(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার উজান পর্বের অধ্যায় বারো ---সুব্রতা মজুমদার।)
বারো
শহরের যে-অংশটিকে বরাকনদীর
অশ্বক্ষুরের আকার দিয়ে ঘিরে রেখেছে, সেই অংশের একটি খণ্ডনাম হরিৎবরণ । এই
অশ্বক্ষুর নিয়েই যত ধন্দ বৈতলের । ঘোড়া নেই দেশে ঘোড়ার ক্ষুরের আকার । মানুষ চিনবে
কী করে ।
বৈতল দেখেছে এক ঘোড়া । অলৌকিক তার চালচলন ।
বৈতলের মার অশান্তি দূর করতে দুই কিশোর বেরিয়েছে তীর্থ দর্শনে । কত মন্দিরের
চরণামৃত, ফুল বেলপাতা জমিয়েছে, পিরবাবাজির পানি পড়া এনেছে । মাকে বলেছে শাহি
ইন্দারার পানি । মা খেয়ে সুস্থ থেকেছে একদিন । আবার বেরিয়েছে, গেছে মৌলভী বাজার ।
পথের কষ্ট বিস্তর । শুধু নদী আর নদী । নদীপথে গিয়ে পৌঁছেছে পিরের গ্রামে । ভটরখাল
মহামায়া আর চন্দনী নদীর মাঝখানে এক অপরূপা গ্রাম জগৎশ্রী । নদীঘেরা গ্রাম সিলেটে
অনেক আছে, গ্রাম থেকে বেরোনোরও কোনও স্থলপথ নেই জগৎশ্রীর । গ্রাম পেরোনোর একমাত্র
সাধন তিন নদীতে তিনখানা নৌকো । কিন্তু পিরবাবাকে কেউ কোনোদিন নৌকা চড়তে দেখেনি ।
দিনের বেলা তাকে কেউ কোথাও যেতেও দেখে নি, দেখে নি তার ঘোড়া মনা রায়কেও ।
দানিশপিরের নাম নিলেই জগৎশ্রীর দুর্গত মানুষ নিরাময় হয় । দানিশপিরের মর্জি হলে
শবদেহ জেগে ওঠে শ্মশানে, কবরের মাটি ফুঁড়ে মুর্দাও বেরিয়ে আসে । হিন্দু মুসলমান
নির্বিশেষে পিরের আশীর্বাদ জলঘেরা গ্রামে । পিরবাবা আলাদা করে মানুষে মানুষে ভাগ
করেন না । এলাকার সবকটি গ্রামেই তিনি মনা রায়কে নিয়ে ছুটে বেড়ান নিরাময়ে ।
কুশালপুর চমৎকার আমতইল কদুপুর সূর্যপাশাম মাসকান্দি গ্রামের মানুষ স্মরণ করলেই
পিরবাবা পৌঁছে যান তার জড়িবুটি নিয়ে । ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া আসা গ্রামে গ্রামে । পানি
পড়া, জড়িবুটি আর পিরের ছোঁয়াতেই মানুষ সুস্থ হয়ে যায় । মানুষ কৃতজ্ঞতায় মনা রায়কেও
প্রণাম করে সালাম জানায় । মনা রায় আরবি ঘোড়া হলেও খুব তেজিয়ান নন, কিন্তু যখন
টগবগিয়ে ছোটেন তখন এক অলৌকিক জ্যোতি বেরোয় তার দেবদেহ থেকে । ঘোড়ার উপর সাদা
আলখাল্লার পিরবাবাকেও দেবদূত মনে হয় । মানুষের অসুখ করলে মনা রায় দুরন্ত হয়ে ওঠেন
। দুর্গম পথ পেরিয়ে যান নিমেষে । বর্ষাকালে সুরমার উপর ছলছলাত দৌড়ান । কালনি
বিবিয়ানা ভেড়ামোহনা পারাপার করেন সপসপিয়ে । যারা দেখে তারা ভাগ্যবান, তারা দুহাত
তুলে ঈশ্বরের গুণগান করে । দুহাত জোড় করে প্রণাম জানায় অলৌকিক তেজি আর
তার সওয়ারকে । একটি অতিরিক্ত নমাজ আদায় করে মানুষ ঈশ্বরের উদ্দেশে ।
সেই মহালয়ের রাতে, যখন গ্রামের পর গ্রাম ডুবে
গেছে আর ভেসে আছে শুধু এক মাটির নৌকো, মালির ভিটা কালিবাড়ি শুধু জেগে আছে কিছু
ভক্ত শরণার্থী নিয়ে । নিচে দুই ক্রুদ্ধ নদী পিয়াইন আর সুরমার সঙ্গমে হুলুস্থূল ।
উথালপাথাল গেরুয়া জলের উদ্গীরণ শুধু । টিলার মন্দিরের উপর একদল মানুষ তখন আপন
গোষ্ঠীকে নিশ্চিত আশ্রয় দিতে পারার স্বস্তিতে একমনে জয়কালী জপছে । দুর্যোগের
মধ্যেও মহা বিপদের মধ্যেও মানুষ মানুষের জন্য ভাবেনি । এমন ঘৃণা । সম্ভাব্য
পরাধীনতার জ্বালায় বৈতলের মনেও ক্রোধ । মন্দির আক্রমণের সম্ভাবনাকে প্রতিরোধ করার
প্রস্তুতি নিচ্ছে বৈতল । রামদা নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরছে । মেয়েদেরও বলছে দা বটি নিয়ে
প্রস্তুত থাকতে । চাচার দল অনেক দিন থেকেই মন্দির দখলের অজুহাত খুঁজছে । মালির
ভিটাকে মোল্লার ভিটা করার তোড়জোড় । গিরিরাজ মহন্তও বলছেন,
--- দিলাও বা তারার জিনিস তারারে দিলাও ।
প্রাণে তো বাচউকা হকলে ।
বৈতল এতসব ভাবে না । সওয়াল করার সময় নেই,
সময়টাই যে তীব্র অবিশ্বাসের । দু দুটো জাতি মুখোমুখি । চাচা ভাই মাসি ফুফু খালা
এমনকি লুলা বৈতলও আলাদা মানুষ হয়ে গেছে । একদলের হাতে রামদা আর একদলেরও লাঠি সড়কি
দা । মুখে জিগির জয়কালী আর আল্লা হো আকবর । বৈতলও হাঁক দেয় ‘বোম
বোম বম্বালে’ । ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়েও বৈতল একবার থমকায় । যখন ওরা জিগির দিয়ে এগোয়
তখন মাথায় থাকে সার সার টুপি । দুর্গতির সময় মানুষ বানানো ধর্মকর্মের প্রাত্যহিকতা
ভুলে যায় । একমাত্র মুরব্বি মানুষ করিম চাচা ছাড়া কারো মাথায় তো বৈতল তকি দেখে না
। তাহলে ওরা কী চাইছে, মন্দির দখলের না আত্মরক্ষার লড়াই লড়তে উঠে আসছে উপরে ।
হিন্দুর মন্দির সেদিন পবিত্র হয় । কলঙ্ক যুক্ত
হয় । বানভাসি মানুষ জাতিধর্ম ভুলে এক হয় টিলার দেবালয়ে । মহন্ত গিরিরাজ আর করিম
বক্সের কোলাকুলি দেখে বৈতলও লুলার হাত ধরে টানে । এক উজ্জ্বল আলোর জ্যোতির দিকে
দিক নির্দেশ করে । বলে,
--- অউ দেখরে নি বেটা পিয়াইনর উপরে ।
--- কিতা দেখতাম, আন্ধাইরো কিচ্ছু দেখা যায়
না, কেউ নি লুক্কা জ্বালার বহুত দূর । ভোরা উরা বার আরি ।
--- না বেটা দেখ মনা রায় আইরা । আর দেখ অলা
নি ধলা ফক্ফকা পির সাহেব । তর মনো নাই নি দানিশ পিররে । তোর মা বেটির লাগি কিতা
বানাইলা । এক ডাবরো কত জড়িবুটি ঢাললা, ঢালিয়া তরে কইলা বিচরা থাকি গোলাপ ফুল আনার
লাগি । ফুল ও ছিড়লা সব মিলাইয়া মধু উধু দিয়া কিতা যে বানাইলা । পয়সাও নিলা পাচ আনা
। আমার মা ভালা অই গেছিল নানি ক ।
বৈতলের সন্দিহান মন অলৌকিককে কাটা ছেঁড়া করে ।
দোহালিয়ার কানা ফকিরের গান ভুলতে পারে না বৈতল । লুলার প্ররোচনায় বৈতলকে ঠকানোও
ভুলতে পারে না । দাড়িয়াপাড়ার সাদা মেয়ের কান ছিঁড়ে পালানোর যন্ত্রণা বৈতলের মনে ।
ফর্সা মেয়েটা সব সময় খিল খিল করে হাসে আর পড়শিবাড়ির মেয়ে হাসির সঙ্গে কথা কয়,
আমলকী চিবোয় । ওরা ভুলভাল বকে আর হাসে । ধলা মেয়ের হাসিতে রাণি মাছের ঝাঁক উঠে আসে
বৈতলের গামছা জালে । বৈতলও যোগ দেয় খলুই পিঠে পুকুরের জল থেকে । বলে,
--- তুমি বাশপাতা মাছ চিন নি ।
সাদা মেয়ে বলে,
--- চিনতাম না কেনে । আছে নি আমরার পুকইরো ।
--- না গো মাই, ইতা কুনু পুকইরোর মাছ নি ।
পাবিয়া চিনো নি ।
--- চিনি, কিতা কইতে ক ।
--- তুমার হাসি নানি অউ বাশপাতা আর পাবিয়া
মাছর লাখান ।
--- ছি, আর কিচ্ছু পাইলে নানি বেটা মিলাইবার
।
পাশেই ছিল ফর্সা মেয়ের বন্ধু হাসিনা । বলে,
--- আইচ্ছা আমার হাসি কিলাখান কও ।
--- তুমি তো হাসি অউ । তুমার আবার হাসি কিতা
।
--- তেও কও, কোন মাছর লাখান ।
--- তুমার হাসি গজার মাছর লাখান ।
বলেই দিয়েছে পুকুরে ডুব খলুই সহ
। রাণি মাছের দল আবার ছাড়া পেয়ে পুকুর ভরে দেয় খুশিতে । মেয়ে দুটি তো ভালই ।
সুন্দরী মেয়েটার জন্যই মাছ ধরে দেয় বৈতল নানানি বিনানির । বৈতল জীবনে সদিচ্ছার
কোনও অর্থ নেই । সেই মেয়েটাই বৈতলকে বলে চাকর । বৈতল দেখিয়ে দেয় চাকর বলার মতো
তুচ্ছ নয় সে । কান ছিঁড়ে সোনার মাকড়ি নিয়ে দৌড়েছে । সোজা হাকালুকি, গ্রাম খিত্তা ।
বন্ধু লুলা তাকে বাড়ি নিয়ে যায় । সব শুনে বলে,
--- খুব বেটাগিরি দেখাইলে নানি । ছুকরির গাত
হাত দিলে ।
লুলা যখন বলে সে অন্যায় করেছে
তখন বৈতল আরো মনমরা হয়ে যায় । বৈতল জীবনের প্রথম অনুতাপ, যা তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে
জীবনভর । পেশকারের মেয়েটিকে তো সে পচ্ছন্দ করেছে । ভাল লাগার স্মৃতি নিয়ে চলে যেতে
চেয়েছে । মেয়েটির নিষ্ঠুরতায় বৈতল ক্ষুণ্ণ হয়েছে । এক অতৃপ্তি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে
হেথায় হোথায় । নীতিপণ্ডিত লুলারও সহমর্মিতা পায়নি সেদিন । গুনা আর গুনাগার বলে বলে
বৈতলকে উদ্ভ্রান্ত করেছে । তবু বন্ধুকে নিয়েই বেরিয়েছে দেশ ভ্রমণে । দেশ বলতে
এতদিন জেনেছে গ্রাম বইয়াখাউরি পরগণা সুনামগঞ্জ জিলা সিলেট । জিলা সিলেটের এমাথা
থেকে ওমাথা ঘুরে বেড়ায় বৈতল । বেড়াতে বেড়াতে বড় হয় । লুলাও বাড়ে, একদিনও বলেনি
ছেড়ে যাবে । বৈতলের মনের অবস্থা বুঝেই কানা ফকিরকে সব কথা আগেভাগে বলে দেয় । সাদা
মেয়ের কথা, কান-ছেঁড়া মাকড়ির কথা, বৈতলের মনখারাপ কথা । ফকিরের গান শুনে বৈতল যে
গুরু খুঁজে পায়, অলৌকিকত্ব আরোপ করে । রাতের আঁধারে জারি গানে যখন সুর লাগায় ফকির,
তখন আর মানুষটাকে মানুষ মনে হয় না । বৈতল তখন মায়ের কাছে চলে যায় । মায়ের কোলে
শুয়ে শুয়ে শোনা মালসী গানের সুরও যে অবিকল এক । লুলা বৈতলের সব কথা শোনে, বোঝে মন
দিয়ে । প্রশ্ন দিয়ে পরিষ্কার করে নেয় । লুলার খটকা হয় । তাই বলে,
--- জারি গান আর মালসী গান এক অইল কেমনে বেটা
।
বৈতল বোঝে লুলার সংশয় । কিন্তু কী করে বোঝায় কানের ছন্দ । বৈতলের মার কণ্ঠ
সব সুরেই যে বিষাদের কান্না ঝরে । মা গাইলেই মনে হয় দুঃখের এক মলিন আলো একটু একটু
করে জ্যোতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে । তখন মাকে ছুঁয়েও দেখা যায় না । ঘোর ভেঙে গেলেই যদি
প্রভা হারিয়ে যায় । দোহালিয়ার অন্ধ ফকিরের গানেও চরাচর আলোয় উদ্ভাসিত হয় আঁধার
রাতের গানে । হায় হাসান বলে মায় কান্দে বিনাইয়া বিনাইয়া...’ । গান থামলে ফকিরের
পায়ে হাত দেয় বৈতল । বলে,
--- তুমি আমার গুরু অইবায় নি ।
অলৌকিক ফকিরের জ্যোতি নিভে যাওয়ায় বৈতল আবার
শুরু করে পথ চলা । বন্ধু লুলা বৈতলকে ছেড়ে যায়নি তখনও । সাধু
ফকিরের অলৌকিকত্বে আর বিশ্বাস করেনি বৈতল । বৈতল বুঝেছে অলৌকিক হয় না । অলৌকিক
তৈরি করতে হয় । মনের সুখ দিয়ে আনন্দ দিয়ে গভীর বিষাদ দিয়ে সাজাতে হয় অপার্থিব ।
তখন অমিল সুরেও সুর মিলে যায়, তখন মন বলে, আঃ ।
তবু বৈতল স্পষ্ট দেখতে পায় পিরবাবার
ঘোড়া মনা রায়কে, আর তার আরোহী দানিশ ফকিরকে । বৈতল দূর থেকে প্রণাম জানায় ।
পিরবাবাকে দেখেছে বৈতল তার ছোটবেলায় । আর সব ধর্মমানুষ থেকে আলাদা এই পুন্যপুরুষ ।
তুকতাকের গাম্ভীর্য কোথাও দেখেনি বৈতল । মায়ের দুঃখে কাতর বৈতলের সঙ্গে কত কথা
তাঁর । বলেন,
--- ইতা ভাবিও না আমি ফুকিয়ার ।
ফুকিয়া উকিয়া কিচ্ছু অয় না রে বাপ । মন ছাপ রাখো তেউ এগারো আনা ভালা । আমাকে যে
দিলায় পাচ আনা, পাচ আনার জড়িবুটি আমি বানাইছি না, খোদায় বানাই রাখছইন সব । তুমিও চিনো, অউত্ত দেখ সাদা ভেড়েলা, হাড়জোড়া, খুনি জবা, পানি পদ্মর শুকনা জড়
হাতো অলাখান বান্দি দিমু যে শয়তান ভাগার পথ পাইত নায় । মাইরে কইও গিয়া পিরে কইছইন
সব ভালা অই যাইব । আর অউ যে ডাবরো বানাইছি দাওয়াই এর লাগি লাগব আরো পাচটা গুলাব ।
কাইল পতাকালোও যদি আনতায় পারো অইব । বছরাই গুলাব লাগব । আমার বিছরার ইতায় অইত নায়
কিন্তু ।
--- আমি ইতা কই থাকি পাইতাম । কই
বছরা ।
--- তে আর কেমনে বনব দাওয়াই ।
হেকিমি দাওয়াই বছরাই গুলাব ছাড়া অয় না । যাও । বইয়া বইয়া খাও বইয়াখাউরিত ।
দুই বন্ধুর মনোদুঃখ দেখে পিরবাবার মুখে
বিস্তৃত হয় হাসি । বলেন,
--- আমি কুনু বেটা দাওয়াই উয়াই
বানাইতাম পারি নি । তুমরা কইয়া কইয়া আমারে পির আর হেকিম বানাইছো । খাওয়াই দিও
মাইরে, ভালা ভালা জিনিষ দিছি । একটু খাইয়া দেখিলাও তুমরাও বছরা উছরা কইলে হেকিমের
দাম বাড়ে এর লাগি কইলাম । ঢঙও বুঝো না নি ।
ডাবর থেকে এক খাবলা ক্কাত্থ উঠিয়ে দুজনকে
চাখতে দেন পিরবাবা । বৈতল অমৃতের স্বাদ জানে না, ইচ্ছে হয় আর একটু নেয় । লুলা বারণ করে । বলে,
--- কিতা কছ বে, মা বেটির দাওয়াই
কম পড়ব ।
লুলার কথামতো পিরের পা ছুঁয়েছে বৈতল, মনা রায়কেও এক আঁটি ঘাস খাওয়ায় । বন্যার
রাতে ধর্মাধর্মের বাঁধভাঙা মন্দির টিলায় দাঁড়িয়ে আবার বৈতল অলৌকিকের উদ্দেশ্যে
প্রণাম জানায় । দানিশ পিরকে বলে,
--- তুমি তো অমৃতবড়ি বানাইতায়
পারো । তে কেনে সবরে অলাখান একখানো থাকার বড়ি খাওয়াই দেও না । সবরে তারার ধর্মউর্ম
ভুলাই দেও । কও তারা সব সিলেটি অউকা । তারা মানুষ অউকা ।
নিজেকে ভোলায় বৈতল । বৈতলের স্বদেশ একদিন
পরবাস হয়ে যাবে বলছে সবাই । মনের জোর না গায়ের জোর জানে না, বৈতল বলে দুটোই । মা
কালীর পূজা করে বলে, ঈদের দিন নামাজ পড়ে না বলেই দেশ বিদেশে হয় না । মাটি কামড়েই
পড়ে থাকে বৈতল । যারা ইন্ডিয়ায় যায় তাদের বলে কাপুরুষ । ভিতু মানুষ সবার জন্য বৈতল
একদলা থু থু ফেলে । বলে,
--- থু ।
যাদের
জন্য দেশটা পাকিস্তান হবে, তারা কি সবাই হিন্দুর শত্রু । শত্রু হলে তো দখল নিতে
পারে মন্দির । বলতে পারে যাও ভাগো । ভাগিয়ে দেয়নি, বরং আশ্রয় ভিক্ষা করেছে । মহন্ত
গিরিরাজ ফিরিয়ে দিলে ওরা ফিরেই যাবে বলেছে । অস্ত্রহীন ভেজা কাপড়ের পুঁটলিতে
যা পেয়েছে গরিবের মহার্ঘ তা নিয়ে চলে এসেছে । সব দেখে শুনে গিরিরাজ বাবাজির চোখের
জলে বৈতল নতমস্তক হয় । বৈতলের নতুন জিগিরে অন্ধকারে আলো উদ্ভাসিত হয় । বৈতল
হাঁকে,
--- জয় বাবা দানিশ পিরের জয় । জয়
মনা রায়ের জয় ।
সমবেত দুর্গত জনের কণ্ঠ সঙ্গে সঙ্গে প্রতিধ্বনি করে । বৈতলের ইচ্ছে হয় জয়কালীর
ধ্বনি দেয়, আবার বলে বোম বোম বম্বালে, ইচ্ছা হয় আই মনসার ধ্বনি দেয়, দেয়নি, বৈতলের
বুদ্ধিমান মন বলেছে পির সাহেব আর দেবতা ঠাকুরে ফারাক অনেক । দানিশপীরের স্থান
ধর্মাধর্মের উপর ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন