।। সপ্তর্ষি বিশ্বাস।।
প্রথম পর্ব
১।
আসল কথাটি এই, যে, শিল্পের কাছ থেকে, সাহিত্যের কাছ থেকে কে ঠিক কী চাইছে। শিল্পের অন্য বিভাগের কথা আপাততঃ তুলছিনা। আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি সাহিত্যক্ষেত্রেই। যদিও সময়ের হাত ধরে কিছু গ্রন্থ যুগে যুগে পাঠকের হাতে এসে পড়ে 'ক্লাসিক' বলে তবু তার থেকেও বিশেষ পাঠকজন তার বিশেষ চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে নির্মাণ করে তার নিজস্ব পাঠের, ক্লাসিকের নির্জন দ্বীপ।
সাহিত্যের কাছে আমার চাওয়ার প্রথম নির্ণায়ক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপরে ক্লাস নাইন-টেন্ থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে বঙ্কিম, মধুসূদন দত্ত ছুঁয়ে বিদেশী সাহিত্য। প্রথমে রাশিয়া – বাংলা অনুবাদে গোগোল, চেকভ্, দস্তয়েভস্কি, টলস্টয়। সহজ ইংরেজিতে শেক্সপীয়ার। সঙ্গে আনন্দমেলা, শুকতারা, কিশোর ভারতী ...
প্রথমবার যখন 'পথের পাঁচালী' পড়েছিলাম, ক্লাস সিক্সে, এক গরমের ছুটিতে – সেই অনুভুতি মনে পড়ে আজো। মনে পড়ে একটা আনন্দ অথচ চোখে জল। মনে পড়ে পড়তে পড়তে বই বন্ধ করে দূর আকাশের দিকে চেয়ে থাকা। যেন অন্য একটি পৃথিবীতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলা ... আরেকটু পরের বয়সে পড়লাম 'দৃষ্টিপ্রদীপ'। হ্যাঁ, সেই পাঠ মর্মে জাগালো প্রথম সেই প্রশ্ন – মৃত্যু কী? 'দৃষ্টিপ্রদীপ' এর নায়ক 'জিতু' যা দেখতে পায় তা’ কী? মৃত্যুর পরে কী হয়? আছে কি অন্য কোনো পৃথিবী? আত্মা? – রবীন্দ্রনাথের গানে হারিয়ে যাওয়ার গহনেও ক্রমে টের পেলাম, আপনাতে, ঐ একই প্রশ্ন – তার উত্তরের ইঙ্গিত, উত্তরের দিকে অভিযান ...
হ্যাঁ, আজো সাহিত্যে মূলতঃ তা’ই খুঁজি। লেখকের ভঙ্গী, কেতা – সমস্তকে ছাপিয়ে আমি অনুভব করতে চাই – জন্ম আর মৃত্যুর ‘ইন্টিগ্রেল ক্যাল্কুলাস’ এর হাতির শুঁড়ের দুদিকে ঠিক কী বসিয়ে রেখেছেন লেখক? আর তার মধ্যকার অনন্তে তিনি গড়ে নিয়েছেন ঠিক কেমন পৃথিবী ? সাহিত্যের কাছে যে পৃথিবী আমি চাই তার বর্ণন, পরে, পেয়েছিলাম জীবনানন্দে যেখানে তিনি বলছেনঃ ‘পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন জলের কল্পনা যায় কিংবা পৃথিবীর সমস্ত দীপ ছেড়ে দিয়ে এক নতুন প্রদীপের কল্পনা করা যায় – তাহলে পৃথিবীর এই দিন, রাত্রি, মানুষ ও তার আকাঙ্খা এবং সৃষ্টির সমস্ত ধূলো সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্রকে ছেড়ে দিয়ে এক নতুন ব্যবহারের কল্পনা করা যেতে পারে যা কাব্য’ – আমি বলবো তা’ই শিল্প। তা’ই সাহিত্য। বিভূতিভূষণের ‘অপু’র যে পৃথিবী তা এমনি, যেমন রবীন্দ্রনাথের 'গোরা’র বা সুচরিতার, বঙ্কিমের ‘কুন্দ’র , যেমন প্রথম পর্বের শ্রীকান্তর, যেমন লেভিনের, প্রিন্স্ মিশকিনের, কার্মাজোভ ভ্রাতাদের... কিন্তু ঐ পৃথিবীযে তাঁরা নির্মাণ করছেন তা কোনোখানে টের পাওয়া যায়না বলেই সেই পৃথিবী যুগে যুগে গ্রাস করে ফেলে পাঠকমানস। পাঠকের অনুভব হয় যে ঐ পৃথিবী তার নিজের চারিধারের পৃথিবীর মতোই – হয়ে ওঠা। টলস্টয় what is art এ’র এক জায়গায় তিনি লিখেছেনঃ The fourth method (সাহিত্য ‘নির্মাণ’ এর) is that of interesting (that is, absorbing the mind) in connection with works of art. The interest may lie in an intricate plot a method till quite recently much employed in English novels and French plays, but now going out of fashion and being replaced by realism, that is, by detailed description of some historic period or some branch of contemporary life. For example, in a novel interest may consist in a description of Egyptian or Roman life, the life of miners, or that of the clerks in a large shop. The reader becomes interested, and mistakes this interest for an artistic impression. The interest may also depend on the very method of expression; a kind of interest that has now come much into use. Both verse and prose, as well as pictures, plays, and music, are constructed so that they must be guessed like riddles, and this process of guessing, again, affords pleasure and gives a semblance of the feeling received from art.
প্রথম পর্ব
১।
আসল কথাটি এই, যে, শিল্পের কাছ থেকে, সাহিত্যের কাছ থেকে কে ঠিক কী চাইছে। শিল্পের অন্য বিভাগের কথা আপাততঃ তুলছিনা। আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি সাহিত্যক্ষেত্রেই। যদিও সময়ের হাত ধরে কিছু গ্রন্থ যুগে যুগে পাঠকের হাতে এসে পড়ে 'ক্লাসিক' বলে তবু তার থেকেও বিশেষ পাঠকজন তার বিশেষ চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে নির্মাণ করে তার নিজস্ব পাঠের, ক্লাসিকের নির্জন দ্বীপ।
সাহিত্যের কাছে আমার চাওয়ার প্রথম নির্ণায়ক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপরে ক্লাস নাইন-টেন্ থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে বঙ্কিম, মধুসূদন দত্ত ছুঁয়ে বিদেশী সাহিত্য। প্রথমে রাশিয়া – বাংলা অনুবাদে গোগোল, চেকভ্, দস্তয়েভস্কি, টলস্টয়। সহজ ইংরেজিতে শেক্সপীয়ার। সঙ্গে আনন্দমেলা, শুকতারা, কিশোর ভারতী ...
প্রথমবার যখন 'পথের পাঁচালী' পড়েছিলাম, ক্লাস সিক্সে, এক গরমের ছুটিতে – সেই অনুভুতি মনে পড়ে আজো। মনে পড়ে একটা আনন্দ অথচ চোখে জল। মনে পড়ে পড়তে পড়তে বই বন্ধ করে দূর আকাশের দিকে চেয়ে থাকা। যেন অন্য একটি পৃথিবীতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলা ... আরেকটু পরের বয়সে পড়লাম 'দৃষ্টিপ্রদীপ'। হ্যাঁ, সেই পাঠ মর্মে জাগালো প্রথম সেই প্রশ্ন – মৃত্যু কী? 'দৃষ্টিপ্রদীপ' এর নায়ক 'জিতু' যা দেখতে পায় তা’ কী? মৃত্যুর পরে কী হয়? আছে কি অন্য কোনো পৃথিবী? আত্মা? – রবীন্দ্রনাথের গানে হারিয়ে যাওয়ার গহনেও ক্রমে টের পেলাম, আপনাতে, ঐ একই প্রশ্ন – তার উত্তরের ইঙ্গিত, উত্তরের দিকে অভিযান ...
হ্যাঁ, আজো সাহিত্যে মূলতঃ তা’ই খুঁজি। লেখকের ভঙ্গী, কেতা – সমস্তকে ছাপিয়ে আমি অনুভব করতে চাই – জন্ম আর মৃত্যুর ‘ইন্টিগ্রেল ক্যাল্কুলাস’ এর হাতির শুঁড়ের দুদিকে ঠিক কী বসিয়ে রেখেছেন লেখক? আর তার মধ্যকার অনন্তে তিনি গড়ে নিয়েছেন ঠিক কেমন পৃথিবী ? সাহিত্যের কাছে যে পৃথিবী আমি চাই তার বর্ণন, পরে, পেয়েছিলাম জীবনানন্দে যেখানে তিনি বলছেনঃ ‘পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন জলের কল্পনা যায় কিংবা পৃথিবীর সমস্ত দীপ ছেড়ে দিয়ে এক নতুন প্রদীপের কল্পনা করা যায় – তাহলে পৃথিবীর এই দিন, রাত্রি, মানুষ ও তার আকাঙ্খা এবং সৃষ্টির সমস্ত ধূলো সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্রকে ছেড়ে দিয়ে এক নতুন ব্যবহারের কল্পনা করা যেতে পারে যা কাব্য’ – আমি বলবো তা’ই শিল্প। তা’ই সাহিত্য। বিভূতিভূষণের ‘অপু’র যে পৃথিবী তা এমনি, যেমন রবীন্দ্রনাথের 'গোরা’র বা সুচরিতার, বঙ্কিমের ‘কুন্দ’র , যেমন প্রথম পর্বের শ্রীকান্তর, যেমন লেভিনের, প্রিন্স্ মিশকিনের, কার্মাজোভ ভ্রাতাদের... কিন্তু ঐ পৃথিবীযে তাঁরা নির্মাণ করছেন তা কোনোখানে টের পাওয়া যায়না বলেই সেই পৃথিবী যুগে যুগে গ্রাস করে ফেলে পাঠকমানস। পাঠকের অনুভব হয় যে ঐ পৃথিবী তার নিজের চারিধারের পৃথিবীর মতোই – হয়ে ওঠা। টলস্টয় what is art এ’র এক জায়গায় তিনি লিখেছেনঃ The fourth method (সাহিত্য ‘নির্মাণ’ এর) is that of interesting (that is, absorbing the mind) in connection with works of art. The interest may lie in an intricate plot a method till quite recently much employed in English novels and French plays, but now going out of fashion and being replaced by realism, that is, by detailed description of some historic period or some branch of contemporary life. For example, in a novel interest may consist in a description of Egyptian or Roman life, the life of miners, or that of the clerks in a large shop. The reader becomes interested, and mistakes this interest for an artistic impression. The interest may also depend on the very method of expression; a kind of interest that has now come much into use. Both verse and prose, as well as pictures, plays, and music, are constructed so that they must be guessed like riddles, and this process of guessing, again, affords pleasure and gives a semblance of the feeling received from art.
সমস্ত দেশের সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলায় ঐ ‘আমদানীকৃত' বাস্তবতা ‘সাহিত্য’ এই ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েছে অনেকদিন। ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ আর অমিয় ভূষণের 'গড় শ্রীখন্ড' তাদের অনেক ভালো element সত্ত্বেও শেষ বিচারে ঐ পর্যায়ের যেখানে সাহিত্য থেকে ভঙ্গীই প্রধান। যখনি এদের নিয়ে দাঁড় করানো যায় ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘ইছামতী’ বা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র কিনারে তখনি টের পাওয়া যায় তাদের রূপের অসত্যতা। কিন্তু আবার ঐ লেখাগুলিকেই গৌরকিশোরের 'প্রেম নেই' বা সমরেশের ‘গঙ্গা’র পাশাপাশি দাঁড় করালে মনেহয় যেন তারা ঝুটা মুক্তা নয়!
প্রকৃত প্রস্তাবে সাহিত্য যেহেতু জীবনবোধেরি সন্ততি তাই যাঁর মর্মে জীবনপ্রশ্ন করতে পারে যতো গভীর ক্ষত তার সাহিত্য ততো বেশী অনায়াসে গড়ে নিতে পারে তার আপন গ্রহটি। এই হেতুই যতো নিকটবর্তী সময়ের দিকে নজর যায় দেখা যায় কোনো লেখকের একটি রচনা প্রায় ক্লাসিক হয়ে উঠলেও অন্য লেখা স্রেফ অপাঠ্য। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। 'মহাস্থবির জাতক' ভিন্ন তাঁর অন্য কোনো রচনা স্রেফ কালি কলম আর সময়ের অপচয়। সময় যতো বেশি জটিল দেহ পরিগ্রহ করেছে ঐ সব লেখকেরা ততোই হারিয়ে ফেলেছেন পথ। তাঁদের জীবনবোধের অসারতার ছায়া ফুটে উঠেছে তাঁদের সাহিত্যে। ফলতঃ পরিকল্পনা করে ক্লাসিক লিখতে গিয়ে আসলে যা লিখেছেন তা ব্যর্থ ডকুমেন্টারি। ( আবার প্রকৃত প্রতিভার হাতে পরলে ডকুমেন্টারিও যে গড়ে নিতে পারে অপর পৃথিবী তারও ঢের প্রমাণ রয়ে গেছে। অবধূতের ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ বা প্রবোধ কুমার সান্যালের 'মহাপ্রস্থানের পথে'র কথা মনে আসছে এই মাত্র।)। যাঁরা হারাননি তাঁদের রচনায় আছে ঐ নদী যা 'পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন জলের কল্পনা' ... আর ঐ সমস্ত রচনাতে কোনো না কোনো ভাবে লেখক রেখে গিয়েছেন তাঁর নিজস্ব অনুভবে প্রতিফলিত জন্ম-মৃত্যুর রহস্য।
ঐ নদী যা 'পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন জলের কল্পনা' তারি সন্ধান আমার পাঠ। তারি উপস্থিতিকে টের পাওয়ার মর্মে আমার কোনো লেখকের, কোনো লেখার প্রতি মুগ্ধতা। তাঁর ‘সচেতন’ চিন্তাকে আমি চাইনা তাঁর গল্পে, কবিতায়, উপন্যাসে। সেসবের জন্যে তাঁর কাছে যদি যাই ও তাহলেও দেখবো তা তাঁর রচনায়, জীবনান্দের ভাষায়, ‘অর্ধনারীশ্বর' এর মতো এসেছে কি’না। যদি আসে তবে তিনি তত্ত্বকথা বল্লেও তা সাহিত্য, তথ্য শোনালেও তা সাহিত্য আর তা যদি নাহয় তাহলে সেগুলি নেহাৎই 'তিস্তা পারের বৃত্তান্ত' – ভঙ্গীর কারিগরি আর তথ্য ও তত্ত্ব পরিবেশনের মাধ্যমে পাঠককে সহজে মাতাল করার প্রচেষ্টা।
১১/১১/২০১৩
২।
চিত্রকলা, সাহিত্য, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র সমস্তই মূলতঃ কোনো না কোনো ভাবে রূপেরি সৃজন। তথাপি মাধ্যমের ভিন্নতার জন্য একই রূপের প্রকাশভঙ্গী প্রতিটি মাধ্যমে ভিন্ন। এতদ্বতিত রূপের মাত্রাও ভিন্ন। কবি আলোক সরকার একবার বলেছিলেন সমস্ত শিল্পই মূলতঃ নির্মাণ। সচেতন নির্মাণ। কিন্তু সফল শিল্প তা’ই যার শরীরে নির্মাণের ‘দাগ’ গুলিকে আর চেনা যায়না আলাদা করে। - আমার বোধ বুদ্ধিতে এ’ই আসল সংজ্ঞা। রূপের।
অপু’র পৃথিবী নির্মাণ করেছেন বিভূতিভূষণ। অবশ্যই তা সচেতন ভাবে। কিন্তু উপন্যাস শরীর থেকে তাঁর গাঁইতি, হাতুড়ির দাগ এমন ভাবে মুছে দিয়েছেন যে পাঠকের অনুভব হয় এ যেন দৈবাদিষ্ট রচনা। বিভুতির এই শান্ত পরিবেশের পাশাপাশি যদি দস্তয়ভস্কির ব্রাদার্স্ কার্মাজভ্’কে নেওয়া যায় – যেখানে প্রতিটি মুহুর্ত্ত উত্তেজনায়, দার্শনিক তর্কে টান্টান্, যেখানে প্রতিটি চরিত্র কোনো না কোনোভাবে স্নায়ু রোগী, যেখানে উপন্যাসের দিগন্ত আরো বিস্তৃত – সেখানেও তাঁর নির্মাণের গাঁইতি, হাতুড়ির দাগ যায়না চিনে নেওয়া। এবার যদি আদ্যন্ত মেধা নির্মিত উপন্যাস – কামু’র 'প্লেগ্'কে নিয়ে ভাবা যায় তাহলেও দেখা যাবে ঐ একই ব্যাপার। নির্মাণের সীজার চিহ্ন নেই। রচনার উদ্দেশ্য ঘোষিত নয়। নিটোল শিশুটি। যেমন রবীন্দ্রনাথের 'ঘরে বাইরে', 'গোরা' বা 'যোগাযোগ'। বঙ্কিমের 'বিষবৃক্ষ', 'কৃষ্ণকান্তের উইল'।
সময়ের আরো বিস্তীর্ণ পটভূমি, আরো বেশি চরিত্র নিয়ে যে উপন্যাস 'ওয়ার এন্ড্ পিস্' – যাতে টলস্টয়ের নিজস্ব দর্শনের বহু বীজই নিহিত সেখানেও একই ঘটনা। প্রসাধন অবশ্যই আছে। কিন্তু পাখিটির চেয়ে খাঁচাটি বড় করে চোখে পড়েনা। আঁচলের ভাঁজে স্তনের রেখা দেখা যায় ঠিক কিন্তু তার জন্যে বার বার নির্লজ্জের মতো আঁচল খসাতে হয়না। জয়েসের উইলিসিস্ যেমন – যে একবার পেয়ে গেছে ঐ রচনায় প্রবেশের পথ সে ঐ পথে – ডাবলীনের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নিজের অজান্তেই চলে এসেছে নিজের ছোট্ট মফস্বলে – নিজের পাপ-তাপে নির্মিত নিজস্ব পৃথিবীতে। যেমন ঘটে কমলকুমারের সফল উপন্যাস গুলিতে। তাঁর ভাষার অদ্ভুত বুনন সত্ত্বেও 'অন্তর্জলী যাত্রা' বা 'পিঞ্জরে বসিয়া শুক'কে মনেহয় না ‘নির্মিত’। মনে হয়না এর আবডালে লেখকের কিছু 'বক্তব্য' আছে। 'অভিসন্ধি' আছে। - অথচ 'বক্তব্য' আর 'অভিসন্ধি' আছে। থাকে। থাকতে বাধ্য। প্রতিটি সফল রচনায় থাকে। থাকবে। কিন্তু তা বেরিয়ে পরবেনা । টের পাওয়া যাবেনা যে লেখক এবার বলতে চলেছেন একটি সময়ের 'ইতিহাস'। তিনি থামবেন না, নিরস্ত হবেন না সেই 'ইতিহাস'টুকু – আর ঐ 'ইতিহাস' নিয়ে তাঁর 'তত্ত্ব' টুকু না জানান দিয়ে – যেমন ইলিয়াসের 'খোয়াবনামা', যেমন গৌরকিশোরের 'প্রেম নেই', যেমন অমিয় ভূষণের 'গড় শ্রীখন্ড'। - হ্যাঁ, লেখক হিসেবে গৌরকিশোর আখতারুজ্জামান থেকে নিম্ন স্তরের বলে তাঁর রচনার বেহায়াপনা পাঠককে বেশি বিরক্ত করে। তবে আখতারুজ্জামান, মূলতঃ উপন্যাসটির শেষের দিকে এসে, কাহন কে লম্বা করেন তাঁর 'ইতিহাস' বলার 'দায়িত্ববোধ' থেকে যেটা অমিয়ভূষণে আসে নানা রকম কসরত্ দেখানোর মাধ্যমে। - ওই কাহ্নেই রূপের দেবী তাঁদের প্রতি বিরূপ।
পাশাপাশি আবু ইস্হাকের 'সূর্য দীঘল বাড়ি'কে আনলে ব্যাপারটা বোঝা যায় আরো গভীর ভাবে। দুইটি বালক-বালিকা, যেন অন্য আবহের অপু-দুর্গা হয়ে টেনে নেয় পাঠককে। ঐ স্রোতে আপনি ভেসে আসে হিন্দুস্থান-পাকিস্তান’এর 'ইতিহাস'এর ছায়া। আবার তা ভেসেও যায় স্রোতে। আসে সামন্ত ব্যবস্থার, মুসলমান সমাজ ও বিবাহ ব্যবস্থার অন্ধকার দিক গুলো। অবলীলায়। তা’ও আবার ভেসে যায় ঐ “অন্য নদীর অন্য জল”এর টানে। - অর্থাৎ নির্মাণের সীজারের দাগ উল্কি হয়ে বসেনা উপন্যাস শরীরে। খুব সূক্ষ্মভাবে হলেও 'লাল সালু' বা 'কাঁদো নদী কাঁদো'তে এক সময় টের পাওয়া যায় লেখকের 'বক্তব্য'। আর তাই শেষ বিচারে আমার মন তাকে বলতে পারেনা ক্লাসিক্ বলে। পাশাপাশি 'তিতাস একটি নদীর নাম' অনেক বিস্তৃত পটভূমি নিয়ে, বহু বহু চক্রবাল ছুঁয়ে বয়ে যায় অবলীলায়। ঠিক যেমন বিমল মিত্রের 'বেগম মেরী বিশ্বাস'। লেখক বলেন গল্প। বাঁকে বাঁকে ইতিহাস ফেলে ছায়া। দুয়ের লাঠালাঠি বাধেনা কোথাও। আবার প্রমথনাথ বিশীর 'কেরী সাহেবের মুন্সী'র প্রথম পংক্তি থেকে টের পাওয়া যায় যে লেখক সাড়ম্বরে সভা ডেকে শোনাতে যাচ্ছেন 'ইতিহাস'।
'রূপ' –এ’ই। নির্মাতার ছেনি-হাতুড়ির দাগ, সীজারের দাগ থাকবেনা উপন্যাস শরীরে আবার সুনীল গাঙ্গুলির মতো কাঠামোর কাছা খুলে যাবেনা যখন তখন। 'রূপ' এর দিক থেকে আরেকজনের নাম না বলে পারছিনা। তিনি প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়। যাঁরা তাঁর 'রত্নদ্বীপ' অন্ততঃ পড়েছেন তাঁরা টের পেয়ে থাকবেন গল্প বলার মুন্সীয়ানা সেখানে কি জটিল-সুন্দর।
৩।
এই রূপটি একটা সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষার 'মুখ্য' লেখকের সবারি রচনায় ছিল উপস্থিত। মানিক এবং তার পরের সময় থেকেই দেখি অনটন। মানিকের রচনাপথ ক্রমে কম্পিত। অন্য কেউও আর এসে দাঁড়াচ্ছেন না বিভূতি , তারাশংকর বা সতীনাথ ভাদুড়ি’র মতো বিরাট স্কন্ধ নিয়ে। আরম্ভ হয়েছে বুদ্ধদেব বসু’র বুঝে না বুঝে পশ্চিমকে অনুকরণের যুগ। এর মধ্যেও শিবরাম চক্রবর্তী’র মতো প্রতিভা, এক দুইজন জ্বলে যাচ্ছেন। কিন্তু পারিপার্শ্বিকের ডামাডোলে মধ্য গগনে আলো ছড়াতে দেওয়া হচ্ছেনা তাঁদের। 'মিহি ও মোটা'য় মিলিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন প্রেমেন মিত্তির। - হায়, তথাকথিত 'সিরিয়াস' লেখালেখির দিকে না গিয়ে প্রেমেন মিত্তির যদি তাঁর অলৌকিক গল্পগুলি, মামাবাবু, ঘনাদা – এগুলোই শুধু লিখে যেতেন তাহলে বাংলার পাঠক টের বেশী উপকৃত হতো তাঁর দ্বারা!
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস শোনাতে বা বিশ্লেষণ করতে বসিনি আজ। তাই সাল ধরে ধরে হোঁচট খেয়ে পথ হাঁটার মানে নেই। যে প্রসঙ্গে বলছিলাম সেখানেই ফিরে আসি। ফিরে আসি রূপহীন বাংলা সাহিত্যের কথায়। ফিরে আসি বুদ্ধদেবের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমরা যা যা হারালাম সেই কাহনে। - প্রথমেই মনে আসছে তাঁর কথা যাঁর হাত থেকে আমরা পেয়েছিলাম ‘কত অজানারে’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’র মতো রচনা সেই ‘শংকর’ এর কথায়। - শংকরের উল্লিখিত রচনাগুলি রূপের দিক থেকে প্রায় ক্লাসিক। কিন্তু শংকরের যা ছিলনা তা সেই অন্তর্দৃষ্টি যা থাকলে চোখের পর্দায় উদ্ভাসিত হয় অন্য চক্রবাল – যা উন্মোচিত হয়েছিল অপু’র, জিতু’র, জাঁ ক্রিস্তফের ও তাদের শ্রষ্টাদের চোখে, যা পাঠককে ফিরে ফিরে ভাবতে বাধ্য করে – এই ব্রহ্মান্ডের কোনো নিশ্চিত অভিপ্রায় রয়েছে কি’না এই কথা, কে আমি, কি আমি, কেন আমি – এই কথা... অর্থাৎ আমাদের নগণ্য যাপনকে ছুটিয়ে দেয় মহাজীবনের চক্রবালের দিকে... এই অন্তর্দৃষ্টি ছিলনা বলেই শংকরের উল্লিখিত রচনা গুলিও ক্লাসিক হতে হতেও ‘ভালো উপন্যাস’ হয়েই রয়ে গেলো। পরেও আর তেমন কিছু হলোনা তাঁর লেখনী থেকে।
ঐ না-হওয়ার বৃত্তান্তই, এর পরে প্রায় সর্বত্র। বুদ্ধি দিয়ে, নানা তত্ত্ব পাঠ করে, সেইসব তত্ত্বকে হজম না করতে পেরে তা উগ্ড়ে দিতে লাগলেন একদল লোক। গৌরকিশোর ঘোষ যাঁদের অগ্রগণ্য। ‘অন্ত্যজ’দের গপ্পো বলার নামে পর্ণগ্রাফিতে লাগলেন আরেকদল। অনবদ্য ভাষা ও নির্মাণ কুশলতা সত্ত্বেও সমরেশ বসু’র মতন লেখকওযে অন্তিমে ঐ পথই নিয়েছিলেন তার হেতু যুগধর্ম’কে অস্বীকার করতে না পারা – যে না পারার মর্মে নিজস্ব বিশ্বাসের ভিত্তিহীনতা। - ক্রমে যা দাঁড়ালো তা এই, যে, ‘প্রিয় উপন্যাস’ যদিবা খুঁজে নিতে সক্ষম হয়েছেন প্রকৃত পাঠকজন কিন্তু একজন 'প্রিয় ঔপন্যাসিক' আর পাওয়াই গেলোনা।
অথচ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে', 'অলৌকিক জলযান' – এমন কি 'ঈশ্বরের বাগান' হেন অনবদ্য লেখাও কিন্তু হয়েছে। আবার তার পরেই সেই লেখকের হাতেই এমন কিছু লিখিত হয়েছে যে পাঠক চমকে উঠেছে। হ্যাঁ, এখানেও তর-তম’র প্রশ্ন আসে। যেমন অতীন বন্দ্যোপাধায়ের 'খারাপ লেখা' যতোটা খারাপ তার চেয়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'মাঝারি লেখা' অনেক বেশি খারাপ। অথচ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ই কিন্তু লিখেছিলেন 'শাহজাদা দারাশুকো' বা 'কুবেরের বিষয় আশয়'...
কিছু ঔপন্যাসিক অকম্পিত যাত্রায় লিখে গিয়েছেন মাঝারি মানের লেখা। যেমন রমাপদ চৌধুরি। তাঁর সমস্ত লেখাই বহুদূর 'ভালো' কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনোখানে তা ব্যর্থ হয়ে গেছে লেখার গহনের উদ্দেশ্যটির প্রকটতায় ( যেমনঃ খারিজ, লজ্জা, দাগ – ইত্যাদি) আর কিছু নির্মাণ কুশলতার অভাবে ( 'দ্বীপের নাম টিয়া রঙ', 'বন পলাশীর পদাবলী' – ইত্যাদি)। অর্থাৎ অন্তিমে অকম্পিত যাত্রায় সফল নন কেউ। - সেই অর্থে যাঁরা 'অফ্বীট্'-'প্যারালাল' – যেমন অমিয়ভূষণ, তাঁদের ব্যর্থতার কথা আগেই বলেছি।
এই সমস্ত গোলমালের মধ্যেও যে দুইজন মানুষের রচনার কাছে অদ্যাপি বসতে হয় স্থির হয়ে তাঁরা – বিমল কর আর শীর্ষেন্দু। এঁরা দুজনের সিংহভাগ রচনার শরীরেই নির্মাণের সীজার চিহ্ন নেই। দুই রকমের দুই চক্রবাল পায় হয়ে তাঁরা দেখান দুই মহানীলাকাশ। - হ্যাঁ, শীর্ষেন্দু’র রচনায় সফলভাবে মিশে থাকা তাঁর নিজস্ব দর্শনের সঙ্গে সর্বদা একমত হওয়া যায়না। তার প্রয়োজনও নেই – ঠিক যেমন রুশ বিপ্লবকে সমর্থন করা সত্ত্বেও ডুবে যাওয়া যায়, ডুবে যেতে হয় পাস্তেরনাকের 'জিভাগো’তে। -বিমল কর আর শীর্ষেন্দু’র ক্ষেত্রে পথ যে অকম্পিত থেকে যায়, তাঁদের সিংহভাগ রচনাই যে ছুঁয়ে থাকে ক্লাসিক-শরীর তার হেতু নিহিত তাঁদের জীবনে। যাপনে। তাঁদের জীবনের মর্মে এক রকমের অধ্যাত্ম ( ‘ধর্মীয়’ নয় কিন্তু, অন্ততঃ বিমল কর’ এর ক্ষেত্রে) কেন্দ্র রয়ে যায় শেষ অবধি যে অধ্যাত্ম কেন্দ্র হারানো বিষয়ে ও শিল্পে তার ছায়াপাত নিয়ে অদ্যাপি চলছে আলোচনা ...
মনে আসছে ঐ অধ্যাত্ম-কেন্দ্রটি, ইউরোপের, বিষয়ে ভিক্টর উগো’র ‘ক্রমওয়েল’ নাটকের ভূমিকা যা ক্রমে হয়ে পরেছিল ফরাসী রোমান্টিকদের ইস্তেহার। ঐ অধ্যাত্ম সময়ের সূচনা বিষয়ে উগো লিখেছেনঃ ‘...the age of the epic draws near its end. Like the society that it represents, this form of poetry wears itself out revolving upon itself. Rome reproduces Greece, Virgil copies Homer, and, as if to make a becoming end, epic poetry expires in the last parturition.
It was time. Another era is about to begin, for the world and for poetry.
A spiritual religion, supplanting the material and external paganism, makes its way to the heart of the ancient society, kills it, and deposits, in that corpse of a decrepit civilization, the germ of modern civilization. This religion is complete, because it is true; between its dogma and its cult, it embraces a deep-rooted moral. and first of all, as a fundamental truth, it teaches man that he has two lives to live, one ephemeral, the other immortal; one on earth, the other in heaven. It shows him that he, like his destiny, is twofold: that there is in him an animal and an intellect, a body and a soul; in a word, that he is the point of intersection, the common link of the two chains of beings which embrace all creation--of the chain of material beings and the chain of incorporeal beings; the first starting from the rock to arrive at man, the second starting from man to end at God.
A portion of these truths had perhaps been suspected by certain wise men of ancient times, but their full, broad, luminous revelation dates from the Gospels. The pagan schools walked in darkness, feeling their way, clinging to falsehoods as well as to truths in their haphazard journeying. Some of their philosophers occasionally cast upon certain subjects feeble gleams which illuminated but one side and made the darkness of the other side more profound. Hence all the phantoms created by ancient philosophy. None but divine wisdom was capable of substituting an even and all-embracing light for all those flickering rays of human wisdom. Pythagoras, Epicurus, Socrates, Plato, are torches: Christ is the glorious light of day.
আর এই অধ্যাত্ম কেন্দ্রটি হারানোর পরের কথা বলে টলস্টয় তাঁর 'হোয়াট্ ইস্ আর্ট' এঃ
The religious perception of our time, in its widest and most practical application, is the consciousness that our well being, both material and spiritual, individual and collective, temporal and eternal, lies in the growth of brotherhood among men in their loving harmony with one another.
This perception is not only expressed by Christ and all the best men of past ages, it is not only repeated in the most varied forms and from most diverse sides by the best men of our times, but it already serves as a clue to all the complex labour of humanity, consisting, as this labour does, on the one hand in the destruction of physical and moral obstacles to the union of men, and on the other hand in establishing the principles common to all men which can and should unite them in one universal brotherhood. And it is on the basis of this perception that we should appraise all the phenomena of our life, and among the rest our art also; choosing from all its realms and highly prizing and encouraging whatever transmits feelings flowing from this religious perception, rejecting whatever is contrary to it, and not attributing to the rest of art an importance not properly belonging to it.
The chief mistake made by people of the upper classes at the time of the so-called Renaissance, a mistake we still perpetuate, was not that they ceased to value and to attach importance to religious art (people of that period could not attach importance to it because, like our own upper classes, they could not believe in what the majority considered to be religion), but their mistake was that they set up in place of religious art which was lacking, an insignificant art which aimed only at giving pleasure, that is, they began to choose, to value, and to encourage, in place of religious art, something which in any case did not deserve such esteem and encouragement.
বাঙালির জীবন থেকে ঐ অধ্যাত্মকেন্দ্রটি মুছে গেছে, ক্রমে, দীর্ঘদিনের পরাধীনতায় । অতঃপর খন্ডিত 'স্বাধীনতা' ও তজ্জনিত ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায়। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের আগ্রাসনে। অন্তিমে বুঝে না বুঝে 'আধুনিক' ও 'কমিউনিষ্ট' সাজবার ভ্রমে। জীবনের কেন্দ্র থেকে অভিকেন্দ্রিক টান ( সামন্ত তান্ত্রিকও বটে) হঠাৎই ছিঁড়ে গেছে দেশভাগে অথচ কোনো নতুন কেন্দ্র সামাজিক নিয়মেই গড়ে ওঠেনি। সঙ্গে এসেছে “প্রগতি” নামক ভুয়ো শব্দ তার সমস্ত কালোজাদুকে সঙ্গে নিয়ে। সুতরাং ঐ সময়ের সন্ততি যেসমস্ত লেখকেরা তার সিংহভাগই আশ্রয় নিয়েছে যে শিবির সামনে পেয়েছে তাতেই। আর ঐ 'আশ্রয়' নেওয়ার মূল্যে যে ঠিক কি তারা হারিয়েছে তা কমলকুমার মজুমদার হেন এক আধজন ব্যতীত কেউ টের পায়নি। আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবি যে সুনীল কমলকুমারের সমস্ত বই’য়ে ‘আনন্দ বাজারী' ভূমিকা লেখে সে, কমলকুমারের এতো কাছাকাছি এসেও কি করে আমরন এই সব লিখে গেলো? – উওরও অবশ্য পাওয়া যায় তার কমলকুমারকে নিয়ে লেখা গুলি নেড়ে চেড়ে দেখলেই। এরা মূলতঃ কমলকুমারের বাইরের চমকদারী দিকটাতেই আকৃষ্ট হয়েছিল। কিন্তু ঐ সময়ে বসে কেন কমলকুমার প্রাক্ -রামমোহন সময়কে নিলেন তাঁর এক প্রধান উপন্যাসের পটভূমি করে, কি বার্তা তিনি তাতে পাঠালেন – এইসব ভেবে দেখবার গভীরতা সুনীলদের ছিলনা। ফলতঃ কৃত্তিবাস থেকেই জন্মালো রনজিত দাশেদের ভ্রূন যারা ‘আধুনিক’ না হলে নস্যও নেবেন না স্থির করে মূলতঃ সাজানো গোছানো আঙ্গিকে অশ্বডিম্ব বিতরনের কর্মটিকে দিলেন আরো এগিয়ে। তাদের ছায়া যে প্রত্যন্ত মফস্বলেও কি মারাত্মক ভাবে পরেছিল তার প্রমাণ একদা আসামের শিলচরের/হাইলাকান্দির ‘অতন্দ্র’। তাদের জীবন। তাদের 'রচনা'।
যখন এইসব ভাবার বীজ ক্রমে অঙ্কুরিত হতে লাগলো – যখন সুনীল ইত্যাদির পাশাপাশি আলোক সরকার, যুগান্তরেরা এসে দাঁড়ালেন, আরেকটু পরের দিকে গৌতম বসু তখন থেকে, ক্রমে, আরম্ভ হলো আরেক নকল নবিশী। যে ভাবের, ভাবনার কোনো প্রয়োগ নেই যাপনে সেই ভাবনাসঞ্জাত যে ফর্ম তাকে নিয়ে ‘প্লাস্টিক-ফুল’ নির্মাণে লাগলেন আরেকদল। ছদ্ম আলোক, নকল গৌতমের ছড়াছড়িতে ভরে গেলো ‘প্যারালাল’ সাহিত্য। - মূলতঃ পদ্যে। গদ্যে ঐ সময় এসেছে বিদেশে পুরোনো হয়ে যাওয়া 'ম্যাজিক রিয়েলিজম'। ‘মেইন স্ট্রীম' এ তার উদাহরণ যদি হয় 'অষ্টম গর্ভ' , প্যারালালে 'মুন্সী' – 'খোয়াবনামা'। - না, ইলিয়াস যেমন সামলাতে পারেননি 'মুন্সী'কে – যেমন সামলেছেন মার্কেজ তাঁর বুয়েন্দিয়া দের – বাণী বসু ( বাণী বসু’ই ত?) সামলাতে পারেননি 'অষ্টম গর্ভ'কে। তিনি যেহেতু ইলিয়াস থেকে অনেক অনেক অনেক অক্ষম তাই ঐ অষ্টম গর্ভের গর্ভপাত 'খোয়াবনামা'র থেকে ঢের শোচনীয়।
৪।
ফিরে যাই যেখান থেকে আরম্ভ করেছিলাম সেখানে। আসল কথাটি এই, যে, শিল্পের কাছ থেকে, সাহিত্যের কাছ থেকে কে ঠিক কি চাইছে। একদল পাঠক সকালে বাজার করতে গিয়ে যা যা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় তা’ই দেখতে চায় সাহিত্যে। - একদল লেখক তাদের জন্য লেখে। উদাহরন ভগীরথ মিশ্র। একদল চায় সাহিত্য পাঠ করে 'জ্ঞানী' হতে। একদল লেখক - – যে ইতিহাস বা দর্শন তারা নিজেরাই পারেনি পরিপাক করতে তা দিয়ে পাঠকদের জোগায় – ইতিহাসের, দর্শনের পাচন । যেমনটি 'তিন পুরুষ', 'শিকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে' ইত্যাদিতে একদা জুগিয়েছে সমরেশ বসু, পরে বাণী বসু 'পঞ্চম পুরুষ' মার্কা লেখায়। সুনীলও ওপথে হেঁটে দেখেছে তার 'সপ্তম অভিযান', 'ধূলিবসন' – ইত্যাদিতে। একদল পাঠকের চাই 'আঞ্চলিক বাস্তবতা'। তাদের জন্য 'গিয়েছিলাম' কে 'গেইস্লাম' আর 'খেয়েছিলাম' কে 'খাইস্লাম' লিখে চোলাই জোগায় মফস্বল। অথচ যেটা সকলে ভুলে গেছে তা হলো শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে সেই প্রাথমিক সত্যটি যা ভিক্টর উগো’র ভাষায়ঃ ‘There is an impenetrable boundary between artistic reality and natural reality. It's folly to confuse them, as some rather backward partisans of 'Romanticisim' do.’ সুতরাং বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রগান হয়ে টলস্টয়, দস্তয়ভস্কিতে এসে আমি যে পথের পথিকত্ব্ব বা যে পাঠের পাঠকত্ব অর্জন করেছি সেই পথ যে দ্বীপে যায় তার ক্লাসিকের তালিকায় বিভূতি-তারাশঙ্করের পরে মাণিকের হাতে গোনা লেখা আর কমলকুমার ছাড়া অন্য কাকে আমি বয়ে নেবো? কীভাবে বয়ে নেবো?
সবচেয়ে বড় কথা হলো কেন বয়েনেবো?
আজ, কোনো গহন বনের নির্জনতায় হয়তোবা লেখা হচ্ছে আরো একটি ক্লাসিক, আরো একটি 'পথের পাঁচালী' কিংবা 'দৃষ্টিপ্রদীপ' – কিন্তু তা আমার জন্য নয়। তা আমার সন্ততির জন্য। হ্যাঁ তেমন কিছু যে লেখা হবে আবার, কোনো দিন, তারো আশ্বাস পাই টলস্টয়ের দেওয়া উদাহরণে, যুক্তিতেঃ
Art is a spiritual organ of human life which cannot be destroyed, and therefore, notwithstanding all the efforts made by people of the upper classes to conceal the religious ideal by which humanity lives, that ideal is more and more clearly recognised by man, and even in our perverted society is more and more often partially expressed by science and by art. During the present century works of the higher kind of religious art, permeated by a truly Christian spirit, have appeared more and more frequently both in literature and in painting, as also works of the universal art of common life accessible to all.
So that even art knows the true ideal of our times and tends towards it. On the one hand, the best works of art of our time transmit religious feelings urging towards the union and the brotherhood of man (such are the works of Dickens, Hugo, Dostoevski; and, in painting, of Millet, Bastien Le-page, Jules Breton, Lhermitte, and others) ; on the other hand, they strive towards the transmission, not of feelings which are natural to people of the upper classes only, but of such feelings as may unite everyone without exception. There are as yet few such works, but the need of them is already acknowledged. In recent times we also meet more and more frequently with attempts at publications, pictures, concerts, and theatres, for the people. All this is still very far from accomplishing what should be done, but already the direction in which good art instinctively presses forward to regain the path natural to it can be discerned.
অতএব ‘রাত কত হল’ এ প্রশ্নের উত্তর যদিও আজো মিলছেনা তবু একদিন মিলবে তেমন ভাবতে ক্ষতি কি? হোক্না সে আমার মৃত্যুর পরে, আমার সন্ততির জন্য ...।।
প্রকৃত প্রস্তাবে সাহিত্য যেহেতু জীবনবোধেরি সন্ততি তাই যাঁর মর্মে জীবনপ্রশ্ন করতে পারে যতো গভীর ক্ষত তার সাহিত্য ততো বেশী অনায়াসে গড়ে নিতে পারে তার আপন গ্রহটি। এই হেতুই যতো নিকটবর্তী সময়ের দিকে নজর যায় দেখা যায় কোনো লেখকের একটি রচনা প্রায় ক্লাসিক হয়ে উঠলেও অন্য লেখা স্রেফ অপাঠ্য। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। 'মহাস্থবির জাতক' ভিন্ন তাঁর অন্য কোনো রচনা স্রেফ কালি কলম আর সময়ের অপচয়। সময় যতো বেশি জটিল দেহ পরিগ্রহ করেছে ঐ সব লেখকেরা ততোই হারিয়ে ফেলেছেন পথ। তাঁদের জীবনবোধের অসারতার ছায়া ফুটে উঠেছে তাঁদের সাহিত্যে। ফলতঃ পরিকল্পনা করে ক্লাসিক লিখতে গিয়ে আসলে যা লিখেছেন তা ব্যর্থ ডকুমেন্টারি। ( আবার প্রকৃত প্রতিভার হাতে পরলে ডকুমেন্টারিও যে গড়ে নিতে পারে অপর পৃথিবী তারও ঢের প্রমাণ রয়ে গেছে। অবধূতের ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ বা প্রবোধ কুমার সান্যালের 'মহাপ্রস্থানের পথে'র কথা মনে আসছে এই মাত্র।)। যাঁরা হারাননি তাঁদের রচনায় আছে ঐ নদী যা 'পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন জলের কল্পনা' ... আর ঐ সমস্ত রচনাতে কোনো না কোনো ভাবে লেখক রেখে গিয়েছেন তাঁর নিজস্ব অনুভবে প্রতিফলিত জন্ম-মৃত্যুর রহস্য।
ঐ নদী যা 'পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন জলের কল্পনা' তারি সন্ধান আমার পাঠ। তারি উপস্থিতিকে টের পাওয়ার মর্মে আমার কোনো লেখকের, কোনো লেখার প্রতি মুগ্ধতা। তাঁর ‘সচেতন’ চিন্তাকে আমি চাইনা তাঁর গল্পে, কবিতায়, উপন্যাসে। সেসবের জন্যে তাঁর কাছে যদি যাই ও তাহলেও দেখবো তা তাঁর রচনায়, জীবনান্দের ভাষায়, ‘অর্ধনারীশ্বর' এর মতো এসেছে কি’না। যদি আসে তবে তিনি তত্ত্বকথা বল্লেও তা সাহিত্য, তথ্য শোনালেও তা সাহিত্য আর তা যদি নাহয় তাহলে সেগুলি নেহাৎই 'তিস্তা পারের বৃত্তান্ত' – ভঙ্গীর কারিগরি আর তথ্য ও তত্ত্ব পরিবেশনের মাধ্যমে পাঠককে সহজে মাতাল করার প্রচেষ্টা।
১১/১১/২০১৩
২।
চিত্রকলা, সাহিত্য, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র সমস্তই মূলতঃ কোনো না কোনো ভাবে রূপেরি সৃজন। তথাপি মাধ্যমের ভিন্নতার জন্য একই রূপের প্রকাশভঙ্গী প্রতিটি মাধ্যমে ভিন্ন। এতদ্বতিত রূপের মাত্রাও ভিন্ন। কবি আলোক সরকার একবার বলেছিলেন সমস্ত শিল্পই মূলতঃ নির্মাণ। সচেতন নির্মাণ। কিন্তু সফল শিল্প তা’ই যার শরীরে নির্মাণের ‘দাগ’ গুলিকে আর চেনা যায়না আলাদা করে। - আমার বোধ বুদ্ধিতে এ’ই আসল সংজ্ঞা। রূপের।
অপু’র পৃথিবী নির্মাণ করেছেন বিভূতিভূষণ। অবশ্যই তা সচেতন ভাবে। কিন্তু উপন্যাস শরীর থেকে তাঁর গাঁইতি, হাতুড়ির দাগ এমন ভাবে মুছে দিয়েছেন যে পাঠকের অনুভব হয় এ যেন দৈবাদিষ্ট রচনা। বিভুতির এই শান্ত পরিবেশের পাশাপাশি যদি দস্তয়ভস্কির ব্রাদার্স্ কার্মাজভ্’কে নেওয়া যায় – যেখানে প্রতিটি মুহুর্ত্ত উত্তেজনায়, দার্শনিক তর্কে টান্টান্, যেখানে প্রতিটি চরিত্র কোনো না কোনোভাবে স্নায়ু রোগী, যেখানে উপন্যাসের দিগন্ত আরো বিস্তৃত – সেখানেও তাঁর নির্মাণের গাঁইতি, হাতুড়ির দাগ যায়না চিনে নেওয়া। এবার যদি আদ্যন্ত মেধা নির্মিত উপন্যাস – কামু’র 'প্লেগ্'কে নিয়ে ভাবা যায় তাহলেও দেখা যাবে ঐ একই ব্যাপার। নির্মাণের সীজার চিহ্ন নেই। রচনার উদ্দেশ্য ঘোষিত নয়। নিটোল শিশুটি। যেমন রবীন্দ্রনাথের 'ঘরে বাইরে', 'গোরা' বা 'যোগাযোগ'। বঙ্কিমের 'বিষবৃক্ষ', 'কৃষ্ণকান্তের উইল'।
সময়ের আরো বিস্তীর্ণ পটভূমি, আরো বেশি চরিত্র নিয়ে যে উপন্যাস 'ওয়ার এন্ড্ পিস্' – যাতে টলস্টয়ের নিজস্ব দর্শনের বহু বীজই নিহিত সেখানেও একই ঘটনা। প্রসাধন অবশ্যই আছে। কিন্তু পাখিটির চেয়ে খাঁচাটি বড় করে চোখে পড়েনা। আঁচলের ভাঁজে স্তনের রেখা দেখা যায় ঠিক কিন্তু তার জন্যে বার বার নির্লজ্জের মতো আঁচল খসাতে হয়না। জয়েসের উইলিসিস্ যেমন – যে একবার পেয়ে গেছে ঐ রচনায় প্রবেশের পথ সে ঐ পথে – ডাবলীনের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নিজের অজান্তেই চলে এসেছে নিজের ছোট্ট মফস্বলে – নিজের পাপ-তাপে নির্মিত নিজস্ব পৃথিবীতে। যেমন ঘটে কমলকুমারের সফল উপন্যাস গুলিতে। তাঁর ভাষার অদ্ভুত বুনন সত্ত্বেও 'অন্তর্জলী যাত্রা' বা 'পিঞ্জরে বসিয়া শুক'কে মনেহয় না ‘নির্মিত’। মনে হয়না এর আবডালে লেখকের কিছু 'বক্তব্য' আছে। 'অভিসন্ধি' আছে। - অথচ 'বক্তব্য' আর 'অভিসন্ধি' আছে। থাকে। থাকতে বাধ্য। প্রতিটি সফল রচনায় থাকে। থাকবে। কিন্তু তা বেরিয়ে পরবেনা । টের পাওয়া যাবেনা যে লেখক এবার বলতে চলেছেন একটি সময়ের 'ইতিহাস'। তিনি থামবেন না, নিরস্ত হবেন না সেই 'ইতিহাস'টুকু – আর ঐ 'ইতিহাস' নিয়ে তাঁর 'তত্ত্ব' টুকু না জানান দিয়ে – যেমন ইলিয়াসের 'খোয়াবনামা', যেমন গৌরকিশোরের 'প্রেম নেই', যেমন অমিয় ভূষণের 'গড় শ্রীখন্ড'। - হ্যাঁ, লেখক হিসেবে গৌরকিশোর আখতারুজ্জামান থেকে নিম্ন স্তরের বলে তাঁর রচনার বেহায়াপনা পাঠককে বেশি বিরক্ত করে। তবে আখতারুজ্জামান, মূলতঃ উপন্যাসটির শেষের দিকে এসে, কাহন কে লম্বা করেন তাঁর 'ইতিহাস' বলার 'দায়িত্ববোধ' থেকে যেটা অমিয়ভূষণে আসে নানা রকম কসরত্ দেখানোর মাধ্যমে। - ওই কাহ্নেই রূপের দেবী তাঁদের প্রতি বিরূপ।
পাশাপাশি আবু ইস্হাকের 'সূর্য দীঘল বাড়ি'কে আনলে ব্যাপারটা বোঝা যায় আরো গভীর ভাবে। দুইটি বালক-বালিকা, যেন অন্য আবহের অপু-দুর্গা হয়ে টেনে নেয় পাঠককে। ঐ স্রোতে আপনি ভেসে আসে হিন্দুস্থান-পাকিস্তান’এর 'ইতিহাস'এর ছায়া। আবার তা ভেসেও যায় স্রোতে। আসে সামন্ত ব্যবস্থার, মুসলমান সমাজ ও বিবাহ ব্যবস্থার অন্ধকার দিক গুলো। অবলীলায়। তা’ও আবার ভেসে যায় ঐ “অন্য নদীর অন্য জল”এর টানে। - অর্থাৎ নির্মাণের সীজারের দাগ উল্কি হয়ে বসেনা উপন্যাস শরীরে। খুব সূক্ষ্মভাবে হলেও 'লাল সালু' বা 'কাঁদো নদী কাঁদো'তে এক সময় টের পাওয়া যায় লেখকের 'বক্তব্য'। আর তাই শেষ বিচারে আমার মন তাকে বলতে পারেনা ক্লাসিক্ বলে। পাশাপাশি 'তিতাস একটি নদীর নাম' অনেক বিস্তৃত পটভূমি নিয়ে, বহু বহু চক্রবাল ছুঁয়ে বয়ে যায় অবলীলায়। ঠিক যেমন বিমল মিত্রের 'বেগম মেরী বিশ্বাস'। লেখক বলেন গল্প। বাঁকে বাঁকে ইতিহাস ফেলে ছায়া। দুয়ের লাঠালাঠি বাধেনা কোথাও। আবার প্রমথনাথ বিশীর 'কেরী সাহেবের মুন্সী'র প্রথম পংক্তি থেকে টের পাওয়া যায় যে লেখক সাড়ম্বরে সভা ডেকে শোনাতে যাচ্ছেন 'ইতিহাস'।
'রূপ' –এ’ই। নির্মাতার ছেনি-হাতুড়ির দাগ, সীজারের দাগ থাকবেনা উপন্যাস শরীরে আবার সুনীল গাঙ্গুলির মতো কাঠামোর কাছা খুলে যাবেনা যখন তখন। 'রূপ' এর দিক থেকে আরেকজনের নাম না বলে পারছিনা। তিনি প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়। যাঁরা তাঁর 'রত্নদ্বীপ' অন্ততঃ পড়েছেন তাঁরা টের পেয়ে থাকবেন গল্প বলার মুন্সীয়ানা সেখানে কি জটিল-সুন্দর।
৩।
এই রূপটি একটা সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষার 'মুখ্য' লেখকের সবারি রচনায় ছিল উপস্থিত। মানিক এবং তার পরের সময় থেকেই দেখি অনটন। মানিকের রচনাপথ ক্রমে কম্পিত। অন্য কেউও আর এসে দাঁড়াচ্ছেন না বিভূতি , তারাশংকর বা সতীনাথ ভাদুড়ি’র মতো বিরাট স্কন্ধ নিয়ে। আরম্ভ হয়েছে বুদ্ধদেব বসু’র বুঝে না বুঝে পশ্চিমকে অনুকরণের যুগ। এর মধ্যেও শিবরাম চক্রবর্তী’র মতো প্রতিভা, এক দুইজন জ্বলে যাচ্ছেন। কিন্তু পারিপার্শ্বিকের ডামাডোলে মধ্য গগনে আলো ছড়াতে দেওয়া হচ্ছেনা তাঁদের। 'মিহি ও মোটা'য় মিলিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন প্রেমেন মিত্তির। - হায়, তথাকথিত 'সিরিয়াস' লেখালেখির দিকে না গিয়ে প্রেমেন মিত্তির যদি তাঁর অলৌকিক গল্পগুলি, মামাবাবু, ঘনাদা – এগুলোই শুধু লিখে যেতেন তাহলে বাংলার পাঠক টের বেশী উপকৃত হতো তাঁর দ্বারা!
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস শোনাতে বা বিশ্লেষণ করতে বসিনি আজ। তাই সাল ধরে ধরে হোঁচট খেয়ে পথ হাঁটার মানে নেই। যে প্রসঙ্গে বলছিলাম সেখানেই ফিরে আসি। ফিরে আসি রূপহীন বাংলা সাহিত্যের কথায়। ফিরে আসি বুদ্ধদেবের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমরা যা যা হারালাম সেই কাহনে। - প্রথমেই মনে আসছে তাঁর কথা যাঁর হাত থেকে আমরা পেয়েছিলাম ‘কত অজানারে’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’র মতো রচনা সেই ‘শংকর’ এর কথায়। - শংকরের উল্লিখিত রচনাগুলি রূপের দিক থেকে প্রায় ক্লাসিক। কিন্তু শংকরের যা ছিলনা তা সেই অন্তর্দৃষ্টি যা থাকলে চোখের পর্দায় উদ্ভাসিত হয় অন্য চক্রবাল – যা উন্মোচিত হয়েছিল অপু’র, জিতু’র, জাঁ ক্রিস্তফের ও তাদের শ্রষ্টাদের চোখে, যা পাঠককে ফিরে ফিরে ভাবতে বাধ্য করে – এই ব্রহ্মান্ডের কোনো নিশ্চিত অভিপ্রায় রয়েছে কি’না এই কথা, কে আমি, কি আমি, কেন আমি – এই কথা... অর্থাৎ আমাদের নগণ্য যাপনকে ছুটিয়ে দেয় মহাজীবনের চক্রবালের দিকে... এই অন্তর্দৃষ্টি ছিলনা বলেই শংকরের উল্লিখিত রচনা গুলিও ক্লাসিক হতে হতেও ‘ভালো উপন্যাস’ হয়েই রয়ে গেলো। পরেও আর তেমন কিছু হলোনা তাঁর লেখনী থেকে।
ঐ না-হওয়ার বৃত্তান্তই, এর পরে প্রায় সর্বত্র। বুদ্ধি দিয়ে, নানা তত্ত্ব পাঠ করে, সেইসব তত্ত্বকে হজম না করতে পেরে তা উগ্ড়ে দিতে লাগলেন একদল লোক। গৌরকিশোর ঘোষ যাঁদের অগ্রগণ্য। ‘অন্ত্যজ’দের গপ্পো বলার নামে পর্ণগ্রাফিতে লাগলেন আরেকদল। অনবদ্য ভাষা ও নির্মাণ কুশলতা সত্ত্বেও সমরেশ বসু’র মতন লেখকওযে অন্তিমে ঐ পথই নিয়েছিলেন তার হেতু যুগধর্ম’কে অস্বীকার করতে না পারা – যে না পারার মর্মে নিজস্ব বিশ্বাসের ভিত্তিহীনতা। - ক্রমে যা দাঁড়ালো তা এই, যে, ‘প্রিয় উপন্যাস’ যদিবা খুঁজে নিতে সক্ষম হয়েছেন প্রকৃত পাঠকজন কিন্তু একজন 'প্রিয় ঔপন্যাসিক' আর পাওয়াই গেলোনা।
অথচ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে', 'অলৌকিক জলযান' – এমন কি 'ঈশ্বরের বাগান' হেন অনবদ্য লেখাও কিন্তু হয়েছে। আবার তার পরেই সেই লেখকের হাতেই এমন কিছু লিখিত হয়েছে যে পাঠক চমকে উঠেছে। হ্যাঁ, এখানেও তর-তম’র প্রশ্ন আসে। যেমন অতীন বন্দ্যোপাধায়ের 'খারাপ লেখা' যতোটা খারাপ তার চেয়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'মাঝারি লেখা' অনেক বেশি খারাপ। অথচ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ই কিন্তু লিখেছিলেন 'শাহজাদা দারাশুকো' বা 'কুবেরের বিষয় আশয়'...
কিছু ঔপন্যাসিক অকম্পিত যাত্রায় লিখে গিয়েছেন মাঝারি মানের লেখা। যেমন রমাপদ চৌধুরি। তাঁর সমস্ত লেখাই বহুদূর 'ভালো' কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনোখানে তা ব্যর্থ হয়ে গেছে লেখার গহনের উদ্দেশ্যটির প্রকটতায় ( যেমনঃ খারিজ, লজ্জা, দাগ – ইত্যাদি) আর কিছু নির্মাণ কুশলতার অভাবে ( 'দ্বীপের নাম টিয়া রঙ', 'বন পলাশীর পদাবলী' – ইত্যাদি)। অর্থাৎ অন্তিমে অকম্পিত যাত্রায় সফল নন কেউ। - সেই অর্থে যাঁরা 'অফ্বীট্'-'প্যারালাল' – যেমন অমিয়ভূষণ, তাঁদের ব্যর্থতার কথা আগেই বলেছি।
এই সমস্ত গোলমালের মধ্যেও যে দুইজন মানুষের রচনার কাছে অদ্যাপি বসতে হয় স্থির হয়ে তাঁরা – বিমল কর আর শীর্ষেন্দু। এঁরা দুজনের সিংহভাগ রচনার শরীরেই নির্মাণের সীজার চিহ্ন নেই। দুই রকমের দুই চক্রবাল পায় হয়ে তাঁরা দেখান দুই মহানীলাকাশ। - হ্যাঁ, শীর্ষেন্দু’র রচনায় সফলভাবে মিশে থাকা তাঁর নিজস্ব দর্শনের সঙ্গে সর্বদা একমত হওয়া যায়না। তার প্রয়োজনও নেই – ঠিক যেমন রুশ বিপ্লবকে সমর্থন করা সত্ত্বেও ডুবে যাওয়া যায়, ডুবে যেতে হয় পাস্তেরনাকের 'জিভাগো’তে। -বিমল কর আর শীর্ষেন্দু’র ক্ষেত্রে পথ যে অকম্পিত থেকে যায়, তাঁদের সিংহভাগ রচনাই যে ছুঁয়ে থাকে ক্লাসিক-শরীর তার হেতু নিহিত তাঁদের জীবনে। যাপনে। তাঁদের জীবনের মর্মে এক রকমের অধ্যাত্ম ( ‘ধর্মীয়’ নয় কিন্তু, অন্ততঃ বিমল কর’ এর ক্ষেত্রে) কেন্দ্র রয়ে যায় শেষ অবধি যে অধ্যাত্ম কেন্দ্র হারানো বিষয়ে ও শিল্পে তার ছায়াপাত নিয়ে অদ্যাপি চলছে আলোচনা ...
মনে আসছে ঐ অধ্যাত্ম-কেন্দ্রটি, ইউরোপের, বিষয়ে ভিক্টর উগো’র ‘ক্রমওয়েল’ নাটকের ভূমিকা যা ক্রমে হয়ে পরেছিল ফরাসী রোমান্টিকদের ইস্তেহার। ঐ অধ্যাত্ম সময়ের সূচনা বিষয়ে উগো লিখেছেনঃ ‘...the age of the epic draws near its end. Like the society that it represents, this form of poetry wears itself out revolving upon itself. Rome reproduces Greece, Virgil copies Homer, and, as if to make a becoming end, epic poetry expires in the last parturition.
It was time. Another era is about to begin, for the world and for poetry.
A spiritual religion, supplanting the material and external paganism, makes its way to the heart of the ancient society, kills it, and deposits, in that corpse of a decrepit civilization, the germ of modern civilization. This religion is complete, because it is true; between its dogma and its cult, it embraces a deep-rooted moral. and first of all, as a fundamental truth, it teaches man that he has two lives to live, one ephemeral, the other immortal; one on earth, the other in heaven. It shows him that he, like his destiny, is twofold: that there is in him an animal and an intellect, a body and a soul; in a word, that he is the point of intersection, the common link of the two chains of beings which embrace all creation--of the chain of material beings and the chain of incorporeal beings; the first starting from the rock to arrive at man, the second starting from man to end at God.
A portion of these truths had perhaps been suspected by certain wise men of ancient times, but their full, broad, luminous revelation dates from the Gospels. The pagan schools walked in darkness, feeling their way, clinging to falsehoods as well as to truths in their haphazard journeying. Some of their philosophers occasionally cast upon certain subjects feeble gleams which illuminated but one side and made the darkness of the other side more profound. Hence all the phantoms created by ancient philosophy. None but divine wisdom was capable of substituting an even and all-embracing light for all those flickering rays of human wisdom. Pythagoras, Epicurus, Socrates, Plato, are torches: Christ is the glorious light of day.
আর এই অধ্যাত্ম কেন্দ্রটি হারানোর পরের কথা বলে টলস্টয় তাঁর 'হোয়াট্ ইস্ আর্ট' এঃ
The religious perception of our time, in its widest and most practical application, is the consciousness that our well being, both material and spiritual, individual and collective, temporal and eternal, lies in the growth of brotherhood among men in their loving harmony with one another.
This perception is not only expressed by Christ and all the best men of past ages, it is not only repeated in the most varied forms and from most diverse sides by the best men of our times, but it already serves as a clue to all the complex labour of humanity, consisting, as this labour does, on the one hand in the destruction of physical and moral obstacles to the union of men, and on the other hand in establishing the principles common to all men which can and should unite them in one universal brotherhood. And it is on the basis of this perception that we should appraise all the phenomena of our life, and among the rest our art also; choosing from all its realms and highly prizing and encouraging whatever transmits feelings flowing from this religious perception, rejecting whatever is contrary to it, and not attributing to the rest of art an importance not properly belonging to it.
The chief mistake made by people of the upper classes at the time of the so-called Renaissance, a mistake we still perpetuate, was not that they ceased to value and to attach importance to religious art (people of that period could not attach importance to it because, like our own upper classes, they could not believe in what the majority considered to be religion), but their mistake was that they set up in place of religious art which was lacking, an insignificant art which aimed only at giving pleasure, that is, they began to choose, to value, and to encourage, in place of religious art, something which in any case did not deserve such esteem and encouragement.
বাঙালির জীবন থেকে ঐ অধ্যাত্মকেন্দ্রটি মুছে গেছে, ক্রমে, দীর্ঘদিনের পরাধীনতায় । অতঃপর খন্ডিত 'স্বাধীনতা' ও তজ্জনিত ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায়। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের আগ্রাসনে। অন্তিমে বুঝে না বুঝে 'আধুনিক' ও 'কমিউনিষ্ট' সাজবার ভ্রমে। জীবনের কেন্দ্র থেকে অভিকেন্দ্রিক টান ( সামন্ত তান্ত্রিকও বটে) হঠাৎই ছিঁড়ে গেছে দেশভাগে অথচ কোনো নতুন কেন্দ্র সামাজিক নিয়মেই গড়ে ওঠেনি। সঙ্গে এসেছে “প্রগতি” নামক ভুয়ো শব্দ তার সমস্ত কালোজাদুকে সঙ্গে নিয়ে। সুতরাং ঐ সময়ের সন্ততি যেসমস্ত লেখকেরা তার সিংহভাগই আশ্রয় নিয়েছে যে শিবির সামনে পেয়েছে তাতেই। আর ঐ 'আশ্রয়' নেওয়ার মূল্যে যে ঠিক কি তারা হারিয়েছে তা কমলকুমার মজুমদার হেন এক আধজন ব্যতীত কেউ টের পায়নি। আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবি যে সুনীল কমলকুমারের সমস্ত বই’য়ে ‘আনন্দ বাজারী' ভূমিকা লেখে সে, কমলকুমারের এতো কাছাকাছি এসেও কি করে আমরন এই সব লিখে গেলো? – উওরও অবশ্য পাওয়া যায় তার কমলকুমারকে নিয়ে লেখা গুলি নেড়ে চেড়ে দেখলেই। এরা মূলতঃ কমলকুমারের বাইরের চমকদারী দিকটাতেই আকৃষ্ট হয়েছিল। কিন্তু ঐ সময়ে বসে কেন কমলকুমার প্রাক্ -রামমোহন সময়কে নিলেন তাঁর এক প্রধান উপন্যাসের পটভূমি করে, কি বার্তা তিনি তাতে পাঠালেন – এইসব ভেবে দেখবার গভীরতা সুনীলদের ছিলনা। ফলতঃ কৃত্তিবাস থেকেই জন্মালো রনজিত দাশেদের ভ্রূন যারা ‘আধুনিক’ না হলে নস্যও নেবেন না স্থির করে মূলতঃ সাজানো গোছানো আঙ্গিকে অশ্বডিম্ব বিতরনের কর্মটিকে দিলেন আরো এগিয়ে। তাদের ছায়া যে প্রত্যন্ত মফস্বলেও কি মারাত্মক ভাবে পরেছিল তার প্রমাণ একদা আসামের শিলচরের/হাইলাকান্দির ‘অতন্দ্র’। তাদের জীবন। তাদের 'রচনা'।
যখন এইসব ভাবার বীজ ক্রমে অঙ্কুরিত হতে লাগলো – যখন সুনীল ইত্যাদির পাশাপাশি আলোক সরকার, যুগান্তরেরা এসে দাঁড়ালেন, আরেকটু পরের দিকে গৌতম বসু তখন থেকে, ক্রমে, আরম্ভ হলো আরেক নকল নবিশী। যে ভাবের, ভাবনার কোনো প্রয়োগ নেই যাপনে সেই ভাবনাসঞ্জাত যে ফর্ম তাকে নিয়ে ‘প্লাস্টিক-ফুল’ নির্মাণে লাগলেন আরেকদল। ছদ্ম আলোক, নকল গৌতমের ছড়াছড়িতে ভরে গেলো ‘প্যারালাল’ সাহিত্য। - মূলতঃ পদ্যে। গদ্যে ঐ সময় এসেছে বিদেশে পুরোনো হয়ে যাওয়া 'ম্যাজিক রিয়েলিজম'। ‘মেইন স্ট্রীম' এ তার উদাহরণ যদি হয় 'অষ্টম গর্ভ' , প্যারালালে 'মুন্সী' – 'খোয়াবনামা'। - না, ইলিয়াস যেমন সামলাতে পারেননি 'মুন্সী'কে – যেমন সামলেছেন মার্কেজ তাঁর বুয়েন্দিয়া দের – বাণী বসু ( বাণী বসু’ই ত?) সামলাতে পারেননি 'অষ্টম গর্ভ'কে। তিনি যেহেতু ইলিয়াস থেকে অনেক অনেক অনেক অক্ষম তাই ঐ অষ্টম গর্ভের গর্ভপাত 'খোয়াবনামা'র থেকে ঢের শোচনীয়।
৪।
ফিরে যাই যেখান থেকে আরম্ভ করেছিলাম সেখানে। আসল কথাটি এই, যে, শিল্পের কাছ থেকে, সাহিত্যের কাছ থেকে কে ঠিক কি চাইছে। একদল পাঠক সকালে বাজার করতে গিয়ে যা যা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় তা’ই দেখতে চায় সাহিত্যে। - একদল লেখক তাদের জন্য লেখে। উদাহরন ভগীরথ মিশ্র। একদল চায় সাহিত্য পাঠ করে 'জ্ঞানী' হতে। একদল লেখক - – যে ইতিহাস বা দর্শন তারা নিজেরাই পারেনি পরিপাক করতে তা দিয়ে পাঠকদের জোগায় – ইতিহাসের, দর্শনের পাচন । যেমনটি 'তিন পুরুষ', 'শিকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে' ইত্যাদিতে একদা জুগিয়েছে সমরেশ বসু, পরে বাণী বসু 'পঞ্চম পুরুষ' মার্কা লেখায়। সুনীলও ওপথে হেঁটে দেখেছে তার 'সপ্তম অভিযান', 'ধূলিবসন' – ইত্যাদিতে। একদল পাঠকের চাই 'আঞ্চলিক বাস্তবতা'। তাদের জন্য 'গিয়েছিলাম' কে 'গেইস্লাম' আর 'খেয়েছিলাম' কে 'খাইস্লাম' লিখে চোলাই জোগায় মফস্বল। অথচ যেটা সকলে ভুলে গেছে তা হলো শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে সেই প্রাথমিক সত্যটি যা ভিক্টর উগো’র ভাষায়ঃ ‘There is an impenetrable boundary between artistic reality and natural reality. It's folly to confuse them, as some rather backward partisans of 'Romanticisim' do.’ সুতরাং বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রগান হয়ে টলস্টয়, দস্তয়ভস্কিতে এসে আমি যে পথের পথিকত্ব্ব বা যে পাঠের পাঠকত্ব অর্জন করেছি সেই পথ যে দ্বীপে যায় তার ক্লাসিকের তালিকায় বিভূতি-তারাশঙ্করের পরে মাণিকের হাতে গোনা লেখা আর কমলকুমার ছাড়া অন্য কাকে আমি বয়ে নেবো? কীভাবে বয়ে নেবো?
সবচেয়ে বড় কথা হলো কেন বয়েনেবো?
আজ, কোনো গহন বনের নির্জনতায় হয়তোবা লেখা হচ্ছে আরো একটি ক্লাসিক, আরো একটি 'পথের পাঁচালী' কিংবা 'দৃষ্টিপ্রদীপ' – কিন্তু তা আমার জন্য নয়। তা আমার সন্ততির জন্য। হ্যাঁ তেমন কিছু যে লেখা হবে আবার, কোনো দিন, তারো আশ্বাস পাই টলস্টয়ের দেওয়া উদাহরণে, যুক্তিতেঃ
Art is a spiritual organ of human life which cannot be destroyed, and therefore, notwithstanding all the efforts made by people of the upper classes to conceal the religious ideal by which humanity lives, that ideal is more and more clearly recognised by man, and even in our perverted society is more and more often partially expressed by science and by art. During the present century works of the higher kind of religious art, permeated by a truly Christian spirit, have appeared more and more frequently both in literature and in painting, as also works of the universal art of common life accessible to all.
So that even art knows the true ideal of our times and tends towards it. On the one hand, the best works of art of our time transmit religious feelings urging towards the union and the brotherhood of man (such are the works of Dickens, Hugo, Dostoevski; and, in painting, of Millet, Bastien Le-page, Jules Breton, Lhermitte, and others) ; on the other hand, they strive towards the transmission, not of feelings which are natural to people of the upper classes only, but of such feelings as may unite everyone without exception. There are as yet few such works, but the need of them is already acknowledged. In recent times we also meet more and more frequently with attempts at publications, pictures, concerts, and theatres, for the people. All this is still very far from accomplishing what should be done, but already the direction in which good art instinctively presses forward to regain the path natural to it can be discerned.
অতএব ‘রাত কত হল’ এ প্রশ্নের উত্তর যদিও আজো মিলছেনা তবু একদিন মিলবে তেমন ভাবতে ক্ষতি কি? হোক্না সে আমার মৃত্যুর পরে, আমার সন্ততির জন্য ...।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন