“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

রাধের বুক ধড়ফড় করে


বুক ধড়ফড় করে...
আমার বুক ধড়ফড় করে

রাধে, তোর সোনার অঙ্গ
চারপেয়েতে উঠল এবার বল।

বৃন্দাবনে বাঁধবি বাসা,
সেই সুখেতেই চল।

যমুনার বুক, ধড়ফড় করে
কৃষ্ণ পরান জ্বলে,
রাধা এখন গাছের ডালে,
ঝুলে.. শুধু ঝুলে...

রাধিকা বিহনে কৃষ্ণ সখারা মূলী বাঁশের পাল্কি তৈরিতে ব্যাস্ত। চিত্রগুপ্তের নির্দেশ, পাল্কির মতো চারপেয়ে চাই। ঈশ্বরের আদালতে অভিযোগ জানিয়েছিল রাধাসখীর দল। যে রাধার যৌবন গেল কৃষ্ণ বিহনে, বার্ধক্য গেল বৃন্দাবনের পথে পথে কৃষ্ণ বিহনে, তার দেহ কিনা কেটে ফালা ফালা করে ফেলা হবে পুরসভার ডাস্টবিনে! এ কোন ধর্ম!

ন্যায্য অভিযোগ পেয়ে চার্জশীট দাখিল করলেন নারদ মুনি। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে না। প্রেমের গোকুলে এই অন্যায়! এতো বড় পাপাচার! রাধার অঙ্গ কেটে কিনা শেষে ফেলে দেয়া হবে ময়লাখোলায়!

আদালতের নির্দেশ, হিন্দু মতেই সৎকার করতে হবে। বৃদ্ধা, স্বামীহীনা, নিঃস্ব রাধাসখীদেরও এই কষ্ট আর সইতে দেয়া যাবে না। দিতে হবে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, আর গোকুল রাজার ভাতাও। হিন্দু রীতি মেনে হতে হবে দাহ। আম কাঠের আকাল পড়লে মরাল গাছের ডাল দেবে শ্মশান বন্ধুরা, মধু দেবে, ঘি দেবে, তিল দেবে, কাঁচা চালের মণ্ডা দেবে আর গঙ্গার কাঁদা।

তবে আগর নেই, আগ্রাতলার আগর গাছে বহু আগেই পোকায় ধরেছে। নিম চন্দন কেটে নিয়ে গেছে ডাকাতের দল। মধু পোকাদের বাসায় প্লাস্টিক হাতের অনুপ্রবেশ। যেমন কুমারি মেয়ের পেটে হাত ঢুকিয়ে বুক টিপতে টিপতে ওঝা বের করে আনে অবাঞ্ছিত ভ্রূণ। যেন সঙ্গমে লিপ্ত প্যালাস্টিকের হাত!

রাধিকা চলেছেন স্বর্গে। নতুন কাপড় পড়িয়ে সখীরা চিতায় তুলবেন তাদের প্রিয় সখীকে।
পুরুষের দল ডান হাতে দিল রাধিকার মুখে প্রিয় নারকেল নাড়ু। সখীর দল বাম হাতে দিল বিন্নি ধানের খই, আটার মণ্ডা। কেউ দিল নতুন ভাতের দলা আর কদম ফুল।

সোনার অঙ্গে এখন আর সেই জেল্লা নেই। গায়ে হলুদ মাখিয়ে স্নান শেষে রাধার বুকে বেঁধে দেয় কাঁচুলি। লালের বুকে সবুজ রঙে আঁকা মাছ, ফুল আঁকা অস্ত্রের ছবির প্রিয় কাঁচুলি। বুক এখনও গরম, শুটকে যাওয়া আঙুরের লাহান নরম টসটসে, রসে ভরপুর।
ধড়ফড়, ধড়ফড় করে লো সই ... ধড়ফড়, ধড়ফড় করে।
বের পায়না রাধার বুকে এই এক চিলতে কাপড়ের টুকরো। মেয়ে মাইনসের বুকে আজীবন সব আদর, ভালবাসা, কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রণা ঘাপটি মেরে থাকে। একটা বিশাল জীবন রে কি এই কাপড়ের টুকরো দিয়ে বাঁন্ধন যায়!
এখনও আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে তাকিয়ে আছে উন্নত স্তন। শরীরের বাঁধনে বার্ধক্য এলেও স্তনসম পৃথিবীর বুকটা, এখনও কাঁপন ধড়ায় কৈলাসে। একটুও হেলে পড়েনি। লজ্জা পায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। আকাশ টের পায় নিজের বুকে, বুক ঝাপ্টানির কাতর আঘাত।
নারী শুধু হৃদয় সর্বস্ব গোপন বোঝাপড়ার খনি, মিছে নয় তার অস্ফুট, চাপা যন্ত্রণা। মিছে নয় তার এই সাহস, ঔদ্ধত্য আর অহংকার। সৃষ্টি কে বশে রাখার যাবতীয় কৌশল তার রপ্ত। ঢাল নেই, তরবারি নেই আছে শুধু স্ফটিকের মতো জল আর শুধু জল। যেমন থাকে পাকের মধ্যি শাপলা ফুল পৃথিবীর সব রঙ নিয়ে একা!

###
ফুলবতির সই রাধা। গত হপ্তায় তার কাঁচুলি দিয়েই মরালা গাছের ডালে বেঁধে খাঁচায় পুড়ে রাখা হয়েছিল মাস তিনেকের মৃত শিশুকে। কিভাবে যে দুধ খেতে খেতে বুকের মধ্যেই মরে গেল তুক্কিটা! আজও কাঁপন ধরে। এক বছরের বাচ্চা মরলে বেঁধে রাখতে হয় কাঁচুলি দিয়ে মরালার মগডালে। যাতে ঈশ্বরের কাছে যেতে পারে সেই শিশু খুব সহজেই। ফুলবতি গিয়ে দেখে আসে প্রত্যেকদিন তার তুক্কি কে গাছের ডালে ঝুলছে। বাপটা আর কোনদিন ছুতে পারবে না এই মরাল গাছের ডাল। ঘুমের মধ্যেও চুমা খায় তুক্কির গাল ভেবে উদাম বুকে। এরপর জেগে উঠে হামলে পড়ে শরীরে। আবার যেন এই রাতেই জন্ম দিতে চায় আরেকটা তুক্কির। শেষে চুক চুক করে মাই চুষে খায়। পাশেই শুয়ে থাকা শুয়োরের বাচ্চা গুলি শব্দ তোলে,  ঘোঁতর ঘোঁতর...ঘোঁত... ঘোঁত...

রাধা কয়, পাণ্ডব পুত্রেরাও অজ্ঞাত বাসে যাবার কালে তাদের অস্ত্রশস্ত্র মায়ের শব বলে ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছিল কামিবৃক্ষের মগডালে। পাছে কেউ না ছুঁতে পারে। শব ঈশ্বরের কাছে যাবে, তাই পোকায় মাকড়ে খেলে দেবতার ভোগে লাগবে না। শ্বাপদ আর শৃগালের খাদ্যে রুচি হয়না ঈশ্বরের। ঈশ্বরের এই বিধান।

###
এবার রাধার শরীর তুলে ধরবে মরদের দল। আহা, আস্তে ধর! ব্যাথা পাবে তো সোনার অঙ্গ। পা চেপে ধরে লাথির পর লাথি মারবে মাটির দেয়ালে। এরপর মাটির চিতায় আগুনে পুড়ে খাক হবে সোনার শরীর। হায়লো রাধে তোর বুঝি এবার শেষ হল সংসারের সুখ, মায়া চিরতরে!
আকাশমুখো  হবি, কানহার দেখা পাবি, যমুনায় এবার নাইবি, আমার বুক ধড়ফড় করে...!
নদীর জলে ভাসবে তোর চারপেয়ে পাল্কি। নদীর কুলে হবে রে তোর বিয়া,আমরা খাবো শেঙড়া পাতার চা।

রাধে, বুক ধড়ফড় করে,
শেঙড়া গাছের শরবৎ দে লো, কইলজা করি ঠাণ্ডা।
রাধে তোর নাভি খাবে রাজায়
কপালের চাড়া নেয় চিলে
কানহার বাঁশি শুধু বাজে
আমার মন উদাসী হয়

আমার বুক ধড়ফড় করে লো সই...
বুক ধড়ফড় করে।

আমার মন ক্যামন করে। লাথি মেরে ভাঙবো এবার গর্ভের ফুলটারে
আমার মন ক্যামন করে লো রাধা, বুক ধড়ফড় করে...।

২টি মন্তব্য:

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় বলেছেন...

মিত্রপক্ষর সব লেখাই আমার বোধকে নাড়া দেয় , এই লেখাটাও তার ব্যতিক্রম নয় । মিত্রপক্ষর লেখা কে কবিতা না গদ্য এ রকম কোন বেড়া দিয়ে বিচার করা যায়না । আমার মুগ্ধতা জানাই লেখককে । ওর একতা লেখা পড়ার জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকা যায় - থাকিও । আর সেজন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য সুশান্তর ও ।

সুশান্ত কর বলেছেন...

ওমা! আমার আবার এতে কৃতিত্ব কিসের? আমি এই ব্লগের মালি মাত্র। ব্লগটা আমাদের সবার। আপনার মতো ওয়েব কাগজের সম্পাদক নইতো।