“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২

মধু পূর্ণিমা

কাশটা দেখলেই, হিংসা চলে যায়
চাঁদ উঠলেই, প্রেম হয়ে যায়

ফুল ফুটলেই,সকাল হয়

তুমি হাসলেই মেঘ করে
তুমি কাঁদলেই বৃষ্টি নামে

তুমি থাকলেই পূর্ণিমা
পৃথিবীতে আজ মধু পূর্ণিমা

বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

‘শরাইঘাট’ - একটি প্রেমকাহিনী?

                                                সপ্তর্ষি বিশ্বাস

১।

একটি প্রকৃত শিল্পবস্তু মূলতঃ পুনর্জন্ম ঘটায় পাঠকের, শ্রোতার, দ্রষ্টার। পাঠক-শ্রোতা-দ্রষ্টার মর্মে তা ঘটায় এমন কোনো পরমানগত পরবর্তন যা প্রতিফলিত হয় পাঠক-শ্রোতা-দ্রষ্টার গুনগত পরবর্তনে। ঠিক যেমন লোহাকে চুম্বকের কাছে রেখে দিলে লোহা, ক্রমে চুম্বক। তেমন বৃষ্টি হলে পাথরও হয়তো কাদা ... পক্ষান্তরে বহু শিল্প প্রচেষ্টার ছায়ায় এসে এ’ও অনুভুত হয়, যে, হলোনা, জন্মান্তর হলোনা। চুম্বকের টান লাগলো বটে কিন্তু সত্তার পরমানগত অদল বদল হলোনা। তাই হলোনা জন্মান্তর। নানা স্থানে আলোড়িত হলো মন। ঠিক। কথন নৈপুণ্যে। কোথাও। কোথাও বা প্লটের উজ্জ্বলতায়। তথাপি অন্তিমে, এক পশলা বৃষ্টি থামলে যেমন, সেই একই রোদ, একই ধূলোবালি ... ধারাস্নান, আষঢ়ের, হলোনা ...

ঠিকই একই অনুভুতি হলো দেবাশিস তরফদারের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘শরাইঘাটঃএকটি প্রেমকাহিনী’ পড়ে শেষ করার অন্তিমে। আমরা জানলাম বরাক উপত্যকার ছোট একটি শহর দীপু বলে একটি ছেলে পদার্থ বিদ্যায় স্মাতকোত্তর পাঠ নিতে এলো থেকে আসামের রাজধানী গৌহাটিতে। সময়টা সত্তরের দশকের শেষ।  জানলাম তার বেশ কিছু বন্ধু বান্ধব হলো। তাদের সঙ্গে মিশে সে ‘অসমীয়া’ হলো, ‘কমরেড’ হলো। অনেক অসমীয়া গান টান শুনলো। সে জানলো অসমীয়া একটি অতি উন্নত ভাষা। হোষ্টেলে মারদাঙ্গা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকশান হলো। ক্রমে দানা বাঁধলো আসামের বিখ্যাত ‘বঙ্গাল খেদা’র আরেকটি পর্ব। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলো কিছুদিন। পরীক্ষাও তাই গেলো পিছিয়ে। দীপু ফিরে এলো। তারপর বেশ কিছুদিন পরে এড্‌মিট্‌ কার্ড পেয়ে আবার গেলো সেই হোষ্টেলে। তখন সেখানে অন্য বাতাস। পুরোনো বন্ধুরাও ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে... হারিয়ে যাচ্ছে যাপনের বাস্তবতার হাহাকারে ...

এই সবই জানলাম ‘দীপু’র মুখে আর তার বন্ধুদের নানান আলোচনায়। কিন্তু পাঠক হিসাবে ‘দীপু’কেই যে চিনলাম না ঠিক করে। দেখলাম দীপু ‘অসমীয়া’ হয়েগেলো , কিন্তু সেই হওয়াটা এতো সরল একটি পথ ধরে ঘটলো, যে, পাঠকের মনে হতে বাধ্য যে লেখক দীপুকে অসমীয়া করার জন্যই এনেছিলেন এখানে। যা’ই অসমীয়া তা’ই তার ভালো লাগে। কেন লাগে? না’ত দীপু নিজেকে এই প্রশ্ন করে কোনোখানে না’ত লেখক দেন কোনো ইঙ্গিত। ‘কমিউনিষ্ট’ হওয়ার ব্যাপারেও তা’ই। দীপু কমিউনিষ্ট হয়ে গেলো। তবে পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে তার কমিউনিষ্ট হওয়ার একটা আবছা যুক্তি খাড়া করা যায় এইভাবে, যে, যে সব ‘কমিউনিষ্ট’ ছেলেদের সঙ্গ সে পেয়েছিল তারা ছিল ‘ভালো’। তবে এই ‘ভালো’ যায় বাস্তবতার মাত্রা পেরিয়ে। ঐতিহাসিক ভাবে দেখলে এ কথা সত্য, যে, বাঙ্গালী বিরোধী তৎকালীন অসমীয়া ক্রিয়া কলাপে ‘কমিউনিষ্ট’ ছাত্র আর ‘কমিউনিষ্ট’ পার্টী সত্যিই একটি ইতিবাচক ভূমিকা বহুদিন পালন করেছিল। কিন্তু ‘যা’ই অসমীয়া তা’ই ভালো’র যে কাহন এখানে শুনিয়েছেন লেখক তা’র পেছনে যুক্তি, ব্যাখ্যা কিছু পেলামনা বিশেষ। অসমীয়া লোকগান ইত্যাদির উল্লেখ প্রায় পাতায় পাতায়। সেগুলির ভাষা ও ভাব ( আমার সীমিত অসমীয়া জ্ঞানে) অবশ্যই উন্নত কিন্তু যে বাঙ্গালী ছেলে ‘দীপু’ কবিতা টবিতা পড়ে, সাহিত্য রসিক সে’কি পূর্ব বা পশ্চিম বাংলার লোকগান কোনোদিন শোনেনি? যদি শুনে থাকে তাহলে সেগুলির ভাব, ভাষা তাকে কি স্পর্শ করেনি? কাহিনীর দীপু’র কাছে এ বিষয়ে কিছুই আমরা শুনিনা। আর শুনিনা বলেই মনেহয় যে দীপু’কে হাজিরই করা হয়েছে অন্তিমে ‘অসমীয়া’ বানানোর জন্য। কিন্তু কেন এই বানানো? জানিনা। দীপু অতোদূর অসমীয়া নাহলেও কাহিনীর কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হতো কি? হয়তো হতো। সে বিষয়ে আসছি পরে। আপাততঃ রচনাটির স্থাপত্য-চরিত্রের দিকে একটু ফিরে যাই।

  এটি কি উপন্যাস না’কি দিনলিপি না’কি নানা জনের নানা কথা’র একটি রানিং কমেন্ট্রি? যারা কথা বলছে তাদের রক্তমাংসের অস্তিত্ব বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার আগেই তাদের কথার তোড়ে ভেসে যেতে হচ্ছে পাঠককে।  কিন্তু এ’কে ঠিক হালের ‘appearance is essence’ তত্ত্ব দিয়েও ব্যাখ্যা করতে পারিনা কেননা এদের ‘appearance’ ই বিশ্বাসযোগ্য হয়না সর্বত্র। একই সমস্যা দীপু’কে নিয়েও। দীপু একটি দিন থেকে আরেকটি দিনে পৌঁছায়। পাঠককে, রচনাটি পুরো পড়ে শেষ করবার তাগিদ ছাড়া অন্য কোনো কারনে প্রয়োজন হয়না তাকে অনুসরন করবার। হ্যাঁ, ‘কথা’ কোথাও কোথাও জমে ওঠে। ঠিক। কিন্তু পর মুহুর্তেই যেন তার রেশ যায় হারিয়ে। রাশ যায় আলগা হয়ে।

কি কথা বলে দীপু? কি কথা বলে তার সঙ্গী সাথীরা? তারা নানা বিষয়ে কথা বলে। রাজনীতি থেকে কবিতা। ঠিক যেমন সুনীল গংগো’র ‘আত্মপ্রকাশ’এর চরিত্ররা বলতো। ঐ অনর্গল কথা বলা ছাড়া ‘আত্মপ্রকাশ’এর চরিত্রেরা যেতো শূঁড়ি খানা আর গণিকালয়ে আর এরা যায় কমলালয়’এ, চায়ের দোকানে, ক্লাসে, হোষ্টেলের ক্যান্টিনে ... কেন যে শূঁড়ি খানা আর গণিকালয়ে যায়না তা’ও এক প্রশ্ন ...

‘দীপু’র পাশাপাশি মনেপড়ে ‘অনি’কে। অনিমেষ। অনিমেষ মিত্র। সমরেশ মজুমদার’এর ‘কালবেলা’র। সে’ও এমনি এক ছোটো শহর থেকে এসেছিল কলকাতায়। এমনি এক টাল মাটাল সময়ে। সে’ও ক্রমে হয়ে উঠেছিল ‘কলকাতা’র ছেলে। হয়ে গিয়েছিল ‘কমিউনিষ্ট’। কিন্তু তার এই হয়ে ওঠা স্রেফ কথায় কথায় হয়ে ওঠা ছিলনা। সব কিছুর আগে সে নিজে পরিগ্রহ করেছিল রক্ত মাংসের চরিত্র। তারপর, ক্রমে, আমরা দেখেছি, বহু দ্বিধা, দ্বন্দ্ব পার হয়ে তার ‘কমিউনিষ্ট’ হওয়া, ‘নকশাল’ হওয়া। আড্ডা, ‘কথা’ আমরা শুনেছি সেখানেও, সেখানেও হোষ্টেল-মেস্‌’এর অন্দর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দার আমরা হেঁটেছি অনিমেষের সঙ্গে, মাধবীলতার সঙ্গে। কিন্তু সেই হাঁটা নেহাৎই রচনাটিকে পড়ে শেষ করবার তাগিদে নয়। আমাদের প্রাণের তাগিদে। ... তাই ‘কালবেলা’, না’ইবা হলো ‘জাঁ ক্রিস্তফ্‌’ বা ‘অপরাজিত’ তথাপি অন্তিমে সে’ও এক পুনর্জন্মের ইঙ্গিত রেখেযায় ... আর ঐ ইঙ্গিত এতোই বাস্তব যে প্রায় কুড়ি বৎসর আগে পড়া উপন্যাসটি, এই লেখাটি লিখতে লিখতে, আবারো খুলে বসে দেখি প্রায় প্রতিটি অধ্যায় এখনো মনে আছে সে রকমই ...

দেবাশিস তরফদারের ‘শরাইঘাটঃএকটি প্রেমকাহিনী’র অন্ততঃ কিছু ‘কথা’, কিছু অংশ দাবী রাখে আসামের, অসমীয়াদের বাঙ্গালী বিদ্বেষের ইতিহাসের নিরিখে বিচার করার। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সেড়ে নিই আরো কিছু আনুষাঙ্গিক কথা... যেমন...রচনাটির নামে ‘শরাইঘাট' এর পরে 'একটি প্রেমকাহিনী' কথা গুলো বলার কোনো দরকার ছিলো কি? প্রেম কাহিনী না'কি বিচ্ছেদ-গাথা সেটা পাঠককে তার মতো করে বুঝে নিতে এই বাক্যবন্ধটি অসুবিধা সৃষ্টি করে। অন্তিমে এ'ও মনেহয় যে, যেহেতু লেখক নিজেও গ্রন্থটির 'প্রেমকাহিনী' চরিত্রটি নিয়ে নিশ্চিত নন তা'ই নামে ঐ বাক্য-বন্ধ ব্যবহার করলেন ...

একই প্রশ্ন জাগে লেখক যখন রচনা শরীরের বাইরে গিয়েও বার বার বলে যেতে থাকেন এই রকমের কথাঃ


রাসকিন বন্ড আমারো অতি প্রিয় এবং পূজনীয় লেখক। ফলে এই রচনাটি লিখতে বসার আগে আমি পড়ে নিই উল্লিখিত ঐ উপন্যাসটিও  এবং পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করি যে এই কাহিনীর ভিত্তিতেই শ্যাম বেনেগার তাঁর আঙ্গুলে ‘ভালো ছবি’র একটি, ‘জুনুন’ করেছিলেন...। সমরেশ মজুমদার’এর ‘কালবেলা’ যেমন নকশাল আন্দোলন,  A Flight of Pigeons’ এ’ও তেমনি সিপাহী বিদ্রোহ নির্মাণ করে আবহ। কিন্তু দুইটি উপন্যাসেই এই দুইটি ঐতিহাসিক ঘটনা নিছক মূক আবহ হয়ে থাকেনা। ‘কালবেলা’ তে লেখক, ক্রমে, নকশালপন্থী রাজনীতির প্রতি তাঁর সমর্থনের কথা জানান দেন এবং অনিমেষের ( না’কি মাধবীলতা’র ?) টানে পাঠকের সমর্থনও নেন আদায় করে। A Flight Of Pigeons’এর ভূমিকায় বন্ড লিখেনঃ “In retelling the tale for today’s reader I attempted to bring out the common humanity of most of the people involved— for in times of conflict and inter-religious or racial hatred, there are always a few (just a few) who are prepared to come to the aid of those unable to defend themselves I published this account as a novella about thirty years ago. I feel it still has some relevance today, when communal strife and religious intolerance threaten the lives and livelihood of innocent, law-abiding people. It was Pascal who wrote, ‘Men never do evil so completely and cheerfully as when they do it from religious conviction.’ Fortunately for civilization, there are exceptions.” আর তাঁর রচনাতেও তাই, প্রকারান্তরে, সমালোচিত যতোটা হয় সিপাহী বিদ্রোহ তার বেশী আলোচিত হয় মানবমনের অন্দর-রহস্য। বন্ড্‌ কিন্তু এ’ও বলেন, যে, এই কাহিনী ’ may be based on fact’

কিন্তু ‘ ‘শরাইঘাটঃএকটি প্রেমকাহিনী’’ বিষয়ে লেখকের বক্তব্যঃ


‘বানিয়ে বলা সত্য’। ঠিক। কিন্তু ‘সত্য’ টি কি? সত্যটি যদি এ’ই হয় যে দীপু নামক একটি ছেলের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো দিনগুলি তাহলে প্রশ্ন ওঠে ঐ দিনগুলির কথা পাঠকের কোন ফিজিক্যাল বা মেটাফিজিক্যাল দরকারে লাগবে যে অর্থে বন্ডের সৃষ্ট রুথ্‌ বা জাভেদ খান’কে জানার মাধ্যমে পাঠক জেনেনেন মানব মনের আরেক দিগন্তকে? যে অর্থে অনিমেষ বা মাধবীলতা’কে জানার মাধ্যমে পাঠক জেনে নেন সত্তরের দশক’কে ‘মুক্তি’র দশক করার স্বপ্নের বিনিময়ে পোচ্ছিম বোঙ্গের ভামপন্থী সরকার ঠিক কি দিয়েছিল যুবসমাজকে ...

সত্যটি যদি এ’ই হয় যে দীপু নামক একটি ছেলের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো দিনগুলি তাহলে এই আলোচনার পরের অংশের প্রয়োজন অন্ততঃ আমার কাছে ছিলোনা কিছু, কিন্তু সত্যটি যদি এ’ই হয় যে দীপু নামক একটি ছেলের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো দিনগুলির বর্ণনের আনাচে কানাচে লেখকের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ঢুকেপড়া কিছু ‘কথা’, কিছু ‘সুর’ আমাকে বাধ্য করে পরের অংশটি লিখতে।

২।

রচনার প্রথম পংক্তিতেই আমরা জানতে পারি যে সেটা ১৯৭৭ ইংরেজি। অর্থাৎ ১৯৬৯ এর দিনগুলি তখন ক্যালেন্ডারে রক্তাক্ত-উপস্থিত। বাঙ্গালী তার নিজের ভাষায় কথা বলতে চেয়ে আন্দোলন করলে আসাম সরকার চালিয়েছে গুলি। ১৯ শে মে শিলচরে শহীদ হয়েছে এগারোজন ছেলেমেয়ে। ১৯৭২ এ খুন হয়েছে বাচ্চু চক্রবর্তী। আসামের সরকার পায়ে পিষে মুছে দিতে চেয়েছে আসামের বাংলীর অস্তিত্ব – যে বাঙ্গালীদের বাস আসামের বরাক উপত্যকায়, যে বাঙ্গালীরা পার্টিশানের আগে পর্যন্ত ছিল পূর্ব বাংলার বাসিন্দা ... ফলতঃ সেই বাঙ্গালী যখন ‘রাষ্ট্র’ নামক যন্ত্রের অনর্গত অমীমাংসিত দ্বন্দ্বের কারনে হয়ে পরলো আসামের বাসিন্দা তখন স্বভাবতঃই তাদের কাছে অসমীয়া ভাষা হলোনা গ্রহনযোগ্য, তারা শিখলোনা অসমীয়া, তারা অসমীয়া অধ্যুষিত ‘আপার’ আসামকে বল্লো ‘আসাম’। কাজেই রচনার প্রথম পাতাতেই, ঈষৎ ব্যাঙ্গের সুরে যখন লেখক বলেনঃ ‘ উহার দেশ কাছাড়ে, যে দেশকে আজকাল বরাক ভ্যালি বলা হইয়া থাকে; যাহা আসামেরই একটি জিলা অথচ যে দেশ হইতে ট্রেনে চাপিবার সময় লোকে ‘আসাম যাইতেছি’ বলিয়া থাকে’। -এই উচ্চারনে ‘যেন‘আসাম যাইতেছি’ না বলিলেই ভালো হইত, ‘আসাম’ই আমাদের দেশ বলিয়া ভাবিতে পারিলে ভাল হইত’ এমন একটি ইঙ্গিত রয়েছে কোথাও আর যে ইঙ্গিতটি, মূলতঃ, এই রচনার মূল সুর। অর্থাৎ বাঙ্গালীরা অসমীয়াদের ‘বুঝলো’ না, ‘কর্তা’ বলে মেনে নিলোনা এমন একটি কথা সর্বত্র প্রচ্ছন্ন। কাছাড় বা বরাকের লোকে অসমীয়া বলেনা, জানেনা বলে দীপু প্রায়ই লজ্জা পায়, দুঃখ পায়, কিন্তু দীপু এটা ভাবেনা যে এইসব বাঙ্গালীরা যে ঐতিহাসিক বাস্তবতার থেকে আজ ‘আসাম’এর বাসিন্দা সেই ঐতিহাসিক বাস্তবতার কোনোখানে অসমীয়া ছিলোনা। তারপরেও হয়তো বরাকের বাঙ্গালী অসমীয়া শিখতে পারতো যদি না তাকে বন্দুক দিয়ে শেখানোর চেষ্টা করতো অসমীয়া ‘প্রভু’ রা। ১৯৬৯’এর ইতিহাস, কিছুটা, এখানে তুলে দিচ্ছি  www.unishemay.org নামক ওয়েব-পাতা থেকেঃ

“... In 1961 when world woke up to celebrate the birth centenary of its poet-laureate, Rabindranath Tagore, the two banks of Barak rose to an wake up call to defend its legitimate right to sing in Tagore’s language, to dream in Tagore’s language, to live a Bengali life. In the railway track of the district town, Silchar of the then undivided district of Cachar of Assam, ten young men and a woman fell down to the bullets of the state police. In the aftermath of the valiant sacrifices of the martyrs, Bengali was made the official language of the three districts of present day Barak valley. The struggle that gave back Bengali its rightful place was never a struggle of the Bengalis’ alone. First to resign from Assam Legislative Assembly in protest of firing was Nanda kishore Singha, a Bishnupriya Manipuri. In a silent protest against the brutal police firing and consequent death of eleven martyrs, thousands of Khasi men and women were on the streets of Shillong. The pluralism exuded out of these events was the essence of the language struggle of 1961. Struggle for a pluralistic polity and life in a multilingual, multiethnic state like Assam is the uniqueness of the Bengalis’ language struggle of the state. Struggle for pluralism against the chauvinistic policies of the ruling classes took its thread from 1961 and went through the tumultuous events of 1972, 1986 and 1995. Bachchu Chakraborty in 1972, Jaganmoy Deb (Jagan) and Dibyendu Das (Jishu) in 1986, in Karimganj and valiant Sudeshna Sinha, a fighter for the cause of her mother tongue, Bishnupriya Manipuri in 1995 in Kalkalighat- followed the footsteps of the eleven martyrs of 1961 and joined the long column of glorious martyrs of history. History and Geography of this land, for long have been engaged in a duel which left an indelible imprint on the archaic memory of the populace. Our literature, our music and our folklore murmur the never-ending agony, the refrain of eternal tragedy of this land. The saga of our journey through the lonesome roads of history remains unheard till date.”

অথচ সংবেদনশীল, সাহিত্য-প্রেমী, উদারমনা দীপু’র মর্মের কোনোখানে এই বাস্তবতার চিহ্নমাত্র নেই। বরং ‘আমগো ভাষা অহইম্মা’ কাহিনীর সত্যতা নিয়ে সে প্রকাশ করে সংশয়। রচনার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখক বলেন ‘আসিবার সময় ( অর্থাৎ দীপু’র ‘আসাম’এ পড়তে আসার সময়) নানাজনে বুঝাইয়াছিল যে আসামে এখন কোনো গন্ডগোল নাই, ৬১ সালের রাজ্যভাষা আন্দোলন এবং ৭২ সালের শিক্ষামাধ্যম আন্দোলনের রেশ কিছুমাত্র নাই’। যেন ঐ আন্দোলনগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা কোনো ‘স্ট্রাইক-স্ট্রাইক’ খেলা ... হায়, রচনাটির আবহ ১৯৭৭ হলেও রচনাটি যখন লিখিত হচ্ছে তখন অসমীয়া আগ্রাসনের, অতি নিম্নমানের জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটে গেছে একাধিকবার, তথাপি, বিষয়গুলিকে লেখক আনলেন এমনি হাল্কা চালে! হায়, এই প্রসঙ্গগুলি উল্লেখ না করলেও কিন্তু রচনার কিছু ক্ষতি বৃদ্ধি হতোনা! তেমনি ‘আমগো ভাষা অহইম্মা’র উল্লেখ না করলেও চলতো। তবু তা’ও উল্লেখ করলেন লেখক, লিখলেনঃ ব্রহ্মপুত্র ভ্যালির বাঙ্গালী মুসলমানদের কেউ কেউ নিজেকে অসমীয়া বলিয়া পরিচয় দেয় এবং বাঙ্গালী হিন্দুদের একটু এড়াইয়া চলে। দাঙ্গার সময় উহারা নাকি অসমীয়া হইয়া যায়। উহাদের বিষয়ে একটি মজার জনশ্রুতি আছে, যে, লোকগণনার সময় উহারা নাকি বলিত – আমাগো ভাষা অহইম্যা’ – এতোদূর বলেই আবার ব্র্যাকেটে এন্টিডোট্‌ দিয়ে রাখলেন লেখক – ‘ সত্যমিথ্যা বলা মুশকিল, যদুকাকার স্টকে এরকম গল্প থাকে’... ‘আমগো ভাষা অহইম্মা’ যেন একটি রগড় ... হায়, আসামে যে অসমীয়ারাই প্রকৃতার্থে সংখ্যালঘু এই তথ্যটি ঢাকতে বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙ্গালী মুসলমানদের অভয় দিয়েছিল অসমীয়ারা। বলা হয়েছিল মাতৃভাষা ‘অসমীয়া’ হলে কোনো ‘ডর’ নেই। ভোটাধিকার পাক্কা। কেননা এতে আসামে ‘অসমীয়া ভাষী’ জনতার পরিসংখ্যানে যে প্রভাব তা’তে প্রমাণিত হবে আসামে ‘অসমীয়ারা’ই সংখ্যা গড়িষ্ঠ। অতএব ‘আপার আসাম’ (ধেমাজি, ডিব্রুগড়,লখিমপুর, গোলাঘাট, শিবসাগর ও তিনসুকীয়া) এর নানা স্থানে বসবাসকারী  বঙ্গভাষী জনতার এক বৃহৎ অংশ ‘তোমার মাতৃভাষা কী’ এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন ‘আম্‌গো ভাহা অহইম্মা’। তথাপি  ঘটেগেলো ‘নেলী’। ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী প্রকাশ্য দিবালোকে নগাঁও’এর নেলীতে খুন হলেন ২১৯১ মানুষ ( বেসরকারী হিসেবে ৫০০০ এর’ও বেশী)। এঁরা মূলতঃ বাংলাভাষী মুসলমান। এঁদেরকে খুন করা হলো কেননা এঁরা চলেছিলেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে। হয়তো আসামের অসমীয়া ‘প্রভু’দের পক্ষে ঐ ভোটাধিকারের প্রয়োগফল হতোনা তেমন সুবিধা জনক সুতরাং ঘটে গেলো এই গনহত্যা। অর্থাৎ ‘আম্‌গো ভাহা অহইম্মা’ বলেও জান বাঁচাতে পারলেন না আসামের অনসমীয়া জনতা। এই গণহত্যার পেছনের আরেকটি বাস্তবতা ছিল এই, যে, ঐ উদ্বাস্তু মুসলমানেরা যে জমিকে করেছিল সোনা ফলানোর জমি তা’ই অসমীয়ারা বহু আছে ‘পতিত জমি’ বলে দিয়েছিল ছেড়ে। এবার সোনা যে’ই ফললো তখন এই জমিতো  আর থাকতে পারেনা অনসমীয়ার দখলে ...

আহা দীপু, মহান দীপু, সে এসব জানেনা, বোঝেনা, ফলে সে ‘অসমীয়া’ হয়ে যায় সহজেই। তার যজ্ঞেশ্বর-টংকে’রাও এসব জানেনা তাই ‘সরল’ ভাবে বলে ‘শিলচর কি আসাম নয়’... হায়, আমি, অধম পাঠক, এই বাস্তবতাগুলিকে ভুলতে পারিনা বলে দীপুর এইসব মহান ভাবনাকে ‘ন্যাকামি’ ছাড়া অন্য কোনো সংজ্ঞাই দিতে পারিনা ...।আর দীপু শুধু অসমীয়া হয়ে গেলেই ক্ষতি কিছু ছিলোনা সে যদি আবার বাঙ্গালী বিদ্বেষীও না হয়ে উঠতো। বিহু দেখে দীপু মুগ্ধ। অতি উত্তম। কিন্তু যারা বিহু দেখে ততো মুগ্ধ নয় তাদের প্রতি কটাক্ষ কেন দীপুর? সে হয়তো ধামাইলে মুগ্ধ। দীপু তার খোঁজ করেনা। হ্যাঁ এর মনোভাবের মধ্য দিয়ে লেখক যদি তথাকথিত ‘জাতীয় ঐক্য’এর ধ্বজাধারীদের ভন্ডামীর দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষন করার ইঙ্গিত করে থাকেন তাহলে এর একটা কোনো অর্থ হয়। নতুবা এ কি নয় সরাসরি বাঙ্গালী’র প্রতি কটাক্ষ? হ্যাঁ অসমীয়াদের কিন্তু justify  করছে দীপু, বলছে ‘একজন বাঙ্গালী বিদ্বেষীও প্রেম করে, চাঁদের আলো ভালোবাসে, গান শোনে পাগলের মতো। সে একজন মানুষ। আজকাল ঘন ঘন দীপুর এই অনুভব হয়’। - অতি উত্তম অনুভব।  এই অনুভবের পাশাপাশি দীপু কিন্তু এটা অনুভব করেনা যে ‘একজন অসমীয়া বিদ্বেষীও প্রেম করে, চাঁদের আলো ভালোবাসে, গান শোনে পাগলের মতো। সে একজন মানুষ’। বরং বাঙ্গালী ছেলে উদয়ন বিশ্বাস যখন দীপুকে বলে যে এবার অসমীয়ারা বাঙ্গালী পেটাবে ফলে এখন হোষ্টেল থেকে চলে যাওয়াই মঙ্গল, দীপু কিন্তু তাকে আঁকে কালো কালিতে, বলে ‘কাপুরুষ’। একইভাবে আরেকটি বাঙ্গালী চরিত্র, যে মূলতঃ অসমীয়াদের আন্দোলনের মূল চরিত্রটি নিয়ে কথা বলছিল ট্রেনে যেতে যেতে, তাকেও দীপু আঁকে সেই কালো কালিতেই। বলে এর বীরত্ব গৌহাটি স্টেশনে এসেই মিইয়ে যাবে। হায় দীপু, অদ্যাপি আমাদের মতো যাদের ভিটে বাড়ি আসামে অথচ পেটের ধান্দায় থাকতে হয় ভারতবর্ষের অন্যত্র, তারা অদ্যাপি দেখি, যে, হাওড়া থেকে গৌহাটি অভিমুখে ট্রেন ছাড়লে গাড়ি ব্যান্ডেল পার হওয়া পর্যন্ত অসমীয়া যাত্রীর আপ্রান (ভুল ভাল) বাংলা বলেযায় আর ব্যান্ডেল পার হলেই অসমীয়া ছাড়া জানেনা অন্য কিছু। পক্ষান্তরে গৌহাটি থেকে হাওড়ার দিকের ট্রেনে, ব্রহ্মপুত্র ব্রীজ পার হওয়ামাত্রই শুরু হয় তাদের বংগ-বাতচিত ...

#

আর বেশী উদাহরন টেনে লাভ নেই। দীপু’র অসমীয়া হয়ে ওঠার মাধ্যমে লেখক যদি জাতীয় সংহতির দিকে অঙ্গুলী নির্দেশের কথা ভেবে থাকেন তাহলে বলতে হয়, না, সংহতি এভাবে হয়না। এই রচনাও মূলতঃ একদেশদর্শী। এই রচনা যদি হয় নেহাৎই স্মৃতিকথা তাহলে বলতে হয় দ্বিতীয় সংস্করনে দীপু’কে অসমীয়া করেও তার মধ্যে সুপ্ত বাংগালী বিদ্বেষকে ফিল্টার না করলে দীপুকে হজম করা মুশকিল।

‘শুধু ভঙ্গী দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ ...’




                                                     সপ্তর্ষি বিশ্বাস
     ১।

ন্যান্য ভাষার মতো বাংলা ভাষাতেও প্রতিদিন হাজার না হলেও অন্ততঃ শো খানেক গদ্য-পদ্য-উপন্যাসের বই ছাপা হচ্ছে। তার কিছু পড়ছে লোকে। কিছু পড়ছেনা। কিছু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিছু দিন। তারপর ভুলে যাচ্ছে। সেইসব বইপত্রের কিছু আমিও পাচ্ছি। কিছু পড়ছি। কিছু রেখে দিচ্ছি ‘পড়বো’ বলে। কিছু কিছু পড়ে ভালো লাগছে। কিছু কিছু লাগছে না। ভালো লাগলে এখানে ওখানে লিখে জানাই। না লাগলে কিছু বলিনা। আমার ভালো-খারাপ লাগায় তেমন কিছু আসে যায়না। সময়ের কাছে সব থাকে। কাজেই ... তাই দেবাশিস তরফদারের ‘শরাইঘাটঃএকটি প্রেমকাহিনী’ পড়েও কিছু লিখতাম না কেননা বইটি আমার এমন কিছু ভালো লাগেনি। দেবাশিস তরফদারের ঢের আরো ভালো লেখা পড়ার অভিজ্ঞতা থাকায় ‘পরে আবার লিখবেন খন’ এমনি আশা নিয়ে বসে থাকতাম। কিন্তু তা হলোনা। লিখতে হলো বইটি নিয়ে। লিখতে হলো যতোটা না সাহিত্য, শিল্পের আলোচনার প্রয়োজনে তার চেয়েও বেশী আমার নিজের ব্যক্তিগত অস্তিত্ব যা আমার জাতি ও ভাষাগত অস্তিত্বের ফসল মাত্র তার প্রতি বইটির ছুঁড়ে দেওয়া মিথ্যা অনুযোগ গুলির জন্য।

                  মনে করা যাক আমি বরাক উপত্যকার কেউ নই, মনে করা যাক আমি পশ্চিমবংগ বা বাংলাদেশের একজন পাঠক। থাকি দেশে বা বিদেশে। বুদ্ধি-শুদ্ধি আছে কিছুটা। আমি পত্রিকা টত্রিকা পড়ি। গল্প-উপন্যাসও পড়ি। এমতাবস্থায় আমার হাতে এলো ‘শরাইঘাট...’ । আমি পড়লাম। আমি পত্র-পত্রিকা পড়ে মোটামোটি জানি যে আসামে ‘আসামী-বাঙ্গালী’ কি একটা ঝামেলা আছে। গন্ডগোল টন্ডগোল হয়। এবার আমি ‘শরাইঘাট...’ পড়লাম এবং এর সঙ্গে, স্বভাবতঃই আমি ‘ইতিহাস’ কে মেলাতে লাগলাম ( যা ৯৯% ভাগে করে)। তাহলে আমি কি পাবো এই বই থেকেঃ

(অ)  আসামের এক বিশেষ স্থানের, মানে বরাক উপত্যকার বাঙ্গালীরা মনে করে তারা আসামের নয় তাই গৌহাটির দিক বা আপার-আসামকে তারা বলে ‘আসাম’। অর্থাৎ এই বাঙ্গালীরা অতি নেমক হারাম। ( প্রথম পাতাতেই যখন লেখক বলেনঃ ‘ উহার দেশ কাছাড়ে, যে দেশকে আজকাল বরাক ভ্যালি বলা হইয়া থাকে; যাহা আসামেরই একটি জিলা অথচ যে দেশ হইতে ট্রেনে চাপিবার সময় লোকে ‘আসাম যাইতেছি’ বলিয়া থাকে’। -তা’তে ব্যঙ্গের সুরটা কি ধরতে পারা যায় না?  এই উচ্চারনে ‘যেন‘আসাম যাইতেছি’ না বলিলেই ভালো হইত, ‘আসাম’ই আমাদের দেশ বলিয়া ভাবিতে পারিলে ভাল হইত’ এমন একটি ইঙ্গিত যে রয়েছে কোথাও সে’ও কি বুঝিয়ে দিতে হবে?)

(আ)  আসামে কি সব আন্দোলন-টন হয়েছিল, সম্ভবতঃ ঐ নেমখারাম বাঙ্গালীরাই সেসব করেছিল তবে সেসব বহু আগে চুকে বুকে গেছে। (‘আসিবার সময় ( অর্থাৎ দীপু’র ‘আসাম’এ পড়তে আসার সময়) নানাজনে বুঝাইয়াছিল যে আসামে এখন কোনো গন্ডগোল নাই,৬১ সালের রাজ্যভাষা আন্দোলন এবং ৭২ সালের শিক্ষামাধ্যম আন্দোলনের রেশ কিছুমাত্র নাই’। যেন ঐ আন্দোলনগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা কোনো ‘স্ট্রাইক-স্ট্রাইক’ খেলা ... পাঠকের মর্মে এই প্রমাদটি সৃষ্ট হয়, হয় লেখকের ইচ্ছায় নয়তো তাঁর ভাষা প্রয়োগ ও context handling এর ব্যর্থতায়।)

(ই) বাহাত্তররের শিক্ষা আন্দোলন ( কাহিনীর প্রোটাগোনিষ্ট ‘দীপু’র মতে ) অসমীয়া মন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ এবং মিছিল আর একটি ছড়া! (পৃঃ ১০)  এ’ও নির্ঘাৎ ঐ নেমক হারাম বাঙ্গালীদের কোনো কুকর্ম!!!

(ঈ) অসমীয়াদের নিয়ে কুচক্কুরে বরাকের বাঙ্গালীরা নানা রকম সত্য মিথ্যা গল্প বানায়। ‘যদুকাকা’র ‘আমগো ভাসা অহইম্যা’ এমনি একটি মুখরোচক গল্প! (পৃঃ ১৩)

(উ)  ইস্‌, কি খারাপ, এই ‘বরাক এর বাঙ্গালীরা’ অসমীয়া জানেত না’ই এমন কি বলার চেষ্টাও করেনা। অথচ দেখো অসমীয়ারা কতো মহান, বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করে। ( পৃঃ ৩৫ , ৪৪, ১৭৬ আরো নানা জায়গায় ...

(ঊ) বরাকের বাঙ্গালীরা ‘কাপুরুষ’, ‘সুযোগে বাঘ হওয়া বিড়াল’, মূর্খ  - ইত্যাদি। ( অধ্যায়ঃ একটি কাপুরুষের পলায়ন, উলটোরথে)

তালিকাটি আরো দীর্ঘ হতে পারে। চক্ষুষ্মান পাঠক এবার নিজে পড়ে সম্পূর্ণ করে নিতে পারেন তালিকাটি। এবার কথা হচ্ছে, লেখক কি এই কথা গুলিই, বরাকের বাঙ্গালী সম্পর্কে, চেয়েছেন প্রচার করতে?

যদি চেয়ে থাকেন সেই ক্ষেত্রে এতো স্রেফ্‌ Hate writing । সাহিত্য-শিল্প কিছুই নয়। এনিয়ে আলোচনা না করে মানহানির মামলা ( জাতীয় মানহানি’র মামলা যদি কিছু আদৌ হয়’) ঠুকে দিলেই আপদ গেলো। পক্ষান্তরে এ যদি না চেয়ে থাকেন তবু যে এই কথা গুলি এভাবে এসে পরলো তা’কি লেখকের এবং লেখাটির ব্যর্থতা নয়?

২।

এবার ‘দীপু’র ক্ষোভের বিপরীতে আমার ‘ক্ষোভ’এর কারনগুলি বলাযাকঃ

(ক)  ‘দীপু’র মতেঃ বরাক উপত্যকার লোকেরা নিজেদের ‘আসামবাসী’ ভাবেনা। তারা অসমীয়া জানেনা। জানার ইচ্ছাও করেনা।

বর্তমান অধম পাঠকের মতেঃ ঠিক। বরাকবাসীরা নিজেদের আসামের মানুষ মনে করেনা। কেননা ‘শ্রীহট্টের ... নির্বাসন ঘটেছিল ১৮৭৪ সালে, নবগঠিত চিফ কমিশনার শাসিত আসাম প্রদেশের ব্যয় সংকুলানের জন্য যখন শ্রীহট্টকে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো। শ্রীহট্ট এবং কাছাড় জেলাকে নিয়ে তখন তৈরী করা হয়েছিল সুরমা ভ্যালী ডিভিশন। শ্রীহট্ট এবং কাছাড় জেলার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটলো ১৯৪৭ সালে, রাজিনৈতিক কুটিল আবর্তের পরিণতিতে। শ্রীহট্টের বৃহত্তর অংশটি তখন আবার যুক্ত হলো বঙ্গের সঙ্গেই, কিন্তু সে বঙ্গ খন্ডিত। কাছাড় এবং শ্রীহট্টের ক্ষুদ্র একটি অংশ ( অধুনা করিমগঞ্জ জেলা) রয়ে গেলো আসামে’। (শ্রীহট্ট কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস, ডঃ সুজিৎ চৌধুরি, প্রস্তাবনা অংশ)।

কাজেই দেখা যাচ্ছে যে কেবল মাত্র ‘সরকারী’ ভাবে ছাড়া ‘কাছাড়’ বা ‘বরাক উপত্যকা’ আসামের ছিলোনা কোনো দিনই। তা জানে অসমীয়া ‘প্রভু’ রাও। ফলতঃ ‘স্বাধীন’ হতে না হতেই এরা আবদার ধরলো ‘ওহে বরাকের লোক তোমাদের পড়াশোনার মাধ্যম হয়েযাক অসমীয়া’। এই একই প্রস্তাব পশ্চিম পাকিস্তানীরা করেছিল পূর্ব পাকিস্তানকে আর এই অসমীয়া ‘প্রভু’রা করলেন। করলেন ত বটেই এবং ক্রমে তা প্রয়োগের জন্য যে অত্যাচার আরম্ভ করলেন তাও ঐ খানসেনাদেরি সমতুল।

ফলে দুই জাতির মধ্যে কোনো সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, আদান-প্রদান ( IPTA আর পার্টিবাজেদের আদান প্রদান দিয়ে কিছু নির্ণয় হয়না) এর কোনো ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার আগেই অসমীয়া প্রভুদের চোখ রাঙ্গানীতে সমস্ত পাল্টে গেলো। যারা ঐসব দিন দেখেছে স্বচক্ষে তাদের কথা’ত বাদই দিচ্ছি, এই যে ১৯৭২ সালে জন্মানো আমি, যে ষাটের-সত্তরের ভাষা আন্দোলন আর নির্যাতনের কিছুই দেখিনি চোখে, কেবল দেখেছি ৮৬ সালের জগন-যীশুর খুন ( তা’ও অকুস্থলে গিয়ে নয়) আর আসামী সরকারের দমননীতি আমিই ঘেন্নায় অসমীয়া শিখিনি, যদিও গৌহাটিতে চাকরী সূত্রে থাকতে হয়েছে দুই বছর, উচ্চারন করিনি একটা অসমীয়া শব্দ।

কাজেই যারা দীপুর সেই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উচ্চারিত ‘৬১ সালের রাজ্যভাষা আন্দোলন এবং ৭২ সালের শিক্ষামাধ্যম আন্দোলন’ স্বচক্ষে দেখেছে তারা যে অসমীয়া বলবেনা, শিখবেনা সে’ত স্বাভাবিক।

সুতরাং ‘বরাক উপত্যকার লোকেরা নিজেদের ‘আসামবাসী’ ভাবেনা। তারা অসমীয়া জানেনা। জানার ইচ্ছাও করেনা’ - দীপুর এই ক্ষোভ ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত বিষয়ে জ্ঞাত পাঠকের কাছে ‘ন্যাকামি’ মনেহয়।

(খ)বরাকের বাঙ্গালীরা ‘কাপুরুষ’, ‘সুযোগে বাঘ হওয়া বিড়াল’, মূর্খ  - ইত্যাদি।

কেন?

না, লামডিঙ্গের ছেলে উদয়ন বিশ্বাস ‘দীপু’কে বলে অচিরেই অসমীয়া-বাঙ্গালী দাঙ্গা লাগবে আর এতে বাঙ্গালীর কোনো লাভ হবেনা কেবল মার খাওয়া ছাড়া। এইসব কথা বলার আগেই সেই উদয়ন বিশ্বাস ‘দীপু’র সংজ্ঞায় খারাপ মানুষ হয়েযায় কেননা উদয়নের ‘বিহুনাচ পছন্দ হয়না। যে অসমীয়া বলার বিশেষ চেষ্টা করেনা’। তাই সে ‘কাপুরুষ’। অর্থাৎ সে অসমীয়াদের মন জুগিয়ে চলেনা। এছাড়া তার আর কোনো ‘খারাপ’ কাজ বা ‘কাপুরুষ’তার কিছু আমরা দেখিনা। বরং ইতিহাস বলে, যে, ১৯৮০/৮১ সালে গৌহাটি মেডিকেল কলেজে বাঙ্গালী ছাত্র অঞ্জন চক্রবর্তী খুন হয় কেননা সে ছিল বাঙ্গালী এবং মেধাবী। এনিয়ে গৌহাটির কোথাও কোনো প্রতিবাদ হয়না। অসমীয়া ‘প্রভু’রা চেপেযায় এই খবর। তথাপি বরাক উপত্যকায় ‘লিক’ করে পৌঁছে যায় খবরটি। যথারীতি সৃষ্টি হয় উত্তেজনার। তখন অসমীয়া ‘প্রভু’রা বরাকের সমস্ত ইস্কুল কলেজ থেকে সমস্ত অসমীয়া ছাত্রছাত্রীদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেন কড়া হাতে। কাছাড় জেলায় হয় মৌন মিছিল। মিছিল বিক্ষোভ।

কাজেই ‘দীপু’র বলা ঐ হোষ্টেল-গপ্পোর সত্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।

একই ব্যাপার সেই ‘উলটোরথে’ অধ্যায়’এ। ফুটবল মাঠে বাঙ্গালীদেরকে পিটিয়েছে অসমীয়ারা। এই নিয়ে ট্রেনে যেতে যেতে ক্ষোভ প্রকাশ করছে আরেকটি বাঙ্গালী ছেলে তাতেও ‘দীপু’র গোঁসা। ঐ বাঙ্গালী ছেলেটি মূর্খ। তার সৌন্দর্য বোধ নেই। নেই কেননা অসমীয়া গান তার ভালো লাগেনা।

অথচ অসমীয়াদের ব্যাপারে ‘দীপু’ এটা বোঝেঃ ‘একজন বাঙ্গালী বিদ্বেষীও প্রেম করে, চাঁদের আলো ভালোবাসে, গান শোনে পাগলের মতো। সে একজন মানুষ। আজকাল ঘন ঘন দীপুর এই অনুভব হয়’। - অতি উত্তম অনুভব।  এই অনুভবের পাশাপাশি দীপু কিন্তু এটা অনুভব করেনা যে ‘একজন অসমীয়া বিদ্বেষীও প্রেম করে, চাঁদের আলো ভালোবাসে, গান শোনে পাগলের মতো। সে একজন মানুষ’।

সুতরাং ‘দীপু’কে বিশ্বাসঘাতক বা rat ছাড়া কি বলাযায় অন্য কিছু?

প্রসঙ্গতঃ মনে আসছে ‘দীপু’ বিষয়ে এক নিবিড় পাঠক ( কাছাড়ের ) উক্তিঃ অন্ধ দুই প্রকারেরি হয় ঘৃণান্ধ এবং প্রেমান্ধ উত্তরফলে কিন্তু প্রভেদ নাই কিন্তু এই প্রভেদ অবশ্যই থাকিতে পারে যে ঘৃণান্ধতা=১০/১০ এবং প্রেমান্ধতা=১০০০০০০/১০০০০০০ কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই, জয় গরু, ফলাফল তো ১। ইহাও মনে রাখিতে হইবে প্রেমের কেবল আলিঙ্গনই থাকেনা, কবল অথবা খপ্পড়ও থাকিতে পারে আর কে’না জানে, উদ্দেশ্য যতোই মহৎ হোক্‌ পথটি যদি পাপের পথ হয় ...। যদি মিথ্যা বলা মহাপাপ হয় তাহা হইলে ত বলিতেই হইবে ‘দীপু’ পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রাণপনে পাপের পথ ধরিয়াছে কারন ‘দীপু’এ যাত্রার শুরুতেই আছে ‘বাবার বন্ধু ...কিছু নাই পৃঃ ১০’। তাহার পরেই আবার ‘একথা অবশ্য ... আসিতেছে’ পৃঃ১০  তা ‘এরূপ কথা’ত বাবার আরেকজন বন্ধু কোনো মধুকাকাই বলেন নাই ইহা আম জনতারি মুখনিঃসৃত। তাহার মানে আমজনতাও নৈরাশ্যে অবিচল! যাহা হইক বকচ্ছপ ভাষায় লিখিত ‘ঢোঁড়া মানস’এর এই ঢপ চরিত আমাকে অধিক দূর সঙ্গ দিতে পারিলনা কারন এই অধমও ‘respect only the books that all but kill their authors’। সবেশেষে সাবধান করিতেছি রাক্ষসের চিতাই কিন্তু অনির্বান’।

এই পাঠকটি কিন্তু টলষ্টয় বা বিভুতিভূষণের ক্ষেত্রে এমনটি বলেন না।



    ‘শরাইঘাট...’ নিয়ে আরেকটি আলোচনা লিখেছিলাম আগেও যেখানে এ’ই কথাগুলিই বলেছিলাম একটু অন্য ভাবে। সেই আলোচনাটি পড়ে ডাক্তার, সমাজকর্মী, পাঠক ও প্রাবন্ধিক মৃন্ময় দেব, যিনি জীবনের দীর্ঘতম সময় কাটিয়েছেন ‘আপার আসাম’এ আর কর্মসূত্রে নিবিড়ভাবে গ্রাম-আসামের সাথে পরিচিত হয়েছেন, তিনি জানালেনঃ আলোচনার যুক্তিগুলি অকাট্য নিশ্চয় (উপন্যাসটা পড়া হয়নি যদিও), তবে একটা কথা কিন্তু ঠিক যে ঐ সময় একজাতের দীপু-মানসিকতা সত্যিই গড়ে উঠেছিল। এটা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। সে বিচারে দেবাশিস তরফদার হয়ত উক্ত বাস্তবতাকে ধরার প্রয়াস করে থাকবেন। এর পেছনে একটা কারণও ছিল। সে সময়ে অসমে তরুণদের মধ্যে বামপন্থী চিন্তার প্রসার ঘটেছিল, মূলত পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালিয়ে আসা নকশালদের দৌলতে। বাঙালি এমনিতেই রোমান্টিক-বামপন্থী, ফলে একটা অবাস্তব মানসিকতা জন্ম নিল, এরা অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে একদল বাঙালির উন্নাসিকতার পাপ স্খালনে উঠে পড়ে লেগে গেলো। আর অসমীয়া বামপন্থীরাও (ভালো অসমীয়া) খানিকটা আত্মতুষ্টি লাভ করল। লক্ষ্য করলে দেখবেন উগ্র জাতীয়তাবাদকে পুরোপুরি নাকচ করে অসমে কোন মতবাদ/আন্দোলন গড়ে তোলা প্রায় দুঃসাধ্য (এটা ইসলামের ক্ষেত্রেও দেখা যায়)- কাজেই বামপন্থীরা একটা অবাস্তব আপোষ-মীমাংসায় পৌঁছে ‘ভালো অসমীয়া’ ও ‘ভাল্‌ বঙালি’-র এক উদ্ভট সমীকরণ তৈরি করে ফেলে, দীপু সম্ভবত সেই ‘ভাল্‌ বঙালি’-র প্রতিনিধি’।

কাহিনীর মেরুদন্ড যেখানে এক বিশেষ সময়ের, বিশেষ ভূগোলের মানুষের সামাজিক বাস্তবতা সেখানে সেই সময়ের বাস্তবতার নিরিখেই  ‘দীপু’ চরিত্রটি দাঁড়াচ্ছেনা আবার সে দোষারোপ করে যাচ্ছে সেই বাঙ্গালীকে, যে, নমকহারাম,মূর্খ, কাপুরুষ হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু গুলি খেয়ে, জেলে গিয়ে বাংলা ভাষায় শিক্ষার অধিকারটুকু জিতে নিলো। এই দোষারোপই আমাকে ক্ষিপ্ত করে। আমি এই বই বিষয়ে চঠি লিখতে গিয়ে লিখতে বাধ্য হইঃঅনেক ছেলেমেয়ের মধ্যে মা-বাপের দু চারটে ছেলে তো কুলাঙ্গার হয়েই যেতে পারে, কিন্তু সেই ‘কুলাঙ্গার’ যখন অন্য ভাই-বোনেদের নিয়ে কটূক্তি করে তখন আমার সহ্যের সীমা পার হয়ে যায়।

 ৩।

এই কাহিনী পড়তে পড়তে আমরা জানলাম বরাক উপত্যকার ছোট একটি শহর শিলচর থেকে দীপু বলে একটি ছেলে পদার্থ বিদ্যায় স্মাতকোত্তর পাঠ নিতে এলো থেকে আসামের রাজধানী গৌহাটিতে। সময়টা সত্তরের দশকের শেষ।  জানলাম তার বেশ কিছু বন্ধু বান্ধব হলো। তাদের সঙ্গে মিশে সে ‘অসমীয়া’ হলো, ‘কমরেড’ হলো। অনেক অসমীয়া গান টান শুনলো। সে জানলো অসমীয়া একটি অতি উন্নত ভাষা। হোষ্টেলে মারদাঙ্গা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকশান হলো। ক্রমে দানা বাঁধলো আসামের বিখ্যাত ‘বঙ্গাল খেদা’র আরেকটি পর্ব। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলো কিছুদিন। পরীক্ষাও তাই গেলো পিছিয়ে। দীপু ফিরে এলো। তারপর বেশ কিছুদিন পরে এড্‌মিট্‌ কার্ড পেয়ে আবার গেলো সেই হোষ্টেলে। তখন সেখানে অন্য বাতাস। পুরোনো বন্ধুরাও ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে... হারিয়ে যাচ্ছে যাপনের বাস্তবতার হাহাকারে ...

এই সবই জানলাম ‘দীপু’র মুখে আর তার বন্ধুদের নানান আলোচনায়। কিন্তু পাঠক হিসাবে ‘দীপু’কেই যে চিনলাম না ঠিক করে আর তার আগেই দেখলাম দীপু ‘অসমীয়া’ হয়েগেলো ,কিন্তু সেই হওয়াটা না’ত ঠিক ‘ছিল রুমাল হয়ে বেড়াল’এর মতো সহজ বোধগম্য না’ত কোনো দার্শনিক,মনস্তাত্ত্বিক ইঙ্গিতরেখা ফলে চক্ষুষ্মান  পাঠকের মনে হতে বাধ্য যে লেখক দীপুকে অসমীয়া করার জন্যই এনেছিলেন এখানে। যা’ই অসমীয়া তা’ই তার ভালো লাগে।

ঐতিহাসিক ভাবে দেখলে এ কথা সত্য, যে,বাঙ্গালী বিরোধী তৎকালীন অসমীয়া ক্রিয়া কলাপে ‘কমিউনিষ্ট’ ছাত্র আর ‘কমিউনিষ্ট’ পার্টী সত্যিই একটি ইতিবাচক ভূমিকা বহুদিন পালন করেছিল। তথাপি এই চরিত্রগুলি ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক’ থেকেও বায়বীয় কেনবা ‘গোপাল’ কে সুবোধ বলার পরের গোপালের শ্রষ্টা দেখিয়েছিলেন কারন গুলিও – গোপাল ইস্কুলে যায়, পড়া করে, রাস্তায় রাস্তায় খেলে বেড়ায় না –ইত্যাদি। কিন্তু এই চরিত্রগুলির ভালো হওয়ার হেতু তারা ‘অসমীয়া’ আর যেহেতু ভালো তাই ‘কমিউনিষ্ট’। হ্যাঁ, কিছু কিছু ‘খারাপ অসমীয়া’ আছে হয়তো তবে ‘খারাপ’ হলেও তারা “প্রেম করে,চাঁদের আলো ভালোবাসে,গান শোনে পাগলের মতো’। তাই তারাও ‘মানুষ’। কিন্তু সেই ‘খারাপ’দের ‘খারাপ’ বলে যে বাঙ্গালীরা তারা কিন্তু ‘মূর্খ’, ‘কাপুরুষ’। কেন? না, ‘দীপু’ তেমনটা বলেছে বলে। রাশিয়ার বিপ্লবের অনেক ‘খারাপ’ দিক আমাদের দেখিয়েছিলেন পাস্তেরনায়েক কিন্তু “শুধু জিভাগোর পছন্দ হয়নি তাই এসব খারাপ” এইভাবে নয়।

অসমীয়া লোকগান ইত্যাদির উল্লেখ প্রায় পাতায় পাতায়। সেগুলির ভাষা ও ভাব ( আমার সীমিত অসমীয়া জ্ঞানে) অবশ্যই উন্নত কিন্তু যে বাঙ্গালী ছেলে ‘দীপু’ কবিতা টবিতা পড়ে, সাহিত্য রসিক সে’কি পূর্ব বা পশ্চিম বাংলার লোকগান কোনোদিন শোনেনি? যদি শুনে থাকে তাহলে সেগুলির ভাব,ভাষা তাকে কি স্পর্শ করেনি? আমার মতো অনসমীয়া পাঠকের পর্যন্ত ‘দীপু’র উদ্ধৃত গান গুলি পড়তে পড়তে মনে এসেছে নানা বাঊল-ভাটিয়ালীর অনুষংগ। কিন্তু দীপুর আসেনি। অর্থাৎ এই কাহিনীতে ঢুকে পড়ার আগে দীপুর কোনো অতীত ছিলোনা আর তাই তার সমস্ত ভাবনা, ধ্যান ধারনা এতো হাল্কা, এতো ভুঁইফোড়। কাজেই আবারো প্রত্যয় হয় যে দীপু’কে হাজিরই করা হয়েছে অন্তিমে ‘অসমীয়া’ বানানোর জন্য।

এইভাবে ‘বানানো’ কিছু কি সাহিত্যের ধোপে টেঁকে যার গা’য়ে নির্মাণের সব দাগ গুলি দগ দগ করছে?

  পড়তে পড়তে এ’ও মনেহয় এটি কি উপন্যাস না’কি দিনলিপি না’কি নানা জনের নানা কথা’র একটি রানিং কমেন্ট্রি? উপন্যাস বলতে বাধে কেননা যারা কথা বলছে তাদের রক্তমাংসের অস্তিত্ব বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার আগেই তাদের কথার তোড়ে ভেসে যেতে হচ্ছে পাঠককে।  কিন্তু এ’কে ঠিক হালের ‘appearance is essence’ তত্ত্ব দিয়েও ব্যাখ্যা করতে পারিনা কেননা এদের ‘appearance’ ই বিশ্বাসযোগ্য হয়না সর্বত্র। একই সমস্যা দীপু’কে নিয়েও। দীপু একটি দিন থেকে আরেকটি দিনে পৌঁছায়। পাঠককে, রচনাটি পুরো পড়ে শেষ করবার তাগিদ ছাড়া অন্য কোনো কারনে প্রয়োজন হয়না তাকে অনুসরন করবার। হ্যাঁ, ‘কথা’ কোথাও কোথাও জমে ওঠে। ঠিক। কিন্তু পর মুহুর্তেই যেন তার রেশ যায় হারিয়ে। রাশ যায় আলগা হয়ে।

কি কথা বলে দীপু? কি কথা বলে তার সঙ্গী সাথীরা? তারা নানা বিষয়ে কথা বলে। রাজনীতি থেকে কবিতা। ঠিক যেমন সুনীল গংগো’র ‘আত্মপ্রকাশ’এর চরিত্ররা বলতো। ঐ অনর্গল কথা বলা ছাড়া ‘আত্মপ্রকাশ’এর চরিত্রেরা যেতো শূঁড়ি খানা আর গণিকালয়ে আর এরা যায় কমলালয়’এ, চায়ের দোকানে, ক্লাসে, হোষ্টেলের ক্যান্টিনে ... কেন যে শূঁড়ি খানা আর গণিকালয়ে যায়না তা’ও এক প্রশ্ন ...

‘দীপু’র পাশাপাশি মনেপড়ে ‘অনি’কে। অনিমেষ। অনিমেষ মিত্র। সমরেশ মজুমদার’এর ‘কালবেলা’র। সে’ও এমনি এক ছোটো শহর থেকে এসেছিল কলকাতায়। এমনি এক টাল মাটাল সময়ে। সে’ও ক্রমে হয়ে উঠেছিল ‘কলকাতা’র ছেলে। হয়ে গিয়েছিল ‘কমিউনিষ্ট’। কিন্তু তার এই হয়ে ওঠা স্রেফ কথায় কথায় হয়ে ওঠা ছিলনা। সব কিছুর আগে সে নিজে পরিগ্রহ করেছিল রক্ত মাংসের চরিত্র। তারপর, ক্রমে, আমরা দেখেছি, বহু দ্বিধা, দ্বন্দ্ব পার হয়ে তার ‘কমিউনিষ্ট’ হওয়া, ‘নকশাল’ হওয়া। আড্ডা, ‘কথা’ আমরা শুনেছি সেখানেও, সেখানেও হোষ্টেল-মেস্‌’এর অন্দর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দার আমরা হেঁটেছি অনিমেষের সঙ্গে, মাধবীলতার সঙ্গে। কিন্তু সেই হাঁটা নেহাৎই রচনাটিকে পড়ে শেষ করবার তাগিদে নয়। আমাদের প্রাণের তাগিদে। ... তাই ‘কালবেলা’, না’ইবা হলো ‘জাঁ ক্রিস্তফ্‌’ বা ‘অপরাজিত’ তথাপি অন্তিমে সে’ও এক পুনর্জন্মের ইঙ্গিত রেখেযায় ...

লেখককে বলে দিতে হয়না ‘কালবেলাঃএকটি বিদ্রোহের গল্প’ বা ‘কালবেলাঃএকটি প্রেমের উপাখ্যান’।...

কিন্তু এই রচনাটির নামে তা বলে দেওয়া হয়েছে। পড়তে গিয়েই মনেহয় ‘শরাইঘাট'এর পরে 'একটি প্রেমকাহিনী' কথা গুলো বলার কোনো দরকার ছিলো কি? প্রেম কাহিনী না'কি বিচ্ছেদ-গাথা সেটা পাঠককে তার মতো করে বুঝে নিতে এই বাক্যবন্ধটি অসুবিধা সৃষ্টি করে। অন্তিমে এ'ও মনেহয় যে, যেহেতু লেখক নিজেও গ্রন্থটির 'প্রেমকাহিনী' চরিত্রটি নিয়ে নিশ্চিত নন তা'ই নামে ঐ বাক্য-বন্ধ ব্যবহার করলেন ...

একই প্রশ্ন জাগে লেখক যখন রচনা শরীরের বাইরে গিয়েও বার বার বলে যেতে থাকেন এই রকমের কথাঃ

রাসকিন বন্ড আমারো অতি প্রিয় এবং পূজনীয় লেখক। ফলে এই রচনাটি লিখতে বসার আগে আমি পড়ে নিই উল্লিখিত ঐ উপন্যাসটিও  এবং পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করি যে এই কাহিনীর ভিত্তিতেই শ্যাম বেনেগার তাঁর আঙ্গুলে ‘ভালো ছবি’র একটি, ‘জুনুন’ করেছিলেন...। সমরেশ মজুমদার’এর ‘কালবেলা’ যেমন নকশাল আন্দোলন,  A Flight of Pigeons’ এ’ও তেমনি সিপাহী বিদ্রোহ নির্মাণ করে আবহ। কিন্তু দুইটি উপন্যাসেই এই দুইটি ঐতিহাসিক ঘটনা নিছক মূক আবহ হয়ে থাকেনা। ‘কালবেলা’ তে লেখক, ক্রমে, নকশালপন্থী রাজনীতির প্রতি তাঁর সমর্থনের কথা জানান দেন এবং অনিমেষের ( না’কি মাধবীলতা’র ?) টানে পাঠকের সমর্থনও নেন আদায় করে। A Flight Of Pigeons’এর ভূমিকায় বন্ড লিখেনঃ “In retelling the tale for today’s reader I attempted to bring out the common humanity of most of the people involved— for in times of conflict and inter-religious or racial hatred, there are always a few (just a few) who are prepared to come to the aid of those unable to defend themselves I published this account as a novella about thirty years ago. I feel it still has some relevance today, when communal strife and religious intolerance threaten the lives and livelihood of innocent, law-abiding people. It was Pascal who wrote, ‘Men never do evil so completely and cheerfully as when they do it from religious conviction.’ Fortunately for civilization, there are exceptions.” আর তাঁর রচনাতেও তাই, প্রকারান্তরে,সমালোচিত যতোটা হয় সিপাহী বিদ্রোহ তার বেশী আলোচিত হয় মানবমনের অন্দর-রহস্য। বন্ড্‌ কিন্তু এ’ও বলেন, যে, এই কাহিনী ’ may be based on fact’

কিন্তু ‘ ‘শরাইঘাটঃএকটি প্রেমকাহিনী’’ বিষয়ে লেখকের বক্তব্যঃ

লেখক কেন এতো জোর দিচ্ছেন ‘সত্য নয়’ কথাটির উপর? তার কারন কি এ’ই যে লেখকও জানেন এইসব টংকে-বংকেরা আসলে সত্য নয়? আসলে সত্য অঞ্জন চক্রবর্তীর খুনীরা’ই????

লেখক বলছেন ‘বানিয়ে বলা সত্য’। ঠিক। কিন্তু ‘সত্য’ টি কি? সত্যটি যদি এ’ই হয় যে দীপু নামক একটি ছেলের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো দিনগুলি তাহলে প্রশ্ন ওঠে ঐ দিনগুলির কথা পাঠকের কোন ফিজিক্যাল বা মেটাফিজিক্যাল দরকারে লাগবে যে অর্থে বন্ডের সৃষ্ট রুথ্‌ বা জাভেদ খান’কে জানার মাধ্যমে পাঠক জেনে নেন মানব মনের আরেক দিগন্তকে? যে অর্থে অনিমেষ বা মাধবীলতা’কে জানার মাধ্যমে পাঠক জেনে নেন সেই সত্য যা ‘সঙ্ঘ নয়, শক্তি নয়, আরো আলো ... মানুষের প্রতি এক মানুষীর গভীর হৃদয়’...

শিল্পের সত্য থেকে এখানেই, আমার কাছে, বিচ্যুত হয় ‘দীপু’। তারপরে আসে ঐতিহাসিক ‘সত্য’র কথা যার ভিত্তিহীনতার কথা আগেও কিছুটা বলেছি।

৪।

রচনার প্রথম পংক্তিতেই আমরা জানতে পারি যে সেটা ১৯৭৭ ইংরেজি। অর্থাৎ ১৯৬৯ এর দিনগুলি তখন ক্যালেন্ডারে রক্তাক্ত-উপস্থিত। বাঙ্গালী তার নিজের ভাষায় কথা বলতে চেয়ে আন্দোলন করলে আসাম সরকার চালিয়েছে গুলি। ১৯ শে মে শিলচরে শহীদ হয়েছে এগারোজন ছেলেমেয়ে। ১৯৭২ এ খুন হয়েছে বাচ্চু চক্রবর্তী। আসামের সরকার পায়ে পিষে মুছে দিতে চেয়েছে আসামের বাংলীর অস্তিত্ব – যে বাঙ্গালীদের বাস আসামের বরাক উপত্যকায়, যে বাঙ্গালীরা পার্টিশানের আগে পর্যন্ত ছিল পূর্ব বাংলার বাসিন্দা ... ফলতঃ সেই বাঙ্গালী যখন ‘রাষ্ট্র’ নামক যন্ত্রের অনর্গত অমীমাংসিত দ্বন্দ্বের কারনে হয়ে পরলো আসামের বাসিন্দা তখন স্বভাবতঃই তাদের কাছে অসমীয়া ভাষা হলোনা গ্রহনযোগ্য, তারা শিখলোনা অসমীয়া, তারা অসমীয়া অধ্যুষিত ‘আপার’ আসামকে বল্লো ‘আসাম’। কাজেই রচনার প্রথম পাতাতেই, ঈষৎ ব্যাঙ্গের সুরে যখন লেখক বলেনঃ ‘ উহার দেশ কাছাড়ে, যে দেশকে আজকাল বরাক ভ্যালি বলা হইয়া থাকে; যাহা আসামেরই একটি জিলা অথচ যে দেশ হইতে ট্রেনে চাপিবার সময় লোকে ‘আসাম যাইতেছি’ বলিয়া থাকে’। -এই উচ্চারনে ‘যেন‘আসাম যাইতেছি’ না বলিলেই ভালো হইত, ‘আসাম’ই আমাদের দেশ বলিয়া ভাবিতে পারিলে ভাল হইত’ এমন একটি ইঙ্গিত রয়েছে কোথাও আর যে ইঙ্গিতটি, মূলতঃ, এই রচনার মূল সুর। অর্থাৎ বাঙ্গালীরা অসমীয়াদের ‘বুঝলো’ না, ‘কর্তা’ বলে মেনে নিলোনা এমন একটি কথা সর্বত্র প্রচ্ছন্ন। কাছাড় বা বরাকের লোকে অসমীয়া বলেনা, জানেনা বলে দীপু প্রায়ই লজ্জা পায়, দুঃখ পায়, কিন্তু দীপু এটা ভাবেনা যে এইসব বাঙ্গালীরা যে ঐতিহাসিক বাস্তবতার থেকে আজ ‘আসাম’এর বাসিন্দা সেই ঐতিহাসিক বাস্তবতার কোনোখানে অসমীয়া ছিলোনা। তারপরেও হয়তো বরাকের বাঙ্গালী অসমীয়া শিখতে পারতো যদি না তাকে বন্দুক দিয়ে শেখানোর চেষ্টা করতো অসমীয়া ‘প্রভু’ রা। ১৯৬৯’এর ইতিহাস, কিছুটা, এখানে তুলে দিচ্ছি  www.unishemay.org নামক ওয়েব-পাতা থেকেঃ

“... সেবার সারা পৃথিবী যখন বিশ্বকবির জন্মশতবর্ষ উদযাপন সমারোহে ব্যস্ত, তখন বরাক নদীর দুপারে চলছিল কবিগুরুর ভাষায় কথা বলার, গান গাইবার, জীবন সাধার অধিকার অর্জনের লড়াই। কবিপক্ষেই আসামের বরাক উপত্যকার তৎকালীন অবিভক্ত কাছাড় জেলার সদর শহর শিলচরের রেল স্টেশনে পুলিসের গুলিতে জীবন আহুতি দিয়েছিল ১১ জন তরুণ তরুণী। রক্তদানের পুণ্যে অর্জিত হয়েছিল বরাক উপত্যকার তিনটি জেলার জন্যে সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি। সেদিন বাংলা ভাষার অধিকার অর্জনের লড়াই শুধুমাত্র বাঙালির লড়াই ছিল না। বাংলা ও বাঙালি ছিল অগ্রভাগে, কিন্তু লড়াই ছিল বহুত্বের স্বপক্ষে বহুভাষী মানুষের লড়াই। ১৯ মে’র গুলিচালনার প্রতিবাদ করে আসাম বিধানসভা থেকে প্রথম যিনি পদত্যাগ করেন, তিনি নন্দকিশোর সিংহ। ভাষিক পরিচয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি। শিলং শহরে ঐতিহাসিক মৌনমিছিল করেছিলেন খাসি পুরুষ রমণীরা। এই বহুত্বের চেতনাই উনিশের চেতনা। বহুভাষিক আসামে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকারের সংগ্রামই ছিল সেদিনের বাংলা ভাষা আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য। উগ্র জাতিদম্ভের বিরুদ্ধে বহুত্বের লড়াই ১৯৬১ সালের পর এগিয়ে গেছে ১৯৭২ সাল হয়ে ১৯৮৬ ও ১৯৯৫ সালেও। ১১ জন তরুণ তরুণীর রক্তচিহ্ন লাঞ্ছিত পথ ধরে শহীদত্বের পথে যোগ দিয়েছেন করিমগঞ্জে ১৯৭২ সালে বাচ্চু চক্রবর্তী ও ১৯৮৬ সালে জগন (জগন্ময় দেব) ও যীশু (দিব্যেন্দু দাস)। রক্তদানের একই ধারায় যুক্ত হয়েছেন ১৯৯৫ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি ভাষার সংগ্রামে কলকলিঘাটে বীরাঙ্গনা সুদেষ্ণা সিনহা। আমাদের ইতিহাস ও ভূগোল পরস্পর দ্বন্দ্বযুদ্ধে মেতে আছে সেই কবে থেকে। ফলেই আমাদের গানে ছবিতে সাহিত্যে আমাদের জীবনধারায় এক চিরন্তন বিরহগাথা,এক অনিঃশেষ দীর্ঘশ্বাস। প্রত্যন্তের নিভৃতিতে একান্তে বেজে চলা আমাদের বাঁশির সুর এখনো বহির্বিশ্বে প্রায় অশ্রুতই ...”

অথচ সংবেদনশীল, সাহিত্য-প্রেমী, উদারমনা দীপু’র মর্মের কোনোখানে এই বাস্তবতার চিহ্নমাত্র নেই। বরং ‘আমগো ভাষা অহইম্মা’ কাহিনীর সত্যতা নিয়ে সে প্রকাশ করে সংশয়। রচনার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখক বলেন ‘আসিবার সময় ( অর্থাৎ দীপু’র ‘আসাম’এ পড়তে আসার সময়) নানাজনে বুঝাইয়াছিল যে আসামে এখন কোনো গন্ডগোল নাই, ৬১ সালের রাজ্যভাষা আন্দোলন এবং ৭২ সালের শিক্ষামাধ্যম আন্দোলনের রেশ কিছুমাত্র নাই’। যেন ঐ আন্দোলনগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা কোনো ‘স্ট্রাইক-স্ট্রাইক’ খেলা ... হায়, রচনাটির আবহ ১৯৭৭ হলেও রচনাটি যখন লিখিত হচ্ছে তখন অসমীয়া আগ্রাসনের, অতি নিম্নমানের জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটে গেছে একাধিকবার, তথাপি, বিষয়গুলিকে লেখক আনলেন এমনি হাল্কা চালে! হায়, এই প্রসঙ্গগুলি উল্লেখ না করলেও কিন্তু রচনার কিছু ক্ষতি বৃদ্ধি হতোনা! তেমনি ‘আমগো ভাষা অহইম্মা’র উল্লেখ না করলেও চলতো। তবু তা’ও উল্লেখ করলেন লেখক, লিখলেনঃ ব্রহ্মপুত্র ভ্যালির বাঙ্গালী মুসলমানদের কেউ কেউ নিজেকে অসমীয়া বলিয়া পরিচয় দেয় এবং বাঙ্গালী হিন্দুদের একটু এড়াইয়া চলে। দাঙ্গার সময় উহারা নাকি অসমীয়া হইয়া যায়। উহাদের বিষয়ে একটি মজার জনশ্রুতি আছে, যে, লোকগণনার সময় উহারা নাকি বলিত – আমাগো ভাষা অহইম্যা’ – এতোদূর বলেই আবার ব্র্যাকেটে এন্টিডোট্‌ দিয়ে রাখলেন লেখক – ‘ সত্যমিথ্যা বলা মুশকিল, যদুকাকার স্টকে এরকম গল্প থাকে’... ‘আমগো ভাষা অহইম্মা’ যেন একটি রগড় ... হায়, আসামে যে অসমীয়ারাই প্রকৃতার্থে সংখ্যালঘু এই তথ্যটি ঢাকতে বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙ্গালী মুসলমানদের অভয় দিয়েছিল অসমীয়ারা। বলা হয়েছিল মাতৃভাষা ‘অসমীয়া’ হলে কোনো ‘ডর’ নেই। ভোটাধিকার পাক্কা। কেননা এতে আসামে ‘অসমীয়া ভাষী’ জনতার পরিসংখ্যানে যে প্রভাব তা’তে প্রমাণিত হবে আসামে ‘অসমীয়ারা’ই সংখ্যা গড়িষ্ঠ। অতএব ‘আপার আসাম’ (ধেমাজি, ডিব্রুগড়,লখিমপুর, গোলাঘাট, শিবসাগর ও তিনসুকীয়া) এর নানা স্থানে বসবাসকারী  বঙ্গভাষী জনতার এক বৃহৎ অংশ ‘তোমার মাতৃভাষা কী’ এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন ‘আম্‌গো ভাহা অহইম্মা’। তথাপি  ঘটেগেলো ‘নেলী’। ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী প্রকাশ্য দিবালোকে নগাঁও’এর নেলীতে খুন হলেন ২১৯১ মানুষ ( বেসরকারী হিসেবে ৫০০০ এর’ও বেশী)। এঁরা মূলতঃ বাংলাভাষী মুসলমান। এঁদেরকে খুন করা হলো কেননা এঁরা চলেছিলেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে। হয়তো আসামের অসমীয়া ‘প্রভু’দের পক্ষে ঐ ভোটাধিকারের প্রয়োগফল হতোনা তেমন সুবিধা জনক সুতরাং ঘটে গেলো এই গনহত্যা। অর্থাৎ ‘আম্‌গো ভাহা অহইম্মা’ বলেও জান বাঁচাতে পারলেন না আসামের অনসমীয়া জনতা। এই গণহত্যার পেছনের আরেকটি বাস্তবতা ছিল এই, যে, ঐ উদ্বাস্তু মুসলমানেরা যে জমিকে করেছিল সোনা ফলানোর জমি তা’ই অসমীয়ারা বহু আছে ‘পতিত জমি’ বলে দিয়েছিল ছেড়ে। এবার সোনা যে’ই ফললো তখন এই জমিতো  আর থাকতে পারেনা অনসমীয়ার দখলে ...

সেই আরেকটি বাঙ্গালী চরিত্র, যে মূলতঃ অসমীয়াদের আন্দোলনের মূল চরিত্রটি নিয়ে কথা বলছিল ট্রেনে যেতে যেতে, তাকেও দীপু আঁকে সেই কালো কালিতেই। বলে এর বীরত্ব গৌহাটি স্টেশনে এসেই মিইয়ে যাবে। হায় দীপু,অদ্যাপি আমাদের মতো যাদের ভিটে বাড়ি আসামে অথচ পেটের ধান্দায় থাকতে হয় ভারতবর্ষের অন্যত্র, তারা অদ্যাপি দেখি, যে, হাওড়া থেকে গৌহাটি অভিমুখে ট্রেন ছাড়লে গাড়ি ব্যান্ডেল পার হওয়া পর্যন্ত অসমীয়া যাত্রীর আপ্রান (ভুল ভাল) বাংলা বলেযায় আর ব্যান্ডেল পার হলেই অসমীয়া ছাড়া জানেনা অন্য কিছু। পক্ষান্তরে গৌহাটি থেকে হাওড়ার দিকের ট্রেনে, ব্রহ্মপুত্র ব্রীজ পার হওয়ামাত্রই শুরু হয় তাদের বংগ-বাতচিত ...

#

আর বেশী উদাহরন টেনে লাভ নেই। দীপু’র অসমীয়া হয়ে ওঠার মাধ্যমে লেখক যদি জাতীয় সংহতির দিকে অঙ্গুলী নির্দেশের কথা ভেবে থাকেন তাহলে বলতে হয়, না, সংহতি এভাবে হয়না। এই রচনাও মূলতঃ একদেশদর্শী। এই রচনা যদি হয় নেহাৎই স্মৃতিকথা তাহলে বলতে হয় দ্বিতীয় সংস্করনে দীপু’কে অসমীয়া করেও তার মধ্যে সুপ্ত বাংগালী বিদ্বেষকে ফিল্টার না করলে দীপুকে হজম করা মুশকিল।

৫।

আগেই বলেছি আমার কাছে এই রচনাটি শিল্প হিসাবে কানাকড়ি মূল্যও রাখেনা তথাপি একে নিয়ে লেখালেখি শুধু এই কথাটিই জানিয়ে যেতে, যে, হে পাঠকবন্ধু, এই যে আসাম দেখছো, এই বই’এ, যেখানে সব-অসমীয়াই ভালো আর কাছাড়ের সব বাঙ্গালীই ‘মূর্খ’, ‘কাপুরুষ’, ‘নেমক হারাম’ তা কিন্তু ঠিক নয়। ঐ বাঙ্গালীগুলি যে অসমীয়া বলেনি তার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ, রক্তাক্ত, ইতিহাস ... হে পাঠক, তোমার শিল্পের সংজ্ঞায় যদি এই বই ‘শিল্প’ হয় তবেও এই বই অসম্মান করেছে কাছাড়ের বাংগালীকে, সেই মৃত ছেলেমেয়েদেরকে, খুন হওয়া অঞ্জন দত্ত’র উন্মাদ হয়ে যাওয়া মা’কে ... আর ‘দীপু’র অসমীয়া হয়ে যাওয়ার মধ্যে সেই অসম্মানের বীজ নয়, বীজটি নিহিত প্রকারান্তরে তার কাছাড়ের বাঙ্গালীকে খুঁচিয়ে যাওয়ার মধ্যে।

এই কথাগুলি পাঠকের কাছে বলে যেতে আমি প্রথম লিখেছিলাম ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২ তে, বইটি পড়ে শেষ করতে পারার পর। আমার সেই লেখাটির ভিত্তিতে কবি ও চিন্তাবীদ গৌতম বসু’র সঙ্গে আমার একটি পত্রালাপ দিয়েই আপাততঃ থামছি।

ক) গৌতম বসুর চিঠিঃ

সপ্তর্ষি,

তোমার আলোচনা পড়লাম। দেবাশিসের উপন্যাসটি আমার খুব ভালো লেগেছে তাঁর লেখার গুণে। এখন অনুভব করছি, শুধুমাত্র লেখার গুণে দেবাশিস আমাকে একটা রক্তাক্ত প্রেক্ষিত ভুলিয়ে দিতে পেরেছেন। কতোদূর গ্রহনযোগ্য এই অবস্থা ( অর্থাৎ আমার ভালোলাগা টুকু ) , তা একটি গভীর প্রশ্ন। যাঁরা বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন, আমার এই ভালোলাগাটুকু তাঁদের অসম্মানের কারন হলো কি’না, এটা নিয়ে কাল থেকে ভাবছি। সপ্তর্ষি, তুমি আমাকে একটা সুকঠিন প্রশ্নের মুখে, একটা অমীমাংসার সামনে এনে ফেল্‌লে,ভাই।

সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ উপন্যাস প্রসঙ্গে কথা বলছিনা, কোনো তূলনামূলক বিচারেও যাচ্ছিনা। আমি অন্য দুটি প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই।

এক, কালী দাশগুপ্ত মহাশয়ের মুখটি মনে পড়ছে। যে সময়ের কথা এটা, তার ঠিক আগে নেলীতে মানুষ মারা হয়েছে। তিনি আমাকে ক্যাসেটের স্পুলের স্তূপ দেখিয়ে বলেছিলেন এই গান গুলি স-ব নেলী থেকে সংগ্রহ করেছিলাম (তাঁর ভাষায় ‘ফিল্ড রেকর্ডিংস্‌’)। তারপর বুক ফাটা হতাশা নিয়ে তিনি আমায় ঐ প্রশ্ন করেছিলেন, ঐ সরল মানুষগুলোকে কে মারছে, কেন মরতে হলো তাঁদের? ঐ হত্যাকান্ড, তাঁর এবং সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের বিশ্বাসের জগতের বাইরের জিনিস রয়েগেলো আজো।

দুই, অলিভার টুইস্ট অবলম্বনে একটি ফিল্ম তৈরী হয়েছিল। নাম ‘অলিভার!’, বোধ করিষাটের দশকে, একটি মিউজিক্যাল-কমেডি। ছবিটি আমি ডিভিডিতে এখনো দেখি, বার বার দেখি, দেখতে বাধ্য হই তার প্রসাদগুনের কারনে। যতোবাএ দেখি ততোবার একটা অপরাধবোধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, আমি ভাবি এ আমি কি করলাম!

আজ এই পর্যন্ত।

ভালো থেকো।

গৌতম বসু

১৭ সেপ্টেম্বর ২০১২

খ) আমার উত্তরঃ

গৌতমদা,

আপনি আমার ‘আলোচনা’র প্রকৃত উৎস আর উদ্দেশ্য দুটোকেই এত পরিষ্কার করে দিয়েছেন, এমন কি, নিজের কাছেও, যে নত হতে বাধ্য হচ্ছি, আবারো আপনার মনন ও ‘ইন্টেলেকচুয়াল অনেস্টি’র কাছে। “কতদূর গ্রহণযোগ্য এই অবস্থা (অর্থাৎ আমার ভালোলাগাটুকু), তা একটি গভীর প্রশ্ন। যারা বাংলাভাষার জন্য প্রাণ দিলেন, আমার এই ভালোলাগাটুকু তাঁদের অসম্মানের কারণ হলো কি হলো না, এটা নিয়ে কাল থেকে ভাবছি”। এই “অমীমাংসা”র জন্ম, শত-জন-মননে, সেই আমার “আলোচনা”র অভীষ্ট। আপনার চিঠিতে তা’যে সিদ্ধ হয়েছে এমন না ভাবার কোনো হেতু নেই।

আপনি লিখেছেন “তোমার আলোচনা পড়লাম। দেবাশিসের  উপন্যাসটি আমার খুব ভালো লেগেছে, তার লেখার গুণে। এখন অনুভব করছি, শুধুমাত্র লেখার গুণে দেবাশিস আমাকে একটা রক্তাক্ত প্রেক্ষিত ভুলিয়ে দিতে পেরেছেন”। গৌতমদা, সমস্যাটা এখানেই। আপনার মত যে কয়েকজন মুষ্টিমেয় মানুষ, পশ্চিমবঙ্গে থেকেও ঘটনাগুলি জানেন, তাঁদের ক্ষেত্রে ‘ভুলিয়ে দেওয়া’র প্রশ্নটা ওঠে। যারা ঐ প্রেক্ষিতটি জানেননা আদৌ, বা ভবিষ্যতের পাঠক তাদের কি হবে? তারা ত’ ধরে নেবে গোটা আসামের বাঙ্গালীদের গোটা ব্যাপারটাই এমন একটা তামাসা, যেমন দেখিয়েছেন দেবাশিসদা... আমি বুঝে নিতে, ভেবে নিতে চাইছি ঠিক কোন মানসিক জ্যামিতি জন্ম দেয় এই রকমের সূক্ষ্ম  মিথ্যার চর্চার... সত্যকে এড়িয়ে যাওয়াও কি নয় মিথ্যা? মিথ্যাচার?... আমার আলোচনাটি পড়ে ডাক্তার, সমাজকর্মী, মৃন্ময় দেব, যিনি জীবনের দীর্ঘতম সময় কাটিয়েছেন ‘আপার আসাম’এ আর কর্মসূত্রে নিবিড়ভাবে গ্রাম-আসামের সাথে পরিচিত হয়েছেন, তিনি জানালেনঃ আলোচনার যুক্তিগুলি অকাট্য নিশ্চয় (উপন্যাসটা পড়া হয়নি যদিও), তবে একটা কথা কিন্তু ঠিক যে ঐ সময় একজাতের দীপু-মানসিকতা সত্যিই গড়ে উঠেছিল। এটা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। সে বিচারে দেবাশিস তরফদার হয়ত উক্ত বাস্তবতাকে ধরার প্রয়াস করে থাকবেন। এর পেছনে একটা কারণও ছিল। সে সময়ে অসমে তরুণদের মধ্যে বামপন্থী চিন্তার প্রসার ঘটেছিল, মূলত পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালিয়ে আসা নকশালদের দৌলতে। বাঙালি এমনিতেই রোমান্টিক-বামপন্থী, ফলে একটা অবাস্তব মানসিকতা জন্ম নিল, এরা অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে একদল বাঙালির উন্নাসিকতার পাপ স্খালনে উঠে পড়ে লেগে গেলো। আর অসমীয়া বামপন্থীরাও (ভালো অসমীয়া) খানিকটা আত্মতুষ্টি লাভ করল। লক্ষ্য করলে দেখবেন উগ্র জাতীয়তাবাদকে পুরোপুরি নাকচ করে অসমে কোন মতবাদ/আন্দোলন গড়ে তোলা প্রায় দুঃসাধ্য (এটা ইসলামের ক্ষেত্রেও দেখা যায়)- কাজেই বামপন্থীরা একটা অবাস্তব আপোষ-মীমাংসায় পৌঁছে ‘ভালো অসমীয়া’ ও ‘ভাল্‌ বঙালি’-র এক উদ্ভট সমীকরণ তৈরি করে ফেলে, দীপু সম্ভবত সেই ‘ভাল্‌ বঙালি’-র প্রতিনিধি।

কে সত্য? দেবাশিস তরফদারের ‘দীপু’ না এই ডাক্তারটির অনুভূতি??? ‘দীপু’কে দিয়ে এই মিথ্যাচারটি লেখক কেন যে করালেন আমি জানিনা তবে এটা যে মিথ্যা, মিথ্যাচারই, সে বিষয়ে আমার কোনো দ্বিধা নেই তাই আপনার এই সংশয়ের ব্যাপারেঃ “কতদূর গ্রহণযোগ্য এই অবস্থা (অর্থাৎ আমার ভালোলাগাটুকু), তা একটি গভীর প্রশ্ন। যারা বাংলাভাষার জন্য প্রাণ দিলেন, আমার এই ভালোলাগাটুকু তাঁদের অসম্মানের কারণ হলো কি হলো না, এটা নিয়ে কাল থেকে ভাবছি” আমি বলব শুধু তাঁদের নয়, এই মুহূর্তে আসামে যে বাঙ্গালী, যে বিহারী বা আরো অন্যান্য ভাষার ও জাতির মানুষ এই অসমীয়া আগ্রাসনের শিকার তাদের প্রত্যেকের প্রতি এই লেখাটি, সাহিত্য মূল্য থাকুক আর নাই থাকুক, অপমানজনক। আমি, সত্যি, বুঝলাম না, দেবাশিসদা ঠিক কি ভাবে ও কারণে এতোবড় সত্যটাকে নেহাত  “ইয়ার্কি” বলে এড়িয়ে গেলেন। গৌতমদা, এ্‌ নিয়ে প্রশ্ন আছে কিন্তু আমার মর্মে কোনো অমীমাংসা নেই। এর হেতুও হয়তো এই, যে, আমি ‘দীপু’র মতো একটা অবাস্তব জায়গা থেকে জিনিসগুলোকে আবাল্য দেখিনি। আমার বাবা-মা দুজনেই ১৯৬৯ এর ভাষা আন্দোলনে জেল খেটেছেন, লুকিয়ে দল নিয়ে কলকাতায় এসেছেন রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য। নলিনাক্ষ সান্যাল তাঁদের সাহায্য করেছিলেন। আমি নিজে, এগারো ক্লাস থেকে, PCC CPIM(L) এর সক্রিয় সদস্য ছিলাম ও সেই সূত্রে, যেহেতু ঐ দল বিশ্বাস করে, Caste struggle is class struggle, আমাকে অসমীয়া, বোড়ো, খাসিয়াদের সঙ্গে মিশতে ও থাকতে হয়েছে দিনের পর দিন, ফলে আমি দেখেছি ঠিক কি ভাবে জাতি ও ভাষাগত দ্বন্দ্ব আসামের পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমার বন্ধু সৌম্যজিত’কে এই ১৯৮৯ সালেও ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজ থেকে পড়া ছেড়ে পালাতে হয়েছে শুধুমাত্র বাঙ্গালী হয়ে বাংলায় কথা বলার জন্য যেখানে অন্যান্যরা ‘দীপু’ হয়ে বেশ টিকে গেছে।

এই ক’দিন আগেও যখন কাতারে কাতারে ছেলে মেয়ে পালিয়ে গিয়েছে বেঙ্গালোর, পুনা, হায়দ্রাবাদ, বোম্বে থেকে। প্রাণের ভয়ে। এরা সব উত্তরপূর্বের মানুষ। মূলতঃ আসামের। হয়তো এর পেছনে রয়েছে গুজব, হয়তো ‘রাজনীতি’। সে প্রসঙ্গে পরে যাবো। তার আগে বলে নিই যে, যেহেতু আমিও ‘অফিসিয়ালি’ ‘আসাম’এর, যেহেতু আমিও থাকছি এই বেঙ্গালোর শহরেই, ফলতঃ এই ঘটনা ঠিক ‘তাত্বিক’ বা ‘দার্শনিক’ ভাবে নয়, আমাকে আক্রমণ করে রক্তে মাংসে। আমি টিভিতে খবর শুনি, ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখি কোন দিকে যাচ্ছে ঘটনার গতি এবং অন্তিমে ফোন করি, ই-মেইল্‌ করি বেঙ্গালোরবাসী অন্য চেনা পরিচিতদের। তারা বলে, মনে হয় ঠিকই বলে, কেননা সেটাই স্বাভাবিক, যে, ‘আমাদের ভয় নেই, মেইন্‌লী ট্রাইবেল্‌রা’ই টার্গেট’ তারপর সামান্য থেমে ‘আর আমাদের চিন্তা কি? কেউ বললে বলবো আমরা কলকাতার’। আমি উত্তেজিত বোধ করি। নিপীড়িত বোধ করি। না, কলকাতা নিয়ে আমার কোনো ঘৃণা বা বিদ্বেষ নেই। কিন্তু প্রাণে বাঁচার জন্য নিজের আদত জন্মস্থানের কথা না বলে নিজেকে বলবো ‘কলকাতার’??? ‘দীপু’ কে যখন ‘বরাকের লোকে আসামী জানেনা কেন?’ বলা হচ্ছিল, তখন দীপু যদি বলতো যে ‘আসামীরা এই আসামীতে কথা বলার জন্য এতো মানুষ মেরেছে যে ঐ ঘেন্নায় বরাকের লোক আসামী বলেনা” তাহলে গোটা লেখার কোনো ক্ষতি হতো কি? (লেখক তো বলেইছেন গল্প মানে বানিয়ে বলা সত্য, তা এইটুকু কথা বানিয়ে বললে আর যা’ই হোক লেখাটির স্নব্‌ চরিত্রটি দূর হতো)।

আমি নিহত বাচ্চু চক্রবর্তীর পত্নীকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনি, আমি জানি বাকী এগারো জন আর ১৯৮৬ সালে নিহত জগন-যিশু’র পরিবারকে কিভাবে ঐ অসমীয়ারা অত্যাচার করেছে, জানি আজ তারা কিভাবে জীবিত। কাজেই, ঐ জানার মূল্যে, ‘দীপু’র এই র‍্যালা, বাঙ্গালীদের নিয়ে আমি সহ্য করতে পারিনা। আমি নিজে ২ বছর গৌহাটিতে থেকেছি, কাজ করেছি কিন্তু একটি অসমীয়া শব্দ উচ্চারণ না করে, আমি অসমীয়া শিখিনি শুধু এই কারণে, যে, যে ভাষা শেখানোর জন্য মানুষকে মারতে হয় সেই ভাষা ঘৃণ্য না’ও যদি হয়, যারা তাকে চাপিয়ে দিতে চায় তারা ঘৃণ্য। কাজেই ‘দীপু’ ‘অসমীয়া’ হলে আমার আপত্তি হয়না, অনেক ছেলেমেয়ের মধ্যে মা-বাপের দু চারটে ছেলে তো কুলাঙ্গার হয়েই যেতে পারে, কিন্তু সেই ‘কুলাঙ্গার’ যখন অন্য ভাই-বোনেদের নিয়ে কটূক্তি করে তখন আমার সহ্যের সীমা পার হয়ে যায়।

আপনি লিখেছেন “সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ উপন্যাস প্রসঙ্গে কথা বলছিনা, কোনো তুলনামূলক বিচারেও যাচ্ছিনা”। আমি ‘কালবেলা’ উপন্যাস প্রসঙ্গ আনার আগে ভেবেছিলাম ডক্টর জিভাগো’র আবহে করবো আলোচনাটা কেননা সেখানেও আবহ এমনি এক রাষ্ট্র-বিপ্লব কিন্তু পরে মনে হল এই ‘শরাইঘাট...’ এর প্রেক্ষিতে পাস্তেরনায়েককে নামিয়ে আনলে সেটা তাঁকে অপমান ছাড়া আর কিচ্ছু হবেনা। ‘গোরা’র কথাও মাথায় এসেছিল। কিন্তু এই ‘শরাইঘাট’ ঐ সমস্ত লেখার পাশাপাশি উচ্চারিত হওয়ার দাবী রাখেনা বলে শেষ পর্যন্ত ‘কালবেলা’তেই এলাম...যদিও আমার ধারনা ‘কালবেলা’ এই ‘শরাইঘাট’ থেকে ঢের সফল ও সত্য...।

আপনার চিঠিতে কালী দাশগুপ্ত মহাশয়ের যে অনুভব তা আমি টের পাই শুধু বুদ্ধি দিয়ে নয়, রক্ত-মাংস-শিরা-উপশিরা দিয়ে। ‘অলিভার’ ছবিটি আমি দেখিনি। এখন, পড়ে, দেখার ইচ্ছে করছে। তবে আপনার বক্তব্য আমি অনুধাবন করতে পারি। এমনটা আমারও হয়। অনেক ক্ষেত্রেই হয়। দালি’র ছবি যখনই দেখি, মানে দেখতে দেখতে মুগ্ধ হই কখনো, তারপর আমারও এমনি অপরাধবোধ  কাজ করে। বা ধরুন কখনো হিট্‌লারের ‘ক্যাম্প’ এর কিছু অংশ ভালো লাগার পরও তেমনি একটা অপরাধবোধ কাজ করেছিল। তবে ‘শরাইঘাট’ এর ব্যাপারে প্রসঙ্গটা অন্য। এখানে হিট্‌লারি’টা এসেছে সত্যকে গোপন করে। যে পাঠক ঐ ঐতিহাসিক সত্যগুলিকে জানেন না তাঁদেরকে “ঘুমে বেচবার” মতো করে। কাজেই আমি নিশ্চিত, এখন, এই আলোচনাটি পড়বার পরে, আবার খুলে বসলে এই লেখা আপনাকে ঐ শিল্পিত শান্তিও দেবেনা।

আমি এই চিঠিগুলি প্রকাশ করতে চাই। আপনার অনুমতি পেলে।

সপ্তর্ষি

১৭/০৯/২০১২

#

হ্যাঁ, আর কিছু না হোক সৎ পাঠক শুধু এটুকু বিচলিত বোধ করুন, যেটুকু করেছেন গৌতম বসু তাহলেও আমার এই ধর্মযুদ্ধ বহুদূর অর্থবহ হবে ...

মঙ্গলবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

রাধের বুক ধড়ফড় করে


বুক ধড়ফড় করে...
আমার বুক ধড়ফড় করে

রাধে, তোর সোনার অঙ্গ
চারপেয়েতে উঠল এবার বল।

বৃন্দাবনে বাঁধবি বাসা,
সেই সুখেতেই চল।

যমুনার বুক, ধড়ফড় করে
কৃষ্ণ পরান জ্বলে,
রাধা এখন গাছের ডালে,
ঝুলে.. শুধু ঝুলে...

রাধিকা বিহনে কৃষ্ণ সখারা মূলী বাঁশের পাল্কি তৈরিতে ব্যাস্ত। চিত্রগুপ্তের নির্দেশ, পাল্কির মতো চারপেয়ে চাই। ঈশ্বরের আদালতে অভিযোগ জানিয়েছিল রাধাসখীর দল। যে রাধার যৌবন গেল কৃষ্ণ বিহনে, বার্ধক্য গেল বৃন্দাবনের পথে পথে কৃষ্ণ বিহনে, তার দেহ কিনা কেটে ফালা ফালা করে ফেলা হবে পুরসভার ডাস্টবিনে! এ কোন ধর্ম!

ন্যায্য অভিযোগ পেয়ে চার্জশীট দাখিল করলেন নারদ মুনি। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে না। প্রেমের গোকুলে এই অন্যায়! এতো বড় পাপাচার! রাধার অঙ্গ কেটে কিনা শেষে ফেলে দেয়া হবে ময়লাখোলায়!

আদালতের নির্দেশ, হিন্দু মতেই সৎকার করতে হবে। বৃদ্ধা, স্বামীহীনা, নিঃস্ব রাধাসখীদেরও এই কষ্ট আর সইতে দেয়া যাবে না। দিতে হবে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, আর গোকুল রাজার ভাতাও। হিন্দু রীতি মেনে হতে হবে দাহ। আম কাঠের আকাল পড়লে মরাল গাছের ডাল দেবে শ্মশান বন্ধুরা, মধু দেবে, ঘি দেবে, তিল দেবে, কাঁচা চালের মণ্ডা দেবে আর গঙ্গার কাঁদা।

তবে আগর নেই, আগ্রাতলার আগর গাছে বহু আগেই পোকায় ধরেছে। নিম চন্দন কেটে নিয়ে গেছে ডাকাতের দল। মধু পোকাদের বাসায় প্লাস্টিক হাতের অনুপ্রবেশ। যেমন কুমারি মেয়ের পেটে হাত ঢুকিয়ে বুক টিপতে টিপতে ওঝা বের করে আনে অবাঞ্ছিত ভ্রূণ। যেন সঙ্গমে লিপ্ত প্যালাস্টিকের হাত!

রাধিকা চলেছেন স্বর্গে। নতুন কাপড় পড়িয়ে সখীরা চিতায় তুলবেন তাদের প্রিয় সখীকে।
পুরুষের দল ডান হাতে দিল রাধিকার মুখে প্রিয় নারকেল নাড়ু। সখীর দল বাম হাতে দিল বিন্নি ধানের খই, আটার মণ্ডা। কেউ দিল নতুন ভাতের দলা আর কদম ফুল।

সোনার অঙ্গে এখন আর সেই জেল্লা নেই। গায়ে হলুদ মাখিয়ে স্নান শেষে রাধার বুকে বেঁধে দেয় কাঁচুলি। লালের বুকে সবুজ রঙে আঁকা মাছ, ফুল আঁকা অস্ত্রের ছবির প্রিয় কাঁচুলি। বুক এখনও গরম, শুটকে যাওয়া আঙুরের লাহান নরম টসটসে, রসে ভরপুর।
ধড়ফড়, ধড়ফড় করে লো সই ... ধড়ফড়, ধড়ফড় করে।
বের পায়না রাধার বুকে এই এক চিলতে কাপড়ের টুকরো। মেয়ে মাইনসের বুকে আজীবন সব আদর, ভালবাসা, কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রণা ঘাপটি মেরে থাকে। একটা বিশাল জীবন রে কি এই কাপড়ের টুকরো দিয়ে বাঁন্ধন যায়!
এখনও আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে তাকিয়ে আছে উন্নত স্তন। শরীরের বাঁধনে বার্ধক্য এলেও স্তনসম পৃথিবীর বুকটা, এখনও কাঁপন ধড়ায় কৈলাসে। একটুও হেলে পড়েনি। লজ্জা পায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। আকাশ টের পায় নিজের বুকে, বুক ঝাপ্টানির কাতর আঘাত।
নারী শুধু হৃদয় সর্বস্ব গোপন বোঝাপড়ার খনি, মিছে নয় তার অস্ফুট, চাপা যন্ত্রণা। মিছে নয় তার এই সাহস, ঔদ্ধত্য আর অহংকার। সৃষ্টি কে বশে রাখার যাবতীয় কৌশল তার রপ্ত। ঢাল নেই, তরবারি নেই আছে শুধু স্ফটিকের মতো জল আর শুধু জল। যেমন থাকে পাকের মধ্যি শাপলা ফুল পৃথিবীর সব রঙ নিয়ে একা!

###
ফুলবতির সই রাধা। গত হপ্তায় তার কাঁচুলি দিয়েই মরালা গাছের ডালে বেঁধে খাঁচায় পুড়ে রাখা হয়েছিল মাস তিনেকের মৃত শিশুকে। কিভাবে যে দুধ খেতে খেতে বুকের মধ্যেই মরে গেল তুক্কিটা! আজও কাঁপন ধরে। এক বছরের বাচ্চা মরলে বেঁধে রাখতে হয় কাঁচুলি দিয়ে মরালার মগডালে। যাতে ঈশ্বরের কাছে যেতে পারে সেই শিশু খুব সহজেই। ফুলবতি গিয়ে দেখে আসে প্রত্যেকদিন তার তুক্কি কে গাছের ডালে ঝুলছে। বাপটা আর কোনদিন ছুতে পারবে না এই মরাল গাছের ডাল। ঘুমের মধ্যেও চুমা খায় তুক্কির গাল ভেবে উদাম বুকে। এরপর জেগে উঠে হামলে পড়ে শরীরে। আবার যেন এই রাতেই জন্ম দিতে চায় আরেকটা তুক্কির। শেষে চুক চুক করে মাই চুষে খায়। পাশেই শুয়ে থাকা শুয়োরের বাচ্চা গুলি শব্দ তোলে,  ঘোঁতর ঘোঁতর...ঘোঁত... ঘোঁত...

রাধা কয়, পাণ্ডব পুত্রেরাও অজ্ঞাত বাসে যাবার কালে তাদের অস্ত্রশস্ত্র মায়ের শব বলে ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছিল কামিবৃক্ষের মগডালে। পাছে কেউ না ছুঁতে পারে। শব ঈশ্বরের কাছে যাবে, তাই পোকায় মাকড়ে খেলে দেবতার ভোগে লাগবে না। শ্বাপদ আর শৃগালের খাদ্যে রুচি হয়না ঈশ্বরের। ঈশ্বরের এই বিধান।

###
এবার রাধার শরীর তুলে ধরবে মরদের দল। আহা, আস্তে ধর! ব্যাথা পাবে তো সোনার অঙ্গ। পা চেপে ধরে লাথির পর লাথি মারবে মাটির দেয়ালে। এরপর মাটির চিতায় আগুনে পুড়ে খাক হবে সোনার শরীর। হায়লো রাধে তোর বুঝি এবার শেষ হল সংসারের সুখ, মায়া চিরতরে!
আকাশমুখো  হবি, কানহার দেখা পাবি, যমুনায় এবার নাইবি, আমার বুক ধড়ফড় করে...!
নদীর জলে ভাসবে তোর চারপেয়ে পাল্কি। নদীর কুলে হবে রে তোর বিয়া,আমরা খাবো শেঙড়া পাতার চা।

রাধে, বুক ধড়ফড় করে,
শেঙড়া গাছের শরবৎ দে লো, কইলজা করি ঠাণ্ডা।
রাধে তোর নাভি খাবে রাজায়
কপালের চাড়া নেয় চিলে
কানহার বাঁশি শুধু বাজে
আমার মন উদাসী হয়

আমার বুক ধড়ফড় করে লো সই...
বুক ধড়ফড় করে।

আমার মন ক্যামন করে। লাথি মেরে ভাঙবো এবার গর্ভের ফুলটারে
আমার মন ক্যামন করে লো রাধা, বুক ধড়ফড় করে...।

রবিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২

ছবিতে কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী

(অমিতাভ দেব চৌধুরীর সৌজন্যে পাওয়া গেল কবি শক্তিপদর এই দুর্মূল্য ছবিগুলো । মনে হলো সংরক্ষিত করে রাখা উচিত)





হারাধন রংমন কথা

   ( ৯৬০এ রাজ্যভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অসমিয়া বাঙালিদের মধ্যে যে সংঘাতময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল।সেই সময় হেমাঙ্গ বিশ্বাস ভূপেন হাজারিকাকে সঙ্গে নিয়ে নানা ভাষা সম্প্রদায় থেকে শিল্পী নিয়ে শিলং থেকে যাত্রা শুরু করেন। দু’জনেই তখন গণনাট্যরে সদস্য হলেও কৌশলগত অবস্থান থেকে সেবারে গণনাট্যের নাম ব্যবহৃত হলো না। ‘Let us meet cultural troupe’ ছিল নতুন স্কোয়াডের নাম।   ভাতৃঘাতি রক্তপাতে উষ্ণ এবং লাল হচ্ছে জল এবং উপত্যকা। সুতরাং তাদের অভিযান ছিল অনেক বেশি সাহসী এবং ঝুঁকি পূর্ণ। এই বিখ্যাত ‘হারাধন –রংমনে’র গীতি আলেখ্যটি তখন লেখেন দু’জনে মিলে। এটি  সহ আরো প্রচুর গান, কবিতা, নাটক নিয়ে দু’ই তাঁরা যেন সংগ্রামী ঐক্যের যুদ্ধ জয় করলেন। বাংলা অসমিয়াতে  ভূপেন হাজারিকার সাগর সঙ্গমে গানটিও ছিল সেই অভিযানের অন্যতম জনপ্রিয় গান।  যে দিকে গেলেন, গানের সুরেই দাঙ্গাবাজদের প্রতিহত করতে করতেই এগুলেন তাঁরা।মূল পাঠটি নেয়া হয়েছে অসম প্রকাশন পরিষদ প্রকাশিত, পরমানন্দ মজুমদার সম্পাদিত 'হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচনাবলী' ; পৃঃ ৯৬৫ থেকে। ---সুশান্ত কর)

                                                                                              হেমাঙ্গ বিশ্বাস
                                                                                             ভূপেন হাজরিকা

রংমনঃ      মনরে বননি চেনেহর নিজরার
                 পানীকে এটুপি পিওঁ।
                 পোরাকৈ ভেঁটিতে তুমি ঘর বান্ধা
                 আমি টঙাল তুলাই দিওঁ।
হারাধনঃ   আবার আমি বান্ধমু ঘর
                আবার গাইমু গান
                দুঃখে যদি পাষান গলে
                গলবে কি পরাণ।
রংমনঃ      লুইতর চাপরিতে চাকৈয়ে কান্দিলে
                 মানুহর নাওখন চাই
                 মানুহর দুখতে মানুহ বুরিব
                আনকচোন দুষিবর নাই।
হারাধনঃ  পদ্মার তুফান উড়াইয়া নিল
                আমার সুখের ঘর
                উজান ঠেইল্যা আইলাম আমি
                লুইতের চর।
               আবার ভাঙা নাওয়ে বন্ধু
               তুমি দিলায় পাল
               আমি ধরলাম বৈঠা বন্ধু
               তুমি ধরলায় হাল।
              এ’ মিলন গাঙে আনলো বলে
               কে বিভেদের বান
              চর ভাঙিল, ঘর ভাঙিল
              ডুবলো সোনার ধান।
              আমার দেহে বৃষ্টি শুকায়
              রক্তকণায় সুরুয ঘুমায়
              হালের খুটি মুঠিতে শোভায়
              তবু কেন উপবাসী
              নিজ দেশে পরবাসী
              সমনীয়া, বলো না আমায়।

রংমনঃ   ভাষা নুবুজিও যুগে যুগে আহে
              মানুহ মানুহর পিনে
              মরমর ভাষারে আখর নাইকিয়া
             বুজিব খুজিলেই চিনে।
             গঙ্গার চাপরিরে তলিতে দেখিবা
             লুইতর পলসো আছে
             তোমার মোরে আয়ে কান্দিলে
            একেই চকুপানী মচে।
            তুমিয়ে ময়ে দেশখন গঢ়োতে
            যদিহে কেঁচাঘাম সরে
            দুয়োরে ঘামরে মিলনে দেখিবা
            বুরঞ্জী রচনা করে।
রংমন-হারাধনঃ (দুঃখে দ্বৈত কণ্ঠে)
            এনেনো দুখ লাগে বান্ধৈ
            এনেনো দুখ লাগে
            এমন দুঃখ লাগেরে বন্ধু
            এমন দুঃখ লাগে
            অতীত দিনর মিলন স্মৃতি
            যখন মনে জাগে।
            তুমি ছড়ালে বীজ বন্ধু
            আমি কাটলাম আলি
           একেই সঙ্গে ঘরে আনলাম
           সোনালী রূপশালি।
           এনেনো ভাল লাগে বান্ধৈ
দ্বৈতকণ্ঠে আনন্দেঃ
           এনেনো ভাল লাগে
           এমন ভালো লাগেরে বন্ধু
           এমন ভালো লাগে
           তুমি নাচো বিহুনাচ আমি দিব তালি
           ঐকতানে মিলে যাব বিহুভাটিয়ালি
           দেশকে আবার গড়বো মোরা
           বুকের মরম ঢালি।।



শুক্রবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আমরা দুবোন

 দি, তুই-আমি দুবোন ,
হতে পারতাম দুটো জোনাকি!
আঁধার রাতে এক মুঠো আলো ছড়িয়ে দিতাম,
ওল বনের শেষ সীমানায়।
অথবা হতে পারতাম দুটো পাখি,
উড়ে যেতাম সুদূরের টানে। 
আমি যখন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়তাম ,
তুই খুঁজে বের করে নিতিস কড়া শাসনে ।
আমার ছোট্ট পাখায় রোদ লেগে যায় পাছে,
সেই ভয়ে ত্রস্ত তুই , বেঁধে নিতি আমায়,
তোর পালকের  স্নিগ্ধ ছায়ায়।
মধু লোভী আমরা দুবোন ,
যদি হতে পারতাম , দুটো মৌমাছি।
ফুলে-ফুলে গুন গুনিয়ে কেটে যেত দিন।
ভালোবাসার গানে তুই ভরিয়ে দিতিস আকাশ বাতাস,
ঠিক শৈশবের মতন, আমার গলায় স্পষ্ট হতো তোরই গানের সুর।
পাগলপারা হয়ে যদি  বয়ে যেতে পারতাম,
 হতে পারতাম কাল বৈশাখী ঝড়!
উড়িয়ে নিতাম পুরাতনের আবর্জনা। 
পৃথিবীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বেজে উঠত,
নবীনের শঙ্খধ্বনি ।  
তখন ও তুই ধরে রাখতিস আমার হাত,
বলতিস, দূরে যাসনে ওরে দস্যি মেয়ে। 
চিরচঞ্চল আমরা দু বোন, যদি হতে পারতাম বৃষ্টি ,
ঝমঝমিয়ে নেচে উঠতাম টিনের ছাদে।
শেষে দুটো ধারার মতো মিলে মিশে বয়ে যেতাম,
মরুভুমির বুক চিরে, সবুজের বন্দনাগানে। 

বৃহস্পতিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১২

জীবন যখন একটাই!



জীবন যখন একটাই! ধুত্তেরি! এটা আবার একটা কথা হল? জীবন-টা যখন গিরগিটির, হাঁ, তার তো সেই একটাই জীবন, রঙ পাল্টানোর অধিকার থেকে সে নিজেকে বঞ্চিত করবে কেন? আবার যদি সেটা যখন কোনও বিষধরের জীবন, তাহলে ছোবল মারার জন্মগত অধিকার থেকে কে তাকে সরিয়ে আনবে? যতই পোষা হোক, দুধ-কলা খাওয়াক না কেন সাপুড়ে; যে তাকে পুলে-পুসে রাখছে – সে ব্যটাও তো ঐ এক্তিয়ারের বাইরে থাকছে না। এটাই তো নিয়ম। একটাই জীবন বলেই কি অর্থনীতির পাঠ নেওয়া মাস্টার মশাই-ও বিশ্বময় গ্রামের বাজারে নিজেকে ভোগ্য-পণ্য (Commodity) বানিয়ে  বাজার-জাত করবে? এটাও তো স্বাভাবিক?
         আসলে ইতর-প্রাণীদের দিয়ে শুরু করেছি বলে, তাদের নিয়েই পুরোটা লিখব, তেমনটা তো আর হয় না। ইতর-রা তো ইতর-ই। মানুষ হয়েও মনুষ্যেতর, ( বরং পড়ুন, 'মনুষ্য-ইতর')! ঐ সমস্ত নীচ বর্গের প্রাণীরা তো আর  মানবিক সংস্কার বা মূল্যবোধের ধার ধারে না!  মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব!  তাদের কাছে এটা তো 'কেতাবি' শব্দ মাত্র!
       জীবন তো একটাই। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ তো সেটাকে ধরে রাখতে হবেই। আর সেই তাগিদে রুটিরুজির সংগ্রামে নিজেকে সামিল করতে যে পেশাটা বেছে নিয়েছেন ভদ্রলোক, সেটা দুর্দান্ত! ফার্মাসি থেকে মেয়াদ ফুরানো ওষুধের ব্যবসা। ভয়ানক জীবিকা! রোজগারের মারাত্মক পন্থা! অন্যকে তিল তিল করে মৃত্যুর খাদে ঠেলে দিয়ে বেশ ভালই এগোচ্ছেন তিনি। একেবারে ডাহা বাস্তব।
       'মান' আর 'হুস', এ দুয়ের সাযুজ্যে বুঝি মানুষ! মান হচ্ছে তাঁর স্বাভিমান, স্বজাতভিমান, যে সংস্কার, যে শিক্ষা পারিবারিক এবং সামাজিক পূর্বজদের কাছ থেকে জীবনের প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে আহরন করেছে এবং করছে-ও, শিরদাঁড়া-টাকে সোজা রেখে জীবনের পথে চলার জন্য।
      শিরদাঁড়া-টাকে সোজা রাখার সংগ্রামে সামিল হয়েছেন যারা, তাদের সংখ্যা এদেশে ভুরি ভুরি। বিপরীত মেরুর বাসিন্দাদের সংখ্যাও তো আজকের জমানায় অপ্রতুল নয়। এই  প্রতুল-অপ্রতুল এর দ্বন্দ্বে, ভাল-মন্দের সংঘাতে, ন্যায়-অন্যায়ের দোলাচলে ভবিতব্যের পথিকেরা আজ দিশেহারা হওয়ার শামিল! ‘আদর্শ’ বলে যাঁকে ধরে রেখেছিল, তিনিই যে মনে হচ্ছে পথভ্রষ্ট!
        আবার মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে যে দেশটার জাতীয় জীবন, যে দেশটাতে  আত্মত্যাগ আর আত্মোৎসর্গের ছড়াছড়ি, তাঁর পুরোধা-রাও তো আজকাল কালো রঙটার সাথে আলিঙ্গনে মগ্ন। মসনদের আধিকারিকেরা তো সমস্ত জীবন আর শক্তি দিয়ে মূল্যবোধের আন্দোলনকে হাজার টুকরো করে দিতে যতটা তৎপর, ঠিক ততটাই নিস্প্রভ  কালো রঙের প্রলেপ টাকে মুছে দিতে!
             এটাও তো আবার সেই একমাত্র জীবন ধারী-দেরই মহিমা।
         আসলে কাজের পরিধিটা ছোট কিম্বা বড়, যে মাপেরই হোক না কেন, আখেরে সেটা করতে গিয়ে “তাতে আখেরে লাভ কি হবে?” এই ব্যক্তি কেন্দ্রিক একমাত্র জিজ্ঞাস্য বিষয়টাই যেখানে নির্ণায়কের ভুমিকা হয়ে দাঁড়ায়, তখন ব্যক্তি,  তথা সমাজের আদর্শ এবং নীতি বলে কি আর কিছু থাকতে পারে?
         'ছা-পো-ষা লো-ক' অর্থাৎ 'আম-জনতা' এই করতে করতে নিজের অজান্তে কবেই যে দেওয়ালে পিঠ  ঠেকে গেছে, সেটা আঁচ করতে পারেন নি...!
        মাথার ওপর যেমন অনন্ত আকাশ, পায়ের নিচেও তেমনি অন্য এক  অপার মহাশূন্য...!
       ছোঁ মেরে এক এক করে সবাইকে যে মহাসমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলার  'নীল-নক্সা'  তৈরি হয়েছে, রঙ বদলের প্রক্রিয়া দিয়ে তো অন্ততপক্ষে এ থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব নয়?
         ব-র্ণ-চো-রা-রা কিছু আঁচ করতে পারছেন কি  ??     তাহলে......??

নোনা ইচ্ছে


গায়ে শ্যাওলা ধরেছে
ইচ্ছে হয় শীলাকে নিয়ে
হানিমুন যাই

ইচ্ছে করে জিরো গ্র্যাভিটিতে
একটা নতুন গ্রহ ছুঁড়ে দিই
নাম রাখি মৃত্তিকা
তোমার নামে।

এরপর যদি চলে খনিজ উল্লাস! অথবা সেন্ট্রাল ব্যুরো
অব ইনভেস্টিগেশানের রেইড
অথবা অকাল নির্বাচন!

বন্ধ হয়ে যেতে পারে নির্গমনের রাস্তা

মহেঞ্জোদারোর সভ্যতায় কাস্তেটা ছিল ভোঁতা

তার চেয়ে ভালো লাল চা, পার্টি অফিসে বসে
চলুক বিসমিল্লা খান কিংবা বীরবিক্রমের বাঁশী

আমার সাদা কালোর সুচিত্রা সেন আজ ঘরবন্দী
ঢের ভালো খুকুমণির গলা সাধা সকালটাই।

সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

রূপসার বুকে কাঁপন


প্রেম আপাতত নিহত, তা বলার কোন কারন নেই। হাত থেকে দস্তানাটা খুলে ফেলে দাও, দেখবে চুমু খেয়ে গেছে কোন বাবুই পাখি।
আজকাল তোমার বুকের রঙ পাল্টে গেছে। তাই মনের রঙেও নতুন রঙ লেগেছে জানি। সেই রঙে কোন নিহত প্রেমের কাব্য লেখা হয়তো সম্ভব নয়, তাই ভাবলাম ভালোই আছো। পিঙ্গল কোন ফুলের কাছেই লিখলাম তোমার কথা।
জানি হাজার নীলাভ চোখ হয়তো এখুনি বাষ্পরুদ্ধ হয়ে উঠবে প্রেমে অথবা অপ্রেমে।
যেদিন আমি থাকবো না সেদিন তুমি অনেকদূরে, মনে পড়া ছাড়া আর কোন পথ হয়তো থাকবে না। তবে সেটা আজকের চেয়েও বেশি কষ্টকর। তোমার কথা।
কবেই বা ছিলে!
আজকাল বাম চোখটা খুব লাফাচ্ছে জানো! সবাই বলে পুরুষের বাম শরীর কাঁপলেই বিপদ। আমি জানি আমার বাম দিকটাই বেশী প্রিয় তোমার। আর তোমার বাম হৃদয় আমারই ছিল। মনে আছে কথা দিয়েছিলে কোনদিন কাউকে স্পর্শ করতে দেবেনা সেই বুকে।
বাবুই পাখি এসে দেখে গেল তো চুপটি করে! তখন তুমি স্নানে ছিলে।
একটা ঝাঁঝালো রক চলছিল। নিওন আলো সম্পর্কিত। তাই টের পাওনি বাবুই পাখির আসা যাওয়া।
আজ একটা নারকেল ভেঙ্গেছি। কিছু তিল ভেজেছি লোহার কড়াইয়ে। হাত অম্বল খাবো বলে। বড্ড গরম আজকাল। শীতল হওয়ার খাদ্য। তোমার প্রিয় কালো তিল। তিল গুলি ভাজতে ভাজতে কাঠের উনানে মনে হয়েছিল, সেগুলি লাল হয়ে যাচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে বর্ণ। ঠিক তোমার বিশেষ কোন মুহূর্তের মতোই।
লোহার কড়াইয়ে, আগুনের আঁচে আমার প্রিয় শরীর, তোমার নিষিদ্ধ তিল। যাকে স্পর্শ করার আমার কোন অধিকার ছিল না কোনদিন, আজও নেই। তাই পাল্টে দিলাম সেই রঙ। এখন নিজের হাতে ছুঁয়ে দ্যাখো, আমারই মতো পুড়ছে সে। আর থাকতে চাইছে না তোমার শরীরে লেপ্টে।
দস্তানাটা খোল। এরপর আমার সামনে এসে দাঁড়াও। শেষবার তোমাকে জানান দেই, আমিও ভালো নেই। তুমিও না।
চলো ঘুড়ির মাঞ্জা বানাই। কাল বিশ্বকর্মা পূজা। গত বছর এই দিনটাতে তোমার ঘুড়ি কেটে দিয়েছিলাম আমি। এই ছাদ থেকেও স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম তোমার কষ্ট। তোমার আকাশ হওয়ার স্বপ্ন এক সেকেন্ডে ভোকাট্টা হতে দেখে পাল্টে যায় তোমার চোখ। তারই জেদ, আমাদের প্রেম। আজ সব ভোকাট্টা।
চলো আরেকটা ঘুড়ি উড়িয়ে দেই, কথা দিলাম আর কাটবো না। সেই সুতোয় গেঁথে দেবো বকুল ফুল। সুতো টানলেই পেয়ে যাবে আমার দখল। চেয়ে দেখো হলুদ, নীল প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে তোমার আকাশে। ছুঁয়ে দেখো একবার।
ওরা সেজেছে আজ তোমারই জন্যে। হঠাৎ বৃষ্টির কোন সংকেত নেই আপাতত। তাই ভিজবে না তুমি কোনদিন।
অন্যথায় দরজাটা খুলে দাও, বাবুই পাখিকে অধিকার দাও আরেকবার চুমু খাওয়ার, বাতাস কে পাঠাই এবেলায় তোমার মনের হদিস পেতে। শেষ বেলায় না হয় আমি যাবো।
সন্ন্যাসী বসন্ত। কিছুতেই হেলে যায়না অবরুদ্ধ দ্বার।
নির্মল শরৎ শান্ত ধীর স্থির। জোনাকিরা কাশ বনে ঘুরে বেড়ায় একাকি নিঃসঙ্গ। নগরীর নটী চলেছে রূপসার পাশ দিয়ে। ভেসে আসে নুপুরের ঝমঝম শব্দ। আমার নেশা রূপসার বুকে, ছলাৎ ছলাৎ লাফায় বুকের ভেতর গঙ্গোত্রীর জল। তুমি দেবী কাঠুরিয়ার।
আমার ভয় হয় জানো...।

ইচ্ছে

মাকে দিতে পারো একমুঠো আকাশ ?
একটা রক্তিম বিকেল?
পায়ে পায়ে বসন্তেরা ছুটে চলেছে,
নামহীন ঠিকানায়।
হারানো ডাইরির পুড়ে যাওয়া গন্ধে,
দম আটকে গেছে সেই কবে।
তবু একবুক দমকা হাওয়া মাঝে মাঝে,
ইচ্ছে নামের খেয়াতরী ভাসিয়ে দেয়,
মন কালিন্দীর ভরাট জলে।
ঝিঙ্গে ফুলের হাল্কা রঙে ,
স্পষ্ট হয় স্মৃতির ছায়াপথ।
আজন্ম লালিত সাধ,
উঁকি দেয়, শুকতারার রাতজাগা চোখে।

বেঁচে আছি তো?


মার ইচ্ছেরা আজকাল
ইচ্ছে হারিয়ে ফেলছে ক্রমশ
সুখ নেই, শোকও নেই কাছাকাছি

আমি চলতে চলতে পিছিয়ে পড়ি
আমার আগন্তুক স্বপ্নেরা বাসা বাঁধে অন্য ঘরে
ধু ধু ফাঁকা মাঠ যেন হাতছানি দেয়
ভবিষ্যতের কোথাও
আমার আকাশে কালো মেঘ সারি সারি
অসাড় শরীর বয়ে নিয়ে যায় সময়
লক্ষ্যহীন পথের পথে
আমি মাঝে মাঝে অজান্তে
চিমটি কাটি শরীরে
বেঁচে আছি তো?
বেঁচে আছি তো? নাকি আমারো মৃত্যু হয়েছে
আরো অনেকের মত
নিজের জন্য বেঁচে বেঁচে

১৭/০৯/১২ সময় রাত ১২-১৫    (c) Picture:ছবি

শুক্রবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১২

মাটি, লবণ ও কবিতা


(আমার বন্ধু, কবি, সাংবাদিক আপন মাহমুদ কে... আপাতত তার দেশের নাম আমি জানিনা।প্রয়াত কথাটাও তাই লিখলাম না। কারন আপন'দের মৃত্যু হয়না কোনদিন। আমি বিশ্বাস করি প্রতিটি মৃত্যু প্রতিদিন নতুন জন্মের ইন্ধন দেয়। মাটি বাঁচতে দেয়, বসতি গড়তে দেয়, খাদ্য দেয় তাই মাটির ভুবনে মৃত্যু শব্দের কোন অস্তিত্ব নেই। তাই এই মাটি, আমি, আমরা যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আপন বেঁচে থাকবে। বন্ধুদের অভিযোগ করতে নেই, তাই অভিযোগ করলাম না শুধু জানতে চাইছি কেমন আছো তুমি...)




 নুন মাটির দেশে শুধু অন্ধকার। একা বড্ড ভয় লাগে আমার।

আমার ডেস্কে ডেটলাইন, বলপেনে বিষয় মৃত্যু
আর তুমি ভালবাসা। সাদা কাগজ

শরীর আমার হিম ঠান্ডা, কোন বিদ্রোহ করার শক্তি আপাতত আমার নেই।
তাহলে হয়তো মৃত্যু সভ্যতার একটা নিখুঁত কপি শেষবার তোমায় দিয়ে যেতে পারতাম বন্ধু।

একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে আমার শরীর মাটির সাথে
যেভাবে মিশে গিয়েছিলাম
তোমার শরীরে
একবার
শেষবার
বহুবার।

আমার মৃত্যু, তুমি, কবর
মাটি, লবণ, কবিতার বই
খিদে, স্বপ্ন এবং মাতৃগর্ভ
সব বেঁচে আছে।


তুমিও বেঁচে আছো
পৃথিবী বেঁচে আছে
বেঁচে আছি বন্ধু জীবাশ্ম হয়ে

আমার নিহত কোষ থেকেই আবার জন্ম নেবে
কোন শিশু, কোন নতুন কবিতা বা প্রিয় বকুল বাগান।

                        (c) Picture:ছবি

শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

সুলেমানপুরের আয়েশা খাতুন




    সুলেমানপুরের আয়েশা খাতুন, কিংবা আয়েশা খাতুনের সুলেমানপুর, দুটোই আমার কাছে অচেনা। কিন্তু কেন জানি এক নিবিড় টান অনুভব করি সুলেমানপুরের প্রতি আর ওইখানটার আয়েশা খাতুনের প্রতি। মাঝে মাঝে এমন লাগে যে ওই সুলেমানপুর আমার চিরচেনা একটা জায়গা আর আয়েশা খাতুন আমার রক্তের কেউ। এবার বলি নামটা জানি কিভাবে। হরফ প্রকাশনি আর আনন্দ পাবলিশার্সের বই সেই ছোটবেলা থেকেই দেখছি ঘর ভর্তি। ইসলামিক বই ছাড়া ও কিছু গল্প, ভ্রমন কাহিনি, আত্মজীবনী ধরনের প্রায় সবই ছিল হরফ প্রকাশনির আর দেশ, আনন্দমেলা, মিস না যাওয়া আনন্দমেলার পুজো সংখ্যা সহ বাকি পই পত্তর প্রায় ওই আনন্দ পাবলিশার্সের ছিল। আমার সীমিত বাল্য কৈশোরের মিশ্র নজরে ওই দুই পাবলিশার্সের ই ছিল এক চেটিয়া আধিপত্য আমাদের ঘরে। এছাড়া আরও কিছু সমগ্র মনে পড়ে গীতি বিতানের সম্পূর্ণ ভল্যুমের সাথে। সুকান্ত, শরৎ, হেমন্ত, সুভাষ সমগ্রের সাথে ওদের কবিতার বই, উপন্যাস ও ছিল যাদের পাবলিশার্স কে ছিল ঠিক মনে নেই। নবকল্লোল, কাকলি সহ আরও কিছু মোটা সাইজের ম্যাগাজিন ছিল যাদের দেখলে মনে হতো চল্লিশ ঊর্ধ্ব অভিনেত্রি, অতিরিক্ত মেদে নেতিয়ে পড়া শরীরে আগের সেই তেজ নেই তাই বাধ্য হয়ে শেলফের নিম্ন সারি থেকে দেখছে উত্তরসূরি আনন্দমেলার যৌবনোদ্দিপ্ত দাপট। আমার কিন্তু বেশ মায়া লাগতো ওদের প্রতি, তাই প্রায় ই ছুটির দিনে ওদের একটু সেবা যত্ন করতাম। এই যেমন ধুলো ঝেড়ে আবার ঠিকঠাক রাখা, ভেতরের ছোটো ছোটো বই পোকাদের পিষে মারা, আর ওদের তৈরি অসংখ্য বেক স্লেশ আর ফরওয়ার্ড স্লেশের মত য-ফলা গুলো দেখে দেখে একটু হারিয়ে যাওয়া। আরেকটা বিষয়ে ওই ম্যাগাজিন গুলোর প্রতি আমার একটা ভাব ছিল, সে হচ্ছে আশির দশকের বিজ্ঞাপনের স্টাইল টা দেখা, সুন্দর দু’লাইনের একটা ছড়া দিয়ে বিজ্ঞাপন গুলো থাকতো। যাইহোক, কথায় কথায় অনেক চলা, আসল কথাই হয়নি বলা।  সুলেমানপুরের আয়েশা খাতুন।

              সে একটা বই এর নাম ছিল। আব্দুল আজিজ আল-আমানের। একটা গ্রাম্য মাঠ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একটা মেয়ে। যদ্দুর মনে পড়ে বইয়ের প্রচ্ছদ টা ছিল এরকমই একটা ছবির। আমার আজ অব্ধি বইটা পড়া হয় নি, অনেকবার দেখেছি শেলফে বিভিন্ন বই খুঁজতে গিয়ে, কিন্তু কেন জানি পড়া হয়ে ওঠেনি এখনও। প্রবাস জীবনে যতবারই আমার ঘরের পড়ার ঘর টা নিয়ে ভেবেছি, শেলফের কোন বই কোথায় ছিল নিয়ে ভাবনায় ডুব মেরেছি, ততবারই ওই বইটার কথা মনে পড়েছে আর প্রতিবারই বলতাম এবার ঘরে গেলে বইটা নিয়ে আসব সঙ্গে করে। আর ওই ভাবনা-চিন্তা আর না আনার বিড়ম্বনায় কবে যে আমার মনে নিজস্ব এক সুলেমানপুর জন্ম নিয়েছে সে কথা টের ই পাই নি। আর তাই প্রায় ই সুলেমানপুর নিয়ে ভাবলেই চোখে ভেসে ওঠে সুলেমানপুরের ভোর, বৃষ্টি স্নাত শান্ত সাদা রঙ এর দুপুর, পড়ন্ত বিকেলের হেলান দেয়া রোদ আর ঝিঁঝিঁ পোকায় ডাকা সুলেমানপুরের রাত।

              আগের রাতের ঝড় তুফানের আছড় লাগা গ্রামের চুন দেয়া মসজিদের পুরনো দেয়াল, গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়া পথের পাশের গর্ত থেকে নাক ডাকানো বেঙের কোরাস আর কিছু বয়স্ক নিয়ে নামাজ শেষে ইমাম সাহেবের পুব আকাশে একমনে তাকানো কে সাক্ষী রেখে ধীরে ধীরে সূর্য যেন চলে এসেছে লক্ষ মাইল অতিক্রম করে এদের কাছে, পাখি গুলো যেন আবার জেগে উঠেছে এক নতুন আনন্দে, লাঙল হাল নিয়ে আবার চাষিরা মাঠে। সুলেমানপুরের সে এক নতুন স্নিগ্ধ ভোর।

               বেলা বাড়তেই আবার ও মেঘলার ঘোর, কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে যায় সুলেমানপুরের আকাশ। একধরনের ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে যাওয়া শেষ সকালে কোত্থেকে যেন একদল ছেলের দল জুটে যায়, ছোটো ছোটো গর্ত গুলোয় বাঁধ দিয়ে শুরু হয় জল সেঁচা, আর মাছ ধরার সময় প্রায় সবারই  রঙ এক হয়ে যাওয়া দলের একজন হয়ে উঠে রীতিমত হিরো। মাগুর, শিং আর কই মাছ ধরার তাঁর অকপট কৌশলে পাড়ে বসা পান মুখো ইঁচড়ে পাকা যুবাদের মুখে ফুটে বিশেষণের ফুলঝুরি।

              এক পশলা বৃষ্টিতে সুলেমানপুরের দুপুর আবার ও সবুজ হয়ে উঠে। ভেজা মাটি আর রৌদ্রের গন্ধে ম ম করছে গ্রামের মেঠো পথ। সদ্যোজাত বাছুরের উদ্দেশ্যহীন দৌড়ের পেছনে পেছনে ক্লান্ত শিশু মুচকি হেসে মুখ লুকোয় যখন দেখে তাকে কেউ লক্ষ্য করছে।

             সুলেমানপুর নিয়ে এরকম আরও কত কিছু মনে আসে প্রায়ই। কখনও ডুব দেই আবার কখন ও ভাবি এবার না হয় বইটা পড়েই ফেলব ঘরে গেলে। আমি আবার ও ঘরে গেলাম, দিন কাটালাম অলসের মত, কাজের কাজ কিছুই হল না, সোমবারে স্কুলে যাওয়ার মত মুখ করে আবার ও ফিরে এলাম। ভাবি থাক আমার সুলেমানপুর না পড়া, থাকুন আয়েশা খাতুন যেভাবে আছেন সে ভাবেই। আমি আমার প্রবাস জীবনে মাঝে মাঝেই ঘুরে আসব সুলেমানপুর। মুচকি হেসে আবার ও বুঝাব সুলামানপুরের কথা কৌতূহলী বউকে। আর কোন কিছুই বুঝে উঠতে না পারা বউয়ের প্রশ্ন বোধক মুখ কে এক পাশে রেখে আবার ও মেতে উঠবো সুলেমানপুরে।

১ সেপ্টেম্বর, ২০১২ (c) Picture: ছবি