চা ( ইংরাজি ‘টি’) শব্দটা এসেছে চীন দেশের ফা-কিয়েন অঞ্চলের ‘ té ’ থেকে। চা, কম্বোডিয়া ভাষায় এর নাম 'chá' এবং ওই নাম নিয়েই সে বিশ্ব ভ্রমন করেছে, গেছে জাপান, ইরান, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং এসেছে আমাদের ভারতে। চীন দেশের লোকেরা খ্রিস্টের জন্মের দুহাজার বছর আগে থেকেই চা এর সবুজ তরতাজা পাতাকে জলে সেদ্ধ করে ওষুধ হিসেবে পান করতেন। পরবর্তীতে চার খ্রিস্টাব্দের মধ্য ভাগে দেওয়া চীনদেশের কুও পু-র তথ্য থেকে সে দেশে চা গাছ রোপণ এবং চা-পান এর বর্ণনা পাওয়া যায়। তাতে উল্লেখ আছে, চিনের ইউনান- প্রদেশের ক্সিসুয়াংবানা অঞ্চলে চায়ের প্রথম চাষ শুরু হয়েছিলো ২২০ থেকে ২৬৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। ওই ইউনান-প্রদেশ থেকেই নদী-পথে ভিয়েতনাম ও বার্মা দিয়ে ভারতে চায়ের আবির্ভাব ঘটে। ১৯৫০ সালে হোয়াইট সাহেবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী চীন দেশের ইরোয়াদি নদী থেকে ইয়াঞ্জিকিয়াং নদী দিয়ে চীনের পূর্বপ্রান্তে, মেকং দিয়ে চীনের দক্ষিণ-পূর্বে, সালুইন দিয়ে আরও দক্ষিণে এবং সবশেষে লুইত নদ দিয়ে পশ্চিম-প্রান্তে অর্থাৎ আসামের চা এর আগমন ঘটে।
ব্রুস সাহেব এবং উনার ভাই (বলা হয় ব্রুস-ব্রাদার্স) ১৮২৩ সালে প্রথমবারের মত আসামের জঙ্গলে পাহাড়ি চা-এর গাছ দেখতে পান। তাঁরা অনুমান করেছিলেন পাহাড়ি উপজাতি লোকেরা একসময়ে ওটা চাষ করেছিল, এবং শিফটিং কালটিভেশন এর প্রচলিত প্রথায় সে স্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। পরবর্তীতে ১৯০৩ সালে ওয়াট এবং মান সাহেব-দ্বয়ের দেওয়া বিবরণে ওই একই তথ্য পাওয়া যায়। সে রকমের জংলী চা গাছ ওই সময়ে আসাম, মনিপুর, মিজোরাম, বার্মা, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছিল। চা-ঐতিহাসিকরা একমত যে, এতদঞ্চলে জুমচাষ প্রথায় চায়ের প্রাথমিক চাষ উনিশ শতকের গোঁড়ার দিকেই হয়েছিল।
চা শিল্পের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সহায়ক হিসেবে যে কটি বিষয় অবশ্য স্বীকার্য তাদের অন্যতম হল, ১) এই শিল্পের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো রয়েছে, ২) বেশ ভালো সংখ্যক আত্ম-নিয়োজিত চা কর্মী রয়েছেন, ৩) শিল্পের তথ্য ও গবেষণার দিকটাও বেশ উন্নত এবং ৪) এ শিল্পে প্রচুর মাত্রায় সুদক্ষ ও স্থায়ী শ্রমিক-রা রয়েছেন। এতোসব অনুকুল পরিকাঠামো থাকার সুবাদেই সবুজ পাতা নির্ভর এই চা শিল্প এক উল্লেখযোগ্য জায়গায় স্থান করে নিয়েছে।
বরাক উপত্যকার চিত্র কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন। বরং বলতে দ্বিধা নেই, দেশের বা বিশ্বের অন্যত্র উদ্ভিদ নির্ভর এই শিল্পের অনুকুল জল হাওয়া বিদ্যমান, আর প্রাকৃতিক ও ভৌগলিক কারনেই এ উপত্যকা পিছিয়ে। তথাপি, আশার কথা, এ অঞ্চলে নিয়োজিত চা কর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টাই এ প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার পক্ষে সহায়ক।
এ উপত্যকায় ছোটবড় মিলিয়ে মোট ১২১ টি চা বাগান রয়েছে। তার মধ্যে আনুমানিক ১০০ হেক্টর রয়েছে শতকরা ৩.৭১ ভাগ (মোট ১,১৬৮ হেক্টর), ১০০ থেকে ২০০ হেক্টর সম্পন্ন বাগান শতকরা ১০.৩৫ ভাগ (মোট ৩,২২৫ হেক্টর), ২০০ হেক্টর বা তদুর্ধে জমি থাকা বাগান শতকরা ৪৫.৩৩ ভাগ (মোট ১৪,১২৯ হেক্টর) এবং বড় বাগান, অর্থাৎ ৪০০ হেক্টর বা তারও বেশী জায়গা থাকা বাগান শতকরা ৪০.৬১ ভাগ। এছাড়াও ইদানিং কালে অনেক ছোট ছোট নতুন চা বাগান গড়ে উঠছে, এবং কিছু কিছু বাগান তাদের পতিত জমিতে নতুন করে চা রোপণ করছে। সবমিলিয়ে সাম্প্রতিককালে এ উপত্যকায় ৩৫,০০০ হাজারেরও বেশী জায়গা জুড়ে চা গাছ রয়েছে।
কোনও কোনও ক্ষেত্রে পুরনো চা গাছের ডালপালা সম্পূর্ণ ছেঁটে দিয়ে টা থেকে নতুন ডালপালা বেরুতে দেওয়া হয়। ইংরাজি পরিভাষায় একে ‘রিজুভিনেশন প্ল্যানটিং’ বলা হয়। এ উপত্যকায় শতকরা ৪০ ভাগ চা গাছের বয়স পঞ্চাশ বা তার বেশী। তাই, রিজুভিনেশন পদ্ধতিতে কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রায় তিনগুন ফসল বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। মাতির উর্বরাশক্তি বাড়িয়ে তোলার জন্য অন্যান্য ফসলের মত চা গাছেও সার প্রয়গ করা হয়। এতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রয়াস এবং প্রতি কিলো প্রস্তুতিকৃত চা-এ এর মুল্যমান প্রায় এক টাকার মত। কীটপতঙ্গ জনিত কারনে এ শিল্পে শতকরা ৬ থেকে ৩০ শতাংশ ক্ষতি হয়ে থাকে। তাই এদের দমনের জন্যও যথেষ্ট পরিমান শ্রম ও অর্থ খরচ হয়ে থাকে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রস্তুতিকৃত চা-তে কীটনাশকের মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এটাকে ‘ ম্যাক্সিমাম রেসিডিউ লিমিট’ বলা হয়। বাজার-জাত চা তে এর মাত্রা কাঙ্খিত ভাবেই কম থাকে, যদিও অনবধানতা বশতঃ কখনও কখনও তা মাত্রার বাইরে লক্ষ্য করা গেছে। তবে সেরকম ঘটনা খুবই কম।
যেহেতু চা একটা প্রকৃতি নির্ভর শিল্প, তাই প্রাকৃতিক পরিবেশের তারতম্যের সাথে এ শিল্পের উত্থান-পতন অনেকটা জড়িত। চা শিল্পে নিয়োজিত কর্মী সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোকেরাই এ সমস্ত প্রাকৃতিক ঝড়-ঝাঁপটা সামাল দেওয়ার পদ্ধতিটা সুকৌশলে করায়ত্ত করে নিয়েছেন, এবং এর ফলস্বরূপেই এ শিল্পের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় চায়ের যথেষ্ট কদর রয়েছে, এবং ফি বছর বিদেশি মুদ্রাও দেশ কামাচ্ছে। আজকের দিনে গোটা বিশ্বের যে সমস্ত দেশ ভারতের চা পান করছে, তাদের মধ্যে উল্লেখ্যোগ্য, আজারবাইজান, কাজাকিস্থান, রাশিয়া, ইউক্রেন, উজবেকিস্থান, আফগানিস্থান, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ইরাক, ইরান, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, জাপান, জর্ডান, লিবিয়া, মাসকট, নেদারল্যান্ড, পাকিস্থান, পোল্যান্ড, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুদান, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইয়েমেন এবং আরও অন্যান্য দেশসমুহ।
বিপুল সম্ভাবনাময়য় এই শিল্প সাড়া দেশজুড়ে কয়েক লক্ষ লোককে কর্মসংস্থান পথ খোলে দিচ্ছে, যা প্রকারান্তরে সরকারের বেকারত্ব লাঘবের পক্ষে সহায়ক। অতি সম্প্রতি, এই শিল্পে জড়িত আধিকারিকেরা উগ্রপন্থা এবং অন্যান্য নিত্যনতুন সমস্যার সম্মুখীন। দেশের কর্নধারদের তাই এ শিল্পের প্রতি সহানুভুতির মনোভাব নিয়ে সহযোগিতার হাত আরও বাড়িয়ে দেওয়া উচিত নয় কি?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন