“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৩ জুন, ২০১৪

আত্মরতি


(C)Image:ছবি













।।দেবলীনা সেনগুপ্ত।।


কটা জরুরি কাজের কথা
মনে পড়ে গেল আজ-
যে কথাটা ভুলেছিলাম
বহুদিন ধরে,
আজ মনে পড়ে গেল হঠাৎ।
অম্‌নি দমকা হাওয়া
ধাক্কা দিল বুকের গভীরে
এক তীক্ষ্ণ আলোকরেখা
সুড়ঙ্গ খুঁড়তে থাকলো
চেতনের শেকড়ে...

আজ আর কথালাপ নয়-
আজ ফোন ধরবো না
আন্তর্জালেও বাধা পড়বো না

আজ শুধু নিজের সাথে আলাপন
মুখোমুখি বসে
একজীবনের আদর করবো নিজেকেই
বড় ভালবেসে...।

মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০১৪

আত্মজাকে


(C)Image:ছবি


















।।দেবলীনা সেনগুপ্ত।।

মামণি,                            
কেমন আছিস্‌ মা?
শেষবারের মত চলে আসার আগে
বড় ইচ্ছে ছিল তোকে দেখার,
ইচ্ছে হচ্ছিল তোর মুখের ওপর
ঝাম্‌রে পড়া চুলগুলো
দুহাতে আল্‌তো সরিয়ে দিয়ে
চুমু খাবার..সেই ছোট্টবেলার মত..
হল না..
দেখা হল না
কথা হল না
একটু ছুঁয়ে দেওয়াও হল না
আর রেখে যাওয়া হল না কিছুই তোর জন্যে...
এই যে বাড়ি-গাড়ি-অর্থ-ধন
কিছুই তো আমার নয়
কী দিই তোকে বল্‌?
তাই যা শুধু আমার
শুধুই একান্তের আমার
সেটুকুই দিয়ে গেলাম তোকে,
দিয়ে গেলাম জরায়ুর রক্তস্রোতে
অধিকার.... নারীত্বের,মাতৃত্বের
আর নিভৃত যন্ত্রণার মাঝেও
খুশি হয়ে বেঁচে থাকার..

বুধবার, ১১ জুন, ২০১৪

মালবিকা, আমার হাত ধর...

(C)Image:ছবি


















মালবিকা? তুই?
কতদিন পরে দেখা হল বল্‌তো?
কেমন আছিস্‌?
চিনতে পারছিস্‌?
আমি কিন্তু তোকে দূর থেকে দেখেই চিনেছি
যদিও তুই বেশ কিছুটা মোটা হতে গিয়েছিস্‌
আর ফর্সাও...
কিন্তু অমন সুন্দর চুলগুলো
কেটে উঠিয়েছিস্‌ কেন কানের ওপর?
এ বুঝি তোর ছেলে?
বাহ...ভারি মিষ্টি..অবিকল তোর মত
আর এই যে...এ আমার মেয়ে
সবাই বলে ওর বাবার মত দেখতে...
ভারি দুষ্টু , জানিস্‌ তো!
ওমা, তুই চুপ করে আছিস্‌ যে?
এখনও চিনতে পারছিস্‌ না?
তোর মনে নেই...
অনামিকা আর মালবিকা...
সেই প্রথমদিন থেকে
স্কুলের বেঞ্চে পাশাপাশি বসা?
একজন ছটফটে , অন্যজন শান্ত
একজন শাম্‌লা,অন্যজন ফর্সা
আমি ভাল গান গাইতাম,
তুই ছবি আঁকতি...
আমি ছুট্‌ ছুট্‌ দৌড়তাম
তুই জোরে জোরে হাস্‌তি
আমি কবিতা বলতাম জোর গলায়
আর তুই মালবিকা
সূঁচ- সুতোর নকশায়
ফুটিয়ে তুল্‌তি রঙিন কবিতা
কি সুন্দর...কি স্বপ্নময়...
আর কি ভাল নাচতি রে তুই
সবাই মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতো
আর সেই সব সময়,
 
মিথ্যে বলব না মালবিকা
সবচেয়ে ভালো বন্ধু হলেও
একটু একটু হিংসে হত তোর ওপর
মালবিকা, তোর মনে আছে...
সেই স্কুলবেলায়, যত আড়ি তত ভাব
সেই বালিকাবেলায়, কত হাসি, কত খুশি...
সেই টিফিনের আচার-ঘুগনির কত লঙ্কাভাগ!
সেই অংক- বিজ্ঞানের খাতায়
হাড্ডাহাড্ডি লড়াই
কখনো তুই আগে তো কখনো আমি
বার্ষিক পরীক্ষার ফলে প্রথম দুটো জায়গা
যেন তোর আর আমার কেনা জায়গীর...।
মালবিকা...জানিস...
এখন আর আমি গান গাই না
কবিতাও বলি না
আমার মেয়ের বাবা পছন্দ করেন না
অবশ্য আমি বিদ্রোহ করতে পারি
স্বাধীনভাবে আকাশে উড়তে পারার মত
ক্ষমতা আছে আমার ডানায়
কিন্তু প্রিয়তম মানুষটির অবহেলা
আমাকে কেমন যেন নির্জীব করে দেয়
আমার চেষ্টাগুলো ইচ্ছেহীন হয়ে পড়ে
আর তারপর...হারিয়ে যায়...
এখন আমি শুধু কথা বলি
অর্থহীন, অন্তহীন , অনর্গল শুধু কথা
দম দেওয়া পুতুলের মত
চাবি ঘোরালেই কথা
চাবি ঘোরালেই...শেষ।
এই দেখ, 
তখন থেকে কেবল একা একাই বকে চলেছি
তুই চুপ করে আছিস কেন?
এখনও অচেনার বিভ্রম?
এই ছেলে, তোমার মা কথা বলছে না কেন?
কি? কি বল্‌লে?
মালবিকা আর কথা বলে না!
কানেও শোনে না!
কেন? কেন?
কি হয়েছে ওর?
এখানে কেন এসেছ তোমরা?
ডাক্তারের কাছে?
মাকে দেখাবে?
মালবিকা...তুই একবার আমার দিকে
আমার চোখের দিকে তাকা
তোর স্থির হয়ে যাওয়া অক্ষিগোলকে
আমি খুঁজে নিতে চাই সেই অসুখকে
যা কেড়ে নিয়েছে তোর নাচ,আমার গান
আর আমাদের দুজনের মুখর প্রাণ!!
মালবিকা আমার হাত ধর্‌
তুই ডাক্তারের কাছে যাস্‌ না
তার চেয়ে চল্‌
একছুটে যাই
সেই চৌকোণা সাদা দেয়ালে
কালো বোর্ড লাগানো ক্লাসঘরটিতে
সেখানে জানালার শিকে মাথা রেখে
চল্‌ দাঁড়াই আর একবার
আর হঠাৎ কোন বর্ষাদিনে এক
যখন দরজার বাইরে মাঠের ওপারে
আকাশে ঘনশ্যাম মেঘ ধরবে
বাদলা হাওয়ায় আন্‌মনা উড়বে
ইতিহাসের খোলা পাতা
সেইসঙ্গে তোর- আমার মন
সমস্ত ক্লাসঘর জুড়ে
মৃদু কলরব আর অস্পষ্ট চঞ্চলতা
ইতিহাসের দিদিমণি রিন্‌রিনে গলায়
চিৎকার করে বলবেন
মেয়েরা, পড়ায় মন দাও
ঠিক তক্ষুনি
মেঘের মাদল বাজিয়ে
ঝম্‌ঝম্‌ বাদল নামবে অঝোরে
দিদিমণি মিষ্টি হেসে বলবেন
আজ পড়া থাক
অনামিকা, একটা গান গাও
আমি গাইব...হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে...
আর তুই মালবিকা
ময়ূরের মত পেখম তুলে তুলে
নাচবি ...নাচবি...
বৃষ্টির সঙ্গতে ক্লাসঘরের সেই জলসা
তুই বিশ্বাস কর মালবিকা
আমাদের সব অসুখ সারিয়ে দেবে
মালবিকা, আমার হাত ধর্‌
আমার হাত ধর...মালবিকা...

সোমবার, ৯ জুন, ২০১৪

একলা মেয়ের ছড়া












।।দেবলীনা সেনগুপ্ত ।।
ই মেয়ে
তুই বড় হলি যে
জানিস না তোর উড়তে মানা?
মেলিস কেন ইচ্ছে –ডানা?
টবে রাখা বেঁটে বনসাই
মেয়ে হবি ঠিক তেমনটাই

এগোবি না পেছোবি না
এক জায়গায় থাকবি স্থির
আটপৌরে জীবনটাকে
আটপৌরেই থাকতে দিস

রাজকন্যা নও তো তুমি
রক্তরং ও নয়কো নীল
ভালোমন্দ সেবাযত্ন
গণতন্ত্রের ধনরত্ন
সবই যাদের ইচ্ছাধীন

তোর জন্য টুকরো আকাশ
ইতিউতি নিষেধ বেড়া
তোর জন্য একলা ঘরে
নীল ইশারা লাল প্রহরা

আকাশ ভরা সূর্য তারা
জীবন- ছবি অন্ধকার
আইন-কানুন উতোর-চাপান
তোর বেলা সব নির্বিকার

কাজকম্ম পড়াশোনা
শিকেয় তোল বা চুলোয় যাক
মানুষ তো নস,মেয়েই শুধু
শরীরটুকু সামলে রাখ।

দু-পেয়ে ঐ শ্বাপদ যত
শানিয়ে নখ আর বাড়িয়ে জিভ
আসছে ধেয়ে ছোট না মেয়ে
জ্ঞা ন শূন্য দিগবিদিগ।

এইখানে আর থাকিস না
গ্রাম-শহর ছাড়িয়ে যা
একলা আকাশ নিজের রঙে
মনের মত রাঙিয়ে নে
এলোমেলো টুকরো জীবন
ভালবেসেই গুছিয়ে নে

এইখানে আর থাকিস না
মন যেথা চায় হারিয়ে যা
‘সীতা’ হলি ‘সতীও হলি
দেবী বলে পূজাও পেলি
তবুও দেখ ফক্কিকারি
‘মানুষ’ হতে পারলি না

‘মেয়ে’ হয়েই রইলি শুধু
‘মানুষ’.....হতে পারলি না.....

অস্তরাগ

 ।।দেবলীনা সেনগুপ্ত ।।


হেমন্তের বাতাসে কেমন যেন এক বিষণ্ণতা  ছড়িয়ে থাকে। প্রকৃতির ধূসর বাদামীতে মন-কেমন-করা ভাব।পর্ণমোচী বৃক্ষেরা পাতা ঝরিয়ে আকাশপানে শূন্যশাখা বাড়িয়ে আকুল প্রার্থনায় মগ্ন। বিকেল ছোটো হয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে হঠাৎ । নীড়ছাড়া পাখীদের দলে তাড়া লেগে যায় নীড়ে ফেরার। শহর উপান্তের এক সম্ভ্রান্ত আবাসনের বারোশো বর্গফুটের ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলার ঝুলবারান্দায় হেমন্ত –বিকেলের বিষাদ – ছোঁয়া মন নিয়ে বসেছিলেন সুপ্রতীক-সুপ্রতীক সেন। এককালের পদস্থ কর্মচারী। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত।

     আজ ভুত-চতুর্দশী।দীপাণ্বিতা বা দীপাবলী। আজকের যুগের ভাষায় ‘দেওয়ালী’। অবশ্য খতিয়ে দেখলে শব্দদুটিতে কোনো অর্থগত বিভেদ বা প্রভেদ নেই। কিন্তু সুপ্রতীকের মনে হয়,‘দীপাবলী’ শব্দটি উজ্জ্বল হলেও সকরুণ কোমল। মৃণ্ময় আকাশপ্রদীপে জ্বলা দীপাবলীর আলোয় থাকে শূন্য থেকে পূর্ণতায় উত্তরণের আভাস। অন্যদিকে ‘দেওয়ালী’ যেন শুধুই কৃত্রিম বৈদ্যুতিক আলোয় ভাসানো শ্রবণ-বিধুর শব্দদূষণের হুজুগ;যেখানে বৈভবের উচ্ছ্বাস আছে,কিন্তু অন্তরের নিবেদন নেই।অবশ্য এইসব ভাবনার হয়তো কোন যুক্তিগ্রাহ্য প্রেক্ষাপট খুঁজে পাওয়া যাবে না। হয়তো বা বয়সের প্রাচীনতাই তার মনে এইসব উদ্ভট ভাবনার উদ্রেক করে।

     তাদের আবাসনটিও আজ আলোকমালায় উজ্জ্বল। ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে চলছে নানারকম আলোকসজ্জার কারিকুরি। বাইরে থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তার নিজস্ব ঘরটিতে ফিরে তাকালেন সুপ্রতীক। দেওয়ালে ফোটোফ্রেমে মৃদু হাসিমাখা দীপাবলীর চোখ তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে।‘এ দীপাবলী শুধু আমারই’,ভাবেন সুপ্রতীক।স্ত্রীর ছবির সামনে আজ নিজে হাতেই একটি সুন্দর মাটির প্রদীপ জ্বালিয়েছেন সুপ্রতীক। ঠিক যেমনটি পছন্দ করতেন দীপাবলী।মাটির প্রদীপের স্নিগ্ধ আলোকশিখায় দীপাবলীর মুখ আরও মায়াময়, চোখে নিবিড় রহস্যের ইশারা। বড় আশ্চর্য্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন দীপাবলী । প্রায় চল্লিশ বছরের যুগ্ম জীবন-যাপনের পরও স্ত্রীকে যেন ঠিকমত বুঝে উঠতে পারেন নি সুপ্রতীক। সুপ্রতীকের আদর্শ স্ত্রীর ভুমিকাটি দীপাবলী আজীবন নিখুঁত ভাবেই পালন করেছেন , কোথাও কোন ফাঁকি  ধরতে  পারেন নি সুপ্রতীক। কিন্ত কখনও কখনও দীপাবলীর বহুমুখী ব্যক্তিত্ব তার বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে ছড়িয়ে পড়ত –সুপ্রতীক তার নাগাল পেতেন না। কখনও নিজেকে অসহায় মনে হত,কখনও খুব ছোট মনে হত আবার কখনও ভাঙ্গন ধরত হৃদয়ের গহনে। কিন্তু প্রতিবার প্রতিটি ঘটনার শেষেই যে সারসত্য সুপ্রতীক অন্তরে অন্তরে উপলব্ধি করতে পারতেন তা হল ,দীপাবলীই তার শেষ আশ্রয়, অন্ততঃ মানসিক ভাবে।

          প্রায় পাঁচ বছর হল দীপাবলী চলে গেছেন । অথচ এখনও প্রতিদিন তিনি নতুন করে স্ত্রীকে আবিষ্কার করে চলেছেন, স্ত্রীর দৈহিক অনুপস্থিতি তাকে যতটা দুঃখ দেয় , মানসিক সান্নিধ্য ততটাই নিবিড় হয়ে চলেছে দিন প্রতিদিন । দীপাবলীর ছবির সামনে প্রতিরাত্রে তিনি উজাড় করে দেন প্রতিটি বিষাদ,প্রতিটি যন্ত্রণা,প্রতিটি অপমান-আর ছবির দীপাবলী চোখের মৃদু হাসিতে ছড়িয়ে দেন শান্তির পরশ এখনও- অবিরত-অবিরাম। এও তো এক দাম্পত্য-ভাবেন সুপ্রতীক।

          অত্যন্ত সন্মানের সঙ্গে কর্মজীবন অতিক্রম করেছেন সুপ্রতীক। দীপাবলীও দায়িত্বশীল পদে কর্মরতা ছিলেন। কিন্তু গার্হস্থ্য ধর্ম পালনে ত্রুটি রাখেন নি। একমাত্র ছেলেকে সুযোগ্য বানিয়েছেন। দুজনের চাকরি জীবনের মিলিত পূঁজির অনেটাই খরচ করেছেন শহর প্রান্তের অভিজাত এলাকায় এই বাসগৃহটি কিনতে। ছেলের বিয়েও দিয়েছেন আন্তরিক আগ্রহে । চেনা-পরিচিত,আত্মীয়স্বজন,বন্ধুবান্ধব সবাইকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন ছেলের বিবাহোৎসবে , তার আর্থিক ব্যয়ও নিতান্ত কম ছিলনা । তা নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র চিন্তিত ছিলেন না। ছেলের বিয়ে উপলক্ষে দীপাবলীও আনন্দ উচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিলেন । কখনও ছোট্ট মেয়ের মত সারা বাড়ী খুশি-পায়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন , আবার কখনও দশভূজা হয়ে কর্মকান্ডের তদারকি করছেন। আর সুপ্রতীকও সমস্ত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও স্ত্রীর এই নতুন উচ্ছ্বসিত উদ্ভাসিত রূপটি আড়চোখে দেখে নিজের বিয়ের দিনটিতে ফিরে ফিরে যাচ্ছিলেন।

          এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল।পুত্রবধূকেও তারা কন্যাস্নেহেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মালিনী নাম্নী উচ্চশিক্ষিতা রুচিশীলা মেয়েটির মধ্যে সব থাকা সত্বেও সারল্যের অভাব ছিল।তার মনের মধ্যে থাকা সূক্ষ্ম অধিকার বোধ ক্রমশঃ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে গ্রাস করতে চাইছিল পরিবারের অন্য তিনটি সদস্যের জীবন। সুপ্রতীক অবশ্য প্রথমে তেমন বোঝেন নি। হয়তো দীপাবলীই তাকে এ সব সমস্যার থেকে আড়ালে রেখেছিলেন। কিন্তু তারপর সেই যে অফিসে একদিন ফোন বেজে উঠলো,তিনি দৌড়ে এলেন বাড়িতে, অচৈতন্য দীপাবলীকে নিয়ে ছুটলেন নার্সিং হোমে,আর তারপর শুনলেন ডাক্তারের সেই নিদারুণ নিদান-মস্তিষ্কের ভয়াবহ বিফলতায় বিপন্ন হয়েছে দীপাবলীর অসম্ভব প্রাণশক্তি সম্পন্ন  রক্তপ্রবাহ, বাকী জীবনটুকু পক্ষাঘাতগ্রস্ত দেহটি নিয়েই কাটাতে হবে।

          নার্সিং হোম থেকে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ীতে ফেরার পর প্রথম সাংসারিক যুদ্ধটি লড়তে হয়েছিল সুপ্রতীককে।তিন শয্যাকক্ষ বিশিষ্ট ফ্ল্যাট বাড়ির পূর্ব-দক্ষিণ খোলা , ঝুলবারান্দাসহ ঘরটি প্রথম থেকেই তাদের স্বামী-স্ত্রীর জন্য বরাদ্দ ছিল।এবং সুপ্রতীক জানতেন এ ঘরটি দীপাবলীর বিশেষ প্রিয়।নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে এ ঘরটির অন্দরসজ্জা করেছিলেন তিনি।কিন্তু নার্সিং হোম থেকে ফিরে সুপ্রতীক দেখলেন তারা কক্ষচ্যুত হয়েছেন,অপেক্ষাকৃত অপ্রশস্ত অন্য একটি কক্ষে নির্দিষ্ট হয়েছে অসুস্থ দীপাবলীর স্থান।আর এই প্রথম স্ত্রীর চোখে এক অদ্ভুত বিষণ্ণ অসহায়তা দেখলেন সুপ্রতীক।মুহূর্তের সিদ্ধান্তে কঠোর হলেন তিনি।গৃহকর্তার অধিকার ও আভিজাত্যে আদেশ দিলেন তাদের দাম্পত্যময় কক্ষটি তাদেরই ফিরিয়ে দিতে। পুত্রবধূটি নির্দেশ মেনে নিয়েছিল । কিন্তু সুপ্রতীক যখন স্ত্রীকে পরম মমতায়  বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছিলেন ,তাঁর কানে এল তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ এক নারীকন্ঠের বিদ্রূপাত্মক উচ্চারণ-‘আদিখ্যেতা...’। সুপ্রতীক স্থির করলেন, এরকম আদিখ্যেতা তিনি আরও করবেন – অন্ততঃ যতদিন পর্যন্ত দীপাবলীর জীবন রয়েছে-ততদিন।

     এরকম ঘাত প্রতিঘাত সংঘাতে কেটে যাচ্ছিল জীবন । ছোট ছোট খুশির মুহূর্তও যে তৈরী হতনা তা নয় – তবে বড় অপ্রতুল হত তাদের আয়ুষ্কাল। এরমধ্যেই সুপ্রতীক   দাদু হলেন,একটি পুত্র-সন্তানের জন্ম হল তার ছেলের ঘরে ।বছর তিনেক পরে তাঁর কর্মজীবনের পরিসমাপ্তির দিনটিও সমাগত হল ।অবসরপ্রাপ্তির দিনটিতে সন্ধেবেলায় বাড়ী ফিরলেন সহকর্মীদের দেওয়া বহুবিধ উপহার নিয়ে। বাড়ী ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই নাতি আধো আধো গলায় জিজ্ঞেস করল –
---দাদু কি এনেছ?                                 
--- প্রাইজ,
----আমাল?
---হ্যাঁ সোনা,তোমার জন্য , তোমার মা-বাবার জন্য
___আমাল ঠাম্মাল জন্য?
----হ্যাঁ তাও আসছে
----কী?
----সেটা সারপ্রাইজ,
----- কি বলনা,
     কথোপকথনের মধ্যেই ডোরবেল বেজে ওঠে। সুপ্রতীক এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেন। দুটি ছেলে প্যাকিং বাক্সে মোড়া কিছু নিয়ে ভেতরে ঢোকে। সুপ্রতীক সকলের অবাক চোখের সামনে দিয়ে তাদের নিজের ঘরটিতে নিয়ে যান।

------ এই যে এখানে রাখ, ঠিক মত লাগিয়ে দাও বিছানার পাশে, দেখ সকাল সন্ধ্যে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের আলো যেন পড়ে এমনভাবে রাখো।

          পাশেই শয্যাগতা দীপাবলীর সপ্রশ্ন দৃষ্টির সামনেই প্যাকিং বাক্সের মোড়ক সরিয়ে দৃশ্যমান হয় একটি আধুনিক নক্সার ইজিচেয়ার।ছেলে দুটি চলে যাবার পর বাক্‌শক্তিহীন দীপাবলী মৃদু কৌতূহল নিয়ে তাকান স্বামীর দিকে...

-নিয়ে এলাম তোমার জন্যে,...সুপ্রতীক বলেন...

         -আজ তো অফিস থেকে বরাবরের মত ছুটি হয়ে গেল।এখন আর কোন কাজ নেই।এই চেয়ারটিতে বসে বসে তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেব, আর গল্প করব...অনেক অনেক গল্প।আমি বলব, তুমি শুনবে...। তুমি তো হুইল চেয়ারেও বসতে চাও  না।এই চেয়ারটা আমি রোজ বিকেলে ব্যালকনিতে নিয়ে যাব। আর তোমাকে কোলে করে নিয়ে বসিয়ে দেব।তারপর সুর্যাস্তের রঙ মেখে পাখীদের ঘরে ফেরা দেখতে দেখতে বিকেলের চা খাব একসঙ্গে...।

          দীপাবলীর চোখের কোণে গড়িয়ে আসা অশ্রু নিবিড় মায়ায় জামার হাতায় মুছে নেন সুপ্রতীক। সেই মুহূর্তেই পর্দার ওপার থেকে কানে আসে মৃদু পদশব্দ আর এক ঈর্ষাময় অভিব্যক্তি-‘আদিখ্যেতা’।

     অতঃপর অবসরজীবনে শুধুমাত্র দুটি আকর্ষণ বিন্দুতেই কেন্দ্রীভূত হয় সুপ্রতীকের যাবতীয় কর্মচঞ্চলতা।একদিকে স্ত্রী, অন্যদিকে নাতি।দীপাবলীর অসুস্থ অসহায়তা তাকে যেমন পীড়া দেয়,অন্যদিকে সমস্ত দাম্পত্যজীবনে এই এখনই যে তিনি দীপাবলীর সম্পূর্ণ অবলম্বন হয়ে উঠতে পেরেছেন,দীপাবলীর প্রতিটি দিন-রাত,প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস যে তারই উপরে নির্ভর করে রয়েছে,এ চিন্তাও কোথায় যেন তার মনে সূক্ষ্ম সুখানুভুতি জাগিয়ে যায়।

          সেদিনও সন্ধ্যে থেকেই ঝুলবারান্দায় আরামচেয়ারটিতে স্ত্রীকে আরামপ্রদ ভঙ্গীতে বসিয়ে দিয়েছিলেন সুপ্রতীক। বেতের মোড়ায় পাশটিতে বসেছিলেন নিজে। স্ত্রীর অনড় হাত ছুঁয়ে টুকটাক কথা বলছিলেন।দীপাবলী চোখ দিয়েই উত্তর দিচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি স্বামীকে অনুরোধ জানালেন গান গাইতে।সুপ্রতীকের গানের অভ্যাস ছিল একসময়। কিন্তু বহুদিন তো আর চর্চা নেই। অবশ্য মাঝে মাঝে এখনও গুণ-গুণ করেন।স্ত্রীর অনুরোধে উঠে গিয়ে গীতবিতান নিয়ে এলেন।

-কোন গানটা গাইব?

স্ত্রীর ইঙ্গিত বুঝে শুরু করেন সুপ্রতীক...“জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে...”

     স্থায়ী অংশটি চোখ বুজে আন্তরিক ভাবেই গেয়ে যান। অন্তরাতে এসে থেমে গেলেন। কথা মনে নেই।দীপাবলী কথা বলতে পারলে নিশ্চয়ই ধরিয়ে দিতেন।বই খুলে দেখতে গেলেন,চোখ পড়ল স্ত্রীর দিকে।পরম সন্তোষে চোখ বুজে আছেন, মুখে মৃদু হাসি।স্ত্রীর গায়ের চাদর খানা একটু টেনে দিতে গেলেন তিনি-অমনি দীপাবলীর মাথা ঝুঁকে পড়ল তার বুকে।শান্তভাবে স্ত্রীর মাথা বুকে গ্রহণ করলেন তিনি আর উপলব্ধি করলেন সেই চরম সত্য-দীপাবলীর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়েছে।

     স্ত্রীর মৃত্যুর পর নিজে থেকেই সরে এসেছিলেন পাশের ছোট ঘরটিতে,কেননা পুত্রবধূর সঙ্গে সংঘাত বাড়িয়ে নিতে তার আর মন চায়নি। তাছাড়া যার জন্য যুদ্ধ করবেন তিনিও তো আর নেই,সুতরাং...কিন্তু সমস্যাটা এল অন্যদিক থেকে।যে মাঝবয়সী লোকটি তাদের হাটবাজার ও অন্যান্য গৃহকর্মে সাহায্য করে থাকে,তার শয্যাস্থানটি পুত্রবধূ নির্দিষ্ট করল সুপ্রতীকের ঘরের মেঝেয়।আরও একবার বিদ্রোহ করলেন সুপ্রতীক। তিনি কেমন করে বোঝাবেন, আজও প্রতিটি রাতে তিনি তার ইজিচেয়ারটিতে বসে দীপাবলীর আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠেন। কেমন করে  বোঝাবেন ওই মানুষটির শয্যা রচনা করতে হলে এই অপ্রশস্ত ঘরটিতে  ইজিচেয়ারখানা রাখার আর জায়গা হবে না,যে চেয়ারটিতে রয়ে গেছে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রিয়তম শেষ স্পর্শ।

          প্রবল বাজির শব্দ আর একটি সুগভীর দীর্ঘশ্বাস সুপ্রতীককে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনলো।“প্রবীণ মানুষের জীবন আসলে দরজার কোণে দাঁড়ানো লাঠির মত।প্রয়োজনে কেউ ব্যবহার করে,নতুবা সব জায়গা থেকে জীবনকে গুটিয়ে এনে দরজার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা...শেষের প্রতীক্ষায়”-ভাবেন সুপ্রতীক। একটু একটু শীত বোধ হয় তার।দীপাবলী থাকলে মৃদু ধমক দিয়ে গায়ে হাল্‌কা চাদর দিয়ে দিতেন।শ্লথ পায়ে ঘরের ভেতর উঠে যান তিনি।আলমারীর লকার থেকে বের করে আনেন একগুচ্ছ কাগজ ও দলিল।একটি কাগজ-চাপা দিয়ে টেবিলের ওপর রাখেন সে সব। আগামীকাল থেকে তার নতুন জীবনের ঠিকানা...নবদিগন্ত বৃদ্ধাশ্রম।এ পরামর্শ ঐ ছবির দীপাবলীই তাকে দিয়েছেন।অযথা যুদ্ধে রক্তাক্ত হতে বারণ করছেন বারবার।মেনে নিয়েছেন তিনি।নিজের টুকিটাকি গুছিয়েও নিয়েছেন।আগামীকাল ছুটির দিন-পুত্র-পুত্রবধূকে সব জানিয়ে দুপুরের আগেই বেরিয়ে পড়বেন... দেওয়াল থেকে আস্তে আস্তে স্ত্রীর ছবিখানা নামিয়ে আনেন।নিষ্কলুষ প্রেমময় আলিঙ্গনে বুকে জড়িয়ে ধরেন।তারপর ধীরে ধীরে গিয়ে বসেন ইজিচেয়ারটিতে।ফিস্‌ফিস্‌ করে বলেন...’এসো প্রিয়তমা...কাল থেকে নতুন আবাস আমাদের...।তার আগে আজ রাতে আবার আমাদের নিশিবাসর...আমাদের এ বাড়িতে...শেষবারের মত...’।

     ছবির দীপাবলী মিষ্টি হেসে ছদ্মরাগে বলে ওঠেন ‘আদিখ্যেতা’।

রবিবার, ৮ জুন, ২০১৪

মেঘকথা
















মেঘের সাথে ভাব জমিয়ে দেব তোর
আর কিছু না হয়ে বরং মেঘ পিয়ন হবো।
মেঘ রঙা শাড়ি পাব মেঘের সাথে ভাব করালে
বৃষ্টি আঁকা জুতো পাব।
আর যাব ঠাকুর দেখতে শিউলি ঝরা পথে।
মেঘ-- তোর সাথে আজ ভাব করাবো ওই
আকাশ চাওয়া মুগ্ধ চোখের।
আর কিছু না হয়ে বরং মেঘ পিয়ন হবো।
মেঘের সাথে ভাব জমিয়ে দেব ওই মেঘবালকের...

লখেতরা


(C)Image:ছবি
   (এই অসমিয়া গল্পের লেখক রবীন শর্মা । রবীন শর্মার  জন্ম ১৯৬০ । গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর । সহজাত জীবনযাপনের মতোই লোকাচার আর জনপদকে ঘিরে তাঁর গদ্যের নির্মাণ – বিনির্মাণ । ‘সং’ , ‘কথাভগীরথ’ সহ তিনটি গল্পগ্রন্থ ইতিমধ্যেই নজর কেড়েছে পাঠকের। বর্তমান গল্পটি অনুবাদ করেছেন     রণবীর পুরকায়স্থ । এটি ছেপে বেরিয়েছিল 'আরম্ভ' , জানুয়ারি ২০১৪ সংখ্যাতে।

        

          কদিন একটা বনপায়রা উড়ে এসে বসে লখেতরা নদীর পারে । দিনটি    ছিল শুক্রবার । নিস্তব্ধ দ্বিপ্রহর । গরুর পালকে নদীর ঘাটে জল খাইয়ে , চারণক্ষেত্রে ছেড়ে দিয়ে নাগকেশর গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিল এক রাখাল । পায়রাটিও এসে বসে তার কাছে । সর্ষেখেতের মতো সুগন্ধবহ সৌম্যকণ্ঠে সে শুধায় , ‘ কু কু কুউ... কু... বুকের মাঝে সারে সারে বেজেছিল তোমার বংশীধ্বনি , আজ কেন হে বাজে না কানে ?’

সামনের বালুচরে আটকে থাকা হাঁটুসমান জল , নিস্তরঙ্গ লখেতরা । নদীর মতোই নিস্তেজ নিরন্ন এই গোরক্ষক যুবকটিও । এক কুড়ি বসন্ত পেরিয়ে এসেছে সে , অথচ অনবরত অশ্রুসজল তার চোখ জোড়ায় জীবনের রিক্ততাই শুধু । এখানে সেখানে নানান রঙের কাপড়ে তালিমারা আলখাল্লার মতো পরিধেয়টিই যেন তার বহুমাত্রিক জীবনের রূপকথা । জন্মের একপক্ষ কালেই সে হারিয়েছিল মাতৃস্নেহের অমৃত । কৈশোরের স্বপ্ন প্রজাপতির রং মুছে গিয়েছিল পিতার মুখাগ্নিতে , লখেতরার পারে । আর বাসন্তী ? থাক, তার থেকেও বড়ো কথা দুনিয়াটাই তো ছলনা করেছে তার সঙ্গে , যখন আবিষ্কার করেছিল সে জন্মমূক , কণ্ঠস্বরহীন ।               
         পায়রার বকম বকমে সে বিমর্ষতা প্রকাশ করে । বলে, ‘এ এ অ... ডালের পাখি ডালেই থাক , বুঝবি নে তুই আমার বুক ভরা দুঃখ ।’

         বকুনি গেয়ে বারদুয়েক এদিক – ওদিক ঘুরে পায়রাটি আবার বলে, ‘ কু কু ... তুমিই বলেছিলে পশ্চিমা বাতাস বইলে আসবে , বাঁশির সুরে মালিনীর দেশে নেবে উড়িয়ে , ওহে মিষ্টি পাখি যাবে না ?’

          আত্মাভিমানের বেদনায় , ভাবাবেগে অস্পষ্ট স্বরে গোরক্ষক বলে, ‘ অ অ ... গেছে যে সময় থেকে এমন সময়...এত দীর্ঘ উপলব্যথিত যাত্রাপথ , জেএটিএনএওয়াই পেরিয়ে যাচ্ছি দিন, ভুলে গেলি , এনেছিলি সেদিন , তোর মধুঝরা কলকাকল ?’

          কপোতটির মন আর্দ্র হয় । দুঃখের বকবকমে বলে, ‘ কু কু ...আসছি রে ভাই তোমার কষ্টের প্রাঙ্গণভরা ক্রন্দন শুনতে ...।’

          রাগ হয় রাখাল যুবকের । হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়ে পায়রাটিকে তাড়িয়ে কুপিত স্বরে বলে, ‘ এ এ ... কার কথা শুনবে , তোমার এই একটুখানি বক্ষ কী সইতে পারবে...।’

         পায়রাটি গভীর নিশ্বাসে বলে, ‘ কু কু ... বাঁশিটা বাজাও ভাই , পথ কেটে জল দাও , তোমার দুঃখের দূর্বাবনে এনে দিই একটুকরো রোদ , তার থেকে না হয় দিও আমায় একটুখানি খুদ ...।’

          কাঠুরিয়ার কুড়ুলের আঘাতে দ্বিপ্রহরের গাম্ভীর্য দীর্ঘায়ত , নদীর দুই পারেও নিস্তব্ধতা । মাঝে মাঝে ঝাউ আর কাশের বনে বসন্তের শিস দিয়ে ডাকে কেউ । কিন্তু এত আয়োজন সত্ত্বেও বনসংগীতের সুবাসভরা পবনে বয় না কোনো ময়ূরপঙ্খী ।

            বিগত রাতের কথা । তাই বা কেন, তারও আগের কথা, আগের দিন কেন বলতে গেলে বিগত মাসটা, মাস কেন যদি বলি বছরের কথা, ভুল হবে না । লখেতরার পারে ছোটো ছোটো কয়েকখানি গ্রাম – কয়াজানি , রাজাবাড়ি , পানিচলা এসবেই হিরণ্যকশিপুর তাণ্ডব । দিন নেই রাত নেই , ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধরত সৈনিক নামছে । চারদিকে হরিণ – মারা ফাঁদ পেতে গ্রামের ছোটো ছোটো কুঁড়েঘরের বাচ্চা মেয়ে- পুরুষ সবাইকে টেনে বের করে । কিছু অচেনা মানুষের নাম নিয়ে বলে, ওরা এসেছিল ? ভাত খেয়েছিল এখানে, কার ঘরে ? এমন উদ্ভট প্রশ্ন । ভয়ে কম্পমান গ্রামবাসী স্পষ্ট উত্তর দিতে না পারলে লাথি মারে, বন্দুকের কুন্দা দিয়ে খুঁচিয়ে ...।

              দিনের বেলা শ্মশান হয়ে থাকে গ্রামগুলি । গোহালের গরু গোহালেই হাম্বা হাম্বা করে , তৃণভূমিতে নিয়ে যাওয়ার সাহস হয় না কারো । এমন সময় আবার ফিরে আসে কপোতটি । গোপাল যুবকটির কাছ থেকে সেই ভয়ানক রাতের বিভীষিকার কথা শুনতে । কী বলো , কম না কি রাখালটির মনোব্যথা, মনের কথা ---

           তার নাম মাধব । গ্রামের বয়স্কজনেরা ডাকে মাধা । খিকখিকিয়ে রং – তামাসায় বয়সিরা ডাকে বেভা । শিকনি – কাটা বাচ্চাকটাও তাকে ছাড়ে না , ভেংচি কেটে গায়--- এংকরি বেংকরি বেভা দাদায় বাঁশি বাজায় বাসন্তীর নামে , ভেংকরি । বলতে পারো , কে এই বাসন্তী ? বলব, তার আগে সংক্ষেপে বলে নিই শোকে দুঃখে কাটানো তার জরাজীর্ণ জীবনের দুটি কথা ।

        লখেতরার পারে ছোটো গ্রাম কয়াজানি । কুড়ি ঘর মানুষ , বাঁশ বেতের বেড়া দেওয়া কুড়িখানা কুঁড়েঘর । নুন- ভাতে একসময় এরা ছিল কৃষিজীবী । হাজোর মাধবমন্দিরের সেবাইত –এর খাসরায়ত । যদিও কালক্রমে আইন- আদালত এবং রায়তিস্বত্বের উপর কাঁকড়ার দাঁড়া চেপে বসায়, খেতের জমি থেকে উচ্ছেদ হতে হয় তাদের ।

           মাধবের বাপ হলধর , বংশানুক্রমে ছিল মন্দিরের দণ্ডধারী পাইক । সেই সুবাদে হলধর সেবাইতের হাতে পায়ে ধরায় , তাদের সম্প্রদায়ের কুড়ি ঘরকে , লখে তরার পারের কয়াজানিতে থাকার সুবিধা করে দেয় , সাতদলায় তাদের ভাগের জমির রায়তিস্বত্ব ছেড়ে দেওয়ার শর্তে টিপসইও একটা দিতে হয় ।

              কয়াজানিতে এদের বসত তো হল, খেতের জমি কই ? চারদিকে তো শুধু ঝিল আর বিলের শান্ত জল । যদিও বছরে দুবার করে লখেতরাও অশান্ত হয় । হলধরের বাপ তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ । সে সবাইকে ডেকে বলে কথায় আছে যার ভাত তার মাত , আজ থেকে আমরা মৎস্যজীবী হলাম , খাল বিলকে জীবীকা করে নিলাম ।

           সেই সূত্রে ওরা কেওট, মাছুয়া ।

            হলধরের বুকে একটা গভীর কান্না ছিল । তার ছেলেমেয়ে বাঁচে না । কোনোটা গর্ভাবস্থায় , কোনোটা একমাস , প্রতিবারই কলাপাতায় জড়িয়ে , বুকের ধন লখেতরায় বিসর্জন দেয় । বয়স্ক দু – একজন বলে মাধা গোঁসাইর শাপ লেগেছে । পিতৃপিতামহের বৃত্তি ছেড়ে দেওয়ার জন্যই এই বিপত্তি ।

          হলধরেরও কথাটায় প্রত্যয় হয় । সেই থেকে টানা তিন বছর সে মণিকূট – এর পূজা করে । চতুর্থ বছরে হয় ছেলে , এ তো মাধা – গোঁসাইয়েরই আশীর্বাদ । তাই তার নাম রাখা হয় মাধব , মাধা । এরপর জন্মের একপক্ষও হল না , সুতিকায় ভুগে , বাচ্চাটিকে তৃষ্ণার অমৃত থেকে বঞ্চিত করে তার মা । লখেতরার পারে চিতার আগুনে হলধরের সংসার ফুটো হয়ে যায় । এখন সদ্যক্রন্দনরত শিশুটিকেই বা কে কোলে তুলে নেয় ! একটা বন্দোবস্ত হয় । সন্তানসন্ততিহীন ঘরের প্রথম শিশুটিকে গ্রামের যে – কোনো দোকানি বৌকে বেচে দেওয়ার প্রথা তাদের । মাধবজন্মের তিনদিনের দিন তাদেরই সম্প্রদায়ের কণ্ঠিবাই – এর কাছে বেচে দেওয়া হয় , নামেই বিক্রি , প্রথারক্ষা । হলধর এই লোকাচারটি রক্ষা করেছিল ।

            যখন কণ্ঠিবাই-এর কথাই উঠল , ছোটো করে বলে রাখি অন্য একটি কথা । বাইও যেন জীবনযন্ত্রণার একটি মাকু । মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো টকটকে লাল সিঁদুরের ফোঁটা পরেও সে স্বামীহারা । সুবিধাই হয় , কেন , বলছি সে কথাই । তিনমাসের এক ফুটফুটে সোনামণি মেয়েকে ছেড়ে স্বামী তার মুকালমোয়ার এক মহিলার মাচান ভাগ করতে যাবে বলে বেরিয়েছিল । সেই নিয়ে দুজনের মধ্যে কিছুদিন ধরেই বিস্তর কথা কাটাকাটি , ঝগড়াঝাঁটি । সহ্যের সীমা বেড়া ভাঙতেই, একদিন বাই রণচণ্ডীরূপ ধারণ করে , মাছকাটার বঁটি নিয়ে তাড়া করে স্বামীকে । মরদটাও বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে কোনোমতে ভীত হরিণের মতো দৌড়োল , তারপরে আর গাঁয়ে দেখা যায়নি তাকে । এক কোপে এক কলার মোচা কেটে সেদিন কণ্ঠিবাই বলেছিল, ঢেমনা – পু ।

         হলধরের বিষণ্ণ তথা আদ্র হৃদয়ের অবস্থা দেখে কণ্ঠিবাইদেউর চোখ ছলছল করে  । দূর সম্পর্কের হলধরকে সে মিমি বলে ডাকে । সে মাধা গোঁসাইয়ের নাম নিয়ে হলধরকে বাচ্চাটি দেওয়ার জন্য হাত পাতে । বলে – আমার বাচ্চাটি যা খাবে সেও খাবে । কালিয়ে গোঁসাই যশোদার দুধ খেয়েছিল যেমন ।

           কণ্ঠিবাইয়ের প্রসারিত হাত দুখানি মাতৃত্বের শুভ্র ও বিশ্বস্ত আশ্রয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । হলধর অনুভব করে তার বিধ্বস্ত জীবনকে যেন নতুন করে মহিমান্বিত করতেই এই প্রসারণ । শিশুটিকে ক্রমাগত চুম্বন করে , থেকে থেকে অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে বাইয়ের হাতে তাকে তুলে দেয় । বলে, জেনো এ আমার  আত্মা , তোমার অমৃতে যদি একে বঁচিয়ে তুলতে পারো তবে  তোমাকে মা বলেই ডাকব ।

             এরপরের কথা বললে শোক আঘাত দেবে, না বললেও দোষ কম হবে না । কণ্ঠিবাইয়ের দেবোপম অমৃত বাঁচিয়ে দেয় দুটি প্রাণীকে । বাসন্তী আর মাধব । বাসন্তী নিজের , মাধব হলধরের । ধূলায় ধূসর সুপুরি পাতার গাড়ি টেনে , ওরা কণ্ঠিবাইয়ের ভাঙা কুঁড়ের হাসিকান্না হয়ে ওঠে । এর মধ্যে একদিন ধরা পড়ে, বাসন্তী যেমন বকবক করে কথার মধু ঝরাতে পারে মাধব পারে না । কিছু একটা বলতে চাইলে সে মুখ তো খোলে , গোটা শরীরের বল প্রয়োগ করার পর ‘এ এ’ বলে দুটো শব্দ বেরোয় ।

              তার মানে ? এও কী মাধা গোঁসাইয়ের লীলা নাকি? জড়িবুটি ঔষধপত্র ঝাঁড়ফুক সবকিছু করেও হলধর মাধবের মুখ থেকে একবারও পিতা শব্দ বের করতে না পারায়, তেমন বয়স না হলেও শোকের আঘাতে মানুষটি অকালেই বৃদ্ধ হয়ে যায় । তার উপর জীবিকার জন্যও তার মহাযুদ্ধ । খালবিলের চুনোমাছ কী আর ক্ষুধার ভাত জোগাতে পারে ? এজন্যেই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই মাছধরার বৃত্তি ছেড়ে অন্য উপায় ধরেছে । পাঁচ – ছয় ঘর  মানুষ এখনো জাল খলুই –এর উপর নির্ভরশীল । সেই ক-ঘরের ভাত তো নয় ভাতের মাড়ের উপরও আরম্ভ হয় অন্য এক আক্রমণ । সত্রের পুরোহিতরা হলধরের থাকার সুবিধা করে দেয় কিন্তু খালবিলের অধিকার দেয়নি । কালক্রমে সেসব আধাসরকারি আধাদালালদের কুক্ষিগত হয়ে যায় । তারা আবার বছরে দুবার বিলের ডাক দিয়ে মহলাদার মহাজনকে ডেকে নেয় । তখন ভাটির দেশের বিপুল সংখ্যক মাছুয়া দিয়ে দুতিন দিনের ভিতর বিলের সব মাছ চেঁছেপুঁছে উঠিয়ে নেয় । হলধরের জন্য থাকে শুধু পুঁটি খলসের পোনা । এই নিয়ে ভাটির দেশের মৎস্যজীবীদের সঙ্গে হলধরের নিত্যি খটাখটি । মহলাদার রাগে তাদের উপর । গড়গরিয়ে বলে, আমি এখানে হরতন চিরতন খেলতে আসিনি , দস্তুরমতো টাকা ঢেলে বিল কিনেছি , শোল, সিংগি যা আছে সব আমার । জাল পাততে দেব না , দেখি কার এত  সাহস , যা যা গিয়ে পেতে আয় দেখি।

            একদিনের কথা । সূর্য পাটে যাওয়ার পর , হলধর ফিরছিল হাট থেকে । লখেতরা পেরিয়ে বিলের পার ধরে আসতে আসতে হঠাৎ চোখে পড়ে কচুরিপানায় ভরা খালের জলে মাছের খলবলানি । ভালো করে চেয়ে দেখে দুটো প্রকাণ্ড বোয়াল মাছ । হঠাৎ করে তার মনটা বড়ো উদাস হয়ে যায় । একবার বোবা মাধবকে সে মেডিকেলে দেখিয়েছিল । ডাক্তার অনেক যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করে হলধরকে উপদেশ দিয়েছিল বাইরের কোনো ভালো কণ্ঠ বিশেষজ্ঞকে দিয়ে দেখাতে । ডাক্তারের মতে টাকা জোগাড় করতে পারলে, তার কথা বলার সম্ভাবনা পুরো মাত্রায় আছে ।

             মাছ দুটোই হলধরের মনকে আশা আর উত্তেজনায় ভরিয়ে দেয় । সেই মুহূর্তে সে সবকিছু মনচাপা দিয়ে ঘরমুখো হয় । রাতদুপুরেই আসতে হবে , যেতে যেতে সে মনস্থির করে, মহলাদারের লোকজন রাতে পাহারা দেয় , ওদের লুকিয়েই আসতে হবে । এভাবে সর্বক্ষণ সে মাধা গোঁসাইয়ের নাম নিতে থাকে – প্রভু , মাছকটা যেন বেরিয়ে না যায় ।

         আষাঢ় মাস । সন্ধেবেলা থেকেই আকাশের মনভার । রাতেই শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড়--কথার শব্দ যায় না শোনা এমন খরবায়ু , গগন ব্যেপে মহামেঘের আন্দোলন । বিজুলি চমকে ক্ষণে ক্ষণে , লাগে ঝিকিমিকি আসি চোখের পলকে ... ।গাছপালা , দুঃখী মানুষের ভাঙা কুঁড়েঘর ভাঙচুর করে ঝড় শান্ত হয় যখন প্রভাত পাখির ডাক শোনা যায় । রক্তগোলা সূর্যও তখন মুখ তুলে তাকিয়েছে ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত গ্রামগুলির দিকে ।

           সেই সকালেই গ্রামের মানুষ খালের পারে আবিষ্কার করে হলধরকে , বুকে পিঠে অনেক জায়গায় বল্লমের ঘা । রাতের বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে রক্তের দাগ । তার ডান হাতের মুঠোয় ধরা দাখানিতে রোদ পড়ে ঝিকমিক করছিল শুধু । সত্যমিথ্যা জানি না, সেই সকালেই নাকি মাধবের মুখে প্রথমবারের মতো কথা ফুটেছিল । পি-পি-তা...পি-পি-তা । তারপর আর কোনোদিনই শোনা যায় নি । হয়ত লখেতরার ঢেউ –এ লখিন্দরের ভেলাখানি ভেসে যাওয়ার মতো তারও হৃদয়চাপা কান্নাগুলি , স্নেহের পিতা শব্দের সঙ্গে চিরদিনের জন্য চলে যায় । আর ফিরে আসে না ।

           এখন যদি বাসন্তীর কথা শুনতে চাও, তাহলে বলছি এই বেলা ---

           পিতার মৃত্যুর পর  জ্যাঠা এসে মাধবকে কণ্ঠিবাই দেউর কাছ থেকে নিয়ে যায়, বলে –আমার ওখানেই খার – পান্তা খাবে , বাড়ির কাঠকুটো , গরুছাগল দেখবে ।

            তার কথায় কণ্ঠিবাই মৃত্যুসম আঘাত পায় । বলে—আমি কী ওকে শুধু দুমুঠো খাইয়েছি মাত্র ? সে আমার কলজের একদিক হে, বাসন্তী যা সেও তা ।     জ্যাঠা বলে , তুমি দুঃখ কোরো না , হলধরের বংশে তেতো লাউ জাতে না জন্মায় তার জন্যেই নিতে এসেছি ... আর মাধা গোঁসাইও তো দৈবকীর কাছে এসেছিলেন , তা বলে কি যশোদা তার মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছিল ?

           পানের পুঁটলি বেঁধে কন্যা বিদায়ের মতো, কণ্ঠিবাই সেদিন মাধবকে জ্যাঠার হাতে তুলে দিয়েছিল । বলেছিল --- আজ থেকে আমার ঘর অন্ধকার ... যা বাপু যা নিজের ঘরে যা ...। দুয়ারের কোণে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল বাসন্তী । তাকে দেখে  বৃদ্ধ জ্যাঠারও দুগালের দুধারে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে । বলে, একটাই গ্রাম , একই মাঠ , একই নদীর ঘাট , আসা যাওয়া তো লেগেই থাকবে ...।

            থাকেও তাই । জীবিকার প্রয়োজনে কণ্ঠিবাই দিনের বেলা যায় দূরের হাটে , মাছের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ায় গ্রাম থেকে গ্রামে । তার মধ্যেই মাধবকে বলে যায় স্নেহের দুকথা , কখনো হাটের বিস্কুট, আর কখনো – বা বাসন্তীর হাত দিয়ে পাঠায় তার প্রিয় ব্যঞ্জন মাছের টকঝোল ।

           মাধব তো শুধু কথা বলতে পারে না , দেখা – শোনায় , স্বভাব – চরিত্রে সে অতি অমায়িক । কোঁকরা চুলের মুখখানিতে সর্বদা লেগে থাকে মধুময় এক অনির্বচনীয় হাসি । গ্রামবাসীর যে –কোনো প্রয়োজনে , যে –কোনো কাজে , পারুক না পারুক সে এগিয়ে যায় । গ্রামের মানুষও খুশি হয়ে তাকে কেউ দেয় গেঞ্জি নিমাগামছা , কেউ দেয় পুরোনো ছেঁড়া কোটজামা ।

           বাসন্তী তাকে দেয় সবচেয়ে প্রিয় বস্তু, একটি বাঁশি । রামদিয়ার মেলা থেকে কিনে আনে । নিজের জন্যও কেনে রংবেরং – এর কাচের চুড়ি । সে আজকাল মেখলা চাদর পরে । মা- ও খড়কুটো জড়ো করার মতো করে এনে দেয় গন্ধতেল , লাক্স সাবান , একজোড়ো , আয়না চিরুনি আর বাড়ির কোণে বানিয়ে দেয় সুপুরি পাতার বেড়া দেওয়া চানঘর ।

           বাঁশিটা পেয়ে সেদিন মাধব যেন এক ছেলেমানুষ । বাঁশির ফুঁ শব্দে সে ফিরে পায় তার কণ্ঠের ভাষা ।

ওদিকে মেলা থেকে ঘরে ফিরে বাসন্তীর অন্য বিপত্তি । বেছে বেছে সযত্নে কেনা চুড়িগুলি যে হাতে ঢোকে না । জোর করে ঢোকাতে গিয়ে দুখানা ভাঙে । মাকে বুঝ দিয়ে বলে, হাতে সাবান মেখে তবেই কাচের চুড়ি পরতে হয় , নইলে ভাঙে । পরদিন লখেতরার পারে বাঁশিতে ফুঁ লাগিয়ে ছাগলের পালের মাঝখানে বসেছিল মাধব । বাসন্তীও  উপস্থিত । বলে, ও মাধ, আমি হাতে সাবান ঘষছি , তুই আমার হাতে চুড়ি কটা পরিয়ে দে তো । এই বলে নদীর জলে হাত ডুবিয়ে , হাতে সাবান ঘষে , চুড়ি কটা মাধবের দিকে এগিয়ে দেয় । মাধবও ধরে পরাবে বলে চুড়িখানা নিতেই , হঠাৎ কী হল কীজানি , তার বুকের ভিতর বৈশাখ মাসের আকাশের মতো গনগনে হয়ে ওঠে । গোটা শরীরে কাঁপুনি তুলে এক বিদ্যুৎ চমক শিরশিরিয়ে যায় ।

            সে বাসন্তীর মুখে তাকাতেই মনে হয় , যেন সিঁদুরে পুঁটিমাছের মতো ঝলমল করছে ।

             চুড়িগুলিও পিছলে বাসন্তীর হাতে ঢুকে যায় । তার বাঁশিতে বিবাহগীতির সুর যেন উলু দিয়ে ওঠে --- ধান পাকে অঘ্রাণে, কোকিল ডাকে ফাগুনে --- সখি হে ... ।

         নতুন জলের ঢেউ খেলছে লখেতরায় । শ্রাবণে সে গর্ভবতী হবে । ফেনায় ফেনায় ঢল নেমেছে , দুকুলপ্লাবী বর্ষার রণচণ্ডী ।

        শোনো বলছি, এবার সেই রাতের কাহিনি ।

         কণ্ঠিবাই রাতের ভাত বেড়েছে । এমন সময় দরজায় কে যেন ডাকে, মাগো দরজাটা খোলো । অচেনা কণ্ঠস্বর । কণ্ঠিবাই আর বাসন্তীর বুক মোচড় দিয়ে ওঠে । সাহসে বুক বেঁধে বাই অর্ধমৃতের মতো বলে, কে ?

            মা আমি, দরজাটা খোলো । উত্তর আসে ।

            বাসন্তীও ভয় পায় । মায়ের হাত চেপে ধরে । বাই লম্ফটা উঠিয়ে দরজায় হুড়কো খুলে সামান্য ফাঁক করে দেখে ---একজন অচেনা সুঠামদেহী যুবক ।বাপু, তুমি কে? বাই বলে । দেখ আমাকে ভিতরে যেতে দাও, বলছি--- যুবকটি সামান্য ঠেলেই ভিতরে ঢুকে এবং দরজা বন্ধ করে দেয় । বাই দেউর হাতের লম্ফটি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয় । বাই আর বাসন্তী ভয়ে কাতর হয়ে অন্ধকার একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ।

             যুবকটি বলে, মা ভয় পেয়ো না , তোমার ভালোর জন্যই আমি আলো নিভিয়েছি । পুলিশ আমায় খুঁজছে । আজ তিনদিন কিছু খাইনি , এক গ্রাস ভাত দেবে মা, কথা দিচ্ছি ভাতটুকু খেয়েই আমি চলে যাব । যুবকটি প্রায় এক নিশ্বাসে কথাকটি বলে।

        বাইদেউর তখন মনে পড়ে গ্রামে মাছ নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে যে কথাগুলি সে শুনছে সব মিথ্যা নয় । কিন্তু লম্ফ না জ্বালালে তোমাকে ভাত বেড়ে দেব কী করে ? বাই আগের ভয় কাটিয়ে যুবকটিকে বলে ।

           না মা, যুবকটি বাধা দিয়ে বলে, তোমার ভালোর জন্যই লম্ফ জ্বালাতে দিচ্ছি না , যদি পারো অন্ধকারেই হাঁড়ি থেকে যা আছে তুলে দাও দুমুঠো ।

            নিরুপায় মায়ে ঝিয়ে অনুমানে নিজের বাড়া ভাতের থালা থেকে একখানা এনে যুবকের হাতে দেয় । বাই বলে, দেখ বাবা আমরা কিন্তু ডোম চাঁড়াল মানুষ  ।

            বড়ো তৃপ্তির সঙ্গে ভাতের দলা মুখেদিয়ে যুবকটি বলে, মায়ের কোনো জাত থাকে ? এসব পুরোনো চিন্তাধারা দূর করতেই আমরা নিজের মাকে ছেড়ে সব মাকে মাতৃজ্ঞান করছি ।

            অন্ধকারে যুবকটির ভাত খাওয়ার শব্দ বাইয়ের বুকে বাজে , আদ্র হয় মন । বাই ভাবে কার জানি আদরের ধন, কার হাতে অন্ধকারে খাচ্ছে ভাত, দেশে এ – কোন অপদেবতার ভর হল যে পেটের ছেলেও নিজের মাকে মা ডাকতে পারে না । ছেলেটির ভাত খাওয়া শেষ হয় । বাসন্তী হাতে জলের ঘটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । মায়ের হাতে দিতেই মা আঁধারের মধ্যে ঘটিটি যুবকের দিকে এগিয়ে দেয় ।

           ঢকঢক করে জলপান করে সে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় । মা, আজ তোমার ভাতের গরাসটি আমাকে শতায়ু করে দিল । যদি বেঁচে থাকি একদিন আলোকে আসব । এই বলে অন্ধকারেই বাই দেউর চরণ ছুঁয়ে প্রণাম করে সে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ।

           বিস্ময় বিমুড় হয়ে বাই শুধু মনে মনে বলে, বাবারে , তোকে মাধা গোঁসাই রক্ষা করুন ।

             সেই রাতের কথা বলছি, যে – রাতে শিয়াল – কুকুরের তীক্ষ্ণ চিৎকার কণ্ঠিবাই আর বাসন্তীর ঘুম কেড়ে নিয়েছিল । বাতাসের এক তীব্র আন্দোলনের মতো ঘটনাটি তাদের মনে এমন এক ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল, যেন সে – রাতেই লখেতরার পার ভাঙবে ।

          তখনই গ্রামের অন্যদিক থেকে কেউ এক ঘরের চালার উপর উঠে চিৎকার করে জানায় , অজ্যাঠা মিলিটারি ... ওঠো ... ডিমুহু ওঠো... ।

         হঠাৎ অন্ধকার  আকাশকে নস্যাৎ করে ফুটে উঠেছিল অনেক গুলি, গুলির শব্দ।

           ঠকঠক করে কাঁপছিল মাধা । সেই মুহূর্তে শিশুর ক্রন্দন, নারীপুরুষের আর্তচিৎকারে গ্রামখানি যেন সৃষ্টি ধ্বংসের কালরাত্রির মুখোমুখি ।

          লখেতরার পাড় ভাঙার শব্দের থেকেও ভয়ানক । ঝড়ের গর্জনের থেকেও গগনভেদী সে – রাতেও আর্তনাদ ...।

          কুঁড়েঘরের চালে টুপটাপ করে পড়তে থাকা বৃষ্টি – ফোঁটাগুলির মতো গ্রামবাসীর নিঃশব্দ রাতও একটু একটু করে শেষ হয় ।

       কিন্তু কার জন্য এই ভোর ? একজন যুবতি, একজন নারী , একজন মায়ের রূপেই তাঁকে তুমি মহিয়সী করো না কেন , বিশাল এই রাজনীতিশাস্ত্র বাসন্তীকে কোনরূপে বন্দিত করবে, গরিয়সী করবে ? সভ্যতার শত আঁচড়ে ধর্ষিতা বাসন্তীকে ? সেই সকালে বাসন্তীকে চিতার আগুনে জ্বলে লখেতরার পাড়ে । রাগ ক্ষোভ , জীবনের চিরবিচিত্র অশ্রুজ্বলে স্নান করে মাধব সেদিন হাতের বাঁশিটা লখেতরার জলে ছুঁড়ে ফেলে । ঢেউ –এর উপর উঠে বাঁশিটাও যেন সেদিন গেয়ে ওঠে ঃ

স্নেহময়ী মা আমার , আমায় রেখো
জীবন দিয়ে পূজিব তোমায় সারাটা জীবন
স্নেহময় মাধা আমার, আমায় রেখো
কত স্বপ্ন বুকে আছে তোমার সঙ্গে
সেই গ্রামখানিতে রেখো আমায়
কন্যা করে বধূ করে ...
তখন সজল কবুতরটি দুঃখের করুণ সুরে ডাকে, কু কু কু কুউ- কু । লখেতরার অন্যপার থেকে কণ্ঠিবাই ডাক পাঠায় --- এই মাধা , বাবারে ফিরে আয়  , সন্ধ্যা হল ।

  

                       

শনিবার, ৭ জুন, ২০১৪

বিদায় বন্ধু, বিদায়...

(C)Image: ছবি
পুদা, তোমাকে একটা গ্রুপে জয়েন করার জন্য রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছি, পারলে একবার দেখ”। আমার থাকা তখন বাঙ্গালোরে আর সময়টা  সম্ভবত দুই হাজার দশ সালের মাঝামাঝি। আমি “ঠিক আছে” বলে ফোন টা রেখে দেই। ফেসবুকের জগতে আমার বয়স তখন দেড় কি দুই হবে আর ইহ জগতের বয়স নাই বা বললাম। যাই হোক টানা পাঁচদিনের কর্ম ব্যস্ততার পর উইকেন্ডের এক বিরাট অংশ থাকত ফেসবুকের নামে। উইক ডেজ গুলোতে যে থাকত না এমন না, খুবই কম আর তাই সপ্তাহের ওই ছুটির দুদিন যেন একেবারে ওয়কফ থাকত ফেসবুকের জন্য।

            “বন্ধু, এ সোসিও লিটারারি গ্রুপ”, জাহিরের পাঠানো গ্রুপটার নাম দেখে বেশ ভালই লাগলো। অনেক ধরণের গ্রুপের ছড়াছড়ি তখন ফেসবুকে, তাই জাহিরের সেদিনের ফোনে আমার তখন ততটা উৎফুল্লতা আসেনি যতটা ভাল লেগেছিল গ্রুপ টা দেখে। বেশ ছিমছাম ছোট্ট একটা গ্রুপ, আমায় নিয়ে বোধহয় গ্রুপের সদস্য সংখ্যা পাঁচ কি ছয় হবে। সবাই কবিতা লেখে, গল্প করে আর মোটামুটি সবই শিলচরের। একটা মুচকি হাসি ছাড়া আর কোন কার্পণ্য করিনি বন্ধুতে যোগ দিতে। আর সেই শুরু এক স্বপ্নের পথ চলা। বিদেশ বিভূঁইয়ের এক ঘেয়েমি জীবনে “বন্ধু” কখনও তরমুজের লাল ডগা তো কখনও গরম গরম ভাজ্জি, পকোড়া। শতদল দা (শতদল আচারজী), গৌরব (গৌরব চক্রবর্তী), চন্দ্রানি (চন্দ্রানি পুরকায়স্থ), অয়িঋদ্ধি (অয়িঋদ্ধি ভট্টাচার্য), জাহির (জাহির জাকারিয়া) আর ধীরে ধীরে আসা নতুন কিছু বন্ধু নিয়ে সে এক জমজমাট আড্ডা। প্রায় রোববারে বসত কিছু বিশেষ আড্ডা, কখনও ছড়ার, তো কখনও কবিতার, আর মাঝে মাঝে গল্পের। “আগামী রোববার সকাল দশটা থেকে ছড়ার আড্ডা থাকলে কেমন হয় বন্ধুরা?”, গৌরবের এমন উদ্যোগমূলক স্ট্যাটাসে সবাই বুঝে যেত যে এক জমজমাট আড্ডায় আসছে রোববার হবে পার। আর যে যার জায়গা থেকে নানান কমেন্ট আর লাইক দিয়ে যে সেদিনই এক আড্ডার সূচনা করে দিত তাঁর খেয়াল হয়ত হতো কিছুটা পরে।  আমি দশটার ট্রেন ধরব বলে দুদিন আগে থেকেই মনে মনে প্রস্তুত থাকতাম, আর আড্ডার দিন নির্ঘাত মিস হতো আমার রাইট টাইমের ট্রেন। এক ঘণ্টা পরে যখন আমি আড্ডায় যোগ দিতাম, তখন দেখতাম ট্রেন তাঁর নির্দিষ্ট প্যাসেঞ্জার নিয়ে মোটামুটি গতিতে এগিয়ে চলছে। দেরীতে আসার একটা অনুনয় সূচক ছড়া দিয়ে যখন ট্রেনে চাপতাম তখন আড্ডার গতি টা হঠাত ই দিক পরিবর্তন করে আমাকে কেন্দ্র করে নিত। আর আমি এই ফাঁকে এ অব্ধি আসা সফরের মোটামুটি গ্যান নিয়ে নিতাম।  তারপর আর আমাদের থামায় কে? একের পর এক ছড়া, টিপ্পনী আর কিছু অকৃত্রিম অদ্ভুত ভালোলাগা মিশ্রিত হরেক রকমের মিষ্টি মুচকি হাসিতে দুপুর গড়িয়ে কখন যে শেষ বিকেলে পৌঁছুত আমাদের আড্ডার ট্রেন টেরই পাওয়া যেত না।

            আমাদের এরকম অনেক আড্ডার এক মধ্যমণি ছিল যার লেখালেখি থেকে বেশি আগ্রহ ছিল আমাদের লিখা ছড়া, কবিতা গুলো পড়ার আর  আমাদের উৎসাহ বাড়িয়ে দেবার। সে নিজে লিখতনা ঠিকই কিন্তু আমাদের লেখালেখিতে আপাদমস্তক নজর থাকত তাঁর। আমার ছড়াগুলোর প্রতি তাঁর একটা আলাদা ভাব ছিল। প্রায়ই আমার ছড়ার তারিফ করত ফেসবুক মেসেঞ্জারে। মাঝে মাঝে আড্ডায় ওকে না পাওয়া গেলে আমরা সবাই বলাবলি করতাম ওর কথা। পরে সে নিজেই জানান দিত তাঁর অনুপস্থিতির কারণ। কখনও ইউনিভার্সিটির কোন এসাইন্মেন্ট নিয়ে ব্যস্ত তো কখনও দুপুর বেলায় মায়ের সাথে আলুর দম নিয়ে। খাবার দাবার নিয়ে আমাদের মাঝে প্রায়ই বেশ গম্ভির আলোচনা হতো। আমি রোববারের দুপুরের মাসিমার হাতের রান্না আর নানান ব্যঞ্জন শুনে সুদুর বাঙ্গালোর থেকে জিভে জল আসার কথা বলতে ও বলত শিলচর এলে একবার ওদের ঘর ঘুরে যেতে। আমি মাঝে মাঝে আপনি বলে সম্ভোদন করলে ও বিরক্ত হয়ে বলত, “দাদা, তুমি আমাকে “তুমি” বলেই ডাকবে”। এভাবেই বেশ একটা মিষ্টি সম্পর্ক ছিল আমাদের মাঝে। ও ছড়া ভালোবাসতো তাই মাঝে মাঝে আমি ছন্দে ওর সাথে কথা বলতাম, যখন ছন্দালাপ দীর্ঘ হয়ে যেত তখন ও বলত, “দাদা, আর পারছিনে”, আমি তখন অনেক কষ্ট করে আমার ছন্দের ভেলায় ব্রেক কষতাম। দেখতে দেখতে বন্ধুতে আমার বয়স বছরে গড়ালো, “বন্ধু” আর বন্ধুর এ’কজন বন্ধু হয়ে ওঠলো আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ফেসবুকে লগিন করেই বন্ধুর পেজে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধুতে বন্ধুদেরে নিয়ে। এ যেন এক মায়াপুরি, কিছুতেই বেরিয়ে আসতে চাইতো না মন। অফিসে গেলেও মন লেগে থাকত বন্ধুতে। বাঙ্গালোরের দিন গুলো এভাবেই কাটতে থাকলো।

তারপর এক মার্চের দুপুর নিয়ে এলো আমার জীবনের এক অবিশ্বাস্য দুঃখের সংবাদ। আমার একমাত্র বোনের মৃত্যুর খবরটা মুহূর্তের মধ্যে এলোমেলো করে দিল আমাদের জীবনটাকে। ফ্লাইট মিস করে শেষবারের মত একবার দেখতে ও পারিনি বোনটাকে। পরের দিন সন্ধায় যখন বাড়ি পৌঁছই ঘর ভর্তি আত্মীয়ের সমাগম আর তারই মাঝে আমার মা ড্যাব ড্যাব চোখে উপরের দিকে তাকিয়ে আছেন। সপ্তা দুয়েক পরে কাজের উদ্দেশে আবার বাঙ্গালোর পাড়ি দিতে হল। সবকিছু কেমন অবিশ্বাস্য লাগছিলো। অফিসে প্রায়ই কান্না আসতো, একা একা কাঁদতাম। কলিগ রা দেখে সান্ত্বনা দিতে আসতো। ঘরে ফিরে বন্ধুতে ডুবার চেষ্টা করতাম, কিন্তু সেখানেও বার বার বোনের কথা মনে পড়তো। ফেসবুকের বন্ধুদের সেই  অ-কবি মধ্যমণি আমার দুঃখের সংবাদ টা শুনে সেদিন ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলো। সে ও ছিল দু ভাইয়ের মাঝের বোন। আমাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই অশান্ত হয়ে পড়তো, আমার মায়ের কথা চিন্তা করতো, তিনি কি করছেন। তাঁর কি হবে এসব। ধীরে ধীরে সময় গড়াতে থাকলো, আমার বাঙ্গালোরের জীবনে ইতি টেনে আমি এক নূতন শহরে, নূতন এক কোম্পানিতে। কোম্পানির গেস্ট হাউসে হপ্তা খানেক থেকে বের হলাম ঘর খুঁজতে। আর ছ বছরে এই প্রথম আবিষ্কার করলাম পৃথিবীটা কত গরম হতে পারে আর তাঁর থেকে কত চরম হতে পারে এমন গরমে থাকার জন্য একটা ঘর বের করা। যাইহোক মাদ্রাজে শেষ পর্যন্ত একটা ঘর জোগাড় হল আমার। নতুন শহর, নতুন ঘর, নতুন ভাষা, সবকিছুই নতুন। আর এই নতুনের ভিড়ে বারবারই পুরনোদের কথা মনে আসতো। মাদ্রাজে প্রায় মাসদিন পর ইন্টারনেট কানেকশনের ব্যবস্থা হল আর লগিন করেই সোজা বন্ধুতে আর গিয়েই আমার সেই আড্ডার মধ্যমণি। ওকে পেয়ে সেদিন কি খুশি। প্রান খুলে কথা হল ওর সাথে। মাদ্রাজে গিয়ে এই প্রথম যেন একটা সস্থির শ্বাস ফেললাম। ধীরে ধীরে আবার সব বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ হল। জীবনটা ধীরে ধীরে সহজ হতে লাগলো।

           তারপর অনেক গল্প আমার জীবনে, সে না হয় আরেকদিন বলা হবে। সেদিন আবার ও হঠাত করে জাহিরের ফোন। আমার থাকা তখন করিমগঞ্জে। “অপুদা, একটা দুঃখের সংবাদ দিতে তোমাকে ফোন করেছি, অয়িঋদ্ধি দি আমাদের মাঝে আর নেই”। আমি নির্বাক কিছুক্ষণ থেকে জাহিরের কাছে শুনতে পেলাম ওর রোগের কথা। বাড়ি ফিরে মাকে বললাম। আর মা সারাটা দিন বার বার ভাবছিল ওর মায়ের কথা, ওর ঘরের প্রতিটি কোনে ওর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কথা, ঘরময় মা’র মেয়ের লেগে থাকার কথা। মায়েরা এমনই হয়, ওদের কলেজা রক্তাক্ত হয় এমন ঘটনায়। আর আমার মত ভায়েরা দিশেহারা হয় এমন বোনের বিচ্ছেদে।

           পৃথিবীতে এমন শত শত ঘটনা আকসারই হচ্ছে, কিন্তু এমন কষ্ট বঝে শুধু তাঁরাই যাদের সাথে এমন হয়। আফসোস  আমরা যদি বুঝতাম বা বুঝার চেষ্টা করতাম যে আমরা কেনই বা এলাম, করছিটা বা কি আর যাবোটাই বা কোথায়।

শুক্রবার, ৬ জুন, ২০১৪

নন্দিনী,তোকে...

(C)Image:ছবি















।।দেবলীনা সেনগুপ্ত ।।

ন্দিনী,তোর মনে পড়ে
শীত-মাখা রোদে
হেসে ওঠা সেই মাঠ - উঠান?
আচার –বড়ির গন্ধে মেশানো
নতুন বইয়ের সুঘ্রাণ?
সেই স্কুলবেলা
হুটোপুটি খেলা
হেসে কুটিকুটি অকারণ?
লাল-চোখ বা
লাল পেন্সিল
মন মানে না কোন বারণ।
নীল আকাশে
নিঃশেষে ওড়ে
পেটকাটা বা চাঁদিয়াল-
ভো-কাট্টা হলেই
ছুট্টে গিয়ে ধরি
পার হয়ে যাই ঘর-দেয়াল।
পরীক্ষা-শেষে
পুতুলের বিয়ে
ঘাস-পাতার বনভোজ,
মাঝে মাঝে আড়ি
খুনসুটি ভারি
আর সরস্বতী পূজোয় সাজগোজ।

জানি আজ তুই
মহা কেউকেটা
টিভি তে দেখি মুখ তোর,
জ্বলজ্বলে আলো
রঙ জম্‌কালো
তার পিছে তবু ব্যথা ঘোর..
তোর চোখ দেখে
আমি বুঝি নন্দিনী,
আমার মত তুইও ভালো নেই...
কত কিছু আছে
আমাদের কাছে
মন তবু আর হাসে কই?
অধরা সেই
সোনার খাঁচার
চাবি যে গেল হারিয়ে
নানারং যত
দিন সব মোর
তাতে রইলো না পোষ মানিয়ে
এখনও আকাশে
মেঘ করে আসে
বৃষ্টিও পরে রুমুঝুম্‌-
রামধনু শুধু
হারিয়ে ফেলেছে
রঙের বাহার—বিল্‌কুল.
বড় ইচ্ছে করে
তোর হাত ধরে
ফিরে যাই সেই স্মৃতিতে,
টুক্‌রো-টুক্‌রো
ছেলেবেলা দিয়ে
মালা গাঁথি বসে দুটিতে...।

বৃহস্পতিবার, ৫ জুন, ২০১৪

কেন?

(C)Image: ছবি
।।দেবলীনা সেনগুপ্ত ।।

          তখন গোধূলি।শেষ বিকেলের সূর্য আকাশে আগুন জ্বালিয়ে শরাইঘাট সেতুর ওপারে লুইতের বুকে লাল রঙ গুলে আস্তে আস্তে লুকিয়ে পড়ছিল। ভরলুমুখের লুইতপারের শঙ্করদেব উদ্যানে দাঁড়িয়ে সেদিকে নির্নিমেষ তাকিয়েছিল নীলাব্দ। শেষ অক্টোবরের  নদীতীরের সান্ধ্য হাওয়ায় শীতের শিহরণ।তা সত্ত্বেও নীলাব্দের গরম লাগছিল-এ উত্তাপ তার বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা অনন্ত শোকাগ্নির।

     -‘বর ধুনীয়া নহয়?’

    সামান্য চমকে তাকাল নীলাব্দ। এক বর্ষীয়ান শিল্পী লুইত তীরে বসে ক্যানভাসে তুলি বুলিয়ে ফুটিয়ে তুলছে অস্ত- সূর্যের আগুন।

  -‘লুইতর বুকুত বেলি মার গইছে। রঙচুয়া আকাশর মাজত রঙা বেলি যেন বিজয়া দশমীর দিনা সেন্দুর খেলি অহা কোনোবা রাঙলী তিরোতা।ইমান উজ্জ্বল আরু কোমল...’

    নীলাব্দ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে।প্রকৃতির সৌন্দর্যে মন্ত্রমুগ্ধ শিল্পীকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠতে পারে না –‘না, আকাশের আগুনের মধ্যে আমি শুধু দেখতে পাই দাউদাউ প্রজ্জ্বলিত চিতা- নির্মম, নিষ্করুণ, আগ্রাসী- যা এক্ মুহূর্তে আমার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ অস্তিত্ত্বকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।’

     নির্বাক নীলাব্দ সরে যায় সেখান থেকে।শিল্পী মানুষটির শৈল্পিক চেতনে হয়ত ধরা পড়ে নীলাব্দের প্রত্যুত্তরহীন মানসিক চঞ্চলতা।এক মুহূর্ত নীলাব্দের ফেলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে নিজের রঙের আর সৃষ্টির জগতের মধ্যে মগ্ন হয়ে যান তিনি।

    ধীর পায়ে হেঁটে এসে নীলাব্দ বসে পড়ে পার্কের বেঞ্চে। লুইতের জলে অস্তরাগের আবহে ঘরে ফেরা পাখীদের কলকাকলি তার কাছে অগ্নিদহ মানুষের আর্তনাদের মত মনে হয়। মনে মনে দুহাতে কান চেপে ধরে সে। কর্ণকুহরের বধিরতা সেই মুহূর্তে তার একমাত্র অভিপ্রেত হয়ে ওঠে। অন্তর্দাহের বাষ্প ঘনীভুত হয়ে দৃষ্টিকে ঝাপসা করে তোলে কিন্তু তরল জল হয়ে গ’লে পড়তে পারে না। শুধু তীব্র জ্বলন অনুভুত হয় দুচোখে।

         প্রায় ছমাস পরে প্রবাসের ছাত্রাবাস থেকে গতকালই গুয়াহাটির বাড়ীতে এসে পৌঁছেছে সে। পিতৃ – মাতৃর চতুর্থ  বার্ষিক প্রয়াণ দিবসের শ্রাদ্ধশান্তির কর্তব্য সম্পাদন করতেই কদিনের জন্য তার বাড়ীতে আসা।শ্রাদ্ধ-পর্ব শেষ হতে হতে দ্বিপ্রহর গড়িয়ে গিয়েছিল। আত্মীয়-স্বজনেরা সন্ধ্যায়  নাম- কীর্তন প্রসঙ্গের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু নীলাব্দের তীব্র আপত্তিতে তা নাকচ হয়ে যায়। ভারাক্রান্ত হৃদয়ের অশ্রু দিয়ে তো সে যথাসাধ্য তর্পণ সম্পূর্ণ করেছে সেই হতভাগ্য জনক-জননীর, যারা তীব্র পৈশাচিক উন্মাদনার শিকার হয়ে, নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করে অকালে, অসময়ে, হৃদয়- মনের সমস্ত অপ্রাপ্তি আর অশান্তি নিয়ে, একমাত্র সন্তান কে অসহায় অনাথ অবস্থায় ফেলে রেখে ইহজগত ছেড়ে যেতে বাধ্য  হয়েছিল। কোন চিৎকৃত শব্দমুখর পরিবেশ সেই অতৃপ্ত  বিদেহী আত্মাদের শান্তি – বিধান করতে পারবে না বলেই তার দৃঢ় বিশ্বাস। তাই শ্রাদ্ধবাসরে পুরোহিতের সুউচ্চ মন্ত্রোচ্চারণও তার অসহনীয় লাগছিল – অবান্তর অর্থহীন বোধ হচ্ছিল সমস্ত নীতি-প্রথা-নিয়ম। তীব্র এক হাহাকার তার বুক ফাটিয়ে গলা চিরে একটিমাত্র শব্দ নিয়ে আছড়ে পড়তে চাইছিল- কেন ? কেন ? কেন ?

     গুয়াহাটির ব্যস্ততম অঞ্চল গণেশগুড়ির বিধায়ক আবাসের পেছনে একটি ছোটো আসাম টাইপ ভাড়া বাসায় নিশ্চিন্তে কৈশোর অতিবাহিত করছিল নীলাব্দ মা বাবার সঙ্গে। বাবা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের আধিকারিক। মা গৃহবধূ – হাস্য মুখী, সদাতৃপ্ত, মায়াময় । ছোটো থেকেই অন্তর্মুখী স্বভাবের নীলাব্দ ছিল মা – অন্ত প্রাণ । বাড়ী থেকে বেরোনোর সময় আর বাড়ীতে ফিরে এসে মায়ের মুখ না দেখলে সে নিতান্তই অস্থির হয়ে উঠত। রাতেও মায়ের পাশটিতে শুতে না পারলে তার নিশ্চিন্তের ঘুম হতো না ।এ নিয়ে কম হাসি বিদ্রূপ সহ্য করতে হয়নি তাকে ।কিন্তু সে নাছোড়। মা নইলে তার পড়াশোনা, সাজসজ্জা, পোশাক –আশাক কিছুই মনোমত হত না। আবার রান্না ও গৃহকর্মে সে ছিল মায়ের সহকারী ও সাথী। এসবই চার বছর আগের কথা। তার বাবা ব্যাঙ্ক থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে একটি বাড়ী তৈরি করছিলেন। নীলাব্দ তখন বারো ক্লাসের ছাত্র। পুজোর মুখে বাড়ীর কাজ প্রায় শেষ। নতুন বাড়ীর গৃহপ্রবেশ, অন্দরসজ্জা ইত্যাদি নিয়ে নিত্যনতুন জল্পনা কল্পনা ছিল তাদের তিনজনের প্রাত্যহিক জীবনের এক সুখবিলাস। নীলাব্দের বারো ক্লাসের  পরীক্ষা যেহেতু ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে অনুস্থিত হওয়ার কথা তাই তার মা চাইছিলেন ডিসেম্বরের বড়দিনের আগেই গৃহপ্রবেশের পূজাকর্ম সম্পন্ন করে ফেলতে।তাহলে পরবর্তী দুমাসে বাকী কাজ শেষ করে ছেলের পরীক্ষার পরে পরেই তারা নতুন স্বগৃহে স্থানান্তরিত হতে পারবেন। সেই মতে আলাপ আলোচনা করে ২ রা ডিসেম্বর গৃহপ্রবেশের দিন ধার্য হয়েছিল।

    উৎসবের মরশুমে সময় যেন দ্বিগুণ গতিতে দৌড়য়। দুর্গাপূজা, কালীপূজা সব শেষ। সেদিন ছিল ৩০ শে অক্টোবর। ভাইফোঁটা। নীলাব্দের একমাত্র মামা শিলচর থেকে এসে পৌঁছবেন বিকেলে,বোনের কাছে ফোঁটা নিতে। নীলাব্দের মা তাই মহাব্যস্ত। সকাল সকাল গৃহকর্ম সেরে দশটা নাগাদ তৈরি হয়ে নিলেন স্বামীর সঙ্গে বেরোনর জন্য।স্বামীর অফিস যাওয়ার পথে দুজনে গনেশগুরি থেকে দাদার জন্য ভাইফোঁটার উপহার, নতুন বাড়ীর জন্য পর্দা ও সোফার কাপড় এবং কিছু টুকিটাকি বাজার সেরে ফেলবেন,সেরকমই ইচ্ছে। নীলাব্দ ও সঙ্গ ধরতে চাইছিল।কিন্তু স্কুটারে তিনজন বসার অসুবিধে, তাছাড়া তার আসন্ন পরীক্ষার প্রস্তুতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে মা তাকে নিরস্ত করেছিলেন। বাধ্য ছেলে নীলাব্দ মেনে নিয়েছিল মায়ের যুক্তি। ঠিকই তো , পূজোর ডামাডোলে কদিন পড়াশোনাতে ঢিলে পড়েছে।তারপর আজ তো সন্ধে থেকেই মামার সঙ্গে খোসগল্প হবে,আবার দুদিন পরেই গৃহপ্রবেশের পুজা...... না এইফাঁকে পড়োশোনা এগিয়ে রাখাই ভাল।

         মা-বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পর সদর বন্ধ করে পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের জগতে তলিয়ে যায় মনোযোগী ছাত্র নীলাব্দ। ফিজিক্স,কেমিস্ট্রি,অংক,ইংরাজীর পাতায় পাতায় নিবিষ্ট হয়ে পড়ে। অকস্মাৎ এক তীব্র কান ফাটানো শব্দে আমূল কেঁপে ওঠে সে। ক্ষণিকের বিমুঢ়তা কাটিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ভয়াল শব্দটির কার্য – কারণ ও উৎসস্থল। সদর খুলে বাইরে আসে।চোখে পড়ে কিছু বিভ্রান্ত ও উদভ্রান্ত মুখ।ছুটপায়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে ওঠে সে।সেখান থেকে শুধু দেখা যায় গল্ গলিয়ে ওঠা কালো ধোঁয়া আর আগুনের হল্কা। মৃদু কোলাহল,আর্তনাদের শব্দ বুঝে উঠতে চেস্টা করে সে। সব কিছু ছাপিয়ে আচমকা বেজে ওঠে অগ্নিনির্বাপক গাড়ীর বিপদ ঘণ্টা আর পুলিশের তীক্ষ্ণ বাঁশি। আরও একবার আমূল কম্পিত হয় সে। আতঙ্ক আর আশঙ্কা তাকে ছাদ থেকে ঠেলে পাঠায় নিজের ঘরে। কাঁপা  হাতে সেলফোনের মধ্য দিয়ে পৌঁছে যেতে চায় মায়ের কাছে,বাবার কাছে, কিন্তু না... শতবারের চেষ্টাতেও সংযোগ ঘটাতে পারে না প্রিয় ও পরিচিত নম্বর দুটিতে।

        দ্রুতহাতে টেলিভিশন চালায় সে এবং তারপরেই ব্রেকিং নিউজ দেখে স্তম্ভিত বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে বিপন্ন ও অসহায় কৈশোর।তার মন জনক জননীর কাছে ছুটে যেতে চায়। পরক্ষণেই তাঁদের উদ্বিগ্ন মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে তার মানসপটে। তাঁরা যে বাড়ীতে ফিরে এসে একমাত্র সন্তানকে না দেখতে পেলে অত্যন্ত আশঙ্কিত হয়ে উঠবেন। নিজেকে ঘরের ভেতর বন্দী রাখাই স্থির করে সে এবং অতঃপর টেলিভিশনের রিমোট ও সেলফোনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে তার আঙ্গুল-জনক জননীর কুশল সংবাদের আশঙ্কায়........

    এভাবেই কেটে যায় বহু পল অনুপল। ঠিক কতক্ষণ পরে তার মনে নেই, প্রতিবেশী যুবকের সশব্দ উপস্থিতি তাকে চকিত করে তোলে। এবং তার পরেই সে পায় সেই নিদারুণ সংবাদ- গণেশগুরিতে বিস্ফোরিত বোমায় সে পিতৃহীন হয়েছে এবং তার মাকে গুরতর আহত ও আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসালয়ে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তার সমস্ত অনুভূতি যেন বোধশূন্য হয়ে যায়। মস্তিষ্কের কোষে  কোষে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে ছড়িয়ে পরে একটাই শব্দ- কেন ? কেন ? কেন ?

           একে একে নিকট  আত্মীয়জন, পরিচিত প্রতিবেশীতে ভরে ওঠে তাদের ছোটো দু-কামরার বাসাবাড়িটি। এত লোকের মাঝে থেকেও এক নিঃসঙ্গ দ্বীপের মত বোধ করে সে। তারপর যন্ত্রচালিতের মত তাকে নিজকর্তব্য করে যেতে হয়। পুলিশ-প্রশাসন-আইনের নিরাপত্তাজনিত অসংখ্য নিয়মাবলী ও নির্দেশ অনুসরণ করতে হয় তাকে, চরম নিরাপত্তাহীনতায় পুড়ে ঝলসে যাওয়া পিতৃদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের টুকরোগুলিকে ফিরে পেতে, তার সৎকার কার্য সম্পন্ন করতে। এসব শেষ করার পরেই সে সময় পায় এবং তাকে নিয়ে যাওয়া হয় তার মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের কাছে। I.C.U  র ছোট্ট জানালা দিয়ে নীলাব্দ দেখতে পায় বহু যন্ত্র সংলগ্ন মায়ের নিথর দেহটি- সেখানে প্রাণের স্পন্দন আছে  কি নেই বুঝে উঠতে পারে না তার ক্লান্ত, শ্রান্ত মস্তিষ্ক। চারপাশে দু চোখ বুলিয়ে  কি যেন খোঁজে সে। হয়ত একটু  আশ্রয়, একটু আশ্বাস। পরমুহূর্তেই দুচোখে প্লাবন নামে। অশ্রু হয়ে গলে গলে পড়ে তরল আগুন, বাবার জন্যে,মায়ের জন্যে অথবা নিজের জন্যে! অনেকক্ষণ কান্নার পর যখন সে বুঝতে পারে কোনো প্রিয় পরিচিত কোমল স্নেহস্পর্শ তার কান্না মোছাতে এগিয়ে আসবে না, নিজে নিজেই মুছে নেয় গালের ওপর গড়িয়ে আসা অশ্রুজল।আত্মীয়েরা তাকে জানায়,উন্নতমানের চিকিৎসার জন্য তার মাকে দিল্লী নিয়ে যাওয়া হবে এবং সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে  তার মনে হয় আজ রাতে তাকে শূন্য শয্যায় মাকে ছাড়া একাই শুতে হবে।

          পরদিন এম্বুলেন্সে বসে বিমানবন্দর পর্যন্ত মায়ের সঙ্গী হয় নীলাব্দ।এরমধ্যে একটিবার মায়ের জ্ঞান ফিরে এসেছিল এবং আকুল চোখে তাকিয়েছিলেন নীলাব্দের দিকে। ঠোঁটও কেঁপেছিল কিন্তু শব্দ ফোটেনি। মাকে নিয়ে বিমান আকাশে ভাসার পর তার মনে হল মা ফিরে এলে জেনে নিতে হবে না-বলা-কথা কটি।

          চতুর্থদিনে পিতৃশ্রাদ্ধের আসনে বসে যখন নীলাব্দ হাতের আঙুলে কুশের আংটি পরছে, তক্ষুনি সেলফোনের বার্তাবহ তরঙ্গ তার জন্য নিয়ে এল দুর্ভাগ্যের চরমতম অভিঘাতটি- মাতৃহারা হয়ে এ জন্মের মত অনাথ হয়ে গেছে সে।সংজ্ঞা হারিয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়বার আগে অস্ফুট উচ্চারণে তার ঠোঁটে ফুটে ওঠে একটাই শব্দ- কেন ?

            চোখের কোণের জমাট অশ্রু জামার হাতায় মুছে নেয় নীলাব্দ। একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অন্তরের মর্মমূল থেকে। ‘আসলে আমরা প্রত্যেকেই শুধু নিজেকেই ভালবাসি,’ ভাবে নীলাব্দ... ‘ আর নিজের প্রতি সেই ভালবাসাকে সুরক্ষিত রাখতেই আমরা আরও কিছু সম্পর্ক, আরও কিছু ভালবাসা গড়ে তুলি’।
 
(C)Image:ছবি

           নয়ত যে মা-বাবা বিহীন  অস্তিত্ব তার সুদূর কষ্টকল্পনাতেও ছিল না, তাঁদের বিহনে  চার-চারটি বছর তো সে আপাতঃ স্বাভাবিক ভাবেই কাটিয়ে দিল। আজ বিকেলের দিকে নিজের অজান্তেই গণেশগুরির সেই বিস্ফোরণ স্থলটিতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল নীলাব্দ। গুয়াহাটীতে এলেই এই ঘাতক জায়গাটি তাকে যেন এক অমোঘ আকর্ষণে টানতে থাকে। আজ সেখানে হাজির হওয়ার পরই এক তীব্র কশাঘাতে নির্বাক হয়ে যায় সে। সেখানে তখন পালিত হচ্ছিল বিস্ফোরণে নিহত ব্যক্তিদের  জন্য ‘শোকসভা’। কিছু গুরুগম্ভীর বক্তৃতা , কিছু ভজন-নাম-কীর্তন,তার মাঝেই নিহতদের পরিবারবর্গের উচ্চকিত ক্রন্দন, দূরদর্শনের পর্দায় শোকপ্রকাশের সরাসরি সম্প্রচারণ, উচ্চমানের ক্যামেরা লেন্সে পিতৃহীন বা পতিহীনের চোখের জলের ব্যতিক্রমী ছবি...তাকে বিস্ময়বিমূঢ় করে দেয়।তীব্র ঘৃণাময় এক বিবমিষা উঠে আসে তার পাকস্থলীর ভিতর থেকে ,সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে দিয়ে।উচ্চ শব্দে বমন করে সে। হঠাৎ করে বোধ হয় বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার মত অক্সিজেনের অভাব।সেখান থেকে পালাতে চায় সে। নিজের অজান্তেই বাসে উঠে পড়ে এবং বাসটি ভরলুমুখে এসে পৌঁছালে নেমে পড়ে নীলাব্দ। প্রবেশ করে নদীতীর সংলগ্ন উদ্যানটিতে, যেখানে বহুদিন বহু উজ্জ্বল সন্ধ্যা কাটিয়েছে সে মা-বাবার সঙ্গে....।

         ‘হেলো ইয়াংম্যান,তুমি নোযোয়া নেকি? এন্ধার হৈ গ’ল....’

            নীলাব্দ দেখে সেই শিল্পী তার পাশে দাঁড়িয়ে- একহাতে রঙের প্যালেট, অন্যহাতে ব্রহ্মপুত্রের বুকে সূর্যাস্তের সদ্যসমাপ্ত ছবি। মুহূর্তের মধ্যে নীলাব্দের মাথায় যেন আগুন জ্বলে যায়। রঙের প্যালেটের কালো রঙে আঙ্গুল ডুবিয়ে ছবিটির ওপরে এঁকে দেয় একটি বীভৎস কালো প্রশ্নচিহ্ণ। তারপর ছুটে বেরিয়ে যায় পার্ক থেকে।

        বর্ষীয়ান মানুষটি ক্ষণকালের জন্য হতবাক হয়ে যান। তারপর মৃদু হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটের ফাঁকে।

    ‘ইয়েস ইয়াংম্যান, ইউ আর রাইট। মই মাত্র কল্পনার রঙ হে আঁকিছিলোঁ। তুমি তার ওপর ত বাস্তবর ক’লা প্রশ্ন আঁকি মোর সৃষ্টিক অমূল্য করি দিলা...থ্যাঙ্ক ইউ ওয়ান্স আগেইন’।

 ধোঁয়াটে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে লুইতের বুকে তখন নেমে এসেছে জমাট কালো অন্ধকার, তার অমোঘ নিরুত্তর প্রশ্ন নিয়ে... ‘ বুঢ়া লুইত তুমি, বুঢ়া লুইত বোয়া কিয়?’ 

সোমবার, ২ জুন, ২০১৪

ফেসবুকের মতো না হলেও ব্লগেরও আছে নিজস্ব টাইম লাইন

কী আর করা যাবে, আজকাল খানিক ডিস্কো করে  না গাইতে পারলে রবীন্দ্র সঙ্গীতও শোনেনা অনেকে। তাই উহ লা লা-র টান দিয়ে তবে সে গাইতে হয় "পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে" । আমরাও ফেসবুক মোহাচ্ছন্নদের দৃষ্টি টানতে 'উহ লা লা' দিয়ে শুরু করলাম। উদ্দেশ্য ব্লগ নিয়ে আগ্রহ ধরে রাখবার, শিরোনামের শুরুতে নিলাম ফেসবুকের নাম। 
                      ফেসবুক টুইটারের বয়সও কম কিছু নয়, এক দশক হতে চলল। কিন্তু এই ২০১০ অব্দি সেগুলোর এতো জনপ্রিয়তা ছিল না, যতটা অরকুটের ছিল। পাশাপাশি পারফস্পট, নিং, লিঙ্কড ইন আরো কতো কী ? বিচিত্র পেশা এবং নেশার লোকেদের ধরে রাখবার জন্যে বিচিত্র সামাজিক মাধ্যম। এই সমস্ত বৈচিত্রকে হজম করে ফেলে ফেসবুক টুইটার শুধু জনপ্রিয় হতে শুরু করল এই সেদিন। তার আগে কলেজ পড়ুয়াদেরতো ধরে বেঁধেও ফেসবুকে আনা যেতো না। মনে হতো বুঝিবা, এই গুরু গম্ভীর পণ্ডিত মন্যদের সামাজিক মাধ্যম। প্রেম করবার ভালো মাধ্যম অরকুটই। এখন পর্ণ দেখবারও ভালো মাধ্যম ফেসবুক। 
         তা যা বলতে, থুড়ি , লিখতে যাচ্ছিলাম, ব্লগের জনপ্রিয়তা কিন্তু এদের সবার চাইতে প্রাচীন। মোটামোটি গেল শতকের শেষ বছর কয় যাত্রা শুরু করে ২০০৯ অব্দি ব্লগ চুটিয়ে রাজত্ব করেছে। যাদেরই মনে হয়েছে, মনের দুটো কথা কাউকে খুলে বলতে পারছেন না , বলা উচিত তাঁরা ব্লগ লিখতে শুরু করলেন। কেউ দিনিলিপি লেখেন, তো কেউ কাল্পনিক প্রেয়সীকে চিঠি। কেউ বা শুধুই গল্প, কবিতা, ভ্রমণ কাহিনি লিখে লিখে লেখক হয়ে উঠতে শুরু করলেন। আমাদের নজরের সামনে এমন অনেক ব্লগারের এখন ছাপা বইর সংখ্যাও কম কিছু নয়।  কেউ বা আরো দুই এক কদম এগিয়ে গিয়ে নিজের সব গবেষণা কর্মও ব্লগেই তুলে রাখতে শুরু করলেন। দেখতে দেখতে, ব্লগারদের বন্ধুত্ব  হলো, আড্ডা হলো, সংঘ হলো, সংগঠন গড়ে উঠল বিশ্ব জুড়েই। অনেকে সম্মিলিত ব্লগও শুরু করলেন ছোট সাময়িক কাগজের মতো, অথবা সেভাবেও নয়। এখানে সবাই রাজা ব্লগের এই রাজার রাজত্বে। সম্পাদক বলে ব্যক্তিটির কাজ হলো, শুধু যুদ্ধ সামাল দেয়া। দুষ্ট লোকের নষ্ট ফন্দি ফাঁদে ধরা। অন্যথা , লিখুন যে খুশি, যেমন খুশি। আপনিই লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক, পাঠক। সবই, আপনি আর আপনার নতুন পুরোনো বন্ধুরা। কাউকে তোষামোদ নেই, তেল নেই, সম্পাদকের হুমকি বা অনুগ্রহ নেই, পাঠকের উপেক্ষা বা অবজ্ঞা নেই। 
              ব্লগের জনপ্রিয়তা দেখে বহু সাময়িক কাগজ যেমন শুরুতে তাদের আন্তর্জালিক সংস্করণ করতে শুরু করল, তেমনি অনেকে আন্তর্জালেই নতুন সাময়িক কাগজ করতে শুরু করলেন আনকোরা নতুন। এই না দেখে উঠল বাই, বাণিজ্যিক পরিকাগুলোও নিজেদের ব্লগ করতে শুরু করল। দেখবেন বাংলা আনন্দবাজারেরও উন্নাসিক অভিজাত (যেকারো প্রবেশাধিকার নেই, তাই শব্দ দুটোর ব্যবহার )লেখকদের নিজেদের ব্লগ আছে, বাংলাদেশের কথাতো বলেই লাভ নেই। অগুনতি।
             এখনো ফেসবুক জনপ্রিয়তার যুগেও দেখবেন বাণিজ্যিক কাগজ বা চ্যানেল প্রায় সব ক'টার --তা যেকোনো ভাষার হোক, ফেসবুক পেজ আছে, টুইটারে বা গোগোল প্লাসে এরাও এসে গেছেন। কাগজে বা টিভিতে বিজ্ঞাপনও দেন।  কিন্তু ব্লগ থেকে সরে যাবার নাম করছেন না। ফেসবুকে টুইটারে আসলে সেই ব্লগ বা সাইটের ইউ আর এল বা লিঙ্ক ছড়ান শুধু। সেখানে আপনি সংবাদ বা প্রতিবেদন পড়তে পারবেন না। পড়তে হলে ব্লগে আসতে হবে। সংবাদ মাধ্যমগুলোর পাতা যাকে আমরা ওয়েব সাইট বলে জানি, আসলে এগুলো ব্লগই। ওয়েব সাইটে রোজ তথ্য যোগ হয় না।  রোজ যেখানে তথ্যের নবীকরণ বা সংযোজন ঘটে, যে গুলোর সচলতা অত্যন্ত দ্রুত সেই সাইট গুলোই আসলে ব্লগ। যা কিনা কোটি টাকার বাণিজ্যিক বা সরকারি প্রতিষ্ঠানও চালাতে পারে, আর হাজার টাকা মাসে আন্তর্জাল সেবা যোগান দাতাকে যুগিয়ে দিয়ে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ব্যক্তিগত ভাবেও খুলে বসতে পারেন। যেমন করেন, বর্তমান ব্লগার। আমার নিজেরই একাধিক বিষয়ভিত্তিক ব্লগ আছে। আর ফেসবুক জমানাতেও আমাকে এখান থেকে কেঊ সরিয়ে ফেলতে পারেন না। কারণ, ফেসবুকে কাউকে হাজার খানিক পাঠক পেতে দেখিনি, আমার ব্লগে জোটে। অথচ, যারা জানেন তারা জানেন যে ফেসবুকেও আমার কোনো লাইকের নেশা নেই। নেই এই নিয়ে কোনো মান অভিমান। অনেকেতো লাইক কমতে শুরু করলেই ফেসবুক থেকেও পালিয়ে বেড়ান। 
            ফেসবুকের জনপ্রিয়তাকে টেক্কা দেয়া কঠিন। এটা ব্লগ পারবে না। আজকাল মোবাইল কোম্পানিগুলোও আন্তর্জালের আর কোনো সুবিধে নাদিলেও ফেসবুকের লোভ দেখিয়ে গ্রাহক টানছে। তাই, অনেকর ধারণা আন্তর্জাল মানেই ফেসবুক। যেমন পুরাণ সাহিত্যের লেখকেরা জানতেন আরকি রাজা মানেই সসাগরা পৃথিবীর রাজা।  যেমন পঞ্জিকার বাজারকে টেক্কা দিতে পারে নি রবীন্দ্র রচনাবলী, তেমনি ব্লগ পারবে না ফেসবুককে টেক্কা দিতে । কিন্তু সৃজনশীল মানুষের মধ্যে ব্লগ টিকে থাকবে বলেই আমাদের এখনো আশা। উকিপেডিয়া জানাচ্ছে ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৯৭তে যাত্রা শুরু করে ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১১তে দুনিয়া জুড়ে ব্লগার সংখ্যা বেড়ে ১৫ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এই সময়টাই ফেসবুক টুইটারের জনপ্রিয়তার যুগ। অনেকে এই সময় সহজ প্রচারের আশাতে ফেসবুকের নোট লেখার সুবিধের টানে চলে গেছেন। বৃদ্ধির হার কমে গেছে। কিন্তু তার পরেও ব্লগারের সংখ্যা বেড়ে ১৭ কোটি ছাড়িয়েছে। ব্লগ লিখবার বহু মঞ্চ আছে। কিন্তু আমরা যেখানে লিখি, সেই 'ব্লগার্সে'র ব্যবহারকারীই সব চাইতে বেশি। এখানে পড়ুনঃ
On 16 February 2011, there were over 156 million public blogs in existence.[4] On 20 February 2014, there were around 172 million Tumblr[5] and 75.8 million WordPress[6] blogs in existence worldwide. According to critics and other bloggers, Blogger is the most popular blogging service used today, however Blogger does not offer public statistics.[7][8] Technorati has 1.3 million blogs as of February 22, 2014[9]

           দুনিয়া জুড়ে ব্লগ শুধু দর্শনে বিজ্ঞানে শিক্ষাতে সাহিত্যে মতবিনিময় সহজ করে যেমন ভাবনা এবং কাজের দ্রুতি এনেছে, তেমনি দেশে দেশে রাজনৈতিক চালচরিত্রের বদলেও নিয়েছে বিশাল ভূমিকা। সে মার্কিন নির্বাচন থেকে শুরু করে আমাদের দেশের সংসদীয় নির্বাচন হোক। কিম্বা আরব বসন্ত থেকে শুরু করে ওয়াল স্ট্রীট দখলের লড়াই কিম্বা শাহাবাগের লড়াই হোক কিম্বা লোকপালের আন্দোলন।  
            ভারতীয় সব ভাষাতেই ব্লগ এখনো বেশ জনপ্রিয়। হিন্দি তামিল বাংলা ইত্যাদি ভাষাতে ব্লগ সমূদ্রে মুক্তো বাছাই করাই এক কঠিন কম্ম। ইংরেজিতেতো কথাই নেই। যারা নিয়মিত ইণ্ডিব্লগারের মতো সম্মিলিত ব্লগ দেখেন তাঁরা অনুমান করতে পারবেন, ভারতে ব্লগারদের আড্ডাটা কতটা বিশাল, বাণিজ্যও কম নয়, বিশেষ করে ইংরেজিতে।
         আমরা বললাম বটে ভারতের সব ক'টা ভাষাতে ব্লগ সমানে জনপ্রিয়। আসলে বাংলার কথাটি খুবই লজ্জা জনক। বাংলাতে ব্লগ লিখে দুনিয়া জুড়ে লেখকদের মঞ্চ যোগানোর দায় গেল দেড় দশক ধরে একা সামাল দিচ্ছেন বলতে গেলে বাংলাদেশের বন্ধুরা। ভারতে ২০১০ অব্দিও গুটি কয় মাত্র বাংলা ব্লগ ছিল। অরকুট জমানাতে অনেকেই সেখানে কবিতা ইত্যাদির গ্রুপ চালাতে লিখতেন রোমান হরফেই। বলে কয়েও অধিকাংশকেই বাংলাতে নিয়ে আসা যেত না। ফেসবুক সেই কাজটি সহজ করেছে ২০১০এর পরে। কিন্তু তার পরেও অসমিয়াতে বিচিত্র স্বাদের এবং বিষয়ের ব্লগ বা সাময়িক 'আলোচনী'র সংখ্যা বাড়লেও বাংলাতে অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয় নি। যা সামান্য হয়েছে তার দায় কেবল কবিদের। এখনো গল্প উপন্যাস, প্রবন্ধ সেভাবে বাংলা ভাষাতে ভারতে অন্তত লেখা হচ্ছে না। এই প্রশ্ন বাহুল্য মাত্র যে গুড নাইট গুড ডে'র ফেসবুকীয় সংস্কৃতি অতিক্রম করে তারা বাংলাতে এখানে গণিত বা কৃষি চর্চা করছেন কিনা।
         আর আমাদের অসমের বন্ধুদের কথা তো বলেই লাভ নেই। কিছু কিছু মা -বাবা যেমন সগৌরবে ঘোষণা করেন, আমার সন্তান বাংলা এক্কেবারে বলতে লিখতে পারে না , জানো! তেমনি, বহু বঙ্গীয় বিদগ্ধজন বন্ধুদের আড্ডাতে সগৌরবে ঘোষণা করনে, আন্তর্জাল বাংলা লিখবার পড়বার জায়গা মোটেও নয়। কী বিচ্ছিরি রে বাবা অক্ষর গুলো ,আর কী ছোট! চোখেই দেখা যায় না। এই সব বিদগ্ধ জনেরা অনেকে নিজের প্রকাশিত বইতে ঢোল পিটিয়ে ফেসবুক ইমেল ঠিকানা দেন। আমাদের এমন রসের অভিজ্ঞতাও হয়েছিল যে একটি কাগজ 'আমাদের ফেসবুক ঠিকানা' লিখে পরে লিখেছেন আসলে ই-মেল আই ডি। সম্প্রতি এক ঔপন্যাসিক জীবনে প্রথম উপন্যাস লিখে বন্ধুদের বলে বেড়াচ্ছেন তিনি প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হয়ে গেছেন। লোকে পুরস্কার দিচ্ছে , সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। (না নিলে কি আর নিরাপদে থাকতে দিচ্ছেন?) । ফেসবুক ঠিকানা জানিয়ে আসলে নিজের নামটাই বাংলা বইতে ইংরেজিতে লিখে দিয়েছেন। ইউ আর এল---তুলে দিতে পারেন নি। বলাই বাহুল্য এসব কী জিনিস-- জানবার ন্যুনতম চেষ্টাও করেন নি। দরকারই বা কি, যদি অর্ধশিক্ষিত পাঠকদের রোমান হরফে নিজের  নাম লিখে ফেসবুক ঠিকানা বলে গেলানো যায়। এক 'মহান' লেখকতো নিত্য প্রবন্ধ লিখে জানান দেন, তিনি কবে রাজমোহন গান্ধিকে বা রামচন্দ্র গুহকে তাঁদের প্রবন্ধ পড়ে মন্তব্যের জায়গাতে ইংরেজিতে তীব্র সমালোচনা করে এসেছেন। লেখাই বাহুল্য তিনি সাইবার-হিন্দু। ভাবেন, আন্তর্জালের দুনিয়া চষে বেড়ান , মন্তব্য করতে জানেন জানাতে পারলে পাঠক ভিরমি খাবে। 
            তো এহেন পূর্বোত্তরীয় দুনিয়াতে ব্লগের জনপ্রিয়তা বাড়ানো, এবং এখানকার ভাষা সাহিত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রচার এবং প্রসারে আন্তর্জালকে কাজে লাগানো মোটামোটি সৌরজগত নিয়ে কেপলার গ্যালিলিওদের জ্ঞানার্জন এবং গবেষণার সংগ্রামের সঙ্গে সবটা না হলেও অনেকটাই তুলনীয়। সাধে কি আর এভারেস্ট বিজইয় করেছিলেন এডমণ্ড হিলারি? আমরা তো ভগবান বলে দূর থেকে প্রণাম করেই তুষ্ট ছিলাম। ফেসবুকের প্রাথমিক উচ্ছ্বাসে অনেকেই যদিও বা এসেছিলেন , বাংলাটা রপ্ত করেছিলেন এখন লাইক কমে টমে যাওয়াতে, বা সুজন বন্ধুদের পাশে বহু দুর্জনের সঙ্গেও একই দ্রুততায় দেখা সাক্ষাৎ হয়ে যাওয়াতে  অনেকে সেখান থেকেও সরে পড়েছেন বা পড়ছেন। যদিও তার পরেও অনেকে লিখছেন , নতুন যোগ দিচ্ছেন বলে ঈশানের পুঞ্জমেঘের মতো ব্লগ চালিয়ে যাওয়া যাচ্ছে, একই নামের ফেসবুক গ্রুপে ধীর লয়ে হলেও সদস্য বেড়ে চলেছে।  স্বপ্ন আছে একটি সাময়িক পত্রিকা ধাঁচের করবার। কবে সে হবে এখনি জানি না। ফেসবুক আর রোমান হরফের মোহ না কাটলে অদূর ভবিষ্যতে হবার নয়।
           যাই হোক, অনেকেই আছেন ফেসবুকের অপদেবতাদের ভয়ে দূরে সরে যাচ্ছেন। অথচ এসেছিলেন কিছু সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত হতে, সমভাবাপন্নদের বা সহকর্মীদের সঙ্গে জুড়তে। সরে যাচ্ছেন। অনেকেই আছেন সহজ কিম্বা সস্তা যশোপ্রার্থী নন, স্থায়ী কিছু কাজ করে দাগ রেখে জীবনে-- যে যেদিন সময় হবে বিদেয় জানাতে চান। তাদের জন্যে দরকারি নির্জনতার যোগান যদি কেউ এখনো যোগাতে পারে, তবে সে ব্লগ।  ফেসবুকের মতো এখানেও সহ ব্লগারদের সংগে বন্ধুত্ব বাড়াতে পারেন। পছন্দের ব্লগের সংগে জুড়তে পারেন। সেগুলো পড়তে এবং মতবিনিময় করতে পারেন।  কী করে, সেই নিয়েই একটি ছোট প্রায়োগিক প্রতিবেদন এখানে রাখছি। আপনার গোগোল মেইল থাকলে সুবিধে। না থাকলেও কথা নেই। যে মেইল আই ডি-ই  থাকুক যদি
           ইতিমধ্যে একটি ব্লগার একাউণ্ট খুলে রেখেছেন ভালো। নইলে খুলে নিন। আমরা ধরে নিচ্ছি আপনার ব্লগার একাউন্ট আছে। এবারে গোগোল হোম পেজ থেকে কী করে ব্লগার 'টাইম লাইনে' আসবেন দেখাচ্ছি।
ছবিটি দেখুনঃ




গোগোল হোম পেজের ডান দিকে একেবারে উপরে দেখবেন ৯টা ছোট বাস্ক মিলিয়ে একটা রুবিক কিউবের মতো বাক্স দেখাচ্ছে। সেটি আসলে গোগোলের বাকি সব প্রডাক্টের সংগ্রহশালা। ক্লিক করলেই আপনি লাল বৃত্তের ভেতরে যেভাবে দেখছেন ব্লগারের আইকন দেখবেন। ক্লিক করুন। আপনার ব্লগার ড্যাসবোর্ড খুলে যাবে নিচের ছবির মতোঃ


আপনার সব ক'টা ব্লগ দেখাবে শুরুতে। আমার অনেক গুলো ব্লগ দেখাচ্ছে, আর যেগুলো আছে সেগুলো view more কথার নিচে চাপা পড়ে গেছে। ক্লিক করলে খুলবে। একেবারে নিচে বামে দেখুন Reading list দেখাচ্ছে। আমি অসংখ্য ব্লগের সঙ্গে জুড়ে আছি । গেল ছ' সাত বছরে সেই সংখ্যা কত, আমি নিজেও মাঝে মধ্যে গুনতে ভুলে যাই। সেই লিস্টে ক্লিক করুন। লিস্ট দেখাবে নিচের ছবির মতো। বস্তুত এসব এমনি দেখায়, স্ক্রল করে খানিক নিচে গেলেই হলো। 




দেখুন বামে অনেকগুলো ব্লগের নাম দেখাচ্ছে। আরো বহু দেখাচ্ছেও না এই ছবিতে। সেগুলো আছে। এসব হচ্ছে সেই সব ব্লগ যাদের সঙ্গে আমি জুড়ে আছি। অনেকটা আপনার ফেসবুক বন্ধু তালিকার মতো। আর ফেসবুক হোম পেজে যেমন বন্ধুরা কেমন স্টেটাস দিলেন দেখিয়ে থাকে, ব্লগার্স তেমনি শুরু থেকেই দেখাতো আপনার ব্লগার বন্ধুদের কে কী লিখলেন তার প্রিভিউ। এই যেমন এক বন্ধু আমার বাংলাতে মহাভারত লিখছেন। নীরবে লিখে যাচ্ছেন তিনি বহুদিন ধরে। এই ব্লগে গেলেই বুঝবেন তিনি সস্তা যশোপ্রার্থী নন, আড়ম্বর ভালো বাসেন না। কাজটা ভালো বেসেই করে যাচ্ছেন। তো সেখানে ঐ নিচের more লেখাতে ক্লিক করে বা তার লেখার শিরোনামে ক্লিক করে আপনি তার ব্লগে পৌঁছে যেতেই পারেন এবং পড়তে পারেন। এভাবে যেকোনো ভালো লাগা পোষ্ট আপনি বিস্তৃত পড়তে পারেন, নিচে মন্তব্য করে ব্লগারকে উৎসাহী বা নিরুৎসাহী করতে পারেন। এভাবে একে একে পড়ে যান। আপনার রুচির সঙ্গে মিলে এমন ব্লগার বন্ধু বাড়িয়ে যান। 



এবারে , কারো সঙ্গে জুড়ে থাকবেন কী করে? আপনার ব্লগার ড্যাসবোর্ডে তার পোষ্ট প্রিভিউ দেখবেন কী করে? ফলোয়ার গ্যাজেটে ক্লিক করে। এখানে দেখুন এই ব্লগে যেমন আমিও জুড়ে আছি। 


এই ব্লগে ফলোয়ার খুবই কম। কিন্তু কোনো কোনো ব্লগে এই সংখ্যা শ বা হাজারও অতিক্রম করে। সেটি নির্ভর করবে আপনি কতটা জুড়তে জানেন এবং পারেন তার উপরে। এই যেমন এই হিন্দি কবির ব্লগে দেখুন, সংখ্যাটা ৩৭০ ঃ





এই, এমন ফলোয়ার গ্যাজেট আপনার ব্লগেও জুড়তে পারেন। তার জন্যে আপনাকে ব্লগার্স ড্যাসবোর্ড থেকে লে আউটের পাতাতে যেতে হবে, সেখানে Add a gadget এ ক্লিক করে এই গ্যাজেট এবং আরো অনেক দরকারি গ্যাজেট পেয়ে যাবেন। তার মধ্যে ব্লগ লিস্ট এবং লিংক লিস্ট খুব দরকারি। নিচের ছবিতে দেখুন। এই দুই গ্যাজেট নিয়ে নিন। ব্লগার্স বন্ধু হলে আপনি ব্লগ লিঙ্কে জুড়ে যেতে পারেন। যাকেই আপনি তাঁর ব্লগে গিয়ে ফলো করবেন, তাঁকেই তখন এই তালিকাতে দেখাবে। রিডিং লিস্টে দেখাবে তার লেখার প্রিভিউ। বাকি যেকোনো ব্লগ বা দরকারি সাইটের লিংক আপনি লিঙ্ক লিস্টে জুড়ে রাখবেন। আমাদের ঈশানের পুঞ্জমেঘ ব্লগ বা কাঠের নৌকা দেখুন। এমন অনেক বাংলা বা অন্য ভাষার কাজের ব্লগ তালিকা পেয়ে যাবেন। এখানে সেরকম তালিকা সংখ্যা কম , কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ব্লগগুলোতে সেই তালিকা অনেক দীর্ঘ।


আশা করছি, আপনার আগ্রহ বাড়াবার জন্যে এই টুকু যথেষ্ট। এর পরেও কৌতুহল আপনার থাকতেই পারে। যেকোনো প্রশ্ন রাখুন মন্তব্যের জায়গাতে। এখন এখানে মন্তব্য করবার সুবিধে হলো, সেগুলো সরাসরি গোগোল প্লাসের সামাজিক সাইটেও চলে যায়। ফলে, আলাপ দু'জনার হয়েও অন্যের নজর এড়াবে না। নির্জনতা পছন্দ করেন এমন অনেকে ফেসবুকে ভিড় করেন না তেমন, একা একা এখানে ঘুরে বেড়ান। শুনছি, গোগোল এই প্লাস জিনিসটি তুলে দেবে। যখন দেবে তখন  দেখা যাবে। আগেও বিকল্প ছিল পরেও থাকবে। কিন্তু আপাতত ব্লগার্স তুলে দেবার কোনো সংবাদ নেই।

রবিবার, ১ জুন, ২০১৪

আমি নিয়ে এসেছি পিতার আশীর্বাদ
















মার ক্ষয় হয়ে যাওয়া রোধ করে
আমাকে পুনরুজ্জীবিত কর জগৎ সেবায়
হে অফুরান শক্তির উৎস সূর্য-
আমি নিয়ে এসেছি পিতার আশীর্বাদ।

আমার দেহ-মনের কলুষতা নাশ করে
আমার প্রতিটি কোষকে পরিশ্রুত কর
আমাকে সতেজ কর হে শীতল বায়ু-
আমি নিয়ে এসেছি পিতার আশীর্বাদ।

আজন্ম পিপাসু আমার তৃষ্ঞা মিটিয়ে
আমার ক্লান্তি শ্রান্তি দূর কর
আমাকে নির্মল কর হে পবিত্র জলরাশি-
আমি নিয়ে এসেছি পিতার আশীর্বাদ।

তোমার অসীম ধৈর্য শক্তি আমাকে দিয়ে
আমায় সংযত হওয়ার শিক্ষা দাও
হে মা মাটি আমাকে অনুপ্রাণিত কর-
আমি নিয়ে এসেছি পিতার আশীর্বাদ।