“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

থিয়েটারে নারী...আমার অনুভবে,আমার ভাবনায়


( WOMAN IN THEATRE: লেখটি 'অভিনয় ত্রিপুরা' কাগজের জুলাই-ডিসেম্বর, ২০১২ সংখ্যাতে বেরিয়েছিল)

 
।।জয়শ্রী ভূষণ।।
             
                  
    শুরুটা ঠিক কোথা থেকে করবো বুঝতে পারছি না । তবু চলতে  চলতে একদিন পথ খুঁজে পাবোই এই আশায় কলম খুলে মনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে আমার ভাবনা গুলোকে প্রকাশ করার প্রয়াস আরম্ভ করলাম। এবার,-- কাকে চয়ন করে  আমার কলমের চাকা চলবে ? “থিয়েটার” , “জীবন” , “আমি”, “আমরা” “নারী” না আরও “অন্যকিছু” । আসলে আমার ভাবনা, চিন্তা,  মননের অপার সাগরে আমি কখনও ডুবে যাই অতলে, আবার কখনও ভেসে উঠি , কিন্তু আজ অবধি কোনো পারেই পৌছুঁতে পারিনি , কিন্তু অবিরাম সাঁতার কেটে চলেছি।

                     আমাকে যখন লিখতে বলা হলো আঁতকে উঠেছিলাম ,আমি তো লেখিকা নই , কিছু একটা হয়তো লিখে নেবো, ভালো করে পারবো কি? এইসমস্ত কিন্তু পরন্তুর প্রশ্নে আমার আমিকে জেরবার করে আমার সাথে আমার আমির যে দ্বন্দ্ব তাকে অতিক্রান্ত করে অবশেষে আমি লিখতে শুরু করলাম। কি করি,  আমি কিছুতেই –‘পারবো না’ বলতে যে পারি না,বড্ড কষ্ট হয়। শুরু হলো আমার চেতন-অবচেতন মনের ভাবনা গুলোকে অক্ষরের মোড়কে বেঁধে লেখার পথ পাড়ি দেওয়া।

                           কোথাও ছোটবেলায় পড়েছিলাম আমরা নাকি সবাই “জীবন নামক রঙ্গমঞ্চের কাঠপুতুল”। খুব সত্যি যদিও ,কিন্তু আমার জানিনা কেন এভাবে নিজেকে কাঠপুতুল ভাবতে ভাল লাগে না।  তাই  জীবন থিয়েটারে যখন যে চরিত্রটি আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছে তার সঠিক রূপায়নে আমি সদাই সদর্থক চেষ্টা করেছি, করছি ও করে চলবো। এখনো মনে পড়ে, ছোটবেলায় যখনই বড়রা কোন-কিছু নিয়ে হাহুতাশ করতো, তখন আমি বিজ্ঞের মত  নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে  বলতাম, আমার নিজের ভাগ্য আমি নিজেই গড়বো ,আমার কর্মই আমার হাতের রেখা বদল করবে,তাই শুধু কাজ করে যাও সময় মতো ফল পাবে---ও খুব গম্ভীর হয়ে বলতাম “যে শুয়ে থাকে তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে”, --  বাংলা ব্যকরণ বইয়ের এই বাংলা Phrase টি মনের মধ্যে গেঁথে গেছিল---তাই নাটকের সংলাপের মত আওরাতাম ও নিজের জীবনে  সাহস সঞ্চয়ে ও অনেক পাহাড় ডিঙোতে এই ধরণের অনেক উপাদান অনেক দূর আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

                            আমি-আমার উপলব্ধিতে থিয়েটারকে ভাগ করেছি দুইপ্রকারে। 1) জীবন থিয়েটার ও 2) থিয়েটার নামক জীবনদর্শন । প্রথমটিতে চরিত্রগুলো   নির্বাচনে  আমাদের কোনো ভূমিকা থাকে না ,Script ও জানা থাকে না ,কোনদিকে যে আমরা এগিয়ে চলেছি তাও আমাদের অজানা এবং সর্বপোরি উপসংহারটুকুও থাকে অজ্ঞাত। শুধুমাত্র যে চরিত্র বা পরিস্হিতি নিয়তির দ্বারা আমাদের ভাগ্যে জোটে সেটির সফল রূপায়ন কতটুকু করতে পারি –বা কতদূর ভালোভাবে জীবনে দর্শাতে পারি তাই বোধহয় জীবনের প্রধান উপপাদ্য। আর এই জীবন থিয়েটারের জীবনযুদ্ধে , যে ব্যক্তি , যত বড় যোদ্ধা, ব্যতিব্যস্ত ও সমস্যার জালে জড়ানো সত্বেও নিজের দুমরানো-মুচরানো জীবনকে আশার কিরণে স্বপ্নের আলোর আভায় ভাসিয়ে দেয় সেই মানুষই জীবন থিয়েটারের সফল নায়ক/নায়িকা  --কারণ বেঁচে থাকতে হলে এগিয়ে যেতে হবে আর চলার আর এক নামই হচ্ছে জীবন। আর স্বপ্নের আলোর আভায় ভাসতে হলে “আমি” র অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে হয়। ঠিক যেন রূপকথার সেই সোনার কাঠির মতো।  তাই দুধরনের থিয়েটারেই “আমাদের বাঁচার স্বপ্ন দেখানোর জন্য”--  “আমি” --factor টি খুব জরুরী দায়িত্ব পালন করছে। “আমি” র জন্মও কিন্ত আমাদের আশেপাশের সবার প্ররোচনায়ই হচ্ছে। মা-বাবা, ভাইবোন, পাড়া-প্রতিবেশী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বিভিন্ন সব সামাজিক চরিত্রগুলি মিলেই আমাদের মধ্যের এই “আমি” কে রোপণ ও বপন করতে সহায়তা করে। তাই আমি যতই “আমি”র কথা বলি না কেন—আমার “আমি” তে “আমরা” মিলেমিশে একাকার হয়ে আছি।  এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই “আমি”কে  আমরা কিভাবে বাড়তে সাহায্য করছি “পরিপূর্ণ মানুষ আমি” না শুধু “পুরুষ আমি”  না “নারী আমি” হিসেবে। সঠিক ভাবে সমাজে আমরা এই “পরিপূর্ণ মানুষ আমি” রূপায়নে, মূল্যায়নে কতখানি  পথ –পাহাড়-মরুভূমি- নদী-নালা –খানা-খন্দ পেরিয়েছি । গন্তব্য অনেকদূর এখনো, আরও অনেক পথ -অনেক  বাধা আমাদের অতিক্রম করতে হবে।

                                এখন যদি  ইতিহাস ও সমাজের বিভিন্ন পটে চোখ রাখি তাহলে আমরা দেখতে পাই, সেই আদিকাল হতে অজ্ঞতা,কুসংস্কার,প্রহসন,দুর্নীতি  ও এরকম আরও অনেক সামাজিক কুবিধি -সমাজের উন্নতির পরিপন্থী কুব্যবস্থা ও কুরীতিনীতির জন্য বিশেষ করে নারীরা মাতৃগর্ভ থেকে নাড়ীর পথটুকু পার হয়ে পৃথিবীর আলোয় চোখ মেলার আগেই ,ভ্রূণহত্যার মত জঘন্য অপরাধ আজও ঘটে চলেছে। শুধু তাই নয় মেয়ে, কিশোরী,মহিলা ,বা নারী-কে ,যে কোন স্তরেই, মানুষ হয়ে বাঁচার জন্য আজীবন সংঘর্ষ চালিয়ে যেতে হয়। আপেক্ষিক ভাবে যদিও আমাদের মনে হতে পারে যে মেয়েদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু যে ভাবে ,আমাদের খাদ্যাভ্যাস , দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে ,খোলামেলা পোশাকআশাক পরিধান আমরা মেনে নিয়েছি, সেই ভাবে কিন্তু --আমাদের মানসিকতার স্তরের ঊর্ধ্বগামী বিচারধারা,--সাম্যবাদী মনোভাব,  মূল্যবোধের অবক্ষয়ের স্তিমিত গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না বলেই, অন্তত-- আমার মনে হয়। এক কথায় বোঝাতে হলে বলতে হয়, নারী এখনও এই বিশ্বায়নের যুগে সবথেকে কমদামী ভোগ্য ও সহজলভ্য পণ্য। শিক্ষা শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যায় পরিণত হয়েছে, একান্নবর্তী পরিবার ধারা প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে, মানুষ আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে, মানুষ হন্যে হয়ে শুধু ছুটছে আর ছুটছে ...যার আছে, তার আরও আরও চাই, যার নেই তার কিছুই নেই,...সে চোখের সামনে কেউ মরে গেলেও আমাদের কিছু যায় আসে না। কোথায়  তাহলে দাঁড়িয়ে আজকের নারী ? নিশ্চয় খুব সুবিধেজনক স্থানে নয়। কারন সুস্থ সমাজ গঠনে  নারী ও পুরুষ উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে। বিশেষ করে নারীদের ভুমিকা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কারন যখন একটি শিশু জন্ম গ্রহণ করে,  তার প্রথম বিকাশ ও শিক্ষার প্রথম ক্ষণটি শুরু হয় মাতৃগর্ভেই। জন্মের পরেই একটি মানবশিশুকে তার মানবিক বিকাশের পথে পা না বাড়িয়ে প্রথমে শুরু হয় লিঙ্গ নির্ধারণের মাধ্যমে ছেলে ও মেয়ে হিসেবে বিভাজন , যা সমাজের বিকাশের প্রধান অন্তরায়। এবং এরপর যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে তা আজও গতানুগতিক ভাবেই চলছে। পৃথিবী যদিও আমাদের হাতের মুঠোয়, কিন্তু দিনকে দিন বেড়ে চলেছে শিশু-শ্রম,দাসত্ব, যৌন-বৃত্তি, পণ প্রথার দরুন মৃত্যুর হার,মানুষ বেচাকেনা,আরও কত কী!   মেয়ে শিশুরা ছেলে শিশুদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভাবে কম পরিচর্যা পেয়ে, অপুষ্টি,অশিক্ষা, অবহেলায়, অবাঞ্ছিত,উপেক্ষিত হয়ে বেড়ে উঠছে, ও ছোটবেলা থেকে প্রতি মুহূর্তে ওদের মনে রাখতে বাধ্য করা হয়, ওরা মানুষ নয়, ওরা মেয়ে, কিশোরী , নারী ,ও নিপীড়ন ও শোষণ ওদের প্রাপ্য সমাজ থেকে।  কিন্তু আমার মনে হয় প্রতিটি পরিবারে যতদিন শিশুর বিকাশে পিতা ও মাতা সম-ভূমিকা পালনে অপারগ থাকবেন ততদিন সুষ্ঠু, সুন্দর,ও গঠনমূলক সমাজের বিকাশের  জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এবং আমরা অপেক্ষা করছি কবে জীবন নদীতে নিজেদের গা না ভাসিয়ে সবাই কে পারে নিয়ে যাবার জন্য স্রোতে বিপরীতে সাঁতার কাটবো-- কবে আমরা  মানুষরূপী জীবের খোলস থেকে বের হয়ে  আসবো ও মান আর হুঁশ সম্পন্ন মানুষ হবো?                                            

                          আমাকে যদিও লেখার বিষয় নির্দেশ করা হয়েছে কিন্তু আমি এখনও বিষয়ের মূল উদ্দ্যেশে পৌঁছানোর জন্য অলিগলি হয়ে গুটিগুটি পায়ে বড় সড়কে পাড়ি দেওয়ার আপ্রাণ প্রয়াস করছি। ছোটবেলা থেকেই খুব স্বতঃস্ফু্র্ত ভাবে বড় হয়েছি। খুব খেলাধূলো করেছি, ছবি আঁকা,চুটিয়ে আড্ডা,গান,নাচ,যোগচর্চা,নাটক,ভরদুপুরে মাকে লুকিয়ে চুরি করে কাঁচা আম,জলপাই,আমলকী আরও কত কী খাওয়া,পড়ার বইয়ের ভেতরে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়,সত্যজিৎ রায়,তারাশঙ্কর,বাটুল দি গ্রেট,হাঁদাভোদা,অরণ্যদেব,ম্যানড্রেক ইত্যাদি ইত্যাদি অজস্র বই পড়া,আবার পরীক্ষার আগে 10/15 দিন  খাওয়া-নাওয়া বন্ধ করে,রুদ্ধশ্বাসে শুধুই পড়াশুনো করে দিব্যি ভালো করেই উতরে যাওয়া,---সবই করেছি,একজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ হিসেবে,কিন্তু নিজেকে সেভাবে  নাবালিকা,মেয়ে বলে কখনও ভাবিনি বা ভাবতে হয়নি বা বাধ্য করেনি কেউ। সেই পারিপার্শিক অবস্হা আমার ছিল এবং সেইজন্য I feel proud and lucky too.কখনও কখনও বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চেয়ে দেখতাম আমি অন্য একজন অচেনা পথচারীর হাত ধরে হাঁটছি। ভয় ও লজ্জা পেয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেছি বাবা দূরে মিটিমিটি হাসছেন। আমিও  ছুটে এসে  বাবার হাত ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শতশত প্রশ্নবান ছুড়ে গল্প  করতে করতে আবার পথ চলা শুরু করেছি। এখনও মনে পড়ে,-- বাবা খুব মিষ্টি করে বকুনি দিয়ে বলেছিলেন –“ মা, কতদিন বলেছি তোমায় ,আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটবে না, মাটীর দিকে তাকাও, নোংরাতে পা পড়বে যে ”। তখন কথাটা এত গ্রাহ্য  করিনি। কিন্তু পরে উপলব্ধি করেছি,সত্যি সবসময় আকাশের দিকে তাকিয়ে পথ চলা যায় না । একদিন ঝুপ করে আমার ছেলেবেলা নামক অঙ্কের যবনিকাপাত হল। বাসন্তী পূজার মহাষ্টমীর দিন সন্ধ্যা আরতির ঢাক  বাজছে, এর মধ্যে আমার প্রিয় খেলারসাথি, আমার সকল আবদার মেটানোর চাবি চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল।  আমার বাবা  পার্থিব শরীর ত্যাগ করলেন। পায়ের নীচের থেকে  হঠাৎ যেন মাটি সরে গেলো, মাথার উপর যেন  বিশাল ছাদ ভেঙ্গে পড়ল,নিরাপত্তার ছায়া সরে গেলো মাথার উপর থেকে—হঠাৎ করে যেন বড় হয়ে গেলাম –বৃষ্টি এলেই মনে হত আকাশেরও  আমার মত মন  খারাপ, নিজের অজান্তেই নিজেকে গুটিয়ে নিলাম আস্তে আস্তে , নিজের চারিদিকে এক কঠিন আবরণের বর্ম পরিধান করে নিজেকে খোলসের মধ্যে পুরে দিলাম ঠিক যেন কচ্ছপের মত, আর সেইসাথে নিজের মনের ভেতরে অনেক গুলি দরজা খুলতে খুলতে এক অন্য দুনিয়ায় পৌঁছে গেলাম, পেয়ে গেলাম আমার এক অনন্য ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধুকে—আমার বিবেক—বা অন্য আমি ।  সেই আমার মনের অনাবিল সাগরে যখন আমি ডুব দিলাম, অবাক হয়ে দেখলাম এ তো আরেক দুনিয়া, ঠিক যেন সমুদ্রের ভেতরের মতন। উপর থেকে সমুদ্রকে দেখলে মনের হয় শুধু জল আর জল—কিন্তু তার গভীর অতলে আছে আর এক অন্য জীবন –সেখানে অনেক নাম না জানা রংবেরঙ্গের বিভিণ্ণ সুন্দর প্রাণী—পাহাড়,গাছপালা ও আরও অনেককিছু আমাদের অজানা। সব মানুষের মনের ভেতরেরই এই গভীরতা বর্তমান। কিন্তু খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও অভাব অনটন, মৃত্যু লোভ, লালসা ,প্রতিহিংসা, অজ্ঞতা,  ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতার জন্য জীবনের আকাশে শুধু অসীম শূন্যতা ও জীবন সমুদ্রের অপার জলরাশিকেই আমরা প্রত্যক্ষ করি। 

                                 জীবন থিয়েটারের এই প্রতিবন্ধকতার নিরসনের প্রয়াসই দ্বিতীয়টি, থিয়েটার নামক জীবনদর্শন বা নাটক  । দ্বিতীয়টিতে ঠিক উল্টো, এখানে আমরা জীবন নাটকের বিভিন্ন অংশকে  বিভিন্ন ঘটনাবলীকে, সমাজের বিভিন্ন চিত্রকে , নাট্যরূপ দিয়ে যথাসম্ভব বাস্তবভাবে জীবনদানে সচেষ্ট হই, ও বিভিন্ন নাট্য চরিত্রগুলি দর্শকদের মননে, আদর্শে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে দর্শক নামক সমাজের একটি অংশের ভাবাবেগকে আলোড়িত করার জন্য সচেষ্ট হই। আর একজন পরিপূর্ণ মানুষ-একজন নারী ও একজন নাট্যকর্মী হিসাবে –সমাজের প্রতি আমার যে দায়বদ্ধতা, আমার আমিকে নতুন করে খুঁজে পাবার যে প্রচেষ্টা, মনের অতল গভীর থেকে ভেসে উঠে জীবন আকাশে পাখি হয়ে ভাসার যে স্বপ্ন দেখা---যে প্রান্তে আকাশ আর সমুদ্র মিলেমিশে একাকার হয়েছে, সেইপ্রান্তে পৌঁছে জীবন সূর্য উঠা – সূর্য ডুবার যে সন্ধিক্ষণ তার মায়াময় আলোয়- আবেগে অপূর্বকে আস্বাদ করা ও সেই উপলব্ধি অন্যদের সাথে ভাগ করে নিতে পারার মত অনুভুতি গুলোর অনুরণন……..  পেয়েছি থিয়েটারের  নামক জীবনদর্শনের মাধ্যমে ---তাই আমার কাছে , থিয়েটার/নাটক মানে --- বেঁচে থাকার রসদ, ---থিয়েটার/নাটক মানে --বাঁচিয়ে রাখার মাধ্যম,---থিয়েটার/নাটক মানে সমাজ গঠনের হাতিয়ার---নাটক মানে অজস্র ঘটনার সহস্র বিবরণ---থিয়েটার/নাটক মানেই জীবন আর জীবন মানেই নাটক।

                                  …আমার খুব ছেলেবেলার বিস্মৃতির স্মৃতিতে এখনও ঝলমল যে নাটকটির একটি দৃশ্য বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠে, … ছোট্ট মিনি  ডাকছে –কাবুলিওয়ালাকে …সেই আবেগ,---- বেদনা,---- ছোট্ট মিনির বড় হয়ে উঠা, ও কাবুলিওয়ালারূপী মানুষের ভেতরে তাঁর আর্ত পিতৃসুলভ আবেগতাড়িত  আচরণ আজও আমাকে বিষণ্ণ করে… একনিমেষে সেই ছেলেবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়……। ছোটবেলায় অনেক ছোটদের নাটক ও বড়দের নাটক দেখেছি, বিভিন্ন সময়ে  অনেক ছোটদের নাটকে অংশ গ্রহণও করেছি  । লাল পরী ও নীল পরীদের সাথে ঠাকুমার ঝুলিতে অনেক মজাদার সব নাটকের সাথে একাত্ম হয়ে রূপকথার দুনিয়ায় ডানা মেলেছি। এই ভাবেই চোখের পলকে বড়বেলার দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলাম কবে নিজের অজান্তে। এরই মধ্যে স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়ে কলেজের পাট শেষ করতে করতেই রত হয়ে গেলাম ব্যস্ত কর্মজীবনে।

                                 ... যদিও  “জীবন নাটক” ও “নাটক জীবন” দুই এরই সিংহভাগ  পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হচ্ছে। দুই ক্ষেত্রেই পুরুষরাই সব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও গুরুভার বয়ে চলেছে। আরও স্পষ্ট ভাবে বলতে গেলে বলা যায় এখনো দুই ধরনের থিয়েটারই  বহুলভাবে পুরুষতান্ত্রিক । কিন্তু আমার বলতে দ্বিধা নেই সেই “ থিয়েটার পুরুষ” রাই আমাকে থিয়েটার নামক জীবন দর্শনের মঞ্চের উচ্চতার শিখরের উত্তরনের  প্রথম সিঁড়িতে পা দেওয়ার জন্য  সহযোগিতার হাত এগিয়ে দিয়েছিলেন । ...আমিও আস্তে আস্তে আমার আমির খোলস ছেড়ে কবে যে বেরিয়ে এলাম জানি না,...একদিন আবিস্কার করলাম আমি আরও সাহসী , দৃঢ় , আমি সদর্পে আমার অভিব্যক্তি প্রকাশ করছি, আমি উদ্দাম হয়ে হাসছি, আমি ভাসছি,নিজেকে সমৃদ্ধ পরিপূর্ণ মনে হয়েছে, ...মনে হয়েছে হ্যাঁ, আমি চোখ বুজে - হাতে হাত রেখে বসে নেই, আমি প্রতিবাদ  ও প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অর্জন করেছি,-----কারন নাটক  আমার প্রতিবাদের ভাষা, নাটক  আমার মত করে আমার কথা বলার সাহস । নাটক আমাকে আবার স্বপ্ন দেখার বিলাস ফিরিয়ে দিয়েছে,নাটক আমাকে আবার প্রান খুলে গাইতে শিখিয়েছি ---নাটক আমাকে উদ্দাত্ত কণ্ঠে কবিতা আওরাতে উদ্বুদ্ধ করেছে----আমার সামাজিক বন্ধন আরও মজবুত করেছে, নাটক আমাকে আমার জীবনের টানাপোড়েন ,সাংসারিক ঝুট-ঝামেলাকে সহ্য করেও আশার ছায়াকে আঁকড়ে ধরে নতুন করে বাঁচার প্রেরনা দেয়, তাই নাটক এখন আমার কাছে সেই রূপকথার জীয়ন কাঠি, আর এই জীয়ন কাঠি আমায় দেখিয়েছে--নাটক সমাজের দর্পণ,---যে দর্পণে জীবনের প্রতিফলন ঘটে...মঞ্চে অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা অভিনয় শিল্প স্বত্বার মাধ্যমে বিভিন্ন ঘটনার দর্শন, মননশীলতা ও নাটকীয়তার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস করেন। কিন্তু এই সমাজ দর্পণে নারীরা এত মুষ্টিমেয় কেন? কেন আমরা শুধু নারী না হয়ে সম্পূর্ণা হয়ে উঠতে পারছি না। কবে একে অপরের হাত ধরে আমরা নারী পুরুষ সমভাবে দুই থিয়েটারে দাপিয়ে বেড়াবো ? এই প্রশ্ন গুলো নিয়ে আমাদেরকে আরও ভাবতে হবে , ও ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য কাজ করতে হবে, বিশেষ করে “থিয়েটার পুরুষ” দের মুঠো থেকে নিয়ন্ত্রনের  চাবি কাঠির সূত্রটি “থিয়েটার নারী” দের হাতে কিছুটা হলেও ভাগ করে দেওয়ার দায়িত্ব পুরুষ নাট্য ব্যক্তিত্বদের নিতে হবে। তবেই বোধহয় আমরা জীবন নদীর চরে আবার সবাইকে নিয়ে খুশি ও উদ্দীপনার স্রোতের ছোঁয়ায় বয়ে যেতে পারব, আর এই স্রোতই একদিন আমাদের জীবন সমুদ্রের অপার আনন্দের গভীরে নিয়ে যাবে যার শেষ হবে দিগন্তের সীমানায়।

                                ...“Social revolution is impossible without active participation of women”…এবং এই ভাবনা দুধরনের থিয়েটারেই নারীদের জন্য প্রযোজ্য।  দুই ধরনের থিয়েটার জীবনেই নারীকে বাদ দিয়ে পরিপূর্ণতা পায় না,অসম্পূর্ণ । কিন্তু আমাকে আমার অভিজ্ঞতা বলে,  it is really very hard to be a woman because she must think like a man, act like a lady, look like a young girl and work like a horse, যদিও হাস্যকর ও অবাস্তব কিন্তু এটাই সত্যি। ঘরে বাইরে অফিস আদালতে, মা ,বোন, স্ত্রী, মেয়ে ,পরিচারিকা ইত্যাদি বিভিন্ন ভূমিকায় নারীদের সমাজের সবার প্রতি জীবন থিয়েটারে  যে অমানুষিক নিঃস্বার্থ অবদান , তাঁর সঠিক মূল্যায়ন আমরা কখনও করিনা , করতে জানি না, তাই থিয়েটার জীবনে নারীদের এত কম উপস্থিতি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই কথা বলতে হচ্ছে নারীরা ভুলে যায় ওরাও মানুষ, ওদের ও মনের খোরাক চাই, ওদের দুঃখ, বেদনা , হাসি , কান্না, চঞ্চলতা, উচ্ছলতার প্রকাশ জরুরী। কিন্তু আমরা শুধু মাত্র মা, বোন , মেয়ে, পরিচারিকা, স্ত্রী, হয়েই জীবন কাটিয়ে দেই, ক্লান্ত ও অপাংক্তেয় ভাবে।

                                  এখানেই নাটক জীবনের সার্থকতা। নাটকের মঞ্চ এমন একটি জায়গা......অনেকটা খোলা আকাশের মত, অসীম অনাবিল সমুদ্রের ঢেউএর  গায়ে ঘেঁষা  ধূধূ সমুদ্র তটের মত, ......সেই মঞ্চ আমাদের মনকে সব আবেগের ঢেউ এর চাদরে উথাল পাথাল করাতে, পারে, আমাদের সেই শৈশবে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে, আমাদেরকে আমাদের কষ্টের কথা, যা কাউকে বলা যায় না, যে যন্ত্রণা, ব্যথা, অবিরত কুরে কুরে  খায়, নাটকের মঞ্চে আমরা  স্বাধীন, আমি ও আমরা চিৎকার করে বলতে পারি...... “ আমি বাঁচতে চাই... সবাই কে নিয়ে আমি বাঁচতে চাই...”  অথবা ... “জীবনে ভালো লাগাটাই হচ্ছে সব চেয়ে জরুরী”......এবং এই যে আবেগের বহিঃপ্রকাশ প্রকারান্তে আমাদের মনের কোনে জমাট বাঁধা ক্ষতে মলমের কাজ করে, মনের মলিনতা ধুইয়ে দেয়, মানিয়ে নেয় মন অনেক কিছু, অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলে......এই মঞ্চে। এবং মঞ্চ বা থিয়েটারে, আমরা যা নই, যা কখনও হতে পারিনি, বলতে পারিনা, বিশেষমুহূর্ত গুলো, ফেলে আসা সোনার খাঁচার দিনগুলি কে আবার উপলব্ধি বা আস্বাদ করতে পারি। আর এই অনুভুতির আস্বাদ যে পায় সেই থিয়েটার জীবনের  আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেকে জড়িয়ে নেই। বহুল সংখ্যক নারীদের এবং অবশ্যই পুরুষ ও নতুন প্রজন্মকে নাটক জীবনের পথে এগিয়ে নিয়ে আসতে হলে সেই অনুভুতির আস্বাদন করাতে হবে, এবং  সবার মনের ভেতরের অন্য রকম ইচ্ছে গুলোকে উসকিয়ে দিতে হবে।

                                 আমার স্বল্প জ্ঞানের পরিসরে ,বিগত এক দশক ধরে, আমার পর্যবেক্ষন ,---- বরাকের নাট্যচর্চা,  বরাকের প্রতিকূল ভৌগলিক অবস্থান ও প্রতিকূল রাজনৈতিক অবস্থা সত্ত্বেও সর্বভারতীয় স্তরের, ও, এখানের নাট্যকার, নাট্য পরিচালক , নাট্যকর্মীদের অভিনয় প্রতিভা এবং গন নাট্য আন্দলনের যে জোয়ার তা, সত্যিই উল্লেখযোগ্য । কিন্তু  পরিপূর্ণ নাট্য  প্রতিভা সম্পন্না নারী যিনি পরিচালনা ও অভিনয় এবং নাটকের বিভিন্ন আঙ্গিকে নিপুনা , এরকম নারী নাট্য ব্যক্তিত্ব সর্বভারতীয় স্তরেই  হাতে গোনা কয়েকজন ব্যতিরেকে বিরল। জনমের  মলয়শ্রী হাসমির সাথে পরিচয়ের পর ও জনমের নাট্যকর্ম আমার নাটক জীবনকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু   মলয়শ্রী হাসমি,ঊষা গাঙ্গুলি, শাঁওলী মিত্র ও সাই পারাঞ্জাতের মত মহিলা নাট্য ব্যক্তিত্ব এতদঞ্চলে প্রায় শূন্যই বলা যায়।

                                     এই অঞ্চলের নাট্য চর্চার ইতিহাস-শুধু-ইতিহাস হয়েই রয়ে আছে, কারন নাট্য চর্চা কে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও নাট্য চর্চার জন্য যে ধরনের পড়াশুনা ও চিন্তাধারা করতে হ্য়, তা  থেকে এক বিশেষ অংশ নিস্পৃহ হয়ে আছেন, বলেই আমার ধারণা। এ অঞ্চলে নাট্য মহিলা ব্যক্তিত্ব নাটক নিয়ে বিশেষ ভাবে চিন্তা ভাবনা ও কাজ করছেন বলে অন্ততঃ আমার জানা নেই। তবে সুখের কথা বিগত দুতিন বছর ধরে বিশেষ করে শিলচরে “ রূপম সর্ব ভারতীয় নাট্য প্রতিযোগীতা” র সময় দুতিন টি মহিলা নাট্য সংগঠন শুধু মাত্র মহিলাদের নিয়ে নাটক পরিবেশন করছেন, এমনকি এবছর এর মধ্যে একটি নাটকের পরিচালিকা ও মহিলা ছিলেন। তবে আশা রাখবো অদূর ভবিষৎ এ এই সংগঠন গুলিই মহিলা নিয়ন্ত্রিত নাট্য পরিচালনার সাথে সাথে পুরুষদের চরিত্রে পুরুষদের নিয়েও নাটক করবে।                                   

                                কিন্তু একটি ব্যাপার আমাকে খুব পীড়া দেয় যে বরাকের নাট্য চর্চা শুধু মাত্র – বিশেষত “ রূপম সর্ব ভারতীয় নাট্য প্রতিযোগীতা” ও আরও কয়েকটি হাতে গোনা প্রতিযোগিতা মূলক নাট্য প্রদর্শনকে কেন্দ্র করেই  কেন কোন মতে জীবিত আছে। এ যেন প্রতি বৎসর দুর্গোৎসবের মত, পূজা এল তো পূজার ধূমধাম, আর “রূপমের” সময় বরাকের সমস্ত নাট্য সংগঠন গুলি জুড়ে কে কার থেকে কত ভালো নাটক করতে পারি, তাঁর প্রতিযোগীতা,সবাই ব্যস্ত মহড়ায়। তাঁর পর যে যার কাজে ,নাটক নিয়ে আর  সেরকম কোন মাথা ব্যথা কারও থাকে বলে মনে হয় না। অথচ যে মানের নাটক এখানে মঞ্চস্থ হয় প্রতি বছর,তা সত্যি প্রশংসনীয়। এই অঞ্চলের নাট্য সংগঠন ও নাট্য চর্চা মূলত শহর কেন্দ্রিক । যদিও এ অঞ্চলেরর বলিষ্ঠ নাট্যকার দের লেখনীতে গ্রামের সমস্যা, নারীদের বিভিন্ন চরিত্রায়ন থেকে শুরু করে ফ্ল্যাট বাড়ি ও সন্ত্রাসবাদের মত সমস্ত বিষয়ই  উঠে আসে, কিন্তু  নাটক গুলি পর্যাপ্ত দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় না এবং এখানে  অনেক ভালো অভিনেত্রী ও বোধ সম্পন্না মহিলা নাট্য ব্যক্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও, সারা বৎসর অনেকেই নাটক করার কোন সুযোগ পান না, তাই ওদের প্রতিভা অব্যবহৃত থেকে যায় । যেহেতু বেশির ভাগ নাটকেই নারী চরিত্র খুব কম থাকে,  এবং প্রায় সব সংগঠনই রূপমে অংশ গ্রহণ করে, তাই নতুন মহিলা নাট্য কর্মীদের আগমনের পথ ও প্রায় রুদ্ধদ্বার। বরাকের এই সমস্যা টি নিয়ে ও নাট্য চর্চাকে নতুন ভাবে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ ও চিন্তা ভাবনার বিশেষ প্রয়োজন অবিলম্বেই।

                                       যদিও বাল্যসুলভ চিন্তা ধারা , তবুও না লিখে পারছিনা, সেদিন cricket এর IPL খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হল, নাটক কে আরও মনোগ্রাহী করার জন্য যদি আমরা  এতদঞ্চলে অন্তঃত  IPL এর ধাঁচে নাট্য উৎসবের  ব্যবস্থাপনা করতে পারি তা হলে কেমন হয়। শুধুমাত্র নাটকের স্বার্থে ও  নাট্য উৎসবের  জন্য নিজেদের  নাট্য সংগঠনের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে ,  নতুন ভাবে, কিছু সংগঠনের নাট্য কর্মীরা সাংগঠনিক প্রথা ভেঙ্গে যে যার মত অদল বদল করে মিলে মিশে IPL style এ, ভাল নাটক মঞ্চস্থ করার প্রয়াস যদি করা যায়, আমার মনে হয় নাটকের সংখ্যা যেমন বাড়বে, ঠিক তেমনি সবাই সবার সাথে কাজ/নাটক করার ও সুযোগ পাবে, বৈচিত্র আসবে, একঘেয়েমি ও কাটবে ।  যেহেতু বেশীর ভাগ নাট্য সংগঠন গুলিই রূপম ছাড়া সেই ভাবে নাটক করার সুযোগ পায় না, তাই আমরা যদি বৎসরে দুই তিনটি নাট্য উৎসবের আয়োজন করি এবং সেই আয়োজনের দায়িত্ব rotation wise কয়েকটি  নাট্য সংগঠন ভাগ করে নেয়, এবং এই নাট্য উৎসবে বিভিন্ন  সংগঠনের সবার সহযোগে পূর্ণাঙ্গ নাটক পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়, তবে আরও বেশি মহিলা ও পুরুষ , নতুন প্রজন্ম সবাই ওতপ্রোত ভাবে নাটক ও সমাজ এবং মূল্যবোধের সাথে একাত্ম হতে পারবে। social network site facebook ,google plus, orkut ইত্যাদির আজকের জমানায় ওই  social network site গুলি visit করলেই আমরা বুঝতে পারি নারী পুরুষ জাত ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ শুধু মানুষই কে চায় , নিজের মত আদান প্রদানের জন্য, একে অপরের ভাবনা বিনিময় করেন, নিজের আদর্শে অন্যকে প্রভাবিত করেন ও অন্যের আবেগে আন্দোলিত হন। কিন্তু social network site এ শুধুমাত্র আক্ষরিক ভাবেই আমরা মানুষের আবেগ গুলো বুঝতে পারি,আর নাটকই একমাত্র শিল্প মাধ্যম যেখানের নাটকের জড়িত প্রতিটি মানুষ সে পরিচালকই হন, আবহকার, আলো, মঞ্চ সজ্জা, অভিনেতা, অভিনেত্রী, কিংবা make up ,prompter ,ইত্যাদি নানা ধরনের যে দায়িত্বেই থাকেন না কেন, নাটকের মধ্যে সমাবেশ করেন গভীর ভাবে,সমবেত ভাবে।  নাটকের মঞ্চ একটি বিশাল canvas এর মত, এতে sketch করেন নাট্যকার, কোথায় কি - কোন  রং দিতে হবে সেই তুলির কাজ করেন পরিচালক ,বিভিন্ন  রং এ ভরিয়ে দেন অভিনেতা , অভিনেত্রী ও বাকি আরও সমস্ত নাট্য কলা কুশলীগণ এবং পরিশেষে যে ছবি ফুটে উঠে, তার বিভিন্ন রঙে দর্শকরা নিজেদের মন ও আবেগ রাঙিয়ে নেন। এখানেই নাটকের প্রাসঙ্গিকতা। জীবন থিয়েটার ও থিয়েটার নামক জীবন,নারী ও পুরুষদের সম্মিলিত প্রয়াসে,আরও সমৃদ্ধ হোক,আর একজন “নারী অথবা পুরুষ”  নাট্য কর্মী হিসেবে আমাদের অঙ্গিকার হোক জীবনের দুধের থেকে  হাঁসের মত আমরা শুধু দুধটুকু দর্শকদের জন্য রাখবো , আর সমস্ত জল ধুইয়ে মুছে ফেলে দেব।      

                                আমি প্রবন্ধকার নই,  নই গবেষক,   বিশ্লেষক ও নই। সাধারন নাট্যকর্মী হিসেবে আমার নাটকের প্রতি ভালবাসা, ও নাটকের মাধ্যমে  সমাজের প্রতি দায়ভার থেকেই আমার লেখনির সঞ্চালনা। আমার উপরোক্ত লেখা পড়ে অবশ্যই বোঝা যাচ্ছে, আমি নাটকের অনুরাগে অনুরক্ত,  সেই অনুরাগের ছোঁয়া আমার আমার মননে, মস্তিষ্কে, বোধের দায়রায়---  নাটকের  প্রতি  আমার   বিশ্বস্তার আবেশ হয়তো আপনারাও পাচ্ছেন। আর সেই বোধের অনুভব থেকেই  আজকের এই লেখার অবতারনা। নাটকই আমার লেখনি।একজন সাধারন নাট্য কর্মী হিসেবে আমিও কখনও জীবন ও নাটককে   আলাদা করতে পারিনি তাই আমার লেখায় হয়তো জীবন নাটক ও নাটক জীবনের একটা মিশ্রণ ঘটেছে কারন  আমি জীবন  ও নাটকের মেল বন্ধন পেয়েছি মাটির সাথে আকাশের মেল বন্ধনের মত  এবং সেই বন্ধন থেকে আমি কখনো মুক্তি পেতে চাই না, আমি আকাশেও মেঘের মত ভাসতে চাই আবার সেই আমি চাই মাটীতে আমার শক্ত শেকড়ের ভিত।

                                দিনের পর দিন, বছরের পর বছরের----  বঞ্চনা, উপেক্ষা,অনেক বাঁধা বিপত্তি,ঘাত প্রতিঘাত, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশ্বায়নের আগ্রাসন, অপসংস্কৃতির দুর্বার হাতছানি কে উপেক্ষা করেও আজকের এতদঞ্চলের নবীন প্রজন্ম প্রবীণের সাথে তাল মিলিয়ে চেষ্টা করছে, নিরন্তর নতুন চিন্তা ধারায় সমৃদ্ধ করছে নতুন নতুন নাটক,  তাতে  রূপালি রেখার মত  ক্ষীণ হলেও আশার আলোয় উজ্জীবিত হই, অদূর ভবিষৎ এ উত্তরসূরিরা ওদের করিশমা দেখাবে,   আমরা সবাই এক সাথে একাত্মভাবে, জীবন ও থিয়েটারের উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবো নিরলস ভাবে, নতুন ভোরের নতুন সূর্য কিরনের আভার ছটায় আমাদের চারপাশ ছেয়ে যাবে, এই আশায় আশায় বুক বাঁধি।
                                       উপরোক্ত আলোচনা, ভাবনার দোলায় বয়ে যাওয়া, তখনই শুধু মাত্র পূর্ণ মাত্রা নেবে , যখন এই ভাবনা গুলো নাটকের  মাধ্যমে  আমরা আরও সহজ, সতেজ, ও পরিপূর্ণ ভাবে নিজের আবেগ ও কথা দিয়ে-- যারা সত্যি এই ভাবনা গুলোর  সহায়তায় জীবনের পাক থেকে বেরিয়ে আসতে  চায় ,মানুষ নামক জীবের গোড়াপত্তনের কাজে বিন্দু মাত্র হলেও সঞ্চালকের ভূমিকায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবো, তবেই আমি ও আমরা সত্যিকারের নাট্যকর্মী হয়ে উঠতে পারবো।

                                 তারজন্য নিয়মিত নাটক নিয়ে কাজ করতে হবে। এবং যারা সত্যি নাটক নিয়ে কাজ করছেন, মানুষের জন্য, সমাজের মানবিক বিকাশের জন্য, তাদের জন্য সাধন কিন্তু অধরা নয়। তাদের জন্য অভিনেত্রী ভালো অভিনয় করছে কি করছে না, দলে কতজন মহিলা নাট্যকর্মী আছেন কি নেই, ভালো মঞ্চ আছে কি নেই, আলো ভালো হল না খারাপ, মঞ্চসজ্জা ও রূপসজ্জা হল কি না, তা গুরুত্ব পূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হচ্ছে, নাটকটি সুস্পষ্ট ভাবে অভিনীত হল কি না, এবং সেই নাটকটির মাধ্যমে যে বার্তা প্রকাশ করতে চান, তা কতখানি সঠিক ভাবে উঠে এল সেটাই বেশী গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া উচিত। আসল ব্যাপার হচ্ছে, যখন   নাট্যকর্মীরা এবং নাট্য দলগুলি নাটক কে ক্ষুরধার কলমের মত ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখনই নাটক নাটক হয়ে উঠতে পারে।

                              নাটক কে একটি বিশেষ মাধ্যমের মত ব্যবহার  করার পারদর্শিতা দেখানোর জন্য বিশেষ অভিনয় প্রতিভা, বা বিশেষ দলের দলগত সদস্য বা সদস্যা হতেই হবে আমি অন্তত তা বিশ্বাস করি না। আমার মতে শুধুমাত্র একটি বিশেষ গুন প্রয়োজন আর তা হচ্ছে, নাটক নামক কলম বা তুলি দিয়ে  যে কাহিনী বা ঘটনাবলী বর্ণন করতে  যাওয়া হচ্ছে, বা যে সামগ্রিক  পরিস্থিতির ছবি ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস করা হচ্ছে, তা করার চেষ্টা করার আন্তরিক প্রচেষ্টা জারি আছে কি নেই সেটাই হবে মোদ্দা কথা। নাটককে আমার মুখের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, মানে আমি ও আমরা  যা বলতে চাই তা আমরা নাটকের ভাষায় বলব, নাটক হবে আমার  সেই আঙ্গুল যা তুলে আমি ও আমরা দেখাবো কোনটা ঠিক , কোনটা ভুল। আমরা হানা হানি খুনা খুনি করবো না, আমাদের সমস্ত বিবাদ- মারামারি ,আমাদের ঝগড়া, আমাদের  বঞ্চনার বিবরণ হবে প্রতীকী ভাষায়,  আর সেই প্রতীকী ভাষাই নাটক। আর এ আমার শুধু বিশ্বাস নয় দৃঢ় বিশ্বাস ,যে --  এই পৃথিবীতে অসংখ্য নাট্যকর্মী বিভিন্ন ভাবে, প্রচার বিমুখ হয়ে এই কাজ করে যাচ্ছেন।

               
          
              আমার কিছুদিন আগের একটি অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই। ইদানীং বেশ  কিছু দিন ধরেই পত্রিকাতে আমাদের এখানের চা বাগানের শ্রমিকদের মৃত্যুর খবর প্রকাশ হচ্ছিল এবং সবথেকে দুঃখজনক খবর ছিল যে চা বাগানের শ্রমিকদের মৃত্যুর কারনটি  অনাহার । আজকের দিনেও অনাহারে  মৃত্যুর খবর নিয়ে অবশ্যই পত্র –পত্রিকায় অনেক লেখালেখি, শাসক গোষ্ঠীর গাঁ বাচানো  বয়ান সবই পড়েছি, কিন্তু সবই যেন কাগজের কচকচানি হয়েই রয়ে গেছে ,--- কিন্তু কিছুদিন আগে শিলচরের নাট্য সংস্থা “কোরাস” আয়োজিত দুই দিনের একটি  চা বাগান নিয়ে workshop এর শেষ দিনের একটি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে আমি অফিস থেকে ফেরার পথে নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে দেরীতেই  হাজির হলাম। একটি নাটক চলছিল, অভিনেতা ও  অভিনেত্রীরাই সবাই চা বাগানেরই বাসিন্দা, ওদের নাটকের ভাষাও চা বাগানের ব্যবহৃত ভাষাই ছিল, এবং সবাই খেটে খাওয়া মানুষ, একটি বাচ্চা ছেলেও ছিল। নাটক টি আমি পুরো দেখতে পারিনি কারন আমি দেরী করে গেছিলাম, কিন্তু যততুকুই দেখেছি , তাতে আমি আমার চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি, আমার ভেতরে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, আর ভাবছিলাম, আমরা কি সত্যি মানুষ না অন্য কিছু। কিছু করতে না পারার জন্য নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছিল।  প্রত্যেক অভিনেতা ও  অভিনেত্রী প্রথম অভিনয় করছিলেন, ওদের কষ্ট,ওদের যন্ত্রণা , ওদের খিদে, ওদের কে বঞ্চনার যে চিত্র, ওদের বোধ ও ওদের কিছু করতে না পারার অপারগতার আবেগ –কান্না --- সব নাটক বলে দিয়েছিল--- আমি কিন্তু ওদের ভাষাও ভালো করে বুঝিনি, কিন্তু যে যন্ত্রণার ছবি খবরের কাগজ আমাকে দিতে পারেনি, সেই নাটক আমার গায়ে শিহরন দিয়ে জানান দিয়েছে, কি চলছে ওখানে , দুর্নীতির কোন পর্যায়ে সমাজ, নির্লিপ্ত শাসক, আর আমরা অন্ধ সামাজিক জীব। নাটকের কোন বিশেষ সাজ, আলো, বলতে গেলে কিছুই ছিল না। কিন্তু শুধু আমি ছাড়াও সমস্ত উপস্থিত বোদ্ধা ও নাট্য ব্যক্তিত্বদেরও সেই একই অনুভূতি ছিল। নাটক শেষ হওয়ার পর আরও চমক ছিল আমার জন্য, আমি সত্যি অভিভূত হয়েছিলাম, এবং মনে প্রানে আমার বিশ্বাস আরও প্রগাঢ় হয়েছিলো , “where there is a will , there is a way”. আমাদের সাথে পরিচয় করে দেওয়া হল “একজন মহিলা—নাম “কাজল দেমতা,-- অবসর প্রাপ্ত শিক্ষিকা”  -- উনি এই উপত্যকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের  “বরসিঙ্গা- চা বাগান” এর বাসিন্দা, এবং উনি দীর্ঘ সময় ধরে এই কাজ করে আসছেন। এই সমস্ত নাটকের মাধ্যমের উনি চা বাগানের মানুষদের নিপীড়নের কারন ও মূল যন্ত্রণার থেকে বেরিয়ে আসার আশার-আলো  দেখাবার চেষ্টা করছেন, আমার কাছে উনি বিশাল বড় মাপের নাট্য পরিচালক, নাট্য সঞ্চালক , বিশাল নাট্য মহিলা ব্যক্তিত্ব, একজন সমাজসেবিকা, সবথেকে বড় পরিচয় উনি একজন সাহসী,উচ্চ মানসিকতার শুধু মাত্র মহিলা নন,পরিপূর্ণ মানুষ, এবং অবশ্যই আমার নমস্য । আমার স্মৃতিতে আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সর্বদা জ্বলজ্বল করবেন । সেই    সাথে   আমি  “ কোরাস” এর কাছে এই ধরনের সাহসী পদক্ষেপের জন্য ও আমার এই উপলব্ধির জন্য আমি সত্যি  কৃতজ্ঞ। “কোরাস” বহুদিন ধরে নাটকের মাধ্যমে  এ ধরনের সাহসী ও ব্যতিক্রমী কাজ করে যাচ্ছে, এবং চা বাগানের উপর কর্মকাণ্ড  কে প্রচারের আলোকে নিয়ে এসে ওদের নাট্য চর্চার ও এতদঞ্চলের নাট্য চর্চার ইতিহাসে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। 

                                     শিলচরের একজন বলিষ্ঠ নাট্যকার, শ্রীচিত্রভানু ভৌমিকের     “বরাক-মঙ্গল” নাটকটির কথা এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। নাট্যকার, শ্রীচিত্রভানু ভৌমিকের  বেশীরভাগ নাটকেরই   মূল বিষয়বস্তু  থাকে স্থানীয় সমস্যা ।  “দশরূপক” সংস্থার  “বরাক-মঙ্গল” নাটকে আমাদের এই অঞ্চলের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ও সরকারী বিভিন্ন সুবিধা গুলো যে আদতে সাধারন নাগরিকদের জন্য নয়, এবং আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাটের জরাজীর্ণ অবস্থার জন্য যে নির্বোধ রাজনৈতিক চেলাচামুণ্ডা ও আমরা  সাধারন জনগণই দায়ী,--এবং video conference এর মাধ্যমের এই অঞ্চলের ভিন্ন চিত্র আদর্শ গ্রাম হিসেবে America ও দেশের অন্যান্য প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া যায়-- তারই একটি চিত্রাঙ্কন করা হয়েছিল।  নাটক চলাকালীন  টানটান  হয়ে বসে নাটকটি দেখেছিলাম। ভীষণ ভালো লেগেছিল নাটকটি, মনে হয়েছে, যথার্থ –এইরকম একটি নাটকের খুব আবশ্যকতা ছিল। সব থেকে মন ছুঁয়ে গেছিল গরীব দিনমজুরের কিশোরী মেয়ের অভিব্যক্তি, একটু ভালো করে বাঁচার আশা, মা ও বাবার সাথে পেট পুরে দুবেলা ভাত খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নতুন ভোরের আলো দেখার স্বপ্ন দেখতে চাওয়া--- খুব বেশী তো কিছু নয়!!!  অসম্ভব ভালো অভিনয় করেছে কিশোরী “ফুলমতিয়া” চরিত্রে “অঙ্কিতা সেনগুপ্ত ”  ……নাটকের শেষাংশে যখন “ফুলমতিয়া”কে পঞ্চায়েত নেতাদের নির্দেশানুসারে ওদের ভালো থাকার গল্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কে শোনাতে বলা হয়, ---- আলো পড়ে “ফুলমতিয়া”র উপর----- ওর চোখটা খুশীতে জ্বলজ্বল করে উঠে---- ফুলমতিয়া বলতে শুরু করে-----“ বাবুউউউউউ...... ঐ টিল্লার পিছে, হামদের ঘর......হাওয়া দিলে মড়মড় করে হিলে...... আর বারিষ দিলে একদম গিলা হইয়ে যায়......আর তখন আমরা সারা রাত জেইগে বসে থাকি......মা বলে ঘরটা কখন গিরে যাবে...বাবা বলে....গিরবেক নাই....আরও ধার লিবে...মা বলে...অর ধার মিলবেক  নাই...বাবা বলে না দিলে গাই টা বেইচে দিবে” । এই নাটকটি একটি জ্বলন্ত উদাহরণ যে ইন্দিরা আবাস যোজনা সত্যি যাদের জন্য ওরা আজও ভাঙ্গা ঘরের চাল মেরামত করতে  অক্ষম, ধার নিয়ে কোন দিন ও ঋণের বোঝা ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না, সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম – হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর ও  –কিশোরী মেয়ের নিরাপত্তা ও দুমুঠো অন্ন ও মাথার উপর ছাদের ব্যবস্থা করতে পারে না...... “ফুলমতিয়া”র  প্রিয় গাই টাকে যখন নিয়ে চলে যায়, তখন তার আর্ত চিৎকার...বাপ ও বাপ......আমার গাই টাকে বাবু লিয়ে যাচ্ছে......এবং সবশেষে  “ফুলমতিয়ার” এইসব অভিব্যক্তির জন্য বকাঝকা ও চড় জুটল, দোভাষী অবশ্য সব সামলে নিয়েছিল... । এই নাটকের সমস্ত চরিত্রায়ন প্রায় নিখুঁত...কিন্তু  আমার  কাছে “ফুলমতিয়া” চরিত্রটি নাট্যকারের অসাধারন সৃষ্টি ।  এই নাটকটিও আমার মতে গ্রামে ও মফস্বল অঞ্চলে আরও বহুবার মঞ্চস্থ   হওয়া খুব উচিত ছিল, তবেই হবে এই নাটকের সার্থকতা। 

                                      আমার  অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতির চাদরে মোড়া অনেক এরকম নাটকের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু নাটক দিয়ে আমার  সাংস্কৃতিক জীবনের  কর্মকাণ্ড শুরু হয়নি।  শিলচরে  আমার প্রথম কাজ   “মানুষের খোঁজে” …নাটক নয়, একটি Video film...script writing এবং Directed by শ্রী দেবব্রত চৌধুরী..এই অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক হিংসার কারণ হিন্দু মুসলমান নয় -- ধর্মের ভিত্তিতে মানুষ যাচাই হয় না,তাই ছিল আসল বক্তব্য। আমার  বড়বেলায়  “নঈমা” চরিত্রটি আমার প্রথম অভিনীত চরিত্র। অভিনয় জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নয়,  আমাকে রাজি হতে হয়েছে, কারণ, “নঈমা”  চরিত্রায়নের মাধ্যমে সত্যিকারের  “মানুষের খোঁজে”র সন্ধানে দর্শকদের পথ দর্শাতে শ্রী দেবব্রত চৌধুরী আমার সাহায্য চেয়েছিলেন, আমি না করতে পারিনি। প্রায় তিন বৎসর ওদের সাথে কাজ করেছি, এবং ঐ Team এ আমিই একমাত্র মহিলা ছিলাম, এবং “মানুষের খোঁজে”র “নঈমা”  চরিত্রায়নের সাথে সাথে আমিও অনেক মানুষের খোঁজ পেলাম , জানি না কবে কখন থিয়েটার মানুষদের সংস্পর্শে এসে গেলাম ও আস্তে আস্তে কি ভাবে যে ভারতীয় গণ নাট্য সংঘের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে গেলাম নিজেই জানি না। যুবতী “নঈমা” নিজের দাঙ্গা কবলিত গ্রাম ও দাউদাউ করে  আগুনে জ্বলন্ত নিজের বাড়ি থেকে অসুস্থ বৃদ্ধ পিতাকে ও নিজেকে অমানুষদের হাত থেকে  বাঁচাবার জন্য ছুটতে ছুটতে পথ হারিয়ে ফেলে , অবশেষে একজন মানুষের (যদিও হিন্দু )দেখা পাওয়া যায়,--যার সাহায্যে  নিরাপদ স্থানের উদ্দেশে ট্রেনে চড়ে নতুন অজানা গন্তব্যে রওনা দেয়......একটি মেয়ের বাঁচার লড়াই যার ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নেই বন্দুক, আছে শুধু বোধ, মানুষকে চেনার চোখ আর সবাইকে নিয়ে বাঁচার ইচ্ছা। তাই “নঈমা “চরিত্রটি আমার “আমি”কে  আরও সমৃদ্ধ করেছে, আমাকে মুসলমান মেয়েদের অবস্থানগত সমস্যা নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছে। যদিও আমাদের কাছাড় তথা বরাক উপত্যকাতে হিন্দু  মুসলমান  দুইয়েরই প্রায় সহাবস্থান তথাপিও হিন্দু মেয়েরা , মুসলমান মেয়েদের চেয়ে শিক্ষা-সংস্কৃতিতে,   অনেকাংশে এগিয়ে। কিন্তু আমার পরিসংখ্যান বলে, আজও এতদঞ্চলের মুসলমান মেয়েদের নাবালিক অবস্থায় নিজের থেকে প্রায় ২০/২৫ বড় পুরুষের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়, ওরা অনবরত ঘরোয়া হিংসার শিকার, প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে পণ প্রথা, ও এই ধরণের দাবী দাওয়ার জন্য পিটিয়ে খুনের খবর থাকে, সব থেকে যা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যে, এই অঞ্চলের মুসলমান মেয়েদের গান, বাজনা, নাটক ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিতি ও ভাগ নেওয়ার পরিসংখ্যান প্রায় নেই বললেই চলে, আর বিষয়টি আমার কাছে খুব তাৎপর্যপূর্ণ এই কারনে, এবং হয়তো এটাও একটি মূল কারণ এই অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া  মুসলিম নারী সমাজ। এখানে আমরা এখনও হিন্দু ও মুসলমান নামক ধর্মের বর্ম থেকে বেরিয়ে আমরা বরাকের বাঙালী  হয়ে উঠতে পারিনি,কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ  ও বাংলাদেশের মুসলমান নারীরা কিন্তু এদিকে অনেক এগিয়ে । ঠিক এই ধরণের একটি বিষয় নিয়ে একটি নাটকের কথা মনে পড়ছে, এ অঞ্চলের স্বনামধন্য বিশিষ্ট  নাট্যকার  শ্রীশেখর দেবরায়ের লেখা ও নির্দেশনায় “কালচারেল ইউনিট শিলচর” এর নাটক “জিম্মা” । ভীষণ ভালো একটি প্রযোজনা  এবং মুসলিম মহিলা “সাবিনা” চরিত্রে আমার অভিব্যক্তি প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। চরিত্রটি খুব প্রশংসিত হয়েছিল, এবং আমার সবথেকে ভালো লেগেছিল যে “জিম্মা” নাটকটির দর্শকের আসনে প্রচুর মুসলিম বর্গের পুরুষ ও  মহিলারা ছিলেন। এই যে এক অদ্ভুত বা অজভুত বললেও ভুল হবে না ,-- এক দ্বন্দ্ব  ---হিন্দু ও মুসলমান, --আমাদের মধ্যে এক বিশাল দেওয়াল  ...অথচ আমাদের ভাষা, চলাফেরা , কথা বার্তা, খাওয়া – দাওয়া  প্রায় সমস্ত কিছুই একই রকম, এবং তার থেকেও বড় কথা, আমরা এই ভাবেই পাশাপাশি বছরেরে পর বছর বসবাস করে আসছি, কিন্তু আমাদের মানসিকতার আধুনিকরণ সেই ভাবে ঘটছে না, সুবিধাবাদী ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক পরিকাঠামো এই বিষয়ে সময় পেলেই সুড়সুড়ি দিয়ে জানান দেয়, এই ক্ষতটিকে আরও গভীর করার কুপ্রয়াস চলছে ও চলবে।  এই নাটকের মাধ্যমে “এই অঞ্চলের মুসলিম মেয়েদের তথা মুসলিম সম্প্রদায় ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানসিক দ্বন্দ্ব ভুলে আসলে আমরা হিন্দু মুসলিম ব্যতিরেকে একে অন্যের পরিপূরক হওয়া উচিত এবং এর জন্য উভয় পক্ষকেই একে অপরের দিকে এগিয়ে যেতে হবে,” ---এই সন্দেশটুকু দেওয়ার প্রচেষ্টার জন্য নিজেকে  সমৃদ্ধ মনে হয়েছে, মনে হয়েছে, হ্যাঁ, আমি অন্তত সেই চেষ্টা করেছি, উভয়ের কাল্পনিক দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব  মোচনের।
  
                                    নাটক আমার বোধের পরিসীমা বর্ধিত করেছে, নাটকের চরিত্র গুলি যেন আমার উপর এক বিশাল দায়ভার চাপিয়ে দেয়, মাঝে মাঝে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি নাটক নিয়ে কেন এত ভাবি, কেন নাটক নিয়ে আমার এত টানাপড়েন --- কিন্তু যেদিন থেকে আমি আমার কথা আমার মত করে বলতে শুরু করেছি, যদিও কথাগুলো শুধুই আমার জন্য নয়, সেদিন থেকেই জানতে পেরেছি, নাটক মানেই আত্মস্থ হওয়া – নাটক মানে আত্মসমালোচনা করা । আমার খুব ভালো লেগেছিল , যেদিন আমি আবিষ্কার করলাম আমি একজন নাট্যকর্মী ।  আমাকে দর্শকদের সাথে পরিচয় করে দেওয়া হয়েছিল, নাট্যকর্মী হিসেবে,না মহিলাও নয় ,পুরুষও নয়, শুধু নাট্যকর্মী। “বদরপুর থিয়েটার ওয়ার্কশপ” বদরপুর আয়োজিত একটি থিয়েটার নিয়ে আলোচনা সভায় নাট্য বোদ্ধাদের সাথে আমিও আমন্ত্রণ পেয়ে  যোগ দিতে হাজির হলাম। আলোচনার বিষয় ছিল  “নাটক” ---নাটকের মান, কেন নাটক হবে, কেন আগের মত নাটক হচ্ছে না, সব সংগঠনকে কিভাবে আরও ওতপ্রোতও ভাবে নাটকের সাথে জড়ানো যায়, ইত্যাদি বিভিন্ন আলোচনা হল। আমার ভালো লেগেছিল এই ভাবের আদান প্রদান। সংবাদ মাধ্যমে কেন নাটকের খবর সেইভাবে প্রচার  কেন হয় না,তা নিয়েও কিছু ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেছিলেন কিছু বক্তা। তারপরই হঠাৎ আমাকে আহ্বান করে একজন নাট্যকর্মী বলে পরিচয় করে দিয়ে কিছু বলতে বলা হল । আমি তো প্রায় ঘাবড়ে গেছিলাম, কারণ আমাকে কিছু বলতে হবে আমার জানা ছিল না, তাছাড়া আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো তাও জানা ছিল না, যা হোক ,নতুন পরিচয়ে অভিভূত আমি   “নাট্যকর্মী” হিসেবে আমার তাৎক্ষনিক মনের ভাব প্রকাশ করলাম----বললাম  সংবাদ মাধ্যমে কেন নাটকের খবর সেইভাবে প্রচার  কেন হয় না, সেটি না ভেবে আমরা নাটককে কিভাবে মাধ্যম হিসেবে আরও বিস্তৃতি দিতে পারি তা নিয়ে আমাদের বেশী করে শুধুই ভাবা নয়, নাটক সাধারনের কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত। নাট্য আন্দোলন , নাট্য সংগঠন ও নাট্যকর্মী ... এই শব্দগুলো একটি শক্তিশালী মাধ্যমের কিছু term. তাই নাটকের প্রচারের জন্য অন্য কোন মাধ্যমের প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। নাটকই একমাত্র সরাসরি মাধ্যম যা দর্শক – শ্রোতা কে প্রভাবিত করতে পারে, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী নাটকের উপস্থাপনা। আর এখানেই পথ নাটকের , বিষয়ে আরও ভাবার ও পথ নাটক নিয়ে কাজ করার সম্ভাবনার রাস্তা খুলে যায়।

                                            জরুরী নয় নাটক করতে হলে স্থায়ী মঞ্চেই করতে হবে, এবং দর্শক ও বাতানুকূল পরিবেশে আরামে বসে নাটকের মজা নেবেন, আমাদের সেই  সমস্তই দর্শকদের নিয়ে ও ভাবতে হবে যাদের নাটক দেখতে আসার , সময় ও সাধ্য নেই, তাই পথ নাটকের মারফত আসল বক্তব্য, ও সেই সমস্ত দর্শকদের বোধের পরিসীমার দায়রা বাড়ানোর জন্য এগিয়ে যেতে হবে, আর তা কিন্তু সম্ভব নাটক নামক মাধ্যমের দ্বারা। এখানে একটি পথ নাটকের উল্লেখ করতে ইচ্ছে করছে, আমার অভিনীত প্রথম পথ নাটক শ্রী  শেখর দেবরায় রচনায়   “ তিন মন্ত্রের তিন ফুঃ”। নাটকের মূল বিষয় আমাদের এতদঞ্চলের বিপর্যস্ত রাস্তাঘাট এবং নিষ্কর্মা মন্ত্রী বিধায়কের নিষ্ক্রিয়তা ।  পথ নাটক টি lead  করার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই আমাকে বলা হল , আমি ও নাটকটিকে কোন মতে উতরে দেওয়ার জন্য রাজি হলাম, খুব একটা সাহস মানে পথ নাটক করার জন্য যে রকম ক্ষুরধার হতে হয় আমার মনে হচ্ছিল সেই সাহসটা ঠিক যেন আমার মধ্যে নেই। তবুও একবার ১২ এপ্রিল, সফদর হাসমির মৃত্যু দিবসে যা   পথ নাটক দিবস হিসেবে পালিত হয়,  ভারতীয় গণ নাট্য সংগঠনের পরিচালনায়  আমরা নাটকটি শহর ও গ্রাম ও মফস্বলের  বেশ কিছু স্থানে পরিবেশন করেছিলাম। খুব ভালো একটি নাটক এবং বহুল প্রশংসিত হয়েছিল । বিশেষ করে গ্রামে গঞ্জে দর্শকদের আমাদের সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়াটা ও নাটকের বিষয় বস্তুকে বুঝে নেওয়া ও সহমত পোষণ করা, আমাকে “আমি” হতে আরও বলিষ্ঠ করেছে।   নাটক টি বহু বার আমরা করেছি এবং সব থেকে মজা পেয়েছিলাম যে হয়তো এমন কোন অনুষ্ঠানে আমরা যখন নাটকটি করছিলাম ,দর্শকাসনে বসে ছিলেন স্থানীয় বিধায়িকা ও মন্ত্রী ।  তখন মনে হয়েছিল ,না নাটক তো নয়, সরাসরি নাটকের রূপক কথকোপনের মাধ্যমে চপেটাঘাত করছি এবং কিছু করতে না পারার লজ্জা  আমি কিন্তু ওদের চেহারার অভিব্যক্তিতে দেখতে পেয়েছিলাম। এখানেই আমাদের নাটকের সার্থকতা।

                                        কোন একবার  মনে আছে, কাছাড় ব্লাড ডোনারস এ্যাসোসিয়েশন শিলচর, ব্লাড ডোনেশন ডে তে একটি নাটক করার অনুরোধ করেছিল, ওরা প্রতি বছর দিনটি খুব সুন্দর ভাবে পালন করে, সেবার আমার গিয়ে খুব ভালো লেগেছিল, কিন্তু আমাদের নাটকটি দারুণ ছিল, সবাই নাটকটি মঞ্চস্থ করার সময় খুব উপভোগ করেছিলাম, দর্শকরাও খুব মজা পেয়েছিল, কিন্তু নাটকটি এত informative ছিল যে, আমি নাটকটিতে অংশ গ্রহণ করার ফলে রক্তদান সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পেরেছিলাম, এবং অন্যদের কে জানাতে ও পেরেছিলাম। এই নাটকটিও শ্রী শেখর দেবরায়ের  লেখা ও নির্দেশিত , আমার সব থেকে ভালো লাগা নাটকের একটি এই নাটকটি। প্রথমে আমরা নাটক টি “রক্ত” নামে মঞ্চস্থ করি, পরে শেখরদার পাণ্ডুলিপির যে নাম  ছিল “ সমবেত সংলাপ”  নামেই নাটকটি পরিবেশিত হয়েছিল। নাটকটি সবার এত ভালো লেগেছিল, যে আমরা অসংখ্য বার  নাটকটি পরিবেশন করেছিলাম। এই নাটকের মূল বিষয় ছিল , রক্ত ও জীবন --- রক্তদান সম্বন্ধে ছোট ছোট খুব জরুরী কথা, এবং অবশ্যই রক্ত দানের আবশ্যকতা । নাটকটি  পথ নাটক হিসেবেই বেশী পরিবেশিত হয়েছে, তবে মঞ্চে ও বহুবার নাটকটি হয়েছে।  আমি  যে কথাটি বলতে চাইছি,  মূল   কথাটি  হল, নাটক ও হতে পারে সমাজের বিভিন্ন কুপ্রথা, ভালো গুণাবলী, অন্যায় অবিচার, সামাজিক অজ্ঞতা ইত্যাদি দূরীকরণের একটি পন্থা । সত্যি বলতে কি  আমিও আস্তে আস্তে উপলব্ধি করলাম, নাটক নামক রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে আমরা যদি অন্তত নিজেদের ভাবনার জট গুলো খুলে দিতে পারি, আর সবাই কে নিয়ে সেই রাস্তায় জীবনের কিছুটা পথ পাড়ি দিই, এবং সবাই কে কি করে ভাবনার ছোঁয়ায়  মশগুল হতে হয় সেই নেশাটা ধরিয়ে দিতে পারি, তখনই আমরা যথার্থ নাট্যকর্মী হয়ে উঠতে পারবো।

                                        শুরুর দিকের কথা, আমাকে  কেউ বিশেষ চেনে না, তখন আমি “মানুষের খোঁজে”  ভিডিও ফিল্মে কাজ করছিলাম প্রায় শেষের দিকে , হঠাৎ একদিন ফোন করে  আমার সাথে দেখা করতে আমার বাসায়  এলেন, নিজের পরিচয় দিলেন,নাম বললেন,একজন নাট্যকার, সাথে আরও একজন ছিলেন, এসেই চটপট করে আমাকে উনার চিত্রনাট্য সংক্ষেপে শোনালেন, আমি কিছু বলার আগেই, বললেন কোথায় কখন রিহারসেলে যেতে হবে, আমি একটু হেসে কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, আমি পারবো আপনি জানেন ? উনি বললেন তোমাকেই করতে হবে, তুমি চলে এসো।   এর আগেও বেশ কয়েকটি অনুরোধ এসেছিল, কিন্তু আমি খুব ইচ্ছুক ছিলাম না।  উনার আমার প্রতি বিশ্বাস ও উনার আত্মবিশ্বাস দুইই আমাকে প্রভাবিত করেছিল । পরে খবর নিয়ে জেনে ছিলাম, তিনিই সেই চিত্রভানু ভৌমিক, এবং উনিই প্রথম নাট্য ব্যক্তিত্ব যার সাথে আমার প্রথম কাজ, যদিও নাটক নয়, ছিল দূরদর্শন এর  একটি Tele Play “ সন্ধ্যা” ।  যেদিন প্রথম রিহারসেলে গেলাম, ঠিক নাটকের মতই রিহারসেল হচ্ছিল, আমি তখনও নাটক অতসত বুঝিনা, তবে ক্যামেরায় সামনে কাজ করার অভিজ্ঞতার সুবাদে বুঝতে পারলাম, একটি নাটক কেই চিত্র নাট্য রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আমাকে বিশেষ কিছু বললেন না, শুধু বললেন তোমার মত করে ভেবে নাও, এই এই ব্যাপার। অসম্ভব ভালো ও সহজ সরল তথাপি হৃদয় ছোঁয়ানো একটি গল্প। আমার বিশেষ চিন্তা করার অবকাশ ছিল না , কারণ আমি ততদিনে ক্যামেরার সামনে সাবলীল হয়ে গেছি, আর ঝটপট করে shot wise কাজ শেষ করতেই আমি বেশী আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু পুরো shouting টাই একটু অন্যরকম ভাবে ক্যামেরাবন্দী করা হয়েছিল, আমার মনে হয়েছিল, shot division properly করা হয়ে উঠেনি। মনে মনে ভাবছিলাম, নাটক – ফাটক খুবই বিরক্তিকর, শুধু রিহারসেল, আমার ক্যামেরাই ভালো, চটপট এসে shot দিয়েই কাজ শেষ। কিন্তু অপর দিকে অন্যরা বলাবলি করতো, নাটকই ভালো, ক্যামেরার সামনে যত ঝামেলা। আমি ছাড়া এই টেলি নাটকে সবাই নাটকের মানুষরাই ছিলেন, এবং সবাই আমার অচেনা। সব শেষ দৃশ্যটি আমার ছিল, এবং আমার এখনো মনে আছে, সারাদিন বসে ছিলাম, ঠিক সন্ধ্যার সময়  আমার shot  এর shouting  শুরু হল, তখনও নাটকটির নাম ঠিক হয়নি, উনি আবার আগাম নাটকের নামটি জানান দেন না, একদম শেষ মুহূর্তে সেটি জানান । কেন্দ্রীয় চরিত্র “সন্ধ্যা” র ভুমিকায় আমি একজন পক্ষাঘাতে পঙ্গু স্বামীর স্ত্রী, যে নিজের সাংসারিক জীবন যুদ্ধে ম্রিয়মান, কিন্তু সবাইকে নিয়ে ভালো ভাবে বাঁচার জন্য কোন ত্রুটি রাখতে চাইছে না। মেয়েটি যদিও অল্প বয়সের, কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থার জন্য মেয়েটিকে অনবরত নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে । স্বামী পঙ্গু, বিছানায়,  তাই সারাদিন কাজ করে, রাতে ঘরে ঠোঙা বানিয়ে দোকানে বিক্রি করে কোন মতে শাশুড়ি - স্বামীর মুখে দুটো অন্ন ও স্বামীর পথ্য জোগাড় করতে করতে  নাজেহাল। স্বাভাবিক ভাবেই যখন তখন ঘর থেকে বেরোতে হয়, ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়, অনেক পুরুষ মানুষদের সাথে কথা বার্তা বলতে দেখা যায়, মাঝে মাঝে কিছু কাজে পুরুষ মানুষ এসে খোঁজ ও করে,...  যা হয় আজও ---আস্তে আস্তে আশেপাশের প্রতিবেশীরা ওকে সন্দেহ ও খারাপ মেয়ে বলে ভাবতে শুরু করে। কিন্তু ওর স্বামী কিন্তু কথা বলতে না পারলেও ইশারায় এসবের প্রতিবাদ করে। সব শেষের দৃশ্যে , যখন মেয়েটি একটা হুইল চেয়ার নিয়ে বাড়িতে আসে, সেদিন একটু বেশী রাতই হয়ে গেছিল, কিন্তু নিজেকে নিংড়ে দিয়ে, সবার অনুমান কে মিথ্যা প্রমাণিত করে যখন সন্ধ্যা প্রমান করলো সে কতটা আশাবাদী , নিজের পঙ্গু স্বামী কে আবার জীবনের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে, হুইল চেয়ারে বসিয়ে নতুন করে বাঁচার  জন্য যে সংঘর্ষ করে যাচ্ছে, আর এই হুইল চেয়ারটি জোগাড় করার জন্যই যত কাণ্ড। আমার এখনো মনে আছে, যখন সন্ধ্যা , কলিং বেল বাজিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো, পেছন থেকে টেনে নিয়ে এলো হুইল চেয়ারটি সবাই বিস্মিত হয়েছিল। “সন্ধ্যা”  যে হুইল চেয়ারে স্বামীকে বসিয়ে এই জীবন  চলার পথে ভালো ভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছিল...  শুধু তাই নয়, নিজেও বাঁচতে চেয়েছিল সবাইকে নিয়ে। সেইসাথে  সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার এই যে আন্তরিক প্রয়াস থেকেই কি আমরা বুঝতে পারি না “ সন্ধ্যা” রা কত শক্তিশালী, ওরা দুর্বল নয়, ওরা খারাপ মেয়ে মানুষ নয়, ওরাও শুধু মানুষ, স্বপ্ন দেখতে চায়, বাঁচতে চায়, হাসতে চায়। ভীষণ ভালো শক্তিশালী একটি চরিত্র...আমার মনে আছে, নাটকের শেষ দৃশ্য, কিন্তু আমার অভিনীত প্রথম  shot, আমার চোখটা জ্বলজ্বল করছিল, বুকের ভেতর কেমন জানি একটা কষ্ট হচ্ছিল, cut and ok শুনতে পেলাম, আরও শুনলাম একজন co-actor আশ্চর্য হয়ে আমায় বলছেন  first takeই ok হয়ে গেলো। অপ্রিয় হলেও আজও সত্যি,যে নারীরা,  কিশোরীরা, মেয়েরা, মহিলারা যত বেশী যুঝছে বেঁচে থাকার জন্য, সমাজ আজ ও হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পরিবর্তে ওদের দিকে আঙ্গুল তুলতেই বেশী আগ্রহী। কিন্তু সব কিছুকে, সব বাঁধা কে নস্যাৎ করে দিয়েও এই সমাজের অগুনতি “সন্ধ্যা” রা  জীবন রাতের অন্ধকার আকাশে সন্ধ্যাতারা হয়ে অন্যদের আলো দেখাবার আপ্রান চেষ্টা করছে,এবং অপেক্ষা করছে কখন ভোরের আলো ফুটবে।  এই চরিত্রটির মাধ্যমেই আমি বিশেষ পরিচিতি পেয়েছি, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল ও মফস্বল …দর্শকদের  কাছে।  অসম্ভব ভালো কিন্তু খুব সাদামাটা ছিমছাম একটি প্রযোজনা, এখনও প্রায়ই অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার হয়ে থাকে।  নাট্যকার শ্রী চিত্রভানু ভৌমিক এর এই যে প্রয়াস, নাটকের মাধ্যমে “সন্ধ্যা” দের বেঁচে থাকার , স্বপ্ন দেখার ও জীবনের স্রোতের বিপরীতে আপ্রান চেষ্টা করে ভেসে থাকার ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার চিত্রাঙ্কন  আসলে সামাজিক জীবদের মান ও হুঁশ নামক বোধের আদল দিয়ে মানুষ রূপ দেওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্যি প্রশংসনীয়।

                                 এই যে ছোট ছোট অথচ খুব সূক্ষ্ম অনুভূতি ও তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়াগুলি কে নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরা ও দর্শকের মনে প্রশ্ন উত্তরের ডামাডোল তৈরী করে দেওয়া, সব পারেন নাট্যকার । আমি যে চরিত্র বা নাটকের কথা গুলো এখানে আলোচনা করছি,  হয়তো মনে হতে পারে পাঠকবর্গের কাছে আমি শুধু বাছা চরিত্র গুলিকেই বিশ্লেষণ করছি, তা নয় আসলে আমি যে চরিত্র গুলি কে মনন করেছি, উপলব্ধি করেছি, ও আমার মত করে ভেবেছি ও আমার জীবন থিয়েটারের অনেক মুহূর্তের সাথে একাত্ম হতে পেরেছি যে সব চরিত্রায়নের মাধ্যমে, সে গুলি আমাকে আমার “আমি” থেকে সমাজের “আমরা” হবার পথে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে, সেই গুলিই আপনাদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছি । আমাদের রোজকার জীবনের অনেক কিছুই আমি মেনে নিতে পারি না, মেনে নিতে কষ্ট হয়, একেক সময় মনে হয় কেন মানুষ সব সময় এত আত্মকেন্দ্রিক,কেন চোখ থাকা সত্বেও না দেখে অন্ধের মত পাশ কেটে চলে যায়, এত সব আমি একা কি করে প্রতিরোধ করবো, মাঝে মাঝে ভীষণ হতাশ লাগে, কিন্তু আমার বিবেক আমার অন্য “আমি” আমাকে কবিগুরুর ভাষায় জানান দেয়, “ অন্তর গ্লানি সংসার ভার... পলক ফেলিতে কোথা হাহাকার......”  আর তাই আমার মন বলে “  যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে...”…….যে কোন ভাবেই হোক এগিয়ে যেতে হবে, থামা চলবে না, এই আশায়... চলতে চলতে একদিন ঠিক পৌঁছে যাবোই।

                                         এই মুহূর্তে আমার আরও একটি নাটকের কথা  খুব মনে পড়ছে কয়েক বৎসর আগের কথা, সব থেকে দুঃখজনক যে নাটকটি আমরা মাত্র একবারই মঞ্চস্থ করেছি, তারপর আর সম্ভব হয়ে উঠেনি, একটি পরীক্ষা মূলক নাটক,  বিশিষ্ট  নাট্যকার শেখর দেবরায় লেখা ও নির্দেশনায় “শিলচর কালচারেল ইউনিট” এর পরিবেশনা “রূপান্তর” । উত্তরপূর্বাঞ্চল এর বিবিধ কৃষ্টি ও সংস্কৃতি  এবং এতদঞ্চলের সমস্যা, রাজনীতি, এবং সন্ত্রাসবাদ এবং প্রতিবাদের সঠিক ভাষা কি সেই প্রশ্ন নিয়েই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। একটি চর্চিত নাটকের অন্যতম এই নাটক। পত্র পত্রিকায় অনেক দিন ধরে  অনেক বিদগ্ধ জনের মতামত , সমালোচনা ও আলোচনা প্রকাশ হয়েছিল। নাটকটি খুব প্রশংসিত ও হয়েছিল। নাটকের মাধ্যমে নাট্যকার একটি প্রশ্ন দর্শকদের জন্য তুলে ধরেছিলেন----- কি হওয়া উচিত আমাদের প্রতিবাদের ভাষা ? প্রকৃতির প্রাচুর্যে ভরপুর কিন্তু সঙ্কুল জনক ও কঠিন  ভৌগলিক অবস্থানের দরুন,  উত্তরপূর্বাঞ্চল ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক পিছিয়ে, এবং তার জন্য রাজনীতি বহুলাংশে দায়ী। মনিপুর , আসাম, ত্রিপুরা, নাগারাজি, মেঘালয়, অরুণাচল , মিজোরাম … এই অঞ্চলের মানুষ কিন্ত অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে ও বাঁচার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে কিছু সুযোগ সন্ধানী অমানুষ, রাজনীতিবিদ নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এক শ্রেণীর নিরীহ ও বোকা জনগণ কে প্রতিবাদের নামে ফুসলিয়ে সন্ত্রাসবাদ নামক এক স্থায়ী ব্যবসাপ্রস্থ   স্থাপন করেছে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ সাধারন মানুষের মনের ক্ষতকে উস্কে দিয়ে সন্ত্রাস নামক ভয়ংকর ছোঁয়াচে মারন রোগের শিকার বানাচ্ছে । আর যারা সন্ত্রাসী, ওরা নিজের জীবন ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে অক্লেশে  ঠাণ্ডা মাথায়  খুনীরূপে আত্ম প্রকাশ করছে। কিন্তু ওদের এই সন্ত্রাসী কার্যকলাপের পেছনে যে যুক্তি কাজ করে তা হচ্ছে …… এই পন্থা ওদের প্রতিবাদের ভাষা……আবার এই প্রতিবাদ কে দমনের জন্য সেনাবাহিনী ও সরকার  মনিপুরে যে দমননীতি চালাচ্ছে (যার মধ্যে অত্যাচার ও ধর্ষণ ইত্যাদি ও বর্তমান) , তার প্রতিবাদে একবার মনিপুরের  একটি ঘটনায়  কিছু সংখ্যক ইমারা ( মনিপুরী মায়েরা)  সেনা বাহিনীর কার্যালয়ের সামনে একসাথে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে গর্জে উঠেছিল-----“ আয় আমাদের ধর্ষণ কর, দেখি তোদের কত ক্ষমতা”……এই যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এবং তার পরবর্তী প্রতিবাদ………একই সাথে আমরা যদি গৌহাটির সেই আদিবাসীদের নিজস্ব দাবী নিয়ে মিছিলের ঘটনার দিনের কথা স্মরণ করি……এবং পরে পুলিশের ব্যভিচারী লাঠি চালানো……এবং একাংশ জনগণের সেই মিছিলের প্রতিবাদস্বরূপ  লক্ষ্মী ওরাং নামের আদিবাসী  কিশোরী কে সম্পূর্ণ নগ্ন করে রাজপথে প্রকাশ্যে দিবালোকে চলতে বাধ্য করেছিল……ঐ ঘটনা গুলির সমন্বয় করে আমরা তুলে ধরতে চেয়েছি বিভিন্ন প্রতিবাদি ভাষা……আমি এই নাটকে ইমা ও আদিবাসী মেয়েটির চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। ইমা চরিত্রটি আমাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়েছিল……আমার ভাবতে গা শিউরে উঠেছিল……যে কতখানি চূড়ান্ত পর্যায়ে একজন নারী স্বেচ্ছায় এ কাজ করতে পারে……কতখানি অসহায় মনিপুরের ইমারা………আর লক্ষ্মী ওরাং আমাদের মহাভারতের কথা মনে পরিয়ে দেয়, সত্যি আজও নারী কত অসহায়, ……আমরা আমাদের নাটকের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছিলাম, সাত বোনের রাজ্যের সমন্বয় মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়, আমরা আমাদের বিবিধ ভাষা…বৈচিত্র …সংস্কৃতি…সবুজ পরিমণ্ডল …বাঁধা বিপত্তি …এসব নিয়েই আছি ও থাকব। শুধু আমাদেরকে আমাদের মত করে থাকতে দাও…এবং দর্শক সমস্ত প্রতিবাদের ভাষা পর্যালোচনা করে নিজেই ঠিক করে নিক……কি হওয়া চাই সঠিক প্রতিবাদের ভাষা। আলোচনা, একে অপরের সাথে সাংস্কৃতিক আদান প্রদান ও মানবিক বোধ সম্পন্ন মানসিকতার বহিঃপ্রকাশই  হওয়া উচিত আমাদের সঠিক প্রতিবাদের ভাষা।

                                        প্রকৃতির মত সমাজও বিবর্তনমুখী......এবং সামাজিক রীতি নীতি, প্রথা ও উন্নত চিন্তা ধারা ও সমাজ সংস্কার মূলক কার্যকলাপ দলগত প্রয়াসের ফসল নাও হতে পারে। একক প্রচেষ্টাও খুব সুক্ষ্ম ভাবে বিশাল বৈপ্লবিক জোয়ার আনতে পারে এবং সামাজিক কুপ্রথা নিরসনে এক ইতিহাস গড়ে তুলতে পারে। সত্য ঘটনা ও ইতিহাস অবলম্বনে আরও একটি নাটকের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাই । নাটক “ শিলালিপি” ,নাট্যকার শেখর দেবরায়, পরিবেশিত হয়েছিল “ শিলচর কালচারেল ইউনিট” এর প্রযোজনায়। খুব পুরনো নয়, ২০১১ তে প্রথম মঞ্চস্থ হয়, পরে এই অঞ্চলের বিভিন্ন নাট্য উৎসবে ও ত্রিপুরাতেও নাটকটি পরিবেশিত হয়েছিল। গত বছরই মেলাঘর-ত্রিপুরা  নাট্য উৎসবেও নাটকটি পরিবেশিত হয়েছিল, সেখানে উপস্থিত  বাংলাদেশের নাট্যদল “লোক নাট্যদল” এর নাট্যকর্মীরাও  সবাই খুব ভূয়সী প্রশংসা করেছেন  নাটকটির । নাটকটির মূল বিষয় আমাদের কাছাড়ের আজকের যে অঞ্চল টি “ডিমা হাসাও” যা পূর্বে উত্তর কাছাড় বলে পরিচিত ছিল, হাফলঙ- মাইবঙ- হারাঙ্গাজাও-মাহুর-জাটিঙ্গা-মাহুর... ইত্যাদি  অঞ্চলগুলির সমাহারই আজকের ডিমা হাসাও, সেই অঞ্চলের রাজতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ইতিহাসে নরবলি নামক কুপ্রথার অবলুপ্তি ও পরবর্তী সময়ে নানা ঘটনাবলীর নাট্যরূপ । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সেই সঙ্গে খুন অপহরণ সন্ত্রাস দুর্নীতি এই অঞ্চলটিকে  আজ আসাম তথা বরাক উপত্যকা এবং অবশ্যই ভারতবর্ষের রক্তক্ষয়ী বধ্যভূমির একটি অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়েছে । কয়েক হাজার বছর পূর্বে  সেই কাছাড় রাজ্যের রাজার অকাল প্রয়াণে তাঁর নাবালক পুত্র সুরদর্পনারায়ণকে রাজা রূপে স্থলাভিসিক্ত করা হয়, কিন্তু যেহেতু রাজকুমার  সুরদর্পনারায়ণ খুবই ছোট  ছিলেন , মাতা চন্দ্রপ্রভা রাজকুমার  সুরদর্পনারায়ণের হয়ে সমস্ত রাজ্য পরিচালনা করতেন। রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের  যে বিভিন্ন hypocrisy এই নাটকের বিভিন্ন চরিত্রায়নের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা করা হয়েছে, তা নাটকটিকে শুধু মাত্র একটি ভালো নাটকই নয় , একই সাথে নাটকের বিষয় বস্তুকে   contemplative and contemporary করে তুলেছে। “রাজমাতা চন্দ্রপ্রভা” চরিত্রটি আমার মতে আমার অভিনীত কঠিন চরিত্র গুলির মধ্যে একটি। রাজ্যের সুখ সমৃদ্ধি অকাল মহামারী ইত্যাদি নিরসনে রাজ্যের ধর্মাধ্যক্ষের আদেশে প্রতি বছর মায়ের মন্দিরে মায়ের চরণে নরবলি উৎসর্গ করা হয়। যারা নরবলির যোগানদার  “মাইপাডাউ” নামে ওরা পরিচিত , সমাজতন্ত্রের অংশাবলি , এবং অবশ্যই রাজতন্ত্রের  কেউ  কিন্তু নরবলির জন্য আজ অবধি বলি হয়নি। রাজ্যের সুখ শান্তির জন্য সাধারন নিরীহ প্রজাদের কেই সব সময় বলির পাঠা হতে হয়। কারণ সমাজতন্ত্রের ও রাজতন্ত্রের প্রতি সমীহ ও সত্ত্বার অধিকারকে হাতের মুঠোতে রাখতে কিছু মানুষ  সবসময় ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে । রাজমাতা চন্দ্রপ্রভার চিন্তাধারার  প্রভাবে রাজা  সুরদর্পনারায়ণ  বড় হয়ে উঠলেন, কোন তন্ত্রের কাঠপুতুল না হয়ে সত্যিকারের রাজা হলেন এবং ইতিহাসে পাতায় জায়গা করে নিয়েছিলেন। বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারক ভুবনেশ্বর বাচুস্পতি প্রেমের বাণী, হিংসা দ্বেষ ভুলে গিয়ে সৌহার্দের ভাষা রাজমাতা চন্দ্র প্রভাকে নিজের ভাবনার প্রতিফলন ভেবে উল্লসিত হওয়া এবং স্বীকারোক্তি যে এমন ব্যক্তিত্ব রাজসভায় চাই যার  জ্ঞানের আলোকে অজ্ঞতা , কুসংস্কার , অন্ধকার দূরীভূত হবে, এবং অবশেষে যখন রাজা সুরদর্পনারায়ণ  ঘোষণা করলেন আজ থেকে নরবলি রাজ্যে নিসিদ্ধ হল, তখন সমাজ তন্ত্রের কুশীলবরা এই আদেশ মেনে নিলেও “মাইপাডাও” রা কিন্তু মানতে পারল না। ওরা বলল , আপনারাই তো আমাদের নরবলির যোগানদার বানিয়েছেন, হাজার হাজার বছর ধরে আমরা তাই করে আসছি, এখন না বললে কি করে হবে, আমরা সেই যুগেও ছিলাম , আমরা এই যুগেও আছি, আমরা ভবিষ্যতে ও থাকব। নরবলির খড়গ নিসিদ্ধ হল, কিন্তু সেই খড়গের জায়গা নিয়েছে আজ বন্দুক পিস্তল, বম , অপহরণ, এবং অহরহ নরবলি চলছে, আজ আসামে  জ্বলছে, হাজার হাজার মানুষ গৃহহারা হচ্ছে...কাল ত্রিপুরাতে সন্ত্রাসবাদের নামে আতঙ্ক খুন লোপাট জলভাতের মত চলছিল, পরশু মণিপুর ......মুম্বাই...দিল্লি...আমেরিকা... মিশর...সিরিয়া...ভিয়েতনাম...ইরাক ......আফগানিস্তান...পাকিস্তান...... সমস্ত বিশ্ব জুড়ে চরম অমানবিকতা ...  চলছেই  চলছে...এবং চলবে যতদিন না রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের বিভেদ ঘুচবে ...সমাজতন্ত্র সঠিক ভাবে কাজ করবে ততদিন রাজতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দ্বারা পোষিত ও  পালিত “ মাইপাডাও” রা এই নিধন যজ্ঞ চালিয়ে যাবে। মানুষ মারার খেলা চলবে। তাই ঘরে ঘরে রাজতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিটি অংশে যারা আছেন তাদের ভাবনা চিন্তা ধারা রাজমাতা চন্দ্রপ্রভার ব্যক্তিত্বের আবেশে আবেগে চালিত হতে হবে এবং বহুলাংশে রাজতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে  “রাজমাতা চন্দ্রপ্রভা” দের মত ব্যক্তিত্বের যোগদান আবশ্যক। আমাদের সমাজে “রাজমাতা চন্দ্রপ্রভা” , “কুন্তী,” “দ্রৌপদী” ...এই ধরণের প্রভাবশালি ব্যক্তিত্ব খুবই জরুরী, যারা রাজতন্ত্রে থেকে সমাজতন্ত্রকে সঠিক পথে চালিত করতে পারে প্রজাতন্ত্রের উন্নতির জন্য। মনে পড়ে গেলো আরও একটি নাটকের কিছু চরিত্রের কথা, বুদ্ধদেব বসুর “প্রথম পার্থ” ......নির্দেশনায় ছিলেন বিশিষ্ট নাট্য কর্মী শ্রীরাহুল দাশগুপ্ত ...প্রযোজনায় “প্রান্তিক” সংস্থা......“দ্রৌপদী” চরিত্রে আমার ভূমিকা ...মহাভারতের দুটি শ্রেষ্ঠ নারী চরিত্রের একটি.....অদ্ভুত লেগেছিল আমার......এত হাজার বছর পূর্বেও এত বলিষ্ঠ নারী চরিত্র ... “দ্রৌপদী” চরিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে  মতাদর্শগত জায়গায় অবস্থান করা যে ক্ষেত্রটি...... আমাকে বিশেষ আকর্ষণ করেছিল। “কুন্তী,”  ও “দ্রৌপদী”  এবং কর্ণ এই তিনটি  চরিত্রই মুখ্য। খুব বিখ্যাত একটি নাটক ।      এই নাটকটিও একটু অন্য ভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমার মনে আছে “প্রথম পার্থ” “রূপম শিলচর সর্ব ভারতীয় নাট্য প্রতিযোগিতা” তে   আমার অভিনীত প্রথম নাটক । এই নাটকটিও খুব  প্রশংসিত হয়েছিল ।

                         হাজার হাজার বছর পূর্বে দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করার প্রয়াস করেছিল, সেই কুকর্মের জন্য দ্রৌপদী শুধু মাত্র দুঃশাসন বা দুর্যোধনকে নয় যুধিষ্ঠির থেকে শুরু করে পঞ্চপাণ্ডবকেও তার জন্য প্রকাশ্যে দায়ী করে ছিলেন, এবং তার প্রতিবাদ স্বরূপ কুরু বংশ ধ্বংস করার জন্য যে পণ করেছিলেন তার ইতিহাস সবার জানা। কিন্তু এখানে যে বিষয়টি লক্ষনীয়  তা হল , সেই যুগেও দ্রৌপদীর মত নারীও প্রতিবাদ করার স্পৃহা ও স্পর্ধা দেখিয়েছিল এবং পরিণামে কুরু বংশ  ধ্বংস হয়েছিল। আজ এই বিশ্বায়নের যুগে আমরা কি সেই স্পৃহা ও স্পর্ধা দেখাবার সাহস অর্জন করেছি। কোন নারী কি সমাজে ...বিশেষ করে উচ্চ প্রতিষ্ঠিত বংশের নারীরা প্রকাশ্যে এভাবে স্বামী বা সমাজের অন্য পুরুষদের ব্যভিচারের,  বিরুদ্ধে সরব হতে পারবে...... প্রকারান্তে আমরা যদি মনিপুরের ইমাদের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই আজকের সমাজের দুঃশাসনরা ইমাদের বাধ্য করছে  এবং প্রতিবাদ স্বরূপ ইমারা প্রকাশ্যে স্বেচ্ছায় বিবস্ত্র হচ্ছে ...... আজ সমাজ অসংখ্য দুঃশাসনের সমাহার তাই প্রকাশ্যে দিবালোকে লক্ষ্মী ওরাং নামের কিশোরীকে রাজপথে বিবস্ত্র করার উদ্ধততা আমরা দেখতে পেয়েছি। আর সম্প্রতি গৌহাটির মৌসুমী কাণ্ড তে চোখ বুলালেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আমরাই সেই যুগের দুঃশাসন থেকে শতগুণ দুঃসাহসী অসংখ্য দুঃশাসনকে জন্ম দিচ্ছি, প্রতিপালন করছি, এবং তাতে আমাদের বিন্দু মাত্র লজ্জা শরম নেই। আর তার থেকেও লজ্জাকর যে ঘটনা, আমরা নীরবে এই ধরণের ঘটনাবলীকে সায় দিয়ে যাচ্ছি, কখনও বা মেয়েদের চরিত্রহীন বলে, কখনও বা মেয়েদের পোশাক পরিচ্ছদের দোহাই দিয়ে, কখনও বা সমাজের দোহাই দিয়ে,  কিন্তু আমরা কখনও নিজে এর দায়ভার স্বীকার করে নিতে পারি না, আর পারি না বলেই অহরহ ঘটে যাচ্ছে আজও এইসব ঘটনাচক্র । কিন্তু একটি কথা স্বীকার করে নিতেই হবে যে সমস্ত বিশ্ব জুড়ে যে অমানবিক কাণ্ডকলাপ , দাঙ্গা, খুন রাহাজানি, দুর্নীতি , ইত্যাদি ইত্যাদি চলছে, তাতে মেয়েদের যোগদান কম। তাই আমাদের সমাজে রাজমাতা চন্দ্রপ্রভা , দ্রৌপদীর ইত্যাদি এরকম  অন্যান্য ব্যক্তিত্বদের  আমাদের সমাজের দুই ধরণের থিয়েটারেই বিশেষ করে জীবন থিয়েটারে,  সমাজের হাল ধরতে হবে, ও দুই ধরণের থিয়েটার নারীদের আরও মানসিক ভাবে শক্তিশালী হতে হবে।

                               শুরুতে দ্বিধা ছিল, আদৌ এগোতে পারবো কি, কিন্তু চলতে শুরু করলে অনেক দূর পাড়ি দেওয়া যায়। শুরু কি ভাবে করবো ভাবতে ভাবতেই শুরু করেছিলাম, এবার থামার জন্য নিজের রাশ টানছি । এবার আমায় থামতে হবে। এই হয় , সর্বক্ষেত্রেই শুরু করাটাই সবথেকে বেশী  জরুরী, শেষ হবেই, চলুন যে যার মত করে শুরু করি, সে জীবন থিয়েটার হোক আর থিয়েটার জীবন দর্শনই হোক । আমরা সবাই ভাবতে জানি, কিন্তু ভাবনার সমুদ্রের অগুনতি ঢেউগুলি শুধু যাওয়া আর আসা করতে থাকে, তারপর একসময় মনের কোনে আবার হারিয়ে যায়, ভাবনার বুদবুদকে যে কোন ভাবে ধরে ফেলি চলুন এই আমি যে ভাবে আমার লেখনির আধারে কাগজ বন্দী করে নিলাম । এত যে কাগজে কলমে যুদ্ধ করলুম তা আপনাদের জন্য নয় কিন্তু , প্রথম পাঠক আমি, আমার সাথে আমার যে কথকপন আমার ভাবনার দোলনায় চড়তে চড়তে আমার মনের জানলা দিয়ে  অনেক কিছু দেখলুম, নিজেকে ফিরে দেখার সুযোগ করে দিলেন লক্ষণ  ঘটক বাবু, উনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, না হলে আমি কিন্তু সত্যি কখনও আমার ভাবনা গুলোকে চিত্রায়িত করতে পারি বলে জানতামই না।


                          আবার সেই আমিতে এসেই শেষ করছি, সব আমার জন্য, আত্মশুদ্ধির জন্য, এ আমি থেকেই শুরু করতে হবে, আমি যে কত শক্তিশালী তা একটি বীজকে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়, একটি বীজের মধ্যে একটি বৃহৎ অঞ্চলকে গহীন ঘন সবুজ অরন্যে পরিণত করার ক্ষমতা সুপ্ত থাকে। আমাদের সেই সুপ্ত ক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলে সমাজকে, আমাদের চারপাশকে মানুষের বাসযোগ্য করে তোলার প্রয়াস করতে হবে । একটি বীজ যখন মহীরুহে পরিণত হয়, এবং সেই মহীরুহ থেকেই অসংখ্য বীজের সৃষ্টি হয়। মনে হতে পারে বীজ, অরন্য, মহীরুহ ......এগুলোর সাথে, সমাজ, থিয়েটার, নারী এসবের কি সম্পর্ক। কিন্তু আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি, এ পৃথিবীতে সব কিছু একে অপরের সাথে কোন না কোন ভাবে জড়িত। শেকড়ের সাথে জলের, গাছের পাতার সাথে সূর্যের আলোর, প্রখর রোদ্দুরের সাথে বৃষ্টির, আর এসব কিছুর সাথে সৃষ্টির ,এবং এটাই সত্যি। আমরা সবাই একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত । তাই আমি ,আপনি  আমি , তোমরা আমি ও আমরা আমি সব আমি মিলে চলুন এগিয়ে যাই সভ্যতার দিকে, হাত বাড়িয়ে দিই যে আমি পেছনে রয়ে গেছে তার জন্যে, সমস্ত “আমি” রা  যে যার মত করে সে হতে পারে নাটক দিয়ে, গান দিয়ে, কবিতা দিয়ে, আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম দিয়ে,সবাই কে নিয়ে স্বপ্ন দেখার , এই সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচার জন্য অঙ্গীকার বদ্ধ হই।

কোন মন্তব্য নেই: