“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১২

লিটল ম্যাগাজিন ....................

প্রবুদ্ধসুন্দর কর
(প্রবুদ্ধ ঈশানের পুঞ্জমেঘের লেখক, কিন্তু সম্ভবত প্রায়োগিক জটিলতা তাঁকে এখানে লেখার থেকে দূরে রাখে। এই লেখাটা তাই , আমরা তাঁর হয়ে তুলে দিলাম, কিন্তু আশা করছি, আগামীতে তিনি স্বয়ং খানিক সক্রিয় হবেন। তাঁর লেখা সংরক্ষিত থাকা খুবই জরুরি!)

বাংলাসাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের 'বঙ্গদর্শন'-ই একমাত্র লিটল ম্যাগাজিন, অনেক আগে এক সাক্ষাৎকারে এরকম একটি মন্তব্য করেছিলেন কথাসাহিত্যিক অমিয়ভূষণ মজুমদার। হয়তো এই একই স্নবারি থেকে তিনি বলেছিলেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'চিলেকোঠার সেপাই' না পড়লে আমি জানতামই না, সতীনাথ ভাদুড়ির পর বাংলা উপন্যাস লেখা হয়েছে। লিটল ম্যাগাজিন প্রসঙ্গে অমিয়ভূষণের এই মন্তব্যে সম্পাদককুল রে রে করে তেড়ে আসার আগে অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিন করিয়েদেরই আবারও একটু আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন।

            তারুণ্যের স্পর্ধা ও উন্মাদনায় প্রকাশিত অনেক লিটল ম্যাগাজিনকেই প্রথম দিকে ছাড় দিলেও একটা সময়ে এসে সেইসব কাগজের ক্রমপরিণতির প্রত্যাশা লেখক ও পাঠকদের মধ্যে তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আগেও শুনে এসেছি, এখনও যে শোনা যায় না তা নয়, আরে লিটল ম্যাগাজিনই তো করছে; খুনখারাবি ছিনতাই রাহাজানি তো আর করছে না। যেন সমস্ত অপরাধ ও অপকর্ম প্রতিরোধের বিকল্প লিটল ম্যাগাজিন! আবার লিটল ম্যাগাজিনের দোহাই দিয়ে কোনও কোনও সম্পাদকের সংঘটিত অপরাধ ও অপকর্মের নজিরও কম নয়।

           কেন লিটল ম্যাগাজিন করব বা করছি? সম্পাদক হিসেবে আমার যোগ্যতাই বা কী? এইসব আত্মপ্রশ্নের মোকাবেলা ক-জন সম্পাদকই বা করে থাকেন? সম্পাদনার কাজটি যে অ্যাসেমবল্ড কম্পিউটার তৈরির কাজ নয়, কিছু লেখা জড়ো করে ছাপিয়ে দেওয়ার নাম যে লিটল ম্যাগাজিন নয়, এই আত্মসমীক্ষা কি আজ তথাকথিত সম্পাদকদের জন্যে প্রাসঙ্গিক নয়? কোথায় সেই লিটল ম্যাগাজিন, যাতে লিখে কোনও তরুণ কবির নিজেকে যুবরাজ বলে মনে হয়? অধিকাংশ কাগজেই লেখার ইচ্ছেটা যেন মরে যাচ্ছে কবি লেখকদের। বাড়ছে হ্যাংলামি। বহুলপ্রচারিত বাণিজ্যিক কাগজে লেখা বেরোলে এস এম এস করে বন্ধুদের পড়ার অনুরোধ জানাচ্ছে। আজ অব্দি সেইসব বন্ধুরা কোনও লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত লেখা পড়ার অনুরোধ জানিয়ে এস এম এস পাঠায়নি।

         আজ এই সময়ে এসে লিটল ম্যাগাজিন কনসেপ্ট অনেক পাল্টে গেছে। দারিদ্রকে আইডিয়ালাইজ করার নাম আর লিটল ম্যাগাজিন নয়। হাওয়াই স্যান্ডেলের সোল কেটে লিনোকাট করে প্রচ্ছদ করার দিন শেষ। স্মৃতিকাতর যারা আজও বলেন, লিটল ম্যাগাজিন একটি অলাভজনক উদ্যোগ, ঠিক তখনই সম্পাদকের তৎপরতা নিয়ে সন্দেহ জাগে। সকালের কলগেট টোটাল থেকে শুরু করে, নোকিয়া, স্পার্ক, আই সি আই সি আই, কংগ্রেস, সি পি আই এম হয়ে রাতের ডটেড ম্যানফোর্স অব্দি যে প্রাত্যহিক জীবন বিজ্ঞাপন ও প্রতিষ্ঠানমুখর, সেই জীবন শুধু লিটল ম্যাগাজিনকে হাস্যকর বিজ্ঞাপন ও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় দেখতে চায়। কাগজ কেউ কেনে না, বলে, যেসব সম্পাদকেরা হা হুতাশ করেন, তাদের উদ্দেশে বলতে ইচ্ছে করে, কেন কিনবে? সম্পাদক হিসেবে আপনার প্রস্তুতি কতটুকু? আপনার সম্পাদিত কাগজ লেখক ও পাঠককে কি আদৌ প্রাণিত করে? নিজেকে ঝাঁকান। কেউ বলেনি আপনাকে লিটল ম্যাগাজিন করতে।

            নিগৃহীত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা নিয়েও যে প্রশ্নটি উত্থাপন করতে চাই, আপনার কাগজে যারা লিখে চলেছেন, যাদের নিরন্তর লেখার যোগান পেয়ে সম্পাদক হিসেবে আপনি প্রচার ও প্রসার পেয়েছেন, তাদের লেখালেখির কি কানাকড়ি মূল্য নেই? আপনি কী করে ভাবছেন, নিজের গাঁটের পয়সা খরচা করে কাগজ কলম কিনে,ডাকমাশুল দিয়ে আপনাকে কবি লেখকেরা তাঁদের শ্রম, অস্থিরতা, অনিদ্রাপ্রসূত লেখাটি পাঠাতে বাধ্য? আপনি হয়তো বলবেন, আপনি তাদের কবিখ্যাতি দিচ্ছেন। লেখক হিসেবে পরিচিতি দিচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাচ্ছেন, আপনার কাগজে না লিখেও, আজ একজন কবি বা লেখক তাঁর সৃষ্টিশীল অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পারে অনায়াসে। মণীন্দ্র গুপ্ত যেমন বলেছিলেন, কাব্যগ্রন্থটিতে ভালো করে কীটনাশক মাখিয়ে মহাকালের গহ্বরে ছুঁড়ে দিতে।                                                                                                

কোন মন্তব্য নেই: