“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

‘শুধু ভঙ্গী দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ ...’




                                                     সপ্তর্ষি বিশ্বাস
     ১।

ন্যান্য ভাষার মতো বাংলা ভাষাতেও প্রতিদিন হাজার না হলেও অন্ততঃ শো খানেক গদ্য-পদ্য-উপন্যাসের বই ছাপা হচ্ছে। তার কিছু পড়ছে লোকে। কিছু পড়ছেনা। কিছু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিছু দিন। তারপর ভুলে যাচ্ছে। সেইসব বইপত্রের কিছু আমিও পাচ্ছি। কিছু পড়ছি। কিছু রেখে দিচ্ছি ‘পড়বো’ বলে। কিছু কিছু পড়ে ভালো লাগছে। কিছু কিছু লাগছে না। ভালো লাগলে এখানে ওখানে লিখে জানাই। না লাগলে কিছু বলিনা। আমার ভালো-খারাপ লাগায় তেমন কিছু আসে যায়না। সময়ের কাছে সব থাকে। কাজেই ... তাই দেবাশিস তরফদারের ‘শরাইঘাটঃএকটি প্রেমকাহিনী’ পড়েও কিছু লিখতাম না কেননা বইটি আমার এমন কিছু ভালো লাগেনি। দেবাশিস তরফদারের ঢের আরো ভালো লেখা পড়ার অভিজ্ঞতা থাকায় ‘পরে আবার লিখবেন খন’ এমনি আশা নিয়ে বসে থাকতাম। কিন্তু তা হলোনা। লিখতে হলো বইটি নিয়ে। লিখতে হলো যতোটা না সাহিত্য, শিল্পের আলোচনার প্রয়োজনে তার চেয়েও বেশী আমার নিজের ব্যক্তিগত অস্তিত্ব যা আমার জাতি ও ভাষাগত অস্তিত্বের ফসল মাত্র তার প্রতি বইটির ছুঁড়ে দেওয়া মিথ্যা অনুযোগ গুলির জন্য।

                  মনে করা যাক আমি বরাক উপত্যকার কেউ নই, মনে করা যাক আমি পশ্চিমবংগ বা বাংলাদেশের একজন পাঠক। থাকি দেশে বা বিদেশে। বুদ্ধি-শুদ্ধি আছে কিছুটা। আমি পত্রিকা টত্রিকা পড়ি। গল্প-উপন্যাসও পড়ি। এমতাবস্থায় আমার হাতে এলো ‘শরাইঘাট...’ । আমি পড়লাম। আমি পত্র-পত্রিকা পড়ে মোটামোটি জানি যে আসামে ‘আসামী-বাঙ্গালী’ কি একটা ঝামেলা আছে। গন্ডগোল টন্ডগোল হয়। এবার আমি ‘শরাইঘাট...’ পড়লাম এবং এর সঙ্গে, স্বভাবতঃই আমি ‘ইতিহাস’ কে মেলাতে লাগলাম ( যা ৯৯% ভাগে করে)। তাহলে আমি কি পাবো এই বই থেকেঃ

(অ)  আসামের এক বিশেষ স্থানের, মানে বরাক উপত্যকার বাঙ্গালীরা মনে করে তারা আসামের নয় তাই গৌহাটির দিক বা আপার-আসামকে তারা বলে ‘আসাম’। অর্থাৎ এই বাঙ্গালীরা অতি নেমক হারাম। ( প্রথম পাতাতেই যখন লেখক বলেনঃ ‘ উহার দেশ কাছাড়ে, যে দেশকে আজকাল বরাক ভ্যালি বলা হইয়া থাকে; যাহা আসামেরই একটি জিলা অথচ যে দেশ হইতে ট্রেনে চাপিবার সময় লোকে ‘আসাম যাইতেছি’ বলিয়া থাকে’। -তা’তে ব্যঙ্গের সুরটা কি ধরতে পারা যায় না?  এই উচ্চারনে ‘যেন‘আসাম যাইতেছি’ না বলিলেই ভালো হইত, ‘আসাম’ই আমাদের দেশ বলিয়া ভাবিতে পারিলে ভাল হইত’ এমন একটি ইঙ্গিত যে রয়েছে কোথাও সে’ও কি বুঝিয়ে দিতে হবে?)

(আ)  আসামে কি সব আন্দোলন-টন হয়েছিল, সম্ভবতঃ ঐ নেমখারাম বাঙ্গালীরাই সেসব করেছিল তবে সেসব বহু আগে চুকে বুকে গেছে। (‘আসিবার সময় ( অর্থাৎ দীপু’র ‘আসাম’এ পড়তে আসার সময়) নানাজনে বুঝাইয়াছিল যে আসামে এখন কোনো গন্ডগোল নাই,৬১ সালের রাজ্যভাষা আন্দোলন এবং ৭২ সালের শিক্ষামাধ্যম আন্দোলনের রেশ কিছুমাত্র নাই’। যেন ঐ আন্দোলনগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা কোনো ‘স্ট্রাইক-স্ট্রাইক’ খেলা ... পাঠকের মর্মে এই প্রমাদটি সৃষ্ট হয়, হয় লেখকের ইচ্ছায় নয়তো তাঁর ভাষা প্রয়োগ ও context handling এর ব্যর্থতায়।)

(ই) বাহাত্তররের শিক্ষা আন্দোলন ( কাহিনীর প্রোটাগোনিষ্ট ‘দীপু’র মতে ) অসমীয়া মন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ এবং মিছিল আর একটি ছড়া! (পৃঃ ১০)  এ’ও নির্ঘাৎ ঐ নেমক হারাম বাঙ্গালীদের কোনো কুকর্ম!!!

(ঈ) অসমীয়াদের নিয়ে কুচক্কুরে বরাকের বাঙ্গালীরা নানা রকম সত্য মিথ্যা গল্প বানায়। ‘যদুকাকা’র ‘আমগো ভাসা অহইম্যা’ এমনি একটি মুখরোচক গল্প! (পৃঃ ১৩)

(উ)  ইস্‌, কি খারাপ, এই ‘বরাক এর বাঙ্গালীরা’ অসমীয়া জানেত না’ই এমন কি বলার চেষ্টাও করেনা। অথচ দেখো অসমীয়ারা কতো মহান, বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করে। ( পৃঃ ৩৫ , ৪৪, ১৭৬ আরো নানা জায়গায় ...

(ঊ) বরাকের বাঙ্গালীরা ‘কাপুরুষ’, ‘সুযোগে বাঘ হওয়া বিড়াল’, মূর্খ  - ইত্যাদি। ( অধ্যায়ঃ একটি কাপুরুষের পলায়ন, উলটোরথে)

তালিকাটি আরো দীর্ঘ হতে পারে। চক্ষুষ্মান পাঠক এবার নিজে পড়ে সম্পূর্ণ করে নিতে পারেন তালিকাটি। এবার কথা হচ্ছে, লেখক কি এই কথা গুলিই, বরাকের বাঙ্গালী সম্পর্কে, চেয়েছেন প্রচার করতে?

যদি চেয়ে থাকেন সেই ক্ষেত্রে এতো স্রেফ্‌ Hate writing । সাহিত্য-শিল্প কিছুই নয়। এনিয়ে আলোচনা না করে মানহানির মামলা ( জাতীয় মানহানি’র মামলা যদি কিছু আদৌ হয়’) ঠুকে দিলেই আপদ গেলো। পক্ষান্তরে এ যদি না চেয়ে থাকেন তবু যে এই কথা গুলি এভাবে এসে পরলো তা’কি লেখকের এবং লেখাটির ব্যর্থতা নয়?

২।

এবার ‘দীপু’র ক্ষোভের বিপরীতে আমার ‘ক্ষোভ’এর কারনগুলি বলাযাকঃ

(ক)  ‘দীপু’র মতেঃ বরাক উপত্যকার লোকেরা নিজেদের ‘আসামবাসী’ ভাবেনা। তারা অসমীয়া জানেনা। জানার ইচ্ছাও করেনা।

বর্তমান অধম পাঠকের মতেঃ ঠিক। বরাকবাসীরা নিজেদের আসামের মানুষ মনে করেনা। কেননা ‘শ্রীহট্টের ... নির্বাসন ঘটেছিল ১৮৭৪ সালে, নবগঠিত চিফ কমিশনার শাসিত আসাম প্রদেশের ব্যয় সংকুলানের জন্য যখন শ্রীহট্টকে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো। শ্রীহট্ট এবং কাছাড় জেলাকে নিয়ে তখন তৈরী করা হয়েছিল সুরমা ভ্যালী ডিভিশন। শ্রীহট্ট এবং কাছাড় জেলার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটলো ১৯৪৭ সালে, রাজিনৈতিক কুটিল আবর্তের পরিণতিতে। শ্রীহট্টের বৃহত্তর অংশটি তখন আবার যুক্ত হলো বঙ্গের সঙ্গেই, কিন্তু সে বঙ্গ খন্ডিত। কাছাড় এবং শ্রীহট্টের ক্ষুদ্র একটি অংশ ( অধুনা করিমগঞ্জ জেলা) রয়ে গেলো আসামে’। (শ্রীহট্ট কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস, ডঃ সুজিৎ চৌধুরি, প্রস্তাবনা অংশ)।

কাজেই দেখা যাচ্ছে যে কেবল মাত্র ‘সরকারী’ ভাবে ছাড়া ‘কাছাড়’ বা ‘বরাক উপত্যকা’ আসামের ছিলোনা কোনো দিনই। তা জানে অসমীয়া ‘প্রভু’ রাও। ফলতঃ ‘স্বাধীন’ হতে না হতেই এরা আবদার ধরলো ‘ওহে বরাকের লোক তোমাদের পড়াশোনার মাধ্যম হয়েযাক অসমীয়া’। এই একই প্রস্তাব পশ্চিম পাকিস্তানীরা করেছিল পূর্ব পাকিস্তানকে আর এই অসমীয়া ‘প্রভু’রা করলেন। করলেন ত বটেই এবং ক্রমে তা প্রয়োগের জন্য যে অত্যাচার আরম্ভ করলেন তাও ঐ খানসেনাদেরি সমতুল।

ফলে দুই জাতির মধ্যে কোনো সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, আদান-প্রদান ( IPTA আর পার্টিবাজেদের আদান প্রদান দিয়ে কিছু নির্ণয় হয়না) এর কোনো ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার আগেই অসমীয়া প্রভুদের চোখ রাঙ্গানীতে সমস্ত পাল্টে গেলো। যারা ঐসব দিন দেখেছে স্বচক্ষে তাদের কথা’ত বাদই দিচ্ছি, এই যে ১৯৭২ সালে জন্মানো আমি, যে ষাটের-সত্তরের ভাষা আন্দোলন আর নির্যাতনের কিছুই দেখিনি চোখে, কেবল দেখেছি ৮৬ সালের জগন-যীশুর খুন ( তা’ও অকুস্থলে গিয়ে নয়) আর আসামী সরকারের দমননীতি আমিই ঘেন্নায় অসমীয়া শিখিনি, যদিও গৌহাটিতে চাকরী সূত্রে থাকতে হয়েছে দুই বছর, উচ্চারন করিনি একটা অসমীয়া শব্দ।

কাজেই যারা দীপুর সেই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উচ্চারিত ‘৬১ সালের রাজ্যভাষা আন্দোলন এবং ৭২ সালের শিক্ষামাধ্যম আন্দোলন’ স্বচক্ষে দেখেছে তারা যে অসমীয়া বলবেনা, শিখবেনা সে’ত স্বাভাবিক।

সুতরাং ‘বরাক উপত্যকার লোকেরা নিজেদের ‘আসামবাসী’ ভাবেনা। তারা অসমীয়া জানেনা। জানার ইচ্ছাও করেনা’ - দীপুর এই ক্ষোভ ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত বিষয়ে জ্ঞাত পাঠকের কাছে ‘ন্যাকামি’ মনেহয়।

(খ)বরাকের বাঙ্গালীরা ‘কাপুরুষ’, ‘সুযোগে বাঘ হওয়া বিড়াল’, মূর্খ  - ইত্যাদি।

কেন?

না, লামডিঙ্গের ছেলে উদয়ন বিশ্বাস ‘দীপু’কে বলে অচিরেই অসমীয়া-বাঙ্গালী দাঙ্গা লাগবে আর এতে বাঙ্গালীর কোনো লাভ হবেনা কেবল মার খাওয়া ছাড়া। এইসব কথা বলার আগেই সেই উদয়ন বিশ্বাস ‘দীপু’র সংজ্ঞায় খারাপ মানুষ হয়েযায় কেননা উদয়নের ‘বিহুনাচ পছন্দ হয়না। যে অসমীয়া বলার বিশেষ চেষ্টা করেনা’। তাই সে ‘কাপুরুষ’। অর্থাৎ সে অসমীয়াদের মন জুগিয়ে চলেনা। এছাড়া তার আর কোনো ‘খারাপ’ কাজ বা ‘কাপুরুষ’তার কিছু আমরা দেখিনা। বরং ইতিহাস বলে, যে, ১৯৮০/৮১ সালে গৌহাটি মেডিকেল কলেজে বাঙ্গালী ছাত্র অঞ্জন চক্রবর্তী খুন হয় কেননা সে ছিল বাঙ্গালী এবং মেধাবী। এনিয়ে গৌহাটির কোথাও কোনো প্রতিবাদ হয়না। অসমীয়া ‘প্রভু’রা চেপেযায় এই খবর। তথাপি বরাক উপত্যকায় ‘লিক’ করে পৌঁছে যায় খবরটি। যথারীতি সৃষ্টি হয় উত্তেজনার। তখন অসমীয়া ‘প্রভু’রা বরাকের সমস্ত ইস্কুল কলেজ থেকে সমস্ত অসমীয়া ছাত্রছাত্রীদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেন কড়া হাতে। কাছাড় জেলায় হয় মৌন মিছিল। মিছিল বিক্ষোভ।

কাজেই ‘দীপু’র বলা ঐ হোষ্টেল-গপ্পোর সত্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।

একই ব্যাপার সেই ‘উলটোরথে’ অধ্যায়’এ। ফুটবল মাঠে বাঙ্গালীদেরকে পিটিয়েছে অসমীয়ারা। এই নিয়ে ট্রেনে যেতে যেতে ক্ষোভ প্রকাশ করছে আরেকটি বাঙ্গালী ছেলে তাতেও ‘দীপু’র গোঁসা। ঐ বাঙ্গালী ছেলেটি মূর্খ। তার সৌন্দর্য বোধ নেই। নেই কেননা অসমীয়া গান তার ভালো লাগেনা।

অথচ অসমীয়াদের ব্যাপারে ‘দীপু’ এটা বোঝেঃ ‘একজন বাঙ্গালী বিদ্বেষীও প্রেম করে, চাঁদের আলো ভালোবাসে, গান শোনে পাগলের মতো। সে একজন মানুষ। আজকাল ঘন ঘন দীপুর এই অনুভব হয়’। - অতি উত্তম অনুভব।  এই অনুভবের পাশাপাশি দীপু কিন্তু এটা অনুভব করেনা যে ‘একজন অসমীয়া বিদ্বেষীও প্রেম করে, চাঁদের আলো ভালোবাসে, গান শোনে পাগলের মতো। সে একজন মানুষ’।

সুতরাং ‘দীপু’কে বিশ্বাসঘাতক বা rat ছাড়া কি বলাযায় অন্য কিছু?

প্রসঙ্গতঃ মনে আসছে ‘দীপু’ বিষয়ে এক নিবিড় পাঠক ( কাছাড়ের ) উক্তিঃ অন্ধ দুই প্রকারেরি হয় ঘৃণান্ধ এবং প্রেমান্ধ উত্তরফলে কিন্তু প্রভেদ নাই কিন্তু এই প্রভেদ অবশ্যই থাকিতে পারে যে ঘৃণান্ধতা=১০/১০ এবং প্রেমান্ধতা=১০০০০০০/১০০০০০০ কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই, জয় গরু, ফলাফল তো ১। ইহাও মনে রাখিতে হইবে প্রেমের কেবল আলিঙ্গনই থাকেনা, কবল অথবা খপ্পড়ও থাকিতে পারে আর কে’না জানে, উদ্দেশ্য যতোই মহৎ হোক্‌ পথটি যদি পাপের পথ হয় ...। যদি মিথ্যা বলা মহাপাপ হয় তাহা হইলে ত বলিতেই হইবে ‘দীপু’ পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রাণপনে পাপের পথ ধরিয়াছে কারন ‘দীপু’এ যাত্রার শুরুতেই আছে ‘বাবার বন্ধু ...কিছু নাই পৃঃ ১০’। তাহার পরেই আবার ‘একথা অবশ্য ... আসিতেছে’ পৃঃ১০  তা ‘এরূপ কথা’ত বাবার আরেকজন বন্ধু কোনো মধুকাকাই বলেন নাই ইহা আম জনতারি মুখনিঃসৃত। তাহার মানে আমজনতাও নৈরাশ্যে অবিচল! যাহা হইক বকচ্ছপ ভাষায় লিখিত ‘ঢোঁড়া মানস’এর এই ঢপ চরিত আমাকে অধিক দূর সঙ্গ দিতে পারিলনা কারন এই অধমও ‘respect only the books that all but kill their authors’। সবেশেষে সাবধান করিতেছি রাক্ষসের চিতাই কিন্তু অনির্বান’।

এই পাঠকটি কিন্তু টলষ্টয় বা বিভুতিভূষণের ক্ষেত্রে এমনটি বলেন না।



    ‘শরাইঘাট...’ নিয়ে আরেকটি আলোচনা লিখেছিলাম আগেও যেখানে এ’ই কথাগুলিই বলেছিলাম একটু অন্য ভাবে। সেই আলোচনাটি পড়ে ডাক্তার, সমাজকর্মী, পাঠক ও প্রাবন্ধিক মৃন্ময় দেব, যিনি জীবনের দীর্ঘতম সময় কাটিয়েছেন ‘আপার আসাম’এ আর কর্মসূত্রে নিবিড়ভাবে গ্রাম-আসামের সাথে পরিচিত হয়েছেন, তিনি জানালেনঃ আলোচনার যুক্তিগুলি অকাট্য নিশ্চয় (উপন্যাসটা পড়া হয়নি যদিও), তবে একটা কথা কিন্তু ঠিক যে ঐ সময় একজাতের দীপু-মানসিকতা সত্যিই গড়ে উঠেছিল। এটা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। সে বিচারে দেবাশিস তরফদার হয়ত উক্ত বাস্তবতাকে ধরার প্রয়াস করে থাকবেন। এর পেছনে একটা কারণও ছিল। সে সময়ে অসমে তরুণদের মধ্যে বামপন্থী চিন্তার প্রসার ঘটেছিল, মূলত পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালিয়ে আসা নকশালদের দৌলতে। বাঙালি এমনিতেই রোমান্টিক-বামপন্থী, ফলে একটা অবাস্তব মানসিকতা জন্ম নিল, এরা অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে একদল বাঙালির উন্নাসিকতার পাপ স্খালনে উঠে পড়ে লেগে গেলো। আর অসমীয়া বামপন্থীরাও (ভালো অসমীয়া) খানিকটা আত্মতুষ্টি লাভ করল। লক্ষ্য করলে দেখবেন উগ্র জাতীয়তাবাদকে পুরোপুরি নাকচ করে অসমে কোন মতবাদ/আন্দোলন গড়ে তোলা প্রায় দুঃসাধ্য (এটা ইসলামের ক্ষেত্রেও দেখা যায়)- কাজেই বামপন্থীরা একটা অবাস্তব আপোষ-মীমাংসায় পৌঁছে ‘ভালো অসমীয়া’ ও ‘ভাল্‌ বঙালি’-র এক উদ্ভট সমীকরণ তৈরি করে ফেলে, দীপু সম্ভবত সেই ‘ভাল্‌ বঙালি’-র প্রতিনিধি’।

কাহিনীর মেরুদন্ড যেখানে এক বিশেষ সময়ের, বিশেষ ভূগোলের মানুষের সামাজিক বাস্তবতা সেখানে সেই সময়ের বাস্তবতার নিরিখেই  ‘দীপু’ চরিত্রটি দাঁড়াচ্ছেনা আবার সে দোষারোপ করে যাচ্ছে সেই বাঙ্গালীকে, যে, নমকহারাম,মূর্খ, কাপুরুষ হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু গুলি খেয়ে, জেলে গিয়ে বাংলা ভাষায় শিক্ষার অধিকারটুকু জিতে নিলো। এই দোষারোপই আমাকে ক্ষিপ্ত করে। আমি এই বই বিষয়ে চঠি লিখতে গিয়ে লিখতে বাধ্য হইঃঅনেক ছেলেমেয়ের মধ্যে মা-বাপের দু চারটে ছেলে তো কুলাঙ্গার হয়েই যেতে পারে, কিন্তু সেই ‘কুলাঙ্গার’ যখন অন্য ভাই-বোনেদের নিয়ে কটূক্তি করে তখন আমার সহ্যের সীমা পার হয়ে যায়।

 ৩।

এই কাহিনী পড়তে পড়তে আমরা জানলাম বরাক উপত্যকার ছোট একটি শহর শিলচর থেকে দীপু বলে একটি ছেলে পদার্থ বিদ্যায় স্মাতকোত্তর পাঠ নিতে এলো থেকে আসামের রাজধানী গৌহাটিতে। সময়টা সত্তরের দশকের শেষ।  জানলাম তার বেশ কিছু বন্ধু বান্ধব হলো। তাদের সঙ্গে মিশে সে ‘অসমীয়া’ হলো, ‘কমরেড’ হলো। অনেক অসমীয়া গান টান শুনলো। সে জানলো অসমীয়া একটি অতি উন্নত ভাষা। হোষ্টেলে মারদাঙ্গা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকশান হলো। ক্রমে দানা বাঁধলো আসামের বিখ্যাত ‘বঙ্গাল খেদা’র আরেকটি পর্ব। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলো কিছুদিন। পরীক্ষাও তাই গেলো পিছিয়ে। দীপু ফিরে এলো। তারপর বেশ কিছুদিন পরে এড্‌মিট্‌ কার্ড পেয়ে আবার গেলো সেই হোষ্টেলে। তখন সেখানে অন্য বাতাস। পুরোনো বন্ধুরাও ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে... হারিয়ে যাচ্ছে যাপনের বাস্তবতার হাহাকারে ...

এই সবই জানলাম ‘দীপু’র মুখে আর তার বন্ধুদের নানান আলোচনায়। কিন্তু পাঠক হিসাবে ‘দীপু’কেই যে চিনলাম না ঠিক করে আর তার আগেই দেখলাম দীপু ‘অসমীয়া’ হয়েগেলো ,কিন্তু সেই হওয়াটা না’ত ঠিক ‘ছিল রুমাল হয়ে বেড়াল’এর মতো সহজ বোধগম্য না’ত কোনো দার্শনিক,মনস্তাত্ত্বিক ইঙ্গিতরেখা ফলে চক্ষুষ্মান  পাঠকের মনে হতে বাধ্য যে লেখক দীপুকে অসমীয়া করার জন্যই এনেছিলেন এখানে। যা’ই অসমীয়া তা’ই তার ভালো লাগে।

ঐতিহাসিক ভাবে দেখলে এ কথা সত্য, যে,বাঙ্গালী বিরোধী তৎকালীন অসমীয়া ক্রিয়া কলাপে ‘কমিউনিষ্ট’ ছাত্র আর ‘কমিউনিষ্ট’ পার্টী সত্যিই একটি ইতিবাচক ভূমিকা বহুদিন পালন করেছিল। তথাপি এই চরিত্রগুলি ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক’ থেকেও বায়বীয় কেনবা ‘গোপাল’ কে সুবোধ বলার পরের গোপালের শ্রষ্টা দেখিয়েছিলেন কারন গুলিও – গোপাল ইস্কুলে যায়, পড়া করে, রাস্তায় রাস্তায় খেলে বেড়ায় না –ইত্যাদি। কিন্তু এই চরিত্রগুলির ভালো হওয়ার হেতু তারা ‘অসমীয়া’ আর যেহেতু ভালো তাই ‘কমিউনিষ্ট’। হ্যাঁ, কিছু কিছু ‘খারাপ অসমীয়া’ আছে হয়তো তবে ‘খারাপ’ হলেও তারা “প্রেম করে,চাঁদের আলো ভালোবাসে,গান শোনে পাগলের মতো’। তাই তারাও ‘মানুষ’। কিন্তু সেই ‘খারাপ’দের ‘খারাপ’ বলে যে বাঙ্গালীরা তারা কিন্তু ‘মূর্খ’, ‘কাপুরুষ’। কেন? না, ‘দীপু’ তেমনটা বলেছে বলে। রাশিয়ার বিপ্লবের অনেক ‘খারাপ’ দিক আমাদের দেখিয়েছিলেন পাস্তেরনায়েক কিন্তু “শুধু জিভাগোর পছন্দ হয়নি তাই এসব খারাপ” এইভাবে নয়।

অসমীয়া লোকগান ইত্যাদির উল্লেখ প্রায় পাতায় পাতায়। সেগুলির ভাষা ও ভাব ( আমার সীমিত অসমীয়া জ্ঞানে) অবশ্যই উন্নত কিন্তু যে বাঙ্গালী ছেলে ‘দীপু’ কবিতা টবিতা পড়ে, সাহিত্য রসিক সে’কি পূর্ব বা পশ্চিম বাংলার লোকগান কোনোদিন শোনেনি? যদি শুনে থাকে তাহলে সেগুলির ভাব,ভাষা তাকে কি স্পর্শ করেনি? আমার মতো অনসমীয়া পাঠকের পর্যন্ত ‘দীপু’র উদ্ধৃত গান গুলি পড়তে পড়তে মনে এসেছে নানা বাঊল-ভাটিয়ালীর অনুষংগ। কিন্তু দীপুর আসেনি। অর্থাৎ এই কাহিনীতে ঢুকে পড়ার আগে দীপুর কোনো অতীত ছিলোনা আর তাই তার সমস্ত ভাবনা, ধ্যান ধারনা এতো হাল্কা, এতো ভুঁইফোড়। কাজেই আবারো প্রত্যয় হয় যে দীপু’কে হাজিরই করা হয়েছে অন্তিমে ‘অসমীয়া’ বানানোর জন্য।

এইভাবে ‘বানানো’ কিছু কি সাহিত্যের ধোপে টেঁকে যার গা’য়ে নির্মাণের সব দাগ গুলি দগ দগ করছে?

  পড়তে পড়তে এ’ও মনেহয় এটি কি উপন্যাস না’কি দিনলিপি না’কি নানা জনের নানা কথা’র একটি রানিং কমেন্ট্রি? উপন্যাস বলতে বাধে কেননা যারা কথা বলছে তাদের রক্তমাংসের অস্তিত্ব বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার আগেই তাদের কথার তোড়ে ভেসে যেতে হচ্ছে পাঠককে।  কিন্তু এ’কে ঠিক হালের ‘appearance is essence’ তত্ত্ব দিয়েও ব্যাখ্যা করতে পারিনা কেননা এদের ‘appearance’ ই বিশ্বাসযোগ্য হয়না সর্বত্র। একই সমস্যা দীপু’কে নিয়েও। দীপু একটি দিন থেকে আরেকটি দিনে পৌঁছায়। পাঠককে, রচনাটি পুরো পড়ে শেষ করবার তাগিদ ছাড়া অন্য কোনো কারনে প্রয়োজন হয়না তাকে অনুসরন করবার। হ্যাঁ, ‘কথা’ কোথাও কোথাও জমে ওঠে। ঠিক। কিন্তু পর মুহুর্তেই যেন তার রেশ যায় হারিয়ে। রাশ যায় আলগা হয়ে।

কি কথা বলে দীপু? কি কথা বলে তার সঙ্গী সাথীরা? তারা নানা বিষয়ে কথা বলে। রাজনীতি থেকে কবিতা। ঠিক যেমন সুনীল গংগো’র ‘আত্মপ্রকাশ’এর চরিত্ররা বলতো। ঐ অনর্গল কথা বলা ছাড়া ‘আত্মপ্রকাশ’এর চরিত্রেরা যেতো শূঁড়ি খানা আর গণিকালয়ে আর এরা যায় কমলালয়’এ, চায়ের দোকানে, ক্লাসে, হোষ্টেলের ক্যান্টিনে ... কেন যে শূঁড়ি খানা আর গণিকালয়ে যায়না তা’ও এক প্রশ্ন ...

‘দীপু’র পাশাপাশি মনেপড়ে ‘অনি’কে। অনিমেষ। অনিমেষ মিত্র। সমরেশ মজুমদার’এর ‘কালবেলা’র। সে’ও এমনি এক ছোটো শহর থেকে এসেছিল কলকাতায়। এমনি এক টাল মাটাল সময়ে। সে’ও ক্রমে হয়ে উঠেছিল ‘কলকাতা’র ছেলে। হয়ে গিয়েছিল ‘কমিউনিষ্ট’। কিন্তু তার এই হয়ে ওঠা স্রেফ কথায় কথায় হয়ে ওঠা ছিলনা। সব কিছুর আগে সে নিজে পরিগ্রহ করেছিল রক্ত মাংসের চরিত্র। তারপর, ক্রমে, আমরা দেখেছি, বহু দ্বিধা, দ্বন্দ্ব পার হয়ে তার ‘কমিউনিষ্ট’ হওয়া, ‘নকশাল’ হওয়া। আড্ডা, ‘কথা’ আমরা শুনেছি সেখানেও, সেখানেও হোষ্টেল-মেস্‌’এর অন্দর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দার আমরা হেঁটেছি অনিমেষের সঙ্গে, মাধবীলতার সঙ্গে। কিন্তু সেই হাঁটা নেহাৎই রচনাটিকে পড়ে শেষ করবার তাগিদে নয়। আমাদের প্রাণের তাগিদে। ... তাই ‘কালবেলা’, না’ইবা হলো ‘জাঁ ক্রিস্তফ্‌’ বা ‘অপরাজিত’ তথাপি অন্তিমে সে’ও এক পুনর্জন্মের ইঙ্গিত রেখেযায় ...

লেখককে বলে দিতে হয়না ‘কালবেলাঃএকটি বিদ্রোহের গল্প’ বা ‘কালবেলাঃএকটি প্রেমের উপাখ্যান’।...

কিন্তু এই রচনাটির নামে তা বলে দেওয়া হয়েছে। পড়তে গিয়েই মনেহয় ‘শরাইঘাট'এর পরে 'একটি প্রেমকাহিনী' কথা গুলো বলার কোনো দরকার ছিলো কি? প্রেম কাহিনী না'কি বিচ্ছেদ-গাথা সেটা পাঠককে তার মতো করে বুঝে নিতে এই বাক্যবন্ধটি অসুবিধা সৃষ্টি করে। অন্তিমে এ'ও মনেহয় যে, যেহেতু লেখক নিজেও গ্রন্থটির 'প্রেমকাহিনী' চরিত্রটি নিয়ে নিশ্চিত নন তা'ই নামে ঐ বাক্য-বন্ধ ব্যবহার করলেন ...

একই প্রশ্ন জাগে লেখক যখন রচনা শরীরের বাইরে গিয়েও বার বার বলে যেতে থাকেন এই রকমের কথাঃ

রাসকিন বন্ড আমারো অতি প্রিয় এবং পূজনীয় লেখক। ফলে এই রচনাটি লিখতে বসার আগে আমি পড়ে নিই উল্লিখিত ঐ উপন্যাসটিও  এবং পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করি যে এই কাহিনীর ভিত্তিতেই শ্যাম বেনেগার তাঁর আঙ্গুলে ‘ভালো ছবি’র একটি, ‘জুনুন’ করেছিলেন...। সমরেশ মজুমদার’এর ‘কালবেলা’ যেমন নকশাল আন্দোলন,  A Flight of Pigeons’ এ’ও তেমনি সিপাহী বিদ্রোহ নির্মাণ করে আবহ। কিন্তু দুইটি উপন্যাসেই এই দুইটি ঐতিহাসিক ঘটনা নিছক মূক আবহ হয়ে থাকেনা। ‘কালবেলা’ তে লেখক, ক্রমে, নকশালপন্থী রাজনীতির প্রতি তাঁর সমর্থনের কথা জানান দেন এবং অনিমেষের ( না’কি মাধবীলতা’র ?) টানে পাঠকের সমর্থনও নেন আদায় করে। A Flight Of Pigeons’এর ভূমিকায় বন্ড লিখেনঃ “In retelling the tale for today’s reader I attempted to bring out the common humanity of most of the people involved— for in times of conflict and inter-religious or racial hatred, there are always a few (just a few) who are prepared to come to the aid of those unable to defend themselves I published this account as a novella about thirty years ago. I feel it still has some relevance today, when communal strife and religious intolerance threaten the lives and livelihood of innocent, law-abiding people. It was Pascal who wrote, ‘Men never do evil so completely and cheerfully as when they do it from religious conviction.’ Fortunately for civilization, there are exceptions.” আর তাঁর রচনাতেও তাই, প্রকারান্তরে,সমালোচিত যতোটা হয় সিপাহী বিদ্রোহ তার বেশী আলোচিত হয় মানবমনের অন্দর-রহস্য। বন্ড্‌ কিন্তু এ’ও বলেন, যে, এই কাহিনী ’ may be based on fact’

কিন্তু ‘ ‘শরাইঘাটঃএকটি প্রেমকাহিনী’’ বিষয়ে লেখকের বক্তব্যঃ

লেখক কেন এতো জোর দিচ্ছেন ‘সত্য নয়’ কথাটির উপর? তার কারন কি এ’ই যে লেখকও জানেন এইসব টংকে-বংকেরা আসলে সত্য নয়? আসলে সত্য অঞ্জন চক্রবর্তীর খুনীরা’ই????

লেখক বলছেন ‘বানিয়ে বলা সত্য’। ঠিক। কিন্তু ‘সত্য’ টি কি? সত্যটি যদি এ’ই হয় যে দীপু নামক একটি ছেলের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো দিনগুলি তাহলে প্রশ্ন ওঠে ঐ দিনগুলির কথা পাঠকের কোন ফিজিক্যাল বা মেটাফিজিক্যাল দরকারে লাগবে যে অর্থে বন্ডের সৃষ্ট রুথ্‌ বা জাভেদ খান’কে জানার মাধ্যমে পাঠক জেনে নেন মানব মনের আরেক দিগন্তকে? যে অর্থে অনিমেষ বা মাধবীলতা’কে জানার মাধ্যমে পাঠক জেনে নেন সেই সত্য যা ‘সঙ্ঘ নয়, শক্তি নয়, আরো আলো ... মানুষের প্রতি এক মানুষীর গভীর হৃদয়’...

শিল্পের সত্য থেকে এখানেই, আমার কাছে, বিচ্যুত হয় ‘দীপু’। তারপরে আসে ঐতিহাসিক ‘সত্য’র কথা যার ভিত্তিহীনতার কথা আগেও কিছুটা বলেছি।

৪।

রচনার প্রথম পংক্তিতেই আমরা জানতে পারি যে সেটা ১৯৭৭ ইংরেজি। অর্থাৎ ১৯৬৯ এর দিনগুলি তখন ক্যালেন্ডারে রক্তাক্ত-উপস্থিত। বাঙ্গালী তার নিজের ভাষায় কথা বলতে চেয়ে আন্দোলন করলে আসাম সরকার চালিয়েছে গুলি। ১৯ শে মে শিলচরে শহীদ হয়েছে এগারোজন ছেলেমেয়ে। ১৯৭২ এ খুন হয়েছে বাচ্চু চক্রবর্তী। আসামের সরকার পায়ে পিষে মুছে দিতে চেয়েছে আসামের বাংলীর অস্তিত্ব – যে বাঙ্গালীদের বাস আসামের বরাক উপত্যকায়, যে বাঙ্গালীরা পার্টিশানের আগে পর্যন্ত ছিল পূর্ব বাংলার বাসিন্দা ... ফলতঃ সেই বাঙ্গালী যখন ‘রাষ্ট্র’ নামক যন্ত্রের অনর্গত অমীমাংসিত দ্বন্দ্বের কারনে হয়ে পরলো আসামের বাসিন্দা তখন স্বভাবতঃই তাদের কাছে অসমীয়া ভাষা হলোনা গ্রহনযোগ্য, তারা শিখলোনা অসমীয়া, তারা অসমীয়া অধ্যুষিত ‘আপার’ আসামকে বল্লো ‘আসাম’। কাজেই রচনার প্রথম পাতাতেই, ঈষৎ ব্যাঙ্গের সুরে যখন লেখক বলেনঃ ‘ উহার দেশ কাছাড়ে, যে দেশকে আজকাল বরাক ভ্যালি বলা হইয়া থাকে; যাহা আসামেরই একটি জিলা অথচ যে দেশ হইতে ট্রেনে চাপিবার সময় লোকে ‘আসাম যাইতেছি’ বলিয়া থাকে’। -এই উচ্চারনে ‘যেন‘আসাম যাইতেছি’ না বলিলেই ভালো হইত, ‘আসাম’ই আমাদের দেশ বলিয়া ভাবিতে পারিলে ভাল হইত’ এমন একটি ইঙ্গিত রয়েছে কোথাও আর যে ইঙ্গিতটি, মূলতঃ, এই রচনার মূল সুর। অর্থাৎ বাঙ্গালীরা অসমীয়াদের ‘বুঝলো’ না, ‘কর্তা’ বলে মেনে নিলোনা এমন একটি কথা সর্বত্র প্রচ্ছন্ন। কাছাড় বা বরাকের লোকে অসমীয়া বলেনা, জানেনা বলে দীপু প্রায়ই লজ্জা পায়, দুঃখ পায়, কিন্তু দীপু এটা ভাবেনা যে এইসব বাঙ্গালীরা যে ঐতিহাসিক বাস্তবতার থেকে আজ ‘আসাম’এর বাসিন্দা সেই ঐতিহাসিক বাস্তবতার কোনোখানে অসমীয়া ছিলোনা। তারপরেও হয়তো বরাকের বাঙ্গালী অসমীয়া শিখতে পারতো যদি না তাকে বন্দুক দিয়ে শেখানোর চেষ্টা করতো অসমীয়া ‘প্রভু’ রা। ১৯৬৯’এর ইতিহাস, কিছুটা, এখানে তুলে দিচ্ছি  www.unishemay.org নামক ওয়েব-পাতা থেকেঃ

“... সেবার সারা পৃথিবী যখন বিশ্বকবির জন্মশতবর্ষ উদযাপন সমারোহে ব্যস্ত, তখন বরাক নদীর দুপারে চলছিল কবিগুরুর ভাষায় কথা বলার, গান গাইবার, জীবন সাধার অধিকার অর্জনের লড়াই। কবিপক্ষেই আসামের বরাক উপত্যকার তৎকালীন অবিভক্ত কাছাড় জেলার সদর শহর শিলচরের রেল স্টেশনে পুলিসের গুলিতে জীবন আহুতি দিয়েছিল ১১ জন তরুণ তরুণী। রক্তদানের পুণ্যে অর্জিত হয়েছিল বরাক উপত্যকার তিনটি জেলার জন্যে সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি। সেদিন বাংলা ভাষার অধিকার অর্জনের লড়াই শুধুমাত্র বাঙালির লড়াই ছিল না। বাংলা ও বাঙালি ছিল অগ্রভাগে, কিন্তু লড়াই ছিল বহুত্বের স্বপক্ষে বহুভাষী মানুষের লড়াই। ১৯ মে’র গুলিচালনার প্রতিবাদ করে আসাম বিধানসভা থেকে প্রথম যিনি পদত্যাগ করেন, তিনি নন্দকিশোর সিংহ। ভাষিক পরিচয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি। শিলং শহরে ঐতিহাসিক মৌনমিছিল করেছিলেন খাসি পুরুষ রমণীরা। এই বহুত্বের চেতনাই উনিশের চেতনা। বহুভাষিক আসামে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকারের সংগ্রামই ছিল সেদিনের বাংলা ভাষা আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য। উগ্র জাতিদম্ভের বিরুদ্ধে বহুত্বের লড়াই ১৯৬১ সালের পর এগিয়ে গেছে ১৯৭২ সাল হয়ে ১৯৮৬ ও ১৯৯৫ সালেও। ১১ জন তরুণ তরুণীর রক্তচিহ্ন লাঞ্ছিত পথ ধরে শহীদত্বের পথে যোগ দিয়েছেন করিমগঞ্জে ১৯৭২ সালে বাচ্চু চক্রবর্তী ও ১৯৮৬ সালে জগন (জগন্ময় দেব) ও যীশু (দিব্যেন্দু দাস)। রক্তদানের একই ধারায় যুক্ত হয়েছেন ১৯৯৫ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি ভাষার সংগ্রামে কলকলিঘাটে বীরাঙ্গনা সুদেষ্ণা সিনহা। আমাদের ইতিহাস ও ভূগোল পরস্পর দ্বন্দ্বযুদ্ধে মেতে আছে সেই কবে থেকে। ফলেই আমাদের গানে ছবিতে সাহিত্যে আমাদের জীবনধারায় এক চিরন্তন বিরহগাথা,এক অনিঃশেষ দীর্ঘশ্বাস। প্রত্যন্তের নিভৃতিতে একান্তে বেজে চলা আমাদের বাঁশির সুর এখনো বহির্বিশ্বে প্রায় অশ্রুতই ...”

অথচ সংবেদনশীল, সাহিত্য-প্রেমী, উদারমনা দীপু’র মর্মের কোনোখানে এই বাস্তবতার চিহ্নমাত্র নেই। বরং ‘আমগো ভাষা অহইম্মা’ কাহিনীর সত্যতা নিয়ে সে প্রকাশ করে সংশয়। রচনার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখক বলেন ‘আসিবার সময় ( অর্থাৎ দীপু’র ‘আসাম’এ পড়তে আসার সময়) নানাজনে বুঝাইয়াছিল যে আসামে এখন কোনো গন্ডগোল নাই, ৬১ সালের রাজ্যভাষা আন্দোলন এবং ৭২ সালের শিক্ষামাধ্যম আন্দোলনের রেশ কিছুমাত্র নাই’। যেন ঐ আন্দোলনগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা কোনো ‘স্ট্রাইক-স্ট্রাইক’ খেলা ... হায়, রচনাটির আবহ ১৯৭৭ হলেও রচনাটি যখন লিখিত হচ্ছে তখন অসমীয়া আগ্রাসনের, অতি নিম্নমানের জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটে গেছে একাধিকবার, তথাপি, বিষয়গুলিকে লেখক আনলেন এমনি হাল্কা চালে! হায়, এই প্রসঙ্গগুলি উল্লেখ না করলেও কিন্তু রচনার কিছু ক্ষতি বৃদ্ধি হতোনা! তেমনি ‘আমগো ভাষা অহইম্মা’র উল্লেখ না করলেও চলতো। তবু তা’ও উল্লেখ করলেন লেখক, লিখলেনঃ ব্রহ্মপুত্র ভ্যালির বাঙ্গালী মুসলমানদের কেউ কেউ নিজেকে অসমীয়া বলিয়া পরিচয় দেয় এবং বাঙ্গালী হিন্দুদের একটু এড়াইয়া চলে। দাঙ্গার সময় উহারা নাকি অসমীয়া হইয়া যায়। উহাদের বিষয়ে একটি মজার জনশ্রুতি আছে, যে, লোকগণনার সময় উহারা নাকি বলিত – আমাগো ভাষা অহইম্যা’ – এতোদূর বলেই আবার ব্র্যাকেটে এন্টিডোট্‌ দিয়ে রাখলেন লেখক – ‘ সত্যমিথ্যা বলা মুশকিল, যদুকাকার স্টকে এরকম গল্প থাকে’... ‘আমগো ভাষা অহইম্মা’ যেন একটি রগড় ... হায়, আসামে যে অসমীয়ারাই প্রকৃতার্থে সংখ্যালঘু এই তথ্যটি ঢাকতে বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙ্গালী মুসলমানদের অভয় দিয়েছিল অসমীয়ারা। বলা হয়েছিল মাতৃভাষা ‘অসমীয়া’ হলে কোনো ‘ডর’ নেই। ভোটাধিকার পাক্কা। কেননা এতে আসামে ‘অসমীয়া ভাষী’ জনতার পরিসংখ্যানে যে প্রভাব তা’তে প্রমাণিত হবে আসামে ‘অসমীয়ারা’ই সংখ্যা গড়িষ্ঠ। অতএব ‘আপার আসাম’ (ধেমাজি, ডিব্রুগড়,লখিমপুর, গোলাঘাট, শিবসাগর ও তিনসুকীয়া) এর নানা স্থানে বসবাসকারী  বঙ্গভাষী জনতার এক বৃহৎ অংশ ‘তোমার মাতৃভাষা কী’ এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন ‘আম্‌গো ভাহা অহইম্মা’। তথাপি  ঘটেগেলো ‘নেলী’। ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী প্রকাশ্য দিবালোকে নগাঁও’এর নেলীতে খুন হলেন ২১৯১ মানুষ ( বেসরকারী হিসেবে ৫০০০ এর’ও বেশী)। এঁরা মূলতঃ বাংলাভাষী মুসলমান। এঁদেরকে খুন করা হলো কেননা এঁরা চলেছিলেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে। হয়তো আসামের অসমীয়া ‘প্রভু’দের পক্ষে ঐ ভোটাধিকারের প্রয়োগফল হতোনা তেমন সুবিধা জনক সুতরাং ঘটে গেলো এই গনহত্যা। অর্থাৎ ‘আম্‌গো ভাহা অহইম্মা’ বলেও জান বাঁচাতে পারলেন না আসামের অনসমীয়া জনতা। এই গণহত্যার পেছনের আরেকটি বাস্তবতা ছিল এই, যে, ঐ উদ্বাস্তু মুসলমানেরা যে জমিকে করেছিল সোনা ফলানোর জমি তা’ই অসমীয়ারা বহু আছে ‘পতিত জমি’ বলে দিয়েছিল ছেড়ে। এবার সোনা যে’ই ফললো তখন এই জমিতো  আর থাকতে পারেনা অনসমীয়ার দখলে ...

সেই আরেকটি বাঙ্গালী চরিত্র, যে মূলতঃ অসমীয়াদের আন্দোলনের মূল চরিত্রটি নিয়ে কথা বলছিল ট্রেনে যেতে যেতে, তাকেও দীপু আঁকে সেই কালো কালিতেই। বলে এর বীরত্ব গৌহাটি স্টেশনে এসেই মিইয়ে যাবে। হায় দীপু,অদ্যাপি আমাদের মতো যাদের ভিটে বাড়ি আসামে অথচ পেটের ধান্দায় থাকতে হয় ভারতবর্ষের অন্যত্র, তারা অদ্যাপি দেখি, যে, হাওড়া থেকে গৌহাটি অভিমুখে ট্রেন ছাড়লে গাড়ি ব্যান্ডেল পার হওয়া পর্যন্ত অসমীয়া যাত্রীর আপ্রান (ভুল ভাল) বাংলা বলেযায় আর ব্যান্ডেল পার হলেই অসমীয়া ছাড়া জানেনা অন্য কিছু। পক্ষান্তরে গৌহাটি থেকে হাওড়ার দিকের ট্রেনে, ব্রহ্মপুত্র ব্রীজ পার হওয়ামাত্রই শুরু হয় তাদের বংগ-বাতচিত ...

#

আর বেশী উদাহরন টেনে লাভ নেই। দীপু’র অসমীয়া হয়ে ওঠার মাধ্যমে লেখক যদি জাতীয় সংহতির দিকে অঙ্গুলী নির্দেশের কথা ভেবে থাকেন তাহলে বলতে হয়, না, সংহতি এভাবে হয়না। এই রচনাও মূলতঃ একদেশদর্শী। এই রচনা যদি হয় নেহাৎই স্মৃতিকথা তাহলে বলতে হয় দ্বিতীয় সংস্করনে দীপু’কে অসমীয়া করেও তার মধ্যে সুপ্ত বাংগালী বিদ্বেষকে ফিল্টার না করলে দীপুকে হজম করা মুশকিল।

৫।

আগেই বলেছি আমার কাছে এই রচনাটি শিল্প হিসাবে কানাকড়ি মূল্যও রাখেনা তথাপি একে নিয়ে লেখালেখি শুধু এই কথাটিই জানিয়ে যেতে, যে, হে পাঠকবন্ধু, এই যে আসাম দেখছো, এই বই’এ, যেখানে সব-অসমীয়াই ভালো আর কাছাড়ের সব বাঙ্গালীই ‘মূর্খ’, ‘কাপুরুষ’, ‘নেমক হারাম’ তা কিন্তু ঠিক নয়। ঐ বাঙ্গালীগুলি যে অসমীয়া বলেনি তার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ, রক্তাক্ত, ইতিহাস ... হে পাঠক, তোমার শিল্পের সংজ্ঞায় যদি এই বই ‘শিল্প’ হয় তবেও এই বই অসম্মান করেছে কাছাড়ের বাংগালীকে, সেই মৃত ছেলেমেয়েদেরকে, খুন হওয়া অঞ্জন দত্ত’র উন্মাদ হয়ে যাওয়া মা’কে ... আর ‘দীপু’র অসমীয়া হয়ে যাওয়ার মধ্যে সেই অসম্মানের বীজ নয়, বীজটি নিহিত প্রকারান্তরে তার কাছাড়ের বাঙ্গালীকে খুঁচিয়ে যাওয়ার মধ্যে।

এই কথাগুলি পাঠকের কাছে বলে যেতে আমি প্রথম লিখেছিলাম ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২ তে, বইটি পড়ে শেষ করতে পারার পর। আমার সেই লেখাটির ভিত্তিতে কবি ও চিন্তাবীদ গৌতম বসু’র সঙ্গে আমার একটি পত্রালাপ দিয়েই আপাততঃ থামছি।

ক) গৌতম বসুর চিঠিঃ

সপ্তর্ষি,

তোমার আলোচনা পড়লাম। দেবাশিসের উপন্যাসটি আমার খুব ভালো লেগেছে তাঁর লেখার গুণে। এখন অনুভব করছি, শুধুমাত্র লেখার গুণে দেবাশিস আমাকে একটা রক্তাক্ত প্রেক্ষিত ভুলিয়ে দিতে পেরেছেন। কতোদূর গ্রহনযোগ্য এই অবস্থা ( অর্থাৎ আমার ভালোলাগা টুকু ) , তা একটি গভীর প্রশ্ন। যাঁরা বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন, আমার এই ভালোলাগাটুকু তাঁদের অসম্মানের কারন হলো কি’না, এটা নিয়ে কাল থেকে ভাবছি। সপ্তর্ষি, তুমি আমাকে একটা সুকঠিন প্রশ্নের মুখে, একটা অমীমাংসার সামনে এনে ফেল্‌লে,ভাই।

সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ উপন্যাস প্রসঙ্গে কথা বলছিনা, কোনো তূলনামূলক বিচারেও যাচ্ছিনা। আমি অন্য দুটি প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই।

এক, কালী দাশগুপ্ত মহাশয়ের মুখটি মনে পড়ছে। যে সময়ের কথা এটা, তার ঠিক আগে নেলীতে মানুষ মারা হয়েছে। তিনি আমাকে ক্যাসেটের স্পুলের স্তূপ দেখিয়ে বলেছিলেন এই গান গুলি স-ব নেলী থেকে সংগ্রহ করেছিলাম (তাঁর ভাষায় ‘ফিল্ড রেকর্ডিংস্‌’)। তারপর বুক ফাটা হতাশা নিয়ে তিনি আমায় ঐ প্রশ্ন করেছিলেন, ঐ সরল মানুষগুলোকে কে মারছে, কেন মরতে হলো তাঁদের? ঐ হত্যাকান্ড, তাঁর এবং সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের বিশ্বাসের জগতের বাইরের জিনিস রয়েগেলো আজো।

দুই, অলিভার টুইস্ট অবলম্বনে একটি ফিল্ম তৈরী হয়েছিল। নাম ‘অলিভার!’, বোধ করিষাটের দশকে, একটি মিউজিক্যাল-কমেডি। ছবিটি আমি ডিভিডিতে এখনো দেখি, বার বার দেখি, দেখতে বাধ্য হই তার প্রসাদগুনের কারনে। যতোবাএ দেখি ততোবার একটা অপরাধবোধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, আমি ভাবি এ আমি কি করলাম!

আজ এই পর্যন্ত।

ভালো থেকো।

গৌতম বসু

১৭ সেপ্টেম্বর ২০১২

খ) আমার উত্তরঃ

গৌতমদা,

আপনি আমার ‘আলোচনা’র প্রকৃত উৎস আর উদ্দেশ্য দুটোকেই এত পরিষ্কার করে দিয়েছেন, এমন কি, নিজের কাছেও, যে নত হতে বাধ্য হচ্ছি, আবারো আপনার মনন ও ‘ইন্টেলেকচুয়াল অনেস্টি’র কাছে। “কতদূর গ্রহণযোগ্য এই অবস্থা (অর্থাৎ আমার ভালোলাগাটুকু), তা একটি গভীর প্রশ্ন। যারা বাংলাভাষার জন্য প্রাণ দিলেন, আমার এই ভালোলাগাটুকু তাঁদের অসম্মানের কারণ হলো কি হলো না, এটা নিয়ে কাল থেকে ভাবছি”। এই “অমীমাংসা”র জন্ম, শত-জন-মননে, সেই আমার “আলোচনা”র অভীষ্ট। আপনার চিঠিতে তা’যে সিদ্ধ হয়েছে এমন না ভাবার কোনো হেতু নেই।

আপনি লিখেছেন “তোমার আলোচনা পড়লাম। দেবাশিসের  উপন্যাসটি আমার খুব ভালো লেগেছে, তার লেখার গুণে। এখন অনুভব করছি, শুধুমাত্র লেখার গুণে দেবাশিস আমাকে একটা রক্তাক্ত প্রেক্ষিত ভুলিয়ে দিতে পেরেছেন”। গৌতমদা, সমস্যাটা এখানেই। আপনার মত যে কয়েকজন মুষ্টিমেয় মানুষ, পশ্চিমবঙ্গে থেকেও ঘটনাগুলি জানেন, তাঁদের ক্ষেত্রে ‘ভুলিয়ে দেওয়া’র প্রশ্নটা ওঠে। যারা ঐ প্রেক্ষিতটি জানেননা আদৌ, বা ভবিষ্যতের পাঠক তাদের কি হবে? তারা ত’ ধরে নেবে গোটা আসামের বাঙ্গালীদের গোটা ব্যাপারটাই এমন একটা তামাসা, যেমন দেখিয়েছেন দেবাশিসদা... আমি বুঝে নিতে, ভেবে নিতে চাইছি ঠিক কোন মানসিক জ্যামিতি জন্ম দেয় এই রকমের সূক্ষ্ম  মিথ্যার চর্চার... সত্যকে এড়িয়ে যাওয়াও কি নয় মিথ্যা? মিথ্যাচার?... আমার আলোচনাটি পড়ে ডাক্তার, সমাজকর্মী, মৃন্ময় দেব, যিনি জীবনের দীর্ঘতম সময় কাটিয়েছেন ‘আপার আসাম’এ আর কর্মসূত্রে নিবিড়ভাবে গ্রাম-আসামের সাথে পরিচিত হয়েছেন, তিনি জানালেনঃ আলোচনার যুক্তিগুলি অকাট্য নিশ্চয় (উপন্যাসটা পড়া হয়নি যদিও), তবে একটা কথা কিন্তু ঠিক যে ঐ সময় একজাতের দীপু-মানসিকতা সত্যিই গড়ে উঠেছিল। এটা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। সে বিচারে দেবাশিস তরফদার হয়ত উক্ত বাস্তবতাকে ধরার প্রয়াস করে থাকবেন। এর পেছনে একটা কারণও ছিল। সে সময়ে অসমে তরুণদের মধ্যে বামপন্থী চিন্তার প্রসার ঘটেছিল, মূলত পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালিয়ে আসা নকশালদের দৌলতে। বাঙালি এমনিতেই রোমান্টিক-বামপন্থী, ফলে একটা অবাস্তব মানসিকতা জন্ম নিল, এরা অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে একদল বাঙালির উন্নাসিকতার পাপ স্খালনে উঠে পড়ে লেগে গেলো। আর অসমীয়া বামপন্থীরাও (ভালো অসমীয়া) খানিকটা আত্মতুষ্টি লাভ করল। লক্ষ্য করলে দেখবেন উগ্র জাতীয়তাবাদকে পুরোপুরি নাকচ করে অসমে কোন মতবাদ/আন্দোলন গড়ে তোলা প্রায় দুঃসাধ্য (এটা ইসলামের ক্ষেত্রেও দেখা যায়)- কাজেই বামপন্থীরা একটা অবাস্তব আপোষ-মীমাংসায় পৌঁছে ‘ভালো অসমীয়া’ ও ‘ভাল্‌ বঙালি’-র এক উদ্ভট সমীকরণ তৈরি করে ফেলে, দীপু সম্ভবত সেই ‘ভাল্‌ বঙালি’-র প্রতিনিধি।

কে সত্য? দেবাশিস তরফদারের ‘দীপু’ না এই ডাক্তারটির অনুভূতি??? ‘দীপু’কে দিয়ে এই মিথ্যাচারটি লেখক কেন যে করালেন আমি জানিনা তবে এটা যে মিথ্যা, মিথ্যাচারই, সে বিষয়ে আমার কোনো দ্বিধা নেই তাই আপনার এই সংশয়ের ব্যাপারেঃ “কতদূর গ্রহণযোগ্য এই অবস্থা (অর্থাৎ আমার ভালোলাগাটুকু), তা একটি গভীর প্রশ্ন। যারা বাংলাভাষার জন্য প্রাণ দিলেন, আমার এই ভালোলাগাটুকু তাঁদের অসম্মানের কারণ হলো কি হলো না, এটা নিয়ে কাল থেকে ভাবছি” আমি বলব শুধু তাঁদের নয়, এই মুহূর্তে আসামে যে বাঙ্গালী, যে বিহারী বা আরো অন্যান্য ভাষার ও জাতির মানুষ এই অসমীয়া আগ্রাসনের শিকার তাদের প্রত্যেকের প্রতি এই লেখাটি, সাহিত্য মূল্য থাকুক আর নাই থাকুক, অপমানজনক। আমি, সত্যি, বুঝলাম না, দেবাশিসদা ঠিক কি ভাবে ও কারণে এতোবড় সত্যটাকে নেহাত  “ইয়ার্কি” বলে এড়িয়ে গেলেন। গৌতমদা, এ্‌ নিয়ে প্রশ্ন আছে কিন্তু আমার মর্মে কোনো অমীমাংসা নেই। এর হেতুও হয়তো এই, যে, আমি ‘দীপু’র মতো একটা অবাস্তব জায়গা থেকে জিনিসগুলোকে আবাল্য দেখিনি। আমার বাবা-মা দুজনেই ১৯৬৯ এর ভাষা আন্দোলনে জেল খেটেছেন, লুকিয়ে দল নিয়ে কলকাতায় এসেছেন রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য। নলিনাক্ষ সান্যাল তাঁদের সাহায্য করেছিলেন। আমি নিজে, এগারো ক্লাস থেকে, PCC CPIM(L) এর সক্রিয় সদস্য ছিলাম ও সেই সূত্রে, যেহেতু ঐ দল বিশ্বাস করে, Caste struggle is class struggle, আমাকে অসমীয়া, বোড়ো, খাসিয়াদের সঙ্গে মিশতে ও থাকতে হয়েছে দিনের পর দিন, ফলে আমি দেখেছি ঠিক কি ভাবে জাতি ও ভাষাগত দ্বন্দ্ব আসামের পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমার বন্ধু সৌম্যজিত’কে এই ১৯৮৯ সালেও ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজ থেকে পড়া ছেড়ে পালাতে হয়েছে শুধুমাত্র বাঙ্গালী হয়ে বাংলায় কথা বলার জন্য যেখানে অন্যান্যরা ‘দীপু’ হয়ে বেশ টিকে গেছে।

এই ক’দিন আগেও যখন কাতারে কাতারে ছেলে মেয়ে পালিয়ে গিয়েছে বেঙ্গালোর, পুনা, হায়দ্রাবাদ, বোম্বে থেকে। প্রাণের ভয়ে। এরা সব উত্তরপূর্বের মানুষ। মূলতঃ আসামের। হয়তো এর পেছনে রয়েছে গুজব, হয়তো ‘রাজনীতি’। সে প্রসঙ্গে পরে যাবো। তার আগে বলে নিই যে, যেহেতু আমিও ‘অফিসিয়ালি’ ‘আসাম’এর, যেহেতু আমিও থাকছি এই বেঙ্গালোর শহরেই, ফলতঃ এই ঘটনা ঠিক ‘তাত্বিক’ বা ‘দার্শনিক’ ভাবে নয়, আমাকে আক্রমণ করে রক্তে মাংসে। আমি টিভিতে খবর শুনি, ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখি কোন দিকে যাচ্ছে ঘটনার গতি এবং অন্তিমে ফোন করি, ই-মেইল্‌ করি বেঙ্গালোরবাসী অন্য চেনা পরিচিতদের। তারা বলে, মনে হয় ঠিকই বলে, কেননা সেটাই স্বাভাবিক, যে, ‘আমাদের ভয় নেই, মেইন্‌লী ট্রাইবেল্‌রা’ই টার্গেট’ তারপর সামান্য থেমে ‘আর আমাদের চিন্তা কি? কেউ বললে বলবো আমরা কলকাতার’। আমি উত্তেজিত বোধ করি। নিপীড়িত বোধ করি। না, কলকাতা নিয়ে আমার কোনো ঘৃণা বা বিদ্বেষ নেই। কিন্তু প্রাণে বাঁচার জন্য নিজের আদত জন্মস্থানের কথা না বলে নিজেকে বলবো ‘কলকাতার’??? ‘দীপু’ কে যখন ‘বরাকের লোকে আসামী জানেনা কেন?’ বলা হচ্ছিল, তখন দীপু যদি বলতো যে ‘আসামীরা এই আসামীতে কথা বলার জন্য এতো মানুষ মেরেছে যে ঐ ঘেন্নায় বরাকের লোক আসামী বলেনা” তাহলে গোটা লেখার কোনো ক্ষতি হতো কি? (লেখক তো বলেইছেন গল্প মানে বানিয়ে বলা সত্য, তা এইটুকু কথা বানিয়ে বললে আর যা’ই হোক লেখাটির স্নব্‌ চরিত্রটি দূর হতো)।

আমি নিহত বাচ্চু চক্রবর্তীর পত্নীকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনি, আমি জানি বাকী এগারো জন আর ১৯৮৬ সালে নিহত জগন-যিশু’র পরিবারকে কিভাবে ঐ অসমীয়ারা অত্যাচার করেছে, জানি আজ তারা কিভাবে জীবিত। কাজেই, ঐ জানার মূল্যে, ‘দীপু’র এই র‍্যালা, বাঙ্গালীদের নিয়ে আমি সহ্য করতে পারিনা। আমি নিজে ২ বছর গৌহাটিতে থেকেছি, কাজ করেছি কিন্তু একটি অসমীয়া শব্দ উচ্চারণ না করে, আমি অসমীয়া শিখিনি শুধু এই কারণে, যে, যে ভাষা শেখানোর জন্য মানুষকে মারতে হয় সেই ভাষা ঘৃণ্য না’ও যদি হয়, যারা তাকে চাপিয়ে দিতে চায় তারা ঘৃণ্য। কাজেই ‘দীপু’ ‘অসমীয়া’ হলে আমার আপত্তি হয়না, অনেক ছেলেমেয়ের মধ্যে মা-বাপের দু চারটে ছেলে তো কুলাঙ্গার হয়েই যেতে পারে, কিন্তু সেই ‘কুলাঙ্গার’ যখন অন্য ভাই-বোনেদের নিয়ে কটূক্তি করে তখন আমার সহ্যের সীমা পার হয়ে যায়।

আপনি লিখেছেন “সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ উপন্যাস প্রসঙ্গে কথা বলছিনা, কোনো তুলনামূলক বিচারেও যাচ্ছিনা”। আমি ‘কালবেলা’ উপন্যাস প্রসঙ্গ আনার আগে ভেবেছিলাম ডক্টর জিভাগো’র আবহে করবো আলোচনাটা কেননা সেখানেও আবহ এমনি এক রাষ্ট্র-বিপ্লব কিন্তু পরে মনে হল এই ‘শরাইঘাট...’ এর প্রেক্ষিতে পাস্তেরনায়েককে নামিয়ে আনলে সেটা তাঁকে অপমান ছাড়া আর কিচ্ছু হবেনা। ‘গোরা’র কথাও মাথায় এসেছিল। কিন্তু এই ‘শরাইঘাট’ ঐ সমস্ত লেখার পাশাপাশি উচ্চারিত হওয়ার দাবী রাখেনা বলে শেষ পর্যন্ত ‘কালবেলা’তেই এলাম...যদিও আমার ধারনা ‘কালবেলা’ এই ‘শরাইঘাট’ থেকে ঢের সফল ও সত্য...।

আপনার চিঠিতে কালী দাশগুপ্ত মহাশয়ের যে অনুভব তা আমি টের পাই শুধু বুদ্ধি দিয়ে নয়, রক্ত-মাংস-শিরা-উপশিরা দিয়ে। ‘অলিভার’ ছবিটি আমি দেখিনি। এখন, পড়ে, দেখার ইচ্ছে করছে। তবে আপনার বক্তব্য আমি অনুধাবন করতে পারি। এমনটা আমারও হয়। অনেক ক্ষেত্রেই হয়। দালি’র ছবি যখনই দেখি, মানে দেখতে দেখতে মুগ্ধ হই কখনো, তারপর আমারও এমনি অপরাধবোধ  কাজ করে। বা ধরুন কখনো হিট্‌লারের ‘ক্যাম্প’ এর কিছু অংশ ভালো লাগার পরও তেমনি একটা অপরাধবোধ কাজ করেছিল। তবে ‘শরাইঘাট’ এর ব্যাপারে প্রসঙ্গটা অন্য। এখানে হিট্‌লারি’টা এসেছে সত্যকে গোপন করে। যে পাঠক ঐ ঐতিহাসিক সত্যগুলিকে জানেন না তাঁদেরকে “ঘুমে বেচবার” মতো করে। কাজেই আমি নিশ্চিত, এখন, এই আলোচনাটি পড়বার পরে, আবার খুলে বসলে এই লেখা আপনাকে ঐ শিল্পিত শান্তিও দেবেনা।

আমি এই চিঠিগুলি প্রকাশ করতে চাই। আপনার অনুমতি পেলে।

সপ্তর্ষি

১৭/০৯/২০১২

#

হ্যাঁ, আর কিছু না হোক সৎ পাঠক শুধু এটুকু বিচলিত বোধ করুন, যেটুকু করেছেন গৌতম বসু তাহলেও আমার এই ধর্মযুদ্ধ বহুদূর অর্থবহ হবে ...

কোন মন্তব্য নেই: