সপ্তর্ষি বিশ্বাস
১।
একটি প্রকৃত শিল্পবস্তু মূলতঃ পুনর্জন্ম ঘটায় পাঠকের, শ্রোতার, দ্রষ্টার। পাঠক-শ্রোতা-দ্রষ্টার মর্মে তা ঘটায় এমন কোনো পরমানগত পরবর্তন যা প্রতিফলিত হয় পাঠক-শ্রোতা-দ্রষ্টার গুনগত পরবর্তনে। ঠিক যেমন লোহাকে চুম্বকের কাছে রেখে দিলে লোহা, ক্রমে চুম্বক। তেমন বৃষ্টি হলে পাথরও হয়তো কাদা ... পক্ষান্তরে বহু শিল্প প্রচেষ্টার ছায়ায় এসে এ’ও অনুভুত হয়, যে, হলোনা, জন্মান্তর হলোনা। চুম্বকের টান লাগলো বটে কিন্তু সত্তার পরমানগত অদল বদল হলোনা। তাই হলোনা জন্মান্তর। নানা স্থানে আলোড়িত হলো মন। ঠিক। কথন নৈপুণ্যে। কোথাও। কোথাও বা প্লটের উজ্জ্বলতায়। তথাপি অন্তিমে, এক পশলা বৃষ্টি থামলে যেমন, সেই একই রোদ, একই ধূলোবালি ... ধারাস্নান, আষঢ়ের, হলোনা ...
ঠিকই একই অনুভুতি হলো দেবাশিস তরফদারের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘শরাইঘাটঃএকটি প্রেমকাহিনী’ পড়ে শেষ করার অন্তিমে। আমরা জানলাম বরাক উপত্যকার ছোট একটি শহর দীপু বলে একটি ছেলে পদার্থ বিদ্যায় স্মাতকোত্তর পাঠ নিতে এলো থেকে আসামের রাজধানী গৌহাটিতে। সময়টা সত্তরের দশকের শেষ। জানলাম তার বেশ কিছু বন্ধু বান্ধব হলো। তাদের সঙ্গে মিশে সে ‘অসমীয়া’ হলো, ‘কমরেড’ হলো। অনেক অসমীয়া গান টান শুনলো। সে জানলো অসমীয়া একটি অতি উন্নত ভাষা। হোষ্টেলে মারদাঙ্গা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকশান হলো। ক্রমে দানা বাঁধলো আসামের বিখ্যাত ‘বঙ্গাল খেদা’র আরেকটি পর্ব। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলো কিছুদিন। পরীক্ষাও তাই গেলো পিছিয়ে। দীপু ফিরে এলো। তারপর বেশ কিছুদিন পরে এড্মিট্ কার্ড পেয়ে আবার গেলো সেই হোষ্টেলে। তখন সেখানে অন্য বাতাস। পুরোনো বন্ধুরাও ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে... হারিয়ে যাচ্ছে যাপনের বাস্তবতার হাহাকারে ...
এই সবই জানলাম ‘দীপু’র মুখে আর তার বন্ধুদের নানান আলোচনায়। কিন্তু পাঠক হিসাবে ‘দীপু’কেই যে চিনলাম না ঠিক করে। দেখলাম দীপু ‘অসমীয়া’ হয়েগেলো , কিন্তু সেই হওয়াটা এতো সরল একটি পথ ধরে ঘটলো, যে, পাঠকের মনে হতে বাধ্য যে লেখক দীপুকে অসমীয়া করার জন্যই এনেছিলেন এখানে। যা’ই অসমীয়া তা’ই তার ভালো লাগে। কেন লাগে? না’ত দীপু নিজেকে এই প্রশ্ন করে কোনোখানে না’ত লেখক দেন কোনো ইঙ্গিত। ‘কমিউনিষ্ট’ হওয়ার ব্যাপারেও তা’ই। দীপু কমিউনিষ্ট হয়ে গেলো। তবে পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে তার কমিউনিষ্ট হওয়ার একটা আবছা যুক্তি খাড়া করা যায় এইভাবে, যে, যে সব ‘কমিউনিষ্ট’ ছেলেদের সঙ্গ সে পেয়েছিল তারা ছিল ‘ভালো’। তবে এই ‘ভালো’ যায় বাস্তবতার মাত্রা পেরিয়ে। ঐতিহাসিক ভাবে দেখলে এ কথা সত্য, যে, বাঙ্গালী বিরোধী তৎকালীন অসমীয়া ক্রিয়া কলাপে ‘কমিউনিষ্ট’ ছাত্র আর ‘কমিউনিষ্ট’ পার্টী সত্যিই একটি ইতিবাচক ভূমিকা বহুদিন পালন করেছিল। কিন্তু ‘যা’ই অসমীয়া তা’ই ভালো’র যে কাহন এখানে শুনিয়েছেন লেখক তা’র পেছনে যুক্তি, ব্যাখ্যা কিছু পেলামনা বিশেষ। অসমীয়া লোকগান ইত্যাদির উল্লেখ প্রায় পাতায় পাতায়। সেগুলির ভাষা ও ভাব ( আমার সীমিত অসমীয়া জ্ঞানে) অবশ্যই উন্নত কিন্তু যে বাঙ্গালী ছেলে ‘দীপু’ কবিতা টবিতা পড়ে, সাহিত্য রসিক সে’কি পূর্ব বা পশ্চিম বাংলার লোকগান কোনোদিন শোনেনি? যদি শুনে থাকে তাহলে সেগুলির ভাব, ভাষা তাকে কি স্পর্শ করেনি? কাহিনীর দীপু’র কাছে এ বিষয়ে কিছুই আমরা শুনিনা। আর শুনিনা বলেই মনেহয় যে দীপু’কে হাজিরই করা হয়েছে অন্তিমে ‘অসমীয়া’ বানানোর জন্য। কিন্তু কেন এই বানানো? জানিনা। দীপু অতোদূর অসমীয়া নাহলেও কাহিনীর কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হতো কি? হয়তো হতো। সে বিষয়ে আসছি পরে। আপাততঃ রচনাটির স্থাপত্য-চরিত্রের দিকে একটু ফিরে যাই।
এটি কি উপন্যাস না’কি দিনলিপি না’কি নানা জনের নানা কথা’র একটি রানিং কমেন্ট্রি? যারা কথা বলছে তাদের রক্তমাংসের অস্তিত্ব বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার আগেই তাদের কথার তোড়ে ভেসে যেতে হচ্ছে পাঠককে। কিন্তু এ’কে ঠিক হালের ‘appearance is essence’ তত্ত্ব দিয়েও ব্যাখ্যা করতে পারিনা কেননা এদের ‘appearance’ ই বিশ্বাসযোগ্য হয়না সর্বত্র। একই সমস্যা দীপু’কে নিয়েও। দীপু একটি দিন থেকে আরেকটি দিনে পৌঁছায়। পাঠককে, রচনাটি পুরো পড়ে শেষ করবার তাগিদ ছাড়া অন্য কোনো কারনে প্রয়োজন হয়না তাকে অনুসরন করবার। হ্যাঁ, ‘কথা’ কোথাও কোথাও জমে ওঠে। ঠিক। কিন্তু পর মুহুর্তেই যেন তার রেশ যায় হারিয়ে। রাশ যায় আলগা হয়ে।
কি কথা বলে দীপু? কি কথা বলে তার সঙ্গী সাথীরা? তারা নানা বিষয়ে কথা বলে। রাজনীতি থেকে কবিতা। ঠিক যেমন সুনীল গংগো’র ‘আত্মপ্রকাশ’এর চরিত্ররা বলতো। ঐ অনর্গল কথা বলা ছাড়া ‘আত্মপ্রকাশ’এর চরিত্রেরা যেতো শূঁড়ি খানা আর গণিকালয়ে আর এরা যায় কমলালয়’এ, চায়ের দোকানে, ক্লাসে, হোষ্টেলের ক্যান্টিনে ... কেন যে শূঁড়ি খানা আর গণিকালয়ে যায়না তা’ও এক প্রশ্ন ...
‘দীপু’র পাশাপাশি মনেপড়ে ‘অনি’কে। অনিমেষ। অনিমেষ মিত্র। সমরেশ মজুমদার’এর ‘কালবেলা’র। সে’ও এমনি এক ছোটো শহর থেকে এসেছিল কলকাতায়। এমনি এক টাল মাটাল সময়ে। সে’ও ক্রমে হয়ে উঠেছিল ‘কলকাতা’র ছেলে। হয়ে গিয়েছিল ‘কমিউনিষ্ট’। কিন্তু তার এই হয়ে ওঠা স্রেফ কথায় কথায় হয়ে ওঠা ছিলনা। সব কিছুর আগে সে নিজে পরিগ্রহ করেছিল রক্ত মাংসের চরিত্র। তারপর, ক্রমে, আমরা দেখেছি, বহু দ্বিধা, দ্বন্দ্ব পার হয়ে তার ‘কমিউনিষ্ট’ হওয়া, ‘নকশাল’ হওয়া। আড্ডা, ‘কথা’ আমরা শুনেছি সেখানেও, সেখানেও হোষ্টেল-মেস্’এর অন্দর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দার আমরা হেঁটেছি অনিমেষের সঙ্গে, মাধবীলতার সঙ্গে। কিন্তু সেই হাঁটা নেহাৎই রচনাটিকে পড়ে শেষ করবার তাগিদে নয়। আমাদের প্রাণের তাগিদে। ... তাই ‘কালবেলা’, না’ইবা হলো ‘জাঁ ক্রিস্তফ্’ বা ‘অপরাজিত’ তথাপি অন্তিমে সে’ও এক পুনর্জন্মের ইঙ্গিত রেখেযায় ... আর ঐ ইঙ্গিত এতোই বাস্তব যে প্রায় কুড়ি বৎসর আগে পড়া উপন্যাসটি, এই লেখাটি লিখতে লিখতে, আবারো খুলে বসে দেখি প্রায় প্রতিটি অধ্যায় এখনো মনে আছে সে রকমই ...
দেবাশিস তরফদারের ‘শরাইঘাটঃএকটি প্রেমকাহিনী’র অন্ততঃ কিছু ‘কথা’, কিছু অংশ দাবী রাখে আসামের, অসমীয়াদের বাঙ্গালী বিদ্বেষের ইতিহাসের নিরিখে বিচার করার। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সেড়ে নিই আরো কিছু আনুষাঙ্গিক কথা... যেমন...রচনাটির নামে ‘শরাইঘাট' এর পরে 'একটি প্রেমকাহিনী' কথা গুলো বলার কোনো দরকার ছিলো কি? প্রেম কাহিনী না'কি বিচ্ছেদ-গাথা সেটা পাঠককে তার মতো করে বুঝে নিতে এই বাক্যবন্ধটি অসুবিধা সৃষ্টি করে। অন্তিমে এ'ও মনেহয় যে, যেহেতু লেখক নিজেও গ্রন্থটির 'প্রেমকাহিনী' চরিত্রটি নিয়ে নিশ্চিত নন তা'ই নামে ঐ বাক্য-বন্ধ ব্যবহার করলেন ...
একই প্রশ্ন জাগে লেখক যখন রচনা শরীরের বাইরে গিয়েও বার বার বলে যেতে থাকেন এই রকমের কথাঃ
রাসকিন বন্ড আমারো অতি প্রিয় এবং পূজনীয় লেখক। ফলে এই রচনাটি লিখতে বসার আগে আমি পড়ে নিই উল্লিখিত ঐ উপন্যাসটিও এবং পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করি যে এই কাহিনীর ভিত্তিতেই শ্যাম বেনেগার তাঁর আঙ্গুলে ‘ভালো ছবি’র একটি, ‘জুনুন’ করেছিলেন...। সমরেশ মজুমদার’এর ‘কালবেলা’ যেমন নকশাল আন্দোলন, A Flight of Pigeons’ এ’ও তেমনি সিপাহী বিদ্রোহ নির্মাণ করে আবহ। কিন্তু দুইটি উপন্যাসেই এই দুইটি ঐতিহাসিক ঘটনা নিছক মূক আবহ হয়ে থাকেনা। ‘কালবেলা’ তে লেখক, ক্রমে, নকশালপন্থী রাজনীতির প্রতি তাঁর সমর্থনের কথা জানান দেন এবং অনিমেষের ( না’কি মাধবীলতা’র ?) টানে পাঠকের সমর্থনও নেন আদায় করে। A Flight Of Pigeons’এর ভূমিকায় বন্ড লিখেনঃ “In retelling the tale for today’s reader I attempted to bring out the common humanity of most of the people involved— for in times of conflict and inter-religious or racial hatred, there are always a few (just a few) who are prepared to come to the aid of those unable to defend themselves I published this account as a novella about thirty years ago. I feel it still has some relevance today, when communal strife and religious intolerance threaten the lives and livelihood of innocent, law-abiding people. It was Pascal who wrote, ‘Men never do evil so completely and cheerfully as when they do it from religious conviction.’ Fortunately for civilization, there are exceptions.” আর তাঁর রচনাতেও তাই, প্রকারান্তরে, সমালোচিত যতোটা হয় সিপাহী বিদ্রোহ তার বেশী আলোচিত হয় মানবমনের অন্দর-রহস্য। বন্ড্ কিন্তু এ’ও বলেন, যে, এই কাহিনী ’ may be based on fact’
কিন্তু ‘ ‘শরাইঘাটঃএকটি প্রেমকাহিনী’’ বিষয়ে লেখকের বক্তব্যঃ
‘বানিয়ে বলা সত্য’। ঠিক। কিন্তু ‘সত্য’ টি কি? সত্যটি যদি এ’ই হয় যে দীপু নামক একটি ছেলের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো দিনগুলি তাহলে প্রশ্ন ওঠে ঐ দিনগুলির কথা পাঠকের কোন ফিজিক্যাল বা মেটাফিজিক্যাল দরকারে লাগবে যে অর্থে বন্ডের সৃষ্ট রুথ্ বা জাভেদ খান’কে জানার মাধ্যমে পাঠক জেনেনেন মানব মনের আরেক দিগন্তকে? যে অর্থে অনিমেষ বা মাধবীলতা’কে জানার মাধ্যমে পাঠক জেনে নেন সত্তরের দশক’কে ‘মুক্তি’র দশক করার স্বপ্নের বিনিময়ে পোচ্ছিম বোঙ্গের ভামপন্থী সরকার ঠিক কি দিয়েছিল যুবসমাজকে ...
সত্যটি যদি এ’ই হয় যে দীপু নামক একটি ছেলের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো দিনগুলি তাহলে এই আলোচনার পরের অংশের প্রয়োজন অন্ততঃ আমার কাছে ছিলোনা কিছু, কিন্তু সত্যটি যদি এ’ই হয় যে দীপু নামক একটি ছেলের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো দিনগুলির বর্ণনের আনাচে কানাচে লেখকের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ঢুকেপড়া কিছু ‘কথা’, কিছু ‘সুর’ আমাকে বাধ্য করে পরের অংশটি লিখতে।
২।
রচনার প্রথম পংক্তিতেই আমরা জানতে পারি যে সেটা ১৯৭৭ ইংরেজি। অর্থাৎ ১৯৬৯ এর দিনগুলি তখন ক্যালেন্ডারে রক্তাক্ত-উপস্থিত। বাঙ্গালী তার নিজের ভাষায় কথা বলতে চেয়ে আন্দোলন করলে আসাম সরকার চালিয়েছে গুলি। ১৯ শে মে শিলচরে শহীদ হয়েছে এগারোজন ছেলেমেয়ে। ১৯৭২ এ খুন হয়েছে বাচ্চু চক্রবর্তী। আসামের সরকার পায়ে পিষে মুছে দিতে চেয়েছে আসামের বাংলীর অস্তিত্ব – যে বাঙ্গালীদের বাস আসামের বরাক উপত্যকায়, যে বাঙ্গালীরা পার্টিশানের আগে পর্যন্ত ছিল পূর্ব বাংলার বাসিন্দা ... ফলতঃ সেই বাঙ্গালী যখন ‘রাষ্ট্র’ নামক যন্ত্রের অনর্গত অমীমাংসিত দ্বন্দ্বের কারনে হয়ে পরলো আসামের বাসিন্দা তখন স্বভাবতঃই তাদের কাছে অসমীয়া ভাষা হলোনা গ্রহনযোগ্য, তারা শিখলোনা অসমীয়া, তারা অসমীয়া অধ্যুষিত ‘আপার’ আসামকে বল্লো ‘আসাম’। কাজেই রচনার প্রথম পাতাতেই, ঈষৎ ব্যাঙ্গের সুরে যখন লেখক বলেনঃ ‘ উহার দেশ কাছাড়ে, যে দেশকে আজকাল বরাক ভ্যালি বলা হইয়া থাকে; যাহা আসামেরই একটি জিলা অথচ যে দেশ হইতে ট্রেনে চাপিবার সময় লোকে ‘আসাম যাইতেছি’ বলিয়া থাকে’। -এই উচ্চারনে ‘যেন‘আসাম যাইতেছি’ না বলিলেই ভালো হইত, ‘আসাম’ই আমাদের দেশ বলিয়া ভাবিতে পারিলে ভাল হইত’ এমন একটি ইঙ্গিত রয়েছে কোথাও আর যে ইঙ্গিতটি, মূলতঃ, এই রচনার মূল সুর। অর্থাৎ বাঙ্গালীরা অসমীয়াদের ‘বুঝলো’ না, ‘কর্তা’ বলে মেনে নিলোনা এমন একটি কথা সর্বত্র প্রচ্ছন্ন। কাছাড় বা বরাকের লোকে অসমীয়া বলেনা, জানেনা বলে দীপু প্রায়ই লজ্জা পায়, দুঃখ পায়, কিন্তু দীপু এটা ভাবেনা যে এইসব বাঙ্গালীরা যে ঐতিহাসিক বাস্তবতার থেকে আজ ‘আসাম’এর বাসিন্দা সেই ঐতিহাসিক বাস্তবতার কোনোখানে অসমীয়া ছিলোনা। তারপরেও হয়তো বরাকের বাঙ্গালী অসমীয়া শিখতে পারতো যদি না তাকে বন্দুক দিয়ে শেখানোর চেষ্টা করতো অসমীয়া ‘প্রভু’ রা। ১৯৬৯’এর ইতিহাস, কিছুটা, এখানে তুলে দিচ্ছি www.unishemay.org নামক ওয়েব-পাতা থেকেঃ
“... In 1961 when world woke up to celebrate the birth centenary of its poet-laureate, Rabindranath Tagore, the two banks of Barak rose to an wake up call to defend its legitimate right to sing in Tagore’s language, to dream in Tagore’s language, to live a Bengali life. In the railway track of the district town, Silchar of the then undivided district of Cachar of Assam, ten young men and a woman fell down to the bullets of the state police. In the aftermath of the valiant sacrifices of the martyrs, Bengali was made the official language of the three districts of present day Barak valley. The struggle that gave back Bengali its rightful place was never a struggle of the Bengalis’ alone. First to resign from Assam Legislative Assembly in protest of firing was Nanda kishore Singha, a Bishnupriya Manipuri. In a silent protest against the brutal police firing and consequent death of eleven martyrs, thousands of Khasi men and women were on the streets of Shillong. The pluralism exuded out of these events was the essence of the language struggle of 1961. Struggle for a pluralistic polity and life in a multilingual, multiethnic state like Assam is the uniqueness of the Bengalis’ language struggle of the state. Struggle for pluralism against the chauvinistic policies of the ruling classes took its thread from 1961 and went through the tumultuous events of 1972, 1986 and 1995. Bachchu Chakraborty in 1972, Jaganmoy Deb (Jagan) and Dibyendu Das (Jishu) in 1986, in Karimganj and valiant Sudeshna Sinha, a fighter for the cause of her mother tongue, Bishnupriya Manipuri in 1995 in Kalkalighat- followed the footsteps of the eleven martyrs of 1961 and joined the long column of glorious martyrs of history. History and Geography of this land, for long have been engaged in a duel which left an indelible imprint on the archaic memory of the populace. Our literature, our music and our folklore murmur the never-ending agony, the refrain of eternal tragedy of this land. The saga of our journey through the lonesome roads of history remains unheard till date.”
অথচ সংবেদনশীল, সাহিত্য-প্রেমী, উদারমনা দীপু’র মর্মের কোনোখানে এই বাস্তবতার চিহ্নমাত্র নেই। বরং ‘আমগো ভাষা অহইম্মা’ কাহিনীর সত্যতা নিয়ে সে প্রকাশ করে সংশয়। রচনার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখক বলেন ‘আসিবার সময় ( অর্থাৎ দীপু’র ‘আসাম’এ পড়তে আসার সময়) নানাজনে বুঝাইয়াছিল যে আসামে এখন কোনো গন্ডগোল নাই, ৬১ সালের রাজ্যভাষা আন্দোলন এবং ৭২ সালের শিক্ষামাধ্যম আন্দোলনের রেশ কিছুমাত্র নাই’। যেন ঐ আন্দোলনগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা কোনো ‘স্ট্রাইক-স্ট্রাইক’ খেলা ... হায়, রচনাটির আবহ ১৯৭৭ হলেও রচনাটি যখন লিখিত হচ্ছে তখন অসমীয়া আগ্রাসনের, অতি নিম্নমানের জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটে গেছে একাধিকবার, তথাপি, বিষয়গুলিকে লেখক আনলেন এমনি হাল্কা চালে! হায়, এই প্রসঙ্গগুলি উল্লেখ না করলেও কিন্তু রচনার কিছু ক্ষতি বৃদ্ধি হতোনা! তেমনি ‘আমগো ভাষা অহইম্মা’র উল্লেখ না করলেও চলতো। তবু তা’ও উল্লেখ করলেন লেখক, লিখলেনঃ ব্রহ্মপুত্র ভ্যালির বাঙ্গালী মুসলমানদের কেউ কেউ নিজেকে অসমীয়া বলিয়া পরিচয় দেয় এবং বাঙ্গালী হিন্দুদের একটু এড়াইয়া চলে। দাঙ্গার সময় উহারা নাকি অসমীয়া হইয়া যায়। উহাদের বিষয়ে একটি মজার জনশ্রুতি আছে, যে, লোকগণনার সময় উহারা নাকি বলিত – আমাগো ভাষা অহইম্যা’ – এতোদূর বলেই আবার ব্র্যাকেটে এন্টিডোট্ দিয়ে রাখলেন লেখক – ‘ সত্যমিথ্যা বলা মুশকিল, যদুকাকার স্টকে এরকম গল্প থাকে’... ‘আমগো ভাষা অহইম্মা’ যেন একটি রগড় ... হায়, আসামে যে অসমীয়ারাই প্রকৃতার্থে সংখ্যালঘু এই তথ্যটি ঢাকতে বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙ্গালী মুসলমানদের অভয় দিয়েছিল অসমীয়ারা। বলা হয়েছিল মাতৃভাষা ‘অসমীয়া’ হলে কোনো ‘ডর’ নেই। ভোটাধিকার পাক্কা। কেননা এতে আসামে ‘অসমীয়া ভাষী’ জনতার পরিসংখ্যানে যে প্রভাব তা’তে প্রমাণিত হবে আসামে ‘অসমীয়ারা’ই সংখ্যা গড়িষ্ঠ। অতএব ‘আপার আসাম’ (ধেমাজি, ডিব্রুগড়,লখিমপুর, গোলাঘাট, শিবসাগর ও তিনসুকীয়া) এর নানা স্থানে বসবাসকারী বঙ্গভাষী জনতার এক বৃহৎ অংশ ‘তোমার মাতৃভাষা কী’ এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন ‘আম্গো ভাহা অহইম্মা’। তথাপি ঘটেগেলো ‘নেলী’। ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী প্রকাশ্য দিবালোকে নগাঁও’এর নেলীতে খুন হলেন ২১৯১ মানুষ ( বেসরকারী হিসেবে ৫০০০ এর’ও বেশী)। এঁরা মূলতঃ বাংলাভাষী মুসলমান। এঁদেরকে খুন করা হলো কেননা এঁরা চলেছিলেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে। হয়তো আসামের অসমীয়া ‘প্রভু’দের পক্ষে ঐ ভোটাধিকারের প্রয়োগফল হতোনা তেমন সুবিধা জনক সুতরাং ঘটে গেলো এই গনহত্যা। অর্থাৎ ‘আম্গো ভাহা অহইম্মা’ বলেও জান বাঁচাতে পারলেন না আসামের অনসমীয়া জনতা। এই গণহত্যার পেছনের আরেকটি বাস্তবতা ছিল এই, যে, ঐ উদ্বাস্তু মুসলমানেরা যে জমিকে করেছিল সোনা ফলানোর জমি তা’ই অসমীয়ারা বহু আছে ‘পতিত জমি’ বলে দিয়েছিল ছেড়ে। এবার সোনা যে’ই ফললো তখন এই জমিতো আর থাকতে পারেনা অনসমীয়ার দখলে ...
আহা দীপু, মহান দীপু, সে এসব জানেনা, বোঝেনা, ফলে সে ‘অসমীয়া’ হয়ে যায় সহজেই। তার যজ্ঞেশ্বর-টংকে’রাও এসব জানেনা তাই ‘সরল’ ভাবে বলে ‘শিলচর কি আসাম নয়’... হায়, আমি, অধম পাঠক, এই বাস্তবতাগুলিকে ভুলতে পারিনা বলে দীপুর এইসব মহান ভাবনাকে ‘ন্যাকামি’ ছাড়া অন্য কোনো সংজ্ঞাই দিতে পারিনা ...।আর দীপু শুধু অসমীয়া হয়ে গেলেই ক্ষতি কিছু ছিলোনা সে যদি আবার বাঙ্গালী বিদ্বেষীও না হয়ে উঠতো। বিহু দেখে দীপু মুগ্ধ। অতি উত্তম। কিন্তু যারা বিহু দেখে ততো মুগ্ধ নয় তাদের প্রতি কটাক্ষ কেন দীপুর? সে হয়তো ধামাইলে মুগ্ধ। দীপু তার খোঁজ করেনা। হ্যাঁ এর মনোভাবের মধ্য দিয়ে লেখক যদি তথাকথিত ‘জাতীয় ঐক্য’এর ধ্বজাধারীদের ভন্ডামীর দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষন করার ইঙ্গিত করে থাকেন তাহলে এর একটা কোনো অর্থ হয়। নতুবা এ কি নয় সরাসরি বাঙ্গালী’র প্রতি কটাক্ষ? হ্যাঁ অসমীয়াদের কিন্তু justify করছে দীপু, বলছে ‘একজন বাঙ্গালী বিদ্বেষীও প্রেম করে, চাঁদের আলো ভালোবাসে, গান শোনে পাগলের মতো। সে একজন মানুষ। আজকাল ঘন ঘন দীপুর এই অনুভব হয়’। - অতি উত্তম অনুভব। এই অনুভবের পাশাপাশি দীপু কিন্তু এটা অনুভব করেনা যে ‘একজন অসমীয়া বিদ্বেষীও প্রেম করে, চাঁদের আলো ভালোবাসে, গান শোনে পাগলের মতো। সে একজন মানুষ’। বরং বাঙ্গালী ছেলে উদয়ন বিশ্বাস যখন দীপুকে বলে যে এবার অসমীয়ারা বাঙ্গালী পেটাবে ফলে এখন হোষ্টেল থেকে চলে যাওয়াই মঙ্গল, দীপু কিন্তু তাকে আঁকে কালো কালিতে, বলে ‘কাপুরুষ’। একইভাবে আরেকটি বাঙ্গালী চরিত্র, যে মূলতঃ অসমীয়াদের আন্দোলনের মূল চরিত্রটি নিয়ে কথা বলছিল ট্রেনে যেতে যেতে, তাকেও দীপু আঁকে সেই কালো কালিতেই। বলে এর বীরত্ব গৌহাটি স্টেশনে এসেই মিইয়ে যাবে। হায় দীপু, অদ্যাপি আমাদের মতো যাদের ভিটে বাড়ি আসামে অথচ পেটের ধান্দায় থাকতে হয় ভারতবর্ষের অন্যত্র, তারা অদ্যাপি দেখি, যে, হাওড়া থেকে গৌহাটি অভিমুখে ট্রেন ছাড়লে গাড়ি ব্যান্ডেল পার হওয়া পর্যন্ত অসমীয়া যাত্রীর আপ্রান (ভুল ভাল) বাংলা বলেযায় আর ব্যান্ডেল পার হলেই অসমীয়া ছাড়া জানেনা অন্য কিছু। পক্ষান্তরে গৌহাটি থেকে হাওড়ার দিকের ট্রেনে, ব্রহ্মপুত্র ব্রীজ পার হওয়ামাত্রই শুরু হয় তাদের বংগ-বাতচিত ...
#
আর বেশী উদাহরন টেনে লাভ নেই। দীপু’র অসমীয়া হয়ে ওঠার মাধ্যমে লেখক যদি জাতীয় সংহতির দিকে অঙ্গুলী নির্দেশের কথা ভেবে থাকেন তাহলে বলতে হয়, না, সংহতি এভাবে হয়না। এই রচনাও মূলতঃ একদেশদর্শী। এই রচনা যদি হয় নেহাৎই স্মৃতিকথা তাহলে বলতে হয় দ্বিতীয় সংস্করনে দীপু’কে অসমীয়া করেও তার মধ্যে সুপ্ত বাংগালী বিদ্বেষকে ফিল্টার না করলে দীপুকে হজম করা মুশকিল।
১।
একটি প্রকৃত শিল্পবস্তু মূলতঃ পুনর্জন্ম ঘটায় পাঠকের, শ্রোতার, দ্রষ্টার। পাঠক-শ্রোতা-দ্রষ্টার মর্মে তা ঘটায় এমন কোনো পরমানগত পরবর্তন যা প্রতিফলিত হয় পাঠক-শ্রোতা-দ্রষ্টার গুনগত পরবর্তনে। ঠিক যেমন লোহাকে চুম্বকের কাছে রেখে দিলে লোহা, ক্রমে চুম্বক। তেমন বৃষ্টি হলে পাথরও হয়তো কাদা ... পক্ষান্তরে বহু শিল্প প্রচেষ্টার ছায়ায় এসে এ’ও অনুভুত হয়, যে, হলোনা, জন্মান্তর হলোনা। চুম্বকের টান লাগলো বটে কিন্তু সত্তার পরমানগত অদল বদল হলোনা। তাই হলোনা জন্মান্তর। নানা স্থানে আলোড়িত হলো মন। ঠিক। কথন নৈপুণ্যে। কোথাও। কোথাও বা প্লটের উজ্জ্বলতায়। তথাপি অন্তিমে, এক পশলা বৃষ্টি থামলে যেমন, সেই একই রোদ, একই ধূলোবালি ... ধারাস্নান, আষঢ়ের, হলোনা ...
ঠিকই একই অনুভুতি হলো দেবাশিস তরফদারের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘শরাইঘাটঃএকটি প্রেমকাহিনী’ পড়ে শেষ করার অন্তিমে। আমরা জানলাম বরাক উপত্যকার ছোট একটি শহর দীপু বলে একটি ছেলে পদার্থ বিদ্যায় স্মাতকোত্তর পাঠ নিতে এলো থেকে আসামের রাজধানী গৌহাটিতে। সময়টা সত্তরের দশকের শেষ। জানলাম তার বেশ কিছু বন্ধু বান্ধব হলো। তাদের সঙ্গে মিশে সে ‘অসমীয়া’ হলো, ‘কমরেড’ হলো। অনেক অসমীয়া গান টান শুনলো। সে জানলো অসমীয়া একটি অতি উন্নত ভাষা। হোষ্টেলে মারদাঙ্গা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকশান হলো। ক্রমে দানা বাঁধলো আসামের বিখ্যাত ‘বঙ্গাল খেদা’র আরেকটি পর্ব। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলো কিছুদিন। পরীক্ষাও তাই গেলো পিছিয়ে। দীপু ফিরে এলো। তারপর বেশ কিছুদিন পরে এড্মিট্ কার্ড পেয়ে আবার গেলো সেই হোষ্টেলে। তখন সেখানে অন্য বাতাস। পুরোনো বন্ধুরাও ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে... হারিয়ে যাচ্ছে যাপনের বাস্তবতার হাহাকারে ...
এই সবই জানলাম ‘দীপু’র মুখে আর তার বন্ধুদের নানান আলোচনায়। কিন্তু পাঠক হিসাবে ‘দীপু’কেই যে চিনলাম না ঠিক করে। দেখলাম দীপু ‘অসমীয়া’ হয়েগেলো , কিন্তু সেই হওয়াটা এতো সরল একটি পথ ধরে ঘটলো, যে, পাঠকের মনে হতে বাধ্য যে লেখক দীপুকে অসমীয়া করার জন্যই এনেছিলেন এখানে। যা’ই অসমীয়া তা’ই তার ভালো লাগে। কেন লাগে? না’ত দীপু নিজেকে এই প্রশ্ন করে কোনোখানে না’ত লেখক দেন কোনো ইঙ্গিত। ‘কমিউনিষ্ট’ হওয়ার ব্যাপারেও তা’ই। দীপু কমিউনিষ্ট হয়ে গেলো। তবে পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে তার কমিউনিষ্ট হওয়ার একটা আবছা যুক্তি খাড়া করা যায় এইভাবে, যে, যে সব ‘কমিউনিষ্ট’ ছেলেদের সঙ্গ সে পেয়েছিল তারা ছিল ‘ভালো’। তবে এই ‘ভালো’ যায় বাস্তবতার মাত্রা পেরিয়ে। ঐতিহাসিক ভাবে দেখলে এ কথা সত্য, যে, বাঙ্গালী বিরোধী তৎকালীন অসমীয়া ক্রিয়া কলাপে ‘কমিউনিষ্ট’ ছাত্র আর ‘কমিউনিষ্ট’ পার্টী সত্যিই একটি ইতিবাচক ভূমিকা বহুদিন পালন করেছিল। কিন্তু ‘যা’ই অসমীয়া তা’ই ভালো’র যে কাহন এখানে শুনিয়েছেন লেখক তা’র পেছনে যুক্তি, ব্যাখ্যা কিছু পেলামনা বিশেষ। অসমীয়া লোকগান ইত্যাদির উল্লেখ প্রায় পাতায় পাতায়। সেগুলির ভাষা ও ভাব ( আমার সীমিত অসমীয়া জ্ঞানে) অবশ্যই উন্নত কিন্তু যে বাঙ্গালী ছেলে ‘দীপু’ কবিতা টবিতা পড়ে, সাহিত্য রসিক সে’কি পূর্ব বা পশ্চিম বাংলার লোকগান কোনোদিন শোনেনি? যদি শুনে থাকে তাহলে সেগুলির ভাব, ভাষা তাকে কি স্পর্শ করেনি? কাহিনীর দীপু’র কাছে এ বিষয়ে কিছুই আমরা শুনিনা। আর শুনিনা বলেই মনেহয় যে দীপু’কে হাজিরই করা হয়েছে অন্তিমে ‘অসমীয়া’ বানানোর জন্য। কিন্তু কেন এই বানানো? জানিনা। দীপু অতোদূর অসমীয়া নাহলেও কাহিনীর কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হতো কি? হয়তো হতো। সে বিষয়ে আসছি পরে। আপাততঃ রচনাটির স্থাপত্য-চরিত্রের দিকে একটু ফিরে যাই।
এটি কি উপন্যাস না’কি দিনলিপি না’কি নানা জনের নানা কথা’র একটি রানিং কমেন্ট্রি? যারা কথা বলছে তাদের রক্তমাংসের অস্তিত্ব বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার আগেই তাদের কথার তোড়ে ভেসে যেতে হচ্ছে পাঠককে। কিন্তু এ’কে ঠিক হালের ‘appearance is essence’ তত্ত্ব দিয়েও ব্যাখ্যা করতে পারিনা কেননা এদের ‘appearance’ ই বিশ্বাসযোগ্য হয়না সর্বত্র। একই সমস্যা দীপু’কে নিয়েও। দীপু একটি দিন থেকে আরেকটি দিনে পৌঁছায়। পাঠককে, রচনাটি পুরো পড়ে শেষ করবার তাগিদ ছাড়া অন্য কোনো কারনে প্রয়োজন হয়না তাকে অনুসরন করবার। হ্যাঁ, ‘কথা’ কোথাও কোথাও জমে ওঠে। ঠিক। কিন্তু পর মুহুর্তেই যেন তার রেশ যায় হারিয়ে। রাশ যায় আলগা হয়ে।
কি কথা বলে দীপু? কি কথা বলে তার সঙ্গী সাথীরা? তারা নানা বিষয়ে কথা বলে। রাজনীতি থেকে কবিতা। ঠিক যেমন সুনীল গংগো’র ‘আত্মপ্রকাশ’এর চরিত্ররা বলতো। ঐ অনর্গল কথা বলা ছাড়া ‘আত্মপ্রকাশ’এর চরিত্রেরা যেতো শূঁড়ি খানা আর গণিকালয়ে আর এরা যায় কমলালয়’এ, চায়ের দোকানে, ক্লাসে, হোষ্টেলের ক্যান্টিনে ... কেন যে শূঁড়ি খানা আর গণিকালয়ে যায়না তা’ও এক প্রশ্ন ...
‘দীপু’র পাশাপাশি মনেপড়ে ‘অনি’কে। অনিমেষ। অনিমেষ মিত্র। সমরেশ মজুমদার’এর ‘কালবেলা’র। সে’ও এমনি এক ছোটো শহর থেকে এসেছিল কলকাতায়। এমনি এক টাল মাটাল সময়ে। সে’ও ক্রমে হয়ে উঠেছিল ‘কলকাতা’র ছেলে। হয়ে গিয়েছিল ‘কমিউনিষ্ট’। কিন্তু তার এই হয়ে ওঠা স্রেফ কথায় কথায় হয়ে ওঠা ছিলনা। সব কিছুর আগে সে নিজে পরিগ্রহ করেছিল রক্ত মাংসের চরিত্র। তারপর, ক্রমে, আমরা দেখেছি, বহু দ্বিধা, দ্বন্দ্ব পার হয়ে তার ‘কমিউনিষ্ট’ হওয়া, ‘নকশাল’ হওয়া। আড্ডা, ‘কথা’ আমরা শুনেছি সেখানেও, সেখানেও হোষ্টেল-মেস্’এর অন্দর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দার আমরা হেঁটেছি অনিমেষের সঙ্গে, মাধবীলতার সঙ্গে। কিন্তু সেই হাঁটা নেহাৎই রচনাটিকে পড়ে শেষ করবার তাগিদে নয়। আমাদের প্রাণের তাগিদে। ... তাই ‘কালবেলা’, না’ইবা হলো ‘জাঁ ক্রিস্তফ্’ বা ‘অপরাজিত’ তথাপি অন্তিমে সে’ও এক পুনর্জন্মের ইঙ্গিত রেখেযায় ... আর ঐ ইঙ্গিত এতোই বাস্তব যে প্রায় কুড়ি বৎসর আগে পড়া উপন্যাসটি, এই লেখাটি লিখতে লিখতে, আবারো খুলে বসে দেখি প্রায় প্রতিটি অধ্যায় এখনো মনে আছে সে রকমই ...
দেবাশিস তরফদারের ‘শরাইঘাটঃএকটি প্রেমকাহিনী’র অন্ততঃ কিছু ‘কথা’, কিছু অংশ দাবী রাখে আসামের, অসমীয়াদের বাঙ্গালী বিদ্বেষের ইতিহাসের নিরিখে বিচার করার। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সেড়ে নিই আরো কিছু আনুষাঙ্গিক কথা... যেমন...রচনাটির নামে ‘শরাইঘাট' এর পরে 'একটি প্রেমকাহিনী' কথা গুলো বলার কোনো দরকার ছিলো কি? প্রেম কাহিনী না'কি বিচ্ছেদ-গাথা সেটা পাঠককে তার মতো করে বুঝে নিতে এই বাক্যবন্ধটি অসুবিধা সৃষ্টি করে। অন্তিমে এ'ও মনেহয় যে, যেহেতু লেখক নিজেও গ্রন্থটির 'প্রেমকাহিনী' চরিত্রটি নিয়ে নিশ্চিত নন তা'ই নামে ঐ বাক্য-বন্ধ ব্যবহার করলেন ...
একই প্রশ্ন জাগে লেখক যখন রচনা শরীরের বাইরে গিয়েও বার বার বলে যেতে থাকেন এই রকমের কথাঃ
রাসকিন বন্ড আমারো অতি প্রিয় এবং পূজনীয় লেখক। ফলে এই রচনাটি লিখতে বসার আগে আমি পড়ে নিই উল্লিখিত ঐ উপন্যাসটিও এবং পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করি যে এই কাহিনীর ভিত্তিতেই শ্যাম বেনেগার তাঁর আঙ্গুলে ‘ভালো ছবি’র একটি, ‘জুনুন’ করেছিলেন...। সমরেশ মজুমদার’এর ‘কালবেলা’ যেমন নকশাল আন্দোলন, A Flight of Pigeons’ এ’ও তেমনি সিপাহী বিদ্রোহ নির্মাণ করে আবহ। কিন্তু দুইটি উপন্যাসেই এই দুইটি ঐতিহাসিক ঘটনা নিছক মূক আবহ হয়ে থাকেনা। ‘কালবেলা’ তে লেখক, ক্রমে, নকশালপন্থী রাজনীতির প্রতি তাঁর সমর্থনের কথা জানান দেন এবং অনিমেষের ( না’কি মাধবীলতা’র ?) টানে পাঠকের সমর্থনও নেন আদায় করে। A Flight Of Pigeons’এর ভূমিকায় বন্ড লিখেনঃ “In retelling the tale for today’s reader I attempted to bring out the common humanity of most of the people involved— for in times of conflict and inter-religious or racial hatred, there are always a few (just a few) who are prepared to come to the aid of those unable to defend themselves I published this account as a novella about thirty years ago. I feel it still has some relevance today, when communal strife and religious intolerance threaten the lives and livelihood of innocent, law-abiding people. It was Pascal who wrote, ‘Men never do evil so completely and cheerfully as when they do it from religious conviction.’ Fortunately for civilization, there are exceptions.” আর তাঁর রচনাতেও তাই, প্রকারান্তরে, সমালোচিত যতোটা হয় সিপাহী বিদ্রোহ তার বেশী আলোচিত হয় মানবমনের অন্দর-রহস্য। বন্ড্ কিন্তু এ’ও বলেন, যে, এই কাহিনী ’ may be based on fact’
কিন্তু ‘ ‘শরাইঘাটঃএকটি প্রেমকাহিনী’’ বিষয়ে লেখকের বক্তব্যঃ
‘বানিয়ে বলা সত্য’। ঠিক। কিন্তু ‘সত্য’ টি কি? সত্যটি যদি এ’ই হয় যে দীপু নামক একটি ছেলের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো দিনগুলি তাহলে প্রশ্ন ওঠে ঐ দিনগুলির কথা পাঠকের কোন ফিজিক্যাল বা মেটাফিজিক্যাল দরকারে লাগবে যে অর্থে বন্ডের সৃষ্ট রুথ্ বা জাভেদ খান’কে জানার মাধ্যমে পাঠক জেনেনেন মানব মনের আরেক দিগন্তকে? যে অর্থে অনিমেষ বা মাধবীলতা’কে জানার মাধ্যমে পাঠক জেনে নেন সত্তরের দশক’কে ‘মুক্তি’র দশক করার স্বপ্নের বিনিময়ে পোচ্ছিম বোঙ্গের ভামপন্থী সরকার ঠিক কি দিয়েছিল যুবসমাজকে ...
সত্যটি যদি এ’ই হয় যে দীপু নামক একটি ছেলের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো দিনগুলি তাহলে এই আলোচনার পরের অংশের প্রয়োজন অন্ততঃ আমার কাছে ছিলোনা কিছু, কিন্তু সত্যটি যদি এ’ই হয় যে দীপু নামক একটি ছেলের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো দিনগুলির বর্ণনের আনাচে কানাচে লেখকের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ঢুকেপড়া কিছু ‘কথা’, কিছু ‘সুর’ আমাকে বাধ্য করে পরের অংশটি লিখতে।
২।
রচনার প্রথম পংক্তিতেই আমরা জানতে পারি যে সেটা ১৯৭৭ ইংরেজি। অর্থাৎ ১৯৬৯ এর দিনগুলি তখন ক্যালেন্ডারে রক্তাক্ত-উপস্থিত। বাঙ্গালী তার নিজের ভাষায় কথা বলতে চেয়ে আন্দোলন করলে আসাম সরকার চালিয়েছে গুলি। ১৯ শে মে শিলচরে শহীদ হয়েছে এগারোজন ছেলেমেয়ে। ১৯৭২ এ খুন হয়েছে বাচ্চু চক্রবর্তী। আসামের সরকার পায়ে পিষে মুছে দিতে চেয়েছে আসামের বাংলীর অস্তিত্ব – যে বাঙ্গালীদের বাস আসামের বরাক উপত্যকায়, যে বাঙ্গালীরা পার্টিশানের আগে পর্যন্ত ছিল পূর্ব বাংলার বাসিন্দা ... ফলতঃ সেই বাঙ্গালী যখন ‘রাষ্ট্র’ নামক যন্ত্রের অনর্গত অমীমাংসিত দ্বন্দ্বের কারনে হয়ে পরলো আসামের বাসিন্দা তখন স্বভাবতঃই তাদের কাছে অসমীয়া ভাষা হলোনা গ্রহনযোগ্য, তারা শিখলোনা অসমীয়া, তারা অসমীয়া অধ্যুষিত ‘আপার’ আসামকে বল্লো ‘আসাম’। কাজেই রচনার প্রথম পাতাতেই, ঈষৎ ব্যাঙ্গের সুরে যখন লেখক বলেনঃ ‘ উহার দেশ কাছাড়ে, যে দেশকে আজকাল বরাক ভ্যালি বলা হইয়া থাকে; যাহা আসামেরই একটি জিলা অথচ যে দেশ হইতে ট্রেনে চাপিবার সময় লোকে ‘আসাম যাইতেছি’ বলিয়া থাকে’। -এই উচ্চারনে ‘যেন‘আসাম যাইতেছি’ না বলিলেই ভালো হইত, ‘আসাম’ই আমাদের দেশ বলিয়া ভাবিতে পারিলে ভাল হইত’ এমন একটি ইঙ্গিত রয়েছে কোথাও আর যে ইঙ্গিতটি, মূলতঃ, এই রচনার মূল সুর। অর্থাৎ বাঙ্গালীরা অসমীয়াদের ‘বুঝলো’ না, ‘কর্তা’ বলে মেনে নিলোনা এমন একটি কথা সর্বত্র প্রচ্ছন্ন। কাছাড় বা বরাকের লোকে অসমীয়া বলেনা, জানেনা বলে দীপু প্রায়ই লজ্জা পায়, দুঃখ পায়, কিন্তু দীপু এটা ভাবেনা যে এইসব বাঙ্গালীরা যে ঐতিহাসিক বাস্তবতার থেকে আজ ‘আসাম’এর বাসিন্দা সেই ঐতিহাসিক বাস্তবতার কোনোখানে অসমীয়া ছিলোনা। তারপরেও হয়তো বরাকের বাঙ্গালী অসমীয়া শিখতে পারতো যদি না তাকে বন্দুক দিয়ে শেখানোর চেষ্টা করতো অসমীয়া ‘প্রভু’ রা। ১৯৬৯’এর ইতিহাস, কিছুটা, এখানে তুলে দিচ্ছি www.unishemay.org নামক ওয়েব-পাতা থেকেঃ
“... In 1961 when world woke up to celebrate the birth centenary of its poet-laureate, Rabindranath Tagore, the two banks of Barak rose to an wake up call to defend its legitimate right to sing in Tagore’s language, to dream in Tagore’s language, to live a Bengali life. In the railway track of the district town, Silchar of the then undivided district of Cachar of Assam, ten young men and a woman fell down to the bullets of the state police. In the aftermath of the valiant sacrifices of the martyrs, Bengali was made the official language of the three districts of present day Barak valley. The struggle that gave back Bengali its rightful place was never a struggle of the Bengalis’ alone. First to resign from Assam Legislative Assembly in protest of firing was Nanda kishore Singha, a Bishnupriya Manipuri. In a silent protest against the brutal police firing and consequent death of eleven martyrs, thousands of Khasi men and women were on the streets of Shillong. The pluralism exuded out of these events was the essence of the language struggle of 1961. Struggle for a pluralistic polity and life in a multilingual, multiethnic state like Assam is the uniqueness of the Bengalis’ language struggle of the state. Struggle for pluralism against the chauvinistic policies of the ruling classes took its thread from 1961 and went through the tumultuous events of 1972, 1986 and 1995. Bachchu Chakraborty in 1972, Jaganmoy Deb (Jagan) and Dibyendu Das (Jishu) in 1986, in Karimganj and valiant Sudeshna Sinha, a fighter for the cause of her mother tongue, Bishnupriya Manipuri in 1995 in Kalkalighat- followed the footsteps of the eleven martyrs of 1961 and joined the long column of glorious martyrs of history. History and Geography of this land, for long have been engaged in a duel which left an indelible imprint on the archaic memory of the populace. Our literature, our music and our folklore murmur the never-ending agony, the refrain of eternal tragedy of this land. The saga of our journey through the lonesome roads of history remains unheard till date.”
অথচ সংবেদনশীল, সাহিত্য-প্রেমী, উদারমনা দীপু’র মর্মের কোনোখানে এই বাস্তবতার চিহ্নমাত্র নেই। বরং ‘আমগো ভাষা অহইম্মা’ কাহিনীর সত্যতা নিয়ে সে প্রকাশ করে সংশয়। রচনার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখক বলেন ‘আসিবার সময় ( অর্থাৎ দীপু’র ‘আসাম’এ পড়তে আসার সময়) নানাজনে বুঝাইয়াছিল যে আসামে এখন কোনো গন্ডগোল নাই, ৬১ সালের রাজ্যভাষা আন্দোলন এবং ৭২ সালের শিক্ষামাধ্যম আন্দোলনের রেশ কিছুমাত্র নাই’। যেন ঐ আন্দোলনগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা কোনো ‘স্ট্রাইক-স্ট্রাইক’ খেলা ... হায়, রচনাটির আবহ ১৯৭৭ হলেও রচনাটি যখন লিখিত হচ্ছে তখন অসমীয়া আগ্রাসনের, অতি নিম্নমানের জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটে গেছে একাধিকবার, তথাপি, বিষয়গুলিকে লেখক আনলেন এমনি হাল্কা চালে! হায়, এই প্রসঙ্গগুলি উল্লেখ না করলেও কিন্তু রচনার কিছু ক্ষতি বৃদ্ধি হতোনা! তেমনি ‘আমগো ভাষা অহইম্মা’র উল্লেখ না করলেও চলতো। তবু তা’ও উল্লেখ করলেন লেখক, লিখলেনঃ ব্রহ্মপুত্র ভ্যালির বাঙ্গালী মুসলমানদের কেউ কেউ নিজেকে অসমীয়া বলিয়া পরিচয় দেয় এবং বাঙ্গালী হিন্দুদের একটু এড়াইয়া চলে। দাঙ্গার সময় উহারা নাকি অসমীয়া হইয়া যায়। উহাদের বিষয়ে একটি মজার জনশ্রুতি আছে, যে, লোকগণনার সময় উহারা নাকি বলিত – আমাগো ভাষা অহইম্যা’ – এতোদূর বলেই আবার ব্র্যাকেটে এন্টিডোট্ দিয়ে রাখলেন লেখক – ‘ সত্যমিথ্যা বলা মুশকিল, যদুকাকার স্টকে এরকম গল্প থাকে’... ‘আমগো ভাষা অহইম্মা’ যেন একটি রগড় ... হায়, আসামে যে অসমীয়ারাই প্রকৃতার্থে সংখ্যালঘু এই তথ্যটি ঢাকতে বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙ্গালী মুসলমানদের অভয় দিয়েছিল অসমীয়ারা। বলা হয়েছিল মাতৃভাষা ‘অসমীয়া’ হলে কোনো ‘ডর’ নেই। ভোটাধিকার পাক্কা। কেননা এতে আসামে ‘অসমীয়া ভাষী’ জনতার পরিসংখ্যানে যে প্রভাব তা’তে প্রমাণিত হবে আসামে ‘অসমীয়ারা’ই সংখ্যা গড়িষ্ঠ। অতএব ‘আপার আসাম’ (ধেমাজি, ডিব্রুগড়,লখিমপুর, গোলাঘাট, শিবসাগর ও তিনসুকীয়া) এর নানা স্থানে বসবাসকারী বঙ্গভাষী জনতার এক বৃহৎ অংশ ‘তোমার মাতৃভাষা কী’ এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন ‘আম্গো ভাহা অহইম্মা’। তথাপি ঘটেগেলো ‘নেলী’। ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী প্রকাশ্য দিবালোকে নগাঁও’এর নেলীতে খুন হলেন ২১৯১ মানুষ ( বেসরকারী হিসেবে ৫০০০ এর’ও বেশী)। এঁরা মূলতঃ বাংলাভাষী মুসলমান। এঁদেরকে খুন করা হলো কেননা এঁরা চলেছিলেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে। হয়তো আসামের অসমীয়া ‘প্রভু’দের পক্ষে ঐ ভোটাধিকারের প্রয়োগফল হতোনা তেমন সুবিধা জনক সুতরাং ঘটে গেলো এই গনহত্যা। অর্থাৎ ‘আম্গো ভাহা অহইম্মা’ বলেও জান বাঁচাতে পারলেন না আসামের অনসমীয়া জনতা। এই গণহত্যার পেছনের আরেকটি বাস্তবতা ছিল এই, যে, ঐ উদ্বাস্তু মুসলমানেরা যে জমিকে করেছিল সোনা ফলানোর জমি তা’ই অসমীয়ারা বহু আছে ‘পতিত জমি’ বলে দিয়েছিল ছেড়ে। এবার সোনা যে’ই ফললো তখন এই জমিতো আর থাকতে পারেনা অনসমীয়ার দখলে ...
আহা দীপু, মহান দীপু, সে এসব জানেনা, বোঝেনা, ফলে সে ‘অসমীয়া’ হয়ে যায় সহজেই। তার যজ্ঞেশ্বর-টংকে’রাও এসব জানেনা তাই ‘সরল’ ভাবে বলে ‘শিলচর কি আসাম নয়’... হায়, আমি, অধম পাঠক, এই বাস্তবতাগুলিকে ভুলতে পারিনা বলে দীপুর এইসব মহান ভাবনাকে ‘ন্যাকামি’ ছাড়া অন্য কোনো সংজ্ঞাই দিতে পারিনা ...।আর দীপু শুধু অসমীয়া হয়ে গেলেই ক্ষতি কিছু ছিলোনা সে যদি আবার বাঙ্গালী বিদ্বেষীও না হয়ে উঠতো। বিহু দেখে দীপু মুগ্ধ। অতি উত্তম। কিন্তু যারা বিহু দেখে ততো মুগ্ধ নয় তাদের প্রতি কটাক্ষ কেন দীপুর? সে হয়তো ধামাইলে মুগ্ধ। দীপু তার খোঁজ করেনা। হ্যাঁ এর মনোভাবের মধ্য দিয়ে লেখক যদি তথাকথিত ‘জাতীয় ঐক্য’এর ধ্বজাধারীদের ভন্ডামীর দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষন করার ইঙ্গিত করে থাকেন তাহলে এর একটা কোনো অর্থ হয়। নতুবা এ কি নয় সরাসরি বাঙ্গালী’র প্রতি কটাক্ষ? হ্যাঁ অসমীয়াদের কিন্তু justify করছে দীপু, বলছে ‘একজন বাঙ্গালী বিদ্বেষীও প্রেম করে, চাঁদের আলো ভালোবাসে, গান শোনে পাগলের মতো। সে একজন মানুষ। আজকাল ঘন ঘন দীপুর এই অনুভব হয়’। - অতি উত্তম অনুভব। এই অনুভবের পাশাপাশি দীপু কিন্তু এটা অনুভব করেনা যে ‘একজন অসমীয়া বিদ্বেষীও প্রেম করে, চাঁদের আলো ভালোবাসে, গান শোনে পাগলের মতো। সে একজন মানুষ’। বরং বাঙ্গালী ছেলে উদয়ন বিশ্বাস যখন দীপুকে বলে যে এবার অসমীয়ারা বাঙ্গালী পেটাবে ফলে এখন হোষ্টেল থেকে চলে যাওয়াই মঙ্গল, দীপু কিন্তু তাকে আঁকে কালো কালিতে, বলে ‘কাপুরুষ’। একইভাবে আরেকটি বাঙ্গালী চরিত্র, যে মূলতঃ অসমীয়াদের আন্দোলনের মূল চরিত্রটি নিয়ে কথা বলছিল ট্রেনে যেতে যেতে, তাকেও দীপু আঁকে সেই কালো কালিতেই। বলে এর বীরত্ব গৌহাটি স্টেশনে এসেই মিইয়ে যাবে। হায় দীপু, অদ্যাপি আমাদের মতো যাদের ভিটে বাড়ি আসামে অথচ পেটের ধান্দায় থাকতে হয় ভারতবর্ষের অন্যত্র, তারা অদ্যাপি দেখি, যে, হাওড়া থেকে গৌহাটি অভিমুখে ট্রেন ছাড়লে গাড়ি ব্যান্ডেল পার হওয়া পর্যন্ত অসমীয়া যাত্রীর আপ্রান (ভুল ভাল) বাংলা বলেযায় আর ব্যান্ডেল পার হলেই অসমীয়া ছাড়া জানেনা অন্য কিছু। পক্ষান্তরে গৌহাটি থেকে হাওড়ার দিকের ট্রেনে, ব্রহ্মপুত্র ব্রীজ পার হওয়ামাত্রই শুরু হয় তাদের বংগ-বাতচিত ...
#
আর বেশী উদাহরন টেনে লাভ নেই। দীপু’র অসমীয়া হয়ে ওঠার মাধ্যমে লেখক যদি জাতীয় সংহতির দিকে অঙ্গুলী নির্দেশের কথা ভেবে থাকেন তাহলে বলতে হয়, না, সংহতি এভাবে হয়না। এই রচনাও মূলতঃ একদেশদর্শী। এই রচনা যদি হয় নেহাৎই স্মৃতিকথা তাহলে বলতে হয় দ্বিতীয় সংস্করনে দীপু’কে অসমীয়া করেও তার মধ্যে সুপ্ত বাংগালী বিদ্বেষকে ফিল্টার না করলে দীপুকে হজম করা মুশকিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন