“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ৮ জুন, ২০১৪

লখেতরা


(C)Image:ছবি
   (এই অসমিয়া গল্পের লেখক রবীন শর্মা । রবীন শর্মার  জন্ম ১৯৬০ । গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর । সহজাত জীবনযাপনের মতোই লোকাচার আর জনপদকে ঘিরে তাঁর গদ্যের নির্মাণ – বিনির্মাণ । ‘সং’ , ‘কথাভগীরথ’ সহ তিনটি গল্পগ্রন্থ ইতিমধ্যেই নজর কেড়েছে পাঠকের। বর্তমান গল্পটি অনুবাদ করেছেন     রণবীর পুরকায়স্থ । এটি ছেপে বেরিয়েছিল 'আরম্ভ' , জানুয়ারি ২০১৪ সংখ্যাতে।

        

          কদিন একটা বনপায়রা উড়ে এসে বসে লখেতরা নদীর পারে । দিনটি    ছিল শুক্রবার । নিস্তব্ধ দ্বিপ্রহর । গরুর পালকে নদীর ঘাটে জল খাইয়ে , চারণক্ষেত্রে ছেড়ে দিয়ে নাগকেশর গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিল এক রাখাল । পায়রাটিও এসে বসে তার কাছে । সর্ষেখেতের মতো সুগন্ধবহ সৌম্যকণ্ঠে সে শুধায় , ‘ কু কু কুউ... কু... বুকের মাঝে সারে সারে বেজেছিল তোমার বংশীধ্বনি , আজ কেন হে বাজে না কানে ?’

সামনের বালুচরে আটকে থাকা হাঁটুসমান জল , নিস্তরঙ্গ লখেতরা । নদীর মতোই নিস্তেজ নিরন্ন এই গোরক্ষক যুবকটিও । এক কুড়ি বসন্ত পেরিয়ে এসেছে সে , অথচ অনবরত অশ্রুসজল তার চোখ জোড়ায় জীবনের রিক্ততাই শুধু । এখানে সেখানে নানান রঙের কাপড়ে তালিমারা আলখাল্লার মতো পরিধেয়টিই যেন তার বহুমাত্রিক জীবনের রূপকথা । জন্মের একপক্ষ কালেই সে হারিয়েছিল মাতৃস্নেহের অমৃত । কৈশোরের স্বপ্ন প্রজাপতির রং মুছে গিয়েছিল পিতার মুখাগ্নিতে , লখেতরার পারে । আর বাসন্তী ? থাক, তার থেকেও বড়ো কথা দুনিয়াটাই তো ছলনা করেছে তার সঙ্গে , যখন আবিষ্কার করেছিল সে জন্মমূক , কণ্ঠস্বরহীন ।               
         পায়রার বকম বকমে সে বিমর্ষতা প্রকাশ করে । বলে, ‘এ এ অ... ডালের পাখি ডালেই থাক , বুঝবি নে তুই আমার বুক ভরা দুঃখ ।’

         বকুনি গেয়ে বারদুয়েক এদিক – ওদিক ঘুরে পায়রাটি আবার বলে, ‘ কু কু ... তুমিই বলেছিলে পশ্চিমা বাতাস বইলে আসবে , বাঁশির সুরে মালিনীর দেশে নেবে উড়িয়ে , ওহে মিষ্টি পাখি যাবে না ?’

          আত্মাভিমানের বেদনায় , ভাবাবেগে অস্পষ্ট স্বরে গোরক্ষক বলে, ‘ অ অ ... গেছে যে সময় থেকে এমন সময়...এত দীর্ঘ উপলব্যথিত যাত্রাপথ , জেএটিএনএওয়াই পেরিয়ে যাচ্ছি দিন, ভুলে গেলি , এনেছিলি সেদিন , তোর মধুঝরা কলকাকল ?’

          কপোতটির মন আর্দ্র হয় । দুঃখের বকবকমে বলে, ‘ কু কু ...আসছি রে ভাই তোমার কষ্টের প্রাঙ্গণভরা ক্রন্দন শুনতে ...।’

          রাগ হয় রাখাল যুবকের । হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়ে পায়রাটিকে তাড়িয়ে কুপিত স্বরে বলে, ‘ এ এ ... কার কথা শুনবে , তোমার এই একটুখানি বক্ষ কী সইতে পারবে...।’

         পায়রাটি গভীর নিশ্বাসে বলে, ‘ কু কু ... বাঁশিটা বাজাও ভাই , পথ কেটে জল দাও , তোমার দুঃখের দূর্বাবনে এনে দিই একটুকরো রোদ , তার থেকে না হয় দিও আমায় একটুখানি খুদ ...।’

          কাঠুরিয়ার কুড়ুলের আঘাতে দ্বিপ্রহরের গাম্ভীর্য দীর্ঘায়ত , নদীর দুই পারেও নিস্তব্ধতা । মাঝে মাঝে ঝাউ আর কাশের বনে বসন্তের শিস দিয়ে ডাকে কেউ । কিন্তু এত আয়োজন সত্ত্বেও বনসংগীতের সুবাসভরা পবনে বয় না কোনো ময়ূরপঙ্খী ।

            বিগত রাতের কথা । তাই বা কেন, তারও আগের কথা, আগের দিন কেন বলতে গেলে বিগত মাসটা, মাস কেন যদি বলি বছরের কথা, ভুল হবে না । লখেতরার পারে ছোটো ছোটো কয়েকখানি গ্রাম – কয়াজানি , রাজাবাড়ি , পানিচলা এসবেই হিরণ্যকশিপুর তাণ্ডব । দিন নেই রাত নেই , ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধরত সৈনিক নামছে । চারদিকে হরিণ – মারা ফাঁদ পেতে গ্রামের ছোটো ছোটো কুঁড়েঘরের বাচ্চা মেয়ে- পুরুষ সবাইকে টেনে বের করে । কিছু অচেনা মানুষের নাম নিয়ে বলে, ওরা এসেছিল ? ভাত খেয়েছিল এখানে, কার ঘরে ? এমন উদ্ভট প্রশ্ন । ভয়ে কম্পমান গ্রামবাসী স্পষ্ট উত্তর দিতে না পারলে লাথি মারে, বন্দুকের কুন্দা দিয়ে খুঁচিয়ে ...।

              দিনের বেলা শ্মশান হয়ে থাকে গ্রামগুলি । গোহালের গরু গোহালেই হাম্বা হাম্বা করে , তৃণভূমিতে নিয়ে যাওয়ার সাহস হয় না কারো । এমন সময় আবার ফিরে আসে কপোতটি । গোপাল যুবকটির কাছ থেকে সেই ভয়ানক রাতের বিভীষিকার কথা শুনতে । কী বলো , কম না কি রাখালটির মনোব্যথা, মনের কথা ---

           তার নাম মাধব । গ্রামের বয়স্কজনেরা ডাকে মাধা । খিকখিকিয়ে রং – তামাসায় বয়সিরা ডাকে বেভা । শিকনি – কাটা বাচ্চাকটাও তাকে ছাড়ে না , ভেংচি কেটে গায়--- এংকরি বেংকরি বেভা দাদায় বাঁশি বাজায় বাসন্তীর নামে , ভেংকরি । বলতে পারো , কে এই বাসন্তী ? বলব, তার আগে সংক্ষেপে বলে নিই শোকে দুঃখে কাটানো তার জরাজীর্ণ জীবনের দুটি কথা ।

        লখেতরার পারে ছোটো গ্রাম কয়াজানি । কুড়ি ঘর মানুষ , বাঁশ বেতের বেড়া দেওয়া কুড়িখানা কুঁড়েঘর । নুন- ভাতে একসময় এরা ছিল কৃষিজীবী । হাজোর মাধবমন্দিরের সেবাইত –এর খাসরায়ত । যদিও কালক্রমে আইন- আদালত এবং রায়তিস্বত্বের উপর কাঁকড়ার দাঁড়া চেপে বসায়, খেতের জমি থেকে উচ্ছেদ হতে হয় তাদের ।

           মাধবের বাপ হলধর , বংশানুক্রমে ছিল মন্দিরের দণ্ডধারী পাইক । সেই সুবাদে হলধর সেবাইতের হাতে পায়ে ধরায় , তাদের সম্প্রদায়ের কুড়ি ঘরকে , লখে তরার পারের কয়াজানিতে থাকার সুবিধা করে দেয় , সাতদলায় তাদের ভাগের জমির রায়তিস্বত্ব ছেড়ে দেওয়ার শর্তে টিপসইও একটা দিতে হয় ।

              কয়াজানিতে এদের বসত তো হল, খেতের জমি কই ? চারদিকে তো শুধু ঝিল আর বিলের শান্ত জল । যদিও বছরে দুবার করে লখেতরাও অশান্ত হয় । হলধরের বাপ তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ । সে সবাইকে ডেকে বলে কথায় আছে যার ভাত তার মাত , আজ থেকে আমরা মৎস্যজীবী হলাম , খাল বিলকে জীবীকা করে নিলাম ।

           সেই সূত্রে ওরা কেওট, মাছুয়া ।

            হলধরের বুকে একটা গভীর কান্না ছিল । তার ছেলেমেয়ে বাঁচে না । কোনোটা গর্ভাবস্থায় , কোনোটা একমাস , প্রতিবারই কলাপাতায় জড়িয়ে , বুকের ধন লখেতরায় বিসর্জন দেয় । বয়স্ক দু – একজন বলে মাধা গোঁসাইর শাপ লেগেছে । পিতৃপিতামহের বৃত্তি ছেড়ে দেওয়ার জন্যই এই বিপত্তি ।

          হলধরেরও কথাটায় প্রত্যয় হয় । সেই থেকে টানা তিন বছর সে মণিকূট – এর পূজা করে । চতুর্থ বছরে হয় ছেলে , এ তো মাধা – গোঁসাইয়েরই আশীর্বাদ । তাই তার নাম রাখা হয় মাধব , মাধা । এরপর জন্মের একপক্ষও হল না , সুতিকায় ভুগে , বাচ্চাটিকে তৃষ্ণার অমৃত থেকে বঞ্চিত করে তার মা । লখেতরার পারে চিতার আগুনে হলধরের সংসার ফুটো হয়ে যায় । এখন সদ্যক্রন্দনরত শিশুটিকেই বা কে কোলে তুলে নেয় ! একটা বন্দোবস্ত হয় । সন্তানসন্ততিহীন ঘরের প্রথম শিশুটিকে গ্রামের যে – কোনো দোকানি বৌকে বেচে দেওয়ার প্রথা তাদের । মাধবজন্মের তিনদিনের দিন তাদেরই সম্প্রদায়ের কণ্ঠিবাই – এর কাছে বেচে দেওয়া হয় , নামেই বিক্রি , প্রথারক্ষা । হলধর এই লোকাচারটি রক্ষা করেছিল ।

            যখন কণ্ঠিবাই-এর কথাই উঠল , ছোটো করে বলে রাখি অন্য একটি কথা । বাইও যেন জীবনযন্ত্রণার একটি মাকু । মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো টকটকে লাল সিঁদুরের ফোঁটা পরেও সে স্বামীহারা । সুবিধাই হয় , কেন , বলছি সে কথাই । তিনমাসের এক ফুটফুটে সোনামণি মেয়েকে ছেড়ে স্বামী তার মুকালমোয়ার এক মহিলার মাচান ভাগ করতে যাবে বলে বেরিয়েছিল । সেই নিয়ে দুজনের মধ্যে কিছুদিন ধরেই বিস্তর কথা কাটাকাটি , ঝগড়াঝাঁটি । সহ্যের সীমা বেড়া ভাঙতেই, একদিন বাই রণচণ্ডীরূপ ধারণ করে , মাছকাটার বঁটি নিয়ে তাড়া করে স্বামীকে । মরদটাও বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে কোনোমতে ভীত হরিণের মতো দৌড়োল , তারপরে আর গাঁয়ে দেখা যায়নি তাকে । এক কোপে এক কলার মোচা কেটে সেদিন কণ্ঠিবাই বলেছিল, ঢেমনা – পু ।

         হলধরের বিষণ্ণ তথা আদ্র হৃদয়ের অবস্থা দেখে কণ্ঠিবাইদেউর চোখ ছলছল করে  । দূর সম্পর্কের হলধরকে সে মিমি বলে ডাকে । সে মাধা গোঁসাইয়ের নাম নিয়ে হলধরকে বাচ্চাটি দেওয়ার জন্য হাত পাতে । বলে – আমার বাচ্চাটি যা খাবে সেও খাবে । কালিয়ে গোঁসাই যশোদার দুধ খেয়েছিল যেমন ।

           কণ্ঠিবাইয়ের প্রসারিত হাত দুখানি মাতৃত্বের শুভ্র ও বিশ্বস্ত আশ্রয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । হলধর অনুভব করে তার বিধ্বস্ত জীবনকে যেন নতুন করে মহিমান্বিত করতেই এই প্রসারণ । শিশুটিকে ক্রমাগত চুম্বন করে , থেকে থেকে অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে বাইয়ের হাতে তাকে তুলে দেয় । বলে, জেনো এ আমার  আত্মা , তোমার অমৃতে যদি একে বঁচিয়ে তুলতে পারো তবে  তোমাকে মা বলেই ডাকব ।

             এরপরের কথা বললে শোক আঘাত দেবে, না বললেও দোষ কম হবে না । কণ্ঠিবাইয়ের দেবোপম অমৃত বাঁচিয়ে দেয় দুটি প্রাণীকে । বাসন্তী আর মাধব । বাসন্তী নিজের , মাধব হলধরের । ধূলায় ধূসর সুপুরি পাতার গাড়ি টেনে , ওরা কণ্ঠিবাইয়ের ভাঙা কুঁড়ের হাসিকান্না হয়ে ওঠে । এর মধ্যে একদিন ধরা পড়ে, বাসন্তী যেমন বকবক করে কথার মধু ঝরাতে পারে মাধব পারে না । কিছু একটা বলতে চাইলে সে মুখ তো খোলে , গোটা শরীরের বল প্রয়োগ করার পর ‘এ এ’ বলে দুটো শব্দ বেরোয় ।

              তার মানে ? এও কী মাধা গোঁসাইয়ের লীলা নাকি? জড়িবুটি ঔষধপত্র ঝাঁড়ফুক সবকিছু করেও হলধর মাধবের মুখ থেকে একবারও পিতা শব্দ বের করতে না পারায়, তেমন বয়স না হলেও শোকের আঘাতে মানুষটি অকালেই বৃদ্ধ হয়ে যায় । তার উপর জীবিকার জন্যও তার মহাযুদ্ধ । খালবিলের চুনোমাছ কী আর ক্ষুধার ভাত জোগাতে পারে ? এজন্যেই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই মাছধরার বৃত্তি ছেড়ে অন্য উপায় ধরেছে । পাঁচ – ছয় ঘর  মানুষ এখনো জাল খলুই –এর উপর নির্ভরশীল । সেই ক-ঘরের ভাত তো নয় ভাতের মাড়ের উপরও আরম্ভ হয় অন্য এক আক্রমণ । সত্রের পুরোহিতরা হলধরের থাকার সুবিধা করে দেয় কিন্তু খালবিলের অধিকার দেয়নি । কালক্রমে সেসব আধাসরকারি আধাদালালদের কুক্ষিগত হয়ে যায় । তারা আবার বছরে দুবার বিলের ডাক দিয়ে মহলাদার মহাজনকে ডেকে নেয় । তখন ভাটির দেশের বিপুল সংখ্যক মাছুয়া দিয়ে দুতিন দিনের ভিতর বিলের সব মাছ চেঁছেপুঁছে উঠিয়ে নেয় । হলধরের জন্য থাকে শুধু পুঁটি খলসের পোনা । এই নিয়ে ভাটির দেশের মৎস্যজীবীদের সঙ্গে হলধরের নিত্যি খটাখটি । মহলাদার রাগে তাদের উপর । গড়গরিয়ে বলে, আমি এখানে হরতন চিরতন খেলতে আসিনি , দস্তুরমতো টাকা ঢেলে বিল কিনেছি , শোল, সিংগি যা আছে সব আমার । জাল পাততে দেব না , দেখি কার এত  সাহস , যা যা গিয়ে পেতে আয় দেখি।

            একদিনের কথা । সূর্য পাটে যাওয়ার পর , হলধর ফিরছিল হাট থেকে । লখেতরা পেরিয়ে বিলের পার ধরে আসতে আসতে হঠাৎ চোখে পড়ে কচুরিপানায় ভরা খালের জলে মাছের খলবলানি । ভালো করে চেয়ে দেখে দুটো প্রকাণ্ড বোয়াল মাছ । হঠাৎ করে তার মনটা বড়ো উদাস হয়ে যায় । একবার বোবা মাধবকে সে মেডিকেলে দেখিয়েছিল । ডাক্তার অনেক যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করে হলধরকে উপদেশ দিয়েছিল বাইরের কোনো ভালো কণ্ঠ বিশেষজ্ঞকে দিয়ে দেখাতে । ডাক্তারের মতে টাকা জোগাড় করতে পারলে, তার কথা বলার সম্ভাবনা পুরো মাত্রায় আছে ।

             মাছ দুটোই হলধরের মনকে আশা আর উত্তেজনায় ভরিয়ে দেয় । সেই মুহূর্তে সে সবকিছু মনচাপা দিয়ে ঘরমুখো হয় । রাতদুপুরেই আসতে হবে , যেতে যেতে সে মনস্থির করে, মহলাদারের লোকজন রাতে পাহারা দেয় , ওদের লুকিয়েই আসতে হবে । এভাবে সর্বক্ষণ সে মাধা গোঁসাইয়ের নাম নিতে থাকে – প্রভু , মাছকটা যেন বেরিয়ে না যায় ।

         আষাঢ় মাস । সন্ধেবেলা থেকেই আকাশের মনভার । রাতেই শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড়--কথার শব্দ যায় না শোনা এমন খরবায়ু , গগন ব্যেপে মহামেঘের আন্দোলন । বিজুলি চমকে ক্ষণে ক্ষণে , লাগে ঝিকিমিকি আসি চোখের পলকে ... ।গাছপালা , দুঃখী মানুষের ভাঙা কুঁড়েঘর ভাঙচুর করে ঝড় শান্ত হয় যখন প্রভাত পাখির ডাক শোনা যায় । রক্তগোলা সূর্যও তখন মুখ তুলে তাকিয়েছে ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত গ্রামগুলির দিকে ।

           সেই সকালেই গ্রামের মানুষ খালের পারে আবিষ্কার করে হলধরকে , বুকে পিঠে অনেক জায়গায় বল্লমের ঘা । রাতের বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে রক্তের দাগ । তার ডান হাতের মুঠোয় ধরা দাখানিতে রোদ পড়ে ঝিকমিক করছিল শুধু । সত্যমিথ্যা জানি না, সেই সকালেই নাকি মাধবের মুখে প্রথমবারের মতো কথা ফুটেছিল । পি-পি-তা...পি-পি-তা । তারপর আর কোনোদিনই শোনা যায় নি । হয়ত লখেতরার ঢেউ –এ লখিন্দরের ভেলাখানি ভেসে যাওয়ার মতো তারও হৃদয়চাপা কান্নাগুলি , স্নেহের পিতা শব্দের সঙ্গে চিরদিনের জন্য চলে যায় । আর ফিরে আসে না ।

           এখন যদি বাসন্তীর কথা শুনতে চাও, তাহলে বলছি এই বেলা ---

           পিতার মৃত্যুর পর  জ্যাঠা এসে মাধবকে কণ্ঠিবাই দেউর কাছ থেকে নিয়ে যায়, বলে –আমার ওখানেই খার – পান্তা খাবে , বাড়ির কাঠকুটো , গরুছাগল দেখবে ।

            তার কথায় কণ্ঠিবাই মৃত্যুসম আঘাত পায় । বলে—আমি কী ওকে শুধু দুমুঠো খাইয়েছি মাত্র ? সে আমার কলজের একদিক হে, বাসন্তী যা সেও তা ।     জ্যাঠা বলে , তুমি দুঃখ কোরো না , হলধরের বংশে তেতো লাউ জাতে না জন্মায় তার জন্যেই নিতে এসেছি ... আর মাধা গোঁসাইও তো দৈবকীর কাছে এসেছিলেন , তা বলে কি যশোদা তার মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছিল ?

           পানের পুঁটলি বেঁধে কন্যা বিদায়ের মতো, কণ্ঠিবাই সেদিন মাধবকে জ্যাঠার হাতে তুলে দিয়েছিল । বলেছিল --- আজ থেকে আমার ঘর অন্ধকার ... যা বাপু যা নিজের ঘরে যা ...। দুয়ারের কোণে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল বাসন্তী । তাকে দেখে  বৃদ্ধ জ্যাঠারও দুগালের দুধারে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে । বলে, একটাই গ্রাম , একই মাঠ , একই নদীর ঘাট , আসা যাওয়া তো লেগেই থাকবে ...।

            থাকেও তাই । জীবিকার প্রয়োজনে কণ্ঠিবাই দিনের বেলা যায় দূরের হাটে , মাছের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ায় গ্রাম থেকে গ্রামে । তার মধ্যেই মাধবকে বলে যায় স্নেহের দুকথা , কখনো হাটের বিস্কুট, আর কখনো – বা বাসন্তীর হাত দিয়ে পাঠায় তার প্রিয় ব্যঞ্জন মাছের টকঝোল ।

           মাধব তো শুধু কথা বলতে পারে না , দেখা – শোনায় , স্বভাব – চরিত্রে সে অতি অমায়িক । কোঁকরা চুলের মুখখানিতে সর্বদা লেগে থাকে মধুময় এক অনির্বচনীয় হাসি । গ্রামবাসীর যে –কোনো প্রয়োজনে , যে –কোনো কাজে , পারুক না পারুক সে এগিয়ে যায় । গ্রামের মানুষও খুশি হয়ে তাকে কেউ দেয় গেঞ্জি নিমাগামছা , কেউ দেয় পুরোনো ছেঁড়া কোটজামা ।

           বাসন্তী তাকে দেয় সবচেয়ে প্রিয় বস্তু, একটি বাঁশি । রামদিয়ার মেলা থেকে কিনে আনে । নিজের জন্যও কেনে রংবেরং – এর কাচের চুড়ি । সে আজকাল মেখলা চাদর পরে । মা- ও খড়কুটো জড়ো করার মতো করে এনে দেয় গন্ধতেল , লাক্স সাবান , একজোড়ো , আয়না চিরুনি আর বাড়ির কোণে বানিয়ে দেয় সুপুরি পাতার বেড়া দেওয়া চানঘর ।

           বাঁশিটা পেয়ে সেদিন মাধব যেন এক ছেলেমানুষ । বাঁশির ফুঁ শব্দে সে ফিরে পায় তার কণ্ঠের ভাষা ।

ওদিকে মেলা থেকে ঘরে ফিরে বাসন্তীর অন্য বিপত্তি । বেছে বেছে সযত্নে কেনা চুড়িগুলি যে হাতে ঢোকে না । জোর করে ঢোকাতে গিয়ে দুখানা ভাঙে । মাকে বুঝ দিয়ে বলে, হাতে সাবান মেখে তবেই কাচের চুড়ি পরতে হয় , নইলে ভাঙে । পরদিন লখেতরার পারে বাঁশিতে ফুঁ লাগিয়ে ছাগলের পালের মাঝখানে বসেছিল মাধব । বাসন্তীও  উপস্থিত । বলে, ও মাধ, আমি হাতে সাবান ঘষছি , তুই আমার হাতে চুড়ি কটা পরিয়ে দে তো । এই বলে নদীর জলে হাত ডুবিয়ে , হাতে সাবান ঘষে , চুড়ি কটা মাধবের দিকে এগিয়ে দেয় । মাধবও ধরে পরাবে বলে চুড়িখানা নিতেই , হঠাৎ কী হল কীজানি , তার বুকের ভিতর বৈশাখ মাসের আকাশের মতো গনগনে হয়ে ওঠে । গোটা শরীরে কাঁপুনি তুলে এক বিদ্যুৎ চমক শিরশিরিয়ে যায় ।

            সে বাসন্তীর মুখে তাকাতেই মনে হয় , যেন সিঁদুরে পুঁটিমাছের মতো ঝলমল করছে ।

             চুড়িগুলিও পিছলে বাসন্তীর হাতে ঢুকে যায় । তার বাঁশিতে বিবাহগীতির সুর যেন উলু দিয়ে ওঠে --- ধান পাকে অঘ্রাণে, কোকিল ডাকে ফাগুনে --- সখি হে ... ।

         নতুন জলের ঢেউ খেলছে লখেতরায় । শ্রাবণে সে গর্ভবতী হবে । ফেনায় ফেনায় ঢল নেমেছে , দুকুলপ্লাবী বর্ষার রণচণ্ডী ।

        শোনো বলছি, এবার সেই রাতের কাহিনি ।

         কণ্ঠিবাই রাতের ভাত বেড়েছে । এমন সময় দরজায় কে যেন ডাকে, মাগো দরজাটা খোলো । অচেনা কণ্ঠস্বর । কণ্ঠিবাই আর বাসন্তীর বুক মোচড় দিয়ে ওঠে । সাহসে বুক বেঁধে বাই অর্ধমৃতের মতো বলে, কে ?

            মা আমি, দরজাটা খোলো । উত্তর আসে ।

            বাসন্তীও ভয় পায় । মায়ের হাত চেপে ধরে । বাই লম্ফটা উঠিয়ে দরজায় হুড়কো খুলে সামান্য ফাঁক করে দেখে ---একজন অচেনা সুঠামদেহী যুবক ।বাপু, তুমি কে? বাই বলে । দেখ আমাকে ভিতরে যেতে দাও, বলছি--- যুবকটি সামান্য ঠেলেই ভিতরে ঢুকে এবং দরজা বন্ধ করে দেয় । বাই দেউর হাতের লম্ফটি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয় । বাই আর বাসন্তী ভয়ে কাতর হয়ে অন্ধকার একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ।

             যুবকটি বলে, মা ভয় পেয়ো না , তোমার ভালোর জন্যই আমি আলো নিভিয়েছি । পুলিশ আমায় খুঁজছে । আজ তিনদিন কিছু খাইনি , এক গ্রাস ভাত দেবে মা, কথা দিচ্ছি ভাতটুকু খেয়েই আমি চলে যাব । যুবকটি প্রায় এক নিশ্বাসে কথাকটি বলে।

        বাইদেউর তখন মনে পড়ে গ্রামে মাছ নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে যে কথাগুলি সে শুনছে সব মিথ্যা নয় । কিন্তু লম্ফ না জ্বালালে তোমাকে ভাত বেড়ে দেব কী করে ? বাই আগের ভয় কাটিয়ে যুবকটিকে বলে ।

           না মা, যুবকটি বাধা দিয়ে বলে, তোমার ভালোর জন্যই লম্ফ জ্বালাতে দিচ্ছি না , যদি পারো অন্ধকারেই হাঁড়ি থেকে যা আছে তুলে দাও দুমুঠো ।

            নিরুপায় মায়ে ঝিয়ে অনুমানে নিজের বাড়া ভাতের থালা থেকে একখানা এনে যুবকের হাতে দেয় । বাই বলে, দেখ বাবা আমরা কিন্তু ডোম চাঁড়াল মানুষ  ।

            বড়ো তৃপ্তির সঙ্গে ভাতের দলা মুখেদিয়ে যুবকটি বলে, মায়ের কোনো জাত থাকে ? এসব পুরোনো চিন্তাধারা দূর করতেই আমরা নিজের মাকে ছেড়ে সব মাকে মাতৃজ্ঞান করছি ।

            অন্ধকারে যুবকটির ভাত খাওয়ার শব্দ বাইয়ের বুকে বাজে , আদ্র হয় মন । বাই ভাবে কার জানি আদরের ধন, কার হাতে অন্ধকারে খাচ্ছে ভাত, দেশে এ – কোন অপদেবতার ভর হল যে পেটের ছেলেও নিজের মাকে মা ডাকতে পারে না । ছেলেটির ভাত খাওয়া শেষ হয় । বাসন্তী হাতে জলের ঘটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । মায়ের হাতে দিতেই মা আঁধারের মধ্যে ঘটিটি যুবকের দিকে এগিয়ে দেয় ।

           ঢকঢক করে জলপান করে সে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় । মা, আজ তোমার ভাতের গরাসটি আমাকে শতায়ু করে দিল । যদি বেঁচে থাকি একদিন আলোকে আসব । এই বলে অন্ধকারেই বাই দেউর চরণ ছুঁয়ে প্রণাম করে সে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ।

           বিস্ময় বিমুড় হয়ে বাই শুধু মনে মনে বলে, বাবারে , তোকে মাধা গোঁসাই রক্ষা করুন ।

             সেই রাতের কথা বলছি, যে – রাতে শিয়াল – কুকুরের তীক্ষ্ণ চিৎকার কণ্ঠিবাই আর বাসন্তীর ঘুম কেড়ে নিয়েছিল । বাতাসের এক তীব্র আন্দোলনের মতো ঘটনাটি তাদের মনে এমন এক ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল, যেন সে – রাতেই লখেতরার পার ভাঙবে ।

          তখনই গ্রামের অন্যদিক থেকে কেউ এক ঘরের চালার উপর উঠে চিৎকার করে জানায় , অজ্যাঠা মিলিটারি ... ওঠো ... ডিমুহু ওঠো... ।

         হঠাৎ অন্ধকার  আকাশকে নস্যাৎ করে ফুটে উঠেছিল অনেক গুলি, গুলির শব্দ।

           ঠকঠক করে কাঁপছিল মাধা । সেই মুহূর্তে শিশুর ক্রন্দন, নারীপুরুষের আর্তচিৎকারে গ্রামখানি যেন সৃষ্টি ধ্বংসের কালরাত্রির মুখোমুখি ।

          লখেতরার পাড় ভাঙার শব্দের থেকেও ভয়ানক । ঝড়ের গর্জনের থেকেও গগনভেদী সে – রাতেও আর্তনাদ ...।

          কুঁড়েঘরের চালে টুপটাপ করে পড়তে থাকা বৃষ্টি – ফোঁটাগুলির মতো গ্রামবাসীর নিঃশব্দ রাতও একটু একটু করে শেষ হয় ।

       কিন্তু কার জন্য এই ভোর ? একজন যুবতি, একজন নারী , একজন মায়ের রূপেই তাঁকে তুমি মহিয়সী করো না কেন , বিশাল এই রাজনীতিশাস্ত্র বাসন্তীকে কোনরূপে বন্দিত করবে, গরিয়সী করবে ? সভ্যতার শত আঁচড়ে ধর্ষিতা বাসন্তীকে ? সেই সকালে বাসন্তীকে চিতার আগুনে জ্বলে লখেতরার পাড়ে । রাগ ক্ষোভ , জীবনের চিরবিচিত্র অশ্রুজ্বলে স্নান করে মাধব সেদিন হাতের বাঁশিটা লখেতরার জলে ছুঁড়ে ফেলে । ঢেউ –এর উপর উঠে বাঁশিটাও যেন সেদিন গেয়ে ওঠে ঃ

স্নেহময়ী মা আমার , আমায় রেখো
জীবন দিয়ে পূজিব তোমায় সারাটা জীবন
স্নেহময় মাধা আমার, আমায় রেখো
কত স্বপ্ন বুকে আছে তোমার সঙ্গে
সেই গ্রামখানিতে রেখো আমায়
কন্যা করে বধূ করে ...
তখন সজল কবুতরটি দুঃখের করুণ সুরে ডাকে, কু কু কু কুউ- কু । লখেতরার অন্যপার থেকে কণ্ঠিবাই ডাক পাঠায় --- এই মাধা , বাবারে ফিরে আয়  , সন্ধ্যা হল ।

  

                       

কোন মন্তব্য নেই: