“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

সুরমা গাঙর পানিঃ উজান পর্ব ১৫

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  উজান  পর্বের  অধ্যায়  পনেরো  ---সুব্রতা মজুমদার।) 

  
পনেরো

বৈতল ভুল করেছে । প্রথম দর্শনেই ছোবল ফিরিয়ে দিয়েছে । মেহেরপুর রিফুজি কলোনি থেকে বেরিয়েছে ভাগ্যান্বেষণে । শুনেছে ইটখোলা আর হরিৎবরণের জমিদার বাড়ির কথা । শুনেছে বাড়ির বিশাল উঠোনের মাঝখানে এক মহুয়া গাছের বৃত্তান্ত । জমিদারের কোন ঊর্ধতন পুরুষের লাগানো গাছটিই আজ পত্রপুষ্পে বিকশিত হয়ে সিংসদনের শোভা । পশ্চিম দেশের নেশাধরা ফুলের গাছ । সেই ফুলের গন্ধে নেশা ধরেছিল সিংপুরুষের অন্দরমহলে । ঘুন ধরেছে পরিবারতন্ত্রের বরগায় । লোকশ্রুতি এই, প্রজন্মে প্রজন্মে সিংবংশে বদল হয়েছে পুরুষকার স্থির থেকেছে পদবি ও উত্তরাধিকার । যুবা রাজার অপঘাত মৃত্যু এখানে নিয়তি । কালো রাজার পর শ্যামলা রাজা, তামাটে রাজা, বর্তমানে রাজার বর্ণ গৌর । জমিদার বংশে মহাভারতে ছায়া । রাজার মৃত্যু হলেও রাণিরা বহাল রেখেছেন বংশগতির ধারা । বর্তমান সাদা রাজা । যমুনা প্রসাদ সিংএর অন্দরে আছে আনন্দবাজার । তাই কড়া প্রহরা অন্দরমহলেপুরুষের প্রবেশ নিষেধ । যুবাপুরুষ তো নয়ই । রাজার মনেও সুখ ভিতরবাড়ির সৌন্দর্য নিয়ে । রাজার মনে আশঙ্কা অন্দরের আগুন নিয়ে । তাই আগুনের প্রতিষেধক করে জলের জাদুকর সৃষ্টিধর শর্মাকে । নিশ্ছিদ্র করতে হবে অন্দর প্রহরা । এমনকি জমিদারের সর্বক্ষণের প্রহরী পুরুষ ভোলা রজকেরও নেই প্রবেশাধিকারনবীনা মহিষীর নাম ফুলকুমারী, দুর্গাবতীর বয়স্তিনী । রাজপুরীর রক্ষণাবেক্ষণের ভার বৈতল হেলাভরে পরিত্যাগ করে । বৈতল কী আর বাঁধা কাজের কারিগর । বৈতল দুর্গাবতীকে বহাল করে দেয় অন্দরের তদারকিতে । ভুল করে বৈতল । বৈতল প্রতিপক্ষকে দুর্বল, নির্জীব ভাবে । যার উপর থেকে ছোবল সরিয়ে এনেছে সে কি আর আঘাত করতে পারে । হতে পারে অকৃতজ্ঞ । গুরু তো বৈতলকে সব বিষয়ে গূঢ় কথা বলতে পারেন না । নারীলোভ যে মানুষকে নরকের কীট থেকেও অধম করে, সে-সত্য জেনেও ভুল করে বৈতল ।
হরিৎবরণে জমিদারবাড়ির উঠোন তিনটেঅন্দরউঠোন সবচেয়ে ছোট, রান্নাঘর আর পিছনবাড়ির যোগাযোগ রক্ষা করে । উঠোনের মাঝখানে তুলসী মঞ্চবড় উঠোন ঘিরে রেখেছে বাড়ি । যার একদিকে বড়ো নাটমণ্ডপ যেখানে বছরে দুবার উৎসব হয় একবার শ্রাবণ মাসে বিষহরি উৎসব আর একবার আশ্বিনে শারদোৎসব দুর্গাপূজা । নাটমণ্ডপের গায়ে নিত্য পূজার মন্দির । নিত্যপূজায় এক বিশেষত্ব, মনসাদেবী লক্ষীদেবী হিসেবে পূজিতা হয়ে থাকেন । বড়উঠোনের মাঝখানেই সেই মহুয়া গাছ, গাছের ডালে ডালে মাতাল পাখির ওড়াউড়ি সারাবেলা । কিছু পরিণত বলে, কিছু জোর বাতাসে আর কিছু পাখির ঠোকরানোয় সাদা ফুল শিউলির সাজে ছড়িয়ে থাকে উঠোনময় । নাটমণ্ডপ আর পুকুরের মাঝামাঝি সিংহদুয়ার । দুই সিংহ দুদিকে, শহরে একমাত্র সিংহদুয়ারের বাড়ি । মানে ফটক, ফটক থেকে বেরিয়ে উঠোনের শেষমাথায় বৈঠকখানা । জমিদারের বসার ঘর, বাইরের বারান্দা । পুকুরের নাম পদ্মপুকুর, ঐ দূরে পুকুরের একপারে একসার পায়খানা । পুকুরের চারদিক ঘেরা তরজাবেড়ায় । পুকুরের আয়তন দেখে বৈতলের লোভ হয় । মাছ ধরবে মনস্থ করে মাছুয়া বৈতল । নছিবালি হাকিমের পুকুরে মাছ ধরায় সুখ নেই । বিশাল দিঘী হলে কী হবে, বড় অশান্ত । তিনদিকেই ঘনবসতির মানুষ, মাছের শান্তি নেই । তাই মাছও কম জলও অগভীর । জমিদার বাড়ির পুকুর শান্ত, সংরক্ষিত । মেহেরপুর থেকে ভোরের বেলা বেরিয়ে পড়ে বৈতল । মাছ ধরলে মাছ চায় না মাছুয়া বৈতল । আটআনায় এক খেপ । আটআনা শুনে আঁৎকে ওঠে অনেকে । বৈতল এক কথার মানুষ । বলে,
--- পুসাইলে মারাইবা, নাইলে আপনার মাছ আপনার । তে আমারে দি মারাইলে ঠগতা নায় । আটআনায় নয় আনার মাছ পাইবা
   বৈতল বলতে চেয়েছে ঠগবে না পুকুরমালিক কম করে একআনার মাছ বাশি পাবে । জমিদার যমুনা প্রসাদ তো বৈতলের শরীর দেখে হেসেই কাত ।  তার উপর কথার ছিরি ।
--- অউ বদন নিয়া মাছ ধরতে নি বেটা, নয় আনি দুকান নি ।
প্রেমতলা গোলাদিঘীর পারে এক অভিনব মনিহারি দোকানের পশরা বসেছে । হরেক মাল নয় আনা । ঠাকুরের বাঁধানো ছবি, কাপ প্লেট, ছুরি কাঁচি হাতা খুন্তি দাড়িকাটার রেজার, জগদীশগুপ্তর পকেটগীতা আরো অনেক কিছু, দরদাম নেই, দাম নয় আনা । বৈতলের কথার কথা আটের পিঠে নয় আনা বলায় বিদ্রূপে বিদ্ধ করে অচেনা মৎস্যশিকারকে । বলে,
--- আমার পুকইরর রউমাছর উজনঅউ তর থাকি বেশি ।
--- রাজার পুকইর, অইব অউত্ত । তে কলর কাম বলে অয় না, রাজায় তো আর উঠান ঝাড়ু দেইন না, পুকইরো মাছ ধরইন না । জাল একবার ফালাই, দেখইন না । নায় মাগনাউ মারি এক খেপ ।
বিনিপয়সায় জাল ফেলার পাত্র নয় বৈতল । কিন্তু তার শরীর নিয়ে তার কথা নিয়ে বিদ্রূপের জবাব তো দেওয়া দরকার । মাগনা কথায় জমিদার রাজি হয়ে যায় । বলে,
--- মারতে ।
মজা দেখতেই পদ্মপুকুরের পারে এসে দাঁড়ায় জমিদার যমুনা সিং । মাগনার খেপে মাছ ওঠে তিড়িংবিড়িং মকা পুঁটি কাংলা আর মস্তো এক রুই । ইচ্ছে করেই বৈতল রুই মাছ ছেড়ে দেয় জলে । গলা নামিয়ে বলে,
--- নয় আনা বারই গেল দেখি ।
গলার জোর বাড়িয়ে বলে,
--- আইড় ঘাঘটও আছে । মারতাম পারি নাইলে মাগনার মকা উকা থাকল ।
রুই ছেড়ে দেওয়ায় রাগ হলেও আইড়ঘাঘটের কথায় হিসেব চিকচিক করে যুবক সিংএর চোখে । বলে,
--- তুল দেখি ।
 ওঠে তিনটে ঘাঘট মস্তো মস্তো । মাছুয়া বলে,
--- মাগুর আছে একমন, তুলতাম নি ।
--- এক মন অউ নি । কেমনে মাপলে ।
--- আমার নাকো আছে বাটখারা । তুলতাম নি কইন । পাল্লা আনাইয়া মাপবা নে ।
--- তুল চাইন দেখি ।
এবার আর জাল ফেলে না বৈতল । যায় পুকুরের উত্তরকোণে যেখানে সার সার পায়খানা । জলের শেষে এক কিত্তা গাছের জঙ্গল । জলজঙ্গলের সীমানায় নরম মাটিতে ঢপ ঢপ করে মারে এক বাড়ি । মাটি ভাঙে ঝুরঝুরিয়ে । মাটির গর্তে কিলবিলানো মাগুর দেখে আবার কাত নবীন পুকুর মালিক । মাছুয়ার কেরামতিতে ভুলে যায় মাগুরের ওজন দেখার কথা । বলে,
--- আর কিতা মারতে ।
--- মারতাম মারতাম । অখন এক আনা বাড়ানি লাগব । নয়আনি ।
বৈতল মাইমলের তখন ভিন্নরূপ । মাছের কেরামতি শেষে জমিদারবাড়ির দাসী চাকরও কৌতূহলে ভিড় করে আছে যদি কোনও চমৎকার দেখা যায়বৈতলের চোখ খোঁজে প্রধানা রমণীকে আছে তো কেউ মহারানী । দুর্গাবতীকে বলতে হবে না সব । থাক তবে, দুর্গাবতীকে কিছু একটা বলে দেওয়া যাবে বানিয়েহাতে তার সময় কম, এবার গুটিয়ে আনতে হবে জাল । ফিরতে হবে এবার । প্রসন্ন জমিদারের দিকে হাত বাড়ায় । বলে,
--- দেইন ।
বাবু জমিদার কিছু বুঝবার আগেই সাপের চেয়ে ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে বৈতলের হাত । জমিদার আর বৈতলদাস কৈবর্তের দূরত্ব তখন দশ কদমসাপ আর জমিদারের এক । ছোবল মারার আগেই এগারো পা দৌড়ে এসে বৈতল ধরে নেয় বিষধরের ফনা । শিকার ফস্কে যাওয়ায় মাছুয়া আলদের চোখে তখন লকলকে হিংসা । পারলে শূন্যেই বমি করে দেয় গরল । বৈতলের হাত পেঁচিয়ে ধরে আছে সাপ । সাপের মুখে হাত রেখে জমিদারকে বলে বৈতল,
--- কইন, মারতাম না ছাড়ি দিতাম পানিত
   জ্ঞান হারানোর আগে সাদা রঙের জমিদারের মুখ ফ্যাকশে হয়ে যায় । বলে,
--- মারো, মারি ফালাও ।
প্রাণ বাঁচিয়েছে যে, তাকে আর তুইতুকারি করার সাহস করেনি যমুনাপ্রসাদ জমিদার । বৈতল মনে মনে হাসে । উল্টোমঙ্গল দেখে সাপ সরিয়ে জমিদার পরিচর্যায় হাত লাগায় । ঢলানির আগেই জিয়ানি দেখে খুশিই হয় সদ্য রিফ্যুজি বৈতল । খালি হাতে ফেরারই তো কথা সেদিন বৈতলের । পয়সা যে দেবে তার তো জ্ঞানই ফেরেনি । তাহলে ।
অনেকদিন পর বৈতল তার মনের কাজ করতে পারায় খুব খুশি । খুশিমনে দুর্গাবতীর ডান হাতের তালুতে দেয় এক সশব্দ চুম্বন । বাঁশ আর চাটাই এর ঘরে আগল বলে কিছু নেই । বাজার ছন্তরের মতো সারি সারি ঘরের অস্বাস্থ্যকর দমবন্ধ ঘরে সব উদ্বাস্তু পরিবার । কারো কিছু লুকোবার নেই । তাই দুর্গাবতী হাত ছাড়াতে চায় । কিন্তু বৈতলের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া সহজ নয় । বলে,
--- চউখ মুজো ।
--- কেনে, ই তিন সন্ধ্যার সময় কিতা আরম্ভ করছ, ছাড়ো ।
--- চউখ মুজি লাও, ছাড়ি দিমু । নাইলে সবে দেখব ।
--- নেও মুজলাম । তুমার গাত ইতা কিতা গন্ধ লাগের । কিচ্ছু খাইয়া আইছনি ।
--- অয় । চাইয়া দেখো অখন ।
  দুর্গাবতী চেয়ে দেখে তার মুঠোয় এক রাশি সাদাফুল । এ ফুল কোনোদিন দেখেনি দুর্গা । বৈতলকে বলে,
--- উঃ কী গন্ধ । ইতা কিতা কও না ।
--- ইতা নানি । কইতাম না গাইতাম কও । গাইলাই, ‘তুমি বনফুল গো
--- অইছে, উল্টা গান গাওয়া লাগত নায় । বনুয়া ফুল নায়, ইতার নাম আছে কিচ্ছু ।
--- মউয়া । নাম হুনছ নি ।
--- সুনতাম না কেনে । মহুয়া, নদের চান্দর গান হুনছ না নি ।
--- ঠিকনি, এর লাগি অউ আমার পেটে গুলার ।
দুর্গাবতীকে সব কথা না বলা পর্যন্ত বৈতলের পেট গুলোয় । আজকের ঘটনায় বৈতল খুব পুলকিত । আজ তার দাদন দেওয়ার দিন । মূর্ছা ভেঙ্গে জমিদার খুঁজবে বৈতলকে । তার প্রাণদাতার জন্য উতলা হবে । বৈতলও কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকবে । ইটখোলার হরিৎবরণের আশে পাশেও যাবে না । বৈতলকে নিয়ে যমুনাপ্রসাদ সাজিয়ে রাখবে ব্যক্তিগত পুনর্বাসন প্রকল্প । বন্ধু লুলাকে নিয়ে বৈতল সিলেটের গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছে, অনেক রকম ভেক ধরে জীবিকা নির্বাহ করেছে । বৈতলকে কেউ তাগড়া যোয়ান বলে না । লিকপিকে তেলাল শরীরে তার বয়স ঢাকা পড়ে আছে । কেউ জানে না কিশোর না যুবক সে । তার বয়স কত । মা বাপের সংসার থেকে বেরিয়ে গেছে বৈতল সে কোন শৈশবে । বন্ধু লুলাকে পায় মিরতিঙ্গার পাহাড়ে । সেই থেকে স্বদেশভ্রমণ দুইবন্ধুর । পাটনির সন্তান বৈতলকে ছাড়েনি, যেখানেই হাওর নদী বিল পেয়েছে পায়ের তলার সর্ষে সরিয়ে রেখেছে, জলের ছোঁয়ায় শরীরকে তেজিয়ান রেখেছে, আবার ছুটেছে । তেলে জলে পুয়া বাড়েজলের প্রবাদ শুনিয়ে বাপ ডাকে বৈতলকে । বৈতল শশীরে বাড়েনি ফনফনিয়ে, সুন্দি বেতের মতো শরীর নিয়ে তার কোনও অভিযোগ নেই । দেশের নদীনালা হাওর বাঁওর বন বাদাড় তার এই শরীরকে গড়েপিটে সাজিয়েছে, যুগিয়েছে তার প্রয়োজনীয় রসদ । যোগান কম হলে চুরি করে পেট ভরিয়েছে । ধরাও পড়েছে, মার খেয়েছে, শরীর পেকেছে ।
মানুষকে ভয় পায় না বৈতল । সাপিখুপিরও ভয়ডর নেই । দরকার হলে ইচ্ছাধারী সাপ হয়ে দংশন করতে পারে । ওঝা হয়েও ঝাড়ে বৈতল । শ্ত্রুর মুখোমুখি তাই বৈতল হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর । ছলচাতুরিতেও কম যায় না মাইমলের পুত । পদ্মপুকুর পারে জমিদারের হাত ধরে যে কান্ডটা ঘটিয়েছে বৈতল, সেই রাতের ময়লা পরিষ্কার করতেই বৈতল যায় তুলাপট্টিতুলাপট্টিতে অনেক সোনার দোকান । বেছে বেছে রাধামাধব জুয়েলারির দ্বিজেনবাবুর হাতে তুলে দেয় সোনার আংটি । এই টুকুনি এক আংটির দাম যে সত্তর টাকা হতে পারে ভাবেনি বৈতল । তিন খেপমারার দাম তো মাত্র দেড় টাকা । তার চেয়ে সত্তর টাকা অনেক । মরে নি ভিতু জমিদার, পোষা সাপ দেখে যে এমন ভয় পাবে ভাবে নি বৈতল । যাক, জিয়ানিও হয়ে যায়, বেঁচে যায় লক্ষীন্দর ! আর বৈতল ফিরবে খালি হাতে, খেপ প্রতি আট আনার হিসেব না নিয়ে এও হয় নাকি । জমিদার যমুনাপ্রসাদের হাত ধরে মূর্চ্ছার পতন থেকে রক্ষা করে বৈতল । হাতের ময়লা যদি কিছু সে নিয়ে থাকে, তাতে কার কী এসে যায় । যার এত আছে, একটা সোনার আংটিতে কত আর কমবে । বৈতলের কাছে এখন সত্তর টাকাই অনেক । একটা আস্তো রিক্সাগাড়ির দাম হয়ে যাবে ।
আংটি আর সত্তর টাকার ঘটনা ছাড়া সবই বলে বৈতল তার রানিকে । আর দুর্বোধ্য মুচকি হাসি দিয়ে দুর্গাবতীর কারণময় কৌতূহলে ইন্ধন দেয় । চেনা মানুষ যখন অচেনার মতো হাসে তখনই সংশয় দুর্গাবতীর । নির্ঘাত কিছু একটা ঘটিয়েছে । কোনও অপকর্ম না করলে এমন খুশি হয় না । বৈতলও জানে এই ব্রাহ্মণ কন্যার কাছে কিছুই লুকোনো থাকে না । বৈতলকে শায়েস্তা করার উপায় সে জানে । প্রতিদিনই কোনও না কোনও ছলে একটা ব্রত শুরু করে দেয় । আর ব্রতধারিণীর কাছে যাওয়া তো বারণ । যা বৈতল পারে না । তবে বৈতলও নিশ্চিত করে, আংটি বৃত্তান্ত বলবে না দুর্গাবতীকে, যে-কোনও জেরার মুখেই সে চুপ । দুর্গাবতীও উদ্বিগ্ন হয়ে বৈতলকে প্রশ্ন করে এক একটা । বলে,
--- আইজ তুমি হিতা খাইছ ।
--- হিতা কিতা ।
--- ইও আরকি । যেতআ খাও । ইওর মাংস । খাইছ ।
--- গরুর মাংস নি । ইতো খাই, তে কিতা অইছে, সস্তা । ইদেশো আইয়া খাইছি না অখনও । আইজ খাইছি না, যে কুনু কিরা । তুমার যে ইতা কিতা বুঝি না । পাঁঠা খাইলে দুষ নাই, গরু খাইলে দুষ । কেনে, ইগুও চাইর পাও, হিগুরও চাইর ।
--- তে চুরি করছ কুনু বাড়িত ।
--- ছি ছি, তুমার নি অউ মন । আমি বেটা মাইমাল, মাছ মারিয়া খাই, চুরিদারি কেনে করতাম ।
--- তে কুনু বেটির বাড়িত গেছ আইজ অত খুশির তো কারণ থাকব ।
--- আইজ নানি ... না বাদ দেও পরে কইমু, অখন তুমি যেলাখান মিঠা আলু চুলাত দিরায় টপ টপাটপ । অত গুসা কিতা তোমার, আমি কুনু অত বাদুয়া নি । অখন কও ই লাল পাইড় কাপড় পিন্দিয়া কই যাইরায় আগুনসুন্দরী ।
--- কই যাইতাম । ই কাপড় তো তুমার রিফুজি বাবু হকলে দিছে । ডুলর কাপড় পয়সা দিছে বারোআনা, চাউল পাচসের । ইস্‌ ইতা খাওয়া যাইত নায় । চাউলো ও পাত্থর ।
--- ই কেম্পো উম্পো আমরা আর থাকতাম নায় ।
--- কই যাইবায় । আমি আর পাকিস্তানো যাইতাম নায় । কেউ কেউ তো গেছে গি আবারশ্রীমঙ্গলর সুধাদা, মলইবাজারোর রমেশ কর্তা গেছইন গি !
--- যা বেটি, তুই গেলেও যাইতে পারছ আমারে ছাড়িয়া, আমি কই যাইতাম । আমি তো খুনর আসামি ।
বৈতলের বুদ্ধিমতী স্ত্রী সব বোঝে । বৈতলের যখন মন ভাল থাকে তখন দুঃখের কথায় বিমর্ষ হয়ে যায় । হয় অভিমানী । তাই দুর্গাবতী চুপ করে উঠে যায় । পিতলের কানা উঠানো ছোটো থালা ভর্তি খাবার নিয়ে আসে । পুজোর প্রসাদ, তার থেকেও বড় কথা প্রসাদের সঙ্গে বৈতলের প্রিয় খাবার, খিচুড়ি আর লাবড়া আছে, মুলোর শুটি কাঁঠাল বিচি মিষ্টি কুমড়ো মুখি কচু আর যা যা সব্জি পেয়েছে সব দিয়ে রেঁধেছে পরিপাটি । বৈতলের চোখে মুখে খুশি আর ধরে না । বলে,
--- আইজ আবার কিতার বর্ত ।
--- আইজ মঙ্গলবার নানি । মঙ্গলচণ্ডীর বর্ত ।
--- এ হিদিন নু দিলায় একবার ।
--- হি ৎ বিপদনাশিনী ।
--- না না আরো কিতা আছিল । বর্তের কথাও সুনাইলায় । অউ যে এক বানিয়ে কইলা গরুর মাংস দেখতা, তান দাসীয়ে দেখাইলা । রাজায় শুনিয়া খুব গুসা করলা, রানিরে মারি লাওয়ার হুকুম দিলা । আর রাজায় গরুর মাংস দেখাত গিয়া দেখইন এক থাল ফুল পড়ি রইছে থালো । তেউ আর রানিরও মরা অইল না দেবীর বরে । তাইন কে ।
--- তাইন অউও সঙ্কটা ।
--- তে আর এক গপ আছে আর এক বেটির । এক দুধ আলিয়ে করছিল বর্ত তাইর বউত পয়সা অই গেল দুধ বেচিয়া । পয়সা অওআয় তাইর ঘুম অয় না । তাই ধারোর বাড়ির বেটিরে কইল, আমারে খামচাই দেও চাইন দেখি, একটু কান্দতাম কান্দিয়া হুপাই হুপাই ঘুমাইতাম ।
--- না না । বর্তর কথা ইলাখান কয় না । সুন্দর করিয়া সাজাইয়া কওন লাগে । আমি কই হুনো । না, অখন কইতাম নায় । যেদিন বর্ত করমু, চান উন করিয়া ঘুমটা দিয়া পড়মু, হুনিও । অখন হাচা কথা খান কইলাও ।
--- হাচা মিছার কিচ্ছু নাই । সীতা মারি রাবণ আনলা, অউত্ত রামায়ণ ।    
প্রথম দিন থেকেই জমিদারকে রাবণের উপমায় মানানসই দেখেছে বৈতল । কিছু একটা দেখেছে বিপরীত । আর সীতার কথাটাও অকারণ নয় । বৈতলের আর ভাল লাগে না এই সরকারি নরক, বাঁশের খাপ বাঁধা ধাড়ার ঘর । গ্রামের মানুষ হলেও মাড়ৈলপোক্ত বাড়িতে থেকেছে বৈতল । মেড়ামেড়ির ঘরে আনন্দ ফুর্তির জন্য পৌষ সংক্রান্তির এক রাত থাকা যায় পুড়িয়ে ফেলার জন্য । বৈতলও উলির ঘর পুড়িয়ে চলে যাবে নতুন ঠিকানায় । তাই বুদ্ধি দিয়ে রাবণ বধের মিছে খেলা খেলেছে সে । শহরের মানুষকে সরলতা দিয়ে বশ করা যায় না জেনেছে বৈতল । আর বর্তমান সময়টাও বড় অবিশ্বাসী । অচেনা শরণার্থীরা যে ঠকাবে না, থাকতে দিলে দখল নেবে না জমিবাড়ি তার কোনও স্থিরতা নেই । ভালমানুষের দলে ঠগঠগামির ছ্যাঁচড়া দু-একজনও আছে । সর্বস্ব খোয়ানো মানুষের মনুষ্যত্ব নিয়ে শুচিবাই নেই । তাই বৈতল রাবণকে কাবু করার খেলার কোনও অনৈতিকতা দেখে না লঙ্কাবাড়িতে সীতা দুর্গাকে নিয়েই সে গিয়ে উঠবে । সেই খুশিতে বিভোর বৈতল তাই হাসে । হাসতে হাসতে দুর্গাবতীকে বলে,
--- এগু শুটকি আলা বুজছ নি, আমি ডাকি বটই । তার নাম বটকিস্ট, হে হুনাইল এক আচানকি রামায়ণ গান । হুনতায় নি ।
--- তুমার অউ সীতা মারি রাবণ আনলা অতা নিহুনাইছ আগে তুমি আইজ কত জাগাত গেলায় । ইদিকে কও শুটকি বাজারো গেলায় । আবার কও ইটখোলার জমিদার বাড়িত গেছ । কুনটা হাচা ।
--- হাচা মিছা দি কিতা করতায় । রামায়ণ ভালা লাগছে নি কও ।
--- পুরা তো কইতায় পারলায় না ।
--- এ লঙ্কাত না গেলে পুরা অইব কেমনে । যাইবায় নি ।
--- জমিদারনিরে কিলাখান দেখলায়, সুন্দরী নি ।
--- উঁ, খুব সুন্দর গো । তুমি আর কিতা সুন্দর, তাইন এক্কেবারে টিকির ছালি ।
--- বাইচ্চা উইচ্চা অইছে নি ।
--- অইছে না, তুমি গেলেউ অইব ।
--- আমি কিতা তারার বাইচ্চা বানাই দিতাম নি ।
--- ছি ছি, কিতা কও নানি । আমি কইয়ার তুমি গেলে তো পাচালি উচালি পড়বায় । কও নানি, নিধনীর ধন অইব, অপুতর পুত অইব । অউকথা কইলাম ।
--- আমি গিয়া পাচালি পড়তাম, না ধাই অইতাম । খুলিয়া কও ।
--- তুমি কেনে ধাই অইতায়, তুমি ধাই অইলে আমার পুড়িরে পালত কে ।
--- অইছে, বেটার মুরাদ নাই, তার অইব পুড়ি । পুড়ি এমনে অই যায় নি । ছলাইও না আমারে ।
--- আইচ্ছা রে বেটি, আমার মুরাদ নাই, নানি । আইজরাইত অউ দেখাইমু ।
    মুরোদের কথায় বৈতলের রাগ হয় । যে একমুঠো মহুয়ার ফুল এনেছে জমিদার বাড়ির উঠোন থেকে সব এক সঙ্গে কচকচ করে খায় । নেশা হয়, কিন্তু মনের দুঃখ যায় না । বমি বমি ভাব হয় । অভিমানে কিছুই দেখায় না, ধাড়ার চাটাই এর উপর একা শুয়ে থাকে বৈতল রাতের মতো ।





চলবে

 < উজান পর্ব ১৪ পড়ুন                                                    উজান পর্ব ১৬ পড়ুন >



 

কোন মন্তব্য নেই: