(C)Image: ছবি |
“অপুদা, তোমাকে একটা গ্রুপে জয়েন করার জন্য রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছি, পারলে একবার দেখ”। আমার থাকা তখন বাঙ্গালোরে আর সময়টা সম্ভবত দুই হাজার দশ সালের মাঝামাঝি। আমি “ঠিক আছে” বলে ফোন টা রেখে দেই। ফেসবুকের জগতে আমার বয়স তখন দেড় কি দুই হবে আর ইহ জগতের বয়স নাই বা বললাম। যাই হোক টানা পাঁচদিনের কর্ম ব্যস্ততার পর উইকেন্ডের এক বিরাট অংশ থাকত ফেসবুকের নামে। উইক ডেজ গুলোতে যে থাকত না এমন না, খুবই কম আর তাই সপ্তাহের ওই ছুটির দুদিন যেন একেবারে ওয়কফ থাকত ফেসবুকের জন্য।
“বন্ধু, এ সোসিও লিটারারি গ্রুপ”, জাহিরের পাঠানো গ্রুপটার নাম দেখে বেশ ভালই লাগলো। অনেক ধরণের গ্রুপের ছড়াছড়ি তখন ফেসবুকে, তাই জাহিরের সেদিনের ফোনে আমার তখন ততটা উৎফুল্লতা আসেনি যতটা ভাল লেগেছিল গ্রুপ টা দেখে। বেশ ছিমছাম ছোট্ট একটা গ্রুপ, আমায় নিয়ে বোধহয় গ্রুপের সদস্য সংখ্যা পাঁচ কি ছয় হবে। সবাই কবিতা লেখে, গল্প করে আর মোটামুটি সবই শিলচরের। একটা মুচকি হাসি ছাড়া আর কোন কার্পণ্য করিনি বন্ধুতে যোগ দিতে। আর সেই শুরু এক স্বপ্নের পথ চলা। বিদেশ বিভূঁইয়ের এক ঘেয়েমি জীবনে “বন্ধু” কখনও তরমুজের লাল ডগা তো কখনও গরম গরম ভাজ্জি, পকোড়া। শতদল দা (শতদল আচারজী), গৌরব (গৌরব চক্রবর্তী), চন্দ্রানি (চন্দ্রানি পুরকায়স্থ), অয়িঋদ্ধি (অয়িঋদ্ধি ভট্টাচার্য), জাহির (জাহির জাকারিয়া) আর ধীরে ধীরে আসা নতুন কিছু বন্ধু নিয়ে সে এক জমজমাট আড্ডা। প্রায় রোববারে বসত কিছু বিশেষ আড্ডা, কখনও ছড়ার, তো কখনও কবিতার, আর মাঝে মাঝে গল্পের। “আগামী রোববার সকাল দশটা থেকে ছড়ার আড্ডা থাকলে কেমন হয় বন্ধুরা?”, গৌরবের এমন উদ্যোগমূলক স্ট্যাটাসে সবাই বুঝে যেত যে এক জমজমাট আড্ডায় আসছে রোববার হবে পার। আর যে যার জায়গা থেকে নানান কমেন্ট আর লাইক দিয়ে যে সেদিনই এক আড্ডার সূচনা করে দিত তাঁর খেয়াল হয়ত হতো কিছুটা পরে। আমি দশটার ট্রেন ধরব বলে দুদিন আগে থেকেই মনে মনে প্রস্তুত থাকতাম, আর আড্ডার দিন নির্ঘাত মিস হতো আমার রাইট টাইমের ট্রেন। এক ঘণ্টা পরে যখন আমি আড্ডায় যোগ দিতাম, তখন দেখতাম ট্রেন তাঁর নির্দিষ্ট প্যাসেঞ্জার নিয়ে মোটামুটি গতিতে এগিয়ে চলছে। দেরীতে আসার একটা অনুনয় সূচক ছড়া দিয়ে যখন ট্রেনে চাপতাম তখন আড্ডার গতি টা হঠাত ই দিক পরিবর্তন করে আমাকে কেন্দ্র করে নিত। আর আমি এই ফাঁকে এ অব্ধি আসা সফরের মোটামুটি গ্যান নিয়ে নিতাম। তারপর আর আমাদের থামায় কে? একের পর এক ছড়া, টিপ্পনী আর কিছু অকৃত্রিম অদ্ভুত ভালোলাগা মিশ্রিত হরেক রকমের মিষ্টি মুচকি হাসিতে দুপুর গড়িয়ে কখন যে শেষ বিকেলে পৌঁছুত আমাদের আড্ডার ট্রেন টেরই পাওয়া যেত না।
আমাদের এরকম অনেক আড্ডার এক মধ্যমণি ছিল যার লেখালেখি থেকে বেশি আগ্রহ ছিল আমাদের লিখা ছড়া, কবিতা গুলো পড়ার আর আমাদের উৎসাহ বাড়িয়ে দেবার। সে নিজে লিখতনা ঠিকই কিন্তু আমাদের লেখালেখিতে আপাদমস্তক নজর থাকত তাঁর। আমার ছড়াগুলোর প্রতি তাঁর একটা আলাদা ভাব ছিল। প্রায়ই আমার ছড়ার তারিফ করত ফেসবুক মেসেঞ্জারে। মাঝে মাঝে আড্ডায় ওকে না পাওয়া গেলে আমরা সবাই বলাবলি করতাম ওর কথা। পরে সে নিজেই জানান দিত তাঁর অনুপস্থিতির কারণ। কখনও ইউনিভার্সিটির কোন এসাইন্মেন্ট নিয়ে ব্যস্ত তো কখনও দুপুর বেলায় মায়ের সাথে আলুর দম নিয়ে। খাবার দাবার নিয়ে আমাদের মাঝে প্রায়ই বেশ গম্ভির আলোচনা হতো। আমি রোববারের দুপুরের মাসিমার হাতের রান্না আর নানান ব্যঞ্জন শুনে সুদুর বাঙ্গালোর থেকে জিভে জল আসার কথা বলতে ও বলত শিলচর এলে একবার ওদের ঘর ঘুরে যেতে। আমি মাঝে মাঝে আপনি বলে সম্ভোদন করলে ও বিরক্ত হয়ে বলত, “দাদা, তুমি আমাকে “তুমি” বলেই ডাকবে”। এভাবেই বেশ একটা মিষ্টি সম্পর্ক ছিল আমাদের মাঝে। ও ছড়া ভালোবাসতো তাই মাঝে মাঝে আমি ছন্দে ওর সাথে কথা বলতাম, যখন ছন্দালাপ দীর্ঘ হয়ে যেত তখন ও বলত, “দাদা, আর পারছিনে”, আমি তখন অনেক কষ্ট করে আমার ছন্দের ভেলায় ব্রেক কষতাম। দেখতে দেখতে বন্ধুতে আমার বয়স বছরে গড়ালো, “বন্ধু” আর বন্ধুর এ’কজন বন্ধু হয়ে ওঠলো আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ফেসবুকে লগিন করেই বন্ধুর পেজে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধুতে বন্ধুদেরে নিয়ে। এ যেন এক মায়াপুরি, কিছুতেই বেরিয়ে আসতে চাইতো না মন। অফিসে গেলেও মন লেগে থাকত বন্ধুতে। বাঙ্গালোরের দিন গুলো এভাবেই কাটতে থাকলো।
তারপর এক মার্চের দুপুর নিয়ে এলো আমার জীবনের এক অবিশ্বাস্য দুঃখের সংবাদ। আমার একমাত্র বোনের মৃত্যুর খবরটা মুহূর্তের মধ্যে এলোমেলো করে দিল আমাদের জীবনটাকে। ফ্লাইট মিস করে শেষবারের মত একবার দেখতে ও পারিনি বোনটাকে। পরের দিন সন্ধায় যখন বাড়ি পৌঁছই ঘর ভর্তি আত্মীয়ের সমাগম আর তারই মাঝে আমার মা ড্যাব ড্যাব চোখে উপরের দিকে তাকিয়ে আছেন। সপ্তা দুয়েক পরে কাজের উদ্দেশে আবার বাঙ্গালোর পাড়ি দিতে হল। সবকিছু কেমন অবিশ্বাস্য লাগছিলো। অফিসে প্রায়ই কান্না আসতো, একা একা কাঁদতাম। কলিগ রা দেখে সান্ত্বনা দিতে আসতো। ঘরে ফিরে বন্ধুতে ডুবার চেষ্টা করতাম, কিন্তু সেখানেও বার বার বোনের কথা মনে পড়তো। ফেসবুকের বন্ধুদের সেই অ-কবি মধ্যমণি আমার দুঃখের সংবাদ টা শুনে সেদিন ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলো। সে ও ছিল দু ভাইয়ের মাঝের বোন। আমাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই অশান্ত হয়ে পড়তো, আমার মায়ের কথা চিন্তা করতো, তিনি কি করছেন। তাঁর কি হবে এসব। ধীরে ধীরে সময় গড়াতে থাকলো, আমার বাঙ্গালোরের জীবনে ইতি টেনে আমি এক নূতন শহরে, নূতন এক কোম্পানিতে। কোম্পানির গেস্ট হাউসে হপ্তা খানেক থেকে বের হলাম ঘর খুঁজতে। আর ছ বছরে এই প্রথম আবিষ্কার করলাম পৃথিবীটা কত গরম হতে পারে আর তাঁর থেকে কত চরম হতে পারে এমন গরমে থাকার জন্য একটা ঘর বের করা। যাইহোক মাদ্রাজে শেষ পর্যন্ত একটা ঘর জোগাড় হল আমার। নতুন শহর, নতুন ঘর, নতুন ভাষা, সবকিছুই নতুন। আর এই নতুনের ভিড়ে বারবারই পুরনোদের কথা মনে আসতো। মাদ্রাজে প্রায় মাসদিন পর ইন্টারনেট কানেকশনের ব্যবস্থা হল আর লগিন করেই সোজা বন্ধুতে আর গিয়েই আমার সেই আড্ডার মধ্যমণি। ওকে পেয়ে সেদিন কি খুশি। প্রান খুলে কথা হল ওর সাথে। মাদ্রাজে গিয়ে এই প্রথম যেন একটা সস্থির শ্বাস ফেললাম। ধীরে ধীরে আবার সব বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ হল। জীবনটা ধীরে ধীরে সহজ হতে লাগলো।
তারপর অনেক গল্প আমার জীবনে, সে না হয় আরেকদিন বলা হবে। সেদিন আবার ও হঠাত করে জাহিরের ফোন। আমার থাকা তখন করিমগঞ্জে। “অপুদা, একটা দুঃখের সংবাদ দিতে তোমাকে ফোন করেছি, অয়িঋদ্ধি দি আমাদের মাঝে আর নেই”। আমি নির্বাক কিছুক্ষণ থেকে জাহিরের কাছে শুনতে পেলাম ওর রোগের কথা। বাড়ি ফিরে মাকে বললাম। আর মা সারাটা দিন বার বার ভাবছিল ওর মায়ের কথা, ওর ঘরের প্রতিটি কোনে ওর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কথা, ঘরময় মা’র মেয়ের লেগে থাকার কথা। মায়েরা এমনই হয়, ওদের কলেজা রক্তাক্ত হয় এমন ঘটনায়। আর আমার মত ভায়েরা দিশেহারা হয় এমন বোনের বিচ্ছেদে।
পৃথিবীতে এমন শত শত ঘটনা আকসারই হচ্ছে, কিন্তু এমন কষ্ট বঝে শুধু তাঁরাই যাদের সাথে এমন হয়। আফসোস আমরা যদি বুঝতাম বা বুঝার চেষ্টা করতাম যে আমরা কেনই বা এলাম, করছিটা বা কি আর যাবোটাই বা কোথায়।
“বন্ধু, এ সোসিও লিটারারি গ্রুপ”, জাহিরের পাঠানো গ্রুপটার নাম দেখে বেশ ভালই লাগলো। অনেক ধরণের গ্রুপের ছড়াছড়ি তখন ফেসবুকে, তাই জাহিরের সেদিনের ফোনে আমার তখন ততটা উৎফুল্লতা আসেনি যতটা ভাল লেগেছিল গ্রুপ টা দেখে। বেশ ছিমছাম ছোট্ট একটা গ্রুপ, আমায় নিয়ে বোধহয় গ্রুপের সদস্য সংখ্যা পাঁচ কি ছয় হবে। সবাই কবিতা লেখে, গল্প করে আর মোটামুটি সবই শিলচরের। একটা মুচকি হাসি ছাড়া আর কোন কার্পণ্য করিনি বন্ধুতে যোগ দিতে। আর সেই শুরু এক স্বপ্নের পথ চলা। বিদেশ বিভূঁইয়ের এক ঘেয়েমি জীবনে “বন্ধু” কখনও তরমুজের লাল ডগা তো কখনও গরম গরম ভাজ্জি, পকোড়া। শতদল দা (শতদল আচারজী), গৌরব (গৌরব চক্রবর্তী), চন্দ্রানি (চন্দ্রানি পুরকায়স্থ), অয়িঋদ্ধি (অয়িঋদ্ধি ভট্টাচার্য), জাহির (জাহির জাকারিয়া) আর ধীরে ধীরে আসা নতুন কিছু বন্ধু নিয়ে সে এক জমজমাট আড্ডা। প্রায় রোববারে বসত কিছু বিশেষ আড্ডা, কখনও ছড়ার, তো কখনও কবিতার, আর মাঝে মাঝে গল্পের। “আগামী রোববার সকাল দশটা থেকে ছড়ার আড্ডা থাকলে কেমন হয় বন্ধুরা?”, গৌরবের এমন উদ্যোগমূলক স্ট্যাটাসে সবাই বুঝে যেত যে এক জমজমাট আড্ডায় আসছে রোববার হবে পার। আর যে যার জায়গা থেকে নানান কমেন্ট আর লাইক দিয়ে যে সেদিনই এক আড্ডার সূচনা করে দিত তাঁর খেয়াল হয়ত হতো কিছুটা পরে। আমি দশটার ট্রেন ধরব বলে দুদিন আগে থেকেই মনে মনে প্রস্তুত থাকতাম, আর আড্ডার দিন নির্ঘাত মিস হতো আমার রাইট টাইমের ট্রেন। এক ঘণ্টা পরে যখন আমি আড্ডায় যোগ দিতাম, তখন দেখতাম ট্রেন তাঁর নির্দিষ্ট প্যাসেঞ্জার নিয়ে মোটামুটি গতিতে এগিয়ে চলছে। দেরীতে আসার একটা অনুনয় সূচক ছড়া দিয়ে যখন ট্রেনে চাপতাম তখন আড্ডার গতি টা হঠাত ই দিক পরিবর্তন করে আমাকে কেন্দ্র করে নিত। আর আমি এই ফাঁকে এ অব্ধি আসা সফরের মোটামুটি গ্যান নিয়ে নিতাম। তারপর আর আমাদের থামায় কে? একের পর এক ছড়া, টিপ্পনী আর কিছু অকৃত্রিম অদ্ভুত ভালোলাগা মিশ্রিত হরেক রকমের মিষ্টি মুচকি হাসিতে দুপুর গড়িয়ে কখন যে শেষ বিকেলে পৌঁছুত আমাদের আড্ডার ট্রেন টেরই পাওয়া যেত না।
আমাদের এরকম অনেক আড্ডার এক মধ্যমণি ছিল যার লেখালেখি থেকে বেশি আগ্রহ ছিল আমাদের লিখা ছড়া, কবিতা গুলো পড়ার আর আমাদের উৎসাহ বাড়িয়ে দেবার। সে নিজে লিখতনা ঠিকই কিন্তু আমাদের লেখালেখিতে আপাদমস্তক নজর থাকত তাঁর। আমার ছড়াগুলোর প্রতি তাঁর একটা আলাদা ভাব ছিল। প্রায়ই আমার ছড়ার তারিফ করত ফেসবুক মেসেঞ্জারে। মাঝে মাঝে আড্ডায় ওকে না পাওয়া গেলে আমরা সবাই বলাবলি করতাম ওর কথা। পরে সে নিজেই জানান দিত তাঁর অনুপস্থিতির কারণ। কখনও ইউনিভার্সিটির কোন এসাইন্মেন্ট নিয়ে ব্যস্ত তো কখনও দুপুর বেলায় মায়ের সাথে আলুর দম নিয়ে। খাবার দাবার নিয়ে আমাদের মাঝে প্রায়ই বেশ গম্ভির আলোচনা হতো। আমি রোববারের দুপুরের মাসিমার হাতের রান্না আর নানান ব্যঞ্জন শুনে সুদুর বাঙ্গালোর থেকে জিভে জল আসার কথা বলতে ও বলত শিলচর এলে একবার ওদের ঘর ঘুরে যেতে। আমি মাঝে মাঝে আপনি বলে সম্ভোদন করলে ও বিরক্ত হয়ে বলত, “দাদা, তুমি আমাকে “তুমি” বলেই ডাকবে”। এভাবেই বেশ একটা মিষ্টি সম্পর্ক ছিল আমাদের মাঝে। ও ছড়া ভালোবাসতো তাই মাঝে মাঝে আমি ছন্দে ওর সাথে কথা বলতাম, যখন ছন্দালাপ দীর্ঘ হয়ে যেত তখন ও বলত, “দাদা, আর পারছিনে”, আমি তখন অনেক কষ্ট করে আমার ছন্দের ভেলায় ব্রেক কষতাম। দেখতে দেখতে বন্ধুতে আমার বয়স বছরে গড়ালো, “বন্ধু” আর বন্ধুর এ’কজন বন্ধু হয়ে ওঠলো আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ফেসবুকে লগিন করেই বন্ধুর পেজে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধুতে বন্ধুদেরে নিয়ে। এ যেন এক মায়াপুরি, কিছুতেই বেরিয়ে আসতে চাইতো না মন। অফিসে গেলেও মন লেগে থাকত বন্ধুতে। বাঙ্গালোরের দিন গুলো এভাবেই কাটতে থাকলো।
তারপর এক মার্চের দুপুর নিয়ে এলো আমার জীবনের এক অবিশ্বাস্য দুঃখের সংবাদ। আমার একমাত্র বোনের মৃত্যুর খবরটা মুহূর্তের মধ্যে এলোমেলো করে দিল আমাদের জীবনটাকে। ফ্লাইট মিস করে শেষবারের মত একবার দেখতে ও পারিনি বোনটাকে। পরের দিন সন্ধায় যখন বাড়ি পৌঁছই ঘর ভর্তি আত্মীয়ের সমাগম আর তারই মাঝে আমার মা ড্যাব ড্যাব চোখে উপরের দিকে তাকিয়ে আছেন। সপ্তা দুয়েক পরে কাজের উদ্দেশে আবার বাঙ্গালোর পাড়ি দিতে হল। সবকিছু কেমন অবিশ্বাস্য লাগছিলো। অফিসে প্রায়ই কান্না আসতো, একা একা কাঁদতাম। কলিগ রা দেখে সান্ত্বনা দিতে আসতো। ঘরে ফিরে বন্ধুতে ডুবার চেষ্টা করতাম, কিন্তু সেখানেও বার বার বোনের কথা মনে পড়তো। ফেসবুকের বন্ধুদের সেই অ-কবি মধ্যমণি আমার দুঃখের সংবাদ টা শুনে সেদিন ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলো। সে ও ছিল দু ভাইয়ের মাঝের বোন। আমাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই অশান্ত হয়ে পড়তো, আমার মায়ের কথা চিন্তা করতো, তিনি কি করছেন। তাঁর কি হবে এসব। ধীরে ধীরে সময় গড়াতে থাকলো, আমার বাঙ্গালোরের জীবনে ইতি টেনে আমি এক নূতন শহরে, নূতন এক কোম্পানিতে। কোম্পানির গেস্ট হাউসে হপ্তা খানেক থেকে বের হলাম ঘর খুঁজতে। আর ছ বছরে এই প্রথম আবিষ্কার করলাম পৃথিবীটা কত গরম হতে পারে আর তাঁর থেকে কত চরম হতে পারে এমন গরমে থাকার জন্য একটা ঘর বের করা। যাইহোক মাদ্রাজে শেষ পর্যন্ত একটা ঘর জোগাড় হল আমার। নতুন শহর, নতুন ঘর, নতুন ভাষা, সবকিছুই নতুন। আর এই নতুনের ভিড়ে বারবারই পুরনোদের কথা মনে আসতো। মাদ্রাজে প্রায় মাসদিন পর ইন্টারনেট কানেকশনের ব্যবস্থা হল আর লগিন করেই সোজা বন্ধুতে আর গিয়েই আমার সেই আড্ডার মধ্যমণি। ওকে পেয়ে সেদিন কি খুশি। প্রান খুলে কথা হল ওর সাথে। মাদ্রাজে গিয়ে এই প্রথম যেন একটা সস্থির শ্বাস ফেললাম। ধীরে ধীরে আবার সব বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ হল। জীবনটা ধীরে ধীরে সহজ হতে লাগলো।
তারপর অনেক গল্প আমার জীবনে, সে না হয় আরেকদিন বলা হবে। সেদিন আবার ও হঠাত করে জাহিরের ফোন। আমার থাকা তখন করিমগঞ্জে। “অপুদা, একটা দুঃখের সংবাদ দিতে তোমাকে ফোন করেছি, অয়িঋদ্ধি দি আমাদের মাঝে আর নেই”। আমি নির্বাক কিছুক্ষণ থেকে জাহিরের কাছে শুনতে পেলাম ওর রোগের কথা। বাড়ি ফিরে মাকে বললাম। আর মা সারাটা দিন বার বার ভাবছিল ওর মায়ের কথা, ওর ঘরের প্রতিটি কোনে ওর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কথা, ঘরময় মা’র মেয়ের লেগে থাকার কথা। মায়েরা এমনই হয়, ওদের কলেজা রক্তাক্ত হয় এমন ঘটনায়। আর আমার মত ভায়েরা দিশেহারা হয় এমন বোনের বিচ্ছেদে।
পৃথিবীতে এমন শত শত ঘটনা আকসারই হচ্ছে, কিন্তু এমন কষ্ট বঝে শুধু তাঁরাই যাদের সাথে এমন হয়। আফসোস আমরা যদি বুঝতাম বা বুঝার চেষ্টা করতাম যে আমরা কেনই বা এলাম, করছিটা বা কি আর যাবোটাই বা কোথায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন