“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১২

শিক্ষার অধিকার : আশা ও আশঙ্কা

                            (লেখাটা বেরিয়েছে ৫ এপ্রিল, ২০১২ তারিখের 'যুগশঙ্খ'-এ)
শিক্ষা নিয়ে গোটা দেশে বেশ একটা সোরগোল শুরু হয়েছে ইদানিং। এর রাজনৈতিক শুরুটা ২০০৯ সালে, ‘শিক্ষার অধিকার’ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে। যে প্রশ্নটা প্রথমেই মাথাচাড়া দেয় তা হচ্ছে স্বাধীনতা লাভের বাষট্টি বছর পর হঠাৎ এই বোধোদয় কীসের দৌলতে? যা লক্ষণীয় তা হল আইনটি এমন এক সময়ে প্রণীত যখন শিক্ষার বেসরকারীকরণ নিয়ে অসন্তোষ ক্রমশ  তীব্রতর হয়ে উঠছে। এই প্রেক্ষাপট মনে রাখলে আমাদের সংশয়ের কারণ সহজে বোঝা যাবে।  পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের এই দেশে আইনের কমতি নেই, নিত্য নতুন আইন প্রণয়নেরও খামতি নেই। প্রণীত আইনের প্রয়োগের তুলনায় অপপ্রয়োগের দৃষ্টান্তই অধিক। আর টি আই কিংবা এনরেগা-র অভিজ্ঞতা কতটা আশাব্যঞ্জক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমতাবস্থায় শিক্ষা বিষয়ক আইনের ওপর আস্থা, আশা-ভরসা সাধারণ মানুষের থাকা উচিত কি অনুচিত তা নিয়েই বিতর্ক চলতে পারে। আমরা আপাতত বিতর্কের পথ পরিহার করে বরং একটু অন্যদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে আগ্রহী।
আইনটি প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য, ৬ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের নিখরচায় বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রদানউক্ত আইনে এই অধিকার দেওয়া হয়েছে ওই বয়সের শিশুদের, অন্তত কাগজে কলমেঅবশ্যই সুসংবাদ। অন্তত পক্ষে দেরিতে হলেও এ কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে এতদিন ধরে উক্ত অধিকার যে কারণেই হোক অস্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু আইনি স্বীকৃতি মিললেও বেশ কিছু সমস্যাও রয়েছে। ছ’বছরের নীচের শিশুদের ‘প্রি-স্কুল’ শিক্ষার বিষয়ে কোন উল্লেখ নেই এতে, ১৪ বছরের পর  ‘ড্রপ আউট’ রোধ করা সম্পর্কেও কোন উচ্চবাচ নেই। সব চেয়ে বড় কথা, শিশুরা তো এই ‘আইনি অধিকার’ দাবি করার কিংবা আদায়ের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের অবস্থায় নেইগ্রামগঞ্জের প্রান্তিকায়িত অভিভাবকরাও শিক্ষার অভাবে সে দাবিটা করতে সক্ষম হবেন বলেও মনে হয় না। যদি বা কেউ করেনও, তাতেও ফললাভ কতদূর হবে তা অনিশ্চিত। বাকি রইল সামাজিক সংগঠনের ভূমিকা। এটা বলা বাহুল্য যে, দু একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে এযাবৎ সামাজিক সংগঠনগুলোর সেরকম সদর্থক ভূমিকা নজরে পড়েনি।  
তাছাড়া আরো একটা বড় সমস্যাও আছে। কেউ যদি প্রাপ্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে তার জন্য কে বা কারা দায়ী হবে, কিংবা জবাবদিহি করবে কে? ধরা যাক, আঠারো বা কুড়ি বছর বয়সে কেউ বুঝল যে শিক্ষার অধিকার থেকে সে বঞ্চিত হয়েছে এবং তার জন্য সে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গের অভিযোগ আনল। তখন কি হবে! প্রতিবিধান কী? সে ক্ষতি পূরণ হবে কীভাবে? হওয়া সম্ভব? এরকম অনেক প্রশ্নের উত্তর আমাদের অবশ্যই খুঁজতে হবে। কেননা, আইনের অন্ধদৃষ্টি সেদিকে মোটেও নজর দেয়নি। অতঃপর রাষ্ট্র হয়ত চাপে পড়ে এরকম বঞ্চিতদের আশ্বস্ত করতে বি পি এল মার্কা অন্য কোন ‘স্কিম’ ঘোষনা করে ‘সহৃদয়তার’ পরিচয় দেবে। বাস্তবে নিটফল কী দাঁড়াবে সে তো সবার জানা। বি পি এল কিংবা অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা নিয়ে অগণন  গণিতজ্ঞের প্রতিবেদনে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’টা তো আর কারো বুঝতে বাকি নেই। ঠকে ঠকে নাস্তানাবুদ এদেশের মানুষের ঈশ্বরবিশ্বাসের মত করুণ বিশ্বাসও অবশিষ্ট নেই আর।    
আরো একটা মারাত্মক ব্যাপারও ঘটতে পারে। সেটাই সবচেয়ে আশঙ্কার কথা। এমনও হতে পারে যে দেখা  গেল সব দোষ পিতামাতা কিংবা অভিভাবকের ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হল (মার্কিন মুলুকে যেমন হয়)যুক্তি? তার কি আর অভাব হবে! আদালতে দাঁড়িয়ে সরকার পক্ষের কৌঁসুলি হয়ত এই বলে সাফাই দেবেন যে, বিদ্যালয় ছিল, বিনা পয়সায় পড়বার সুযোগও ছিল,  কিন্তু অভিভাবকরা যদি সুযোগ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক না হন তাহলে সরকারের কি বা দোষ? যুক্তি অকাট্য, সন্দেহ নেই। আদালত যদি সায় দেয় তো জজ সাহেবকেও দোষ দেওয়া যাবে না। শেষ রাতে ওস্তাদের মার যে এভাবেই আসবে না তা হলফ করে বলা মুশকিল। কেন তা বলছি। এদেশে কৃষকদের  আত্মহত্যা নিয়ে এরকম খেলাই চলছে প্রতিদিন। আসলে ঢুঁস খেয়ে খেয়েও আমাদের পুরো হুঁস হয়নি এখনো।

গোটা দেশে দেনার দায়ে কৃষকের আত্মহত্যা নিয়ে হৈ চৈ তো কম হল না। এ হেন লজ্জাকর ঘটনা চাপা দিতে গিয়ে সরকারের অবস্থা অনেকটা ‘আঁচলে মুখ ঢাকতে গিয়ে গা উদোম’ হওয়ার যোগাড়। যারা আত্মহত্যা করেছে তারা যে সত্যি সত্যি কৃষক সেটা সাব্যস্ত করার জন্য নাকি স্ব-নামে জমি থাকাটা আইনের চোখে অতীব জরুরি। ফলে ঘটনা দাঁড়িয়েছে এমন যে বাপ-ঠাকুর্দার নামে থাকা জমিতে যারা চাষবাস করেছে আইনের চোখে তারা কৃষকই নয়। তাদের আত্মহত্যাও অতএব, আর যা হোক কৃষকের আত্মহত্যা নয় কিছুতেই। সত্য লোপাট আর কাকে বলে! এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের এর চেয়ে উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আর হয় না। কৃষকের আত্মহত্যাও গায়েব, সাথে আর্থিক ক্ষতিপূরণও হাপিস। এই হচ্ছে আইন রক্ষার, পরিকল্পনা রূপায়নের বাস্তব চিত্র। রক্ষকের মুখোসের আড়ালে নির্লজ্জ ভক্ষকের মুখ সর্বত্র বিদ্যমানএ হেন রাষ্ট্রব্যবস্থা দেশের নিরীহ ও দরিদ্র জনসাধারণকে যা-ই  দেয় বা দিতে পারে তার ধরণটা আসলে ‘উড়ো খৈ গোবিন্দায় নমঃ’ গোত্রের। মুখোসটা বজায় রাখতে গিয়ে নেহাত উপায়ান্তর না হলে সেটুকুও হয়ত জুটত না। ঘর-পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখেই ডরায়। তাই আশঙ্কা, শিক্ষার অধিকার সংক্রান্ত আইনও শেষ পর্যন্ত না উলটো ফল প্রসব করে বসে। রত্নাকর ‘মরা’ জপতে জপতে ‘রাম’ উচ্চারণ শিখে বাল্মীকি হয়েছিলেন, আর এযুগে ‘রাম’-নাম জপের মহড়া অবশেষে বাল্মীকিকেও না রত্নাকর বানিয়ে ছাড়ে সেটাই ভয়ের !

আশঙ্কা যে অমূলক নয় এটা বোধকরি সকলেই মানবেন। তবুও কোন এক মধ্যবর্তী আলে দাঁড়াবার আশা নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। কাজটা বিরাট সন্দেহ নেই, অত্যন্ত দুরূহও নিশ্চয়। তবে  সদিচ্ছা থাকলে অসাধ্যও নয়। তার জন্য যথার্থ পরিকল্পনা দরকার। আসলে আমরা ‘কী করি’ আর ‘কী করতে চাই’ তাতেই বিরাট তারতম্য ঘটে যায়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান হাল কি দেখা যাক। এদেশের ২৫% মানুষ নিরক্ষর। পঞ্চম শ্রেণিতে পৌঁছে ৪২% শিশু স্কুল ছেড়ে দেয় - অর্থাৎ, ড্রপ আউট। যে কোন শ্রেণিতে স্কুল-ছুটের হার কমেও ১০%। গড়ে ২৫% শিক্ষক যে কোন সময় স্কুলে গরহাজির থাকেন। ৭৫% হাজির থাকলেও মাত্র ৪৭% সক্রিয় ভাবে শিক্ষা প্রদানে রত দেখা যায়। এর পেছনে নানা কারণ আছে। আপাতত সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না, আমরা কেবল মাত্র বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরার চেষ্টা করছি ।  এছাড়া স্কুলের সংখ্যা ও উপযুক্ত পরিকাঠামো, শিক্ষকের ঘাটতি (পরিমাণ ও গুণগত) ইত্যাদি বিষয় তো রয়েছেই। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে যে, সরকরি স্কুলের শিক্ষার গুণগত মান নিম্ন। সরকার শিক্ষার  আইনি অধিকার দিয়েছে সত্য, কিন্তু সে শিক্ষার মান কী হবে তার উল্লেখ নেই। শিক্ষা মানে তো তেমন কিছু যার দৌলতে সামাজিক গুণগত পরিবর্তন  দৃষ্টিগোচর হবে। অর্থাৎ, শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখতেই হবে। শুধু তাই নয়, শহর ও গ্রামাঞ্চলে  একই মানের শিক্ষার সুযোগ চাই। নতুবা সামাজিক সাম্যের বিপরীতে অসাম্য বৃদ্ধি পাবে।   
 তাই কেবল স্কুলঘর নির্মাণই সব নয়, প্রয়োজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষকের (ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ৩০:১ হওয়া বাঞ্ছনীয়)চাই বিজ্ঞানসম্মত পাঠ্যক্রম ও শিক্ষা-পদ্ধতি, মূল্যায়নের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পন্থা। স্কুলের ভারি ব্যাগের পাশাপাশি সবুজ খেলার মাঠ,  এবং আরো, আরো অনেক কিছু। অবশ্যই প্রয়োজন বিরাট ধনরাশিরও কিন্তু আইনকে বাস্তবে  প্রয়োগের প্রশ্নে সরকারি তরফে এযাবৎ অর্থের জোগান (যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়) ধরা ছাড়া আর কোন পদক্ষেপ গ্রহণের আগ্রহ আছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং খানিকটা দায়মোচনের প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বেসরকারি বিদ্যালয়ে গরিবদের জন্য ২৫% আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে আইনে। সুবন্দোবস্ত নিশ্চয়! কিন্তু এর থেকে এটাও স্পষ্ট যে প্রয়োজনানুসারে যথেষ্ট সংখ্যক সরকারি স্কুল স্থাপনের প্রশ্নে বর্তমান সরকার বাহাদুরও নিঃসন্দিগ্ধ নয়। তাই প্রাইভেট-পাব্লিক পার্টনারশিপের মোহনীয় দাওয়াই লোহার বাসরে কাল কেউটের প্রবেশের ছিদ্রপথ নয় তো? গ্রামীণ স্বাস্থ্য অভিযানে যে ‘মহৎ কেলেঙ্কারি’ গুলো ঘটেছে তার থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন কি ছিল না!
পরিহাসপ্রিয় আমজনতার একটা অংশের কাছে ‘সর্বশিক্ষা’ যে ‘সর্বনাশা শিক্ষা’য় পর্যবসিত তার খবর জানে না দিল্লির জনপথ! এই পরিহাসের আড়ালের ‘নিষ্ঠুরতা’টুকু উপলব্ধি করতে না পারার একটাই অর্থ, আর তা হল, আমজনতার আস্থালাভের প্রশ্নে চূড়ান্ত অনীহা। আইন-আদালত নয় কেবল, গোটা ব্যবস্থার উপরই বীতশ্রদ্ধ এদেশের সাধারণ মানুষ। কোনও প্রকল্প পরিকল্পনার কাছেই মানুষ আসলে কিছু প্রত্যাশা করে না আর। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের সুনিশ্চয়তাহীন মানুষের কাছে ‘শিক্ষার অধিকার’ কি বস্তু - খায় না মাথায় দেয়! আমাদের মাতৃ এবং শিশু মৃত্যুর হার আফ্রিকার নিতান্ত গরিব দেশের মানুষকেও লজ্জা দেয়। পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের অর্ধেকের বেশি যেখানে অপুষ্টির শিকার সেখানে ছ’ বছরে যারা স্কুলে ভর্তি হবে তাদের অর্ধেকই থাকবে অপরিণত। শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে এরা স্বাভাবিক কারণেই পিছিয়ে পড়তে বাধ্য। অথচ এসব দিকে কারো নজর দেবার ফুরসত নেই। শিক্ষার বিষয়টা যে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, অন্য অনেক কিছুর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জোড়া সামাজিক বিষয় তা বোঝা দরকার। মায়ের স্বাস্থ্যের সঙ্গে নবজাতকের স্বাস্থ্য ও মানসিক বিকাশ জড়িত, কাজেই শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে গেলে সেদিকে নজর দিতে হবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা তাই এক বন্ধনীভুক্ত হওয়া আবশ্যক। অন্যথায় লেজ-মুড়ো আলাদা হয়ে যেতে বাধ্য। স্বাস্থ্যের মত  শিক্ষাও যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং সার্বিক উন্নয়নের অনিবার্য পূর্বশর্ত সেটা যত শীঘ্র উপলব্ধি করবে রাষ্ট্র এবং প্রকৃত অর্থে সে  অধিকারের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করবে ততই মঙ্গল। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির পরিবর্তে শিক্ষার আলো প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দেবার দায়বদ্ধতা যদি স্বীকার করে নেয় কোন দল বা সরকার তাহলে আইন থাকা-না থাকায় আসে যায় না কিছু, এটাই মূল কথা। 
          
   
           

কোন মন্তব্য নেই: