“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ৩১ মার্চ, ২০১৫

মৃতের গল্প বলা


।।শৈলেন দাস।।
                                               মার বাইকের গতি যেখানে এসে বেড়ে যেত সেই রাস্তাটির নাম মহাসড়ক। জীবনের বাস্তবতা মেনে আমি যখন স্বপ্ন দেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম, কোন গল্প বা উপন্যাসের নায়কের মত নিজেকে ভাবার প্রবণতাও যখন কমে এসেছিল আমার মধ্যে ঠিক তখনই এই মহাপথের সূচনা। কর্মসূত্রে এই পথে রোজ আমার আসা যাওয়া। শিলচর-সৌরাষ্ট্র মহাসড়কের জিরো পয়েন্ট থেকে কলারতল মাত্র এক কিলোমিটার দূরত্ব এবং সময় দেড় মিনিট। এই অতিঅল্প পরিসরে আমার জীবনের এবড়ো খেবড়ো লেখচিত্র সরলরৈখিক হয়ে যেত নিজের থেকে। পুরনো স্বপ্ন দেখা শুরু হয়ে যেত নতুন করে। সামনের দিকে বড়াইলের দৃশ্য। তার বুক ছুঁয়ে মেঘেদের ভেসে বেড়ানো আমাকে মোহিত করত। মাঝে মাঝে এক দুই ঝাঁক পাখি যখন উড়ে যেত দূরের আকাশে তখন মন পুলকিত হত, ভাবনায় লাগত রোমান্টিকতারর ছোঁয়া। নিজের অজান্তেই অস্পষ্টে বলে ফেলতাম "হারিয়ে যেওনা ............ "
            তারপর একদিন নোটিশ এল। প্রয়াত হয়ে যাওয়া আমার পিতার নাগরিকত্ব নাকি সন্দেহজনক। সেই সূত্রে আমি ডি'ভোটার। শুরু হল আইনি লড়াই। বংশানুক্রমে আমার পূর্বজ-রা নিরক্ষর হলেও দুয়েকটি কাগজপত্র রেখেছিলেন খুব যত্ন করে। সেই কাগজ পেশ করলাম ট্রাইব্যুনাল কোর্টে। কিন্তু মহামান্য বিচারক গ্রাহ্য করলেন না সেই সব। আমার মত সেগুলিও নাকি সন্দেহজনক। অতএব অন্যকোন বিকল্প নথি পেশ করার হুকুম দিয়ে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করে আপাত রেহাই দিলেন আমাকে।
             এর কিছুদিন পর এল একটি ফর্ম। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এন.আর.সি.)-তে নাম তুলতে হলে অবশ্যই তা পূরণ করে দুমাসের মধ্যে জমা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট সরকারি কার্যালয়ে। সাথে দিতে হবে ষোলটি বিকল্প নথির মধ্যে যেকোন একটি। আমার চিন্তা বেড়ে গেল কয়েক গুণ। এদিকে ডি'ভোটার মামলার পরবর্তী শুনানির দিন বাকি আরও তিন মাস। এখন কি হবে?
            সেদিন আমি একটু বিমর্ষ ছিলাম। এন.আর.সি.-র ফর্ম পূরণ করে জমা দিয়ে এসেছি আগের দিন। আমার দেওয়া নথি দেখে সরকারি কর্তার ব্যাঙ্গোক্তি "শরণার্থী ক্যাম্পের ভূয়া বাঙালী এবার যাবে ডিটেনশন ক্যাম্পে"। সেইকথা ভাবতে ভাবতে আমি উত্তেজিত হয়ে খেই হারিয়ে ফেললাম। বাইকের বেগ কখন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকল বুঝে উঠার আগেই ছোট্ট একটি অঘটন.........।
            কলারতলের মোড়ের চা-দোকানী প্রায়ই গল্প করে কাস্টমারদের সাথে- "আমি ভিনদেশী নই~ আমি ভিনদেশী নই" বলতে বলতেই নাকি আমার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে এবং সন্ধ্যার পর মাঝে মাঝে সে নাকি আজও শুনতে পায় তার প্রতিধ্বনি।
                 মহাসড়কের মাঝ বরাবর আমি হেঁটে চলি বড়াইলের দিকে......

কোন মন্তব্য নেই: