সেই কাঠি যেন উপন্যাসের শেষে এসে তিনি খুঁজে পান বিপ্রের মধ্যে। কমলিনীর সন্ধানে বিপ্র যখন বাসে চড়ল, বিদায় জানাতে এসে কৃষ্ণসুন্দরের মনে হচ্ছিল বাসের ভেতরেও আসলে বসে আছে কৃষ্ণসুন্দর।
                 প্রসন্ন চৌধুরী আরেকটি বেশ বড় চরিত্র এই উপন্যাসে। তাঁরই যেন পরোক্ষ কিম্বা প্রত্যক্ষ শাখা প্রশাখা অখিল, রঞ্জন ইত্যাদিরা এবং তাঁর স্ত্রী দীপালি অবশ্যই। তাঁকে না বুঝলে আসলে বিপ্র কৃষ্ণসুন্দরের এহেন হতাশার কিছুই বোঝা হবে না।যদিও ইনি ঘোষের দোকানের আড্ডার কেউ নন।বাংলার শিক্ষিকা স্ত্রী দীপালি আর কলেজের হোস্টেল ছেড়ে আসা মেয়েকে নিয়ে তাঁর ছোট সংসার। পার্টি করতে করতে আর নির্বাচন লড়তে লড়তে , মেয়ে বৌএর দিকে নজর দিতে পারেন নি খুব। তাই মেয়ে যখন হোস্টেল ছেড়ে আসে, পাশে বসিয়েও কারণটি জিজ্ঞেস করে উঠতে পারেন নি ভালো করে। যৌবনে স্বাধীনতার জন্যে লড়েছিলেন, কিন্তু স্বরাজ আসেনি বোঝেন। জীবনানন্দের কবিতা বুঝতেন, কিন্তু এখনকার জীবনের মানে বোঝেন না। কিন্তু ইনি কৃষ্ণসুন্দর নন। ‘বহুৎ মাছ খাইয়া এখন বিড়াল তপস্বী হইয়া’ আছেন। জীবনের শেষ বেলাতে এসে এঁর ব্যর্থতা বোধ তাঁকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে যেন। মনে হয়, জীবনে সবই হয়ে গেল, যা চেয়েছিলেন তা নয় তেমন, যা চাননি তাই। তিনি কিছু করেন না যেন। নির্বাচনের সময় এলে পার্টি তার নাম নিয়েই ফেলে, তিনিও দাঁড়িয়ে পড়েন। জিতেছিলেন একবারই। তার নামে এক জমিও এসে গেছিল। কোন এক সেটেলমেন্ট বাবুর পেন্সিলের টানে বিনামূল্যেই। নির্বাচনের সময়ে নিজের কিছু নেই দেখাবার জন্যে সমস্ত স্থাবর সম্পত্তিই লিখে দিয়েছিলেন দীপালির নামে। আজ তাঁর সত্যি মনে হচ্ছে, কিচ্ছুটি নেই। তিনি নিঃস্ব। সেখানে তিনি নুনু-যতন-গরিবাদের বসিয়েছিলেন। যতনার মতো অনেকে তাই তাঁকে দেবতা জ্ঞান করে। দীপালির বড় ইচ্ছে এই জমির একটা হিল্লে করা, দালাল নিরাপদকে জুটিয়েছেন। এখন সেখানে এক ফ্যাক্টরি বসবে। প্রসন্নের ইচ্ছে নুনু-গরিবাদের লিখে দিয়ে দেয়া। গণি মিঞা উকিল তাঁর বন্ধু ছিলেন, মারা গেছেন। তিনি থাকলে বুদ্ধি দিতেন। এখন বৌ বলে কিনা, ‘বিনবায় ধরছে, ভূদান করবা? তা চুপে চুপে ক্যান, পত্রিকায় দাও, যাতে খবর হয়।’ জমি বিক্রির জন্যে দীপালি দালাল নিরাপদের সঙ্গে নিরাপদ যোগযোগ গড়ে তোলেন। নুনুদের বস্তিতে বিপ্রের যাতায়াত ছিল। তাদের মধ্যে গিয়ে সে এক তথ্যচিত্র করে, ‘পভার্টিঃ কজ অফ ইণ্টারনেল মাইগ্রেশন’। ব্যয় কোত্থেকে আসবে, বিনয় সেই প্রশ্ন উঠলে শ্যামল, যুধিষ্ঠিরেরা জবাব দেয়, চাঁদা তুলে হবে সেই চিত্র। ‘বস্তি উন্নয়ন কমিটি’ সম্প্রতিই শুধু বানিয়ে রেশন কার্ড পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছে সে এবং তার সঙ্গীরা । জমির মালিক প্রসন্ন চৌধুরী , এ কথা জেনে বলেছিল, ‘যারই হোক, জমি ছাড়বে না।’ জমি তাঁকে জমিদার বানিয়েছিল বটে। ইয়ার দোস্ত চ্যালাও ভাল জুটেছিল। তাদেরই কেউ তাঁর কাছে নিয়ে এসছিল সদ্য বিধবা মীনারানিকে । এসছিল কাজ চাইতে, তিনি ঠাই দিলেন খামার বাড়িতে। খামার বাড়িতে ধান তোলা, সেদ্ধ করা ছাড়াও আর যা কাজ তাকে করতে হয়েছিল, তাতে শরীর ছিঁবড়ে হয়ে এসছিল। শেষ কালে প্রসন্নের পায়ে পড়ে মীনারানি ভিক্ষে করেছিল , মরলে যেন তিনি মুখে আগুন টুকু দেন। দেন নি। সকালে যে খবর দিতে এসছিল তার হাতে টাকা কটা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘দায় সারো’। তখনই আসছিল দীপালির সন্তান, মাতৃসদনে। এখন যখন মেয়ের ক্ষোভ বুঝে উঠতে পারেন না, ইচ্ছে জাগে, ‘সব যদি আবার নতুন করে শুরু করা যাইত...বড়ো ভুল হয়ে গেছে , মা...।’ বস্তুত প্রসন্ন চৌধুরীই বোধ করি সেই ব্যক্তি যিনি ‘কমলিনী’র বৃত্তান্তকে অনেক বেশি স্পষ্ট করেন। তিনি শাসক শ্রেণি এবং দলের লোক বটে, ব্যবস্থার ভেতরের লোক। কিন্তু ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক নন। ইচ্ছে করলেই সব পালটে দিতে পারেন না। বিপ্রের মনে একবার প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, ‘নিজের জীবন কি সত্যই রচনা করিতে পারিতেছে! পারা যায়? পূর্বে রচিত না হইলেও, পারিপার্শ্বিক দ্বারা রচিত হইবার নানাহ সম্ভাবনা লইয়া, জীবন রচিত হইয়া চলিতেছে। ইহাতে হয় স্রোতে ভাসিতে হইবে, নয় প্রতিস্রোতে। প্রায় সকলেই বলে, সে প্রতিস্রোতে ভাসিতেছে, কিন্তু ইহা যে আদতে স্রোত নয়, একথাই বা কে নিশ্চিত বলিবে?’ সেই প্রতিস্রোতের স্রোতকে ভয় করছিল বিপ্র। কিন্তু সেই স্রোতেই গা ভাসিয়ে বিপন্ন প্রসন্ন চৌধুরী আসলে এই উপন্যাসের এক ট্রাজিক চরিত্র। তাঁর প্রতি ঘৃণার উদ্রেক ঘটিয়ে নায়ক খলনায়কের দ্বন্দ্বে জমিয়ে তুলতে যান নি পল্লব এখানেই তাঁর মুন্সিয়ানা। বরং প্রশ্নগুলোকেই আরো ঋদ্ধ করেন। তিনি হতে চেয়েছিলেন এক ‘না-পারা স্বপ্নের সওয়ারি।’ শৈশবে অক্ষম হাতে গোরা সৈন্যের দিকে ঢিল ছুঁড়েছিলেন। মড়কের রোগীর পথ্য কিনতে গিয়ে বাবার পকেট কেটেছিলেন। আখড়াতে লাঠি খেলা, ছুরি খেলা শিখেও বিশ্বাস করতেন ‘চরখা আর খাদিতে আত্মনির্ভর হইবে পচা পানার ম্যালেরিয়া গ্রাম।’ কিন্তু মাঝ বয়সে এসে স্বাধীনতার যে চেহারা দেখলেন এবং নিজেও আঁকলেন তাতে নিজেই অবাক হন। ‘তিনি ভাবিয়াছিলেন স্বাধীন সমাজের সেনা -পুলিশের দরকার হয় না। আজ স্বাধীনতাই সেনা ও পুলিশনির্ভর। হয়তো সেই চাওয়া এক শতাব্দীর কাজ ছিল না, তবু তাহারে মূর্তি বানাইয়া, তাহার ভাবনা সহ দেশকে এমন এক অটোমোবাইলে তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে, যাহার ব্রেক নাই। ছুটিতে আছে এক অনিবার্য ধ্বংসের দিকে।’ ভয় হয়, আজকের ছেলেরাও কি সেই যৌবনের প্রসন্ন হতে গিয়ে বার্ধক্যের প্রসন্ন হয়ে পড়ছে? এখনো ইচ্ছে করে নিজেকে পাল্টাবার , কিন্তু চৌধুরী বংশের আভিজাত্যকে মরতে দিতে মন সায় দেয় না। তাঁর এই দ্বন্দ্বের শরিক নন স্ত্রী দীপালি। তাঁর সমস্যা অন্য। নষ্ট প্রসন্নের সঙ্গিনী ছিলেন আজীবন। নিজেকে এক সময় মনে হতো প্রসন্নের হাতের পুতুল। সেই পুতুল জীবন থেকে বেরিয়ে আসতেই তাঁর প্রয়াসগুলো সবল হয়েছে, যখন প্রসন্ন নিজেও আর পুতুল নাচাবার সামর্থ্য রাখেন না কোনো, চানও না। তাঁর গর্ভে মেয়ে এসছিল জ্যোতির্ময়ের সৌজন্যে। অপঘাতে সে মারা যায় । তার কাটা ছেঁড়া শরীরের ফুলে ওঠা, পচা টুকরোগুলো দিন দুই পরে পাওয়া গেছিল এক পুরোনো কুয়োতে। স্পষ্ট নয়, বোধকরি এর জন্যে প্রসন্নকেই দায়ী করেন দীপালি। ওদিকে মেয়ে একান্তে একদিন মায়ের পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করে মাকে লেখা জ্যোতির্ময়ের চিঠি। সেই থেকে তাকে আর বোঝেন না, প্রসন্ন। শহরের কলেজের হোস্টেল ছেড়ে সে অন্য বাড়িতে গিয়ে উঠে। কোথায়, কেন –কেউ জানে না। ব্যর্থজীবন প্রসন্ন ইচ্ছে করলেই জিজ্ঞেস করতে পারতেন, “এ কী কৌতুক নিত্যনূতন/ ওগো কৌতুকময়ী ,/আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে/ বলিতে দিতেছ কই ।/অন্তরমাঝে বসি অহরহ/মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ ,/মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ/ মিশায়ে আপন সুরে।” জীবনের শেষ বেলাতে এসে মনে হয় এই প্রসন্নই শুধু নুনু-গরীবাদের মধ্যে পেয়েছিলেন কমলিনীর সন্ধান। কিন্তু তখন আর তাঁর করবার বেশি কিছু ছিল না বিশেষ। শুধু উপন্যাসের শেষের দিকে নিরাপদের জবানীতে বিপ্র জানতে পায়, যে মেয়ের সন্ধানে শহরে যাবার আগে চুপিচুপি তিনি জমির সবটাই নুনু-গরিবাদের লিখে দিয়ে গেছেন। বিপ্রও এই প্রথমই মনোযোগ দিয়ে জানতে এবং বুঝতে পারে, জমিটি তাঁর। নিজের বাড়িটি , যে টুকু বোঝা যায়, তাঁকে তুলে দিতেই হয় গোল্ডেন রিসর্ট কনস্ট্রাকশনের হাতে।
               এবারে আমাদের কমলিনীর কথাতে আসতেই হবে। রাধা প্রসঙ্গে শব্দটি অজস্রবার উচ্চারিত হয়েছে বাংলা কবিতায়, গানে। নিধু বাবুর টপ্পাতে আছে, “কমলিনী অধিনী তোমার, শুন অলিরাজ।সদত তোমারে, ভাবি হে অন্তরে, এই মোর কায।” উপন্যাসের শেষের দিকে রয়েছে, বাসে চড়ে বিপ্রের চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণসুন্দর ভাবছেন, “ যাচ্ছিস, যা। জানি না, সেখানেও পাবি কিনা। তবে মনে রাখিস, কমলিনীর দিকে যাওয়ার চেষ্টাটাই আসল।”
                    কিন্তু কমলিনী কি কিছু করে না? সেও কি যায় না? উপন্যাসের শুরু হয়েছে কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে। ‘কমলিনী আমার নাম। আমারে দেখিতে সহসা আয়নার দরকার হয় না। যদিও অই ফুলটি, যাহা জাতীয়, আজ অবধি দেখিলাম না। তবু, নিজেরে যখন দেখি অই ফুলটির মনোলোভা টের পাই বিপ্রের চোখে।’ সে মেয়ে মেয়ে নয়, যে কমলিনী বা কমল ফুল দেখেনি। এই কথাটা এখন বলবার সময় এসে গেল। গুরুগম্ভীর শৈল্পীক কুশলতার সঙ্গে লেখক এক রসিকতাপূর্ণ চালাকি করেছেন পাঠকের সঙ্গে। পাঠকের মনে এক বাসনা জাগে বিপ্র-কমলিনীর প্রেম কাহিনি পড়বেন বলে। কথা যত এগোয়, তিনিও সেই ভ্রমের থেকে বেরুতে থাকেন বিপ্রের সঙ্গে সঙ্গে। অথবা বেরোন না। কমলিনী এক ভাবের নাম। অথবা এক মেয়ের নাম। এর সঙ্গে বিপ্রের আলাপ হয় বিনয়ের পাল্লাতে পড়ে। ভাব হলেও তার আবির্ভাব হঠাৎ হতে পারে নাতো। কেউ আলাপ করিয়ে দিতে হবে। লেখক পরিপক্কতার সঙ্গে কথাটি মনে রেখেছেন। বিনয় মন্ডল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিস্কের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় বলতে মনে পড়ল, ত্রিপুরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা কিন্ত ১৯৮৭তে । উপন্যাস লেখা হয়ে উঠবার পরের বছর। তাতে ক্ষতি বৃদ্ধি কিছু হয় নি। বিপ্রের সঙ্গে যেচে এসে ক্যান্টিনে আলাপ। সেই আলাপ সাত মাসের ঘনিষ্ট বন্ধুত্বে পরিণত হলো। এই সাত মাসে, ‘কমলিনী কীরূপে থাকিয়া গেল, গড়িয়া উঠিল। গড়িয়া যে উঠিল, ইহাতে তাহার তেমন ভূমিকা নাই। হয়তো সময়ের জটিলতা। যে জটিলতা লইয়া আজিকাল ঘোষের দোকানেও সে বেমানান।’ বিনয় সপ্রতিভ তরুণ। তার ভেতরে বিপ্রের চোখে ধরা পড়ে যেন যেন এক স্বপ্নের দেশ। চুম্বকের মতো টানে বিপ্র তার অনুগামী হয়ে গেল। মন্টুঘোষের দোকানে একদিন যখন সব্বাই এক জ্যোতিষকে নিয়ে ব্যস্ত হয়েছিল। বিপ্রও খেলার ছলে হাত দেখিয়েছিল, জ্যোতিষ যা বলেছিল, উপন্যাসে সেও অর্থবহ, “আপনার কিছুই পাওয়ার নেই।’ শুনে বিনয় বলছিল, ‘ কিন্তু...বৈষম্য যতদিন থাকবে,...অন্তত হাত চেপেতো আর বসে থাকা যাবে না।” তার টেবিলে তখন গুয়েভারার ডাইরি। বিপ্রের মনে হলো বিনয়ের চোখে লেগে আছে আলো। বিনয়ের সঙ্গে করেই নুনুদের বস্তিতে যায় বিপ্র প্রথম। ‘মিডলক্লাস জীবনের বাইরে যাচ্ছি।’ এই ছিল বিনয়ের উত্তর।
                  এবারে, এই মিডিলক্লাস বাইরের জীবনটি কেমন? ‘গ্রামের বাইরে, বোধ হয় খাসভূমিতে, ঘর নয়, কতগুলা ঝুপড়ি, কোনমতে বান্ধিয়া রাখা, ভাল করিয়া বাতাস আইলে লণ্ডভণ্ড হইয়া যাইবে মনে লয়; এইগুলিতে উহারা থাকে। ভিতরে খাট পালঙ্ক দূরে থাক, একটা কাঁথা কী বিছানাও নাই। দেখিয়া অবধি তাহার মনে হইতেছিল, এমন জীবন আগে দেখে নাই। ঘুমায় কোথায় জিজ্ঞাসা করায়, নুনুর বৌ অবাক চাহিয়া মাটির দিকে আঙুল দেখাইল।’ এই ‘অবাক চাহিয়া’ কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। কৃষ্ণসুন্দর একজায়গাতে ভেবেছিলেন, ‘এ-ই ভারতবর্ষ। এইখানে আসিয়া নিজেরে স্ট্রেঞ্জার বলিয়া বোধ হয়।’ বিনয়রা জানেনা তারা মাটিতে শোয় ---এই তথ্যটাই নুনু তেলেঙ্গার বৌএর কাছে অবাক কথা। বিপ্রও ভাবে, এদের সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় কী করে! ‘নুনুদের জীবনে ঢুকিয়া যাওয়া কি সম্ভব, বিনয়ের পক্ষেও? ভাবিয়া পায় না।’ কে কবে এই নুনুদের চা-বাগানের শ্রমিক করে এনেছিল নুনু নিজেও জানে না। মালিক বাগান বেচে দিলে থাকার কোন জায়গা নেই বলে নুনুরা এখানে এসে উঠে। আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি, এই জমি খাস হয়ে নেই। এ জমির মালিক প্রসন্ন চৌধুরী। চাষের কাজ জানে না বলে দিনমজুরি করে। যেদিন কাজ জুটে না পাখি শিকার করে পুড়িয়ে খায়। এই বস্তিতে গরিবারাও থাকে । সে তিনপুরুষের প্রাচীন এখানে। উপন্যাসের শুরুতে আছে কিন্তু দিন তিনেক আগেও একটি লোক বিহার থেকে এসছে। জমি ছিল না। ‘জমিদারের খেতিতে বেগার খাটুয়া বাপ, ভুখ মিটাইতে না পারিয়া উহারে ভাগাইয়াছে।’
             বিনয় আর বিপ্রকে খাওয়াবে বলে বড় আনন্দে নুনু ছুটতে ছুটতে দুটো পাখি মেরেছিল তিরে। সেই মাংস বিনয় খায় নি। বিপ্রেরও উদ্গার এসছিল। কিন্তু বিনয়, বুঝতে না দিয়ে যখন বলল, ‘মাংস বাচ্চাদের দাও নুনু। আমি খাব না...’ তখন নুনুর বকলমায় আসলে বিপ্রেরই মনে হয়েছিল, ‘বাবু, যতই চেষ্টা করো, নুনু হইতে পারিবে না। নুনু হওয়া যায় না।’ সেদিন ফিরবার পথে প্রথমে ধুলি ঝড় এবং বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছিল এদের দু’জনকে। কাছেই টিলার উপর শাদা বাড়ি। প্রসন্ন চৌধুরীর বাড়ি এটা বিপ্র বিনয় কেউ জানত না। ‘বৃষ্টিতে ভিজিতে ভিজিতে দেখে , ক্রমশ আকাশ মাঠ শাদা হইয়া যাইতেছে। সমস্ত নীলাভ কালো মুছিয়া, শাদা বাড়িটিও আর স্পষ্ট নয়, জলরঙে ধুইয়া গিয়াছে।’ বিপ্র দেখছিল দাঁড়িয়ে। বিনয় বলল, ‘বৃষ্টি আর থামবে না, চল যাই।’ কিয়ৎক্ষণ পরে বিপ্রের উত্তর, ‘ চল, অই বাড়িতে যাই।‘ ‘কী করবি গিয়ে? কাউকে চিনিস, না কেউ তোকে চেনে?’ বিপ্র তখন নিজেতে মগ্ন। বুঝিবা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। বিনয়ের আবার জিজ্ঞাসা, ‘ তুই চিনিস?’ নিজের ভাবনা বলয়ের ভেতর থেকে অস্ফুট উত্তর ‘কমলিনী’।
             বাস্তবে বাড়িটি প্রসন্ন চৌধুরীর। তাঁর একটি মেয়ে আছে। যার কোন নাম নেই উপন্যাসে। ওদিকে কমলিনীর নেই কোন শরীরী অস্তিত্ব। সেই কি কমলিনী? দুই কি এক? তাকে যে কোথাও ভালো করে দেখেছে বিপ্র, পাশে বসে দুটো মনের কথা বলেছে কোনদিন-- সেরকম একটিও তথ্য নেই গোটা উপন্যাসে। এর কি দুটো ইঙ্গিত? এক , দু’জনের সত্যিই বাস্তব সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাই উপন্যসের শেষে সেই মেয়েটি যেমন নিরুদ্দেশ, বিপ্রও যাত্রা করে সেই নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে। কিন্তু প্রবল অস্পষ্টতা আছে সেই সম্পর্কের। এমন কি, বিপ্রতো এও জানতো না বাড়িটি প্রসন্ন চৌধুরীর। যেদিন জেনেছিল, সেদিনই শুধু সে সব ছেড়ে বাসে চড়ে বসে। সুতরাং প্রথম সম্ভাবনাটি নাকচ হয়ে যায়। দুই, তেমন প্রবল না হলেও অস্পষ্টতা প্রসন্ন চৌধুরীর মনেও রয়েছে নিজের মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে। তিনি জানেনও না সে তার নিজের ঔরসজাত নয়। তিনও শহরে ছুটছেন মেয়ের সন্ধানে। পাচ্ছেন না। বিপ্র প্রসন্ন দু’জনেই তখন সন্ধান করছেন জীবনের মানে, দু’জনেই কিন্তু দুভাবে জুড়ে গেছেন নুনু তেলেঙ্গাদের জীবনের সঙ্গেও । নুনুদের জমির অধিকারের প্রশ্নে দু’জনের অবস্থানের কোনো ভিন্নতা নেই। এই অধিকার সাব্যস্ত করা নিয়ে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে লড়ছেন যখন তখনই নিজেকেও প্রসন্ন চৌধুরীর মনে হচ্ছে নিঃস্ব, তিনি যেন জানেন ভুল কোথায় হয়ে গেছে। জীবনে প্রথমবার মেয়েকে দিয়ে সেই ভুল শুধরাবার চেষ্টা নিচ্ছেন। আর ওদিকে নুনুদের গ্রামে গিয়ে বিনয়ের সেই উদ্গারের পর থেকেই বিপ্রের মনে আঁকা হচ্ছে ছবি , ‘কমলিনী’র। এ কমলিনীকে বিনয় চেনে না। বিনয় সম্পর্কে এর পর থেকে বিপ্রের উপলব্ধি হচ্ছে, ‘ উহার কোনো ঠায় ঠিকানা আদৌ ছিল না। তিক্ত বিতৃষ্ণায় চক্ষু বুজিয়া আসিল।’ এক বিকেলে বিপ্র জানছিল, গবেষণার কাজে বিনয় বিদেশ যাবে। তার ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় যাইবেন বিনয়বাবু, সে কোন দেশ? উহাতে কি বদলাইবার থাকিবে না?’
             প্রসন্ন, বিনয়, বিপ্র এবং কমলিনীর সংযোগের অনেকগুলো ইঙ্গিত আছে উপন্যাসে । সংযোগ রেখাটি যেমন হয় না সরল সোজা, তেমনিই। বাঁকা। পড়তে হয় মন দিয়ে, ধরতে হয় ‘সৃজনশীলতা’ দিয়ে। কথাটি বিনয়েরই, “ অধরাকে ধরতে হয়। ধারণাকে বাস্তব রূপ দিতে হয়। ইহাই সৃজনশীলতা।” নুনুদের জমি বাঁচাবার জন্যে উকিল বন্ধু গণি মিঞার অভাবে যখন হাহাকার করছিলেন প্রসন্ন। তার ঠিক পরের অধ্যয়টি শুরু হচ্ছে এই বাক্য দিয়ে, ‘ এই হাহাকারটি কাহারেও বুঝাইবার নয়। হয়ত বিনয়ই বুঝিত...’ কিন্তু এরপরেই বাক্যটি ঘুরে যায়, ‘ এখানে আইলেই বিপ্রের গতি কেন শ্লথ হয়।’ নুনুদের বস্তিতে যাবার পথেই টিলার উপর প্রসন্ন চৌধুরীর শাদা বাড়ি। ‘নুনুদের গ্রামে যাইবার পশ্চাতে যে এই আকর্ষণটি কম নয়, ইহাই অস্বীকার করে কীরূপে?’ জমি চলে যাবে জেনেও যখন যতনবুড়া, চধরি ‘নিশ্চিন্তে হাড়িয়া লইয়া বয়, টানিতে টানিতে ঘনঘন মাথা নাড়ায় আর হাসে’ বিরক্তি ভরে বিনয় বিপ্রকে বলে, ‘ভাব , এদের অবস্থা।’ কিন্তু এই উদ্বেগবিলাস নিয়েইতো বিনয় বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। কোন আলো ধরতে যাচ্ছে সে? এতেই কি বেঁচে থাকার কোন সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যাবে? বিপ্র জানে না। ‘শুধু ছাই উড়াইতে থাকে। একদিন এই ছাইয়ের ভিতর হইতে, কমলিনী উঠিয়া আইবে। বহুদিন পর, সে মনে মনে ডাকিয়া উঠিল, ---কমলিনী।’ নানা রূপে নানা চেহারাতে কমলিনী ধরা দেয় তার কাছে। পূর্ণস্বরূপে কক্ষনোই না। জরাগ্রস্ত অবনীমোহনকে দেখে বিপ্রের মনে হয় কমলিনী এক সাগর, নদী যেমন সাগরের দিকে ছুটে, ‘ এই জীবন কী তবে কমলিনীর দিকে যাইবার জন্যই রচিত?’ তার পরেই আছে সেই স্রোত –প্রতিস্রোতের কথা—যেগুলো আমরা আগে লিখছি। যেখানে বিপ্রের মনে জাগে এই জিজ্ঞাসা, প্রতিস্রোতটিই যে ‘আদতে স্রোত নয়, একথাই বা কে নিশ্চিতে বলিবে?’ নিজের জীবনকে অর্থহীন মনে হয়। অর্থ বুঝিয়ে দিতে পারত আবার সেই কমলিনী। আর কেউ না। কিন্তু তার সঙ্গেই ‘অই দূরত্ব আজিও ঘুচিল না।’ ভাবতে ভাবতে সে যেদিকে এগোয় সে গরিবাদের বস্তি।
         
    যা বয়ে যায় সেতো নদী। কিন্তু যা স্থির গভীর? ভাসায় না ডুবিয়ে দেয়—তার কী নাম? ‘ভাবিয়া কি কমলিনীও উন্মনা হয় না?’ কখনো বা দূরের আকাশের তারাকে দেখেও ‘কমলিনীরেও বিন্দু বলিয়া ভ্রম হয়। যেরূপ স্নিগ্ধতায় তারারা আলো ছড়ায়, তেমন স্বপ্নবৎ’ তথ্যচিত্রের পাণ্ডুলিপির লেখক বিপ্রের তেমনি কখনো আবার কমলিনীকে মনে হয়, ‘...ফ্রিজশট; স্থির হইয়া আছে। অথচ জীবন ক্রমাগত বদলাইতে আছে।’ এ আসলে বিপ্রের উদ্বেগ। জীবনের দিশা সন্ধানেই যদি জীবন যায়, তবে চলমান জীবনকে ধরে সে এগুবে কবে? করে খাবে কী , এই ভাবনাও তাকে বিব্রত করে। গরিবাদের বস্তিতে গিয়েও চরস গাঁজায় ডুবে লুম্পেন জীবন না বরণ করে নিতে হয় এই উৎকণ্ঠাও কম নয় তার। ‘কিন্তু এই হওয়াটাও যে কত কঠিন, অন্তত আজকের জন্মভিত্তির উপর দাঁড়াইয়া, একথা গরিবাই তাহারে বুঝাইয়া গিয়াছে। ভিত্তিকে মুছিয়া দিবার, হারাইয়া যাইবার প্রচেষ্টা যে ভুল, তাহা বুঝিয়াও, বুঝিবার ইচ্ছা লয় না। মনে হয় নিজেরে মুছিয়া দিতে পারিলেই, কমলিনী আসিয়া দাঁড়ায়।’ এমন অজস্র কঠিন সত্য দার্শনিক জিজ্ঞাসার সামনে লেখক পাঠককে দাঁড় করান গোটা উপন্যাসে। এবং উত্তরে ভুল- শুদ্ধের এমন দ্বান্দ্বিকতা নিয়েই পাঠকের সামনে, ‘কমলিনী আসিয়া দাঁড়ায়।’ কমলিনী নিজেই কখনো প্রশ্ন করে, ‘আমি কি কোনও দিনই স্পষ্টতা পাব না?’ বিপ্র ভেবে পায় না, ‘কমলিনী নাই বলিলে, কমলিনী থাকিবে না, এতটা কি মানিয়া লওয়া সম্ভব?’ দিনের শেষে বাড়ি ফেরা লোকের হাতে ব্যাগ দেখলে বিপ্রের মনে হয়, সেসব আগামী দিনের সঞ্চয় তাদের। ‘যত সামান্যই হোক, ইহা কি কিছুই নয়?’ অথচ নিজের দিকে তাকালেই দেখে, ‘ বাড়ি নাই, ঘর নাই, উপাধি নাই, উত্তরাধিকার নাই। এক অপরিচয়ের ভূত তাহার ভিতর ঢুকিয়া যায়।’ অস্বস্তিতে চঞ্চল কমলিনী জিজ্ঞেস করে, ‘আমি কে? বলো আমি কে?’ বিপ্রের উত্তর, ‘তুমি কমলিনী।স্থিরতা’
                 মন্টু ঘোষের আড্ডা থেকে উঠে একদিন গরিবাদের বস্তিতে গিয়ে বিপ্র এবং কৃষ্ণসুন্দর দেখেন দালাল ঘোরাঘুরি করছে। নিরাপদ। বিপ্রদের জিজ্ঞেস করে, ‘দাদাদের কী কোন কোম্পানি? হাড়িয়াতে মত্ত কৃষ্ণসুন্দর জবাব দেন, ‘টো-টো কোম্পানি।’ নিরাপদ নুনুকে বলে, ‘জমিটা বেচলে জানিও নুনুভাই।’ ‘কোন জমি?’ বিপ্রের জিজ্ঞাসা। এর পরে প্রতি প্রশ্ন আসে, ‘এটা নুনু বেচবে কী করে? এটা তো প্রসন্ন চৌধুরীর।’ কথাটি বোধকরি কৃষ্ণসুন্দরের। আগে কখনো উচ্চারণ করবার দরকার বোধ করেন নি, বললে বিস্ময়ে তাকাতো না বিপ্র। নিরাপদের মনে হয়, ‘আমি নিরাপদ, এরা দেখছি বিপদ- আপদ। সব জানে। জমির মালিকানাও।’ হাত জোড় করে সে বলে, ‘তিনিতো ভগবান মানুষ। যাওয়ার আগে, এই জমি এদের নামেই লিখে দিয়ে গেছেন।’ ‘গেছেন মানে?’ আরে না না, শহরে চলে গেছেন। যাওয়ার আগে এই জমি এদের দিয়ে গেছেন, তা কাক পক্ষীতেও জানতে পারে নি।’ ‘চৌধুরী কি এখানেই থাকতেন?’ বিপ্র আবার জিজ্ঞেস করে, এবং প্রথম জানতে পায় ‘কমলিনী’র সেই শাদা বাড়িটিতেই থাকতেন প্রসন্ন চৌধুরী। ‘মুহূর্তে তার পৃথিবী দুলিয়া উঠে। একটা শাদা বাড়ি; কাগজের মতো টুকরো টুকরো হইয়া যাহা ছড়াইয়া পড়িল। কিছুই লেখা নাই। শাদা শূন্য। এই শূন্যতায় একটি ছবি আঁকা হইয়াছিল, অথবা শূন্যতা সেই ছবি আঁকিয়া দিয়াছিল। এখন টুকরা টুকরা হইয়া সেই ছবি ভাসিতে আছে। বিপ্র দেখিতে চেষ্টা করে, সেই মুখ, সেই চোখ। কিন্তু কিছুতেই সামগ্রিকতায় মিলাইতে পারিতেছে না।” কিয়ৎক্ষণ ঘোরের পর কৃষ্ণসুন্দর জিজ্ঞেস করেন, ‘বাড়ি যাইবি না?’ বিপ্রের উত্তর, ‘ খুঁজতে হবে।’ ‘কী?’ ‘একটা বাড়ি।’ তারপরেই হচ্ছে বিপ্রের সেই বাস যাত্রা। পাঠক নিশ্চয় মুচকি হেসে ভাবতে বসবেন, ওহ! এই তাহলে কথা। তবে বাপু ঝেড়ে কাশো না কেন? প্রসন্ন চৌধুরীর মেয়েটির পেছনে ছুটছতো? কৃষ্ণসুন্দরও জিজ্ঞেস করেছিলনে, ‘খুঁজবি কীভাবে? ঠিকানা আছে?’ বিপ্র জবাব দেয়, ‘ ঠিকানা একটা নির্দিষ্ট ছাঁচ, ইহাতে কমলিনীরে আঁটিবে কেন! কমলিনী ছড়াইয়া থাকিবে ঠিকানার বাইরে। সেখানেই তাহারে খুঁজিতে হইবে। এই কথা কাহাকে বলিবে, আর বলিলেই বা কে বুঝিবে?’... শেষে গিয়ে তাই কৃষ্ণসুন্দর এই বোধে গিয়ে থামেন, ‘কমলিনীর দিকে যাওয়ার চেষ্টাটাই আসল।’
                 পল্লব যখন এই উপন্যাস লিখছিলেন, সাহিত্যে উত্তরআধুনিকতাবাদ কিম্বা যাদু বাস্তবতার কথা বেশ শোনা যাচ্ছিল। অনেকেই এই ছাঁচে ফেলে দিতে চাইলেও চাইতে পারেন উপন্যাসটিকে। পুরাকথার থেকে নেয়া কমলিনীর নামও তাদের প্ররোচিত করলেও করতে পারে। এই অব্দি এসে সব্বাই আশা করি, মেনে নেবেন যে এমন কোন আধা চেনা প্রতীচ্য তত্ত্বের আলো না ফেলেও এই উপন্যাস বেশ বুঝে ফেলা যায়। ধরেও ফেলা যায়। কোন যাদু টাদু নেই । নেই কোন বাস্তবাতিরিক্ত গল্প কথা। ছাঁচের বাইরে ঠিকানা খুঁজতে হবে বলেই কমলিনীও নয় কোন বিশৃঙ্খলার প্রতীকী নাম। সে আসলে এক নবতর শৃঙ্খলার নাম। গতির ভেতরে নবতর স্থিতির নাম। যাকে অনুধাবন করাটা আপাতত যেকোন পাঠকের বিপ্রের মতোই, লেখকের মতোই, ব্যক্তিগত কাম।
                লেখকের কথা বয়ন কৌশল নিয়ে আলাদা করে বলা যেত। কিন্তু বোধকরি ইতিমধ্যে আমরা সে পরিচয় দিয়েছি অনেক। কিন্তু এ কেমন ভাষা, ‘কান্দিতে আছে’, ‘গ্যাঁজাইবার’? একেবারে শুরুর উদ্ধৃতিটি দেখুন। এহ বাহ্য! আরো আছে। এই যেমন, “...পরনের ফিরোজ লুঙ্গিটি হাঁটুর উপর গোটানো , খালি গা, মাথায় গামছা বান্ধিয়া, তাহার বয়সি যে, এই মাত্র চাউলের বস্তাটি ট্রাক হইতে নামাইয়া, উহাদের মধ্যে আইয়া বইল, কয়দিন আগে মাত্র বিহার হইতে আইয়াছে।” কিম্বা “...বুজিবা চুকুমবুদাই, দূর রাস্তার দিকে চাহিয়া , কিছুই দেখিতেছে না, এমন দাঁড়াইয়া রহিল।” নজির লিখে গেলে তালিকা দীর্ঘ হবে। ইতিমধ্যে প্রচুর দেয়াও হয়েছে। প্রশ্নটা উঠবেই। এ কেমন ভাষা? তাই লিখছি, যিনি পড়বেন তাঁর ‘বৃত্তান্ত একা’ ঘুরে বেড়াবে। যিনি লিখেছেন তাঁরতো বটেই।
               এখন যখন এই সহজপাঠ লিখতে বসেছি তখনো মনে হচ্ছে এই জবাবদিহির দায়িত্ব এড়িয়ে এক পাও এগুনো যাবে না। আমাদের এলাকার, একালের পাঠক এই ভাষার সঙ্গে পরিচিত বটে । কিন্তু তিনি জানেন এই ভাষাতে আজকাল আর উপন্যাস কেন, কোনো কিছুই লেখা হয় না তেমন। তার উপর তিনি যে বাংলা সাধু ভাষাকে জানেন সেটি সংস্কৃতপ্রায় তৎসম শব্দ বহুল। সেই ভাষাটিকে বিদ্রূপ করে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সেই আদ্যিকালেই লিখেছিলেন“সংস্কৃত বাংলা অর্থাৎ যাকে আমরা সাধুভাষা বলে থাকি তার মধ্যে তৎসম শব্দের চলন খুবই বেশি। তা ছাড়া সেই-সব শব্দের সঙ্গে ভঙ্গির মিল করে অল্প কিছুকাল মাত্র পূর্বে গড়-উইলিয়মের গোরাদের উৎসাহে পণ্ডিতেরা যে কৃত্রিম গদ্য বানিয়ে তুলেছেন তাতে বাংলার ক্রিয়াপদগুলিকে আড়ষ্ট করে দিয়ে তাকে যেন একটা ক্লাসিকাল মুখোশ পরিয়ে সান্ত্বনা পেয়েছেন; বলতে পেরেছেন, এটা সংস্কৃত নয় বটে, কিন্তু তেমনি প্রাকৃতও নয়। যা হোক, ওই ভাষা নিতান্ত অল্পবয়স্ক হলেও হঠাৎ সাধু উপাধি নিয়ে প্রবীণের গদিতে অচল হয়ে বসেছেন। অন্ধভক্তির দেশে উপাধির মূল্য আছে।”(বাংলা শব্দতত্ত্ব ; বানান-বিধি) চলিত ভাষা , যাকে আমরা ভুল করে কখনো বা ‘মুখের ভাষা’ বলেও জানি, তাকে সাহিত্যের এবং সভার ভাষা হিসেবে দাঁড় করাবার কৃতিত্বটাও আসলে রবীন্দ্রনাথেরই, সঙ্গে ছিলেন প্রমথ চৌধুরী। এই জুটির প্রায় এক শতক পরে সেকালের সেই কৃত্রিম ভাষাতে উপন্যাস লেখা উচিত কী?-- এই প্রশ্নটি পল্লবের উপন্যাস পড়তে গেলে শুরুতেই উঠবে। তার উপর ওই ‘চাউল’, ‘চুকুমবুদাই’, ‘মাজাকি’র মতো শব্দগুলো দেখে এই প্রশ্নও উঠবে , তিনি বাংলা ভাষাটি জানেন তো?
                পল্লব নিশ্চয়ই জানেন, আমরাও জানি। শুধু জানাটা লুকিয়ে গেছে প্রতাপ লব্ধ কিছু অভ্যাসেই আড়ালে। চারপাশের বাস্তবতা । চাউল, কয়দিন, আইয়া বইল –এগুলোর সবটাই আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহৃত বাংলা ভাষারই শব্দ। আর রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত ভাষাটিও আমাদের মুখের বাংলা নয় আদৌ। যেখানকার এ মুখের ভাষা সেখানকার বই পত্তর পড়তে পড়তে সংস্কারটা আমাদের দাঁড়িয়ে গেছে মাত্র। এমনিতেও সাধু বাংলার ব্যবহার কমে গেলেও উঠে কোনদিনই যায় নি। শরৎ চন্দ্র , তারাশঙ্কর , বিভূতি ভূষণেরা দিব্যি চালিয়ে গেছিলেন এর ব্যবহার। ফুরিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিল যখন তখন একে প্রায় পুনরুজ্জীবিত করলেন এসে প্রথমে জীবনানন্দ এবং পরে কমলকুমার। কমলকুমার ফিরে গেলেন, মাইকেলী যুগে—এমনটা অনেকে বলে থাকেন। আমাদের সন্দেহ আছে। তত দাঁত খটমট যুক্তাক্ষর বহুল মাইকেলী বাংলা তিনি তেমন ব্যবহার করেন নি, বরং তাঁর পরীক্ষা নিরীক্ষা ছিল সাহেবী বাংলার বাক্য গঠন অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসার। কতটা পেরেছেন,সে অন্য বিতর্ক। কিন্তু করেছিলেন সেরকমই।
                রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথ চৌধুরী আশা করেছিলেন ‘কলকাতা’তে যেহেতু ভিড় করেন গোটা বাংলার বাঙালি, তাই ওখানকার ভাষা হয়ে উঠবে বাঙালির ভাষা। কিন্তু এটি হয়ে উঠেনি তেমন। দেশটিও ভাগ হয়ে দু’ভাগ হয় নি শুধু চার বা তারও বেশি ভাগ হয়েছে। এখনা আর বাংলার বৈচিত্র শুধু নয়, জেলার । বরং রাষ্ট্রের এবং প্রদেশের। অসম-ত্রিপুরার বাঙালিও যে বাঙালি—পুথিপত্তর সেই সত্য আড়ালে ঠেলে দিতে চাইলেও কথাটা সত্য। কলকাতার বাংলা পড়ে-শোনে বোঝেন যারা তাঁরা বিদ্বান। কিন্তু লিখতে বলতে পারেন না, অধিকাংশ বাঙালি। তাদের কাছে চলতি কিম্বা ‘মুখের ভাষা’টিও আসলে এক কৃত্রিম ভাষা, চাপানো ভাষা। আমাদের এলাকার, একালের বাঙালি সম্পর্কেও কথাটা খুবই খাঁটি। যিনি পড়েন মাও-ৎসে-তুঙের ‘ইয়েনান বক্তৃতা’ কিম্বা লুসুনের কবিতা, কিম্বা তথ্যচলচ্চিত্র করেন, ‘পভার্টিঃ কজ অফ ইণ্টারনেল মাইগ্রেশন’ নামে তিনিও ‘চলিত বাংলা’ বিশুদ্ধ বয়নে উচ্চারণে বলতে বা লিখতে পারেন না মোটেও। সেই বাঙালির গল্প ‘কমলিনীর উপখ্যান’। তাই তাঁরা যখন তাঁর উপন্যাসে চরিত্র হয়ে উঠে আসেন, তখন রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে নিজেদের ভাষাকে ছেটে উঠে আসেন নি, এসছেন সঙ্গে নিয়ে। অবিকল , অকৃত্রিম। উপন্যাসের আর প্রতিটি উপকরণ যেমন শিল্পের দাবি মেনে এসছে, মিশেছে, নবরূপ নিয়েছে –এর ভাষাটিও তেমনি। ঠিক তাই, কি? আমরা কি তবে সাধু বাংলাতে কথা বলি? নয় বটে, কিন্তু ‘সাধু বাংলা’ কথাটাও উনিশশতকী নির্মাণ ।ভাষাটি তার আগেও ছিল। আমাদের বৈষ্ণব সুফি কাব্যের ভাষা দেখুন, দেখুন পাঁচালী-মঙ্গল কাব্যগুলোর ভাষা। এ যেন প্রাদেশিক বৈচিত্রকে এক সুতোতে বাঁধতে বাঁধতে আপনিই গড়ে উঠছিল সারা বাংলার সাহিত্যের ভাষা হিসেবে। না ছিল কোনো ব্যাকরণের নির্দেশ, না ছিল কোনো শুদ্ধিকরণের সূচিবাই। তার নাম ছিল, দেশি ভাষা। বানান, শব্দপ্রকরণ, বাক্যগঠনের চরিত্রের সবটাই ছিল দেশি।সংস্কৃত বা তৎসম নয়। পল্লব সেই রীতি মেনে লিখেছেন উপন্যাস। মুখের শব্দ তিনি বসিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথও না বসিয়ে থাকেন নি। সেই যে ‘দেখলুম, খেলুম, গেলুম’ ক্রিয়াপদগুলো—নিতান্তই ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘উপভাষা’ থেকে নেয়া। পল্লবের ‘চাউল’, ‘চুকুমবুদাই’ তবে করেনি অপরাধ কোনো। যে বাঙালির এগুলো মুখের শব্দ তাঁরাও বরঞ্চ এখনো চিঠিতে, বিজ্ঞাপনে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন এহেনো বাংলা লিখতে এবং ‘কান্দিতে আছে’র মতো প্রচুর ব্যাকরণের ভুল সহই। সুতরাং এই সিদ্ধান্ত নিতেই পারি যে ‘চলিত’ সংস্কারের বাইরে বেরিয়ে এলে দেখব, যে পল্লব উপন্যাস লিখেছেন আমাদের আদি অকৃত্রিম গুরুচণ্ডালি ভাষাতেই। বরং ভাষা যখন তার অর্থবহ বর্ণনাতে বাস্তবতার ছবি আঁকে, পল্লবের ভাষা সেখানে বাস্তবতার সেই বর্ণগন্ধ ধারণ করেছে নিজের শরীরে। বোঝা যায় উপন্যাসটি আসলে ত্রিপুরার তথা পূর্বোত্তরের এক আধাশহরের মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প। কমলিনী সেই মধ্যবিত্তের সন্ধান কিনা, এই প্রশ্ন আমরাও খোলাই ছেড়ে দিলাম। শুধু এইটুকুন মনে রাখলে চলবে, যে রাধারমণ যখন এই ভাষাতেই গেয়েছিলেন, ‘আমার ছিলো আশা দিলো দাগা রে সুবল।।/আমার এই পিরিতের কার্য নয়/কেমন আছে কমলিনী রাই।' তখন সেই গানের তালে দোলেন যেসব সিলেট টিপেরার লোক তারা কিন্তু অধিকাংশই জানেন না, ডকু ফিল্ম মানে কী,আর ফিজিক্স কোন স্কুলে পড়ানো হয়। তারা সব টুনু-গরীবার আত্মীয়, হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তের দেশের লোক।

                              *******************************

কোন মন্তব্য নেই: