[ আমি
সাধারণত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনুদান আয়োগের সেমিনার এড়িয়ে চলি। এগুলোতে আদৌ
বিশেষ কোনো বৌদ্ধিক আন্দোলন হয় কি না আমার সংশয় আছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়
মহাবিদ্যালয় অন্যভাবে কিছু করতে পারে কি না, সেই নিয়েও সংশয় আছে। কিন্তু
সেই সব সেমিনার যেখানে শিক্ষকদের পদোন্নতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, এবং একটি
বাধ্যবাধকতা থাকে, আয়োগের অনুদান পাবারও একটি বিষয় জড়িয়ে থাকে ফলে অধিকাংশ
আলোচনা চক্রই পরিণত হয় এক যান্ত্রিক অনুশীলনে। যারা অংশ নেন, তাদের সবটা
বলতে লিখতেও দেয়া হয় না। কেউ শোনতে চাইলেও সবটা শোনতে পারেন না। এবং অনেকেই
বিষয় জেনে নিয়ে দুনিয়ার সব বিষয়েই বিশেষজ্ঞ হবার ভান করে ফেলতে পারেন। সেই
সম্পর্কে কারো কারো বেশ প্রতিভা আছে, দেখলে চমকে যেতে হয়। কিন্তু সরসুনা
কলেজের বাংলা বিভাগ , বিশেষ করে অধ্যাপক তন্ময় বীর এবং যাদব পুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, বিশেষ করে অধ্যাপক অতনু সাহা
যখন কোনো উদ্যোগ নেন, তখন আমার মতো লোকেদের কাছেও এ এক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন
হয়ে যায়। সম্ভবত সারা ভারতেই আর একটিও বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ নেই যারা
তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের প্রতি আমাদের
দায়বদ্ধতার স্বরূপ কী হবে, তাই নিয়ে যথার্থ চিন্তনে ছাত্র-শিক্ষকদের
উদ্বুদ্ধ করবার কাজ করে থাকেন। ফলে তাদের ডাক পেলে নিজেরও দায়বোধের কাছে
জবাবদিহি করতে হয়। এর আগে এরা বাংলাতে স্টাইলশীট নিয়ে দুদিনের সেরকম
কর্মশালা করেছিলেন। গেছিলাম। গেলবারে উকিপেডিয়ার দশম বর্ষপুর্তি অনুষ্ঠানের
আয়োজন করেছিলেন। যেতে পারি নি। এবারে ২৫, ২৬ নভেম্বর, ২০১৬তে আয়োজন করলেন ""বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা’ শীর্ষক
দুইদিনের আলোচনা চক্র। গেলাম, বললাম শোনলাম সমৃদ্ধ হলাম। যারা যোগ
দিয়েছিলেন তারাও বললেন, এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। নিছক প্রমাণ পত্র
সংগ্রহের জন্যে আলোচনা চক্র ছিল না। পরতে পরতে ছিল অনানুষ্ঠানিকতা আর
দায়বদ্ধতার ছাপ। এক আন্দোলনের ছাপ, যেমনতর আন্দোলনের ফলস্বরূপে এককালে গড়ে
উঠেছিল 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ' আর বাংলা ভাষা সাহিত্যের চেহারাই দিয়েছিল
বিশ শতকের শুরুতেই, এখনো এমনটাই কিছু হতে যাচ্ছে। CDACএর
থেকে এসেছিলেন ড০ অমিত চৌধুরী। তিনি বলেই ফেললেন, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের
সেই মেজাজ আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। সেই মেজাজের পুনরুত্থান ঘটাতে ভারতে যারা
কাজ করছেন, সেই অগ্রণী সেনানীদের সহযাত্রী হতে পারবার আনন্দই আলাদা। এই
লড়াই চলছে, চলবে। এখানে রয়েছে পুরো কর্মসূচী এবং সংক্ষিপ্তসার সেখানে আমার উপস্থাপিত নিবন্ধটি এখানে সবার পড়বার জন্যে
এগিয়ে দিলাম।]
বুদ্ধদেব বসু
সম্পাদিত ‘কবিতা’ কাগজটির পরিকল্পনা,এমন কি নামকরণেও একটি মার্কিন কবিতার কাগজের বেশ প্রভাব ছিল। সেটির নাম ছিল "পোয়েট্রি'। বুদ্ধদেব বসুর জীবনকালেই
অস্তিত্ববিহীন হয়েছিল তাঁর সম্পাদিত কাগজ "কবিতা’। কিন্তু "পোয়েট্রি' কাগজটি শতবর্ষ পার করেও সমানে চলছে এক বিশাল
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে।এখন "পোয়েট্রি' আন্তর্জালে আছে।এদের আন্তর্জালীয় ঠিকানা: http://www.poetryfoundation.org/poetrymagazine/।এই নভেম্বর,২০১৬তেও
এদের তরতাজা সংস্করণ আন্তর্জালে রয়েছে।কাগজটির প্রকাশনার দায়িত্ব এখন বহন করে
পোয়েট্রি ফাউন্ডেশন।নিজেদের
আন্তর্জালীয় উপস্থিতি সম্পর্কে তাঁদের প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ এরকম:“The Poetry Foundation, publisher of Poetry magazine, is an independent literary organization
committed to a vigorous presence for poetry in our culture. It exists to
discover and celebrate the best poetry and to place it before the largest
possible audience. The
Poetry Foundation works to raise poetry to a more visible and influential
position in American culture. Rather than celebrating the status quo, the Foundation seeks to be a leader in
shaping a receptive climate for poetry by developing new audiences, creating
new avenues for delivery, and encouraging new kinds of poetry. In the long
term, the Foundation aspires to alter the perception that poetry is a marginal
art, and to make it directly relevant to the American public.” ১
শুরুতেই
এই কথাগুলোর উল্লেখের উদ্দেশ্য এই নয় যে
বুদ্ধদেব বসু যেরকম করেছিলেন ছাপাখানার জমানাতে আন্তর্জাল জমানাতে আমরাও আবার ‘পোয়েট্রি’ কাগজ
থেকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে। সেরকম বিদেশী প্রেরণার কথা এলেই যা হয়, প্রমথ চৌধুরীর সেই বিখ্যাত উক্তি মনে
পড়ে,--- ব্যাধিই সংক্রামক,স্বাস্থ্য নয়।বাংলা ‘কবিতা’ কাগজও সবটা ওদের থেকে নেয় নি নিতে পারে নি,তাই টিকতেও
পারে নি।আমরাও পারছি না এটাই সত্য।আমাদের খুব কম কাগজের জন্যে ‘মডার্ন পোয়েট্রি
এসোসিয়েশন’ জাতীয় কিছু গড়ে উঠেছিল বলে শুনেছি। ছোটখাটো পরিসরে সেরকম কিছু যদিও বা
শোনাও যায়,কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তির দানে ‘পোয়েট্রি ফাউন্ডেশন’ গড়ে উঠবার কথাতো জানিই
না।আমাদের দেশ-কাল ভিন্ন।এটাই হচ্ছে কারণ যে ওদের স্বাস্থ্যের সবটা আমরা নিতে পারি
না। আর এই কথাটা মনে না রেখে যে কোনো স্বাস্থ্যকে নিতে গেলেও তা অচিরেই ব্যাধিতে
পরিণত হয়। এমনিতেও পশ্চিমা বিদেশী
অনুপ্রেরণা আমাদের চিন্তন মনন সৃজনের জগতে আবিষ্কার করতে হয় না,সে স্বয়ং এসে
উপস্থিত হয়।আমরা এই আলোচনাতে তার সেই ব্যাধি এবং স্বাস্থ্য দু’টো নিয়েই আলোচনা
করব।
বুদ্ধদেব
বসুর মতো খুব কম লোকের সৌভাগ্য হয়েছিল ইংরেজি ‘পোয়েট্রি’ কাগজটি যখন কেবলই ছেপে
বেরুত তখন সেটি হাতে নিয়ে দেখবার পড়বার। অন্যের লেখা নিবন্ধ পড়ে হয়তো কাগজটির কথা
জেনেছিলেন কেউ কেউ।কিন্তু এখন ট্যুশনির পয়সাতে যে সাহিত্যানুরাগী যে বেকার ছেলে বা
মেয়েটি আন্তর্জাল সেবা নিজের মোবাইলে নিয়ে রেখেছেন,তিনিও ‘পোয়েট্রি’ পড়তে
পারেন।তার জন্যে তাঁকে বুদ্ধদেব বসু হবার দরকার পড়ে না। সেখানে এখন কবিতা শুধু পড়া
যায় না, পুথিপড়া সংস্কৃতির দিনগুলোর মতো কবিতা শোনাও যায়।প্রযুক্তি এবং সংস্কৃতির
বিকাশের গতি যে নয় সরলরৈখিক, বরং সর্পিল এর চেয়ে ভালো নজির আর কী হতে পারে?
আন্তর্জালের সর্পিল গতির
কথা:
ছাপা
জমানারও আগেকার পুথি সাহিত্যের কিন্তু স্থানান্তর কিম্বা কালান্তরে যাত্রার গতি ছিল অতি ধীর।খুব কম লোকে সেগুলো পড়তে পারতেন,তার থেকেও কম লোকে এগুলো
লিখতেন বা প্রতিলিপি করতেন। ফলে গান করেই,পারলে অভিনয় সহ স্রোতা-দর্শকের সামনে উপস্থিত করা হত।“অর্থাৎ লেখক-গায়ক এবং স্রোতাকে এক স্থানে কালে বসে সেসব উপভোগ করতে হত। ছাপা বই কিন্তু স্থান-কাল বদলের গতি বাড়িয়ে দিল। লেখাপড়া জানলে যে কেউ বই ছাপাতে পারেন। এবং অন্য স্থানে কালে যে কেউ সেটি পড়তে পারেন।তিনি হোন ব্রাহ্মণ কিম্বা শূদ্র,ধনী কিম্বা দরিদ্র,হিন্দু কিম্বা মুসলমান। লেখকে পাঠকে ছোঁয়াছুঁয়ির কোনো ভয় নেই।”২ পুথি সাহিত্য
জমানাতে অনেকেই অন্যের ভণিতাতে লিখতেন যেমন সত্য, তেমনি এও সত্য যে ‘ভনয়ে
বিদ্যাপতি’ বা ‘ভাইবে রাধারমণ বলে’ কথাগুলো পাঠের ভেতরে ঢুকে গিয়ে শ্রোতা-পাঠককে
শাসন করত। অন্যদিকে ছাপাপ্রযুক্তির দিনে বিশ শতকের শেষভাগে এসে এক পশ্চিমা পণ্ডিত তো ঘোষণাই দিয়েই বসলেন,‘লেখকের মৃত্যু হয়ে গেছে।’“কিন্তু সেখানেও সমস্যা আছে।বই যেখানে খুশি ছাপা হলে পাঠকের দিকে যাত্রা করে না।একটি দৃশ্যমান, ক্রম-বিকশিত এবং প্রতিষ্ঠিত
স্থির বাজার ব্যবস্থার থেকে তাকে প্রকাশিত হতে হবে। সেই বাজার যেখানে ছাপার জন্যে পুঁজি বিনিয়োজিত হয়। যেখানে পুঁজি কেন্দ্রীভূত হয়। যে বাজারে ‘ব্র্যান্ড’ তৈরি হয়।বাংলাভাষার জন্যে এই কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল কলকাতাতে প্রথমে। কলেজ স্ট্রিট তথা বটতলা বললেই চেনেন সব বাঙালি।এভাবে কলকাতা নিজেই একটা ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে গেল বাংলা বিদ্যাচর্চার। দ্বিতীয় কেন্দ্রটি গড়ে উঠেছিল উনিশ শতকেরই মাঝভাগে ঢাকার চকবাজারের ‘কেতাবপট্টি’তে। এখন এই দুই কেন্দ্র দুই দেশের মহানগর। দুই কেন্দ্রর দুই স্বতন্ত্র পরিধিও।পরিধিতে প্রকাশিত বই পত্র কেন্দ্রের বাজারে বিকোয় না বিশেষ,কেন্দ্রের বাজারে প্রকাশিত বই পরিধিরও স্বাতন্ত্র্য ঢেকে ফেলে।ছাপা বইয়ের স্থানান্তর কিম্বা কালান্তর ঘটতে পারে,কিন্তু ছাপানোর স্থান তথা কেন্দ্রটি নড়াচড়া করবে না কিছুতেই।ফলে লেখক লেখিকারও কেন্দ্রীভবন ঘটে সেখানে। জন্মভূমি ছেড়ে কর্মভূমিতে বাসা বাঁধা তাদের স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায় ঠিক সেরকম যেরকম স্বপ্ন হত রাজসভাতে গিয়ে ঠাই নেবার প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজে।অর্থাৎ পুথি জমানার মতো ছাপার যুগে লেখককে ব্রাহ্মণ বা বনেদী হতেই হবে এমন কথা বিশেষ নেই বটে, কিন্তু তাঁকে কেন্দ্রের মানুষ হতেই হবে।না,যদি হন সেখানে পাড়ি দেবার আর্থিক এবং বৌদ্ধিক ক্ষমতা থাকতে হবে।অন্যথা তিনি লিখতে পারেন,বই/পত্রিকা ছাপতেও পারেন।কিন্তু সেই ছাপা বই যে গতিতে কেন্দ্রাভিমুখী যাত্রাটি করবে,কেন্দ্র থেকে ছাপা যে কোনো বই বা পত্রিকা পরিধি মুখে যাত্রা করে তার থেকে সহস্রগুণ বেশি দ্রুতিতে।তাই আমাদের আমজনতার এখনো এই সংস্কার ঘুচে যায় নি যে বিশ্বের সেরা গ্রন্থগুলো লেখা হয় মূলত পশ্চিমা কিছু মহানগরেই,আর বাংলাতে যা কিছু হয় সবই কলকাতায়।কলকাতার কোনো কাগজে লেখা বেরুলে আমাদের অসমেরও বহু লেখকের এখনো উল্লাসের কোনো সীমা থাকে না। তাতে করেই তৈরি হয় রণজিৎ দাস এবং শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর পাঠকপরিচিতি ভেদ।এই উল্লাস শুধু প্রকট করে ‘ছাপা বই যুগে’র বৌদ্ধিক সীমারেখাকে।আন্তর্জাল সেই সীমারেখাকে ভেঙ্গে দিয়েছে। কোনো রেখাই রাখে নি দাবি করা যাবে না বটে,অধিকাংশ মানুষের হাতে এখনো কম্প্যুটার কিম্বা মোবাইল পৌঁছায় নি। পৌঁছালেও ভাষাজ্ঞান পৌঁছায় নি। কিন্তু যে দ্রুতিতে পৌঁছোনো শুরু করেছে সে দুই শতকের ছাপা বইয়ের দ্রুতি থেকে অকল্পনীয় ভাবে বেশি।বইয়ের দুই শতকের দৌড় কম্পিউটার দুই দশকে পার করেছে বললে কিছুই অত্যুক্তি করা হয় না। আপাতত বইয়ের বাজার হিসেবে বেঙালুরু হয়তো কলকাতাকে পেছনে ঠেলেও দিয়েছে,কিন্তু সে স্থায়ী হবার নয়,আর লেখককেও বেঙালুরু দৌড়োবার কোনো কারণ নেই।” ৩
তার উপরে আরেকটি কথা সত্য যে আন্তর্জালের অধিকাংশ বিষয়ই তো প্রায় বিনামূল্যে।কারো যদি একটি মোবাইল,ট্যাবলেট,ল্যাপটপ কিম্বা কম্পিউটার আছে আর কোনো এক সেবাদায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক সেবামূল্য দিয়ে আন্তর্জাল সংযোগ দিয়ে রেখেছেন,তবে তিনি আর একটিও পয়সা খরচ না করে লেখক,সম্পাদক,প্রকাশক এবং পাঠক হতে পারছেন।এখন তিনিই কেন্দ্র---কলকাতা নয়।বাকি দুনিয়া তাঁর পরিধি।ঘটনা এরকমই অনেকটা।এরকম লক্ষ-কোটি
বৃত্ত, আরো সঠিক করে বললে, ‘গোলক’ মিলেই তৈরি হয় এক বৃহৎ জাল,যার নাম আন্তর্জাল
তথা internet। যে মঞ্চগুলো তিনি ব্যবহার করবেন যেমন গোগোল প্লাস,ফেসবুক,টুইটার,ব্লগার,ওয়ার্ডপ্রেস ইত্যাদি বহু সামাজিক মাধ্যম ---সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ হয় তো হয়ে থাকে পশ্চিমা বা পূব এশিয়ার কোনো দেশ কিম্বা শহর থেকে-----কিন্তু প্রকাশকদের মতো
তারা গ্রাহক-ব্যবহারকারীদের থেকে কোনো পয়সা নিচ্ছেন না। ফেসবুক হোয়াটসআপের যে কোনো ব্যবহারকারী সেটি জানেন।এ অনেকটা টিভি দেখার মতো ব্যাপার। দেখার জন্যে যে গ্রাহকের থেকে সেবামূল্যের দাবিদার অন্য। সেটি তারা সেবা দেবার আগে বা পরে নিয়ে
নেন। মূল্যের হার বা পরিমাণ মোটের উপরে স্থির। লোকে দেখেন বলে চ্যানেলগুলো তার ব্যয় তোলে নেয় বিজ্ঞাপন দাতাদের থেকে। এই সব আন্তর্জালিক মঞ্চগুলোও তাই করে থাকে।কিন্তু বিনিময়ে গ্রাহককে স্বাধীনতা দেয় টিভির থেকেও বহু বেশি। গ্রাহক সেখানে শুধু রিমোটের সুইচ বদল করছেন না,রীতিমত অংশভাগী হয়ে উঠছেন।এমন কি চাই যদি গ্রাহক সেই মঞ্চকে নিজের মতো করে সাজিয়ে উন্নত করে ফেলতে চান সেই আমন্ত্রণও খোলাখুলি গ্রাহক
ব্যবহারকারীদের দেয়াই থাকে।তার জন্যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি জুবেরকারেরও দরকার পড়ে নি, কোনো গ্রাহকেরও পড়বে না। বিল গেটসের একটি
উক্তি আন্তর্জালে ঘোরাফেরা করে,অনেকেই পড়ে থাকবেন। তিনি বলছেন, “I failed in some
subjects in exam, but my friend passed in all. Now he is an engineer in
Microsoft and I am the owner of Microsoft.”
ডিগ্রি কিম্বা লেখা পড়া নিয়ে যে মধ্যবিত্ত অহমিকা---এসবই আসলে ছাপাবই যুগের দান।প্রাক-পুঁজিবাদী যুগে ‘জ্ঞানী’ শুধু তাঁকেই বলা হত যিনি ঈশ্বরকে জানেন।এবারে শুরু হল জ্ঞানী তাঁকেই বলা---যিনি লিখতে পড়তে পারেন।আমাদের স্বাক্ষরতা
অভিযানের লক্ষ্য দাঁড়িয়েছিল,ব্যক্তিকে কেবলই নিজের নাম লিখতে সক্ষম করা সঙ্গে কিছু
সংখ্যা এবং প্রাথমিক অংক শেখানো। কিন্তু জ্ঞান কি শুধু অক্ষরজ্ঞানেই বাড়ে? তবে কি প্রাক-ছাপা যুগের গেয় সাহিত্যের স্রোতারা সবাই অজ্ঞানীই ছিলেন? কিম্বা একালের চলচ্চিত্র কি দর্শকদের বোধ বুদ্ধি সত্যি ভোতা করে দেয়?রামায়ণ –মহাভারত কিম্বা মনসা মঙ্গলের কাহিনি একাল অব্দি পৌঁছুল কী করে! সে কি শুধুই গুরুশিষ্য পরম্পরা ধরে? নির্বাক কিম্বা সবাক, লিপি কিম্বা চিত্র, নৃত্য কিম্বা অভিনয়, গান কিম্বা আবৃত্তি----মানবী বিদ্যার যত মাধ্যমকে মানুষ তার পুরো ইতিহাস জুড়ে আয়ত্ত করেছে,অর্জন করেছে কম্পিউটার তথা আন্তর্জাল এর সবগুলোকে আবার একত্রে এনে এক মঞ্চে জড়ো করেছে।আমাদের বই পড়বার অভ্যাস কিম্বা হাতে কলমে লিখবার অভ্যেসের সঙ্গেও সে বৈরিতা রাখেনি কোনো,সবার থেকে শিখেছে, সবার থেকে নিয়েছে। এবং সবার থেকে উন্নত এক প্রযুক্তি হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করেছে।তার থেকে দূরে সরে থাকবার বুদ্ধি যে ব্যক্তি কিম্বা সমাজের হবে বুঝতে হবে জরা এবং জড়তা তাকে গ্রাস করে ফেলেছে।
কম্প্যুটার নিছক টাইপরাইটার,জেরক্স মেশিন কিম্বা ডাকঘরের বিকল্প নয়।আন্তর্জাল তো নয়ই। “কম্প্যুটার তথা ইন্টারনেট এখন আমাদের সিনেমা-থিয়েটার হল,সঙ্গীত মঞ্চ,রেডিও,লেখার ঘর,পড়ার ঘর,লাইব্রেরী,বইয়ের দোকান,বাজার,স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়।এই বিষয়টি সবচাইতে
বেশি স্পষ্ট দেখা যাবে ব্লগে,ওয়েবসাইটে ঢু মারলে। সেখানে ব্যক্তি লেখক সম্পাদক প্রকাশক সবটাই।কলেজ স্ট্রীট এতো দ্রুত কাউকে ঢাকা কিম্বা টোকিওর পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারে না,যতটা পারে ইন্টারনেট। ফলে যে নগর কলকাতা এতোদিন শুধু লিখত বাকি বাংলা পড়ত,নগর কলকাতা গাইত বাকি বৃহত্তর বাংলা শুনত,নগর কলকাতা অভিনয় করত বাকি বাংলা তা দেখত--বৌদ্ধিক আধিপত্যের এই সমীকরণ যাচ্ছে উলটে।” ৪
ছাপাজমানার কেন্দ্র-পরিধির সংস্কৃতি যে
১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছিল, সেই সত্য বাংলাদেশই প্রথম আমাদের চোখে আঙুল
দিয়ে দেখিয়েছিল।বাংলা ভাষাতে ছাপাজমানার কেন্দ্র যদি ছিল কলকাতা, আন্তর্জাল জমানার
কেন্দ্র অবশ্যই ঢাকা তথা বাংলাদেশ। সেগুলো হয়েছিল মূলত সেদেশের ব্যক্তিগত বা সম্মিলিত ব্লগকে আশ্রয় করেই। বাংলাতে তাঁরাই ‘ব্লগ’ সংস্কৃতিকে জনপ্রিয় করেন।২০১০এর আগেও ভারত থেকে যারাই ব্লগ লিখতেন তাদের আশ্রয় ছিল সেই সব বাংলাদেশের সম্মিলিত ব্লগ। যেমন ‘আমার ব্লগ’,"সামহোয়ার ইন’,"সচলায়তন’,"চতুর্মাত্রিক’,"লোটাকম্বল’,‘সাহিত্যকাফে’ ইত্যাদি।আমাদের প্রায়োগিক পরামর্শদাতাও ছিলেন তাঁরাই। "কফি হাউসের আড্ডা’র মতো গুটি কয় ভারতীয় সম্মিলিত ব্লগ ছিল। ব্যক্তিগত ব্লগের সংখ্যাও খুব বেশি ছিল না। ভারতে তখন হাত-গুণা কিছু সম্পাদিত পত্রিকা ছিল।যেমন "কৌরব’,"পরবাস’।"গুরুচণ্ডালী’র মতো একাধারে সম্মিলিত এবং সম্পাদিত ব্লগগুলো।এখনও এই সম্পাদিত ব্লগ বা ওয়েব-জিনই সংখ্যাতে বাড়ছে।
বৌদ্ধিক আধিপত্য কিংবা ‘প্রতিষ্ঠানে’র
বিরুদ্ধে বাংলা ‘লিটল ম্যাগাজিনে’র এক আন্দোলন বাঙালি গড়ে তুলেছিলেন। বাকি ভারতের
সঙ্গে পূর্বোত্তর ভারতেও সেই আন্দোলনের জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনো প্রশ্নই নেই।কিন্তু
খুব কম ‘লিটিল ম্যাগাজিন’ এই প্রশ্ন তুলছিলেন যে ‘অনুষ্টুপ’,‘অমৃতলোক’,‘উৎস মানুষ’
ইত্যাদির মতো কাগজের জায়গা পূর্বোত্তর থেকে প্রকাশিত ‘সাহিত্য’,‘মুখাবয়ব’,‘নাইন্থ
কলাম’-এর মতো কাগজগুলো নিতে পারে নি কেন? প্রশ্নগুলো একেবারে উঠে নি নয়,জবাবও
মিলেছে অত্যন্ত সরল এবং বহু ক্ষেত্রেই অসত্য---গুণগত মানে পৌঁছুলে কোত্থেকে বেরুলো
কাগজ সেটি কোনো বড় প্রশ্ন নয়।কিন্তু বড় প্রশ্ন তো এটাও যে গুণগত মানে পৌঁছুতেও
একটি কাগজকে কলকাতা কিংবা পশ্চিম বাংলার থেকে প্রকাশিত হতে হয় কেন? তার উপরে সেই
কলকাতার প্রকাশিত কিছু কাগজ এতো দুর্মূল্য হয় যে সব বাজারে সেগুলো মেলেও না, আর
মিললেও আয়ে ছোট মানুষের পক্ষে কিনে পড়া সম্ভব নয়। ছোট পত্রিকার সম্পাদকেরা তো
সাধারণত দরিদ্র হন।অনেকেই বেকার অবস্থাতে ট্যুশনের পয়সাতে কাগজগুলো করেন।তারাও
আরেকটি ভালো লিটিল ম্যাগাজিন হাতের কাছে পেলেও কিনে পড়তে পারেন না।তাঁর কাছে চার-পাঁচশত
টাকার ‘অনুষ্টুপ’ কিনে পড়বার চাইতে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ টাকা ‘দেশ’ পত্রিকা কিনে পড়া
এবং সেই পত্রিকার প্রাতিষ্ঠানিক আদর্শে প্রভাবিত হওয়া অনেক সহজ।
‘অনুষ্টুপের’ মতো লিটল ম্যাগাজিন কিনে পড়বার চাইতে এখন আন্তর্জালে
আনন্দবাজার,এবেলা,আজকালের মতো দৈনিক কাগজ পড়া,তাও
বিনামূল্যে অনেক সহজ।কিন্তু ‘দেশ’ পড়া যায় না,যেমন পড়া যায় না ‘অনুষ্টুপ’।যদিও তাদের দৃষ্টি
নন্দন ওয়েবসাইট রয়েছে। সেসব ওদের বিজ্ঞাপন মাত্র।আমরা প্রতীকার্থে দু’টি নাম
নিলাম।এমনতর আরো অনেক আছে।আন্তর্জাল উপস্থিতিতে এদের সংস্কৃতি এক। হয়তো ভাবেন
আন্তর্জালে কাগজ পড়তে দিলে তাঁদের ছাপা সংস্করণের বাণিজ্য যাবে। সে হোক কয়েক কোটি
কিংবা কয়েক হাজার টাকার বাণিজ্য। সেই বাণিজ্যে পুঁজি সঞ্চয়ন হোক,চাই শুধু ব্যয়টাই
উঠে আসুক।তার বিপরীতে ‘সৃষ্টি’,‘কৌরব’,‘গুরুচণ্ডালী’,‘অনীক’,‘জয়ঢাক’,‘বাক’,‘বাংলা’,‘ও কলকাতা’, ‘ইচ্ছামতি’ ঈশানেরপুঞ্জমেঘ,কাঠের নৌকা,অন্যদেশ,‘অন্য নিষাদ’, ‘গল্পগুচ্ছ’,‘কালিমাটি’,‘প্যাপিরাস’-এর
মতো প্রচুর ভারতীয় বাংলা ব্লগ সহজেই সেই সব পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে,যারা মোবাইলে,কম্প্যুটারে
আন্তর্জাল সংযোগ নিয়ে রেখেছেন। অনেকেই হয়তো ডোমেইন কিনে নিয়েছেন,অনেকেই ব্লগস্পট, ওয়ার্ডপ্রেসের
মতো সেবামঞ্চগুলোর বিনামূল্যের ‘মুক্ত উৎস’ সেবা ব্যবহার করছেন। সেই পৌঁছে যাবার
গতিপথটি ছাপা জমানার থেকে ভিন্ন।বাংলা ভাষা,সাহিত্য এবং বৌদ্ধিক অনুশীলনের জগতে এই
গতিপথের চরিত্র বদলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগে যদি একটি সেই গতিপথকে এক বৃত্তের
কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে নানামুখী সরল রেখাতে আঁকা সম্ভব ছিল,এখন সেভাবে আর সম্ভব
নয়। এখন বৃত্তের সংখ্যা অসংখ্য,রেখাগুলো বক্র রেখা।এই চরিত্রটি সাধারণ ভাবে
আন্তর্জালের সব বিষয় সম্পর্কেই সত্য। তাই ছাপা জমানার মহানগরের আধিপত্য এখন
প্রত্যাহ্বানের মুখে,এবং ক্রম ক্ষয়িষ্ণু। বিজ্ঞাপনদাতারাও এখন ছাপা সংস্করণ থেকে আন্তর্জাল
সংস্করণে আগ্রহ দেখাচ্ছেন বেশি। এই কথাগুলো বোঝেই কিছু কিছু দৈনিক কাগজও এখন
পূর্বোত্তরীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছে।আবার পূর্বোত্তরীয় দৈনিক বের করেছে মহানাগরিক
সংস্করণ। আমরা আনন্দ বাজার এবং দৈনিক যুগশঙ্খের নাম নিতেই পারি।কলকাতার
আনন্দবাজারের এখন শিলচর সংস্করণ রয়েছে,ইংরেজি টেলিগ্রাফের গুয়াহাটি সংস্করণ
আছে।আবার শিলচরের যুগশঙ্খের রয়েছে কলকাতা সংস্করণ।আন্তর্জালীয় পরিবেশ ছাপা
সংস্কৃতিকেও তার চরিত্র বদলে বাধ্য করছে
এটি তার ছোট্ট হলেও গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। সেরকম অন্যদেশ,ঈশানের পুঞ্জমেঘ
পূর্বোত্তর থেকে সম্পাদিত হয়েও যদি বাকি ভারত বাংলাদেশের পাঠকের কাছে সুপরিচিত নাম,সেরকমই
সুপরিচিত নাম গুরুচণ্ডালী, অন্য নিষাদ সুপরিচিত পূর্বোত্তরে , বাংলাদেশে। এবং অবশ্যই সারা
বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীদের মধ্যে।
ব্লগ, মাইক্রোব্লগ,
সামাজিক মাধ্যমের জটিল কথা :
অনেকেই প্রশ্ন করবেন কথাগুলো কি এতটাই সরল? সরল যে নয়,এই সম্পর্কে আমরা সচেতন।
বিষয় যখন আন্তর্জাল,তখন তার উৎপাদিত পণ্য বা বস্তুটি আর ছাপা যন্ত্রের মতো ক্রম মেনে সরলরেখাতে যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসছে
না।ছাপাখানা কিংবা বই
বাজারের মতো কেন্দ্র থেকে বহুমুখী সরলরৈখিক পথ ধরেও সেগুলো পাঠকের কাছে গিয়ে পৌঁছচ্ছে
না। সে অবস্থাতে তার সম্পর্কে কোনো আলোচনাও আর সরলরেখাতে করা যায় কিনা,সেই নিয়ে
আমাদের সংশয় আছেই।কিন্তু সংক্ষেপে বলতে গেলে আমাদের সরল উপস্থাপন ভিন্ন কোনো
বিকল্প নেই।
আমরা ব্লগ নিয়ে কথা বলছি এমন একটা সময়,যখন তার ‘স্বর্ণযুগ’টি
বলতে গেছে বিদায় নিয়েছে বছর পাঁচ ছয় হয়েই গেল।বাংলা ভাষাতে সেই ‘স্বর্ণযুগে’র নেতৃত্বে আর ছিল না কলকাতা
বা পশ্চিম বাংলা,ছিল বাংলাদেশ।এটি একটি চিত্তাকর্ষক বৈপরীত্য যে বাংলা ব্লগের
স্বর্ণযুগটি ঠিক সেই সময় বিদেয় নিয়েছে যখন কিনা ভারতবর্ষে আন্তর্জালে বাংলার
ব্যবহারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে ফেসবুক।বাংলাদেশে সেই কাজ বহুদূর
আগেই এগিয়ে রেখেছিল বাংলা ব্লগ,সংবাদ পত্র ইত্যাদির ওয়েবসাইট।তার জন্যেই ফেসবুকের
জনপ্রিয়তার বহু আগেই আমরা সেই দেশ থেকেই আরো বহু বাংলা লেখার কি-বোর্ডের পাশাপাশি
পেয়েছিলাম অভ্র-কি-বোর্ড’।পশ্চিম বাংলার বৈশাখী কি-বোর্ডের বয়স কিন্তু সেরকম প্রাচীন
নয়,সেরকম জনপ্রিয়ও হতে পারে নি। ভারতে আমরা আন্তর্জাল বললে আর ব্লগ চিনিনা,চিনি
ফেসবুক। আমরা অনেকে ই-মেইলকেও
ভুলতে বসেছি,মাঝে মধ্যে ব্যবহার করলেও,ইমেলকে ব্যবহার করেও যে কত বিচিত্র কাজ
এককালে করা যেত,আজকের তথ্য-প্রযুক্তিতে উচ্ছ্বসিত অনেকেই সেসব জানেনও না,বোঝেনও
না। তাঁদের আন্তর্জালে নিয়েই এসেছে ফেসবুক।তাহলে আমরা ‘ব্লগ’ নিয়ে বলছি কেন? সেই
প্রশ্নেই আমরা আসছি।
এমন নয় যে ‘কৌরব’,‘অন্য
নিষাদ’,‘ঈশানের পুঞ্জমেঘ’-এর মতো আন্তর্জালীয় অন্তর্বস্তুকেই ব্লগ বলে। আনন্দবাজার
পত্রিকার ওয়েবসাইটে গেলেও ঐ সেদিনও দেখা যেত ‘ব্লগ’ বলে একটি অংশ রয়েছে।
আন্তর্জালে অধিকাংশ বিষয়ই আসে ওয়েবসাইটের রূপেই। কিন্তু মোটা দাগে যেগুলোর
অন্তর্বস্তু চরিত্রগতভাবে স্থির,নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় না সেগুলোকেই ওয়েবসাইট
বলে। যেমন সরকারি –বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইট। কিন্তু যেগুলো নিয়মিত
হালনাগাদ করা হয় সেগুলোকেই ব্লগ বলে। সেগুলোর অধিকাংশই বৌদ্ধিক চর্চার মঞ্চ। সেই
চর্চা হতে পারে সাহিত্য,বিজ্ঞান,কৃষি-অর্থনীতি যাই হোক। সেদিক থেকে যে কোনো দৈনিক
কাগজের সাইটকেও ব্লগ বলাই যেতে পারে। মূলে কথাটা ‘ওয়েবলগ’।এরও যাত্রা শুরু
পশ্চিমে,সেই ১৯৯৭তে।মূলত
আন্তর্জালে দিনলিপি লেখার প্রয়াস দিয়ে দেড় দশক আগে যে সংস্কৃতি যাত্রা শুরু করেছিল,তার এখন বৈচিত্র্য এবং ভাণ্ডার বিশাল।দশ বছরের মাথায় উইকিপেডিয়া
জানিয়েছিল ডিসেম্বর, ২০০৭-এ ব্লগ
খোঁজারু ইঞ্জিন টেকনোরাতি প্রায় এগারো কোটি বার লাখেরও বেশি ব্লগের হদিশ পেয়েছিল। ফেসবুক বাণিজ্যের
ধাক্কাতে তার বৃদ্ধিতে ভাটা পড়লেও সংখ্যাটা এখন আরো কয়েক কোটি তো হবেই।ভারতেই তখন হিন্দি-ইংরাজি-তামিল
ইত্যাদি কিছু ভাষাতে ব্লগের সংখ্যা চল্লিশ লক্ষের বেশি ছিল,এটা টেকনোরাতির
হিসেব।এখনও সেই সংখ্যা কমে গিয়েও চার-পাঁচলক্ষ তো হবেই। যদিও তার অধিকাংশেরই ভাষা
ইংরেজি, হিন্দি বা তামিল। ব্লগ হতে পারে
ব্যক্তিগত,হতে পারে সম্মিলিত
যেখানে অগুনতি লেখক নিয়মিত লেখেন,অথবা সম্পাদিত
পত্রিকা। উইকিপেডিয়া নিজেকে ব্লগ বলেই দাবি করে।বাংলা উইকিপেডিয়া যদিও যাত্রা শুরু
করেছিল বাংলাদেশে,গত বছরে তার দশম বর্ষ পূর্তিতে ৯ ও ১০ জানুয়ারি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও আয়োজিত হয়েছে উৎসব
অনুষ্ঠান সেসব তথ্য আমরা জানি।
কিন্তু বহু ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী’ লেখকও ‘ফেসবুক’ বাণিজ্য মোহে বাঁধা পড়ে ফেসবুক গ্রুপকেই বলে বসেন ‘ব্লগ’। ফেসবুকের জনপ্রিয়তা যতই থাক,আমাদের প্রায়োগিক জিজ্ঞাসা
রয়েছে অতি অল্পই। ফেসবুক,টুইটারকে বলে ‘মাইক্রোব্লগ’। স্বল্প সময়ে,স্বল্প
কথা বলবার জায়গা সেগুলো।সময় নিয়ে গুরুগম্ভীর মনন-চিন্তন-সৃজনের জায়গা নয়। টুইটারতো
নয়ই।তাই বাংলা কবিতার ছড়াছড়ি ফেসবুকে দেখা গেলেও টুইটারে দেখা যায় না মোটেও। গল্প
উপন্যাস, প্রবন্ধ টুইটারে তো কল্পনাই করতে পারি না। সেগুলো ফেসবুকেও তারাই লেখেন
যারা তাৎক্ষণিক নিন্দে প্রশংসার জন্যে মুখিয়ে থাকেন। ফেসবুক বাণিজ্যের একটি একটি বড় মন্ত্রই হচ্ছে তার ‘লাইক’ বোতাম।অনেকেই
একটা লাইক পাবার জন্যে নির্লজ্জের মতো চাপাচাপিও করেন। লাইক না পেলে সংসার ভেঙ্গে যাবার গল্প,খুনোখুনির
গল্পও আমরা প্রায়ই কাগজে পড়ে থাকি। সেখানে যারা লেখেন,নিজের লেখার স্থানান্তরের
সুবিধেটি তারা নেন,কিন্তু কালান্তরে পৌছে দেবার কোনো ভাবনাই তাদের নেই। সেসব ভাবনা
ফেসবুকের নিজেরও নেই।সুতরাং আক্ষরিক অর্থেই দাবি করতে পারি ফেসবুকের বৌদ্ধিক
সম্পদগুলো ঝরাপালকের মতোই হালকা।আসল পাখিরা ব্লগে-ওয়েবসাইটে ঘোরাফেরা করেন।এবং
ফেসবুকেও ব্যবহারকারীরা বিষয়ের গভীরে যেতে গেলে সেই সব ব্লগ-সাইটেই নির্ভর করেন।
দেদার ছড়িয়ে থাকেন,ফেসবুকের পরিভাষাতে যাকে বলে ‘শেয়ার করা’। সুতরাং ভারি এবং দীর্ঘজীবী সম্পদের জন্যে
ব্লগের উপরে ভরসা করা ছাড়া এখনো আমাদের কোনো বিকল্প নেই। যদিও ফেসবুকের আগ্রাসী
বাণিজ্য নীতি সেগুলোকে কতটা টিকতে দেবে সেই সম্পর্কে আমরা শঙ্কিত।
আন্তর্জালে দু’বছর আগেও জনপ্রিয় ছিল এমন বহু ব্যক্তিগত
ব্লগের সন্ধান করলে সাম্প্রতিক পোষ্ট মেলে না বললেই চলে। পূর্বোত্তরভারতের ‘ঈশানের
পুঞ্জমেঘ’,‘ও কলকাতা’,‘গুরুচণ্ডালী’র মতো কিছু সম্মিলিত ব্লগ বাদ দিলে ভারতে
বাংলাতে সম্মিলিত ব্লগের কোনো ধারণাই বিকশিত হল না। তার মূল কারণ, তৎক্ষণাৎ সেগুলো
পাঠকের নজরে পড়ে না বা নিন্দে প্রশংসা কিছুই জোটে না। যা কিনা বাংলাদেশের ব্লগগুলোতে এককালে
অন্তত কোনো সমস্যাই ছিল না,এখনো সেরকম বড় সমস্যা বলে মনে হয় না।আন্তর্জাল যে স্তরভেদের পুরোনো সংস্কৃতি ভেঙ্গে দিচ্ছে,বা দেবে সেই সত্য এখনো অনুমান করতেই পারেন না বহু লেখক লেখিকা। তাদের কাছে এখনো সম্পাদকের বাছাই পর্ব পার করে ছাপাটাই
সম্মানের ব্যাপার। সেই সম্মানের জন্যে মুখিয়ে থাকেন। সেই তারাই আবার ফেসবুকের খোলা আসরে ভিড় জমান। নিশ্চয়ই ‘লাইকে’র মোহে। কিন্তু সেখানে ভাবগম্ভীর বিষয়ে যেমন বিস্তৃত বেশি কিছু লেখা যাবে না।লিখলেও কাগজ বা বইয়ের মতো সাজাতে পারবেন না।পারলেও সেগুলো তলিয়ে গিয়ে ফেসবুকের ভাণ্ডারে জমা হবে, দরকারে খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। আর পেলেও গোগোল বা বিং সার্চ ইঞ্জিনে এগুলো দেখাবে না।তাতে ফেসবুক বাণিজ্য মার খায়। ফেসবুকের বাণিজ্য বাঁচিয়ে আমরা ভারতীয় বিশেষ করে পূর্বোত্তরের বাঙালি নিজেদের মেধাকে মার দিতে প্রস্তুত!এটা ঠিক যে খুচরো সংলাপে উৎসাহী করিয়ে ফেসবুক তার জন্মের বহু পরে,মূলত ২০১০এর থেকে বাংলা,অসমিয়া ইত্যাদি ভারতীয় ভাষা প্রচারে প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। তখন থেকে ফেসবুকের
যেকোনো বার্তা ই-মেলে চলে যেতে
শুরু করে।এবং তখন অব্দি জনপ্রিয় ই-মেলের আধিপত্য
খসিয়ে নিজের দিকে লোক টানতে শুরু করে।ফলে অরকুটের মতো জনপ্রিয় মাধ্যমও
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়। গেল বছর অরকুট চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
এই আশংকা করবার যথেষ্ট সংগত কারণ রয়েছে যে ফেসবুকের দাপটে
একদিন ব্লগগুলোও হারিয়ে যেতে পারে। অথচ,আন্তর্জাল জমানাতে ব্লগগুলো বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের
মতো। সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার অথবা উন্নতর বিকল্পের সন্ধানের দায় আমাদের সবার।এই
কাজে এখনই নামা উচিত,যারা বাংলা ভাষা সাহিত্য তথা সৃজন-মনন-চিন্তনের তৈরি বৌদ্ধিক
সম্পদগুলোর সমৃদ্ধি,সংরক্ষণে আগ্রহী।প্রযুক্তি তার স্বাভাবিক নিয়মেই আমাদের পথ দেখাবে,এরকম
আশ্বস্ত হয়ে বসে থাকবার মানসিকতাটি ঔপনিবেশিক দেশগুলোর মনস্তত্ত্ব নয়।হলে তাদের
দেশ থেকেই গোগোল,ফেসবুক ইত্যাদি জন্মই নিত না। এগুলো আমাদের মতো উপনিবেশ তথা নয়া-উপনিবেশের
মনস্তত্ত্ব।এই প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষের উপলব্ধি আমাদের ভালো কাজে আসতে পারে।
জ্যোতির কনকপদ্ম বনাম অমাবস্যার অন্ধকার:
পশ্চিমা উপনিবেশের
সঙ্গে পশ্চিমা নবজাগরণের ঢেউটাও এই দেশে এসে পৌঁছেছিল বলে এখনো অধিকাংশ মানুষের
মনে একটা গৌরব বোধ আছে। সেই ‘নবজাগরণে’র
ধারণাকে এখন সাম্প্রদায়িকতার কাজে লাগানো হয়,তার পরেও। ‘বাংলার নবজাগৃতি’ গ্রন্থে বিনয় ঘোষ
খুব উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কিছু কথা লিখেছিলেন প্রযুক্তির প্রশংসাতে,“ইউরোপ থেকে ‘টেকনোলজি’
ও ‘ইডিওলজি’ দুইই এদেশে আমদানি হয়েছিল।কিন্তু কেবল যদি ‘আদর্শ’ আসত,যদি টাকা তৈরির
যন্ত্র, ছাপাখানা ও রেলপথ না তৈরি হত,তাহলে আদর্শের সোনার কাঠির স্পর্শেও এদেশের
ঘুমন্ত সমাজের ঘুম ভাঙত না,ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হত আদর্শকে।আদর্শকে এদেশে বসবাস
করতে হয়েছে,সেই বাসের বনিয়াদ তৈরি করেছে উন্নত উৎপাদনের হাতিয়ার,নতুন যন্ত্রপাতি,টেকনিক।কত
সাধকের কত আদর্শ ব্যর্থ হয়েছে এদেশে,জড়তার অতল অন্ধকারে কত মহান আদর্শ ডুবে গেছে
তার হিসেব নেই।” ৫ সুতরাং তিনি আশা করেছিলেন,“চৈতন্য যা পারেন
নি,বাষ্প ও বিজ্ঞান সহজেই সেই জাতিভেদ ও বর্ণবৈষম্য সমাজের বুক থেকে বিলুপ্ত করতে
পারবে। আর বুদ্ধ –যিশু-মহম্মদ কেউ যা পারেন নি, ‘টাকা’ তাই পারবে। নবযুগের সুদর্শন
চক্র ‘টাকা’ প্রচণ্ড বেগে ঘুরপাক খেতে খেতে সমাজের মধ্যযুগীয় শ্রেণিভেদ বংশগৌরব
কৌলীন্যবোধ বর্ণভেদ সব ভেঙে চুরমার করে দেবে।”৬ বিনয় ঘোষ অন্যান্য
প্রযুক্তির সঙ্গে আলোচনার বিষয় করেছিলেন ছাপাযন্ত্রকে।তিনি লিখেছিলেন, “ছাপাখানা
প্রতিষ্ঠার ফলে এক অভাবনীয় বিপ্লব ঘটল।শিক্ষা ও জ্ঞান কারও ব্যক্তিগত বা কুলগত
সম্পত্তি আর রইল না।মধ্যযুগের ধর্ম ও কুসংস্কারের ভিত্তি যে অজ্ঞান তার প্রথম
যান্ত্রিক শত্রু হলো প্রিন্টিং প্রেস।শিক্ষার সর্বজনীন গণতান্ত্রিক আদর্শ
ছাপাখানাই ঘোষণা করল।কার্টার তাই বলেছেন,পৃথিবীর সমস্ত আবিষ্কারের মধ্যে সবচাইতে ‘cosmopolitan’ ও ‘international’ আবিষ্কার হল প্রিন্টিং প্রেস।” ৭ এই কথাগুলো বিশ
শতকের চল্লিশের দশকে প্রকাশিত বইটির প্রথম সংস্করণের।কথাগুলোর আংশিক সত্যতা নিয়ে
আমাদেরও কোনো দ্বিমত নেই। সংস্করণটি যখন প্রকাশিত হয়েছে দেশে তখন ‘স্বাধীনতা’ বা ‘ক্ষমতার
হস্তান্তর’ হয়েছে বা হচ্ছে মাত্র।রুশ বিপ্লব হয়ে গেছে,চীন বিপ্লব হচ্ছে। সত্তর দশকে যখন এর
নতুন সংস্করণ করছেন,তাঁর অভিমত বহু পালটে গেছে।সংযোজন অংশে হতাশার স্বরে লিখছেন,বইটির
তিন খণ্ডের পরিকল্পনা করেছিলেন।কিন্তু ইতিমধ্যে,“অনেক প্রশ্ন জাগল মনে,অনেক
প্রশ্ন।শহর থেকে গ্রামের দিকে তাকাবার ইচ্ছে হল প্রবল। ...বাংলার গ্রামের মানুষ,গ্রামের
সমাজ,গ্রামের জীবন যাত্রা, গ্রামের সংস্কৃতি স্বচক্ষে দেখতে দেখতে বারংবার মনে হতে
লাগল,পণ্ডিতেরা উনিশ শতকে বাংলার যে রেনেসাঁস বা নবজাগরণের কথা বলেন,সেটা কি
পদার্থ?কোথায় এবং কখন ‘জাগরণ’ হল?জাগল কারা?কলকাতা শহর যদি ‘নবজাগৃতিকেন্দ্র’ হয়,যদি
রেনেসাঁসের সূর্য ‘জ্যোতির কনকপদ্মের’ মতো কলকাতার আকাশে উদিত হয়ে থাকে, তাহলে
কলকাতার খুব কাছাকাছি গ্রামেও, দেড়শো বছর পরেও, কেন অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার? কেন
অতীতের ছেঁড়াকাথায় শুয়ে গ্রামের মানুষ আজো গভীর ঘুমে অচৈতন্য? কেন পৌরাণিক যুগের
স্বপ্নের ঘোরে আজও তাদের স্বপ্নচারিতা? এরকম অনেক প্রশ্ন।অনেক সংশয়।” ৮
‘কলকাতার’ খুব কাছাকাছি গ্রামে’ও ‘অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার’ আছে বলেই
ছাপাযন্ত্রকে নাকচ করবার কোনো প্রশ্নই উঠে না নিশ্চয়,কিন্তু ‘জ্যোতির কনকপদ্ম’ উদিত
হবে বলে আশায় আশায় কাল কাটানোও খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সমস্যাটা কী---সেই
প্রশ্নেরই উত্তর সন্ধান করছিলেন বিনয় ঘোষ। তিনি যে ‘পণ্ডিত’দের কথা লিখছেন,তার
মধ্যে নিজেও রয়েছেন।এমনতর সততা খুব কম লেখকের মেলে,যিনি নিজের আগেকার পুরো
সিদ্ধান্তের পুনরুল্লেখ করে শেষের দুই সংযোজিত অধ্যায়ে আগেকার সব সিদ্ধান্তকে
প্রশ্নবিদ্ধ করছেন।
কম্প্যুটার যখন এল তখনও ছাপা
প্রযুক্তি কোনো হুমকির মুখে পড়ে নি। বরং ভাবা হয়েছিল নতুন উত্থান,নতুন বিকাশ হল
ছাপাপ্রযুক্তির।কিন্তু যেই
আন্তর্জাল এল,আন্তর্জাতিক স্তরেই এখন ছাপাপ্রযুক্তি ক্রমে ক্রমে বিদেয় নিতে
চলেছে।কাগুজে টাকাকে বিদেয় দেবার কথা যখন জোরেশোরে ভারত সরকারই বলছে,তখন কাগুজে
বইয়ের লেখক,প্রকাশক কিংবা পাঠকদের শুয়ে বসে কাল কাটাবার সময় আর নেই।ভারতের মতো
কিছু সামান্য দেশেই হুমকিটি এখনো সহনীয় হয়ে আছে,শীঘ্রই তা থাকবে না ভাববার প্রচুর
সঙ্গত কারণ রয়েছে।ইতিমধ্যে আমাজন,ফ্লিপকার্টের দৌলতে বইবাজারে কলকাতার প্রতিষ্ঠা
প্রত্যাহ্বানের মুখে পড়েছে,মাথা তুলছে বাঙালুরু,--সেসব সংবাদ বেরুচ্ছেই।অধিকাংশ
ভারতীয় কিংবা বাঙালিই এই নিয়ে বিভাজিত দুই শিবিরে--- একদল ‘জ্যোতির কনকপদ্ম’ উদিত
হচ্ছে বলে উচ্ছ্বসিত।আর দল ‘অমাবস্যার রাত’ নিয়েই সন্তুষ্ট। খুব কম মানুষ রয়েছেন
তৃতীয় শিবিরে , যারা প্রশ্ন করছেন, “এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার /ও কি সূর্য নাকি স্বপনের চিতা/ও কি পাখির কূজন নাকি হাহাকার” যেমন সব প্রশ্ন
করেছিলেন সত্তর দশকের বিনয় ঘোষ। আমরা সেই তৃতীয় শিবির থেকে বাংলা ব্লগের সমস্যাটিকে
দেখছি।
সত্তর
দশকে বিনয় ঘোষ যখন কলকাতা ছেড়ে গ্রামের দিকে তাকাচ্ছেন,তখন আর বাংলা অবিভক্ত নয়। ‘দ্বিধাবিভক্ত’
হয়েছে বলে একটি জনপ্রিয় ধারণা রয়েছে। এবং এই ‘দ্বিধাবিভক্তি’ বাংলার নবজাগরণের ব্যর্থতা বলেও
অনেকেই দাবি করেন।কিন্তু সেটি আসলে মোটাদাগের ধারণা।বাংলা আসলে বহুধা বিভক্ত
হয়েছিল, মানুষ বিভক্ত হয়েছিল বিচিত্রভাবে। যদিও তার কিছু টুকরো প্রতিবেশী ভারতীয়
প্রদেশগুলোতেও গিয়ে মিশেছে। বহু মানুষ সেই প্রদেশগুলোতে প্রব্রজিতও হয়েছেন। গোটা পূর্বোত্তর,বিশেষ করে অসম-ত্রিপুরা তার
মধ্যে অন্যতম।বৃহত্তর ত্রিপুরার একটি একটি অংশ বাংলাদেশে থেকেও গেছিল।সেখান থেকে হাজারো
বাঙালি ভারতীয় ত্রিপুরাতে চলে আসেন বলে আজকাল আসামে অপবাদ শুনতে হয়,বাঙালিরা এসে
ত্রিপুরি জনজাতিদের সংখ্যালঘু করে ফেললেন। আসামে প্রচার করা হয়, অসমক ত্রিপুরা হ’বলৈ দিয়া নহ’ব।এই
পরিস্থিতিতে আমরা শুধু এই কথাটিই স্মরণে রেখে আলোচনা এগুতে চাই যে বাংলা মানে আর
শুধু কলকাতা আর পশ্চিম বাংলার গ্রাম নয়।বাংলা মানে শুধু পুবে পশ্চিমে বিভাজিত এপার বাংলা ওপার
বাংলা নয়।অনেকেই বলেন, তার বাইরে একটি ‘অপার বাংলা’ও আছে।কিন্তু পূর্বোত্তর ভারত
সেই ‘অপার বাংলা’র থেকেও আলাদা।আলাদা কেন না,তারা মোটেও ‘প্রবাসী বাঙালি’ নন। তারা
সেখানে বাংলাদেশ বা পশ্চিম বাংলাতে বেড়াতে বা জীবিকার সূত্রে গিয়ে বাস করছেন
না।বহু মানুষ ঐতিহাসিকভাবেই সেখানকারই বাঙালি জাতি গঠন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে
প্রাচীন বাসিন্দা।বাংলা ভাষা এবং জাতি
নিয়ে যে সব প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা হয়,সেখানে সেই সব পূর্বোত্তরীয় বাস্তবতা
সাধারণত বাদ পড়ে।প্রাতিষ্ঠানিক ‘আদর্শে’র আলো সেই সব মানুষের উপরে কোনোদিক থেকেই
পড়ে না।ফলে তারা নিজেরাও অধিকাংশ সময় নিজের মুখখানাও দর্পণে ভালো করে দেখতে পান
না। এই সত্যগুলোও মনে রাখা ভালো।
উন্নতর প্রযুক্তি মানেই কিন্তু নয়
দীর্ঘতর আয়ু :
তাই বলে, তথ্য প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্তকে আজ আর অস্বীকার করবার উপায় নেই,এড়িয়ে
চলবারও পরামর্শ আমরা দিই না।কিন্তু এটাও মনে রাখবার বিষয় যে এটি একটি পুঁজিবাদী বাস্তবতা। সেই বাস্তবতাতে আমরা আমজনতা অধিকাংশ সময়েই নিতান্তই গ্রাহক কিম্বা শ্রমিক।এই সম্পর্কে আমরাঅন্যত্র লিখেছিলাম,“এর মর্মবস্তু কিম্বা গতিপ্রকৃতির উপরে সৃজনশীল হস্তক্ষেপ কিম্বা অন্তর্ঘাত করবার যোগ্যতা আমরা অর্জন করিনি বিশেষ।পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এক মৌলিক সমস্যা হল যে বস্তুটি গ্রাহক হিসেবে ব্যবহার করছি,সেটি আমি তৈরি করিনি বা উৎপাদন করিনি।আর যদি উৎপাদন করেছি তবে সেটি আর আমি ব্যবহার করছি না বড়ো। সে আমার দখলে থাকে না। কে নিয়ে যায়,কই নিয়ে যায় কেউ জানি না।এই বিচ্ছিন্নতার ব্যামোতে পণ্যের বাজারে তাই ব্যক্তির সৃজনশীলতা বলে বিশেষ কিছু থাকে না।যদি না সেই ব্যক্তির মুনাফা কিছু অর্জনের পথ না থাকে।নতুন কোনো কাজে হাত দিলেই আমাদের প্রথম প্রশ্ন---লাভটা কী হবে?লাভ ছাড়া এখানে মেঘও বৃষ্টি হারিয়ে ফেলে।বৃষ্টি হওয়া না হওয়াটাও এখন আর নিছক প্রাকৃতিক নয়,অর্থনৈতিক পরিঘটনাও।শ্রমিক কী করবে ঠিক করে দেয় প্রত্যক্ষ ভাবেই মালিক।গ্রাহক কী করবে তাও ঠিক করে দেয় মালিক।পরোক্ষে,বিজ্ঞাপনে। অথবা বাজার থেকে আপনার পছন্দের পণ্য তুলে দিয়ে।আমাদের হাতের পণ্যটির সঙ্গে আমাদের বিচ্ছিন্নতা বুঝিবা ব্রহ্মারই কপালে লিখন।তাই,হাওয়া যেদিকে ছোটে এবং ছোটায় আমরা সেদিকেই ছুটতে থাকব,নান্য পন্থা। সৃজনশীলতার বিপরীতে ‘ব্র্যান্ড’ এবং ‘ট্র্যাণ্ড’ই এখানে শেষ কথা।”৯ এই কথাগুলো সাধারণ যন্ত্রব্যবস্থা সম্পর্কে
সত্য।কিন্তু আন্তর্জালীয় যে বাণিজ্য সেখানে আমরা আর শুধু গ্রাহক বা শ্রমিক নই, কাঁচামালও।
আমাদের মনন মেধাকে ব্যবহার করেই ফেসবুক, গোগোল, ইয়াহু আদির কোটি কোটি ডলারের
বাণিজ্য।
“পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতা বিষয়টি এতোই তীব্র যে সে পুঁজিবাদীদেরকেও শান্তিতে শ্বাস ফেলতে দেয় না। সে গতকাল যে পণ্য এবং সম্পর্কগুলো তৈরি করে আজ তাকে ধ্বংস করে।আগামীকাল আবার কোন নতুন বিষয়কে সামনে এনে আজকের দিনটিকেও বারোটা বাজাবে সেই সিদ্ধান্তও নিয়ে রাখে।”১০ সুতরাং কোনো অত্যুৎসাহেরই এখানে আয়ু বেশি নয়। আর তথ্য-প্রযুক্তির
জমানাতে সেই আয়ু ফুরোবার দ্রুতি তো এখন আরো অনেক বেশি।আলঙ্কারিক ভাষা ব্যবহার করে
দাবি করা যেতেই
পারে --- সেই দ্রুতি আলোর চাইতে সামান্য কম।সম্প্রতি একটি সংবাদে দেখেছিলাম ১৯৩৫ এ
মুক্তি পাওয়া প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত-অভিনীত ‘দেবদাস’ ছায়াছবির একটিই প্রিন্ট বাংলাদেশ সরকার ভারতকে দিচ্ছে।ভারতে
তার কোনো প্রতিলিপি নেই। এর হিন্দি –অসমিয়া সংস্করণও ছিল। সেগুলো কোথাও নেই।
প্রমথেশ বড়ুয়ার আগেও ১৯২৮শে নরেশ মিত্র একখানা নির্বাক ‘দেবদাস’ করেছিলেন,সেটি আর
এখন দেখাই যাবে না,এর প্রিন্ট নষ্ট। নষ্ট তো পুথি সাহিত্যও
হয়েছিল। ষোড়শ শতকের আগে কোনো বাংলা পুথি মেলে না বলে সুকুমার সেন দাবি করেছিলেন। সেগুলোরও
খুব কমই ছাপা প্রযুক্তিতে বইতে রূপান্তরিত হয়েছিল। তবু যেগুলো মিলেছিল সেগুলো যে
কয়েক শতক টিকেছিল,সে সত্য। ছাপা বইগুলো সেই আয়ু স্পর্শ করবে কি না,এখনো দেখার
বাকি।কারণ,বাংলা বইয়ের বয়স এখনো তিন শতক পার করে নি।সামাজিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে
এমন কিছু বই তবুও এই সময় পার করে টিকে আছে,কিন্তু সেগুলো অধিকাংশই আছে সরকারি
বেসরকারি গ্রন্থাগারে। বাজার থেকে অধিকাংশ প্রাচীন বইই উধাও।‘দেবদাস’ ছাপাবই
নিশ্চয় বাজারে মেলে।আগামী বছরে শতবর্ষ পার করেও আরো বহুদিন মিলবে।কিন্তু তার
প্রাচীন চলচ্চিত্রে রূপান্তরগুলো কিন্তু এক শতক আয়ু নিয়েও জন্মাল না। প্রযুক্তি
উন্নতর হয়েও আমাদেরকে তার নিজের এবং তার উৎপাদের কোনো আয়ুর গ্যারেণ্টি কিন্তু দিতে
পারল না। উন্নতর প্রযুক্তি মানেই কিন্তু নয় দীর্ঘতর আয়ু। এখন কম্প্যুটার
প্রযুক্তি এক দশক আয়ুরও কোনো নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। আমরা নিশ্চিত যারা উইন্ডোজ
নাইনটি এইটে অভ্যস্ত ছিলেন,তারা আর নিজেদের পুরোনো লেখা উদ্ধার করতে পারছেন
না।সিডিতে যদি ব্যাকআপ রেখেছিলেন,সেগুলোরও অধিকাংশেরই পাঠোদ্ধার করতে পারছেন
না।অতি সম্প্রতি গোগোল তাদের ছবি তুলে রাখবার ‘পিকাসা’ সাইট বন্ধ করে দিয়েছে।
গোগোলের সেবা ব্লগগুলোকে ছবি দিয়ে সাজাবার জন্যে ‘পিকাসা’ খুবই ব্যবহার বান্ধব
ওয়েবসাইট ছিল।আমাদের অনেকেরই গোগোলের সেবা ব্লগারে,যা ব্লগস্পট বলেই সুপরিচিত,লেখালেখি
করবার অভ্যাস আছে। বহু বাংলা ওয়েব ম্যাগাজিনও ব্লগারে আছে। সেগুলো না অচিরে বন্ধ
করতে বাধ্য হয় গোগোল সেই আশঙ্কাতে আমরা দিন গুনছি।
এই
সংকটের কথা আমরা আলোচনা করছি ঠিক তখন যখন বিশ্বের সবচাইতে উন্নত বিশটি দেশের ৭৫ % মানুষের
কাছে আন্তর্জাল সেবা পৌঁছে গেছে। কিন্তু বাকি বিশ্বের মাত্র ২৫%এর মধ্যে সেটি পৌঁছুতে পেরেছে। তার মধ্যে চীন-ভারতের
মানুষও রয়েছেন।যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ইত্যাদি দেশের ৮০% জনতা
আন্তর্জাল ব্যবহার করবার বিপরীতে দু’বছর আগেও ভারতের জনসংখ্যার ২০%-এর কাছেও ভালো
করে পৌঁছোয় নি আন্তর্জাল। এর মানে হচ্ছে
ভারতের মতো দেশগুলোতে আন্তর্জাল বাণিজ্যের জন্যে সম্ভাবনা ব্যাপক। সেই
বাজার দখলের জন্যে গোগোলে-ফেসবুকে এবং অন্যান্য সংস্থার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও
প্রায় যুদ্ধের চেহারা নিয়েছে বললে অত্যুক্তি হয় না।এই যুদ্ধে বিভিন্ন হার্ড-ওয়ার,সফটওয়ার
নির্মাতা এবং আন্তর্জাল সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোও নানা সম্পর্কে জড়িয়ে আছে।কম্প্যুটারকে
পেছনে ঠেলে এগুচ্ছে মোবাইল কোম্পানিগুলো। এখনই ভারতে আন্তর্জাল ব্যবহারকারীদের ৬০%ই
মোবাইল ব্যবহার করছেন। ফেসবুকের প্রায় দেড়কোটি ব্যবহারকারীদের ৯০%ই আসছেন মোবাইল
থেকে।১১ মোবাইলেও ব্লগে লেখা পড়া করা যাচ্ছে, এবং ভারতীয়
ভাষাগুলোতেই করা যাচ্ছে। সে যেমন একটি সুসংবাদ, সেরকমই এও সত্য যে সেগুলোতে ফেসবুক-হোয়াটসআপের
মতোই টুকরো কথার সমাহারই বেশি হওয়া সম্ভব।
মোবাইলে একটি ব্লগে লেখা,ছবিতে, চলচ্চিত্রের সাজানো তত সহজ নয়। মোবাইলে তৈরি কোনো
ব্লগের সন্ধান আমরা এই অব্দি পাই নি। ফলে সেখানে ‘কপি-পেস্ট-শেয়ার’ সংস্কৃতির বেশি
এগোনো সম্ভব বলে মনে হয় না। মাঝে মধ্যে সেখানেও সাধারণ ব্যবহারকারীর প্রতিভা দেখে
চমকে যেতে হয় নিশ্চয়। যেমন বর্তমান ‘মুদ্রাবদল’ সংকট নিয়ে একটি বিদ্রূপাত্মক
পদ্যের প্রথম কয়েকটি কলি এরকম: হকের টাকা আমি তারেই বলি/ কালো তারে বলে মোদীর লোক/
রেখেছিলেম লেপ তোষকের ফাঁকে/ খুঁজে পেল আই টি-র ঝানু চোখ/বেশি টাকা ছিল না তো মোটে/লাখ
বিশেক,সব হাজারের নোটে/ কালো? তা সে কালো টাকা হোক/ ঘরের লক্ষ্মী,কালো টাকার থোক...”
দুই দশক আগেও এরকম যেকোনো মানবিক সংকটে আমরা বহু মৌলিক কবিতা পড়তে পেতাম। এখন সেই
সব প্রায় দুর্লভ হচ্ছে বললেই চলে। অথবা এই সব নকল পদ্যের ভিড়ে কবিতা খুঁজে মেলা
ভার হয়েছে। সেরকম ঘটনা ছাপা জমানাতেও হয়েছিল,বা এখনো হচ্ছে।বাংলাতে ‘বটতলা সাহিত্য’
বলে একরকমের সাহিত্যকে ব্রাত্য করে দেবার প্রয়াস ছিল অভিজাতদের মধ্যে।আমরা সেরকম
আভিজাত্যের সংকীর্ণ গলিতে প্রবেশ করতে চাইছি না। এরকম গদ্য পদ্যও বাংলা ভাষার
ব্যবহারের পরিমাণ বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা
পালন করে।পরিমাণ একটা স্তর অতিক্রম না করা অব্দি মানের কথা কল্পনাই করা যায়
না।বটতলা সাহিত্য না হলে বাংলা বইবাজার টিকে থাকত এবং বিকশিত হত কিনা আমরা
সন্দিহান,এবং সেই বাজার না থাকলে বাজার বিরোধী ‘লিটল ম্যাগাজিন’ আন্দোলনও গড়ে
উঠবার কোনো কারণ কিংবা বাস্তবতার কিছুই থাকত না।এই সব দ্বন্দ্ব এবং বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্যের কথা মনে রেখেই আমরা
সমস্যাটিকে বুঝবার চেষ্টা করছি।
মান, পরিমাণ এবং আমাদের হস্তক্ষেপ :
প্রশ্ন হলো আমরা বাংলাতে কী করছি? এবং বাংলাকে নিয়ে গোগোল তথা আন্তর্জাল
বাণিজ্য সংস্থাগুলো কী ভাবছেন? একেবারে ভাবছেন না এ সত্য নয়। মোবাইলে করে হলেও
বাংলার ব্যবহার সম্প্রতি ব্যাপক হারে বাড়ছে।মাইক্রোম্যাক্সের সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপন অনেকে দেখে
থাকবেন।হিন্দিতেও আসছে,বাংলাতেও আসছে। যেখানে ইংরেজির ব্যবহারকে ‘বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ’ দেখাবার
কথা বলা হচ্ছে। এসব করা হচ্ছে ভারতীয় ভাষাকে ভালোবেসে নয়,ইংরেজি দিয়ে ভারতের
বাজারকে আর ধরা যাচ্ছে না বলে। কিন্তু সেটা ঠিক কী পরিমাণে বাড়ছে আমরা জানি না।
শুধু জানি যে পরিমাণে বাড়লে একটি গুণগত পরিবর্তনও আসতেই পারে। কিন্তু সেসব যে আমাদের
বৌদ্ধিক হস্তক্ষেপ বা অন্তর্ঘাত ছাড়া কাঙ্ক্ষিত মোড় নেবে, তেমনটা নিশ্চিত হয়ে দাবি করা কঠিন।বাজারের উৎপাদন প্রধানত
বাজারের স্বার্থ এবং মতাদর্শই বহন করে।ব্লগের জনপ্রিয়তার দিনেও বাংলাদেশে বাংলাতে
প্রচুর পর্ণসাইট খুলেছে।ভারতেও হিন্দি বা অন্যান্য ভাষাতে সেগুলোর অভাব নেই।
কিন্তু বৈপরীত্য এটাই যে যে দেশে যে ভাষাতে ‘পর্ণ-সাহিত্যে’র দেখা মিলবে,সেই দেশে
সেই ভাষাতে তার ঠিক বিপরীত রুচি এবং চিন্তা এবং মননের সাহিত্যেরও অভাব হবে না।যদিও পরিমাণে
দ্বিতীয়টি সব সময়েই কম, কিন্তু মানে সমুন্নত। এই সত্য ছাপা জমানার সম্পর্কেও সত্য,আন্তর্জালেও
সত্য।
ভারতে বাংলা
ব্লগগুলোর জনপ্রিয়তার শুরুটাই যেহেতু ফেসবুকের জনপ্রিয়তার সমবয়সী,তাই একটি বিষয় মনে রাখা ভালো যে লাতভিয়া বা
এস্তোনিয়াতে আন্তর্জাল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ফেসবুকের মতো মাইক্রোব্লগের এবং
মোবাইলের মতো খুদে যন্ত্রের জনপ্রিয়তার আগেই ভারতকে ছাড়িয়ে গেছিল। ফলে যে
সংস্কৃতিতে তারা অভ্যস্ত বলে এখনো ব্লগ, ওয়েবসাইট নিয়ে প্রত্যয়-দীপ্ত উচ্চারণগুলো
করতে পারেন, সেই সংস্কৃতির সঙ্গে আমরা পরিচিত নই সেই সব উচ্চারণও বাংলাতে ভারতে
সেভাবে শোনা যায় না। ‘ভিলনিয়াস রিভ্যু’তে কেউ ইচ্ছে করলেই ঘুরে আসতে
পারেন।লিথুয়ানিয় ভাষার সঙ্গে তাঁদের সম্পদ ইংরেজি অনুবাদেও পাওয়া যাবে।মাত্র ২০
লক্ষ জনতার একটি ভাষা। সেই ভাষার সাহিত্যের
প্রতিনিধিত্ব করে,কাগজটির সম্পাদক মারিয়াস বুরোকাস লিখছেন,“The
magazine Vilnius Review
that you are holding in your hands—a thick volume published once a year—is a
tribute to attractive design,the printed press, and the desire to touch,feel,and
flick through pages.The texts in this volume are a peculiar cross-section of
Lithuanian literature from the most recent couple of years. Needless to say, it
is not as exhaustive as would require not a magazine but a thousand-page
anthology, but these days such anthologies are successfully replaced by
internet websites.That is what has happened with Vilnius Review: after about twenty years in print,it has
moved to the internet. Now you can find Lithuanian prose, poetry, book reviews,
interviews, and the like at vilniusreview.com.”১৭
ভাষার চারটি
প্রকাশভেদ রয়েছে। ভাষা লোকে বলেন,শোনেন,লেখেন এবং পড়েন। সাধারণ একটি ধারণা রয়েছে
যে লেখা-পড়ার পরিমাণ বলা-শোনার চাইতে সব সময়েই কম। সেই কম লোকেদেরকেই ছাপাজমানা ‘শিক্ষিত’
বলে মনে করে। লেখা-পড়ার ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে আমাদের শুচিবায়ুও ঠিক এই সময়েরই দান।
ছাপাজমানার আগে বাংলা-হিন্দি-অসমিয়া ইত্যাদি আধুনিক ভাষাতে ব্যাকরণ-অভিধান বলে
কোনো বস্তুর সন্ধানই মেলে না। ফেসবুক টুইটারের মতো সামাজিক মাধ্যমের যুগে ভাষার
বাকি সব প্রকাশভেদ গৌণ হয়ে গিয়ে এই লেখা-পড়াটাই বাড়ছে।তাও,ছাপা জামানাতে যেখানে
লেখার চাইতে পড়বার পরিমাণটি বেশি ছিল, সামাজিক মাধ্যমের যুগে তারও এক গুণগত
পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। লোকে লিখতে সবচাইতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন।কিছু একটা লিখলেই
অন্যে তা না পড়েও বহু সময় লাইক কিংবা শেয়ার করে ফেলেন। এই যে প্রবণতা-- ফেসবুক
টুইটারের বাণিজ্যের এটাই মূল মন্ত্র।এই মন্ত্রের প্রচুর বিপজ্জনক দিক আছে,বলেই
সাম্প্রতিক মার্কিন নির্বাচনের পরে ফেসবুক সেদেশে প্রবল প্রতিবাদী চাপের মধ্যে
পড়েছে।আমরা একটি নিবন্ধ পড়লাম,যার শিরোনাম “Wake up call: The nefarious future of Facebook”১৮।ব্লগে এসব হয় না বলেই ব্লগগুলো পিছিয়ে যাচ্ছে।প্রচুর লোকে
ব্লগ পড়েন। এককালে সেখানে নিজেদের অভিমতও জানাতেন।কিন্তু এখন আর সেসব হচ্ছে
না।সাধারণ ব্লগারদের নিরুৎসাহের এটি বড়, এবং সম্ভবত প্রধান কারণ এটি।তাতে একটি
লাভও হচ্ছে,কিন্তু বিদ্যা-বুদ্ধি সৃজনী কর্ম যাদের কোনো রকম সাধনার ধন নয়,তারা
ব্লগ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন।
পড়া কমে গিয়ে লেখা
বেড়ে যাওয়াটা সমাজের জন্যে খুব ভালো জিনিস কিনা আমাদের ভাবা উচিত। ডেভিড ভাণ্ডেয়া
নামে এক পশ্চিমা অধ্যাপক,যার অধ্যাপনার বিষয়ই সৃজনী সাহিত্য আন্তর্জালেও প্রচুর
লেখালেখি করেন।তাঁর নিজের ব্লগ রয়েছে এই নামে http://davidvandewaa.blogspot.in/। তিনি এক নিবন্ধে লিখছেন, “Poor readers are
poor writers and vice versa.The fragmentary,scattered,and simplistic nature of
the vast majority of online content (as well as personal and even professional
communication) has only served to make people’s writing increasingly
fragmentary,scattered, and simplistic.”১৯ এই নিবন্ধে তাঁর দেয়া কিছু তথ্য দিয়েই
আমাদের বক্তব্য আমরা শেষ করছি।তিনি লিখছেন,৫৫%এর বেশি পাঠক ১৫ সেকেন্ডের ভেতরেই
একটি ব্লগ বা সাইট থেকে বেরিয়ে পড়েন।যারা পড়েন,তাদেরও এক বড় অংশ মূল পাঠের ১৮%এর
বেশি পড়েন না। ফলে গুরুত্ব দিয়ে নেবার মতো পাঠক আন্তর্জালে খুবই কম।তিনি রসিকতা
করেই লিখছেন, “So if you’re still with me,you’re among the smallest of
minorities. I like to think of us as ‘the elite’, though.” বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর কাছে যে হেতু প্রতি বিন্দু স্থান-কাল
মূল্য বহন করে তারা এই সামান্য কিছু সেকেন্ডের সদ্ব্যবহারই শুধু করে না, সেটুকুই
ছিনিয়ে নেবার জন্যে নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এবং এই ১৮ সেকেন্ডের
সংস্কৃতিকেই প্রশ্রয় দিয়ে ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’ বানিয়ে দেয়।আজকাল তাই বহু বড় লেখক,গায়ক,শিল্পীও
একটি ব্লগ না থাকাকে অসম্মানের বিষয় বলে মনে করেন না,ফেসবুক একাউন্ট একটি না
থাকাকে মনে করেন।তাঁদের ফেসবুক বন্ধু তালিকারও অনেকে জানেন ই না, ফেসবুকের বাইরে
তিনি কী করেন?
তারপরেও ডেভিডের
মতো আমাদেরও প্রত্যয়, “In a study of over 20,000 keywords, for
example, results showed that the average length for all of the top 10 search
engine results was over 2,000 words. Other research indicates that using
long-form content increases conversions by 30 to 40 percent.” ফেসবুকের মতো মাইক্রোব্লগগুলোর ডেভিডের এই কথার
সত্যতা প্রমাণ করে। দেখা যাবে, সেখানে লাখো অমনোযোগী ব্যবহারকারীও বহু সময় শিরোনাম
দেখেই নিজের যুক্তির পক্ষে অন্যের শ্রমে তৈরি লেখাগুলো ছড়িয়ে থাকেন। সেইগুলো হয়তো
লেখা হয়েছে কোনো দৈনিক বা মাসিক কাগজের সাইটে,ব্যক্তিগত বা সম্মিলিত এবং সম্পাদিত
ব্লগে।ইংরেজি কাফেলা,সংহতি,বাংলা গুরুচণ্ডালী,মুক্তমনা,অসমিয়া মুক্তচিন্তা,বাওঁপন্থী
বতরা,সাহিত্য ডট অর্গ ইত্যাদি এরই জন্যে নিজেদের ‘প্রতিষ্ঠা’ অক্ষুণ্ণ রাখতে
পারছে। আমরা ঈশানের পুঞ্জমেঘ ব্লগ পরিচালনা করতে গিয়েও দেখেছি সমৃদ্ধ অন্তর্বস্তু
থাকলে এখনো পাঠকের অভাব হয় না।সব পাঠক হয়তো সেখানে কথা বলেন না,প্রশংসা প্রশস্তি
করেন না।কিন্তু যে লেখক সেই সব সম্পর্কে নির্বিকার থেকে ভালো লিখতে পারেন,তাদের
লেখালেখি ঠিকই বহুদিন ধরে পাঠক পেতে থাকে।বাংলাদেশের ব্লগগুলোর ভারতের পাঠকের কাছে
এখনো সমান জনপ্রিয়তা মনে হয় সেই কথাই প্রমাণ করে। ডেভিডের কথাতেই শেষ করি, “Furthermore,
long-form content consistently gets more traction on social media.Thus, while
the short history of the Internet Age has been one of even shorter attention spans,
fragmented information, and diffusion, the future looks a bit brighter as we
begin to harness the power of the Internet for the creation and promotion of
original content that informs and fosters dialogue—content whose creation
requires a mastery of the written word।”
তথ্যসূত্র:
১) The Poetry Foundation: History
and Mission;
২) সুশান্ত কর: ভাষা ও প্রযুক্তি:
আন্তর্জালে বাংলা ভাষা; আকাদেমি পত্রিকা; ভাষা ও সংস্কৃতি সংখ্যা; সম্পাদনা সঞ্জীব
দেবলস্কর; বরাক উপত্যকা বঙ্গ
সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন; পৃ: ১০৪।
৩) সুশান্ত কর; ঐ।
৪) সুশান্ত কর; ঐ; পৃ: ১১৭।
৫) বিনয় ঘোষ: নবজাগৃতির ভাববিপ্লব; বাংলার নবজাগৃতি; ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান; কলকাতা-৭২; ২০০৯;পৃ: ১১৮।
৬) বিনয় ঘোষ; ঐ; পৃ: ১১৯।
৭)বিনয় ঘোষ; ঐ;পৃ:১২২।
৮) বিনয় ঘোষ: নবজাগৃতির ভাববিপ্লব;ঐ; পৃ: ১৬৪।
৯) সুশান্ত কর; ঐ; পৃ: ৯৮।
১০) সুশান্ত কর; ঐ; পৃ: ৯৮।
১১) Ritesh Bendre: 90% of Facebook’s 132 million users from India
come from
mobile phones; bgr.in;
১২) K Yatish Rajawat: Google will destroy local newspapers with Indian
language
Internet Alliance; firstpost.com;
১৩) Facebook and Google are
fighting it out in Indian villages for the ultimate internet
১৪) রতন সিং শেখাওয়াত: गूगल ने आयोजित की हिंदी ब्लॉगर्स मीट;ज्ञान दर्पण;
১৫) Bangladesh Telecommunication Regulatory Commission (BTRC);
১৬) Hindi content consumption on
Internet growing at 94%; 1 in 5 Indian users prefer
Hindi: Google; news18.com;
১৭) Marius Burokas,Chief editor
of Vilnius Review;
১৯) David Vandewaa:Why Write? The Relevance of Good Writing in the Internet
Age;
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন