“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৩

বরাক উপত্যকায় কৈবর্ত সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থান


                                    ।। শৈলেন দাস।।

কৈবর্ত সমাজের প্রধান গুণ হল তাদের সংঘবদ্ধ অবস্থান। তারা যেখানেই যায় দলবদ্ধভাবে বসবাস করে- অন্যদের থেকে একটু তফাত বজায় রেখে। তারা সাধারণত: সহজ-সরল জীবন যাপনে অভ্যস্থ। জলাভূমিবা হাওর অঞ্চলগুলিই বসবাসের জন্য তাদের অধিক পছন্দ। তারা কৃষিকাজ এবং মৎস্যচাষে পারদর্শী। কোন একটি অঞ্চলে বসতি স্থাপনের সময় তারা যথেষ্ট পরিমাণ কৃষি জমির দখলনেয় বা খরিদ করে এবং মাছ চাষের জন্যও উপযুক্ত জলাশয় খুঁজে নেয় বা তৈরী করে। ফলে তারা নিজেদের পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারে সহজেই। কৃষিকাজের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তারা বিভিন্ন ধরণের গৃহপালিত পশু-পাখি প্রতিপালন করেও আর্থিকভাবে লাভবান হয়। গ্রাম প্রতি কয়েকটি পরিবার এমনও পাওয়া যায় যাদের আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট মজবুত এবং বিষয় সম্পত্তির পরিমান শহুরে উচ্চপদস্থ চাকুরিয়ান বা ধনী বনিকের চেয়েও বেশীই হবে বৈকি কম নয়। কিন্তু সামগ্রিক চিত্র বড়ই ব্যঞ্জণাদায়ক। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং নানান প্রাকৃতিক প্রদূষণের ফলে প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে ফসলের উৎপাদন এবং মৎস্য চাষেও ঘটছে ব্যাঘাত। এহেন পরিস্থিতিতে দিনে দিনে গ্রামীণ কৈবর্তদের ভাঁড়ার ক্রমশ: শূন্য হয়ে পড়ছে। গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত প্রায় প্রতি বছরই বন্যার জলে ডুবে যাচ্ছে কৃষিজমি, ভেঙ্গে যাচ্ছে জলাশয়ের বাঁধ। বাধ্য হয়ে জীবিকার সন্ধানে তারা শহরাভিমুখে রওয়ানা হচ্ছে নিজেদের ভিটে মাটি ফেলে– ধরে রাখতে পারছেনা নিজেদের স্বাভিমান। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সর্বসান্ত হয়ে বেশির ভাগ কৈবর্তই আশ্রয় নিচ্ছে শহরতলীর নীচু, পরিত্যক্ত এলাকাগুলিতে। স্ত্রী-পুত্র-কন্যার মুখে দুবেলা দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে তারা হন্যে হয়ে ঘুরছে কাজের সন্ধানে। যেহেতু কৃষি কাজ এবং মৎষ্য চাষের উপর নির্ভরশীল কৈবর্ত সমাজের তরুণ প্রজন্ম কারিগরি বিদ্যা অর্জন করেনি এবং অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেনি তাই বাঁচার তাগিদে তারা প্রবৃত হয়েছে এমন সবকাজ করতে যা শহুরে বাবুদের কাছে ছোটকাজ বলে পরিগণিত। ফলস্বরূপ আর্থ-সমাজিক ক্ষেত্রে কয়েক ধাপ পিছিয়ে পড়েছে এই সমাজ। অন্যান্যদের কাছে আজ তারা ব্রাত্য,অবহেলিত কখনো বা করুণার পাত্র। যে কৈবর্ত বছরে শতাধিক মণ ধান ঘরে তুলত, যার বাড়ির পুকুরে লক্ষাধিক টাকার মাছ চাষ হত, যার সন্তানদের দুবেলা দুধ-ভাত না হলে চলত না, অবস্থার দুর্বিপাকে আজ তারা এক কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি।
                সামগ্রিকভাবে কৈবর্ত সমাজ পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ হল তাদের বাসভূমির ভৌগোলিক অবস্থান। হাওর বা জলাভূমি কেন্দ্রিক গ্রামগুলিতে কৈবর্তরা কৃষিকাজ, মাছ চাষ এবং গবাদি পশু প্রতিপালন করে নিজেদের জীবিকা অর্জনে সক্ষম হলেও অপর্যাপ্ত যোগাযোগ এবং পরিবহণ ব্যবস্থার দরুণ শহর তাদের কাছে দূরের দেশ। তাই কৃষিজাত সামগ্রী সরাসরি নিজেরা বাজারে বিক্রি করে দু-পয়সা বাড়তি আয় করা তাদের কাছে কষ্টকর যাত্রা। তাছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য,বিশুদ্ধ পানীয় জল এবং ইলেকট্রিসিটির জাদুকাঠির ছোঁয়া থেকেও বঞ্চিত কৈবর্ত সমাজ বছরের পর বছর প্রাকৃতিক নানা ঘাত প্রতিঘাত সয়ে সয়ে ক্লান্ত হয়ে আটকে পড়েছে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে। বুঝতেই পারছেনা যে তারা ক্রমশ: পিছিয়ে পড়ছে অন্যদের থেকে। তাদের চিন্তাভাবনায় লাগেনি আধুনিকতার ছোঁয়া। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে, সবার সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার দৌড় থেকে বিরত থেকে অন্যদের কাছে যথাযত মর্যাদা পাচ্ছেনা এই সমাজ।
         তবে কি বাসভূমির ভৌগোলিক অবস্থনের জন্যই বর্তমানে কৈবর্ত সমাজের এই আর্থ-সামাজিক অবনমন? উত্তর হল- না। কৈবর্ত সমাজের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হল রাজনীতি। গণতন্ত্রে গুণের চেয়ে সংখ্যার প্রাধান্যই বেশি এবং বরাক উপত্যকার দুটি লোকসভা সমষ্টিতে কৈবর্ত সমাজের ভোটারসংখ্যা নেহাত কম নয়। করিমগঞ্জে তো কী-ফ্যাক্টর। তাছাড়া শিলচর, আলগাপুর, কাঠিগড়া, রাতাবাড়ি প্রমুখবিধানসভা সমষ্টিগুলির প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ে কৈবর্ত ভোটারদের একটা প্রভাব থেকেই যায়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এমন একটিসমাজের গুরুত্ব বা মর্যাদা দল মত নির্বিশেষে সবার কাছে অপরিসীম হওয়ার কথা। সেইঅনুযায়ী এই সমাজের সার্বিক উন্নয়ণ হওয়াও ছিল বাঞ্চনীয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব প্রতিপত্তি যথেষ্ট থাকার কথা এই সমাজের। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুচতুর শাসক শ্রেণী সুশিক্ষিত, মেধাবী এবং সুযোগ্য কৈবর্তদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উঠেআসার পথকে দুর্গম করে তুলেছে। অনেক ক্ষেত্রে তো চক্রান্ত করে গোড়াতেই নষ্ট করে দিয়েছে কৈবর্ত সমাজের তরুণ প্রতিভাকে। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দি পেরিয়েও ‘সেই ট্রেডিশন সমানে চলেছে’। কৈবর্ত জাতি কখন বুঝবে এইকথা?
             কেউ হয়ত যুক্তি দেখাতেই পারেন সাংসদ বা বিধায়কও তো অনেকেই হয়েছেন এই সমাজ থেকে, তাছাড়া জেলাপরিষদ সদস্য, পঞ্চায়েত প্রতিনিধি বা পৌর সদস্যও তো হয়েছেন অনেক কৈবর্ত। তাদের অনুরোধ করব ভেবে দেখতে নিজের সমাজের জন্য কাজ করতে কতটুকু স্বাধীন ছিল তারা। বলিষ্ট রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বহীন সমাজ স্বার্থপর ভারতবর্ষে এগিয়ে যাবে কি করে? সাধারণ কোঠায় রাজনীতির কথা বাদ দিলেও অনুসূচিত জাতি পরিষদ এবং অনুসূচিত জাতিপর্ষদেও কৈবর্ত প্রতিনিধিত্ব হতাশাজনক এবং ধিক্কারযোগ্য। পরিসংখ্যান অনুযায়ী যারা সংখ্যাধিক্য তাদের মাত্র দুই বা তিনবারই সুযোগ দেওয়া হয়েছে অনুসূচিত জাতি পর্ষদের চেয়ারম্যান হওয়ার। অনুসূচিত জাতি পরিষদের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত কোন কৈবর্তের সৌভাগ্য হয়নি এই সংস্থাটির সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হওয়ার। বিচিত্র এই দেশ বিচিত্র তার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা! রাষ্ট্রক্ষমতা যেহেতু তাদের অনূকূলে নয় তাই সমগ্র দেশে গ্রামীণ বৈদ্যুতিকরণ প্রকল্প শুরু হলেও কৈবর্ত সমাজ অধ্যূষিত বরাকের অঞ্চলগুলি সুর্যাস্তের সাথে সাথে টুপ করে অন্ধকারে ডুবে যায়। স্বাস্থ্য এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে এমনভাবে পঙ্গু করে রাখা হয়েছেযে সাধারণ রোগে ভোগলেও সদর হাসপাতালে পৌঁছতে পৌঁছতে এই এলাকাগুলির মানুষকে ‘যমের দোয়ার’ দেখতে হয়। বিশুদ্ধপানীয় জল এই এলাকাগুলিতে সরবরাহ করা হয় ‘অকাল বৃষ্টি’র ন্যায়। তবে বঞ্চনারএই সাতকাহনের দায় কৈবর্তদের নিজেদেরও কিছুটা বহন করতে হবে। প্রচলিত ধ্যান-ধারণা বদলে এবং আবেগিক রাজনীতি পরিহার করে দলব্ধভাবে বসবাস করার মত সম্মিলিতভাবে কেবল একটি রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দিয়ে সেই দলের আস্থা অর্জন করলে মন থেকে না চাইলেও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে হলেও কোন কোন নেতা বা নেত্রী প্রতিনিয়ত ব্রতী হবে কৈবর্ত সমাজের সার্বিক মঙ্গলকামনায়। উন্নয়ণের স্বার্থে সুযোগ্য ব্যক্তিত্বের পাশে একজোট হয়ে দাঁড়ালে কৈবর্তজাতির নরকযন্ত্রণা ভোগ কিছু লাঘব হওয়ারই কথা। তবে এক্ষেত্রে কৈবর্ত সমাজকে পা ফেলতে হবে সতর্কতার সাথে, কারো একনিষ্ট সমর্থক হলেও যেন  ক্রীড়নক না হয় গোটা সমাজ। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনা করে চলতে হবে, বুঝতে হবে কার কৈবর্ত প্রীতি লোক দেখানো এবং কার নীতিই কৈবর্তদের মঙ্গল কামনা করা।
              একক সমাজ হিসাবে কৈবর্ত সমাজের সংঘবদ্ধঅবস্থান এবং সামাজিক সংকটের মূহূর্তে একজোট হয়ে লড়াই করার মানসিকতায় অনেকেই বিরক্ত এবং ঈর্শান্বিত। তাই কলে-কৌশলে তাদের দৃঢ় এবং মজবুত মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে দিতে শাসক শ্রেণীকে প্রভাবিত করে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে এই সমাজ অধ্যূষিত এলাকাগুলিকে। বরাক উপত্যকার কৈবর্ত সমাজ অধ্যূষিত এলাকাগুলি যেমন- কাঠিগড়া, চাতলা, বক্রিহাওর, শনবিল, পুটিছড়া, মালিনীবিল, তপোবননগর, রংপুর, তাপাং, কালিবাড়িচর প্রভৃতিকে শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে রাখা হয়েছে অমানবিকভাবে। অধিকাংশ এলাকাতেই নেই প্রাথমিক বিদ্যালয়। কোন কোন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু-একটি বিদ্যালয় থাকলেও সে সবের হাল হকিকত খোঁজ করার মানসিকতা নেই কোনসরকারি কর্মকর্তার। কোন অজ্ঞাত কারণে এই এলাকাগুলিতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগও নেওয়া হয়নি অথচ সমগ্র আসামে শিক্ষাক্ষেত্রে চলছে আমূল সংস্কার। তাছাড়া ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অপ্রতুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রজন্মেরপর প্রজন্ম কৈবর্ত সমাজ বঞ্চিত হয়ে আছে উচ্চশিক্ষা লাভ থেকে। ফলস্বরূপ সরকারি চাকুরিয়ানের সংখ্যা অতি নগণ্য এই সমাজে। তাই বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প বা সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তি থেকে তারা বঞ্চিত। তবে আশার কথা কৈবর্ত সমাজের একাংশ যুবক-যুবতি পারিপারিক আর্থিক সচ্ছলতার কারণে এবং কয়েকজন গরীব তরুণ-তরুণী লড়াইয়ে টিকে থাকার অদম্য আত্মবিশ্বাসে যাবতীয় বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে। আসাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ন্যাশনাল ইনষ্টিটিউট অফ্ টেকনোলজির শিলচর কেন্দ্রে প্রভাষক হিসাবে মর্যাদা সহকারে দায়িত্ব পালন করছে কয়েকজন কৈবর্ত গুণীজন। ডজনখানেক কৈবর্ত সন্তান বরাক উপত্যকার বার সংস্থাগুলিতে সুনামের সাথে আইন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। উচ্চ ডিগ্রীধারী ডাক্তার, পদস্থ সরকারি আমলা, কলেজ শিক্ষকও রয়েছেন যাদের শিরায় কৈবর্ত রক্ত বহমান। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলিতেও কৈবর্ত সন্তানরা আদর্শ শিক্ষকরূপে পাঠদান করে গড়ে তুলছে দেশের নতুন প্রজন্মকে। সাহিত্য, সঙ্গীত এবং সংস্কৃতি চর্চায়ও ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ ঘটছে কৈবর্ত সমাজের তরুণ প্রতিভাদের। এই পরিসংখ্যান ক্রমশ: বেড়েই চলছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক তথ্য হল উচ্চশিক্ষা লাভ করে এই সমাজের যারাই অগ্রসর হয়েছে তাদের অধিকাংশই সরে গেছে বৃহত্তর কৈবর্ত সমাজকে ছেড়ে। বাঁচার তাগিদেই হোক আর আত্মগ্লানিতেই হোক কৈবর্ত মায়ের আঁচল ধরে হাঁটতে আজ তারা কুণ্ঠিত, লজ্জিত। গর্ব করার মত উপকরণ সমৃদ্ধ হয়েও কৈবর্ত সমাজ আজ নিদারুণ গ্লানিতে ভোগছে। কৈবর্ত মায়েরা তাই নীরবে চোখের জল ফেলে, সন্ধ্যা হলে পথের ধারে দাঁড়িয়ে ডাকে- ‘আয় খোকা আয়, ফিরেআয়’।

কোন মন্তব্য নেই: