“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ১১ জুন, ২০১৪

মালবিকা, আমার হাত ধর...

(C)Image:ছবি


















মালবিকা? তুই?
কতদিন পরে দেখা হল বল্‌তো?
কেমন আছিস্‌?
চিনতে পারছিস্‌?
আমি কিন্তু তোকে দূর থেকে দেখেই চিনেছি
যদিও তুই বেশ কিছুটা মোটা হতে গিয়েছিস্‌
আর ফর্সাও...
কিন্তু অমন সুন্দর চুলগুলো
কেটে উঠিয়েছিস্‌ কেন কানের ওপর?
এ বুঝি তোর ছেলে?
বাহ...ভারি মিষ্টি..অবিকল তোর মত
আর এই যে...এ আমার মেয়ে
সবাই বলে ওর বাবার মত দেখতে...
ভারি দুষ্টু , জানিস্‌ তো!
ওমা, তুই চুপ করে আছিস্‌ যে?
এখনও চিনতে পারছিস্‌ না?
তোর মনে নেই...
অনামিকা আর মালবিকা...
সেই প্রথমদিন থেকে
স্কুলের বেঞ্চে পাশাপাশি বসা?
একজন ছটফটে , অন্যজন শান্ত
একজন শাম্‌লা,অন্যজন ফর্সা
আমি ভাল গান গাইতাম,
তুই ছবি আঁকতি...
আমি ছুট্‌ ছুট্‌ দৌড়তাম
তুই জোরে জোরে হাস্‌তি
আমি কবিতা বলতাম জোর গলায়
আর তুই মালবিকা
সূঁচ- সুতোর নকশায়
ফুটিয়ে তুল্‌তি রঙিন কবিতা
কি সুন্দর...কি স্বপ্নময়...
আর কি ভাল নাচতি রে তুই
সবাই মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতো
আর সেই সব সময়,
 
মিথ্যে বলব না মালবিকা
সবচেয়ে ভালো বন্ধু হলেও
একটু একটু হিংসে হত তোর ওপর
মালবিকা, তোর মনে আছে...
সেই স্কুলবেলায়, যত আড়ি তত ভাব
সেই বালিকাবেলায়, কত হাসি, কত খুশি...
সেই টিফিনের আচার-ঘুগনির কত লঙ্কাভাগ!
সেই অংক- বিজ্ঞানের খাতায়
হাড্ডাহাড্ডি লড়াই
কখনো তুই আগে তো কখনো আমি
বার্ষিক পরীক্ষার ফলে প্রথম দুটো জায়গা
যেন তোর আর আমার কেনা জায়গীর...।
মালবিকা...জানিস...
এখন আর আমি গান গাই না
কবিতাও বলি না
আমার মেয়ের বাবা পছন্দ করেন না
অবশ্য আমি বিদ্রোহ করতে পারি
স্বাধীনভাবে আকাশে উড়তে পারার মত
ক্ষমতা আছে আমার ডানায়
কিন্তু প্রিয়তম মানুষটির অবহেলা
আমাকে কেমন যেন নির্জীব করে দেয়
আমার চেষ্টাগুলো ইচ্ছেহীন হয়ে পড়ে
আর তারপর...হারিয়ে যায়...
এখন আমি শুধু কথা বলি
অর্থহীন, অন্তহীন , অনর্গল শুধু কথা
দম দেওয়া পুতুলের মত
চাবি ঘোরালেই কথা
চাবি ঘোরালেই...শেষ।
এই দেখ, 
তখন থেকে কেবল একা একাই বকে চলেছি
তুই চুপ করে আছিস কেন?
এখনও অচেনার বিভ্রম?
এই ছেলে, তোমার মা কথা বলছে না কেন?
কি? কি বল্‌লে?
মালবিকা আর কথা বলে না!
কানেও শোনে না!
কেন? কেন?
কি হয়েছে ওর?
এখানে কেন এসেছ তোমরা?
ডাক্তারের কাছে?
মাকে দেখাবে?
মালবিকা...তুই একবার আমার দিকে
আমার চোখের দিকে তাকা
তোর স্থির হয়ে যাওয়া অক্ষিগোলকে
আমি খুঁজে নিতে চাই সেই অসুখকে
যা কেড়ে নিয়েছে তোর নাচ,আমার গান
আর আমাদের দুজনের মুখর প্রাণ!!
মালবিকা আমার হাত ধর্‌
তুই ডাক্তারের কাছে যাস্‌ না
তার চেয়ে চল্‌
একছুটে যাই
সেই চৌকোণা সাদা দেয়ালে
কালো বোর্ড লাগানো ক্লাসঘরটিতে
সেখানে জানালার শিকে মাথা রেখে
চল্‌ দাঁড়াই আর একবার
আর হঠাৎ কোন বর্ষাদিনে এক
যখন দরজার বাইরে মাঠের ওপারে
আকাশে ঘনশ্যাম মেঘ ধরবে
বাদলা হাওয়ায় আন্‌মনা উড়বে
ইতিহাসের খোলা পাতা
সেইসঙ্গে তোর- আমার মন
সমস্ত ক্লাসঘর জুড়ে
মৃদু কলরব আর অস্পষ্ট চঞ্চলতা
ইতিহাসের দিদিমণি রিন্‌রিনে গলায়
চিৎকার করে বলবেন
মেয়েরা, পড়ায় মন দাও
ঠিক তক্ষুনি
মেঘের মাদল বাজিয়ে
ঝম্‌ঝম্‌ বাদল নামবে অঝোরে
দিদিমণি মিষ্টি হেসে বলবেন
আজ পড়া থাক
অনামিকা, একটা গান গাও
আমি গাইব...হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে...
আর তুই মালবিকা
ময়ূরের মত পেখম তুলে তুলে
নাচবি ...নাচবি...
বৃষ্টির সঙ্গতে ক্লাসঘরের সেই জলসা
তুই বিশ্বাস কর মালবিকা
আমাদের সব অসুখ সারিয়ে দেবে
মালবিকা, আমার হাত ধর্‌
আমার হাত ধর...মালবিকা...

কোন মন্তব্য নেই: