(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার উজান পর্বের অধ্যায় তেরো ---সুব্রতা মজুমদার।)
তেরো
নদীর উপর দৌড়য় যে ঘোড়া ছলছলাৎ, তার কি
কোনও ক্ষুর আছে । বৈতল জীবনে দ্বিতীয় ঘোড়া দেখা হয়নি মনা রায় ছাড়া । ইন্ডিয়ায়, এই
দেশে কনোকালে ঘোড়দৌড় হয়েছে, ঘোড়া খেলার মাঠ আছে বিশাল । দুনিয়ায় ঘোড়ার পিঠে বল
খেলাও শুরু হয় কাছাড় জেলায় । সাহেবদের ক্লাব সিনেমা হল হোটেল দোকান সবই ঘোড়দৌড়ের
মাঠ লাগোয়া । মাঠের মাঝখানে আছে এক কুলগাছ । কনোকালে এক তেঁতুল গাছও মানুষ
দেখেছে গায়ে লাগা । জামাই বউ গাছ নিয়ে অনেক কথা । বৈতল দুখু আর আপদ বছই ধোঁয়া
ওড়াতে আসে বরই গাছের নিচে । নেশার ধোঁয়ায় রাত কালো হতেই বৈতল দুখুকে ভয় দেখায় ।
বলে,
--- অউ গাচো কিন্তু ভূত আছে ।
বাট্টি মানু দেখলেউ ঘাড় ভাঙ্গি দেয় ।
--- তুইন তো হালার হালা অত কালা ভূতর বাপেও
খুজি পাইত নায় ।
--- তুই ঢঙ্ ভাবরে নানি । দেখ ভূত আছে কইয়ার
। তোর ধারোউ আছে ।
--- তুই অউত্ত ভূত ।
--- নাবে না, দেখছ না । অউ আমি, অউ তুই অউ
বছই আর আপদ গেল কই । আপদ দুগু অই গেল কেমনে । অউত্ত আপদ । তে হিগু কিগু ক । পাইলে
নি ভূত ।
অবাক বিস্ময়ে চারজন এক ঠাঁই এসে দাঁড়ায় । এক
সাথে দেয় ধমক । বলে,
--- অই, তুই কিগু বে ।
পঞ্চমজনের গায়ের রং বৈতলের বিপরীত । ফক্ফকা ধলা । সাহেবের মতো । বৈতল
দুখুর গায়ে কিল মেরে বলে,
--- ইগু দেখি সাহেব ভূত । অত ধলা অয় নিবে ভূত
। ইগুর গাত শ্বেতি নিবে চা চাইন । দেশলাই জ্বালা দেখি, আন্ধাইর না জমলে তো ভূত অইত
নায় ।
দুখু ভাল করে জরিপ করে । নিশ্চিত
হয়, সাহেব নয়, শ্বেতীও নয় । বলতে বলতে বৈতল ঢুসুম করে হাত চালায় । মাটিতে গড়াগড়ি
যায় ভূত । বৈতল ওঠায় । বলে,
--- তুই কেবে ।
--- আমি কালু, কালুরাম হাজাম । আমি নাউঠাকুর
।
--- নাউঠাকুর তে সিলেটি মাতরে কেনে ।
--- আমরাও সিলেটি ।
এবার দুখুও মারে এক থাবড়া । বলে,
--- তে ক নাপিত । তর ই সাহেবের লাখান রং কেনে
।
--- আমি সাহেব কেলাবো কাম করি ।
--- কিতা কাম করছ । তুইন কিতা রং মিস্ত্রি নি
।
--- চুল কাটি দাড়ি কাটি । ইউ কাটিং মারি ।
--- অই বেটা কাটিং যে মারাইরে, চুরর লাখান
ইখানো অইলে কেনে । তোর গার যে রং, তরে কেউ চুরিতও নিত নায় ।
--- কালি মাখি লাইমু ভুষা । তেউত নিবায় আমারে
।
--- বাক্কাউতো জানছ কথা । অখন ক কিতা চুরি
করতে আইচছ ।
--- তুমরা যেতা খাও । দেও না এক টান, অতো
মারছো ।
--- গাইঞ্জা খাইতে ।
এবার বৈতলের বাঁ পায়ের লাথি খেয়ে
মাটিতে পড়ে কালুরাম গৌরাঙ্গ । গড়াগড়ি থেকে উঠে সাদা মুখের কালো দাঁত বের করে হাসে
। বলে,
--- বিলাতি বিড়ি খাইতায় নি । সিগরেট ।
সবারই চোখ চিকচিক করে । আপদ আর
বছই কালুর গায়ের ধুলো ঝেড়ে দেয় । বলে,
--- দে তেখি তোর বিলাতি মাল ।
সেয়ানা দুখু ভোলে না । বলে,
--- কেনে খাওয়াইতে, মাগনা নি ।
--- মাগনা, একেবারে মাগনা ।
--- ঠিক আছে বার কর ।
কালু তার লাল কালো পায়জামার পকেট
থেকে বের করে বিচিত্র সব আধপোড়া সিগেরেটের টুকরো । বছই নেড়ে চেড়ে দেখে, গন্ধ নেয়,
পোড়া গন্ধের সঙ্গে একটা সাহেবি ব্যাপারও আছে । মুখে লাগায় আপদও । বৈতল কালুরামের ক্ষীণকায় চেহারার দিকে তাকায়, কুচা মারার আগে যেমন মাছের আকৃতি
জরিপ করে শিকারি । বন্ধু দুখুকে বলে,
--- অখন তুই হাত লাগা । মুখো মারবে । হালার
হালার কালা দাত কয়টা ভাঙ্গিয়া আমার হাতো দিবে । আমরারে ইগুয়ে পথুয়া পাইছে নি ।
খাওরা বিড়ি খাওয়াইত । অউ মুখ দিয়া বেটাইন্তে গরু খাইছে শুওর খাইছে, অউ ছেপ দিয়া
চাটছে । থু ।
দুখুর হাত চালানোর আগেই অবস্থা
বেগতিক দেখে কালুরাম ভাগে । অন্ধকারে বিদ্যুতের আলোর মতো শুধু পায়জামা পরা ওর সাদা
শরীরটা এঁকে বেঁকে ছুটে যায় টাউন ক্লাবের দিকে । ওখান থেকে ইন্ডিয়া ক্লাবের দিকে
গিয়ে মিলিয়ে যায় হঠাৎ ।
এই দেশের বেশিরভাগ নগর পত্তনের
কৃতিত্বই সাহেবদের । শাসন শোষণের সুবিধার্থে নিজেদের জন্য নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা,
বিনোদনের একটা ঠিকানাও তো চাই । বরাক নদীর পারের এই শহরও সেই প্রয়োজন মিটিয়েছে ।
কত মানুষের কত ধানী জমি দখল নিয়ে মাঠ বানিয়েছে । বাড়িঘর অট্টালিকা বানিয়েছে ।
ক্লাবঘর হয়েছে, মাঠে ঘোড়া ঘোড়সওয়ারির ব্যবস্থা হয়েছে, অদূরে একটা উপাসনালয়ও করেছে
সাহেবরা ।
কালুরাম হাজাম এরপরও এসেছে ।
দুখু বৈতলের কিল চড় খেয়েছে । গাঁজাও খেয়েছে । বৈতল জেনেছে তার পরিচয় । কালুর নেশা
আছে অনেক, নাপতেগিরিতে সব হয় না । তাই ওদের দলে ভিড়তে চায় । দুখু সাফ
বলে দেয়,
--- আমরার কুনু দলউল নাই । আমরা আমরার মতো ।
তুইন কিগু । ভাগ ।
কালুরাম ভাগেনি । একদিন খাইয়েছে
গোটা সিগারেট একটা বৈতলকে । বৈতলের কানে কানে বলেছে কথা । বলেছে,
--- আমার নানিয়ে কইছে অউ গাছোর নিচে মোহর আছে
।
বৈতল
ডাকে দুখুকে । বলে,
--- আবার গাইঞ্জা মারের । কর, ইখানো বুলে গাছোর নিচে মোহর আছে । দে এক রুন্দা ।
--- মারিও না, আছে কইলাম, আমি মাটি কাটছি ।
মাইনষে দেখিলায় আবার ভরিয়া রাখি দেই । তুমরা পারবায় ।
--- আমরারে আউয়া পাইচছ, ছাবাল নি । কেউ কইছে
না কুনুদিন আর তর নানিয়ে জানে সব । নানিয়েও খায় নি ।
--- আমার নানিরে দেখলে বেটা ইতা কইতে নায় ।
--- তাইন কিতা মেমসাহেব নি ।
--- আমার নানি বহুত বিলাতি মাত জানে ! নানি
ডাকলে গুসা করে, কয় গেনি ডাকিছ । আমি কই না ।
বৈতল কালুরামের কথা শুনে হাসে ।
বাকিদের দিকে তাকায়, সবাই হাসছে । ফিসফিসিয়ে হাসছে বছই, হাসছে আপদ, দুখুর কাঁধে হাত
রেখে ঢলে পড়ছে । দুখুও তার হাড়জ্বালানি মুচকি হাসির প্রশ্রয় দিচ্ছে কালুরাম
হাজামকে । বলেছে,
--- অই বেটা, তুইন তো কইরে খুব কামলা তুই ।
--- আমি কামলা উমলা নায়, আমি নাউ ঠাকুর ।
--- বুঝছি, কামলা বেটা, মাটিকামলা কইয়ার না,
তুইন খুব কামর মানুষ । অখন আমার একখান কাম করি দে দেখি । এক বদনা পানি আনি দে ।
--- বদনা পাইতাম কই ।
--- তুই যেতা পাছ অতাত অউ লই আইছ । যা ।
দুখু আপাতত তাড়িয়ে দেয় কালুরামকে । বৈতল জানে এবার ভাষণ শুরু হবে । কী বলবে
তাও জানে । বলবে, আল্লার তৈরি দুনিয়ায় সব মানুষ সমান, কারো শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে
হাসতে নেই । কালুরামের কণ্ঠস্বর সাধারণ মানুষের মতো নয়, মেয়েলি, খোনাখোনা আহ্লাদি
কণ্ঠস্বরে পুরুষ মহিলার মাঝামাঝি একটা অবস্থান নির্ধারিত হয় । আর তাই নিয়েই ওদের
মজা । বৈতল বুঝতে পারে না মজা করতে বাধা কোথায় । দুখুর সব তাতেই বাড়াবাড়ি, সে যখন
বৈতলকে নিয়ে যা নয় তাই বলে তখন কোথায় থাকে নীতিপণ্ডিত মানুষ । আসলে দুখুর সব তাতেই
মোড়লি । নেশা ভাং করে না বলে সব নীতিকার মালিক হয়ে গেছে । কথায় কথায় সে আল্লাকে
খদাকে ডেকে আনে, একবারও তো সে ভগবানের কথা বলে না, রাধামাধবের কথা বলে না । বছই
আপদ আবার সাপের ভয়ে মাঝে মাঝে মনসা আইকে ডাকে । না ডাকুক, না ডাকলেও দুখু বৈতলকে
তো ডাকে । যতই রাগারাগি করুক বৈতলকে তো ছাড়ে না । মনটা তো ভাল ।
বৈতলের গুরু সৃষ্টিধর ওঝা বলেছেন, ধর্মপ্রাণ মানুষ বড় শান্তিপ্রিয় হয় । দুখও বলে,
কোরাণ বইতেও নাকি লেখা আছে প্রতিবেশির প্রতি সম্মানের কথা । বৈতল বোঝে না, সব
গ্রন্থে, সব বইএ কিতাবে যদি শান্তির কথা থাকে, প্রতিবেশীর প্রতি সম্মানের কথা থাকে
তবে কেন তাড়িয়ে দেয় পাশের বাড়ির রবিলালকে, শান্তি কৈবর্তকে, মানুষকে মারে
শ্রীমঙ্গল, ধর্মপাশায় । দুখুর সঙ্গে তর্ক করা যায় না । ওর ইচ্ছে হলে ভাল ভাল কথা
বলবে, ইচ্ছে হলে পাকিস্তানের পতাকা ওড়াবে । তবে এবার কালুরামকে তাড়িয়ে সে ভিন্ন
কথা বলে । বৈতলকেই উদ্দেশ্য । বলে,
--- দেখ, তুইন যেতা ভাবরে ইতা অইত নায় । ই
বেটিমুখা বেটা ইগুরে লইয়া আমরার কিচ্ছু অইত নায় । ইগু অইল জাত চুর, পারলে হে তরে
আমারেউ চুরি করি লাইব । দুই দিনর লাগি ঢং ঢাং করিয়া ছাড়ি দে ।
দুখুর ওস্তাদি কথায় রাগ হয় বৈতলের । বৈতলকে সে
ভেবেছে বোকা । দুখু থেকে বেশি বুদ্ধি ধরে সে । কালুরামের গন্নাকাটা গলার কথা নিয়ে
মজায় মজেনি বৈতল । বৈতল জানে ও ব্যাটা সঙ্গে থাকলে অসুবিধা নেই, ফাইফরমাশ তো খাটতে
পারবে । আর গায়ের রং । সে তো বলেইছে ভুষোকালি মেখে নেবে গায় । চুরিবিদ্যা কতটুকু
জানে সেসব নিয়ে ভাবে না বৈতল । তবে ওর সঙ্গী টিকরবস্তির খন্ডল আর বেরেঙ্গার সোনাওর
দাগী চোর । বোবা খন্ডলের গায়ে অপরিসীম শক্তি, আর শুঁটকিওলা সোনাওর চোরাই মাল
বিক্রিতে ওস্তাদ । বছইর ঘনিষ্ঠ । ফাটকবাজার শুটকির ছন্তর থেকে মাল পাঠিয়ে দেয়
কুকিতল, ওখান থেকে সোজা পাকিস্তান । বৈতল জানে এদের নিয়ে তার কোনও কাজ নেই, কিন্তু
কালুকে সে সহজে ছাড়ছে না । কালুর মধ্যে কিছু একটা আছে, যা বৈতলকে টানে । গাঁজায় দম
দিয়ে কালু কথা বলে । কথার দম এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় । ঘোড়দৌড়ের মাঠে ভূতের কণ্ঠস্বর
নিয়ে ওর উদয় থেকে কুলগাছের পাশে এক তেঁতুল গাছের গল্প, জামাই বৌ গাছের
নবপ্রস্তাবনা । এখন জামাই আছে বৌ নেই, নাকি জামাই নেই । কালু হাজাম বিহারি
ভাষায় বলে, ইমলি । ইমলি গাছটাই উধাও, কেউ জানে না কেউ বলেনি এমন তেঁতুল গাছের কথা
। মোহরের গল্পটাও একেবারে গাজাখুরি কি । বোকা তো নয় প্রায় কিম্পুরুষ কালু, বোকা
হলে নয় মাটি কাটার একটা যুক্তি হয় । কোথাও একটা কিছু আছে । বৈতল এতদিন নদী আর তার
আকার নিয়ে লড়ে গেছে দুখুর সঙ্গে । এবার তার নতুন লড়াই কালুরামকে নিয়ে । নদীর পাশে শহর, আর তার মাঠ, মাঠের মধ্যে গুপ্তধন । দুখু বিশ্বাস করে না মোহরের
গল্প । মাটির ভিতর থেকে মামলত বেরোয় না জানে বৈতলও । তবু সে কালুর গাঁজাখুরিকে
গুরুত্ব দেয় । হেডমাস্টার বৈতলকে শুধু ভুগোল শেখায় নি, ইতিহাসের হাতছানি ধরতেও
শিখিয়ে গেছে ।
রাত অন্ধকার । চার মালিকের
আশ্চর্য প্রদীপসুন্দর জিন ফিরেও আসে মুহূর্তে । ক্লাবের পিছনের কাঁটাতার ডিঙিয়ে
ভাঙা বালতিতে জল নিয়ে ফেরে কালু । দুখু মিয়া তফনের গিঁট কোমরের উপর উঠিয়ে নেয় ।
গোড়ালির উপরে ওঠে লুঙি । বালতির জলে কনুই ভিজিয়ে নেয়, মুখে জল দেয়, পা ধুয়ে জল রাখে
আপদ বছইর জন্য । কোমর থেকে গামছা খুলে ঝেড়ে নেয় । দুভাঁজ করে মাটির উপর বিছিয়ে নেয়
। দুখুর সময়জ্ঞানও নিখুঁত । হাঁটু গেড়ে নামাজের শুরু করতেই দূর থেকে ভেসে আসে
ইটখোলা মসজিদের আজানধ্বনি । দিনের শেষ প্রার্থনা । দুখু বলে আল্লার গুণগান । একবার
করলেই হয় । আপদ আর বছইর উপর রাগে । বলে,
--- ইতা কুনু বাঙ্গাল নি । ইতা মুসলমান নায় ।
ইতা দেখানির মুসলমান । খালি ইদর দিন ইদগাত গিয়া দেখাইয়া আইল । ফজরর নমাজ পড়লে কিতা
হয় রে বেটা, ঘুম তো ভাঙব । কিতা কছ তুই বৈতল ।
বৈতল প্রমাদ গোনে । কী বলতে কী বলবে আর রেগে
যাবে দুখু । সে নিজেই কি ধর্মাচরণ করে ঠিকঠাক । শুধু শ্রাবণীর সময় আইর পুঁথি পড়া
ছাড়া কখনও কোনও আখড়া বা মন্দিরে যায় না । যদিও আখড়া তার খুব প্রিয় জায়গা । কীর্তন
ভাল লাগে গান বলে । আর ভাল লাগে আখড়ার প্রসাদ, পঞ্চব্যঞ্জন । শ্যামাসুন্দর আখড়ার
মতো ভোগ সে কোথাও খায় নি, বইয়াখাউরির শ্যামচাঁদের আখড়ার লাবড়ার গন্ধ এখনও নাকে
লেগে আছে, পাগলার আখড়ার খিচুড়ি ভোগের মুলো আর কচুরমুখিতে শীতকাল ম ম করে । মালির
ভিটা কালিবাড়ির ভোগে কোনও আলাদা গন্ধ থাকে না । মাছ মাংস আর কারণ সেবাই প্রধান
গিরিবাবার মন্দিরে । দুখুর সালিশিতে বিব্রত বৈতল তাই বছই আর আপদকে ধাক্কা দেয় ।
বলে,
--- অই বেটা যাছ না । আল্লারে ডাকি লা একটু ।
মৌলবি ইগুরে ঠাণ্ডা করি লা ।
ব্যাস আর যায় কোথায় । বৈতল যা ভেবেছে তাই,
বৈতলের দিকে ঘুরে যায় নিশানা । মাটিতে পেতে রাখা জায়নামাজ, তার সব কাজের কাজি
গামছা কাঁধে বৈতলের দিকে ঘোরে । বলে,
--- অই মৌলবি কছ কারে । মৌলবি হওয়া অতো সহজ
নায় । যেতা জানছ না ইতা মাতিছ না । নমাজর সময় আছে, সময় গেলে গি অইত নায়, বক্তর কাম
বক্তো করন লাগব । ইতা তোর অংবংচং নায় ।
--- এ আমারে হুনাইরে কেনে বে ইতা । আমি কিতা
করতাম । হাইর উপরে গুসা, পাড়াপড়শির উপরে নি ঝাড়বে । হে । তে কইলেউ
যখন কই । আমি অখনো যোয়ান ধাক্কাড় আছি,অংবং করন লাগে না । ই দুগুও তোর মতন থুড়থুড়া
বুড়া অইগেছে না যে খালি উঠবইশ করব হারাদিন । আর তুইও কিতা আছলে আমি জানি, অখন বেশি
ইমামতি দেখাইরে, দুইদিন আগেও কসবি লইয়া ঘুরচছ অখন তসবি ঘুরাইবে । আর তুই আমারে
হিকাইছ না আল্লার মহিমা । আমার গুরুয়ে ইতা সব শিখাইছইন । তাইন খালি গান গাইতা ।
গান গাইয়া শিখাইতা । তর মানো অখন খুব গুসা । গুসা ঠাণ্ডা করার এক সুর হুনাইয়ার হুন
।
অনেকদিন পর বৈতলকে গানের নেশায়
পায় । গুরু সৃষ্টিধরকে প্রণাম করে রাতের আঁধার ভেঙে গায় ভানু শেখের গান,
--- ‘মন তুমি জপ না ইল্লাল্লাহ, ইল্লাল্লাহ
জপিলে যাইরে রে মন তোর হৃদয়ের জ্বালা
মন তুমি জপ না ইল্লাল্লাহ ।’
আল্লাকে ডাকলে হৃদয়ের জ্বালা
জুড়োবে দুখু মিয়ার । বৈতলের কী হবে তবে । বৈতলের রাগ জুড়োবে কোন গানে । বৈতলের রাগ
ঠাণ্ডা হয় না । খোনা নাপিতকে নিয়েই যখন সব উৎপাত, দুখুর রাগ, ও ব্যাটাকেই তাহলে
তাড়াবে এবার । কালুরামকে পিছন ঘুরিয়ে দাঁড় করায় বৈতল, আর মারে এক লাথি । ছিটকে গিয়ে পড়ে তিনহাত দূরে । মার খেয়ে হাসে কালু । বৈতল এবার তাকায় দুখুর
দিকে । বলে,
--- ইগু কিতা দেখরে নি । মাইর খাইয়াও হাসের ।
তুই খেদা ।
--- হাসব অউও । শয়তান খালি হাসে । ইগু ইবলিশর
বাইচ্চা ইগুরে মারিয়া কিচ্ছু অইত নায় ।
--- বুঝছি, উবা । অই কেন্ কেনাউরা । একদম
সাফসাফ কইলা, তুই আমরার লগে আঠাইলর লাখান লাগি রইচছ কেনে । কেনে ইতা মোহরর গফ
বানাইলে । আমরারে দিয়া নি মাটি কামলার কাম করাইতে । তোর ভকা বোবা ইগু আছে নানি
খণ্ডল, আর শুটকির দোকানদার সোনা । তারারে লইয়া মাটির তল থাকি বার কর তোর নানিহালি
সম্পত্তি । অখন ভাগ তোর বাল্টি লইয়া । আর কুনুদিন আমরার ধারো কাছো দেখলে কিন্তু
তোর একদিন কী আমার একদিন । মোহরর মাটিত তোরেও গাড়ি লাইমু ।
--- ঠিক তো । তোমরা অউ কতা কইলায় । নানির কথা
মানলায় নায় তো । মোহর আছে, মেকুর সাহেবের মোহর । সোনার চাক্কা, আমি দেখছি । সব
গাড়ি রাখছে সাহেবে বরই গাছোর তলে ।
--- মেকুর সাহেব ।
আবার সমবেত হাসি । হাসতে হাসতে রাগে বৈতল । বলে,
--- আবার ঝাড়রে, নানি । মেকুর আবার সাহেব অয়
নি । মেকুর তো বিলাই ।
--- বিলাই নায় ঘুড়া । ঘুড়ার নাম লিলি ।
--- আবার উল্টাপাল্টা মাতরে । দেখি তোর অউ
চক্রাবক্রা পেন্ট অগু খোল । তুই ঘুড়া না ঘুড়ি দেখি লাই । লিলি কুনুদিন ঘুড়া হয় না
বে আউয়া ।
--- আইচ্ছা তে ঘুড়ি অউ বালা । ঘুড়ি লইয়া আইত
সাহেবে কেলাবো । হনো কাম করত এক বিল্টুফুল ছুকরি । খুব সুন্দর ।
--- হিগুর নামও নি লিলি । সাহেবে বিয়া করি লই
গেছে বিলাতো । অউত্ত গপ । ইতা আমরা জানি ।
--- না বিয়া করত পারছে না, এর আগেউ মরি গেছে
। সাহেব মরল তেতই গাছর তলে, মনর দুঃখে ঘুড়াও মরি গেল । ইমলি গাছও মরি গেল ।
--- ভালাউত্ত সব মরি গেল, সব সাফ । মরল না
কেউ মারল ।
--- কে মারত । ভৈরব বাবার শাপ ।
--- তুই কালু কই থাকি যাইরে, থামাইতে পারবে
নি ।
--- আমার বাপে কইছে । আমার ঠাকুরদাদা সাহেবর
দাড়ি কাটত । লিলির পাও নাল পিন্দাই দিত । আমরার বাড়িত অখনও আছে ঘুড়ার নাল ।
--- ঠিক নি, আছে নি । আনিছ চাইন, দেখমুনে ।
বৈতলের মন টগবগ করে ফোটে । আবার সে বরাক নদীর
জলের ছলাছলাৎ শুনতে পায় । শহরকে নদীর সঙ্গে জুড়ে দেয় এবার । কালুকে যখন বলে দিয়েছে
তখন নিয়ে আসবে নিশ্চয় ! দুখুকে দেখানো যাবে নদীর আকৃতি ।
শহরের নিস্তরঙ্গ জীবনে সাময়িক
ঢেউ খেলে জায় দূর সরসপুর জঙ্গল থেকে বাঘ মারার খবরে । মিয়াবাড়ির ছেলের সঙ্গে
হিন্দুবাড়ির মেয়ে নন্দার পালিয়ে যাওয়ার খবরে । সেন্ট্রাল রোডের চন্দবাড়ির সামনে
কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হয়ে শোকপ্রকাশ করে অরুণ কুমার চন্দর প্রয়াণে । কাছাড়
জেলায় কংগ্রেসের অবিসংবাদী নেতার বিদায় । জোয়াল কাধে জোড়া বলদ প্রতীকে তারপর রইলেন
সতীন্দ্রমোহন দেব যতীন্দ্রমোহন দেব লস্কর দ্বারিকানাথ তেওয়ারি ময়নূল হক চৌধুরী ।
বিরোধীপক্ষে আর কে কোথায় । অচিন্ত্য ভট্টাচার্য বীরেশ মিশ্ররা তো সরকার-বিরোধী তাই
লুকিয়ে । তারাপদ ভট্টাচার্য কাছাড় হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেছেন, গোলাম ছবির খান
শহরের বিবেক হয়ে হিন্দু মুসলমানের মিলন সেতু গড়ে চলেছেন । শান্তির শহরে সাহেবদের
রমরমা ধীরে ধীরে শেষ হচ্ছে । পুতুল দত্ত ভুতু চৌধুরীরা শহরের নতুন সাহেব, চা
বাগানের মালিক । সেন্ট্রাল রোড থেকে সাহেব রুটির সবচেয়ে বড় যোগানদার ইসমাইলের
দোকানও বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে । সাহেব চলে যাচ্ছে, রুটি খাবে কে । খাসিয়া পট্টিতে
একঘর অ্যাংলো ইন্ডিয়ান শুধু । জন স্মীল ও ক্রোজিয়ার কোম্পানির মালিকানাও বদল হয়ে
গেছে । শিলচর থানায় তিন চোর ধরা পড়ায় শহর একটু সরগরম এখন । এর মধ্যে দুজন দাগি ।
দাগি দুজনের একজন বোবা অন্যজন ফাটকবাজার শুঁটকি ছন্তরের দোকানদার । নতুন চোর
কালুরাম হাজাম সাহেব ক্লাবের সেলুন কর্মী । কালুরাম বন্দী হওয়ায় মন খারাপ হয়
বৈতলের । দুদুটো উত্তেজক বিষয়ের সমাধান পিছিয়ে যায় । ঘোড়ার নাল দেখা হয় না বৈতলের,
মোহর রহস্যেরও কোনও সূত্র পাওয়া যায় না । তবে বৈতল নিশ্চিত সে কালুরামকে ছাড়বে না
। চুরির আসামি বেশিদিন হাজতেও থাকে না, জেলেও না । ছাড়া সে পাবেই অচিরে, খোনা গলায়
এমন নাটক করবে যে জজ পুলিশ কেউই ধরে রাখতে পারবে না । বৈতলও তক্কে তক্কে ঘোরে তার রিক্সাগাড়ি
পঙ্খীরাজ নিয়ে । তবে জেল রোড আর জানিগঞ্জ আর ফাটকবাজারের মুখেই সদর থানা । জেল
রোডে জেল । বৈতলের চোখ কালুরামকে খোঁজে ।
চার্চ রোড এর তিনমাথার উপর জেলার
এর সরকারি বাড়ি । বৈতলের রিক্সা সওয়ারিসহ থেমে যায় জেলটিলার মুখে । গোপালগঞ্জের
মনিহারি দোকানের পাইকার গোষ্ঠ পাল-এর বাড়ি ইটখোলা ঘাট । বৈতলের বাঁধা সওয়ারি ।
দোকানে দোকানে ঘুরে তাগদা দেয় । বৈতল সর্বক্ষণের সঙ্গী থাকে । গোষ্ঠ পালের এক
ভাড়ায় চৌকিদারও হয়ে যায়, পালকাকু জানে বৈতল সঙ্গে থাকলে তার খুতি নিরাপদ । কিন্তু
আজ বৈতল কাকার সঙ্গী হতে পারে না । টিলার দিকে রিক্সা উর্দ্ধমুখি রেখে ব্রেক
চাপে । বলে,
--- পাম বারই গেছে । আর যাইতাম নায় । আপনে
দেখিলাইন আর একটা ।
--- অখন আমি কও চাইন ই মাঝপথো কই পাইতাম ।
--- পাইবা তিন মাথার মুখো উবাইন ।
--- তুমার আকতা কিতা অইল বা । পাম উম তো ঠিক
অউ আছে ।
--- আপনে কুনু রিক্সা ড্রাইভার নি । পাম বুঝি
আমরা । লামইন, যাইন পয়সা দেওন লাগত নায় ।
গোষ্ঠ পালকে নামিয়েই মুচকি হাসে বৈতল । পাওয়া
গেছে, তার অভীষ্টে পৌঁছে গেছে । কালুরামকে পাওয়া গেছে । লোভী কালু বৈতলের কথা
শোনেনি । চা বাগানের সাহেবকে বাংলোয় গিয়ে দাড়ি কেটে আসতে বসেছিল । সাহেব বাড়ির
ফাঁক ফোঁকর ট্রাঙ্ক সিন্দুকের হদিশ আনতে বলে । বেটার আর তর সয় না । চণ্ডীঘাট বাগান
থেকে ধরে আনে পুলিশ । এখন জেল দারোগার চুলদাড়ি কাটে আর সব্জিবাগানে খুরপি চালায়
কালো ডোরার নিমা আর আণ্ডারপ্যান্টে । বৈতলকে দূর থেকে দেখেই চিনতে পারে কালুরাম ।
বৈতলকে কে রোখে, সোজা ঢুকে যায় জেলবাগানে । কালুর মাথায় মারে এক কিল । বলে,
--- খাওয়াইতে নি আর বিলাতি সিগারেট । অখন তো
তুই অউ অই গেচছ কাঞ্চির বাক্স । বিচরা আলা অইচছ । হালার হালা জানছ না, অতি লোভে
তাতি নষ্ট । কুনদিন ছাড়ব জানছ নি ।
--- জানি না । আগে তো ধরা খাইছি না । ছাড়ব
নিবা তাড়াতাড়ি ।
--- তরে তো হুনছি চুরির লাগি ধরছে না ।
হিতায়তো ছাড়া পাই লাইছইন । তুই তো খুনির আসামি । তর হাতো খুর আছিল । মেমসাহেবরে
মারতে গেছলে ।
--- ইতা মিছা কথা ।
--- আমি জানি, কিন্তু পুলিশে যখন ধরছে ছাড়ব
নি । খুন আর ডাকাতির লাগি যাবজ্জীবন অই যাইব ।
--- হে, আমারে বাচাও রেবা ।
--- কেনে, তোর জেল অউ ভালা, বিচরাত কাম কররে
। খাইরে দাইরে চিত সুখে গান গাইরে আর কিতা । বউত পয়সা পাইবে বারনির সময় । তর আর কে
আছে ক ।
--- কেনে, বাপ আছে, নানি আছে ।
--- মোহর আছে । ঘুড়ার নাল আছে । হালার হালা
খালি নি গাইঞ্জা ঝাড়ছ । তর লাগি দারোগারে কইতাম পারি । কইতেও ডর লাগে ।
--- তুমি চিনো নি দারোগারে । কও না ।
--- কইতাম পারি । আমার রিক্সাত অউত ভৈরব বাড়ি
যায় ।
--- তে কও রেবা ।
--- কেনে কইতাম ক চাইন । বার অইয়া অউত্ত ঢুলা
মারবে আবার । নানির গপ করবে, মোহর গপ করবে, ঘোড়ার নালর গপ করবে ।
--- আছে সব আছে, নানি তো মোহর বেচিয়াউ খায় ।
--- আর নাল । বেচি দিছে নি লুয়ার টুকরা ।
--- আছে ।
--- কই আছে কই দে, সব তোরে দিলাইমু, খালি
লুয়ার টুকরা নিমু ।
--- পারতায় নায় । আমি নাতি অইয়াউ পারছি না ।
--- তর বাড়ির ঠিকানা ক দেখি । বৈতলে পারে না
কিতা । দেখিছ । ডরাইছ না, ছাড়াইয়া আনমু যা ।
বৈতল ইমলিবাড়ি খুঁজে পায় ।
তারাপুর মেথর পট্টির গা-লাগোয়া বাড়ি । সর্বক্ষণ দুর্গন্ধ । লোকে বলে
মালগুদাম । বিদ্রূপ করেই বলে, আসল মালগুদাম তো মালুগ্রামে । চাউল গুদাম । এত চালের
বস্তা যে কোথা থেকে আসে । কয়েক বিঘা জমির উপর লাল বাড়িটার কোনও দরজা জানালা নেই ।
দুর্গাবতীও দেখেনি এমন বাড়ি । বৈতলকে বলে,
--- ই বাড়িত মানুষ থাকে নি । অত উচা করছে কেনে ।
--- জানো নানি, ইখানো বেঙে মুতলেও পানি অই
যায় এর লাগি উচা করছে । সারা জিলার উগার । চাউল থাকে ।
--- অত চাউল কই থাকি আয় ।
--- কী জানি, ইছপল্টু দিয়া চাল রে ই চান্দর
লাখান তেড়া করছে কেনে ।
--- চান্দ তেড়া না অইলে সুন্দর অইন না ।
চান্দ সবসময় তুমার লাখান, এর লাগি । লাল রঙ করায় আরো সুন্দর লাগের নানি ।
প্রশংসা করলে দুর্গাবতীর লজ্জা
হয় । লজ্জায় লাল হয় । গ্রামের মেয়ে দুর্গাবতী শহরের কিছুই দেখেনি । তাই ওর
অবাক-করা চোখে বৈতলের গর্ব আর ধরে না । বৈতল নিয়ে এসেছে বলেই না দেখা । রেলগাড়ির
ঝমঝমি দেখেছে দেশে থাকতে । তিন চাকার রিক্সা দেখেনি কখনও, শিলচর রেল স্টেশনে সার
সার রিক্সা দেখে অবাক হয়েছে । দুর্গার বিস্মিত চোখে চোখ লাগিয়ে বসে থাকতে পারে
বৈতল । সুনামগঞ্জ সিলেট বিয়ানিবাজার করিমগঞ্জে রিক্সা দেখেছে বৈতল । রিক্সা দেখে
বিস্মিত হওয়ার কারণ খুঁজে না পেলেও দুর্গাকে বলেছে,
--- তিন চাক্কার গাড়ি । মাইনষে চালায় ।
--- একেবারে রথর লাখান ।
--- রথ দেখলায় কই ।
--- ইতা শুনিয়া শুনিয়া ভাবি লাইছি । রামায়ণ
মহাভারতো ছবিও দেখছি ।
--- চড়তায় নি ।
--- না, পয়সা লাগব । বাদ দেও পরে চড়মু নে ।
--- পরে কেনে তে । তুমার হাউস অইছে, অখন অউ
চড়তায় ।
বৈতল মেয়েদের তুষ্ট করার ঔষধ জানে । অল্পেতেই
খুশি হয়ে যায় মেয়েরা । ইমলি বুড়ির জন্য ইসমাইলের দোকান থেকে এক আনার গরম বানরুটি
চারটে কিনে নেয় । গরম রুটির গন্ধে লোভ হয় বৈতলের । চারটে থেকে দুটো কমিয়ে রাখলেই
হয় । কিন্তু মালগুদামের গন্ধে সব ভুলে যায় । ওয়াক আসে পেটের ভিতর
থেকে । শহরে এমন মালগুদাম কয়েকটি আছে । খাসিয়াপট্টিতে একটা, একটা তারাপুর আরো আছে
হয়তো জানে না বৈতল । গ্রামে তাদের এসব নেই । মাটির গর্তে পড়ে কালে কালে মাটি হয়ে
যায় গু । বিষ্ঠা সংগ্রহ, জমানো তার পর পোড়ানোর এত সব প্রক্রিয়া বৈতলও জানে না ।
বৈতলের যখন দুর্গন্ধে বমির ভাব হচ্ছে তখন নালার পাশে বাচ্চারা খেলছে । বৈতল একদল
বাচ্চার সামনে কিড়িং কিড়িং ঘণ্টি বাজায় । বলে,
--- অই বাইচ্চা । কালু নাপিতর বাড়ি চিনছ নি ।
--- চিনি না ।
--- ইতা কিতা খেলরে বে ।
--- ডাগ্গি, তাস দিয়া খেলি ।
--- ইতা নি তাস । সিগারেটর বাক্সর কাগজ ।
--- অতাউ আমরার তাস । আর অউ পাত্থরর টুকরা
ডাগ্গি । খেলতায় নি । এক পয়সা দেও দশ পাত্তি দিমু ।
বৈতলের লোভ হয় খেলায় নামার,
কিন্তু এক কাজে এসে অন্য কাজে জড়িয়ে যাওয়া স্বভাব নয় তার । বলে,
--- খেলমু, অখন নায় । রিক্সা ইগু দেখিছ রেবা
। আগে নানির বাড়ি বার করি । এবার নানির নাম শুনে বাচ্চারা খেলা থামিয়ে ছড়া কাটে,
--- মারমু ঘুড়া চড়মু গাড়ির বুড়ি নি ।
--- হে ।
--- তে আগে কইলায় না কেনে ইমলি বুড়ির বাড়ি ।
--- অখন তো কইলাম ।
--- তুমার হাতো কিতা ।
--- বনবিস্কুট ।
--- মেম খায় বিসকুট । অউ বাড়ি ।
কালুরাম এক মহা ঢপবাজ । মাঝে
মাঝে কিছু সত্য কথাও মিশিয়ে দেয়, বোঝা যায় না । কালু বৈতলকে বলেছে ওর নানির বয়স
একশ বছর । বুড়ির চামড়া ঝুলে গেছে, মুখের শত কুঞ্চনেও অপরূপ রুপের ছটা হারিয়ে যায়নি
। বস্তিবাড়ির ঘর এত পরিপাটি করে রাখে কে । সারা বাড়িতে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট ।
কিন্তু বৃদ্ধার এক চিলতে ঘরে যেন সব বৈভব সুন্দর করে সাজানো । সবচে বড় সম্পদ বুড়ি
নিজে । সাধারণ তক্তপোষ থেকে একটু দামি খাট বিছানা । বৃদ্ধা শুয়ে আছে রানির মতো ।
ধব্ধবে সাদা কাপড়ে কালো রুপের ছটা ছিটকে বেরোচ্ছে ।
বৈতল যত দেখছে, তত অবাক হচ্ছে ।
একের পর এক প্রশ্ন জড়ো হচ্চে মনে । অশক্ত এই মহিলাকে সাজিয়ে রাখে কে । বাচ্চাগুলো
যে ছড়া কাটে, তার কই কোনও রহস্য আছে । বুড়ির নাম কেন এমন । ইমলি মানে তেঁতুল,
কালুরাম তো তাই বলেছে । বৈতল শেষ প্রশ্নটাই করে বুড়িকে । বলে,
--- তুমার নাম ইমলি নি । ইমলি কিতা ।
--- আমরা বিহারী আছলাম । ঘুড়দৌড়র
মাঠর মাঝখানো তেতই গাছর নিচে আমার জন্ম । আমার মাও কাম করত কেলাবো ।
একশ বছর বয়স হলে কণ্ঠস্বর খোনা
ফোকলা হয়ে যায় । বুড়ির স্পষ্ট দেঁতো স্বরের কথায় ষোল বছরের বালিকার বেণী দোলে ।
বৈতল বুড়িকে লোভ দেখায় । বলে,
--- নানি, বনরুটি খাইতায় নি । ইসমাইলর দোকান
থাকি আনছি ।
--- ইসমাইল কে । পাউরুটির কারখানা আছিল
কেলাবো । কি গন্ধ রে ভাই । দে দেখি তর বন থাকিও গন্ধ বারর ।
বৈতলের মনের ধন্দ যায় না । বুড়িও
কি কালুর মতো ফন্দিবাজ না সরল মনের । তাই মোহরের কথায় না গিয়ে অন্য কথা বলে,
--- তুমারে কে দেখে নানি ।
--- কালু এ দেখে ।
--- কালুরে দেখার কেউ নাই, হে তুমারে দেখব ।
--- আমার পুয়া আছে, কালুর বাপ ।
--- মাইনষে কয় হেও মদ খাইয়া তুমারে পিটায় ।
--- আমার পুয়ার মন ভালা ।
--- হাচা কথা কইলায় না নানি । তুমার বউত টেকা
। মাটির তলে গাড়ি রাখছ । মোহর উহর ।
--- কালু আর তার বাপে নিয়া শেষ করছে ।
--- আমারে দেও না একটা ।
--- পাইবে । জামাই-বৌ গাছ চিনছনি । আছে মাটির
তলে । সাহেবে রাখি গেছে আমার লাগি ।
--- আইচ্ছা বাদ দেও ইতা গাইঞ্জা গপ । তুমার
কাছে বুলে ঘুড়ার নাল আছে । ইগুতো লুলার টুকরা, দিলাও ।
--- আছে, দিতাম নায় ।
--- বস্তির পুয়াইন্তে ‘মারমু ঘুড়া’ কইয়া
তুমারে চিড়ায় কেনে ।
--- কিচকামি করে । তোরে আমি চিনি, তুই বৈতল ।
বুড়িকে রাগিয়ে দিতে চায় বৈতল ।
সব রহস্যের দরজা জানালা খুলতে চায় । বুড়ি রাগে না । একশ বছর বেঁচে থাকার রহস্য
জেনে নিতে বৈতল নানির গলা জড়িয়ে ধরে আদরে ।
দিনের শেষে দুখুকে সব কথা না বললে বৈতলের পেটের ভাত হজম হয় না । তাই ইমলি
বুড়ি সন্দর্শনের তথ্য ও সত্য মিথ্যা মিলিয়ে জানায় তিন বন্ধুকে । বলে,
--- দেখিয়া আইলাম বেটা ঘুড়ার নাল । ঠিক
যেলাখান তেড়া আমরার মধুরামুখো বরাক নদী । মাস্টারে কইছলা ঠিক অউ ।
--- আনচছ নি তে ।
--- আনছি ।
---দেখছ না ।
--- বাসাত রাখি দিছি ।
--- বালা করচছ, দরজার উপরে লাগাই রাখি দিছ ।
বুরা নজর থাকি বাঁচবে । তর বউ আবার অলা সুন্দর । কেউ হাত দিতো পারত নায় ।
--- হাত্তাইশ মন ঘি দি মাঞ্জিলেও কুত্তার
লেঙ্গুর সিধা অইত নায় । ভালা কথা মাতিয়ার ইখানো ঘরর বৌরে কেনে আনলে
বে কুত্তা । আর ঘুড়ার নাল কেনে নিছি তুই বুঝতে নায় । তর খুপরিত ঘিলু নাই ।
--- অয় সব ঘিলু দিয়া তুই বিরিয়ানি বানাইবে ।
মাদরেছা খুলবে । ফাজিল পরীক্ষাত পড়াইবে ঘুড়ার নাল । নদী কিলাখান । বৈতল ছাবে
কইছইন, ঘুড়ার লেইঞ্জর লাখান । তেউ ফাশ ।
--- তুই তো বেটা আধাখান জিন আধাখান ভূত । তোর
গতি কই অইব ক । তুই ফাশও করতে না, ফেইলো করতে নায় । লটকি থাকবে, অউ মেকুর সাহেবের
লাখান বরই গাছো ।
--- বরই গাছ দেখাইরে তুই আমারে ।
--- অয় দেখাইয়ার কিতা করি লাইবে ।
--- আধা বেটি কালুর লগে আর এক বিয়া দিলাইমু
তোর । অতউ যখন পিরিত ।
--- অ, অখন বুঝলাম হালার হালার গুসার জড় ।
মোহর নি আমি একলা খাইলাই । দোস্তি দেখাছ বেটা ।
--- কালু ইগু ঠগ জানছ নি ।
--- কেমনে কইলে ।
--- মেকুর সাহেবের গপ বানাইছে । নাপিতে
সাহেবের চুল দাড়ি কাটত । আর ছুকরি ইগু আয়ার কাম করত কেলাবো । সাহেবের লগে লেট পেট
অই গেছিল । নাউয়া ইগুয়ে মানত কেনে, তার নু বউ । সাহেবের গলাত খুর লাগাই দিল, ঘুড়াও
মারল । দুই লাশ লইয়া আইল তেতই গাছর তলে । এমনেউ মাইনষে রাইত আয় না মাঠর মাঝখানো ।
গাছ কাটিয়া নাপিত ধুনি জালাই দিল । অউত্ত গপ ।
--- তুই কিচ্ছু জানছ না ।
--- তুইন কিতা জানছ ।
--- নাপিত ইগু একলা আছিল না ।
--- তুইন হক্কলতাউ খালি টানিয়া লম্বা করছ ।
--- অই বেটা বাট্টি, কওয়া কওয়ির কিতা । বেটি
ইগু লগে আছিল । ইমলি, তেতই । অউ বুড়ির বাড়িত গেছলাম আইজ । একুশ বছর
বয়স । কী সুন্দর বে বুড়ি, কিতা কইতাম । আমারে দিত নায় কইল ঘুড়ার নাল, দিল অউ না ।
--- তে নু কইলে ।
--- কইলাম আরি ।
দুখুর কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার দুঃখ
নেই বৈতলের । আসলে বৈতলের ভিতর যে আবিষ্কারের আনন্দ টগবগ করে ফুটছে তার ভাগ নিতে
পারে ঐ বেঁটে মানুষটাই । ঢপবাজ কালু হাজামের ঠাকুরমাকে দেখেও বিস্মিত হয়েছে বৈতল ।
মনে হয়েছে শহরের জ্যান্ত ইতিহাসের নড়াচড়া দেখে এল । মেকুর সাহেবের উপকথা সত্য হলে
এক প্রজন্ম পরে সাদা চামড়া ফিরে আসার বিস্ময়টাও কম নয় । বুড়ির মোহরকথায় গা করে নি
বৈতল । কিন্তু ঘোড়ার নালটা সে হাতিয়েছে । দুখুকেও মিথ্যে বলেনি একবর্ণ । ইমলি
বুড়ির সৌভাগ্য বৈতল ঘরে রাখে নি । বরাক নদীকেই সমর্পণ করে অন্নপূর্ণা ঘাটে । তাই
বুড়ির মৃত্যুসংবাদে আত্মীয়বিয়োগের দুঃখে কাতর হয় । দুখুকে বলে,
--- শ্মশানো যাইতাম নি ।
দুখু না করে । কিছু একটা বুঝতে পারে । বলে,
--- বাদ দে, যাইছ না । এর থাকি চল নদীর পারো
বই থাকি ।
দুখুর এই বন্ধুমন বৈতলকে আকৃষ্ট
করে । বৈতল দুখুর হাত ছুঁয়ে দেখে । মনে হয় এই লোকটা থাকলে বৈতল নিশ্চিন্ত ।
বিপথগামী হলেও টেনে তুলবে । বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবে । লড়তে লড়তে বৈতল বন্ধুত্ব
মজবুত করবে । লড়াই কি কম হলো । এই নদীর আকার নিয়ে কত কথা । বৈতলের কোনও কথাই দুখুর
পছন্দ নয় । ঘোড়ার ক্ষুরের বইকথা আর মানতে হবে না দুখুকে, নদীর আকার বৈতল নদীকেই
দিয়ে দিয়েছে । খুরাদিল বাটি গ্লাস, গুলতির বাঁট, ভাঙা হাঁটুর উপমা কিছুই মানেনি ।
বৈতল বলে চাঁদের মতো, শিব ঠাকুরের মাথায় যে-চাঁদ, মসজিদের মাথার যে-চাঁদ । তাও
বেটা মানে না । কাঁখে কলসীর উপমা তো বলেইনি । আসলে বৈতলই বুঝতে পারেনি তার সব
উপমা, দুখু তার সব কথাই মানে, বৈতলের ছেলেমানুষিকে শাসনের মান্যতা দেয় । তাই
দুখুকেই সত্য মানে, দুখু যখন নদীকে ডাকে ‘বড বেকা’, তখন মনে হয় আর সব নাম মিথ্যে,
উপমা অর্থহীন ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন