সুলেমানপুরের আয়েশা খাতুন, কিংবা আয়েশা খাতুনের সুলেমানপুর, দুটোই আমার কাছে অচেনা। কিন্তু কেন জানি এক নিবিড় টান অনুভব করি সুলেমানপুরের প্রতি আর ওইখানটার আয়েশা খাতুনের প্রতি। মাঝে মাঝে এমন লাগে যে ওই সুলেমানপুর আমার চিরচেনা একটা জায়গা আর আয়েশা খাতুন আমার রক্তের কেউ। এবার বলি নামটা জানি কিভাবে। হরফ প্রকাশনি আর আনন্দ পাবলিশার্সের বই সেই ছোটবেলা থেকেই দেখছি ঘর ভর্তি। ইসলামিক বই ছাড়া ও কিছু গল্প, ভ্রমন কাহিনি, আত্মজীবনী ধরনের প্রায় সবই ছিল হরফ প্রকাশনির আর দেশ, আনন্দমেলা, মিস না যাওয়া আনন্দমেলার পুজো সংখ্যা সহ বাকি পই পত্তর প্রায় ওই আনন্দ পাবলিশার্সের ছিল। আমার সীমিত বাল্য কৈশোরের মিশ্র নজরে ওই দুই পাবলিশার্সের ই ছিল এক চেটিয়া আধিপত্য আমাদের ঘরে। এছাড়া আরও কিছু সমগ্র মনে পড়ে গীতি বিতানের সম্পূর্ণ ভল্যুমের সাথে। সুকান্ত, শরৎ, হেমন্ত, সুভাষ সমগ্রের সাথে ওদের কবিতার বই, উপন্যাস ও ছিল যাদের পাবলিশার্স কে ছিল ঠিক মনে নেই। নবকল্লোল, কাকলি সহ আরও কিছু মোটা সাইজের ম্যাগাজিন ছিল যাদের দেখলে মনে হতো চল্লিশ ঊর্ধ্ব অভিনেত্রি, অতিরিক্ত মেদে নেতিয়ে পড়া শরীরে আগের সেই তেজ নেই তাই বাধ্য হয়ে শেলফের নিম্ন সারি থেকে দেখছে উত্তরসূরি আনন্দমেলার যৌবনোদ্দিপ্ত দাপট। আমার কিন্তু বেশ মায়া লাগতো ওদের প্রতি, তাই প্রায় ই ছুটির দিনে ওদের একটু সেবা যত্ন করতাম। এই যেমন ধুলো ঝেড়ে আবার ঠিকঠাক রাখা, ভেতরের ছোটো ছোটো বই পোকাদের পিষে মারা, আর ওদের তৈরি অসংখ্য বেক স্লেশ আর ফরওয়ার্ড স্লেশের মত য-ফলা গুলো দেখে দেখে একটু হারিয়ে যাওয়া। আরেকটা বিষয়ে ওই ম্যাগাজিন গুলোর প্রতি আমার একটা ভাব ছিল, সে হচ্ছে আশির দশকের বিজ্ঞাপনের স্টাইল টা দেখা, সুন্দর দু’লাইনের একটা ছড়া দিয়ে বিজ্ঞাপন গুলো থাকতো। যাইহোক, কথায় কথায় অনেক চলা, আসল কথাই হয়নি বলা। সুলেমানপুরের আয়েশা খাতুন।
সে একটা বই এর নাম ছিল। আব্দুল আজিজ আল-আমানের। একটা গ্রাম্য মাঠ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একটা মেয়ে। যদ্দুর মনে পড়ে বইয়ের প্রচ্ছদ টা ছিল এরকমই একটা ছবির। আমার আজ অব্ধি বইটা পড়া হয় নি, অনেকবার দেখেছি শেলফে বিভিন্ন বই খুঁজতে গিয়ে, কিন্তু কেন জানি পড়া হয়ে ওঠেনি এখনও। প্রবাস জীবনে যতবারই আমার ঘরের পড়ার ঘর টা নিয়ে ভেবেছি, শেলফের কোন বই কোথায় ছিল নিয়ে ভাবনায় ডুব মেরেছি, ততবারই ওই বইটার কথা মনে পড়েছে আর প্রতিবারই বলতাম এবার ঘরে গেলে বইটা নিয়ে আসব সঙ্গে করে। আর ওই ভাবনা-চিন্তা আর না আনার বিড়ম্বনায় কবে যে আমার মনে নিজস্ব এক সুলেমানপুর জন্ম নিয়েছে সে কথা টের ই পাই নি। আর তাই প্রায় ই সুলেমানপুর নিয়ে ভাবলেই চোখে ভেসে ওঠে সুলেমানপুরের ভোর, বৃষ্টি স্নাত শান্ত সাদা রঙ এর দুপুর, পড়ন্ত বিকেলের হেলান দেয়া রোদ আর ঝিঁঝিঁ পোকায় ডাকা সুলেমানপুরের রাত।
আগের রাতের ঝড় তুফানের আছড় লাগা গ্রামের চুন দেয়া মসজিদের পুরনো দেয়াল, গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়া পথের পাশের গর্ত থেকে নাক ডাকানো বেঙের কোরাস আর কিছু বয়স্ক নিয়ে নামাজ শেষে ইমাম সাহেবের পুব আকাশে একমনে তাকানো কে সাক্ষী রেখে ধীরে ধীরে সূর্য যেন চলে এসেছে লক্ষ মাইল অতিক্রম করে এদের কাছে, পাখি গুলো যেন আবার জেগে উঠেছে এক নতুন আনন্দে, লাঙল হাল নিয়ে আবার চাষিরা মাঠে। সুলেমানপুরের সে এক নতুন স্নিগ্ধ ভোর।
বেলা বাড়তেই আবার ও মেঘলার ঘোর, কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে যায় সুলেমানপুরের আকাশ। একধরনের ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে যাওয়া শেষ সকালে কোত্থেকে যেন একদল ছেলের দল জুটে যায়, ছোটো ছোটো গর্ত গুলোয় বাঁধ দিয়ে শুরু হয় জল সেঁচা, আর মাছ ধরার সময় প্রায় সবারই রঙ এক হয়ে যাওয়া দলের একজন হয়ে উঠে রীতিমত হিরো। মাগুর, শিং আর কই মাছ ধরার তাঁর অকপট কৌশলে পাড়ে বসা পান মুখো ইঁচড়ে পাকা যুবাদের মুখে ফুটে বিশেষণের ফুলঝুরি।
এক পশলা বৃষ্টিতে সুলেমানপুরের দুপুর আবার ও সবুজ হয়ে উঠে। ভেজা মাটি আর রৌদ্রের গন্ধে ম ম করছে গ্রামের মেঠো পথ। সদ্যোজাত বাছুরের উদ্দেশ্যহীন দৌড়ের পেছনে পেছনে ক্লান্ত শিশু মুচকি হেসে মুখ লুকোয় যখন দেখে তাকে কেউ লক্ষ্য করছে।
সুলেমানপুর নিয়ে এরকম আরও কত কিছু মনে আসে প্রায়ই। কখনও ডুব দেই আবার কখন ও ভাবি এবার না হয় বইটা পড়েই ফেলব ঘরে গেলে। আমি আবার ও ঘরে গেলাম, দিন কাটালাম অলসের মত, কাজের কাজ কিছুই হল না, সোমবারে স্কুলে যাওয়ার মত মুখ করে আবার ও ফিরে এলাম। ভাবি থাক আমার সুলেমানপুর না পড়া, থাকুন আয়েশা খাতুন যেভাবে আছেন সে ভাবেই। আমি আমার প্রবাস জীবনে মাঝে মাঝেই ঘুরে আসব সুলেমানপুর। মুচকি হেসে আবার ও বুঝাব সুলামানপুরের কথা কৌতূহলী বউকে। আর কোন কিছুই বুঝে উঠতে না পারা বউয়ের প্রশ্ন বোধক মুখ কে এক পাশে রেখে আবার ও মেতে উঠবো সুলেমানপুরে।
১ সেপ্টেম্বর, ২০১২ (c) Picture: ছবি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন