“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১২

তিতলি

তিতলি,কোথায় আছো?সমুদ্রের বিস্তৃতি আছে, শুধু গিলে খায়। যেয়ো না ওর কাছে।নদীর আর্সেনিক জনিত রোগ। পেটে পাথর জমতে পারে।পৃথিবীর কাছে থেকো। এখানে সবুজ আছে, আছে নীল মুনিয়া।
পাহাড় শুধু ক্ষয় রোগীর মতো। নিজেকে নিঃস্ব করেও তোমায় আশ্রয় দেবে জানি। 

বৃষ্টি আছে, তোমার কৈশোর আছে। একটা নীল আকাশ আছে অন্তহীন। জলরঙে তুমি দেখতে পাবে তোমার প্রথম যৌবনের সব রঙ গুলি আবার নতুন করে, আমার হাত কাগজে।আমি জানি তোমার লাল রঙ খুব প্রিয়। তোমার ঠোটের রঙ লাল, তুমি লজ্জা পেলে লাল হয়ে যাও।

 প্রথম কৈশোরে, প্রথম চিনেছিলে তোমার প্রথম রক্তপাত। তোমার আজীবনের এই রঙকে। অসম্ভব ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল শরীর। ভাগ্যিস সেদিনও তুমি পড়েছিলে লাল ফুল ফুল জামা। মুখ গুঁজেছিলে মায়ের হলুদ মাখা শাড়িতে। দুই নারী শরীরের একই স্রোত ঝর্ণা হয়ে ঝরে পড়ে পৃথিবীর সমাধিতে।

প্রথম কোন বর্ষায় ভিজতে ভিজতে নিজেকেই নিজে একদিন ভালবেসে ফেললে। জলের শরীর তোমায় আদর করলো নরম করে। সেদিন নিজের দু'বুকের গভীরে বৃষ্টি ধারা গুলি আটকে গিয়েছিল মুহূর্তের জন্য। তোমার নিঃশ্বাস গরম হয়ে উঠেছিল। অহংকারী হয়ে উঠেছিল খুব! সেই প্রথম নিজেকে আবিষ্কার করেছিলে তুমি, তিতলি।

এই পৃথিবীর যাবতীয় রূপ মন্ত্রগুপ্তির মতো রপ্ত করেছিলে সেই বৃষ্টি ভেজা দিন থেকেই।তোমার শরীরী ভাষায় উচ্চারিত হয়েছিল পাহাড় ঝরে পড়ার নীরবতা। আজও ডুব দিই তোমার গভীরতায়। ঠাই পাই কোথায় বল!

আকাশের কাছে বৃষ্টি চেয়েছি আমি, এই কাঠফাটা রোদ্দুরে। আকাশের সেই ক্ষমতা কোথায়! পৃথিবীর আছে। তোমার কাছে আছে। এসো, নেমে এসো এই পৃথিবীতে।

সমুদ্রের কাছে যেওনা, নদীর কাছেও না।

পাহাড়ের কাছে এসো। বুকে পেতে দেবে আশ্রয় তোমায়। তিতলি, এবার তোমার শুধু ঝরে পড়ার সময়।
কাল রাতে প্রচন্ড ঝড়ে আমার শনের ছাউনি উড়ে গেছে। কী লাভ? তুমি তো আসবে না জানি।তাই আজ থেকে খোলা আকাশেই খুঁজবো তোমায়। আকাশের সব পথ খোলা রেখে, প্রতীক্ষা করবো রাত জেগে।

তোমার ঘর আছে, ছাদ আছে, দরজা নিয়ে গেছে অবাধ্য কালবৈশাখীর ঝড়ো বাতাস।শুনেছি কাল রাতের ঝড়ে জয়চন্দ্র এসে চিৎকার করে ডেকে গেছে তোমায়। তুমি সাড়া দাওনি। আশ্রয় দাওনি। সমস্ত দরজা বন্ধ করে রেখেছিলে!

আজ সক্কালে দেখলাম, কাল রাতের উদ্দাম ঝড়ে আমার  ঘরের দেওয়াল আবার নতুন করে লাল।  তিতলির হাতের ছাপ আমার ঘরের মাটির দেয়ালে। সবুজ শন গাছেরা ফালি ফালি করে কেটেছে তোমার হাত, ঠোট, পায়ের পাতা, নরম সোনালী নখ।

না জলের কলসি গলায় বেধে আত্মহত্যা করেনি তিতলি। বৃষ্টি ভিজে ধুয়ে নিয়েছে নাভিমূল। লাল মাটির প্রলেপ দিয়েছে বুকে।

রিলিফ ক্যাম্পের মানুষগুলি আজ সকালেও এসেছিল তিতলির তছনছ হয়ে যাওয়া বাগানকে আবার নতুন করে সাজিয়ে দেবে বলে। তাদের সামনে নিজের বুকের কাপড় আজ নিজেই খুলে দিয়েছে তিতলি।
সূর্যালোকে ঐ বুকের ঔদ্ধত্য দেখে পালিয়েছে মানুষগুলি।

পৃথিবীটা শুধু তিতলি'দেরই বারবার রক্তাক্ত করে, ঘরে বাইরে, বিছানায়, বাগানে, নদীর ধারে অথবা রিলিফ ক্যাম্পে! আর তিতলি'রা আমাদের রক্তাক্ত করে রাখে আজীবন প্রকাশ্যে।

কালো হাতগুলি আজ চালডাল দিচ্ছে মুফতে। আমিও দাঁড়িয়ে লাইনে। তিতলি'র আজ খিদে নেই। কিন্তু কিছু তো খেতে দিতে হবে তাকে। কিছু চাল আর ডাল হাত পেতে নিতেই হবে এদের কাছ থেকে। এরপর দুজন মিলে খাবো। 

দেখে নিয়ো তিতলি, একফোঁটা জল তোমার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে আজ তছনছ করে দেবে আকাশের এই রৌদ্রজ্জল অহংকে। পৃথিবী আজ কথা বলবে না।তোমার বাগানে আজ সবুজ ফুল।

তিতলি, এভাবে পৃথিবীর সব কিছু কি আজও তোমার খুব ভালো লাগে? ইচ্ছে করে ঘরের দরজা বন্ধ করে বিছানাকে দিতে তোমার কান্না! দেখো, এমন একটি পৃথিবী দেব যেখানে তুমি ভালবাসতে পারবে শুধু তোমাকেই। এসো ভাত খেয়ে নিই। এসো...।

এরপর ছাউনিটা দিতেই হবে। আকাশের অবস্থা ভালো নয় তিতলি। আজ তুমি আমার কাছেই থেকে যেও।



কোন মন্তব্য নেই: