।।জয়শ্রী ভূষণ।।
( লেখাটি আগরতলা থেকে প্রকাশিত 'অভিনয় ত্রিপুরা'র শারদ সংখ্যা, ২০১৩তে প্রকাশিত)
( লেখাটি আগরতলা থেকে প্রকাশিত 'অভিনয় ত্রিপুরা'র শারদ সংখ্যা, ২০১৩তে প্রকাশিত)
রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, সমাজনীতি, দুর্নীতি, সংস্কৃতি, শান্তি, সম্প্রীতি, সংহতি,রীতিনীতি ইত্যাদি... ইত্যাদি... যদিও এগুলোকে শুধুমাত্র এক একটি শব্দ রূপে আমরা দেখছি ও পড়ছি, তবে এরা কি শুধুই এক একটি শব্দ না এই এক একটি শব্দ এক বিশাল গভীরতর প্রশস্ত কুয়ার মত, যার উপরটুকু আমরা দেখতে পাই শব্দ রূপে, কিন্তু এর বিস্তার ও সীমার পরিধি আমাদের কারোই জানা নেই, বা জানার চেষ্টা সচরাচর করা হয় না। এদের মিলন যে মাটির পরতে পরতের প্র্ত্যেক স্তরের সাথে এবং সর্বশেষে অবগাহন হয় যেখানে ধরিত্রীর সৃষ্টি ও সমুদ্রের শুরু, এবং সেই সমুদ্রের স্পর্শে মিলে মিশে আরও কত কত যে রংবদল তা নিয়ে আমরা সাধারান মানুষ কখনও ভাবিনা । কিন্তু আমি ভাবছি ... কদিন ধরেই “রাজনীতি” শব্দটি নিয়ে ভাবছি, চেষ্টা করছি মনে করতে, আমি কি এই শব্দটিকে চিনি, শুনেছি অনেক... কিন্তু আমি কতটুকু জানি... “রাজনীতি” কে। ভেবে ভেবে যা বুঝলাম তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম । আমি তো কিছুই জানি না আসলে “রাজনীতি” কি ? আমার আশেপাশের যারা তথাকথিত রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞ তাদের ধ্যান ধারণা ও জীবন যাপনের পদ্ধতি ...মনে মনে পড়ার চেষ্টা করে ... “রাজনীতি” কে বোঝার চেষ্টা ... আমার সমস্ত ভাবনা... ,আরও গুবলেট হয়ে গেল । কি আর করি শেষমেশ ...ধ্যাৎতেরিকা... বলে কিছুদিনের জন্যে আমার এই অসফল বোঝার প্রয়াসে কমা দিলাম। তবুও যেন.... আমার ভাবনাগুলি কিন্তু ...ভাবের আকাশে সাঁতার কাটছে আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি না চাইলেও আমার ভাবনা গুলি আমার মনের আকাশে ধোঁয়ার মত হারিয়ে যেতে যেতেও কোথায় যেন একটু সময়ের জন্য থেমে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, আর আমিও আমার অজান্তে সেইসব ভাবনার ধোঁয়াকে হঠাৎ যেন দূরে সবুজ পাহাড়ের গায়ে নীল আকাশের গায়ে গা ঘেষে ঘন ধবধবে সাদা মেঘের মত দেখতে পাচ্ছিলাম স্পষ্ট । এই যে পাওয়া ও না পাওয়ার দ্বন্দ্ব... , বোঝা ও বুঝতে না পারার কষ্ট ...... থেকে বেরিয়ে হঠাৎ করে পেয়ে যাওয়ার আনন্দ সত্যি রোমাঞ্চকর...অন্তত আমার কাছে, এ পাওয়া বড় পাওয়া... বিশাল প্রাপ্তি...অনেকটা হারিয়ে যাওয়া নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মত।
সত্যি বলছি, একদম সোজা সাপটা ভাষায় অকপটে প্রথমেই স্বীকার করে নিচ্ছি রাজনীতি মানে তথাকথিত সবাই রাজনীতি বলতে যা বোঝায়... তারপর লাল সবুজ গেরুয়া নিয়ে সবার বিশ্লেষণ আমি এখনও সঠিক ভাবে মগজধঃকরণ করতে পারি না,তবুও কেন তাহলে এ বিষয়ে লিখতে বসলাম, তার উত্তরের দেখা হয়ত আমি আমার এই লেখার অন্ত পথেই পাব সেই সাহস নিয়েই আমার উপস্থিতি আপনাদের মাঝে এখানে একজন সাধারন মানুষ হিসেবে। প্রথমেই যেদিন “রাজনীতি” বিষয়টি নিয়ে ভাবলাম, আমার সেই মুহূর্তের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ যে ছবিটি আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠল, বলতে পারেন আমার মনের থিয়েটারের পর্দা সরে যাওয়ার পর পরই যে দৃশ্য ভেসে উঠল...... “সংসদ ভবনে সংসদ চলাকালীন সময়ে কিছু রাজনৈতিক নেতা যারা নাকি এই সমাজের হর্তা কর্তা বিধাতা ও আমাদের সবার ত্রাতা , কয়েকটি কেদারা মানে চেয়ার মাথার উপর উঠিয়ে ভীষণ বেগে বিপক্ষের দিকে ছুড়োছুড়ি করছেন, আর আমরা কোটি কোটি আম জনতা, টেলিভিশনের পর্দায় সেই থিয়েটারের সরাসরি সম্প্রচারন উপভোগ করছিলাম...”। আসলে এই যে দৃশ্যটি যখন আমি একদিন সত্যি সত্যি টেলিভিশনের পর্দায় প্রত্যক্ষ্য করেছিলাম, সেদিন আমি একেবারে বলতে পারেন “থ” বনে গেছিলাম, আমি ভাবতে পারছিলাম না যে এরা কিভাবে দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকতে পারে, এদের তো নিদেন পক্ষে সাধারনজ্ঞানটুকুও নেই। যাহোক আমি পরমুহূর্তেই যারপরনাই খুশী হয়ে আমার মনের থিয়েটারের পর্দা বন্ধ করে দিলাম, আর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবলাম, যাক্, এযাত্রা আর চিন্তা নেই, এই বিষয়ে আমি অনেক কিছুই লিখতে পারব, কারণ রাজনীতি মানেই তো থিয়েটার আর থিয়েটার মানেই তো রাজনীতি, তাই আমিও খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম, ভাবলাম এত বিশাল ব্যাপ্তি বিষয়টির, এতগুলি খবরের চ্যানেল চলছে... শুধুমাত্র “রাজনীতি” উপর নির্ভর করে, ওরা এত এত অনুষ্ঠান, সরাসরি অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা করছে, কত কত রমরমা, মুখরোচক খবরের খনি হচ্ছে খবরের চ্যানেল গুলি, বলতে গেলে এই সব চ্যানেল গুলোই তো মূর্তিমান “থিয়েটারে রাজনীতি রাজনীতিতে থিয়েটারের” সত্যতা প্রতিষ্ঠাতা, একদম আমাদের অন্দরমহলতক সব পৌঁছে দিচ্ছে, কজন আর থিয়েটারে গিয়ে রাজনীতির পাঠ পড়েন, সবাই টেলিভিশনের পর্দার সামনে বসেই নিজেদের Ph.D. থিসিস করে নেন। এরই মধ্যে আমার মাথার ভেতরে অনবরত মনের থিয়েটারের পর্দা খুলছে, আর আমি দেখছি আবার বন্ধ হচ্ছে আবার খুলছে আবার দেখছি ...এই প্রক্রিয়াটি বেশ কিছুদিন ধরেই আমার মধ্যে চলছে, মানে আমি উঠতে বসতে একটু অবসর পেলেই মনে মনে থিয়েটারে রাজনীতি ও রাজনীতিতে থিয়েটার... দুটোই আমার আমির সাথে নিজেই নিজের মধ্যে উপভোগ করছিলাম।
...প্রথম দৃশ্য... “সোনিয়া গান্ধী পতাকা দুলিয়ে অনেকগুলি ট্রাক ভর্তি ত্রান সামগ্রী পাঠাচ্ছেন উত্তরাঞ্চলের দুর্গতদের জন্য, ...দেখেই কেমন যেন বোকা বোকা লাগছিল হাসব কি না তাই ভাবছিলাম,...দ্বিতীয় দৃশ্যটি ছিল যেখানে গিয়ে ট্রাকগুলো দাড়িয়ে ছিল মানে ওখান থেকে আর রাস্তা নেই যাওয়া যাবে না, প্রতিবেদক ট্রাক চালকদের সাথে কথা বললেন, ওরা বলল ওদের কাছে কোন নির্দেশ নেই এখন ওরা কি করবে ... ট্রাকের ভেতরের সামগ্রীর কি হবে, আর দুদিন দাড়িয়ে থাকলে সব সামগ্রী পচে গলে নষ্ট হয়ে যাবে, ...না হেসে আর পারলাম না,... দারুণ ব্যাপার লাগছিল আমার...সোনিয়াজী পতাকা দুলিয়ে ওদের কে বিদেয় করার আগে খোঁজ নিতে ভুলে গেছেন ওদিকের রাস্তা ঘাট সমস্ত ভেঙ্গে গেছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল তাই সবাই আটকে আছেন, হাজার হাজার মানুষ ও সাথে সমস্ত পশু ও গবাদির শবের গণ সৎকারের চিন্তা করছে সেনা জওয়ানরা, উনি শুধু পতাকা দুলিয়ে দিলেন আর ক্যামেরা বন্দি করে খবরের চ্যানেলে খবর পাচার ব্যস..., তারপরে আবার রাজনৈতিক ভাবে এদেশের আপামর জনগণের জন্য মাথা বেঁধে কোমর কষে লেগে গেলেন কি করে সব রাজ্যে কংগ্রেস নামক রাজনৈতিক সংগঠনটির সদস্য সদস্যাদের রাজনৈতিক পাঠ দিতে যাতে ওরাও উনার মত শুধু পতাকা দুলানোটুকুও অন্তত ভালো ভাবে শিখে নেয়। উনি হচ্ছেন “হাই কমান্ড” ..উনার হ্যাঁ ও নার উপর ভারতবর্ষের রাজনীতি হেলদোল চলছে ও চলবে..
.দ্বিতীয় দৃশ্য ...এদিকে দুই নেতা বিমানবন্দরে হাতাহাতিতে ব্যস্ত কে আগে যাবেন বিমানে ...গিয়ে পৌঁছে জানান দিতে হবে যে উনারা কে কার আগে উত্তরাঞ্চলের দুর্গতদের পাশে দাড়িয়ে ছিলেন, ওখানে যেসব ভাগ্যবান-দুর্গতরা বিমানে চড়ে নিজেদের ঘর বাড়ি ও গন্তব্য স্থলে পৌঁছনোর জন্য অপেক্ষারত...ওরাও নিরুপায় হয়ে রাজনীতিতে থিয়েটার দেখে তারপর বিমানে চড়ার সুযোগ পেলেন। কম ভাগ্যের ব্যাপার নয় বলুন, এ রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ের তথাকথিত “রাজনীতি” র সুবাদে, এই দুর্দিনেও এরকম সরাসরি থিয়েটার উপভোগ করা যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও পশ্চিমবঙ্গে তোলপাড় চলছিল, না কি হয়েছে, “পরিবর্তন চাই”... দিদির দৌলতে আমরা অনেক নতুন ধরণের সংলাপ যা নাকি বিগত সরকার আমাদের শোনাতে পারেনি, আমরা অহরহ শুনছি, আনন্দ পাচ্ছি, ও সেই সাথে পরিবর্তনের আবর্তে ঢুকছি। সম্প্রতি আবার “মোদী” নামক অধিনায়কের চয়ন হল, খুব সামনেই রাজনীতির ফাইনাল ম্যাচ, ভারতীয় জনতা পার্টি নামক রাজনৈতিক দলের বদৌলতে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে উথাল পাথাল হয়ে গেল, রাজা বদল, সাথে সাথে পালাও বদল মানে রাজার সাথে সাথে, সংলাপ ও রাজনীতির থিয়েটার বিষয় ও অনেকটাই বদলে যায়, কি দারুন ভাবুন তো! এরকম যে হাজার হাজার বিষয়, অনেক ব্যক্তিত্ব, এতসব তো আমি লিখে শেষ করতে পারব না, কাজেই এখানেই ক্ষান্ত দিচ্ছি।
ইস্ যাঃ.. আর একজন আমার খুব প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব... উনার কথাটা এখানে না লিখলে ঠিক জমবে না, আমাদের সবার প্রিয় লালুজি, যখনই টেলিভিশনের পর্দায় উনাকে দেখি কথা বলছেন , আমি সঙ্গে সঙ্গে “স্ট্যাচু” হয়ে যাই ও খুব মন দিয়ে উনার কথা শুনি, বিশেষ করে সংসদ চলাকালীন সময়ে আমি খুব চেষ্টা করি লালুজির বক্তব্য শুনতে, অনেকটা রম্য রচনার মত মনে হয়, হিহিহি করে একটু হাসার সুযোগ পাই আমি। এই যে উপরে এত সময় “রাজনীতিতে থিয়েটার” নিয়ে হাহা ও হিহি করলাম, তাতে কিন্তু “ হাহা-হিহি” ছাড়া সদর্থক কিছুই পেলাম না । আমরা বোকার মত ভারতীয় “রাজনীতির থিয়েটারে” শুধু মাত্র নীরব দর্শক... যেসব দর্শকদের সমস্যা ও সমাধান, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয় নিয়ে ওরা ওদের থিয়েটারের সংলাপ ও বিষয় হিসেবেও ভাবে না, কিন্তু আমরা প্রতিবার, গাঁটের পয়সা দিয়ে, আমাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পারিশ্রমিক দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক থিয়েটারের দলগুলিকে বিভিন্ন রংগের জামা পরিয়ে আইপিএল এর মত ম্যাচ দেখি, ম্যাচ ফিক্সিং করি, তারপর আবার পরবর্তী ফাইনাল ম্যাচের জন্য অপেক্ষা করি। উপরোক্ত ভাবনাগুলো যখন আমার মনকে কালো ধোঁয়ার মত ছেয়ে ফেলেছে, তখন আমি কোনোমতে মুখে হাত দিয়ে দম বন্ধ করে আবার আমার মনকে খোলা আকাশের নীচে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে এলাম আর প্রান ভরে শ্বাস নিলাম। আমাকে আবার বোঝাতে শুরু করলাম, এ কি ভাবছি আমি, এত শুধু পরনিন্দা আর পরচর্চা হয়ে যাচ্ছে, কোন ভালো কথা আমি নিজেকে পর্যন্ত শোনাতে পারছি না, এ কোন রাজনীতি, এ কোন থিয়েটার, না না এসব তো আমি ভাবতে চাই না, আমি আপনাদের সাথেও ভাগ করতে চাই না, মনটা আবার একটু খারাপ হয়ে গেল, তাহলে মনে হচ্ছে সত্যি আসলে “রাজনীতি” মানেটা কি এখনও বোধহয় আমার বোধগম্য হল না। আবার ভাবতে শুরু করলাম, এবার একটু নিরাশ হয়েই ভাবছি। তখনই হঠাৎ মনে পড়ল, শব্দটি বোধহয় “রাষ্ট্রবিজ্ঞান” বা “পৌরবিজ্ঞান” । আমি তখন সবে অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছি। অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে প্রতি আমার অনুরাগ ছোটবেলা থেকেই, কিন্তু অষ্টম শ্রেণীতে একটু বাড়তি বিষয় নির্বাচন করতে হত আমাদের, তো আমি ভাবছিলাম কোন বিষয়টি পছন্দ করবো। ১৯৮২ সাল, বৈশাখ মাসের একদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গল কান্না আর হইচই শুনে, কে কাঁদছে, কি হয়েছে জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে বিছানা থেকে উঠে চোখ খুলেই জানালার পর্দা উঠিয়ে উঁকি দিয়ে ছোট্ট মেয়েটি দেখতে পেল... বাড়ির সামনে ট্রাক দাড়িয়ে আছে...আর ট্রাকটির মধ্যে মনে হচ্ছে ওর বিছানার মতই ধবধবে সাদা চাদর দিয়ে কাউকে ঢাকা দিয়ে রাখা । কৌতূহল আরও বাড়ল, কী যেন একটা অজানা ভয়ে মনটা কেঁপে উঠল, ছোট্ট মেয়েটি আর কিছু না বুঝুক এটুকু আঁচ করতে পারল একটা কিছু হয়েছে তাই, বুড়ি, কুট্টি,ঝুট্টি,সুমু, শঙ্কু আর শম্ভুদা অমন করে চীৎকার করে কাঁদছে। আরে ওই তো বাপি আর বড় পিসী মিলে ট্রাকে উঠে গেল...তারপর সবাই মিলে ট্রাক থেকে সেই ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা সেই বস্তুটি নামিয়ে উঠোনে তুলসী তলায় রেখে দিল। এবার আর কৌতূহল সম্বরণ না করতে পেরে একছুটে উঠোনে গিয়ে মেয়েটি যেই না সাদা চাদর সরিয়েছে, দেখতে পেল...আরে এত জেঠু ঘুমিয়ে আছে, কি করে এত সকালে জেঠু আগরতলা থেকে করিমগঞ্জের বাড়ীতে, আর তাও কেন উঠোনে এভাবে ঘুমিয়ে আছে, ওঠে না কেন, হঠাৎ করে কোথা থেকে মা এসে টেনে নিয়ে কানে কানে বলল, তুমি দুষ্টুমি করবে না, জেঠু মারা গেছে, তুমি পা ছুঁয়ে বসে থাকো, ছোট্ট মেয়েটি মনে মনে ভাবল দাঁত না মেজেই বসব, আশে পাশে ততক্ষণ পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই ভিড় করেছে...তাই আর রা না কেড়ে চুপটি করে বসে রইল ...... এই প্রথম মুখোমুখি মৃত্যুর সাথে আমার পরিচয় কিন্তু খুব ভালভাবে তখনও মৃত্যুকে চিনতে পারিনি ।
তারপর ১৯৮৬ সাল ১৭ই এপ্রিল, বাসন্তী পূজার মহাষ্টমীর সন্ধ্যা আরতি চলছে, ঢাক বাজছে, কাঁসর বাজছে, পয়লা বৈশাখের ঠিক দুদিন পরেই... বাপির আকস্মিক মৃত্যু... ...আমাকে মৃত্যুর আসল কদর্য রূপ চিনিয়ে দিল...... । মৃত্যু নামক ঝড়ে আমার ছোটবেলা উধাও হল ...তারপর থেকেই মাও যেন কেমন বদলে গেল...আগের মত মারে না, বকাঝকা ও করে না। মা যে এখন চাকরীর জন্য দরখাস্ত করছে......এ অফিস...সে অফিস ছুটোছুটি করছে... ডি সি র অফিস, ডি আই অফিসে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ হাঁটাহাঁটি করতে করতে ক্লান্ত বিধ্বস্ত আমার মা...না মার কোন চাকুরী হল না, একান্নবর্তী পরিবারে বসবাস করার দরুন থাকা খাওয়ার কষ্ট সেরকম হল না, পড়াশোনাও চালিয়ে গেলাম ...সাদামাটা ভাবে। অনেকবার ভেবেছি কি করলে আমাদের আর্থিক সমস্যার সমাধান হবে, আমি তখনও ছোট, মায়ের চাকুরীই সব সমস্যার সমাধান, কিন্তু কে দেবে...অনেকটা সিনেমার গল্প বলে মনে হলেও নাবালিকা অপক্ক কিশোরী মনের আবেগে আমি তখনকার প্রধানমন্ত্রীকে আমার মাকে একটি চাকুরী পাওয়ার জন্য আবেদন করে চিঠি লিখব বলে মনস্থির করলাম, কারণ আমার তখনকার সেই পারিপার্শ্বিক ব্যবস্থা, আমার মায়ের অসহায় অবস্থায় একমাত্র অভিভাবক হিসেবে অবুঝ ও অজান্ত মনেও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপরই নির্ভর করেছিলাম। কিন্তু তখন আমি এতটাই ছোট যে চিঠি খানি পর্যন্ত ভালো করে লিখে উঠতে পারিনি, সেইদিন গুলোতেই বোধহয় মনে হয় আমার আবোধমনে প্রথম রাজনীতির সাথে পরিচয়। সেই কবেকার মনের কথা মনেই রয়ে যেত যদি না আজ আপনাদের সাথে ভাগ না করতাম।
সময় গতির ঢেউ এ দিন গড়িয়ে গেল আর সেই মনের কোনের চাপা আবেগই হয়ত অষ্টম শ্রেণীতে “সিভিক্স” অর্থাৎ “পৌরবিজ্ঞান” নামক বিষয়টির প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করে ছিল, যা হোক কিছু দিন পড়ার পর আমি ওই বিষয়টির মাথামুণ্ডু কিছুই আমার মগজে প্রবেশ না করাতে পেরে ষাণ্মাসিক পরীক্ষার ঠিক একমাস আগেই “সিভিক্স” এর বদলে সংস্কৃত নিয়ে নিলাম ও বাংলা ও ইংরেজির মত আমি সংস্কৃতকেও খুব ভালোবেসে ফেললাম । তাই “রাজনীতির পাঠ” আর আমার হয়ে উঠেনি। আরও পড়াশোনা করার অদম্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, পারিবারিক কারণেই আর্থিক অনটনের জন্য আর কেন্দ্রীয় সরকারী চাকুরী পেয়ে যাওয়ায়, মায়ের ইচ্ছানুসারে “হাতের লক্ষ্মী পায়ে না ঠেলে” কলেজের পাট শেষ করতে করতেই সরকারী চাকুরীজীবী হয়ে গেলাম। আমার বিভাগে যোগদানের প্রথম দিন থেকেই দুয়েকজন বরিষ্ঠ সহকর্মীরা আমায় সব ব্যাপারে খুব সাহায্য করেছেন, প্রায় তিনমাস ভিনরাজ্যে চাকুরিগত প্রশিক্ষণে ছিলাম, সেখানেও আমাকে পারিবারিক কারনে একাই যাওয়া আসা করতে হয়েছে, উনারা সব সময় আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন, এবং স্বাভাবিক ভাবেই উনারা আমার আস্থাভাজন হয়ে উঠেন ও আমিও উনাদের উপর কিছুটা নির্ভরশীল হয়ে পরি। উনাদের পরামর্শ মতই আমি আমার বিভাগেই বিএমএস নামক এক ইউনিয়ন এর সদস্য পদের জন্য সমস্ত কাগজপত্রে সই করি কিন্তু তা আমি বিভাগে যোগদানের প্রায় ৪/৫ মাস পরে জানতে পারি । কারণ আমাদের বিভাগের ট্রেড ইউনিয়ন পদ্ধতি ও ওদের কর্মকাণ্ডের কোন জ্ঞান আমার ছিল না। পরবর্তী সময়ে শিলচর শাখায় যোগদানের পর জানতে পারি এই বিভাগে তিনটি ইউনিয়ন আছে, বিএমেস, এনএফপিই ও এফএনপিও । ওদের মধ্যে নীতিগত কোন তফাত আছে বলে আজ অব্দি আমার বোধগম্য হয়নি। তাই আমিও কোন দলে আছি তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি। আসল কাজের সময় কাছাড় ডিভিশনের তিনটি ইউনিয়নই প্রকৃতপক্ষে নিষ্ক্রিয়। কাজেই এই তিনের কোন ভেদাভেদ আমি বুঝতে পারিনি বা বলতে পারেন এখানেও আমার রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতাই দায়ী। ঠিক রাজনৈতিক নেতাদের মত আমাদের বিভাগের বেশীরভাগ ইউনিয়ন নেতাদেরও কাণ্ড কারখানা দেখে ও কথাবার্তা শুনে আমার তো প্রথমে চোখ চড়ক গাছে, তারপর দিনে দিনে রাগে গা রিরি করতে শুরু করল, মানে বুঝতে পারতাম, সহ্য শক্তি কমে আসছে। পরিবারের কেউ কোন দিন কোন কিছুতে বাধা না দিলেও ছোটবেলা থেকেই খুব রক্ষণশীল ভাবেই বড় হয়েছি, কিন্তু চিন্তাধারায় কোন রক্ষণশীলতা পরিবার থেকে পাইনি, কথাবার্তা অমায়িক ভাবে বলা, পোশাক-আশাক, চলা-ফেরা, সব কিছুতে আমার মায়ের শিক্ষার আঁচ পেতাম। মা বলতেন “কয় জন বড় না সয় জন বড়” । ছোটবেলা অন্যদের ঝগড়া শুনলে বা দেখলে আমি ভয়ে চিল চীৎকার করতাম। সেই আমির স্বভাব একটু একটু করে বদলাতে শুরু করল। অফিসে ৮ ঘণ্টার জায়গায় ৯/১০ ঘণ্টা কাজ করতে হত, আমি কথা কম বলতাম, তাই হয়ত ভাবত কিছু বোঝে না, আমি দেখতাম, অনেকে আড্ডা মারছে, ঘুরছে, পান খাচ্ছে, বড় বড় কথা বলছে, ফোনে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে, কিন্ত প্রশাসনিক স্তরের কারও কিছু যায় আসে না, যে কাজ করে না তার জন্য কোন কাজ না করলেও কোন সমস্যা নেই ,কারণ ওদের মতে ও তো কাজ করে না ওকে বাদ দাও, যে করছে তাকে আরও চাপ দাও ,করে নিতে পারলে আরও দায়িত্ব বাড়িয়ে দাও, আর যারা করছে না ওদের জন্য শুধু মাস শেষে মাইনেটুকু দিয়ে দাও। এক দেড় বছর এগুলো দেখে দেখে আমার মাথা খারাপ হবার জোগাড়, ইতিমধ্যেই আমি স্পন্ডেলাইটিস নামক রোগের কব্জায় চলে এলাম। এরই মধ্যে একদিন অফিসে কাজের ফাঁকে একটু দুপুরের টিফিন খেয়ে একটু শ্বাস নিচ্ছিলাম, আর মনে মনে ভাবছিলাম যে কি পাপ করেছিলাম, যে আমাকে সরকারী চাকুরে হতে হল, মনে মনে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সবার শ্রাদ্ধ করছিলাম, এত কষ্ট করে পড়াশোনা করে কিছুই যে আমার মাথায় মঠ উঠাতে পারল না কেন,... সেই সব হাবিজাবি ভাবছিলাম ..... আমার সমস্ত স্বপ্ন আস্তে আস্তে ভেঙ্গে চুরমার, ইচ্ছে ছিল পড়ব আর শুধুই পড়ব...কোনদিন থামব না, সেই আমাকে মাঝ রাস্তায় থেমে পড়তে হল, ভীষণ নিরাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম, মনের গতি তো ...এক এক সেকেন্ডেই আমার মনের সৌরমণ্ডলে পাই পাই করে ঘুরছিল, ঠিক সেসময়ই আমাদের বিভাগের এনএফপিই-র (National Federation of Employees Union)একজন নেতা যিনি সারাদিন পান চিবোন, নিজের চেয়ারে থাকেন না, আর আমাদের বিভাগের নিম্নস্তরের কর্মচারীরা কোন দরকারে অনুনয় বিনয় করতে আসলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন, উনি আবার সবজান্তা, লাল মানে বামপন্থি ইউনিয়ের নেতা হিসেবে নিজেকে ও লাল রঙেই project করেন , সব দেখে শুনে এতদিনে আমার যা উপলব্ধি...যে মাসের শেষে বিনা কাজে মাইনে গুনা আর উস্তাদি করার জন্যই উনার নেতা রূপে আত্মপ্রকাশ...যা হোক আমাকে দেখেই ভাল মন্দ জিজ্ঞেস করতে করতে কথায় কথায় বললেন উনি এখন সিনেমা গিয়ে কি একটা নাচে গানে ভরপুর সিনেমার নাম বললেন ঠিক মনে আসছে না এখন, সেটি দেখতে যাচ্ছেন, আমি দেখেছি কি না জানতে চাইলেন। শুনেই ঝাঁ করে মাথায় মনে হল রক্ত চড়ে গেল, জিজ্ঞেস করলুম,----“মম্মো” , “একদিন আচানক” , “মেঘে ঢাকা তারা” , “The Birds,” “The Roots”, “War and Peace”, “Mirracle Still Happens” ......দেখেছেন ? আমি আপনার মত অফিস ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখি না, আর কোথায় আপনি মশাই সবার থেকে বেশী কাজ করবেন না সারাদিন খালি এদিক ওদিক করেন...আপনার থেকে আমরা ছোটরা শিখব না আপনি শিখবেন কোনটা......একটু মুচকি হেসেই কথাগুলো বলছিলাম,...উনি প্রথমে হাঁ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথা গুলি শুনলেন তারপর বললেন ...তোমাকে তো দেখলে বোঝা যায় না তুমি তো অন্যরকম...আমি বললাম হ্যাঁ আমি আমার মতন...এই বলে নিজের জায়গায় গিয়ে আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলুম। কথাগুলি বলে মনে হচ্ছিল মনের আগুনের জ্বালায় কিছুটা জল ঢেলেছি, অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছিলাম….. একেই বোধহয় বলে “Outburst” ... “মনের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির লাভাক্ষরন...” । এই যে এই মুহূর্তের আবোলতাবোল কাগুজে কচকচানিও কোথাও যেন তথাকথিত রাজনীতির থিয়েটারের এক একটি দৃশ্যের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে তাই না। আমি আবার সেই “রাজনীতি” নামক শব্দের ঘোলা থকথকে ঘন কাঁদা মেশানো বেনো জলের তোড়ে আমার ভাবনার স্রোত থেকে উৎপাটিত হয়ে যাচ্ছি যেন। কিন্তু আসলে কি রাজনীতি মানেই “নোংরা নীতি” ...রাজনীতি মানেই কি “অরাজকতা”, ...রাজনীতি মানেই কি “দুর্নীতি”...... রাজনীতি মানেই কি “তেলা মাথায় তেল দেওয়া”... রাজনীতি মানেই কি “মোসাহেবি” ...... রাজনীতি মানেই কি “গুন্ডারাজ”... রাজনীতি মানেই কি “ডাল মে কুছ কালা হ্যায় ”...... রাজনীতি মানে কি “শুধুই দলাদলি-দলবাজি” ... রাজনীতি মানেই কি “স্বজন পোষণ”...... রাজনীতি মানেই কি “ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ”...... রাজনীতি মানেই কি “ সাধারনের নাগালের বাইরে সবকিছু”...... রাজনীতি মানেই কি “শুধুই অনিয়ম”... “রাজনীতি মানেই কি “শুধু কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি একে অপরের প্রতি...”...রাজনীতি মানেই কি “ নাক সিটকানো -ভুরু কুঁচকানো”...রাজনীতি মানেই কি আমাদের জন্য শুধুই “থিয়েটার” আর আমরা শুধু ক্ষণিকের দর্শক...”।
না না আমি এভাবে ভাবতে আর পারছি না, মন সায় দিচ্ছে না, মাথাটা যেন ঝিমঝিম করছে, আমি বোধহয় আবার দ্বিধাগ্রস্ত –confused হয়ে যাচ্ছি। আমাকে আবার একটু সময়ের জন্য থামতে হবে, প্রান ভরে শ্বাস নিয়ে আমার ভাবনার গতি পথ বদলাতে হবে। উপরোক্ত কথাগুলি আপনাদের মূল বিষয় থেকে আলাদা মনে হলেও হতে পারে কিন্তু আজকে যখন “থিয়েটারে রাজনীতি ও রাজনীতিতে থিয়েটার” নিয়ে আমার সাথে আমার আলাপচারিতা ও অনুসন্ধান আপনাদের সাথে সরাসরি ভাগ করে নিচ্ছি ......তখন কখনও যেন মনে হচ্ছে... আমি ও বিশেষ করে আমার মন হচ্ছে নদীর পারের জলের মত..অনবরত দুলছে ....এই মনে হচ্ছে পার ছুঁয়ে ফেলেছি আবার পরক্ষনেই মনে হচ্ছে আমার মন আবার মাঝ নদীতে...... কখন যে কোন বিষয় কোথা থেকে এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে... কি যেন এক অদৃশ্য সূক্ষ্ম সুতোয় জুড়ে আছে আমার আশপাশ চতুর্দিক। সব কিছু মিলেমিশেই আমি আর এই আমিরও পরিবর্তন হচ্ছে অনবরত যা কেউ বুঝতে পারি না... বিজ্ঞানের ভাষায়—“ Nothing is constant in this world”…এই জগত পরিবর্তনশীল......আর আমরা সবাই যেহেতু এই জগতের জাগতিক বস্তু......আমাদেরও পরিবর্তন চলছে...তাই আমরা সবাই আমাদের জন্ম, মৃত্যু, বেড়ে উঠার আবর্তে জড়িয়ে আছি...। কিছুদিন পরেই বিকেলে আমার অফিসের রুমে আমার সাথে দেখা করতে কয়েকজন ভদ্রলোককে নিয়ে উপরোক্ত নেতা সহকর্মী উপস্থিত হলেন...আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ওদের সাথে......। বললেন ...উনারা একজন অন্যরকম মেয়ের সন্ধান করছেন যে ওদের সাথে কাজ করতে পারবে। সেই শুরু, আমি আস্তে আস্তে এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করলাম, বলতে পারেন উনারা এসে আমাকে সেই পথ দেখিয়ে দিলেন...। অনেকের সাথে পরিচয় হল.............. সবার সাথে নানা থিয়েটার কেন্দ্রিক কাজে জড়িয়ে পরলুম, ......বিশেষ করে রাহুল দাসগুপ্তের অভিভাবকতায় ......ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শিলচর শাখার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেলাম। এদের মাঝে এসে আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম,.......ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সংস্পর্শ আরও পরিবর্তন আনল আমার মধ্যে ..আমার নাগরিক সচেতনতা বোধের পরিধি,.........নিজেকে প্রকাশ করার বিধি ...সামাজিক দায়বদ্ধতা, আমার ভালো লাগা - খারাপ লাগা, নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করা ও সাংগঠনিক পরিচালনামূলক কাঠামো... ইত্যাদি নানা বিষয়ের অ আ ক খ শিখতে শুরু করলাম। আমি আমার পরিবার ও অফিসের গণ্ডি পেরিয়ে নতুন শহরে অজানা ও অচেনা মানুষের মাঝে এক নতুন আমিকে খুঁজে পেলাম। বিভিন্ন ধরণের নাটকের চরিত্রে অভিনয় করতে শুরু করলাম, সাথে গান , কবিতায় , লেখায় বিভন্ন সমাজ সচেতনতা প্রক্রিয়ার ক্রিয়া বিক্রিয়ায় এক অন্য আমিকে পেলাম, সেই আমি আর আগের মত নিরাশ হয় না, নিজেকে একা অসহায় ভাবে না, অনেক বেশী সাবলীল, সাহসী, উদ্দীপ্ত, ও আশার-প্রত্যাশার স্বপ্নের বেড়াজালের প্রায়শই বিচরণ করে.....এই যে পরিবর্তন......আমার মধ্যে...যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে যুঝার জন্য প্রস্তুত করার জন্য এন্টিবায়োটিকের মত কাজ করেছে, আমার চারপাশের “থিয়েটারে রাজনীতি” ...... যেখানে আমি পাঠ পেয়েছি সাধারণ মানুষের রাজনৈতিকসত্বাবোধের......এই মানসিক পরিবর্তন এক দিনে হয় না, তার জন্য দায়ী পারিবারিক পরিমণ্ডল......গুনগত শিক্ষা..... পারিপার্শ্বিক আবর্ত ....আর জরুরী ... “Sense of Displacement.” মাত্র ২/৩ মাস আগে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সফররত সময়ে শিলচরের নাট্যবোদ্ধাদের সাথে আড্ডায় এক সন্ধ্যায় বিখ্যাত নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, চিত্র পরিচালক ও আরও অনেক গুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব শ্রীমহেশ দাত্তানির কথা শুনছিলাম......বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে উনি বলছিলেন......... “ a sense of displacement is very necessary for some creative and positive thinking and that sense of displacement from his mother Language....his home town...and many more things gave him that power to outburst causing outbreaking of Theatre activities.” কথাগুলি শুনে আমার ভীষণ ভাল লেগেছিল, মনে হয়েছিল বোধহয় আমরা এক পথেরই পথিক।
আসলে থিয়েটার কী ও কেন করি সেই প্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম, যে যদিও থিয়েটার একধরনের বিনোদন মূলক অনুষ্ঠান তবুও আমরা এ অঞ্চলের বেশীরভাগ নাট্যদল ও নাট্যকর্মীরা এই অঞ্চলের পিছিয়ে পড়তে পড়তে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থার উত্তরণের পথে একটু আশার আলো দেখাতে প্রদীপের ভূমিকা গ্রহণ করে থাকি। তাতে যা মনোরঞ্জন হয় বাকিটুকু হচ্ছে আমাদের প্রতিবাদ , প্রতিরোধ ও আমাদের বিরোধের ভাষা আমাদের থিয়েটার। ইতিমধ্যে আমি আঁচ করতে পারলাম , অনেকেই আমাকে বামপন্থী, বলে শুধু ভাবা নয় সরাসরি অনেক প্রশ্নও করতে শুরু করে দিল। কিন্তু আসলে তো আমার কাছে ডান ও বাম বলে কোনদিনও রাজনৈতিক ভাবে কোন কিছুই সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। তাই অনেকের এই ধরণের উক্তি গুলো আমার কাছে কিছুটা উটকো মনে হত এবং আমিও যারপরনাই বিরক্ত হতাম। আমি ভাবতাম আমি নাটক করছি , আলোচনা সভায় যোগদান করছি, যে সব অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করছি, তাতে আবার সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেস কি? একদিন রবিবারের সকালবেলা... টিং টং...টিং টং...ফ্ল্যাটের দরজার কলিংবেল বেজে উঠল, খুলে দিতেই দেখলাম পাশের ফ্ল্যাটের দাদা, ভেতরে এসে বসতে বসতেই বললেন... “ কিতা ,...তুমরা তো পারলায় না... কুনু কামের না তুমরা...” ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না কি বলতে চাইছেন, আমি প্রশ্ন বোধক চিহ্ন মুখে নিয়ে ভেতরে গিয়ে আমার পতি দেবকে বললাম দাদা এসেছে...ও সঙ্গে সঙ্গে ড্রয়িং রুমে চলে এল...শিলচরে এলে রবিবারে মাঝেমধ্যে ওরা আড্ডা দেয়, ...আমার কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে বোধহয় ...একটু পরে উনি আবার বললেন... “ কিতা ...পারলায় না তো ইবারও... কুনুবার পারতায় না....আমরার তো ১৫ এর মধ্যে ১৩ জনেই পাই লাইল”...... যেই ১৫ ও ১৩ সংখ্যাটি শুনলাম, বুঝেগেলাম শুনি আসামের নির্বাচনী ফলাফলের কথা বলছেন, গত নির্বাচনে আসামের মুখ্য মন্ত্রী তরুণ গগৈ বলেছিলেন যদি কাছাড় উনাকে ১৫ জনই বিজয়ী বিধায়ক দিতে পারে উনি কাছাড়কে হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ দেবেন। গতবার ১৫ টি আসনের মধ্যে ১৩ টি কংগ্রেস জিতেছিল, সেবার ভোটের আগে শুধু ভোটের আগে বললে ভুল হবে প্রকৃত পক্ষে সারা বৎসরই আমরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই অঞ্চলের বঞ্চনা, যন্ত্রণা, ভাষা আগ্রাসন, এই অঞ্চলের প্রতি উদাসীনতার কথা, অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া মূল্য, অচল যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্রডগেজ, মহাসড়ক ইত্যাদি নানা সামাজিক উন্নয়ন মূলক কাজের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করা হয় এবং আমি এই সব কাজে যতটুকু সম্ভব সক্রিয় ভাবে যোগদান করি। তো যেহেতু আমি এই সব কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকি তাই উনি ধরে নিয়েছেন আমি এখন সিপিএম এর মানুষ। কথাটা শুনেই কেন জানি না সেদিন খুব চটে গেলুম। চটে গেলাম বললেও ভুল হবে আসলে ক্ষেপে গেলুম। আসলে তো আমি কখনও নিজেকে বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী বলে ভাবিনি, আমার অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব ছিল , স্বতন্ত্র ছিল, হ্যাঁ হতে পারে আমার চিন্তা ধারার সাথে উনি বাম রাজনীতির মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন। বললুম ৫০ বৎসর ধরেই তো কংগ্রেসের শাসন চলছে, এখনও কিছু হল না , এবারও তাই হবে “ঘোড়ার ডিম” । এবং সত্যি আজও এক টাকার প্যাকেজ আসেনি, তাতে কোন অসুবিধা নেই , পরবর্তী নির্বাচনেও ওরাও গরিষ্ঠতা পাবে নিশ্চিত। আসলে আমি তখনও জানি না যে আমার কথাবার্তা কিছুটা হলেও বামঘেষা, যাহোক খুব ঝাড়লাম উনাকে আমাকে কথার বর্ষণ ধারায় , নানা কথা বলে একেবারে প্রায় উত্তেজিত হয়ে পড়লুম আর কি? কিন্তু আমি একটা জিনিস স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম আমাদের সমস্ত কার্যকলাপকে এমন কি আমাদের থিয়েটারের বিষয় বস্তু , চরিত্রের বিশ্লেষণকে অনেকেই বাম নীতির ছোঁয়া বলে মনে করতে শুরু করলেন।
গভীর ভাবে ভাবতে শুরু করলাম, তাহলে কি যা কিছু চিন্তা ধারা, কার্যকলাপ, যা সবার সুবিধার জন্য, জনগনের জন্য, যে সব মানুষ শুধু মাত্র নিজের পরিবারের গণ্ডির বাইরে বেড়িয়ে পাড়া প্রতিবেশী, শহর ও সমাজের বৃহত্তর অংশের কথা ভাবে, নিজের পরিবারের অংশ বলে মনে করে ওরাই বামপন্থী, ওটাই কি তাহলে বাম মানসিকতা, যে একের মধ্যে নয় রৌদ্রের ছটার মত সবাই কে সমান উত্তাপের অনুররণ করাতে চায়। তখন থেকেই খুঁজছি আর খুঁজছি, ...... নিজেকে বোঝাতে পারছি না “রাজনীতি” র অর্থ ...... তাহলে কি “রাজনীতি” মানে “রাজার নীতি”, রাজা একটি রাজ্যের সর্বোচ্চ পদ, রাজার নেতৃত্বে রাজ্যের প্রজাদের সুখ সমৃদ্ধির জন্য যে রীতি নীতি নির্ধারণ করা হয় তাই কি রাজনীতি ? যে নীতি সবচেয়ে উৎকৃষ্ট যে নীতি দেশের জনসাধারণের জন্য, একটি রাষ্ট্রকে সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য ব্যবহার হয় তাই কি রাজনীতি ? তাহলে কি রাজার মত “ রাজনীতি” হচ্ছে একটি সমাজের, একটি দেশের , যে কোন একটি শাসন ব্যবস্থার জন্য প্রণীত সর্বোচ্চ নীতি যা দেশের ও জনগণের উন্নয়নের জন্য ব্যবহার হয়। তাহলে আমার সংজ্ঞায় “রাজনীতি” কি দাঁড়ালো? মনে হচ্ছে চলতে চলতে আমি কোন এক মোড়ে পৌঁছে গেছি, যেখানে একটু একটু আমার স্বল্পজ্ঞানে কোথাও রাজনীতির অস্পষ্ট আদল কি দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে বোধহয়, আরও একটু মনোযোগ দিয়ে দেখি হ্যাঁ , সত্যি তো আমি কিছুটা হলেও দেখতে পাচ্ছি কি আসল “রাজনীতি” র ছবি ? কিন্তু এখন তো সেই রাজতন্ত্র নেই, তাই রাজনীতির সংজ্ঞা ও কি বদলে গেছে। এখন কি আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে ? না কি আসলে আমাদের এখন কোন রাজাই নেই , নেই কোন নীতি ও ... তাই বোধহয় বদলে গেছে আজকের পরিপ্রেক্ষিতে “রাজনীতি”র সংজ্ঞা ও । আজ রাজনীতি পরিণত হয়েছে, প্রহসনে, নিকৃষ্ট নীতিতে যে নীতি শুধুই স্বেচ্ছানীতি-স্বার্থ নীতির কথা বলে, যে নীতি শুধুই দ্বন্দ্ব – আর বিভেদের কথা বলে।
বেশ কয়েক বছর আগে, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ শিলচর শাখার উদ্যোগে , “জনম –( জন নাট্য মঞ্চ) নাট্য দল শিলচর এসে পৌঁছুল, কয়েকদিন ধরে সমস্ত শিলচর সহ বরাক উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে ওদের নাটকগুলি পরিবেশন করলেন। বিভিন্ন নাট্য বোদ্ধা ও এই অঞ্চলের সাধারন জনতা তাদের পরিবেশনা শুধু মাত্র উপভোগ করলেন বললে ভুল হবে, একাত্ম হয়ে গেলাম। আমিও সেই প্রথম ওই ধরণের অভিনয় ও নাটক ও পথ নাটক দেখতে পেলাম, অনেক কিছু শিখতে পেলাম। ওরা যা বিশ্বাস করে, যে অবস্থায় দেশের ৮০ শতাংশ জনগণ দিন কাটাচ্ছে, তাঁদের রাজনৈতিক শিক্ষা ও অধিকারবোধ জাগ্রত করার এক সফল প্রয়াস বলে মনে হল। ওরা সরাসরি দেশের আর্ত সামাজিক ব্যবস্থা, ও তার জন্য দায়ী রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল গুলোকে বেছে নিয়েছিল, এবং সেই সাথে ওরা স্বীকার করে নিয়েছে ওটাই ওদের আজীবন ব্রত, ওদের নাটক কথা বলে বাম রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষে এবং তাতে কোন ইনিয়ে বিনিয়ে বলার পদ্ধতি ওদের ছিল না । ওরা সরাসরি বলেছিল, আমরা বাম রাজনৈতিক দলগুলির জন্য কাজ করি, নির্বাচনের আগে ওদের নাটকের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার অভিযানে ওরা অংশ গ্রহণ করেন। প্রয়াত সফদর হাসমীর পত্নী মলয়শ্রী হাসমী ও সুধন্য দেশপাণ্ডের নেতৃতে , নিউজিল্যান্ডের একজন অভিনেতা ও আরও কয়েকজন এর অভিনয়ে এবং ওদের যেখানে সেখানে রাস্তায় ঘাটে মোড়ে বাজারে ওদের বিন্দাস পরিবেশনা, সত্যি যাদের নাগরিক সচেতনতা, অধিকার বোধের পাঠের নুন্যতম যে শিক্ষা জরুরী , তার কিরন ছিটিয়ে দিয়েছিল। “জনম” এর সংস্পর্শ আমাকে কিছুটা হলেও “ থিয়েটারে রাজনীতি” র আভার ছোঁয়া দিয়েছিল। খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে মেকআপ ছাড়া, কোন নির্দিষ্ট মঞ্চ ছাড়া সাধারনের মাঝখানে শুধু মাত্র বাচন ভঙ্গি, ও বিষয় বস্তুর গভীরতায় ছোঁয়া ওদের নাটকে পেয়েছিলাম, উনারা বলছিলেন “ হাম নাটক করতে দর্শককে লিয়ে দর্শক কে বিচ মে...উনতক পহুচনা হামারা কাম হ্যায় ”। ২০১২ এর অগাস্টে হঠাৎ একদিন ফেসবুকে দেখলাম ধর্মনগরে নাটকের কর্মশালা হচ্ছে, নাটকের কর্মশালা শুনলেই আমার কি রকম জানি একটা তীব্র ইচ্ছে হয়... মনে হয় ইসস...আমিও যদি যেতে পারতাম, যদিও সময় ও সুযোগে হয়ে উঠে না। সেদিন ও ইচ্ছে হল।
আমার চোখ পড়ল শিলচর এর স্বনামধন্য নাট্যকর্মী সুব্রত ভট্টাচার্য ও ধর্মনগরের মণিদীপ দাস এর কথোকপন এর উপর । মণিদীপ দাস লিখেছে বরাকের নাট্য কর্মীদেরও সাথে নিয়ে ওরা কর্মশালায় কাজ করতে চাইছে। ফোন নাম্বার দেওয়া ছিল যোগাযোগের জন্য। আমি মণিদীপ এর সাথে কথা বললাম, ভীষণ ভাবে আমন্ত্রণ জানালো ,খুশী হল বলল দিদি চলে এসো তোমার ভালো লাগবে। আমাকে প্রবীর গুহের ফেসবুকের ঠিকানায় বিস্তারিত সব জেনে নিতে বলল। কর্মশালায় যোগদানের যোগ্যতা ছিল নাট্যকর্মী হলে খুব ভালো অথবা ১৮ বছরের উপর বয়স হতে হবে। আমি যেখানে যাই সেখানে আমার একমাত্র ছেলেকে সাথে নিয়ে যাই বিশেষ করে নাটক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমি ওকে আমার সাথে জড়িয়ে রাখি। কিন্তু মণিদীপের সাথে কথা বলে বুঝলাম আমার ছেলেকে সাথে নিয়ে কর্মশালায় যোগদান করা যাবে না। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো। মনে হল এবার ও বোধহয় আমার যাওয়া হল না। তবুও আমি ফেসবুকে প্রবীর গুহের নাট্য কর্মকাণ্ডের খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম। দেখলাম উনি Alternate Living Theatre এর Director. মনে হল অন্যরকম কিছু। আর অন্যরকম কিছু হলেই আমার উচাটন আরও বেড়ে যায়। যাহোক শেষমেশ ভেবে দেখলাম, অনেক ঝামেলা, ছেলের Half Yearly Exam. , Office, তার মধ্যে শিলচর থেকে ধর্মনগরে গিয়ে ১০/১২ দিন থাকা আমার জন্য অসুবিধাজনক হয়ে যাবে। মন বেজার করেই মনকে বোঝালাম যে এবার ও আমার যাওয়া হচ্ছে না। আমিও চুপচাপ আবার নিজের মন কে বুঝিয়ে Busy হয়ে গেলাম জীবনের আবর্তে। কর্মশালা শুরু হয়েছিল ৩০ শে আগস্ট থেকে,২৭ শে আগস্ট আমাকে মণিদীপ ফোন করলো , আমি বললাম না আমি আসছি না ছেলেকে একা রেখে আসতে পারবো না । মণিদীপ বলল না দিদি চলে আসুন ছেলেকে নিয়েই আসুন কোন অসুবিধা হবে না। মনের ভেতরের চাপা ইচ্ছেটা আবার লাফিয়ে উঠল, আমার ছেলে আমার সামনে বসে ছিল, আমার সাথে যেতে পারবে শুনেই খুব খুশী হয়ে বলল হ্যাঁ মাম্মা, তুমি চিন্তা করো না, আমি পড়বো এসে পরীক্ষা দেব। যেমনি কথা তেমনি কাজ, তারপর কোনোমতে দুজনে সব কিছু সামলে, অফিস, ছেলের স্কুল সব ফেলে ধর্মনগরের জন্য রওয়ানা দিলুম ২৯ শে আগস্ট বাসে চড়ে, পৌঁছুতে পৌঁছুতে প্রায় ৪টা বাজল। যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলাম, সেখানে গিয়েই ব্যাগ-ট্যাগ রেখেই আমরা দুজনে বেরিয়ে পরলুম BBI স্কুলে , বিকেল ৫টায় শুরু হওয়ার কথা ছিল, আমরা ৫ মিনিট আগেই হাজির হলাম, কাউকেই তেমন করে চিনি না, অনেকেই উপস্থিত ছিলেন, এরই মধ্যে স্যার শ্রী প্রবীর গুহ এলেন, সাথে মণিদীপ ও এলো। এরপরই শুরু হল L.E.Society ও নাট্যমঞ্চের যৌথ উদ্যোগে সঙ্গীত নাটক একাডেমীর সহায়তায় উদ্বোধনি অনুষ্ঠান, প্রদীপ প্রজ্জলন করলেন ত্রিপুরা বিধানসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ অমরেন্দ্র শর্মা। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নাট্যকর্মী দেবব্রত চৌধুরী , নাট্যকার হৃষীকেশ নাথ এবং কলকাতা থেকে আগত “অলটারনেটিভ লিভিং থিয়েটার” নাট্য দলের নির্দেশক ও এই কর্মশালার মুখ্য প্রশিক্ষক আন্তর্জাতিক নাট্য ব্যক্তিত্ব শ্রী প্রবীর গুহ । অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন রঞ্জিত পুরকায়স্থ। স্বাগত ভাষন রাখেন নাট্যকর্মশালার আহ্বায়ক তথা নাট্য মঞ্চের সম্পাদক মণিদীপ দাস। খুব সংক্ষেপে সবাই বক্তব্য রাখলেন। সব শেষে প্রশিক্ষক শ্রী প্রবীর গুহ তাঁর বক্তৃতায় “জননাট্যের খোঁজে” শীর্ষকের ব্যাখ্যা করলেন। উনি বললেন নাটক মানেই শুধু অভিনয় নয়, নাটক মানে শুধু ভালো মঞ্চ নয়, নাটক মানে Voice for voiceless. আমার খুব ভালো লাগছিল উনার কথা শুনতে। মনে হচ্ছিল আরে...আমার ভাবনা অনেকটা মিলে যাচ্ছে তো! আরও বললেন আমরা নাটকের দর্শক তৈরি করতে পারছি না কারণ নাট্যকর্মীরা দর্শকদের কাছে পৌঁছুতে পারছিনা, তাঁর মতে দর্শকরা যদি নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন , নাটক দেখতে না চান, নাট্য কর্মীদের নাটক নিয়ে দর্শকদের কাছে পৌঁছে যেতে হবে। আর সে জন্যেই পথে ঘাটে, স্কুল কলেজে, অফিস প্রাঙ্গণে সাধারন মানুষের কাছে পৌছার মত প্রতিটি জায়গায় নাটক করতে হবে। দর্শক তৈরি করাটাও নাট্য কর্মীদেরই দায়িত্ব আর সেই দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। মূলত উনার নাট্য জীবনের গুরু বাদল সরকার। তবে উনার কিছু স্বতন্ত্র ধারা গত ৪০ বছর ধরে নাট্য চর্চার মাধ্যমে তৈরি করেছেন, আর তাই তিনি তাঁর দলের নাম রেখেছেন “অলটারনেটিভ লিভিং থিয়েটার” । বললেন আজীবন থিয়েটার করে যাবেন সেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তা পালন করছেন। খুব সাধারন পরিবেশে বড় হয়েছেন, বুঝতে পারলাম তিনি মাটিতেই আছেন, তাই মাটির মানুষ , গ্রামের মানুষ, আদিবাসী, লোক সংস্কৃতি এসব নিয়ে কাজ করছেন এবং সেই কাজের জন্য একটি ধারা ও শৈলী তৈরি করে মানুষ গড়ার মানুষ হওয়ার মানসিকতার বীজ বপন করছেন। আমার মনে হল ভাগ্যিস এসেছিলাম, না হলে তো খুব miss করতাম। খুব সুন্দর করে বললেন আমরা বিদেশী culture adopt করছি, আর উনি বিভিন্ন দেশে গিয়ে বিদেশীদের ভারতীয় নাট্য ধারার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ও কর্মশালা করছেন। আমাদের কর্মশালা শেষ করেই ১৩ই সেপ্টেম্বর জাপান যাচ্ছেন আরও একটি কর্মশালায় প্রশিক্ষন দিতে। আরও বললেন আমরা যখন নাটক করি, দর্শকদের involve করতে পারি না, তাই নাটকের চরিত্র যে রূপায়িত করছে তার সাজসজ্জা, অভিনয় , আলো মঞ্চ ইত্যাদি নিয়েই দর্শকরা বেশী ভাবে। নাটকের বিষয় বস্তু নিয়ে কিন্তু সেভাবে কেউ কথা বলে না ভাবে না বা বেশীদিন সেই ভাবনা দর্শকদের মনকে দোলায় না। আমাকে খুব ছুঁয়ে গেলো কথাটা। কারণ আমিও উনার সাথে সমভাবাপন্ন । তাই নাট্যকার বা নাট্যকর্মী হিসেবে আমাদের সেই দায়িত্ব নিতে হবে সমাজের যে ব্যবস্থা, সমস্যা, রাজনীতি, সমাজনীতি কুপ্রথা সেগুলো কে অপসারণের জন্য সমাজের সবাই কে ভাবাতে হবে। আর একটা খুব সুন্দর কথা বললেন শুনে খুব ভালো লাগলো, বললেন আজকাল বিশাল budget এর নাটক হচ্ছে, খুব সম্প্রতি নাকি NSD এক কোটি টাকার budget এর নাটক উপস্থাপন করেছে। বিশাল দামি দামি মঞ্চ, মঞ্চে গাড়ী, এমনকি বাইক ও আসতে পারছে। সেইটার বিপরীতে তিনি যা বললেন আমার দারুণ লাগলো, বললেন ওরা এক কোটি টাকা খরচ করছে, আমি এক টাকা দিয়ে করবো। দুর্দান্ত মনে হোল আমার শুনে। এই challenge গুলো জীবনে না থাকলে বোধহয় অন্যরকম কিছু করে উঠা যায় না। তাই উনাকে আমার সত্যি অর্থে একজন বড় মাপের মানুষ, দৃপ্ত ব্যক্তিত্ব ও একজন বলিষ্ঠ নাট্য যোদ্ধা বলে মনে হল। আর মনে হল আমার আসাও সার্থক হল অবশ্যই। কিছুক্ষণের মধ্যেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হল। ঠিক হল পরের দিন মানে ৩০ শে সেপ্টেম্বর সকাল ৭-৩০ থেকে ৯-৩০ ও বিকেলে আবার শুরু হবে ৫-৩০ থেকে ৭-৩০। প্রতিবেলায় ৪ জনের rotationwise বিভিন্ন group করে দেওয়া হল যারা এসে room সাফ করবে, গুছিয়ে নেবে, সাজিয়ে রাখবে artistic way তে। শুধু একটা নিয়ম মেয়েরা ঝারু দেবে না, খাবার serve করা, ইত্যাদি করবে না, ওগুলো সব ছেলেরা করবে, মেয়েরা সব সময় এই কাজগুলি ঘরে করে, তাই এই দায়িত্ব ছেলেদের দেওয়া হল। আমার ছেলে যদিও ৮ বছরের তবুও স্যার বললেন, তুমি তোমার ছেলেকে ও নিয়ে এসো। ও খুব খুশী মার সাথে নাটকের workshop করবে। পরের দিন মানে যেদিন workshop শুরু হল, ১১/১২ থেকে শুরু করে below ১৮ বছরের বয়সের প্রশিক্ষণার্থী ছাড়াও ৩৫/৪০ বছরের আরও প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন। উনি বললেন খুব POSITIVE কথা। বললেন যে কেউ , যার সদিচ্ছা আছে, আশা আকাঙ্খা আছে, নিজের কষ্ট ব্যথা বেদনার কথা বলতে চায় নিজের মত সশক্ত ভাবে বিশ্বাস করে, সেই থিয়েটার করতে পারে। আরও বললেন থিয়েটার মানেই অবিকল যে চরিত্রটি অভিনয় করছে তার নকল করতে হবে তা নয়, নতুন নতুন experiment আমরা করতে পারি। যা ইচ্ছে তাই তবে হ্যাঁ, তাতে জীবনের কথা,বাঁচার কথা, আশার কথা, আমাদের সমস্যার কথা, দুর্বলদের যন্ত্রণার কথা থাকতে হবে, তবেই আমরা থিয়েটার নিয়ে মানুষের - দর্শকদের মনকে ছুঁতে পারব। আর বললেন এখানে আমরা যা করবো সব “আমি” না “আমরা” করবো ।আমি তো মনে মনে শিহরিত হয়ে উঠছিলাম, আর ভাবছিলাম, আমার মত ভাবনা সেই বিশেষ ব্যক্তি ও ভাবেন সেই ভাবনায় পথ চলছেন বিগত ৪০ বছর ধরে, আমার মনে হল তাহলে আমিও তো সেই পথেই চলছি , সত্যি বলছি, আমার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেলো। আমার মত চলার , বলার , ভাবার ইচ্ছে আরও বলিষ্ঠ হল। আরও কিছু নিয়ম ছিল , নাটক করতে হলে ও নাটককে গুরুত্ব দিতে হবে, যারা দিতে পারবে ওরাই workshop attend করতে পারবে, এই যে নিয়মানুবর্তিতা, দৃঢ়তার পাঠ , খুব জরুরী কিন্ত । Priority টা আমাদের বুঝতে হবে, সেই বোধ টা উনি আমার মনে হয় অনেকের ভেতরে জাগাতে পেরেছেন। জোর দিলেন দৈহিক অঙ্গ সঞ্চালন, ভঙ্গি , দেহ ভাষা ও বলা যেতে পারে, যা আমাদের কথা না বলেও অনেক কিছু বোঝাতে পারে। একদম প্রথম দিন উনি শুরু করলেন হাল্কা free hand exercise দিয়ে। ৩৪ জন সবাই মিলে গোল হয়ে দাঁড়ালাম। গোল হয়ে দাঁড়ানোর কারণটা শুনে তো আমার দারুণ লাগল। গোল হয়ে দাঁড়ালে সবাই সবাইকে দেখতে পাবে। তিনটি কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ বললেন, সব সময় চোখে চোখ রেখে কথা বলতে, টানটান সোজা হয়ে দাঁড়াতে আর হাত দুটিকে এমন ভাবে রাখতে হবে ভাবতে হবে আমাদের হাত নেই, ওই প্রথম প্রথম যে জড়তা থাকে নাটকের সময় সেটা ভাঙ্গার জন্যেই হাত কোথায় রাখবো পা কোথায় রাখবো সেটাকে মাথায় রেখেই এই নিয়মগুলি আমাদের workshop এ চালু করে দিলেন। ভুলবশত যেই হাত পেছনে নিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে তার অদ্ভুত শাস্তি, হয় বাঁদরের মত নাচতে হবে, ডিগবাজি দিতে হবে, ছেলেদের নেচে দেখাতে হবে, যে গাইতে জানে না তাকেই গাইতে হবে, মানে এক কথায় শাস্তি গুলো এত মজার যে স্যারের হয়ে একে অন্যের ভুলটা ধরিয়ে দিচ্ছিল, কারণ শাস্তি পেলেই তো সবাই হিহিহি করে হেসে লুটোপুটি। আমার বেশ ভালো লাগলো কি সুন্দর করে স্যার জীবনে এগিয়ে চলার ভাবনা গুলো ও আস্তে আস্তে এই ভাবে নাটক নাটক খেলার মাধ্যমে মনের মধ্যে গেঁথে চলেছেন। তিনি প্রথমেই বলেছিলেন, নাটকে বেশী কথা বলা ভালো লাগে না, তাই কথা কম ,দেহ ভাষা বেশী ব্যবহার করতে হবে, আর অনবরত আমরা নতুন নতুন ভাবনায় আমাদের সমস্যা, আমাদের কষ্ট, আমাদের আনন্দ, আমাদের আশা, উৎসাহ গুলো কে তুলে ধরবো, আর দর্শকদের ভালো লাগবেই, আর আমাদের কাজের প্রথম দর্শক তো আমরাই। আর ও একটি খুব আমার মনের আমার বিশ্বাসের কথা যা আমি মনে প্রানে শুধু বিশ্বাস করি নয়, মেনে চলি ও যে আমি একজন পরিপূর্ণ মানুষ। উনি ও সেই কথাটি শুধু বললেন নয় প্রতিষ্ঠা করলেন, ছোট বড় সবাই যার যার মত সমভাবে ব্যক্ত করবে, ভাবের আদান প্রদান করবে এবং workshop এ প্রতিদিন সমস্ত activities এ actively involve হতে হবে এবং হলও তাই। বিভিন্ন বয়সের ৩৪ জন মিলে মিশে “আমরা” হয়ে কি করে যে ১০ দিন কেটে গেলো খেলতে খেলতে আর সবাই যে কত কিছু শিখেনিলাম তা ওখানে না গেলে বোধহয় জানতে পারতাম না। শুরু হয়ে ছিল free hand exercise দিয়ে। সেই শরীরী ভঙ্গি গুলো কে রোজ রোজ একটু একটু করে ভাবনার তুলি দিয়ে কথা সুর উচ্ছলতার রঙ দিয়ে কিভাবে সাজাতে হ্য় মাত্র ১০ দিনে তাই তিনি করে দেখালেন, শেখালেন সবাইকে। আমার সাথে একদিন workshop এর পর discussion বসেছিলেন, অনেক কথা শুনলেন, বোঝালেন , বললেন, guide করলেন। এই যে ব্যাপারটা উনি যে অন্যের মনের ভাবনাকে পড়তে পারেন , English-এ বোধহয় একেই বলে “CLAIR VOYANCE” …..এই অতিরিক্ত ভাবনা গুলোই উনাকে একজন বিশাল ব্যক্তিত্বতে পরিণত করেছে এবং আমি খেয়াল করেছি, উনি প্রথম দিন থেকেই যাদেরকে selectively point out করেছেন, শেষের দিকে কিন্তু ওরাই সবার থেকে ভালো করেছে, এবং ওরা অদূর ভবিষ্যতে কাজ করে যেতে পারবে এবং এই যে মানুষকে মানুষ গড়ার, সমাজকে সবার বাসযোগ্য করে তোলার জন্য জহুরির মত মানুষদেরকে কাজ করে তোলবার জন্য খেলার মাধ্যমে নাটকের মাধ্যমে গড়ে তোলার পদ্ধতি বা formula মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে বলতেন এগুলো হচ্ছে, Probilogy…. আমার কাছে দারুণ রোমাঞ্চকর মনে হয়েছে । উনার উপর উনারই এক ছাত্র “ দামাল” নামে একটি documentary তৈরি করেছে, আমায় বললেন তুমি দেখ, পড়ে অবশ্য সবাই কে একদিন কর্মশালায় দেখানো হয়েছিল, আমি “দামাল” দেখে চোখের জল আটকাতে পারিনি, স্যারকে বললাম, কি করে এরকম হল স্যার, আপনি যা বলছেন এখানে ওগুলো তো সব আমারও কথা। আমি সত্যি খুব imotional হয়ে পড়েছিলাম সেদিন , তবে একই সাথে আমার মনে হয়েছিল আমার ভাবনা, আমার চলার পথে , আমার আগে আগে আরও আরও অনেক আছে, আর এই সত্যটি আমাকে আরও বেশী আমার মত করে বাঁচার সাহস দিয়েছে, আমি উপলব্ধি করেছি, আমি একা নই। মনে হয়েছিল, আমাদের নাটকে , আমাদের গানে, আমাদের চলাফেরায় আমাদের রাজনৈতিক চেতনা থাকা চাই। সব কিছুতেই রাজনীতি আছে, এবং থিয়েটার করতে হলেও তার একটা রাজনৈতিক দৃষ্টি ভঙ্গি থাকবেই এবং থাকা উচিত। প্রবীর গুহের নাট্য কর্মশালায় মূলত প্রথম আমার উপলব্ধি হল যে সমস্ত নাট্য কর্মীর “থিয়েটারে রাজনীতি” র জ্ঞান জরুরী এবং এই জ্ঞানই আস্তে আস্তে বিন্দু থেকে সিন্ধুর মত আমাদের মত সাধারনের মগজে “রাজনীতি” র এক স্বচ্ছ অবয়বের ছবি ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হবে এবং এই “থিয়েটারে রাজনীতি” র পাঠের জন্য জরুরী নিয়মিত এই ধরণের নাট্য কর্মশালা , তাতে বিভিন্ন নাট্য শৈলী ধারার সাথে যেভাবে আমাদের পরিচয় হয় একই সাথে আমাদের রাজনৈতিকবোধের বীজ অঙ্কুরিত হয়। ভাল-মন্দ, ডান-বামের জানার পরিধির ব্যাপ্তি ঘটে। এই প্রকারের “থিয়েটারে রাজনীতি” ই কিন্তু “রাজনীতির থিয়েটারকে” বহুলাংশে প্রভাবিত করে ও সমাজ সংস্কারে এক অনবদ্য ভূমিকা নিতে পারে। কোন কথা না বলে তাৎক্ষণিক একটি নাটকের ঘটনার মুহূর্ত তৈরি করা এবং তাতে কোন সামাজিক পারিপার্শ্বিক বা মানসিক সমস্যা ও তার দূরীকরণ কি ভাবে দেখানো যায় , শুধু মাত্র মাথা থেকে পা পর্যন্ত isolated movement দিয়ে কিভাবে মানুষের বিভিন্ন characteristics গুলো কে বর্ণনা করা যায়, এই যে শিক্ষা গুলো সত্যি অভূতপূর্ব। ৩৪ জন আমরা যারা কর্মশালায় ছিলাম , ছোট বড় সবাইকে একদম সরবতের মতন মিশিয়ে দিতেন। বাচ্চারা একসাথে দাঁড়াবে না, মেয়েরা একসাথে দাঁড়াবে না, বলতেন এখানে ছেলে মেয়ে বাচ্চা বলে কিছু নেই, সবাই সমান , খেলতে খেলতে শেখাতে শেখাতে হঠাৎ করে ৫/৬ দল বানিয়ে দিতেন আর সময় খুব বেশী হলে ৫/১০ মিনিট , ওই সময়ের মধ্যেই একেকদিন সুর, কথা, কোন বিষয়বস্তুকে কি ভাবে উপস্থাপন করতে হবে সেই কাজ গুলো করাতেন। সব থেকে মজার ব্যাপার হল কার দলে কে আছে সব লটারি। কিছুই করার নেই কারণ স্যার ও ওভাবেই দল গড়ছেন। আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল ছোট্টরা ও পিচ্চিরা সবাই সত্যি কিন্তু বড়দের থেকেও অনেক গভীর ভাবে ভাবতে ,গড়তে ও করতে জানে। সব দল ওদের performance দেখাবে আর দর্শক ছিলাম অন্য সব দলগুলো। সবাই তক্ষুনি সবার ভালো লাগা, খারাপ লাগা , কেন, কি করে সব এক এক করে বলছে, আর মজা লাগত যে ছোটরাও কিন্ত কোন অংশে কম নেই। এই যে ছোট বড় মাঝারি মননের সবাইকে একসাথে balance করে তার পর এধরনের কর্মশালা এত উদ্যম উৎফুল্লতা, সত্যি বলতে আমরা সবাই সত্যি অর্থে “আমরা” হয়ে পড়েছিলাম। সব শেষে উনি যা করলেন তা হলও এতদিন সবাই যে যা করেছে, কেউ খুব ভালো দেহ ভাষা প্রদর্শন ও বর্ণনা দিয়েছে, কেউ বা হয়তো খুব ভালো সুর করেছে, খুব ভালো লিখেছে, হঠাৎ করে বলতেন ,যাও তোমরা সব জুড়ে দাও কিন্তু ভালো লাগতে হবে, আবার শুরু হল সেই দেহ ভাষা,সুর, কথা, নাটকের মুহূর্ত কে মালার মত গেঁথে আর একটি নতুন মালা গাঁথার খেলা। এই করতে করতেই উনি শিখিয়ে দিলেন কি করে আলাপ থিয়েটার, nonsenseথিয়েটার করতে হয়। সবাই একাত্ম না হলে কিন্তু কিছু সৃষ্টি করা যায় না, সত্যি আমরা একে অপরের সাথে মিলেমিশে নতুনের সৃষ্টির আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে থাকতাম। এই করেই চোখের নিমেষে ১০ দিন শেষ হয়ে গেল। সমাপ্তি অনুষ্ঠানের জন্য উনি বললেন আমি কিছুই করব না বলব না, সব তোমাদের করতে হবে, যদি পার তবেই কর, আমি তোমাদের সাথে আছি। শেষ পর্যন্ত তাই হলও আমরা সবাই মিলেই সমাপ্তি অনুষ্ঠানটি চিন্তা ভাবনা করে, পরিচালনা , সঞ্চালনা, অভিনয়, কথা, গান, সবই হল স্যার এঁর অভিভাবকতার আড়ালে , এবং দুর্দান্ত হয়েছিল এত কম সময়ে এই রকম অন্য ধরণের অনুষ্ঠান সত্যি মনোগ্রাহী হয়েছে এবং দর্শকরাও সমভাবে আমাদের সাথে involved হয়ে গেছিল। এই ১০ দিনে দেখলাম ও বুঝলাম স্যারের অনেক অনুগামী যারা এই ধরণের “থিয়েটারে রাজনীতি” র বোধ নিয়ে রতন থিয়াম, সুধন্য দেশপাণ্ডে ও আরও আরও অনেক বিখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্বের সাথে কাজ করছে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে নাট্য কর্মশালার আয়োজন করছে, এবং অনাম্নি ভাবে প্রচার বিমুখ হয়ে বিভিন্ন আদিবাসী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই ধরণের থিয়েটারের অনুষ্ঠান করছে, আস্তে আস্তে মানুষকে মানসিকভাবে, রাজনৈতিক ভাবে সজাগ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। জেনে খুব ভাল লাগলো আসলে “থিয়েটারে রাজনীতি” র প্রভাব কত বিস্তীর্ণ কণ্টক পথে গভীর জঙ্গলের আদিবাসীরাও ওদের মাদল ওদের গানের আমেজে মিলিয়ে মিশিয়ে সবার সাথে পায়ে পায়ে মিলিয়ে দুলে দুলে আনন্দে নাচতে নাচতে একটু একটু করে শিখছে আর সেই সাথে আমরা যারা কংক্রিটের জঙ্গলে বাস করি আমাদের চার দেওয়াল আর বোকাবাক্সের মধ্যে আমাদের পৃথিবী আবদ্ধ, ওদের কাছে গিয়ে প্রকৃতির নির্মল সহজ-সরল থিয়েটারের আনন্দ নিচ্ছি, এই যে দেওয়া আর নেওয়ার আর এক নামই থিয়েটারে রাজনীতি।
সনটা ২০১০ হবে, এপ্রিল মাস, আন্দামান-নিকবোর দ্বীপের পোর্টব্লেয়ারের মাটীতে পা দিয়েই একটু FRESH হয়ে চলে গেলাম সোজা সেলুলার জেলে। সমস্ত গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল, আমাদের আজকের এই স্বাধীন দেশ, চতুর্দিকে কেলেঙ্কারি আর কেলেঙ্কারি,দুর্নীতি, গরীব আরও গরীব, ধনী আরও ধনী, হিন্দু মুসলমান নামক হাতিয়ার ব্যবহার করে শতশত হাজার , হাজার শিশু – মহিলা গ্রাম শহর ধ্বংস , রাজনৈতিক দলগুলির প্রকাশ্যে কোন্দল,এর জন্যেই কি ওখানে এই দেশের শতশত শহীদেরা অমানুষিক পাশবিক অত্যাচার হাসিমুখে বরণ করে আত্ম বলিদান করেছিলেন । শুধু ১৫ই আগস্টে ও ২৬ এ জানুয়ারিতে কিছু দেশাত্মবোধক গান বাজিয়ে আবার সবাই যে যার মত ব্যস্ত অরাজনৈতিক কর্মে । ভীষণ খারাপ লাগছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের পরিস্থিতির সাথে আমাদের দেশের এখনকার পরিস্থিতির তুলনা করে, কালাপানির সমুদ্রের ঢেউ এর দোলায় মনটা সত্যি হুহু করে উঠলো। রাগে মনে মনে বলে উঠলুম সমস্ত রাজনৈতিক তথাকথিত নেতাদের রাজনীতিতে প্রবেশের আগে অন্তত তিনদিন এই জেলে ঐসব কুঠুরিতে কাটানো উচিত, সেই কষ্ট সেই যন্ত্রণার কণা বিন্দু যদি ওরা অনুভব করতে পারেন , “রাজনীতিতে থিয়েটার” এর দৃশ্যাবলীর কিছুটা হলেও পরিবর্তন ঘটবে। কারণ রাজনৈতিক নেতারাও তো আমাদের দেশের এক একজন বেতনভুগি কর্মচারী, তাহলে কেন আমাদের গণতন্ত্রে একটি বিশেষ পদ্ধতি, বিশেষ শিক্ষার মাধ্যম থাকবে না, শুধু ক্ষমতার লোভ ও যথেচ্ছাচারিতার আঁচড় যাতে রাজনীতির রাজে ও নীতিতে কোন ছায়া ফেলতে না পারে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রাজনীতির থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয় তার জন্য কি প্রয়াস চলছে ? এখানেই “থিয়েটারে রাজনীতি” দৃশ্যপট শুরু এবং সমাজের বিভিন্ন নাট্য কর্মী , নাট্য দল প্রতিনিয়ত নিজের গাঁটের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত একের পর এক দৃশ্যপটের সূচনা, অনুশীলন ও পরিবেশন করে যাচ্ছেন। এই প্রয়াসের এক জ্বলন্ত উদাহরণ লক্ষ্মণ ঘটক বাবু , উনার “অভিনয় ত্রিপুরা” যিনি আমার মত গবেটকে দিয়েও “থিয়েটারে রাজনীতি ও রাজনীতিতে থিয়েটারে” লিখিয়ে নিলেন, হয়ত সুদূর ভবিষ্যতে আমি সত্যি সত্যি “রাজনীতি” র অভিধানিক ও সাংবিধানিক গূঢ় অর্থ বুঝতে পারব, বা বোঝার সেই পথে প্রথম চলতে শুরু করলাম।
গত ১৫ই মে, “১৯শে র মহাপথচলা” শীর্ষক মহামিছিলের শেষে শিলচর ভাষা শহীদ ষ্টেশনে দাড়িয়ে সন্ধ্যে বেলা, “দলছুটের” পথ নাটক দেখছিলাম,নাটকটি এ অঞ্চলের মুখ থুবড়ে পড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার দৃশ্যায়ন করছিল,হঠাৎ ই দেখলাম ওপাশ থেকে চার্বাক স্যার , আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের Masscom Deptt এর প্রফেসর, বললেন কি খবর আপনার “ভালো লাগা ও ভালো থাকা” লেখাটা পড়লুম, ভালো লিখেছেন, ঘটক বাবু তো আপনাকে লেখক বানিয়ে ফেললেন, দুজনেই হেসে উঠলুম। লেখা ভালো হয়েছে শুনে সত্যি যতটা অবাক হয়েছি ততটাই ভালো লেগেছে, কথায় কথায় বললুম এবারের বিষয় ““থিয়েটারে রাজনীতি ও রাজনীতিতে থিয়েটার” তা কি যে লিখব বুঝতে পারছি না কারণ রাজনীতি তো সেরকম বুঝি না, আবার হেসে উঠলেন বললেন বলেন কি আপনি “আই.পি. টি .এ.” করেন রাজনীতি বোঝেন না । তারপর বললেন, আপনি শুধু আপনার ভাবনাটুকু লিখে ফেলুন তা হলেই হবে। আমি এখানে শুধু আমার ভাবনাটুকুই লিখলাম, হয়ত তা ““থিয়েটারে রাজনীতি ও রাজনীতিতে থিয়েটারে” র পার ছুঁতেও পারে নি। কিন্তু আমি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে , আমি যদি আমার বোধকে একটি সরল রেখার সাথে তুলনা করি তা হলে দেখতে পাই ...... সেই রেখায় দুটো অন্ত আছে, একটা ডান ও আর একটি বাম......দুটো ধরণ আছে ভালো ও মন্দ কিন্তু দুটোই একই সাথে এক সরলরেখায়। আমার বোধের গতি ও দিশা বামের দিকে অন্যদের হয়ত ডানের দিকে , সেই দিক পরিবর্তন ও গতির চলাচল বদলের জন্য নাট্যকর্মীরা, সমাজসেবীরা, NGOs.ও আরও বিভিন্ন সংস্থা “থিয়েটারে রাজনীতি ও রাজনীতিতে থিয়েটারে”র সার্বিক উন্নতির জন্য প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে.........আর এই প্রয়াসই হয়তো ভারতীয় রাজনীতির সরল রেখায় .........কংগ্রেস, বিজেপী, সিপিএম, জেডিঊ , অগপ, তৃণমূল ......ইত্যাদি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির সহাবস্থান , নীতিগত ডান ও বামের দিকে চলাচল, আমাদের বিচিত্র ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ , জৈন ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মের বর্ণের মানুষের সুযোগ্য বাসভূমি রূপে পরিণত করতে সহায়ক হবে।
সত্যি বলছি, একদম সোজা সাপটা ভাষায় অকপটে প্রথমেই স্বীকার করে নিচ্ছি রাজনীতি মানে তথাকথিত সবাই রাজনীতি বলতে যা বোঝায়... তারপর লাল সবুজ গেরুয়া নিয়ে সবার বিশ্লেষণ আমি এখনও সঠিক ভাবে মগজধঃকরণ করতে পারি না,তবুও কেন তাহলে এ বিষয়ে লিখতে বসলাম, তার উত্তরের দেখা হয়ত আমি আমার এই লেখার অন্ত পথেই পাব সেই সাহস নিয়েই আমার উপস্থিতি আপনাদের মাঝে এখানে একজন সাধারন মানুষ হিসেবে। প্রথমেই যেদিন “রাজনীতি” বিষয়টি নিয়ে ভাবলাম, আমার সেই মুহূর্তের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ যে ছবিটি আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠল, বলতে পারেন আমার মনের থিয়েটারের পর্দা সরে যাওয়ার পর পরই যে দৃশ্য ভেসে উঠল...... “সংসদ ভবনে সংসদ চলাকালীন সময়ে কিছু রাজনৈতিক নেতা যারা নাকি এই সমাজের হর্তা কর্তা বিধাতা ও আমাদের সবার ত্রাতা , কয়েকটি কেদারা মানে চেয়ার মাথার উপর উঠিয়ে ভীষণ বেগে বিপক্ষের দিকে ছুড়োছুড়ি করছেন, আর আমরা কোটি কোটি আম জনতা, টেলিভিশনের পর্দায় সেই থিয়েটারের সরাসরি সম্প্রচারন উপভোগ করছিলাম...”। আসলে এই যে দৃশ্যটি যখন আমি একদিন সত্যি সত্যি টেলিভিশনের পর্দায় প্রত্যক্ষ্য করেছিলাম, সেদিন আমি একেবারে বলতে পারেন “থ” বনে গেছিলাম, আমি ভাবতে পারছিলাম না যে এরা কিভাবে দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকতে পারে, এদের তো নিদেন পক্ষে সাধারনজ্ঞানটুকুও নেই। যাহোক আমি পরমুহূর্তেই যারপরনাই খুশী হয়ে আমার মনের থিয়েটারের পর্দা বন্ধ করে দিলাম, আর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবলাম, যাক্, এযাত্রা আর চিন্তা নেই, এই বিষয়ে আমি অনেক কিছুই লিখতে পারব, কারণ রাজনীতি মানেই তো থিয়েটার আর থিয়েটার মানেই তো রাজনীতি, তাই আমিও খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম, ভাবলাম এত বিশাল ব্যাপ্তি বিষয়টির, এতগুলি খবরের চ্যানেল চলছে... শুধুমাত্র “রাজনীতি” উপর নির্ভর করে, ওরা এত এত অনুষ্ঠান, সরাসরি অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা করছে, কত কত রমরমা, মুখরোচক খবরের খনি হচ্ছে খবরের চ্যানেল গুলি, বলতে গেলে এই সব চ্যানেল গুলোই তো মূর্তিমান “থিয়েটারে রাজনীতি রাজনীতিতে থিয়েটারের” সত্যতা প্রতিষ্ঠাতা, একদম আমাদের অন্দরমহলতক সব পৌঁছে দিচ্ছে, কজন আর থিয়েটারে গিয়ে রাজনীতির পাঠ পড়েন, সবাই টেলিভিশনের পর্দার সামনে বসেই নিজেদের Ph.D. থিসিস করে নেন। এরই মধ্যে আমার মাথার ভেতরে অনবরত মনের থিয়েটারের পর্দা খুলছে, আর আমি দেখছি আবার বন্ধ হচ্ছে আবার খুলছে আবার দেখছি ...এই প্রক্রিয়াটি বেশ কিছুদিন ধরেই আমার মধ্যে চলছে, মানে আমি উঠতে বসতে একটু অবসর পেলেই মনে মনে থিয়েটারে রাজনীতি ও রাজনীতিতে থিয়েটার... দুটোই আমার আমির সাথে নিজেই নিজের মধ্যে উপভোগ করছিলাম।
...প্রথম দৃশ্য... “সোনিয়া গান্ধী পতাকা দুলিয়ে অনেকগুলি ট্রাক ভর্তি ত্রান সামগ্রী পাঠাচ্ছেন উত্তরাঞ্চলের দুর্গতদের জন্য, ...দেখেই কেমন যেন বোকা বোকা লাগছিল হাসব কি না তাই ভাবছিলাম,...দ্বিতীয় দৃশ্যটি ছিল যেখানে গিয়ে ট্রাকগুলো দাড়িয়ে ছিল মানে ওখান থেকে আর রাস্তা নেই যাওয়া যাবে না, প্রতিবেদক ট্রাক চালকদের সাথে কথা বললেন, ওরা বলল ওদের কাছে কোন নির্দেশ নেই এখন ওরা কি করবে ... ট্রাকের ভেতরের সামগ্রীর কি হবে, আর দুদিন দাড়িয়ে থাকলে সব সামগ্রী পচে গলে নষ্ট হয়ে যাবে, ...না হেসে আর পারলাম না,... দারুণ ব্যাপার লাগছিল আমার...সোনিয়াজী পতাকা দুলিয়ে ওদের কে বিদেয় করার আগে খোঁজ নিতে ভুলে গেছেন ওদিকের রাস্তা ঘাট সমস্ত ভেঙ্গে গেছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল তাই সবাই আটকে আছেন, হাজার হাজার মানুষ ও সাথে সমস্ত পশু ও গবাদির শবের গণ সৎকারের চিন্তা করছে সেনা জওয়ানরা, উনি শুধু পতাকা দুলিয়ে দিলেন আর ক্যামেরা বন্দি করে খবরের চ্যানেলে খবর পাচার ব্যস..., তারপরে আবার রাজনৈতিক ভাবে এদেশের আপামর জনগণের জন্য মাথা বেঁধে কোমর কষে লেগে গেলেন কি করে সব রাজ্যে কংগ্রেস নামক রাজনৈতিক সংগঠনটির সদস্য সদস্যাদের রাজনৈতিক পাঠ দিতে যাতে ওরাও উনার মত শুধু পতাকা দুলানোটুকুও অন্তত ভালো ভাবে শিখে নেয়। উনি হচ্ছেন “হাই কমান্ড” ..উনার হ্যাঁ ও নার উপর ভারতবর্ষের রাজনীতি হেলদোল চলছে ও চলবে..
.দ্বিতীয় দৃশ্য ...এদিকে দুই নেতা বিমানবন্দরে হাতাহাতিতে ব্যস্ত কে আগে যাবেন বিমানে ...গিয়ে পৌঁছে জানান দিতে হবে যে উনারা কে কার আগে উত্তরাঞ্চলের দুর্গতদের পাশে দাড়িয়ে ছিলেন, ওখানে যেসব ভাগ্যবান-দুর্গতরা বিমানে চড়ে নিজেদের ঘর বাড়ি ও গন্তব্য স্থলে পৌঁছনোর জন্য অপেক্ষারত...ওরাও নিরুপায় হয়ে রাজনীতিতে থিয়েটার দেখে তারপর বিমানে চড়ার সুযোগ পেলেন। কম ভাগ্যের ব্যাপার নয় বলুন, এ রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ের তথাকথিত “রাজনীতি” র সুবাদে, এই দুর্দিনেও এরকম সরাসরি থিয়েটার উপভোগ করা যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও পশ্চিমবঙ্গে তোলপাড় চলছিল, না কি হয়েছে, “পরিবর্তন চাই”... দিদির দৌলতে আমরা অনেক নতুন ধরণের সংলাপ যা নাকি বিগত সরকার আমাদের শোনাতে পারেনি, আমরা অহরহ শুনছি, আনন্দ পাচ্ছি, ও সেই সাথে পরিবর্তনের আবর্তে ঢুকছি। সম্প্রতি আবার “মোদী” নামক অধিনায়কের চয়ন হল, খুব সামনেই রাজনীতির ফাইনাল ম্যাচ, ভারতীয় জনতা পার্টি নামক রাজনৈতিক দলের বদৌলতে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে উথাল পাথাল হয়ে গেল, রাজা বদল, সাথে সাথে পালাও বদল মানে রাজার সাথে সাথে, সংলাপ ও রাজনীতির থিয়েটার বিষয় ও অনেকটাই বদলে যায়, কি দারুন ভাবুন তো! এরকম যে হাজার হাজার বিষয়, অনেক ব্যক্তিত্ব, এতসব তো আমি লিখে শেষ করতে পারব না, কাজেই এখানেই ক্ষান্ত দিচ্ছি।
ইস্ যাঃ.. আর একজন আমার খুব প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব... উনার কথাটা এখানে না লিখলে ঠিক জমবে না, আমাদের সবার প্রিয় লালুজি, যখনই টেলিভিশনের পর্দায় উনাকে দেখি কথা বলছেন , আমি সঙ্গে সঙ্গে “স্ট্যাচু” হয়ে যাই ও খুব মন দিয়ে উনার কথা শুনি, বিশেষ করে সংসদ চলাকালীন সময়ে আমি খুব চেষ্টা করি লালুজির বক্তব্য শুনতে, অনেকটা রম্য রচনার মত মনে হয়, হিহিহি করে একটু হাসার সুযোগ পাই আমি। এই যে উপরে এত সময় “রাজনীতিতে থিয়েটার” নিয়ে হাহা ও হিহি করলাম, তাতে কিন্তু “ হাহা-হিহি” ছাড়া সদর্থক কিছুই পেলাম না । আমরা বোকার মত ভারতীয় “রাজনীতির থিয়েটারে” শুধু মাত্র নীরব দর্শক... যেসব দর্শকদের সমস্যা ও সমাধান, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয় নিয়ে ওরা ওদের থিয়েটারের সংলাপ ও বিষয় হিসেবেও ভাবে না, কিন্তু আমরা প্রতিবার, গাঁটের পয়সা দিয়ে, আমাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পারিশ্রমিক দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক থিয়েটারের দলগুলিকে বিভিন্ন রংগের জামা পরিয়ে আইপিএল এর মত ম্যাচ দেখি, ম্যাচ ফিক্সিং করি, তারপর আবার পরবর্তী ফাইনাল ম্যাচের জন্য অপেক্ষা করি। উপরোক্ত ভাবনাগুলো যখন আমার মনকে কালো ধোঁয়ার মত ছেয়ে ফেলেছে, তখন আমি কোনোমতে মুখে হাত দিয়ে দম বন্ধ করে আবার আমার মনকে খোলা আকাশের নীচে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে এলাম আর প্রান ভরে শ্বাস নিলাম। আমাকে আবার বোঝাতে শুরু করলাম, এ কি ভাবছি আমি, এত শুধু পরনিন্দা আর পরচর্চা হয়ে যাচ্ছে, কোন ভালো কথা আমি নিজেকে পর্যন্ত শোনাতে পারছি না, এ কোন রাজনীতি, এ কোন থিয়েটার, না না এসব তো আমি ভাবতে চাই না, আমি আপনাদের সাথেও ভাগ করতে চাই না, মনটা আবার একটু খারাপ হয়ে গেল, তাহলে মনে হচ্ছে সত্যি আসলে “রাজনীতি” মানেটা কি এখনও বোধহয় আমার বোধগম্য হল না। আবার ভাবতে শুরু করলাম, এবার একটু নিরাশ হয়েই ভাবছি। তখনই হঠাৎ মনে পড়ল, শব্দটি বোধহয় “রাষ্ট্রবিজ্ঞান” বা “পৌরবিজ্ঞান” । আমি তখন সবে অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছি। অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে প্রতি আমার অনুরাগ ছোটবেলা থেকেই, কিন্তু অষ্টম শ্রেণীতে একটু বাড়তি বিষয় নির্বাচন করতে হত আমাদের, তো আমি ভাবছিলাম কোন বিষয়টি পছন্দ করবো। ১৯৮২ সাল, বৈশাখ মাসের একদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গল কান্না আর হইচই শুনে, কে কাঁদছে, কি হয়েছে জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে বিছানা থেকে উঠে চোখ খুলেই জানালার পর্দা উঠিয়ে উঁকি দিয়ে ছোট্ট মেয়েটি দেখতে পেল... বাড়ির সামনে ট্রাক দাড়িয়ে আছে...আর ট্রাকটির মধ্যে মনে হচ্ছে ওর বিছানার মতই ধবধবে সাদা চাদর দিয়ে কাউকে ঢাকা দিয়ে রাখা । কৌতূহল আরও বাড়ল, কী যেন একটা অজানা ভয়ে মনটা কেঁপে উঠল, ছোট্ট মেয়েটি আর কিছু না বুঝুক এটুকু আঁচ করতে পারল একটা কিছু হয়েছে তাই, বুড়ি, কুট্টি,ঝুট্টি,সুমু, শঙ্কু আর শম্ভুদা অমন করে চীৎকার করে কাঁদছে। আরে ওই তো বাপি আর বড় পিসী মিলে ট্রাকে উঠে গেল...তারপর সবাই মিলে ট্রাক থেকে সেই ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা সেই বস্তুটি নামিয়ে উঠোনে তুলসী তলায় রেখে দিল। এবার আর কৌতূহল সম্বরণ না করতে পেরে একছুটে উঠোনে গিয়ে মেয়েটি যেই না সাদা চাদর সরিয়েছে, দেখতে পেল...আরে এত জেঠু ঘুমিয়ে আছে, কি করে এত সকালে জেঠু আগরতলা থেকে করিমগঞ্জের বাড়ীতে, আর তাও কেন উঠোনে এভাবে ঘুমিয়ে আছে, ওঠে না কেন, হঠাৎ করে কোথা থেকে মা এসে টেনে নিয়ে কানে কানে বলল, তুমি দুষ্টুমি করবে না, জেঠু মারা গেছে, তুমি পা ছুঁয়ে বসে থাকো, ছোট্ট মেয়েটি মনে মনে ভাবল দাঁত না মেজেই বসব, আশে পাশে ততক্ষণ পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই ভিড় করেছে...তাই আর রা না কেড়ে চুপটি করে বসে রইল ...... এই প্রথম মুখোমুখি মৃত্যুর সাথে আমার পরিচয় কিন্তু খুব ভালভাবে তখনও মৃত্যুকে চিনতে পারিনি ।
তারপর ১৯৮৬ সাল ১৭ই এপ্রিল, বাসন্তী পূজার মহাষ্টমীর সন্ধ্যা আরতি চলছে, ঢাক বাজছে, কাঁসর বাজছে, পয়লা বৈশাখের ঠিক দুদিন পরেই... বাপির আকস্মিক মৃত্যু... ...আমাকে মৃত্যুর আসল কদর্য রূপ চিনিয়ে দিল...... । মৃত্যু নামক ঝড়ে আমার ছোটবেলা উধাও হল ...তারপর থেকেই মাও যেন কেমন বদলে গেল...আগের মত মারে না, বকাঝকা ও করে না। মা যে এখন চাকরীর জন্য দরখাস্ত করছে......এ অফিস...সে অফিস ছুটোছুটি করছে... ডি সি র অফিস, ডি আই অফিসে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ হাঁটাহাঁটি করতে করতে ক্লান্ত বিধ্বস্ত আমার মা...না মার কোন চাকুরী হল না, একান্নবর্তী পরিবারে বসবাস করার দরুন থাকা খাওয়ার কষ্ট সেরকম হল না, পড়াশোনাও চালিয়ে গেলাম ...সাদামাটা ভাবে। অনেকবার ভেবেছি কি করলে আমাদের আর্থিক সমস্যার সমাধান হবে, আমি তখনও ছোট, মায়ের চাকুরীই সব সমস্যার সমাধান, কিন্তু কে দেবে...অনেকটা সিনেমার গল্প বলে মনে হলেও নাবালিকা অপক্ক কিশোরী মনের আবেগে আমি তখনকার প্রধানমন্ত্রীকে আমার মাকে একটি চাকুরী পাওয়ার জন্য আবেদন করে চিঠি লিখব বলে মনস্থির করলাম, কারণ আমার তখনকার সেই পারিপার্শ্বিক ব্যবস্থা, আমার মায়ের অসহায় অবস্থায় একমাত্র অভিভাবক হিসেবে অবুঝ ও অজান্ত মনেও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপরই নির্ভর করেছিলাম। কিন্তু তখন আমি এতটাই ছোট যে চিঠি খানি পর্যন্ত ভালো করে লিখে উঠতে পারিনি, সেইদিন গুলোতেই বোধহয় মনে হয় আমার আবোধমনে প্রথম রাজনীতির সাথে পরিচয়। সেই কবেকার মনের কথা মনেই রয়ে যেত যদি না আজ আপনাদের সাথে ভাগ না করতাম।
সময় গতির ঢেউ এ দিন গড়িয়ে গেল আর সেই মনের কোনের চাপা আবেগই হয়ত অষ্টম শ্রেণীতে “সিভিক্স” অর্থাৎ “পৌরবিজ্ঞান” নামক বিষয়টির প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করে ছিল, যা হোক কিছু দিন পড়ার পর আমি ওই বিষয়টির মাথামুণ্ডু কিছুই আমার মগজে প্রবেশ না করাতে পেরে ষাণ্মাসিক পরীক্ষার ঠিক একমাস আগেই “সিভিক্স” এর বদলে সংস্কৃত নিয়ে নিলাম ও বাংলা ও ইংরেজির মত আমি সংস্কৃতকেও খুব ভালোবেসে ফেললাম । তাই “রাজনীতির পাঠ” আর আমার হয়ে উঠেনি। আরও পড়াশোনা করার অদম্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, পারিবারিক কারণেই আর্থিক অনটনের জন্য আর কেন্দ্রীয় সরকারী চাকুরী পেয়ে যাওয়ায়, মায়ের ইচ্ছানুসারে “হাতের লক্ষ্মী পায়ে না ঠেলে” কলেজের পাট শেষ করতে করতেই সরকারী চাকুরীজীবী হয়ে গেলাম। আমার বিভাগে যোগদানের প্রথম দিন থেকেই দুয়েকজন বরিষ্ঠ সহকর্মীরা আমায় সব ব্যাপারে খুব সাহায্য করেছেন, প্রায় তিনমাস ভিনরাজ্যে চাকুরিগত প্রশিক্ষণে ছিলাম, সেখানেও আমাকে পারিবারিক কারনে একাই যাওয়া আসা করতে হয়েছে, উনারা সব সময় আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন, এবং স্বাভাবিক ভাবেই উনারা আমার আস্থাভাজন হয়ে উঠেন ও আমিও উনাদের উপর কিছুটা নির্ভরশীল হয়ে পরি। উনাদের পরামর্শ মতই আমি আমার বিভাগেই বিএমএস নামক এক ইউনিয়ন এর সদস্য পদের জন্য সমস্ত কাগজপত্রে সই করি কিন্তু তা আমি বিভাগে যোগদানের প্রায় ৪/৫ মাস পরে জানতে পারি । কারণ আমাদের বিভাগের ট্রেড ইউনিয়ন পদ্ধতি ও ওদের কর্মকাণ্ডের কোন জ্ঞান আমার ছিল না। পরবর্তী সময়ে শিলচর শাখায় যোগদানের পর জানতে পারি এই বিভাগে তিনটি ইউনিয়ন আছে, বিএমেস, এনএফপিই ও এফএনপিও । ওদের মধ্যে নীতিগত কোন তফাত আছে বলে আজ অব্দি আমার বোধগম্য হয়নি। তাই আমিও কোন দলে আছি তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি। আসল কাজের সময় কাছাড় ডিভিশনের তিনটি ইউনিয়নই প্রকৃতপক্ষে নিষ্ক্রিয়। কাজেই এই তিনের কোন ভেদাভেদ আমি বুঝতে পারিনি বা বলতে পারেন এখানেও আমার রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতাই দায়ী। ঠিক রাজনৈতিক নেতাদের মত আমাদের বিভাগের বেশীরভাগ ইউনিয়ন নেতাদেরও কাণ্ড কারখানা দেখে ও কথাবার্তা শুনে আমার তো প্রথমে চোখ চড়ক গাছে, তারপর দিনে দিনে রাগে গা রিরি করতে শুরু করল, মানে বুঝতে পারতাম, সহ্য শক্তি কমে আসছে। পরিবারের কেউ কোন দিন কোন কিছুতে বাধা না দিলেও ছোটবেলা থেকেই খুব রক্ষণশীল ভাবেই বড় হয়েছি, কিন্তু চিন্তাধারায় কোন রক্ষণশীলতা পরিবার থেকে পাইনি, কথাবার্তা অমায়িক ভাবে বলা, পোশাক-আশাক, চলা-ফেরা, সব কিছুতে আমার মায়ের শিক্ষার আঁচ পেতাম। মা বলতেন “কয় জন বড় না সয় জন বড়” । ছোটবেলা অন্যদের ঝগড়া শুনলে বা দেখলে আমি ভয়ে চিল চীৎকার করতাম। সেই আমির স্বভাব একটু একটু করে বদলাতে শুরু করল। অফিসে ৮ ঘণ্টার জায়গায় ৯/১০ ঘণ্টা কাজ করতে হত, আমি কথা কম বলতাম, তাই হয়ত ভাবত কিছু বোঝে না, আমি দেখতাম, অনেকে আড্ডা মারছে, ঘুরছে, পান খাচ্ছে, বড় বড় কথা বলছে, ফোনে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে, কিন্ত প্রশাসনিক স্তরের কারও কিছু যায় আসে না, যে কাজ করে না তার জন্য কোন কাজ না করলেও কোন সমস্যা নেই ,কারণ ওদের মতে ও তো কাজ করে না ওকে বাদ দাও, যে করছে তাকে আরও চাপ দাও ,করে নিতে পারলে আরও দায়িত্ব বাড়িয়ে দাও, আর যারা করছে না ওদের জন্য শুধু মাস শেষে মাইনেটুকু দিয়ে দাও। এক দেড় বছর এগুলো দেখে দেখে আমার মাথা খারাপ হবার জোগাড়, ইতিমধ্যেই আমি স্পন্ডেলাইটিস নামক রোগের কব্জায় চলে এলাম। এরই মধ্যে একদিন অফিসে কাজের ফাঁকে একটু দুপুরের টিফিন খেয়ে একটু শ্বাস নিচ্ছিলাম, আর মনে মনে ভাবছিলাম যে কি পাপ করেছিলাম, যে আমাকে সরকারী চাকুরে হতে হল, মনে মনে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সবার শ্রাদ্ধ করছিলাম, এত কষ্ট করে পড়াশোনা করে কিছুই যে আমার মাথায় মঠ উঠাতে পারল না কেন,... সেই সব হাবিজাবি ভাবছিলাম ..... আমার সমস্ত স্বপ্ন আস্তে আস্তে ভেঙ্গে চুরমার, ইচ্ছে ছিল পড়ব আর শুধুই পড়ব...কোনদিন থামব না, সেই আমাকে মাঝ রাস্তায় থেমে পড়তে হল, ভীষণ নিরাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম, মনের গতি তো ...এক এক সেকেন্ডেই আমার মনের সৌরমণ্ডলে পাই পাই করে ঘুরছিল, ঠিক সেসময়ই আমাদের বিভাগের এনএফপিই-র (National Federation of Employees Union)একজন নেতা যিনি সারাদিন পান চিবোন, নিজের চেয়ারে থাকেন না, আর আমাদের বিভাগের নিম্নস্তরের কর্মচারীরা কোন দরকারে অনুনয় বিনয় করতে আসলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন, উনি আবার সবজান্তা, লাল মানে বামপন্থি ইউনিয়ের নেতা হিসেবে নিজেকে ও লাল রঙেই project করেন , সব দেখে শুনে এতদিনে আমার যা উপলব্ধি...যে মাসের শেষে বিনা কাজে মাইনে গুনা আর উস্তাদি করার জন্যই উনার নেতা রূপে আত্মপ্রকাশ...যা হোক আমাকে দেখেই ভাল মন্দ জিজ্ঞেস করতে করতে কথায় কথায় বললেন উনি এখন সিনেমা গিয়ে কি একটা নাচে গানে ভরপুর সিনেমার নাম বললেন ঠিক মনে আসছে না এখন, সেটি দেখতে যাচ্ছেন, আমি দেখেছি কি না জানতে চাইলেন। শুনেই ঝাঁ করে মাথায় মনে হল রক্ত চড়ে গেল, জিজ্ঞেস করলুম,----“মম্মো” , “একদিন আচানক” , “মেঘে ঢাকা তারা” , “The Birds,” “The Roots”, “War and Peace”, “Mirracle Still Happens” ......দেখেছেন ? আমি আপনার মত অফিস ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখি না, আর কোথায় আপনি মশাই সবার থেকে বেশী কাজ করবেন না সারাদিন খালি এদিক ওদিক করেন...আপনার থেকে আমরা ছোটরা শিখব না আপনি শিখবেন কোনটা......একটু মুচকি হেসেই কথাগুলো বলছিলাম,...উনি প্রথমে হাঁ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথা গুলি শুনলেন তারপর বললেন ...তোমাকে তো দেখলে বোঝা যায় না তুমি তো অন্যরকম...আমি বললাম হ্যাঁ আমি আমার মতন...এই বলে নিজের জায়গায় গিয়ে আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলুম। কথাগুলি বলে মনে হচ্ছিল মনের আগুনের জ্বালায় কিছুটা জল ঢেলেছি, অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছিলাম….. একেই বোধহয় বলে “Outburst” ... “মনের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির লাভাক্ষরন...” । এই যে এই মুহূর্তের আবোলতাবোল কাগুজে কচকচানিও কোথাও যেন তথাকথিত রাজনীতির থিয়েটারের এক একটি দৃশ্যের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে তাই না। আমি আবার সেই “রাজনীতি” নামক শব্দের ঘোলা থকথকে ঘন কাঁদা মেশানো বেনো জলের তোড়ে আমার ভাবনার স্রোত থেকে উৎপাটিত হয়ে যাচ্ছি যেন। কিন্তু আসলে কি রাজনীতি মানেই “নোংরা নীতি” ...রাজনীতি মানেই কি “অরাজকতা”, ...রাজনীতি মানেই কি “দুর্নীতি”...... রাজনীতি মানেই কি “তেলা মাথায় তেল দেওয়া”... রাজনীতি মানেই কি “মোসাহেবি” ...... রাজনীতি মানেই কি “গুন্ডারাজ”... রাজনীতি মানেই কি “ডাল মে কুছ কালা হ্যায় ”...... রাজনীতি মানে কি “শুধুই দলাদলি-দলবাজি” ... রাজনীতি মানেই কি “স্বজন পোষণ”...... রাজনীতি মানেই কি “ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ”...... রাজনীতি মানেই কি “ সাধারনের নাগালের বাইরে সবকিছু”...... রাজনীতি মানেই কি “শুধুই অনিয়ম”... “রাজনীতি মানেই কি “শুধু কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি একে অপরের প্রতি...”...রাজনীতি মানেই কি “ নাক সিটকানো -ভুরু কুঁচকানো”...রাজনীতি মানেই কি আমাদের জন্য শুধুই “থিয়েটার” আর আমরা শুধু ক্ষণিকের দর্শক...”।
না না আমি এভাবে ভাবতে আর পারছি না, মন সায় দিচ্ছে না, মাথাটা যেন ঝিমঝিম করছে, আমি বোধহয় আবার দ্বিধাগ্রস্ত –confused হয়ে যাচ্ছি। আমাকে আবার একটু সময়ের জন্য থামতে হবে, প্রান ভরে শ্বাস নিয়ে আমার ভাবনার গতি পথ বদলাতে হবে। উপরোক্ত কথাগুলি আপনাদের মূল বিষয় থেকে আলাদা মনে হলেও হতে পারে কিন্তু আজকে যখন “থিয়েটারে রাজনীতি ও রাজনীতিতে থিয়েটার” নিয়ে আমার সাথে আমার আলাপচারিতা ও অনুসন্ধান আপনাদের সাথে সরাসরি ভাগ করে নিচ্ছি ......তখন কখনও যেন মনে হচ্ছে... আমি ও বিশেষ করে আমার মন হচ্ছে নদীর পারের জলের মত..অনবরত দুলছে ....এই মনে হচ্ছে পার ছুঁয়ে ফেলেছি আবার পরক্ষনেই মনে হচ্ছে আমার মন আবার মাঝ নদীতে...... কখন যে কোন বিষয় কোথা থেকে এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে... কি যেন এক অদৃশ্য সূক্ষ্ম সুতোয় জুড়ে আছে আমার আশপাশ চতুর্দিক। সব কিছু মিলেমিশেই আমি আর এই আমিরও পরিবর্তন হচ্ছে অনবরত যা কেউ বুঝতে পারি না... বিজ্ঞানের ভাষায়—“ Nothing is constant in this world”…এই জগত পরিবর্তনশীল......আর আমরা সবাই যেহেতু এই জগতের জাগতিক বস্তু......আমাদেরও পরিবর্তন চলছে...তাই আমরা সবাই আমাদের জন্ম, মৃত্যু, বেড়ে উঠার আবর্তে জড়িয়ে আছি...। কিছুদিন পরেই বিকেলে আমার অফিসের রুমে আমার সাথে দেখা করতে কয়েকজন ভদ্রলোককে নিয়ে উপরোক্ত নেতা সহকর্মী উপস্থিত হলেন...আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ওদের সাথে......। বললেন ...উনারা একজন অন্যরকম মেয়ের সন্ধান করছেন যে ওদের সাথে কাজ করতে পারবে। সেই শুরু, আমি আস্তে আস্তে এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করলাম, বলতে পারেন উনারা এসে আমাকে সেই পথ দেখিয়ে দিলেন...। অনেকের সাথে পরিচয় হল.............. সবার সাথে নানা থিয়েটার কেন্দ্রিক কাজে জড়িয়ে পরলুম, ......বিশেষ করে রাহুল দাসগুপ্তের অভিভাবকতায় ......ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শিলচর শাখার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেলাম। এদের মাঝে এসে আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম,.......ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সংস্পর্শ আরও পরিবর্তন আনল আমার মধ্যে ..আমার নাগরিক সচেতনতা বোধের পরিধি,.........নিজেকে প্রকাশ করার বিধি ...সামাজিক দায়বদ্ধতা, আমার ভালো লাগা - খারাপ লাগা, নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করা ও সাংগঠনিক পরিচালনামূলক কাঠামো... ইত্যাদি নানা বিষয়ের অ আ ক খ শিখতে শুরু করলাম। আমি আমার পরিবার ও অফিসের গণ্ডি পেরিয়ে নতুন শহরে অজানা ও অচেনা মানুষের মাঝে এক নতুন আমিকে খুঁজে পেলাম। বিভিন্ন ধরণের নাটকের চরিত্রে অভিনয় করতে শুরু করলাম, সাথে গান , কবিতায় , লেখায় বিভন্ন সমাজ সচেতনতা প্রক্রিয়ার ক্রিয়া বিক্রিয়ায় এক অন্য আমিকে পেলাম, সেই আমি আর আগের মত নিরাশ হয় না, নিজেকে একা অসহায় ভাবে না, অনেক বেশী সাবলীল, সাহসী, উদ্দীপ্ত, ও আশার-প্রত্যাশার স্বপ্নের বেড়াজালের প্রায়শই বিচরণ করে.....এই যে পরিবর্তন......আমার মধ্যে...যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে যুঝার জন্য প্রস্তুত করার জন্য এন্টিবায়োটিকের মত কাজ করেছে, আমার চারপাশের “থিয়েটারে রাজনীতি” ...... যেখানে আমি পাঠ পেয়েছি সাধারণ মানুষের রাজনৈতিকসত্বাবোধের......এই মানসিক পরিবর্তন এক দিনে হয় না, তার জন্য দায়ী পারিবারিক পরিমণ্ডল......গুনগত শিক্ষা..... পারিপার্শ্বিক আবর্ত ....আর জরুরী ... “Sense of Displacement.” মাত্র ২/৩ মাস আগে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সফররত সময়ে শিলচরের নাট্যবোদ্ধাদের সাথে আড্ডায় এক সন্ধ্যায় বিখ্যাত নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, চিত্র পরিচালক ও আরও অনেক গুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব শ্রীমহেশ দাত্তানির কথা শুনছিলাম......বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে উনি বলছিলেন......... “ a sense of displacement is very necessary for some creative and positive thinking and that sense of displacement from his mother Language....his home town...and many more things gave him that power to outburst causing outbreaking of Theatre activities.” কথাগুলি শুনে আমার ভীষণ ভাল লেগেছিল, মনে হয়েছিল বোধহয় আমরা এক পথেরই পথিক।
আসলে থিয়েটার কী ও কেন করি সেই প্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম, যে যদিও থিয়েটার একধরনের বিনোদন মূলক অনুষ্ঠান তবুও আমরা এ অঞ্চলের বেশীরভাগ নাট্যদল ও নাট্যকর্মীরা এই অঞ্চলের পিছিয়ে পড়তে পড়তে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থার উত্তরণের পথে একটু আশার আলো দেখাতে প্রদীপের ভূমিকা গ্রহণ করে থাকি। তাতে যা মনোরঞ্জন হয় বাকিটুকু হচ্ছে আমাদের প্রতিবাদ , প্রতিরোধ ও আমাদের বিরোধের ভাষা আমাদের থিয়েটার। ইতিমধ্যে আমি আঁচ করতে পারলাম , অনেকেই আমাকে বামপন্থী, বলে শুধু ভাবা নয় সরাসরি অনেক প্রশ্নও করতে শুরু করে দিল। কিন্তু আসলে তো আমার কাছে ডান ও বাম বলে কোনদিনও রাজনৈতিক ভাবে কোন কিছুই সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। তাই অনেকের এই ধরণের উক্তি গুলো আমার কাছে কিছুটা উটকো মনে হত এবং আমিও যারপরনাই বিরক্ত হতাম। আমি ভাবতাম আমি নাটক করছি , আলোচনা সভায় যোগদান করছি, যে সব অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করছি, তাতে আবার সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেস কি? একদিন রবিবারের সকালবেলা... টিং টং...টিং টং...ফ্ল্যাটের দরজার কলিংবেল বেজে উঠল, খুলে দিতেই দেখলাম পাশের ফ্ল্যাটের দাদা, ভেতরে এসে বসতে বসতেই বললেন... “ কিতা ,...তুমরা তো পারলায় না... কুনু কামের না তুমরা...” ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না কি বলতে চাইছেন, আমি প্রশ্ন বোধক চিহ্ন মুখে নিয়ে ভেতরে গিয়ে আমার পতি দেবকে বললাম দাদা এসেছে...ও সঙ্গে সঙ্গে ড্রয়িং রুমে চলে এল...শিলচরে এলে রবিবারে মাঝেমধ্যে ওরা আড্ডা দেয়, ...আমার কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে বোধহয় ...একটু পরে উনি আবার বললেন... “ কিতা ...পারলায় না তো ইবারও... কুনুবার পারতায় না....আমরার তো ১৫ এর মধ্যে ১৩ জনেই পাই লাইল”...... যেই ১৫ ও ১৩ সংখ্যাটি শুনলাম, বুঝেগেলাম শুনি আসামের নির্বাচনী ফলাফলের কথা বলছেন, গত নির্বাচনে আসামের মুখ্য মন্ত্রী তরুণ গগৈ বলেছিলেন যদি কাছাড় উনাকে ১৫ জনই বিজয়ী বিধায়ক দিতে পারে উনি কাছাড়কে হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ দেবেন। গতবার ১৫ টি আসনের মধ্যে ১৩ টি কংগ্রেস জিতেছিল, সেবার ভোটের আগে শুধু ভোটের আগে বললে ভুল হবে প্রকৃত পক্ষে সারা বৎসরই আমরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই অঞ্চলের বঞ্চনা, যন্ত্রণা, ভাষা আগ্রাসন, এই অঞ্চলের প্রতি উদাসীনতার কথা, অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া মূল্য, অচল যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্রডগেজ, মহাসড়ক ইত্যাদি নানা সামাজিক উন্নয়ন মূলক কাজের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করা হয় এবং আমি এই সব কাজে যতটুকু সম্ভব সক্রিয় ভাবে যোগদান করি। তো যেহেতু আমি এই সব কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকি তাই উনি ধরে নিয়েছেন আমি এখন সিপিএম এর মানুষ। কথাটা শুনেই কেন জানি না সেদিন খুব চটে গেলুম। চটে গেলাম বললেও ভুল হবে আসলে ক্ষেপে গেলুম। আসলে তো আমি কখনও নিজেকে বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী বলে ভাবিনি, আমার অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব ছিল , স্বতন্ত্র ছিল, হ্যাঁ হতে পারে আমার চিন্তা ধারার সাথে উনি বাম রাজনীতির মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন। বললুম ৫০ বৎসর ধরেই তো কংগ্রেসের শাসন চলছে, এখনও কিছু হল না , এবারও তাই হবে “ঘোড়ার ডিম” । এবং সত্যি আজও এক টাকার প্যাকেজ আসেনি, তাতে কোন অসুবিধা নেই , পরবর্তী নির্বাচনেও ওরাও গরিষ্ঠতা পাবে নিশ্চিত। আসলে আমি তখনও জানি না যে আমার কথাবার্তা কিছুটা হলেও বামঘেষা, যাহোক খুব ঝাড়লাম উনাকে আমাকে কথার বর্ষণ ধারায় , নানা কথা বলে একেবারে প্রায় উত্তেজিত হয়ে পড়লুম আর কি? কিন্তু আমি একটা জিনিস স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম আমাদের সমস্ত কার্যকলাপকে এমন কি আমাদের থিয়েটারের বিষয় বস্তু , চরিত্রের বিশ্লেষণকে অনেকেই বাম নীতির ছোঁয়া বলে মনে করতে শুরু করলেন।
গভীর ভাবে ভাবতে শুরু করলাম, তাহলে কি যা কিছু চিন্তা ধারা, কার্যকলাপ, যা সবার সুবিধার জন্য, জনগনের জন্য, যে সব মানুষ শুধু মাত্র নিজের পরিবারের গণ্ডির বাইরে বেড়িয়ে পাড়া প্রতিবেশী, শহর ও সমাজের বৃহত্তর অংশের কথা ভাবে, নিজের পরিবারের অংশ বলে মনে করে ওরাই বামপন্থী, ওটাই কি তাহলে বাম মানসিকতা, যে একের মধ্যে নয় রৌদ্রের ছটার মত সবাই কে সমান উত্তাপের অনুররণ করাতে চায়। তখন থেকেই খুঁজছি আর খুঁজছি, ...... নিজেকে বোঝাতে পারছি না “রাজনীতি” র অর্থ ...... তাহলে কি “রাজনীতি” মানে “রাজার নীতি”, রাজা একটি রাজ্যের সর্বোচ্চ পদ, রাজার নেতৃত্বে রাজ্যের প্রজাদের সুখ সমৃদ্ধির জন্য যে রীতি নীতি নির্ধারণ করা হয় তাই কি রাজনীতি ? যে নীতি সবচেয়ে উৎকৃষ্ট যে নীতি দেশের জনসাধারণের জন্য, একটি রাষ্ট্রকে সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য ব্যবহার হয় তাই কি রাজনীতি ? তাহলে কি রাজার মত “ রাজনীতি” হচ্ছে একটি সমাজের, একটি দেশের , যে কোন একটি শাসন ব্যবস্থার জন্য প্রণীত সর্বোচ্চ নীতি যা দেশের ও জনগণের উন্নয়নের জন্য ব্যবহার হয়। তাহলে আমার সংজ্ঞায় “রাজনীতি” কি দাঁড়ালো? মনে হচ্ছে চলতে চলতে আমি কোন এক মোড়ে পৌঁছে গেছি, যেখানে একটু একটু আমার স্বল্পজ্ঞানে কোথাও রাজনীতির অস্পষ্ট আদল কি দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে বোধহয়, আরও একটু মনোযোগ দিয়ে দেখি হ্যাঁ , সত্যি তো আমি কিছুটা হলেও দেখতে পাচ্ছি কি আসল “রাজনীতি” র ছবি ? কিন্তু এখন তো সেই রাজতন্ত্র নেই, তাই রাজনীতির সংজ্ঞা ও কি বদলে গেছে। এখন কি আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে ? না কি আসলে আমাদের এখন কোন রাজাই নেই , নেই কোন নীতি ও ... তাই বোধহয় বদলে গেছে আজকের পরিপ্রেক্ষিতে “রাজনীতি”র সংজ্ঞা ও । আজ রাজনীতি পরিণত হয়েছে, প্রহসনে, নিকৃষ্ট নীতিতে যে নীতি শুধুই স্বেচ্ছানীতি-স্বার্থ নীতির কথা বলে, যে নীতি শুধুই দ্বন্দ্ব – আর বিভেদের কথা বলে।
বেশ কয়েক বছর আগে, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ শিলচর শাখার উদ্যোগে , “জনম –( জন নাট্য মঞ্চ) নাট্য দল শিলচর এসে পৌঁছুল, কয়েকদিন ধরে সমস্ত শিলচর সহ বরাক উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে ওদের নাটকগুলি পরিবেশন করলেন। বিভিন্ন নাট্য বোদ্ধা ও এই অঞ্চলের সাধারন জনতা তাদের পরিবেশনা শুধু মাত্র উপভোগ করলেন বললে ভুল হবে, একাত্ম হয়ে গেলাম। আমিও সেই প্রথম ওই ধরণের অভিনয় ও নাটক ও পথ নাটক দেখতে পেলাম, অনেক কিছু শিখতে পেলাম। ওরা যা বিশ্বাস করে, যে অবস্থায় দেশের ৮০ শতাংশ জনগণ দিন কাটাচ্ছে, তাঁদের রাজনৈতিক শিক্ষা ও অধিকারবোধ জাগ্রত করার এক সফল প্রয়াস বলে মনে হল। ওরা সরাসরি দেশের আর্ত সামাজিক ব্যবস্থা, ও তার জন্য দায়ী রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল গুলোকে বেছে নিয়েছিল, এবং সেই সাথে ওরা স্বীকার করে নিয়েছে ওটাই ওদের আজীবন ব্রত, ওদের নাটক কথা বলে বাম রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষে এবং তাতে কোন ইনিয়ে বিনিয়ে বলার পদ্ধতি ওদের ছিল না । ওরা সরাসরি বলেছিল, আমরা বাম রাজনৈতিক দলগুলির জন্য কাজ করি, নির্বাচনের আগে ওদের নাটকের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার অভিযানে ওরা অংশ গ্রহণ করেন। প্রয়াত সফদর হাসমীর পত্নী মলয়শ্রী হাসমী ও সুধন্য দেশপাণ্ডের নেতৃতে , নিউজিল্যান্ডের একজন অভিনেতা ও আরও কয়েকজন এর অভিনয়ে এবং ওদের যেখানে সেখানে রাস্তায় ঘাটে মোড়ে বাজারে ওদের বিন্দাস পরিবেশনা, সত্যি যাদের নাগরিক সচেতনতা, অধিকার বোধের পাঠের নুন্যতম যে শিক্ষা জরুরী , তার কিরন ছিটিয়ে দিয়েছিল। “জনম” এর সংস্পর্শ আমাকে কিছুটা হলেও “ থিয়েটারে রাজনীতি” র আভার ছোঁয়া দিয়েছিল। খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে মেকআপ ছাড়া, কোন নির্দিষ্ট মঞ্চ ছাড়া সাধারনের মাঝখানে শুধু মাত্র বাচন ভঙ্গি, ও বিষয় বস্তুর গভীরতায় ছোঁয়া ওদের নাটকে পেয়েছিলাম, উনারা বলছিলেন “ হাম নাটক করতে দর্শককে লিয়ে দর্শক কে বিচ মে...উনতক পহুচনা হামারা কাম হ্যায় ”। ২০১২ এর অগাস্টে হঠাৎ একদিন ফেসবুকে দেখলাম ধর্মনগরে নাটকের কর্মশালা হচ্ছে, নাটকের কর্মশালা শুনলেই আমার কি রকম জানি একটা তীব্র ইচ্ছে হয়... মনে হয় ইসস...আমিও যদি যেতে পারতাম, যদিও সময় ও সুযোগে হয়ে উঠে না। সেদিন ও ইচ্ছে হল।
আমার চোখ পড়ল শিলচর এর স্বনামধন্য নাট্যকর্মী সুব্রত ভট্টাচার্য ও ধর্মনগরের মণিদীপ দাস এর কথোকপন এর উপর । মণিদীপ দাস লিখেছে বরাকের নাট্য কর্মীদেরও সাথে নিয়ে ওরা কর্মশালায় কাজ করতে চাইছে। ফোন নাম্বার দেওয়া ছিল যোগাযোগের জন্য। আমি মণিদীপ এর সাথে কথা বললাম, ভীষণ ভাবে আমন্ত্রণ জানালো ,খুশী হল বলল দিদি চলে এসো তোমার ভালো লাগবে। আমাকে প্রবীর গুহের ফেসবুকের ঠিকানায় বিস্তারিত সব জেনে নিতে বলল। কর্মশালায় যোগদানের যোগ্যতা ছিল নাট্যকর্মী হলে খুব ভালো অথবা ১৮ বছরের উপর বয়স হতে হবে। আমি যেখানে যাই সেখানে আমার একমাত্র ছেলেকে সাথে নিয়ে যাই বিশেষ করে নাটক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমি ওকে আমার সাথে জড়িয়ে রাখি। কিন্তু মণিদীপের সাথে কথা বলে বুঝলাম আমার ছেলেকে সাথে নিয়ে কর্মশালায় যোগদান করা যাবে না। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো। মনে হল এবার ও বোধহয় আমার যাওয়া হল না। তবুও আমি ফেসবুকে প্রবীর গুহের নাট্য কর্মকাণ্ডের খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম। দেখলাম উনি Alternate Living Theatre এর Director. মনে হল অন্যরকম কিছু। আর অন্যরকম কিছু হলেই আমার উচাটন আরও বেড়ে যায়। যাহোক শেষমেশ ভেবে দেখলাম, অনেক ঝামেলা, ছেলের Half Yearly Exam. , Office, তার মধ্যে শিলচর থেকে ধর্মনগরে গিয়ে ১০/১২ দিন থাকা আমার জন্য অসুবিধাজনক হয়ে যাবে। মন বেজার করেই মনকে বোঝালাম যে এবার ও আমার যাওয়া হচ্ছে না। আমিও চুপচাপ আবার নিজের মন কে বুঝিয়ে Busy হয়ে গেলাম জীবনের আবর্তে। কর্মশালা শুরু হয়েছিল ৩০ শে আগস্ট থেকে,২৭ শে আগস্ট আমাকে মণিদীপ ফোন করলো , আমি বললাম না আমি আসছি না ছেলেকে একা রেখে আসতে পারবো না । মণিদীপ বলল না দিদি চলে আসুন ছেলেকে নিয়েই আসুন কোন অসুবিধা হবে না। মনের ভেতরের চাপা ইচ্ছেটা আবার লাফিয়ে উঠল, আমার ছেলে আমার সামনে বসে ছিল, আমার সাথে যেতে পারবে শুনেই খুব খুশী হয়ে বলল হ্যাঁ মাম্মা, তুমি চিন্তা করো না, আমি পড়বো এসে পরীক্ষা দেব। যেমনি কথা তেমনি কাজ, তারপর কোনোমতে দুজনে সব কিছু সামলে, অফিস, ছেলের স্কুল সব ফেলে ধর্মনগরের জন্য রওয়ানা দিলুম ২৯ শে আগস্ট বাসে চড়ে, পৌঁছুতে পৌঁছুতে প্রায় ৪টা বাজল। যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলাম, সেখানে গিয়েই ব্যাগ-ট্যাগ রেখেই আমরা দুজনে বেরিয়ে পরলুম BBI স্কুলে , বিকেল ৫টায় শুরু হওয়ার কথা ছিল, আমরা ৫ মিনিট আগেই হাজির হলাম, কাউকেই তেমন করে চিনি না, অনেকেই উপস্থিত ছিলেন, এরই মধ্যে স্যার শ্রী প্রবীর গুহ এলেন, সাথে মণিদীপ ও এলো। এরপরই শুরু হল L.E.Society ও নাট্যমঞ্চের যৌথ উদ্যোগে সঙ্গীত নাটক একাডেমীর সহায়তায় উদ্বোধনি অনুষ্ঠান, প্রদীপ প্রজ্জলন করলেন ত্রিপুরা বিধানসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ অমরেন্দ্র শর্মা। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নাট্যকর্মী দেবব্রত চৌধুরী , নাট্যকার হৃষীকেশ নাথ এবং কলকাতা থেকে আগত “অলটারনেটিভ লিভিং থিয়েটার” নাট্য দলের নির্দেশক ও এই কর্মশালার মুখ্য প্রশিক্ষক আন্তর্জাতিক নাট্য ব্যক্তিত্ব শ্রী প্রবীর গুহ । অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন রঞ্জিত পুরকায়স্থ। স্বাগত ভাষন রাখেন নাট্যকর্মশালার আহ্বায়ক তথা নাট্য মঞ্চের সম্পাদক মণিদীপ দাস। খুব সংক্ষেপে সবাই বক্তব্য রাখলেন। সব শেষে প্রশিক্ষক শ্রী প্রবীর গুহ তাঁর বক্তৃতায় “জননাট্যের খোঁজে” শীর্ষকের ব্যাখ্যা করলেন। উনি বললেন নাটক মানেই শুধু অভিনয় নয়, নাটক মানে শুধু ভালো মঞ্চ নয়, নাটক মানে Voice for voiceless. আমার খুব ভালো লাগছিল উনার কথা শুনতে। মনে হচ্ছিল আরে...আমার ভাবনা অনেকটা মিলে যাচ্ছে তো! আরও বললেন আমরা নাটকের দর্শক তৈরি করতে পারছি না কারণ নাট্যকর্মীরা দর্শকদের কাছে পৌঁছুতে পারছিনা, তাঁর মতে দর্শকরা যদি নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন , নাটক দেখতে না চান, নাট্য কর্মীদের নাটক নিয়ে দর্শকদের কাছে পৌঁছে যেতে হবে। আর সে জন্যেই পথে ঘাটে, স্কুল কলেজে, অফিস প্রাঙ্গণে সাধারন মানুষের কাছে পৌছার মত প্রতিটি জায়গায় নাটক করতে হবে। দর্শক তৈরি করাটাও নাট্য কর্মীদেরই দায়িত্ব আর সেই দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। মূলত উনার নাট্য জীবনের গুরু বাদল সরকার। তবে উনার কিছু স্বতন্ত্র ধারা গত ৪০ বছর ধরে নাট্য চর্চার মাধ্যমে তৈরি করেছেন, আর তাই তিনি তাঁর দলের নাম রেখেছেন “অলটারনেটিভ লিভিং থিয়েটার” । বললেন আজীবন থিয়েটার করে যাবেন সেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তা পালন করছেন। খুব সাধারন পরিবেশে বড় হয়েছেন, বুঝতে পারলাম তিনি মাটিতেই আছেন, তাই মাটির মানুষ , গ্রামের মানুষ, আদিবাসী, লোক সংস্কৃতি এসব নিয়ে কাজ করছেন এবং সেই কাজের জন্য একটি ধারা ও শৈলী তৈরি করে মানুষ গড়ার মানুষ হওয়ার মানসিকতার বীজ বপন করছেন। আমার মনে হল ভাগ্যিস এসেছিলাম, না হলে তো খুব miss করতাম। খুব সুন্দর করে বললেন আমরা বিদেশী culture adopt করছি, আর উনি বিভিন্ন দেশে গিয়ে বিদেশীদের ভারতীয় নাট্য ধারার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ও কর্মশালা করছেন। আমাদের কর্মশালা শেষ করেই ১৩ই সেপ্টেম্বর জাপান যাচ্ছেন আরও একটি কর্মশালায় প্রশিক্ষন দিতে। আরও বললেন আমরা যখন নাটক করি, দর্শকদের involve করতে পারি না, তাই নাটকের চরিত্র যে রূপায়িত করছে তার সাজসজ্জা, অভিনয় , আলো মঞ্চ ইত্যাদি নিয়েই দর্শকরা বেশী ভাবে। নাটকের বিষয় বস্তু নিয়ে কিন্তু সেভাবে কেউ কথা বলে না ভাবে না বা বেশীদিন সেই ভাবনা দর্শকদের মনকে দোলায় না। আমাকে খুব ছুঁয়ে গেলো কথাটা। কারণ আমিও উনার সাথে সমভাবাপন্ন । তাই নাট্যকার বা নাট্যকর্মী হিসেবে আমাদের সেই দায়িত্ব নিতে হবে সমাজের যে ব্যবস্থা, সমস্যা, রাজনীতি, সমাজনীতি কুপ্রথা সেগুলো কে অপসারণের জন্য সমাজের সবাই কে ভাবাতে হবে। আর একটা খুব সুন্দর কথা বললেন শুনে খুব ভালো লাগলো, বললেন আজকাল বিশাল budget এর নাটক হচ্ছে, খুব সম্প্রতি নাকি NSD এক কোটি টাকার budget এর নাটক উপস্থাপন করেছে। বিশাল দামি দামি মঞ্চ, মঞ্চে গাড়ী, এমনকি বাইক ও আসতে পারছে। সেইটার বিপরীতে তিনি যা বললেন আমার দারুণ লাগলো, বললেন ওরা এক কোটি টাকা খরচ করছে, আমি এক টাকা দিয়ে করবো। দুর্দান্ত মনে হোল আমার শুনে। এই challenge গুলো জীবনে না থাকলে বোধহয় অন্যরকম কিছু করে উঠা যায় না। তাই উনাকে আমার সত্যি অর্থে একজন বড় মাপের মানুষ, দৃপ্ত ব্যক্তিত্ব ও একজন বলিষ্ঠ নাট্য যোদ্ধা বলে মনে হল। আর মনে হল আমার আসাও সার্থক হল অবশ্যই। কিছুক্ষণের মধ্যেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হল। ঠিক হল পরের দিন মানে ৩০ শে সেপ্টেম্বর সকাল ৭-৩০ থেকে ৯-৩০ ও বিকেলে আবার শুরু হবে ৫-৩০ থেকে ৭-৩০। প্রতিবেলায় ৪ জনের rotationwise বিভিন্ন group করে দেওয়া হল যারা এসে room সাফ করবে, গুছিয়ে নেবে, সাজিয়ে রাখবে artistic way তে। শুধু একটা নিয়ম মেয়েরা ঝারু দেবে না, খাবার serve করা, ইত্যাদি করবে না, ওগুলো সব ছেলেরা করবে, মেয়েরা সব সময় এই কাজগুলি ঘরে করে, তাই এই দায়িত্ব ছেলেদের দেওয়া হল। আমার ছেলে যদিও ৮ বছরের তবুও স্যার বললেন, তুমি তোমার ছেলেকে ও নিয়ে এসো। ও খুব খুশী মার সাথে নাটকের workshop করবে। পরের দিন মানে যেদিন workshop শুরু হল, ১১/১২ থেকে শুরু করে below ১৮ বছরের বয়সের প্রশিক্ষণার্থী ছাড়াও ৩৫/৪০ বছরের আরও প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন। উনি বললেন খুব POSITIVE কথা। বললেন যে কেউ , যার সদিচ্ছা আছে, আশা আকাঙ্খা আছে, নিজের কষ্ট ব্যথা বেদনার কথা বলতে চায় নিজের মত সশক্ত ভাবে বিশ্বাস করে, সেই থিয়েটার করতে পারে। আরও বললেন থিয়েটার মানেই অবিকল যে চরিত্রটি অভিনয় করছে তার নকল করতে হবে তা নয়, নতুন নতুন experiment আমরা করতে পারি। যা ইচ্ছে তাই তবে হ্যাঁ, তাতে জীবনের কথা,বাঁচার কথা, আশার কথা, আমাদের সমস্যার কথা, দুর্বলদের যন্ত্রণার কথা থাকতে হবে, তবেই আমরা থিয়েটার নিয়ে মানুষের - দর্শকদের মনকে ছুঁতে পারব। আর বললেন এখানে আমরা যা করবো সব “আমি” না “আমরা” করবো ।আমি তো মনে মনে শিহরিত হয়ে উঠছিলাম, আর ভাবছিলাম, আমার মত ভাবনা সেই বিশেষ ব্যক্তি ও ভাবেন সেই ভাবনায় পথ চলছেন বিগত ৪০ বছর ধরে, আমার মনে হল তাহলে আমিও তো সেই পথেই চলছি , সত্যি বলছি, আমার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেলো। আমার মত চলার , বলার , ভাবার ইচ্ছে আরও বলিষ্ঠ হল। আরও কিছু নিয়ম ছিল , নাটক করতে হলে ও নাটককে গুরুত্ব দিতে হবে, যারা দিতে পারবে ওরাই workshop attend করতে পারবে, এই যে নিয়মানুবর্তিতা, দৃঢ়তার পাঠ , খুব জরুরী কিন্ত । Priority টা আমাদের বুঝতে হবে, সেই বোধ টা উনি আমার মনে হয় অনেকের ভেতরে জাগাতে পেরেছেন। জোর দিলেন দৈহিক অঙ্গ সঞ্চালন, ভঙ্গি , দেহ ভাষা ও বলা যেতে পারে, যা আমাদের কথা না বলেও অনেক কিছু বোঝাতে পারে। একদম প্রথম দিন উনি শুরু করলেন হাল্কা free hand exercise দিয়ে। ৩৪ জন সবাই মিলে গোল হয়ে দাঁড়ালাম। গোল হয়ে দাঁড়ানোর কারণটা শুনে তো আমার দারুণ লাগল। গোল হয়ে দাঁড়ালে সবাই সবাইকে দেখতে পাবে। তিনটি কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ বললেন, সব সময় চোখে চোখ রেখে কথা বলতে, টানটান সোজা হয়ে দাঁড়াতে আর হাত দুটিকে এমন ভাবে রাখতে হবে ভাবতে হবে আমাদের হাত নেই, ওই প্রথম প্রথম যে জড়তা থাকে নাটকের সময় সেটা ভাঙ্গার জন্যেই হাত কোথায় রাখবো পা কোথায় রাখবো সেটাকে মাথায় রেখেই এই নিয়মগুলি আমাদের workshop এ চালু করে দিলেন। ভুলবশত যেই হাত পেছনে নিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে তার অদ্ভুত শাস্তি, হয় বাঁদরের মত নাচতে হবে, ডিগবাজি দিতে হবে, ছেলেদের নেচে দেখাতে হবে, যে গাইতে জানে না তাকেই গাইতে হবে, মানে এক কথায় শাস্তি গুলো এত মজার যে স্যারের হয়ে একে অন্যের ভুলটা ধরিয়ে দিচ্ছিল, কারণ শাস্তি পেলেই তো সবাই হিহিহি করে হেসে লুটোপুটি। আমার বেশ ভালো লাগলো কি সুন্দর করে স্যার জীবনে এগিয়ে চলার ভাবনা গুলো ও আস্তে আস্তে এই ভাবে নাটক নাটক খেলার মাধ্যমে মনের মধ্যে গেঁথে চলেছেন। তিনি প্রথমেই বলেছিলেন, নাটকে বেশী কথা বলা ভালো লাগে না, তাই কথা কম ,দেহ ভাষা বেশী ব্যবহার করতে হবে, আর অনবরত আমরা নতুন নতুন ভাবনায় আমাদের সমস্যা, আমাদের কষ্ট, আমাদের আনন্দ, আমাদের আশা, উৎসাহ গুলো কে তুলে ধরবো, আর দর্শকদের ভালো লাগবেই, আর আমাদের কাজের প্রথম দর্শক তো আমরাই। আর ও একটি খুব আমার মনের আমার বিশ্বাসের কথা যা আমি মনে প্রানে শুধু বিশ্বাস করি নয়, মেনে চলি ও যে আমি একজন পরিপূর্ণ মানুষ। উনি ও সেই কথাটি শুধু বললেন নয় প্রতিষ্ঠা করলেন, ছোট বড় সবাই যার যার মত সমভাবে ব্যক্ত করবে, ভাবের আদান প্রদান করবে এবং workshop এ প্রতিদিন সমস্ত activities এ actively involve হতে হবে এবং হলও তাই। বিভিন্ন বয়সের ৩৪ জন মিলে মিশে “আমরা” হয়ে কি করে যে ১০ দিন কেটে গেলো খেলতে খেলতে আর সবাই যে কত কিছু শিখেনিলাম তা ওখানে না গেলে বোধহয় জানতে পারতাম না। শুরু হয়ে ছিল free hand exercise দিয়ে। সেই শরীরী ভঙ্গি গুলো কে রোজ রোজ একটু একটু করে ভাবনার তুলি দিয়ে কথা সুর উচ্ছলতার রঙ দিয়ে কিভাবে সাজাতে হ্য় মাত্র ১০ দিনে তাই তিনি করে দেখালেন, শেখালেন সবাইকে। আমার সাথে একদিন workshop এর পর discussion বসেছিলেন, অনেক কথা শুনলেন, বোঝালেন , বললেন, guide করলেন। এই যে ব্যাপারটা উনি যে অন্যের মনের ভাবনাকে পড়তে পারেন , English-এ বোধহয় একেই বলে “CLAIR VOYANCE” …..এই অতিরিক্ত ভাবনা গুলোই উনাকে একজন বিশাল ব্যক্তিত্বতে পরিণত করেছে এবং আমি খেয়াল করেছি, উনি প্রথম দিন থেকেই যাদেরকে selectively point out করেছেন, শেষের দিকে কিন্তু ওরাই সবার থেকে ভালো করেছে, এবং ওরা অদূর ভবিষ্যতে কাজ করে যেতে পারবে এবং এই যে মানুষকে মানুষ গড়ার, সমাজকে সবার বাসযোগ্য করে তোলার জন্য জহুরির মত মানুষদেরকে কাজ করে তোলবার জন্য খেলার মাধ্যমে নাটকের মাধ্যমে গড়ে তোলার পদ্ধতি বা formula মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে বলতেন এগুলো হচ্ছে, Probilogy…. আমার কাছে দারুণ রোমাঞ্চকর মনে হয়েছে । উনার উপর উনারই এক ছাত্র “ দামাল” নামে একটি documentary তৈরি করেছে, আমায় বললেন তুমি দেখ, পড়ে অবশ্য সবাই কে একদিন কর্মশালায় দেখানো হয়েছিল, আমি “দামাল” দেখে চোখের জল আটকাতে পারিনি, স্যারকে বললাম, কি করে এরকম হল স্যার, আপনি যা বলছেন এখানে ওগুলো তো সব আমারও কথা। আমি সত্যি খুব imotional হয়ে পড়েছিলাম সেদিন , তবে একই সাথে আমার মনে হয়েছিল আমার ভাবনা, আমার চলার পথে , আমার আগে আগে আরও আরও অনেক আছে, আর এই সত্যটি আমাকে আরও বেশী আমার মত করে বাঁচার সাহস দিয়েছে, আমি উপলব্ধি করেছি, আমি একা নই। মনে হয়েছিল, আমাদের নাটকে , আমাদের গানে, আমাদের চলাফেরায় আমাদের রাজনৈতিক চেতনা থাকা চাই। সব কিছুতেই রাজনীতি আছে, এবং থিয়েটার করতে হলেও তার একটা রাজনৈতিক দৃষ্টি ভঙ্গি থাকবেই এবং থাকা উচিত। প্রবীর গুহের নাট্য কর্মশালায় মূলত প্রথম আমার উপলব্ধি হল যে সমস্ত নাট্য কর্মীর “থিয়েটারে রাজনীতি” র জ্ঞান জরুরী এবং এই জ্ঞানই আস্তে আস্তে বিন্দু থেকে সিন্ধুর মত আমাদের মত সাধারনের মগজে “রাজনীতি” র এক স্বচ্ছ অবয়বের ছবি ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হবে এবং এই “থিয়েটারে রাজনীতি” র পাঠের জন্য জরুরী নিয়মিত এই ধরণের নাট্য কর্মশালা , তাতে বিভিন্ন নাট্য শৈলী ধারার সাথে যেভাবে আমাদের পরিচয় হয় একই সাথে আমাদের রাজনৈতিকবোধের বীজ অঙ্কুরিত হয়। ভাল-মন্দ, ডান-বামের জানার পরিধির ব্যাপ্তি ঘটে। এই প্রকারের “থিয়েটারে রাজনীতি” ই কিন্তু “রাজনীতির থিয়েটারকে” বহুলাংশে প্রভাবিত করে ও সমাজ সংস্কারে এক অনবদ্য ভূমিকা নিতে পারে। কোন কথা না বলে তাৎক্ষণিক একটি নাটকের ঘটনার মুহূর্ত তৈরি করা এবং তাতে কোন সামাজিক পারিপার্শ্বিক বা মানসিক সমস্যা ও তার দূরীকরণ কি ভাবে দেখানো যায় , শুধু মাত্র মাথা থেকে পা পর্যন্ত isolated movement দিয়ে কিভাবে মানুষের বিভিন্ন characteristics গুলো কে বর্ণনা করা যায়, এই যে শিক্ষা গুলো সত্যি অভূতপূর্ব। ৩৪ জন আমরা যারা কর্মশালায় ছিলাম , ছোট বড় সবাইকে একদম সরবতের মতন মিশিয়ে দিতেন। বাচ্চারা একসাথে দাঁড়াবে না, মেয়েরা একসাথে দাঁড়াবে না, বলতেন এখানে ছেলে মেয়ে বাচ্চা বলে কিছু নেই, সবাই সমান , খেলতে খেলতে শেখাতে শেখাতে হঠাৎ করে ৫/৬ দল বানিয়ে দিতেন আর সময় খুব বেশী হলে ৫/১০ মিনিট , ওই সময়ের মধ্যেই একেকদিন সুর, কথা, কোন বিষয়বস্তুকে কি ভাবে উপস্থাপন করতে হবে সেই কাজ গুলো করাতেন। সব থেকে মজার ব্যাপার হল কার দলে কে আছে সব লটারি। কিছুই করার নেই কারণ স্যার ও ওভাবেই দল গড়ছেন। আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল ছোট্টরা ও পিচ্চিরা সবাই সত্যি কিন্তু বড়দের থেকেও অনেক গভীর ভাবে ভাবতে ,গড়তে ও করতে জানে। সব দল ওদের performance দেখাবে আর দর্শক ছিলাম অন্য সব দলগুলো। সবাই তক্ষুনি সবার ভালো লাগা, খারাপ লাগা , কেন, কি করে সব এক এক করে বলছে, আর মজা লাগত যে ছোটরাও কিন্ত কোন অংশে কম নেই। এই যে ছোট বড় মাঝারি মননের সবাইকে একসাথে balance করে তার পর এধরনের কর্মশালা এত উদ্যম উৎফুল্লতা, সত্যি বলতে আমরা সবাই সত্যি অর্থে “আমরা” হয়ে পড়েছিলাম। সব শেষে উনি যা করলেন তা হলও এতদিন সবাই যে যা করেছে, কেউ খুব ভালো দেহ ভাষা প্রদর্শন ও বর্ণনা দিয়েছে, কেউ বা হয়তো খুব ভালো সুর করেছে, খুব ভালো লিখেছে, হঠাৎ করে বলতেন ,যাও তোমরা সব জুড়ে দাও কিন্তু ভালো লাগতে হবে, আবার শুরু হল সেই দেহ ভাষা,সুর, কথা, নাটকের মুহূর্ত কে মালার মত গেঁথে আর একটি নতুন মালা গাঁথার খেলা। এই করতে করতেই উনি শিখিয়ে দিলেন কি করে আলাপ থিয়েটার, nonsenseথিয়েটার করতে হয়। সবাই একাত্ম না হলে কিন্তু কিছু সৃষ্টি করা যায় না, সত্যি আমরা একে অপরের সাথে মিলেমিশে নতুনের সৃষ্টির আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে থাকতাম। এই করেই চোখের নিমেষে ১০ দিন শেষ হয়ে গেল। সমাপ্তি অনুষ্ঠানের জন্য উনি বললেন আমি কিছুই করব না বলব না, সব তোমাদের করতে হবে, যদি পার তবেই কর, আমি তোমাদের সাথে আছি। শেষ পর্যন্ত তাই হলও আমরা সবাই মিলেই সমাপ্তি অনুষ্ঠানটি চিন্তা ভাবনা করে, পরিচালনা , সঞ্চালনা, অভিনয়, কথা, গান, সবই হল স্যার এঁর অভিভাবকতার আড়ালে , এবং দুর্দান্ত হয়েছিল এত কম সময়ে এই রকম অন্য ধরণের অনুষ্ঠান সত্যি মনোগ্রাহী হয়েছে এবং দর্শকরাও সমভাবে আমাদের সাথে involved হয়ে গেছিল। এই ১০ দিনে দেখলাম ও বুঝলাম স্যারের অনেক অনুগামী যারা এই ধরণের “থিয়েটারে রাজনীতি” র বোধ নিয়ে রতন থিয়াম, সুধন্য দেশপাণ্ডে ও আরও আরও অনেক বিখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্বের সাথে কাজ করছে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে নাট্য কর্মশালার আয়োজন করছে, এবং অনাম্নি ভাবে প্রচার বিমুখ হয়ে বিভিন্ন আদিবাসী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই ধরণের থিয়েটারের অনুষ্ঠান করছে, আস্তে আস্তে মানুষকে মানসিকভাবে, রাজনৈতিক ভাবে সজাগ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। জেনে খুব ভাল লাগলো আসলে “থিয়েটারে রাজনীতি” র প্রভাব কত বিস্তীর্ণ কণ্টক পথে গভীর জঙ্গলের আদিবাসীরাও ওদের মাদল ওদের গানের আমেজে মিলিয়ে মিশিয়ে সবার সাথে পায়ে পায়ে মিলিয়ে দুলে দুলে আনন্দে নাচতে নাচতে একটু একটু করে শিখছে আর সেই সাথে আমরা যারা কংক্রিটের জঙ্গলে বাস করি আমাদের চার দেওয়াল আর বোকাবাক্সের মধ্যে আমাদের পৃথিবী আবদ্ধ, ওদের কাছে গিয়ে প্রকৃতির নির্মল সহজ-সরল থিয়েটারের আনন্দ নিচ্ছি, এই যে দেওয়া আর নেওয়ার আর এক নামই থিয়েটারে রাজনীতি।
সনটা ২০১০ হবে, এপ্রিল মাস, আন্দামান-নিকবোর দ্বীপের পোর্টব্লেয়ারের মাটীতে পা দিয়েই একটু FRESH হয়ে চলে গেলাম সোজা সেলুলার জেলে। সমস্ত গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল, আমাদের আজকের এই স্বাধীন দেশ, চতুর্দিকে কেলেঙ্কারি আর কেলেঙ্কারি,দুর্নীতি, গরীব আরও গরীব, ধনী আরও ধনী, হিন্দু মুসলমান নামক হাতিয়ার ব্যবহার করে শতশত হাজার , হাজার শিশু – মহিলা গ্রাম শহর ধ্বংস , রাজনৈতিক দলগুলির প্রকাশ্যে কোন্দল,এর জন্যেই কি ওখানে এই দেশের শতশত শহীদেরা অমানুষিক পাশবিক অত্যাচার হাসিমুখে বরণ করে আত্ম বলিদান করেছিলেন । শুধু ১৫ই আগস্টে ও ২৬ এ জানুয়ারিতে কিছু দেশাত্মবোধক গান বাজিয়ে আবার সবাই যে যার মত ব্যস্ত অরাজনৈতিক কর্মে । ভীষণ খারাপ লাগছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের পরিস্থিতির সাথে আমাদের দেশের এখনকার পরিস্থিতির তুলনা করে, কালাপানির সমুদ্রের ঢেউ এর দোলায় মনটা সত্যি হুহু করে উঠলো। রাগে মনে মনে বলে উঠলুম সমস্ত রাজনৈতিক তথাকথিত নেতাদের রাজনীতিতে প্রবেশের আগে অন্তত তিনদিন এই জেলে ঐসব কুঠুরিতে কাটানো উচিত, সেই কষ্ট সেই যন্ত্রণার কণা বিন্দু যদি ওরা অনুভব করতে পারেন , “রাজনীতিতে থিয়েটার” এর দৃশ্যাবলীর কিছুটা হলেও পরিবর্তন ঘটবে। কারণ রাজনৈতিক নেতারাও তো আমাদের দেশের এক একজন বেতনভুগি কর্মচারী, তাহলে কেন আমাদের গণতন্ত্রে একটি বিশেষ পদ্ধতি, বিশেষ শিক্ষার মাধ্যম থাকবে না, শুধু ক্ষমতার লোভ ও যথেচ্ছাচারিতার আঁচড় যাতে রাজনীতির রাজে ও নীতিতে কোন ছায়া ফেলতে না পারে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রাজনীতির থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয় তার জন্য কি প্রয়াস চলছে ? এখানেই “থিয়েটারে রাজনীতি” দৃশ্যপট শুরু এবং সমাজের বিভিন্ন নাট্য কর্মী , নাট্য দল প্রতিনিয়ত নিজের গাঁটের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত একের পর এক দৃশ্যপটের সূচনা, অনুশীলন ও পরিবেশন করে যাচ্ছেন। এই প্রয়াসের এক জ্বলন্ত উদাহরণ লক্ষ্মণ ঘটক বাবু , উনার “অভিনয় ত্রিপুরা” যিনি আমার মত গবেটকে দিয়েও “থিয়েটারে রাজনীতি ও রাজনীতিতে থিয়েটারে” লিখিয়ে নিলেন, হয়ত সুদূর ভবিষ্যতে আমি সত্যি সত্যি “রাজনীতি” র অভিধানিক ও সাংবিধানিক গূঢ় অর্থ বুঝতে পারব, বা বোঝার সেই পথে প্রথম চলতে শুরু করলাম।
গত ১৫ই মে, “১৯শে র মহাপথচলা” শীর্ষক মহামিছিলের শেষে শিলচর ভাষা শহীদ ষ্টেশনে দাড়িয়ে সন্ধ্যে বেলা, “দলছুটের” পথ নাটক দেখছিলাম,নাটকটি এ অঞ্চলের মুখ থুবড়ে পড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার দৃশ্যায়ন করছিল,হঠাৎ ই দেখলাম ওপাশ থেকে চার্বাক স্যার , আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের Masscom Deptt এর প্রফেসর, বললেন কি খবর আপনার “ভালো লাগা ও ভালো থাকা” লেখাটা পড়লুম, ভালো লিখেছেন, ঘটক বাবু তো আপনাকে লেখক বানিয়ে ফেললেন, দুজনেই হেসে উঠলুম। লেখা ভালো হয়েছে শুনে সত্যি যতটা অবাক হয়েছি ততটাই ভালো লেগেছে, কথায় কথায় বললুম এবারের বিষয় ““থিয়েটারে রাজনীতি ও রাজনীতিতে থিয়েটার” তা কি যে লিখব বুঝতে পারছি না কারণ রাজনীতি তো সেরকম বুঝি না, আবার হেসে উঠলেন বললেন বলেন কি আপনি “আই.পি. টি .এ.” করেন রাজনীতি বোঝেন না । তারপর বললেন, আপনি শুধু আপনার ভাবনাটুকু লিখে ফেলুন তা হলেই হবে। আমি এখানে শুধু আমার ভাবনাটুকুই লিখলাম, হয়ত তা ““থিয়েটারে রাজনীতি ও রাজনীতিতে থিয়েটারে” র পার ছুঁতেও পারে নি। কিন্তু আমি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে , আমি যদি আমার বোধকে একটি সরল রেখার সাথে তুলনা করি তা হলে দেখতে পাই ...... সেই রেখায় দুটো অন্ত আছে, একটা ডান ও আর একটি বাম......দুটো ধরণ আছে ভালো ও মন্দ কিন্তু দুটোই একই সাথে এক সরলরেখায়। আমার বোধের গতি ও দিশা বামের দিকে অন্যদের হয়ত ডানের দিকে , সেই দিক পরিবর্তন ও গতির চলাচল বদলের জন্য নাট্যকর্মীরা, সমাজসেবীরা, NGOs.ও আরও বিভিন্ন সংস্থা “থিয়েটারে রাজনীতি ও রাজনীতিতে থিয়েটারে”র সার্বিক উন্নতির জন্য প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে.........আর এই প্রয়াসই হয়তো ভারতীয় রাজনীতির সরল রেখায় .........কংগ্রেস, বিজেপী, সিপিএম, জেডিঊ , অগপ, তৃণমূল ......ইত্যাদি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির সহাবস্থান , নীতিগত ডান ও বামের দিকে চলাচল, আমাদের বিচিত্র ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ , জৈন ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মের বর্ণের মানুষের সুযোগ্য বাসভূমি রূপে পরিণত করতে সহায়ক হবে।
ফিরে এসেই আমার একটি অনুষ্ঠান ছিল তাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, ২রা Oct’12 দুটো নাটক হয়েছে । তার মধ্যে একটি ছোটদের নাটক ছিল। ১০ জন ছোট শিশু যাদের বয়স ৫ থেকে ৯ বছরের ভেতর, আমার ছেলে এবং আমি মিলে ৪ দিনে একটি ছোটদের নাটক ১০ জনে মিলে বসে, আলোচনা করে, without any script, music আমরা নাটকটি মঞ্চস্থ করি, সবাই মানে ১০ জন শিশু থেকে শুরু করে দর্শকরা সবাই খুব উপভোগ করেছে , কারন সেই নাটক শিশুদের মননের রাজনৈতিক নীতিবোধের উষ্ণ আঁচ দর্শক পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পেরেছিল। থিয়েটার আমাদের সমাজ দর্পণ , আমাদের নিজেদের ছবি , আমাদের পাওয়া ও না পাওয়ার ব্যথা ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশের মঞ্চ বা স্থান যাই বলুন, আমদের প্রশ্ন ও উত্তরের একটি খোলা বই, এবং সেই থিয়েটারে ......রাজনীতির ভিটে বহু পুরনো ও চিরস্থায়ী, আমরা কি ভাবে সেই রাজনীতির সাথে নিজেদের সখ্যতা গড়ে নেব ও সেই সখ্যতা আমাদের দর্শকদের মনেও সঞ্চারণ করবো তা নির্দিষ্ট হবে আমরা যারা নাট্য কর্মী, আমরা যারা নাট্য দলগুলি নিয়ে থিয়েটার করি আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান কি ও আমাদের রাজনীতির মতাগত দর্শন কি তার উপর। রাজনীতি রান্নাঘর থেকে শুরু করে অফিস আদালত স্কুল কলেজ পাড়া প্রতিবেশী সর্বত্র বিদ্যমান, রাজনীতি ছাড়া কিছুই চলতে পারে না, কারণ সব কিছুর জন্যই যে নীতিগত আদর্শ দরকার, কাজেই রাজনীতি সবকিছুরই , আবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর যেহেতু আমাদের থিয়েটার বা মঞ্চে সমাজের বিভিন্ন বিষয়, সমস্যা, বার্তা, স্বপ্ন, আদির পুনর্জন্মস্থল, “থিয়েটারে রাজনীতি” আমাদের সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। নাট্য কর্মী, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ ও আমাদের সবার দায়িত্ব আমরা আমাদের মঞ্চ-থিয়েটার এবং সমাজ থিয়েটারে সক্রিয় ভাবে রাজনৈতিকবোধের প্রকাশ করা । আমাদের সমাজ ও দৈনন্দিন জীবনে আমাদের সমাজ থিয়েটারে আমরা অহরহ জান্তে অজান্তে কোথাও বাধ্য হয়ে, কোথাও স্বেচ্ছায় অভিনয় করে যাচ্ছি বা করতে হচ্ছে, এবং এই সমাজ থিয়েটারের রাজনীতিতে “রাজনীতি" শব্দটিকে সদর্থক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে নাট্য কর্মীদের বিভিন্ন থিয়েটারের দর্শন ও কলাকৌশল অনুসারে বিনোদনের আস্তরণের মোড়কে শিক্ষা ও সমাজনীতি, নাগরিক চেতনা ও অধিকার বোধ, শোষণ ও দমনের বিরুদ্ধাচরণ, অহিংসনীতি পরায়ণতা, উগ্র জাতীয়তাবাদের পথ পরিত্যাগ , ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের সংমিশ্রণের আকারে “রাজনীতি”র বোধের উন্মেষ ঘটাতে হবে, তবে তা একদিনে তো হবে না, কারণ তা একটি on going chain process । তবে সেই সাথে আরও একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, “ রাজনীতি” র রাজ ও নীতি দুটোই কিন্তু সরাসরি রাজনৈতিক নেতাদের ও নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল। কবে কোন রাম রাজ্য ছিল, কবে কোথাকার শুদ্ধধন ছিলেন, তখনকার রাজনীতি, কবেকার আকবর ও তার সভার নবরত্ন, কবেকার কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল, বীরবলদের কাহিনী ও চিত্রনাট্য আমাদেরকে যে আভাস দেয়, যে রাজ্যের রাজা যত ভাল, রাজতন্ত্র সুষ্ঠু ভাবে পরিচালিত হয়, সেই রাজ্যে রাজনীতির থিয়েটারে রাজতন্ত্রের সাথে সমাজতন্ত্রের বিভেদ কম থাকে, প্রজারা ভাল থাকবে, রাজ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতির পরিবেশ সৃষ্টি হবে, সেই সব রাজ্যে বা রাষ্ট্রে থিয়েটারে রাজনীতির মান অনেক উন্নত হয়। কিন্তু এখন তো সেই রাজতন্ত্রের জমানা শেষ, আগে রাজপরিবারের ভাবি রাজা ও রাজকুমারদের বিশেষ ভাবে রাজতন্ত্রের ভার গ্রহণ করার জন্য ছোটবেলা থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হত, মানসিক ভাবে তৈরি করা হত। আজকাল তো এসবের কোন বালাই নেই, এলেবেলে দুধভাত হলেই রাজনীতি তে হাতে খড়ী , তারপরেই তো সমাজের খুঁটি, আর কিছু জানার দরকার নেই। এক নিমেষে রাজনৈতিক দল গড়ে, ভোটে জিতে মন্ত্রী হয়ে কেল্লা ফতে আর কি। দেশ, জনগণ , সব গোল্লায় যাক। এদের আর কি দোষ, এদের বোধের দায়রায় এরা সবাই “সুবিধাবাদী পার্টি” র সদস্য এবং গণতন্ত্র নামক থিয়েটারে ওরা রাজনীতির রাজ কে বিদেয় করে “দুর্নীতি” আমদানি ও রপ্তানি করছে। যে দেশে জওয়ানরা, সেনা বাহিনী, সীমা সুরক্ষা বল, সমস্ত ছোট ও আধিকারিকের পদের জন্য UPSC, SSC, TET, SLAT, NET, AIEEE, JET,এরকম হাজার ধরনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়, পিয়নের চাকুরী থেকে শুরু করে শিক্ষকের নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু বাধ্যতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ওদের চয়ন হয়, সেইখানে, সেনা , শিক্ষা, মেধা, অর্থনীতি, সমাজনীতি , ইত্যাদি ইত্যাদি যারা পরিচালনা করবেন , ওদের না কোন শিক্ষাগত যোগ্যতার দরকার, না তাঁদের ACCOUNTABILITY OR EFFICIENCY নামক কোন ভয় আছে। খুবই আশ্চর্যের যদিও, হয়তো আপনারা আমার লেখা পরে ভাবছেন আমার কি উদ্ভট ভাবনা ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন