“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

কাশ্মীরে বন্যা এবং আমার কন্যা

         
    স্কুল থেকে ফেরার পথে মেয়ের নানা গল্প থাকে। সব মেয়েরই থাকে। আমার কন্যা পৌষালিরও থাকে। সে শুরু করবে এই বলে, আজ কী হয়েছে জানো? আমার পালটা জিজ্ঞাসা , “তুমি না বললে জানব কী করে?” তো, কাল শনিবারে যা বলল, সেই গল্প অন্যরকম। স্কুলের ক্লাসের এক ফাঁকে সব ছাত্রীদের মাঠে জড়ো করে কাশ্মীরের বন্যার তাণ্ডব এবং বন্যা বিধ্বস্তদের যন্ত্রণার কথা বলা হয়েছে। সব ছাত্রীদের অনুরোধ করা হয়েছে  পাড়াতে বা ধারে কাছে যারা থাকে তারা যেন নিজেরা দল করে রোববারে দিনের বেলা অনুদান সংগ্রহ করে এনে সোমবারে স্কুলে জমা দেয়। সুতরাং মেয়ের দারুণ আনন্দ। তাদের দল হয়ে গেছে, রোববারে ওর চারবন্ধু এসে জুটবে ওর বাড়ি। এরা দল বেঁধে চাঁদা সংগ্রহে বেরুবে। অনুমতি নেবার দরকার নেই ওর।  নেয়ও নি। আমাকে শুধু ওর এই নব আনন্দে জাগবার কথাটা জানালো। জিজ্ঞেস করলাম, কোনো রসিদ বা আবেদন পত্র দিয়েছে কি স্কুল থেকে। সে জানালো, “না।” “তবে লোকে দেবে কেন? বিশ্বাসই বা করবে কেন তোদের? যদি বলে তোরা মিথ্যে চাঁদা তুলে বাজে কাজ করবি?” মেয়ে কথাটি ভাবে নি। বলল, আমরা বলব, কাশ্মীরের কথা। কাশ্মীর কেন, অসমের কথা বলেই যে চাঁদা লুণ্ঠন কত হয় ---মেয়ে জানে না। তার জানবার কথা নয়। সে জানে আমাদের বাড়িতে অনেকেই চাঁদা নিতে আসে। কেউ পায়, কেউ পায় না। সে আর তার বন্ধুরা বেরিয়ে গেলে সেরকম না পেয়ে ফিরবে না। বললাম, “ঠিক আছে । আমি তোদের একটা রসিদ বানিয়ে দেবো। কলেজে দিন কয় ধরে নানান ব্যস্ততা। একটি জাতীয় আলোচনা চক্র চলছে। শনিবারেই শেষ হলো। বাংলা বিভাগেও সোমবারে একটি দেয়াল পত্রিকা উন্মোচনের অনুষ্ঠান আছে। মেয়েকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, নেয়ে খেয়ে আমি আবার কলেজ গেলাম। ফিরতে সন্ধ্যে বেলা। মেয়ে চেপে ধরল, “রসিদ বানিয়ে দাও।” বিশ্রাম নেবার উপায় নেই। আমরা নিজেরা ভাড়াটে বাকি ভাড়াটে আর মালিকের ঘর থেকে রাতেই ওর চাঁদা তোলা চাই। তর সইছে না। এমনিতে সে মুখে সবাইকে বলেও দিয়েছে। চারবন্ধুতে ঘনঘন ফোনেও আলাপ হচ্ছে।
            তো, আমি কম্পিউটার খুলে বসলাম রসিদ ছাপাতে। মেয়ে মাঝে মধ্যে এসে নির্দেশিকা দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশী এক বান্ধবী আছে, ওর এক ক্লাস উপরে পড়ে। ওকে জিজ্ঞেস করল, “তুই তুলবি না?” তার জিজ্ঞাসা, “আমাদের দল হয় নি। তুলে লাভ কী হবে? আমার কী লাভ?” “সব কাজে কী লাভ দেখতে হয়? এতো মানুষ বিপদে পড়েছে, আর আমরা লাভ দেখব?” মেয়ের জবাব। আমাকে এসে জানালো। বললাম, “ওকে বল , তোরা যে নিত্য বাড়িতে পুজো করিস , কী লাভ হয়? কত কত  খরচ হয়। এমনি এমনি।” বান্ধবী ওর মায়ের কাছে  কথাটা তুলল। ওর মায়েরও একই কথা। কিন্তু পৌষালি হাল ছাড়বার পাত্রী নয়। অনেক চাপাচাপিতে ঠিক হলো, সে পৌষালিদের দলের সঙ্গেই বেরুবে। যত আদায় হবে, তার পাঁচ ভাগ হবে। একভাগ সে আলাদা করে নিয়ে গিয়ে ওর ক্লাসের শিক্ষক বা শিক্ষিকার হাতে তুলে দেবে। দল বাড়ছিল। ধরা যাক, সেই বান্ধবীর নাম পুতুল। ঠিক নাম দেয়া যাবে না।  ঠিক তখন, ওর সহপাঠিদের একজনের ফোন এলো, সে বেরুতে পারবে না, মা মানা করছে। কিছুক্ষণ কী কথা হলো। ফোন রেখে দিল। মেয়ের মন ভাঙতে শুরু করল। ব্যথার কথাটা এসে আমাকে জানালো। ওর মাকেও জ্বালালো।  আমি তখন রসিদে মেতে আছি। শুধু বললাম, এমন হয়। কিছুক্ষণ  পরে ও আবার সেই বান্ধবীকে ফোন করল। ওর বাবা ফোনটা তুলতেই সোজা বাবাকেই রাজি করাতে চাইল, যাতে বান্ধবীকে না আটকায়। বাবাতো রাজি হয়েই যাচ্ছিলেন, দূর থেকে মায়ের কণ্ঠ ফোনেও শোনা গেল, “ হবে না। কাজ নেই খেয়ে দেয়ে আমার মেয়ে বেরুবে ভিক্ষে করতে!” ফোন রেখে দিল। ধরা যাক এই বান্ধবীর নাম, পঞ্চমী।
            রসিদ বানিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছি কি, রাতেই আমাদের বাড়ির আর সবার থেকে চাঁদা তুলে নিল পৌষালি আর পুতুল দোকা ।  কিন্তু...। আমাদের এক প্রতিবেশী আছেন, দূর থেকে কেউ চাঁদা নিতে আসছে দেখলেই দরজা জানালা চাপিয়ে দেন। বৃষ্টি পড়ছিল। মেয়ে গিয়ে বেল বাজালো, পুতুল তখন ওর সঙ্গে। বাইরে দাঁড়িয়ে। নিতান্ত বাড়ির মেয়ের আবদার না ঠেলতে পেরে, এগারো টাকা। বাইরে বাইরে। কোনো জিজ্ঞাসা নেই। কৌতূহল নেই। বাড়ির বাকিরা কিন্তু তখন বেশ মেতেছে ওদের সঙ্গে। এক ঘর থেকেই বর-বৌ, দাদা-বৌদি, আঙ্কল-আণ্টিদের থেকে আলাদা আলাদা আদায় করেছে। ওর মাকেও দিতে হয়েছে আলাদা করেনিজেরও জমানো টাকা থেকে নিয়েছে একটা ভাগ।
            সক্কাল সক্কাল আরেক বান্ধবী ফোনে জানালো ওর বড় পায়ে ব্যথা। কথাটা যথারীতি আমার কানে তুলে মেয়ে বলল, “কাল যদি ওকে স্কুলে দেখি, তবে জিজ্ঞেস করব, আজ তোর পায়ে ব্যথা ঠিক হয়ে গেলো, কী করে রে!” আমি বললাম, “করিস! এইভাবেই মানুষ চেনা যায়। তোর বান্ধবীতো নয়, বাজে বুদ্ধিটা শিখিয়ে দিয়েছে ওর বাড়ির বড়রাই।” এবারে কী হবে? চারজন কমে দাঁড়ালো দুই। সুতরাং সে আরো বন্ধু জোটাতে এখানে ওখানে ফোন করল। খুব সফল হলো না। পাশের বাড়ির অন্য এক স্কুলে পড়ে , ওর বন্ধু ---ধরা যাক তার নাম কল্যাণী---রাজি করালো ওদের সঙ্গে বেরুতে। বেচারি বন্ধুকৃত্য করতে রাজি হয়ে গেল।
       রোববার হলেও আমার কলেজে কাজ ছিল, আগেই বলেছি। আমি চলে গেছি। ফিরেছি সেই সন্ধ্যাবেলা।  বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ পুতুল , কল্যাণীকে নিয়ে পৌষালি বেরুলো হাতে রসিদের  বই, আর কাঁধে ঝোলানো ছোট্ট  বেগ । সেই যে আরেক বান্ধবী রইল—ধরা যাক ওর নাম ঈশানী---ওর বাড়ি। বাড়িটা পাশের পাড়ায়।  ঈশানীও সারা সকালে বসে বানিয়ে ফেলেছে একটা কাগজের বাক্স। তাতে সংগ্রহ করবে অনুদান। এই কাজ করেছে, অন্য আরো বেশ কিছু দল। সন্ধ্যা থেকে  সকালে  বহু বহু ফোনে জানা গেছে। অনেকে অনেক পাড়াতে বেরিয়েও গেছে পৌষালিদের বহু আগেই। শুধু ঈশানীর মা-বাবা ওকে বাড়ি থেকে বেশি দূর যেতে দিতে রাজি নয়। সে আমরাও নই। মেয়ে পড়ে মাত্র ক্লাস সিক্সে। ওকেতো আর শহর চষে বেড়াতে পাঠাতে পারি না। তবু আমাদের ভূগোল খানিক বড়ই ছিল। ওর জানা ছিল। আমাদের কিছু বলতে হয় নি। তো, চার পাঁচটা বাড়ি করে ঈশানী আর এলো না, বাক্সটা নিয়ে পৌষালিরা পাড়াতে ফিরে এলো। ইতিমধ্যে সেই যে পঞ্চমী , যার ওদের সঙ্গে বেরুবার কথা ছিল, ওর বাড়িতেও গেছিল ওরাদেখেই ওর মা চটে লাল, “তোমাদের প্রিন্সিপালের খেয়েদেয়ে কাজ নেই। কোথাকার কাশ্মীর তার জন্যে মেয়েদের বলে দিয়েছে ভিক্ষে করতে। এতোই যদি দরদ নিজে কেন দেয় না! আমাদের এতো টাকা নেই! যত্তসব।” মুখ কালো করিয়ে কচি এই মেয়েদের তিনি  বিদেয় দিলেন। এরাও বেরিয়ে এসে যেন রক্ষা পেল। না, পঞ্চমী ওর মায়ের মেয়ে নয়। ওর বাবাতে মায়ে বুঝি তফাৎ দ্বিমেরু সমান। পঞ্চমী ওর বাবার মেয়ে। এক ছাদের তলাতে থাকতে হয় বলে মাতৃ আজ্ঞা পালন করে।  পৌষালি জানিয়েছে।ছাদে বুঝি ফাটল ধরেছে বহু আগেই। আলাদাও হয়ে গেছিল। পরে আবার মেয়ের কথা ভেবে জুড়ে রাখা হয়েছে আলগা করে।  ওর বাবা তখন বাড়িতে ছিলেন না। থাকলে হয়তো এতোটা হতাশ আর অপমানিত হয়ে ফিরতে হতো না। স্বার্থপরতা আর আত্মকেন্দ্রীকতা কী সুখ দেয় মানুষকে এখনো জানি না, কিন্তু কতটা ছোট করতে পারে তার আশ্চর্য নজির বটে এই ভদ্রমহিলা।

            পাড়াতে কাল একটা বাজে ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটা বেশ শোকেরই। আমাদের সঙ্গে সেরকম আলাপ নেই, কিন্তু সবাই চেনে,  আমরাও চিনি। এক বনেদি বাড়ি। বাড়ির বাবাকে নিয়ে ছেলে গেছিলেন ডিব্রুগড় মেডিক্যাল কলেজেবাবাকে সেখানে ভর্তি করিয়ে ফেরার পথে দুর্ঘটনাতে পড়ে তাদের গাড়ি। আবার মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হলো।  পথেই  ছেলের করুণ মৃত্যু হলো  পৌষালিরা যখন পাড়াতে ফিরে এসেছে, তার সামান্য আগে মৃতদেহ নিয়ে এসেছে এবং  সৎকার করতে শ্মশানে নিয়েও গেছে। এখানে ওখানে লোক জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের এতো শতো বোঝার কথা নয়। এরা আশা নিয়ে, পাড়াতে থাকেন এক বাংলা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা, তাঁর বাড়িতে গেছে। ভদ্রমহিলা ওর মাকেও চেনেন, আমাকেও চেনেন। সম্ভবত আমার পদাধিকারের জন্যে সমীহ করে হাসিও ছুঁড়েন দেখা হলে। সুতরাং তারা গেছে আশা নিয়ে সগৌরবে। নিশ্চয়ই তিনি বেশ অনুপ্রাণীত করবেন। কিন্তু মুখ ঝ্যামটা দিয়ে উঠলেন, “পাড়াতে লোক মারা গেছে। আর চাঁদা দেবো কাশ্মীরের জন্যে!” মেয়ের চটপট পালটা জবাব, “এখানেতো একজন মারা গেছেন । কাশ্মীরে কতজন মারা গেছেন তার হিসেব আছে? ওদের চিন্তা করতে হবে না? ” তাঁর বাড়িতে আরো একজন পূর্বপরিচিত শিক্ষিকা ছিলেন। দু’জনে মিলে নিতান্ত না পেরে তুলে দিলেন দশটি করে টাকা। মেয়ে কিছু মনে করে নি। কিন্তু বিগড়ে গেল পুতুল । সে বাড়ি চলে এলো। আর ঐ যে অন্য স্কুলের বান্ধবী কল্যাণীকে সঙ্গে নিয়েছিল ওর মা ডেকে পাঠালেন, বেলা হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরতে হবে। তার উপরে ওর পরীক্ষা চলছে। পড়াও আছে।  মেয়ের তখনো পরিকল্পনা বাকি আরো বহু বহু। সে এবারে করে কী? বাড়ি ফেরা ছাড়া উপায় ছিল না। পুতুলকে বহু বোঝালো। পুতুল যাবে না। বাড়ি ফিরে সেই শিক্ষিকার কথা মায়ের কানে তুলতেই ওর মা বুঝি বললেন, “লোকের বাড়ি গিয়ে চাওয়া আমাদের সংস্কৃতিতে নেই।” কথাটা সে পৌষালিকে জানাতে, পৌষালি বলল, “আমরা কি আমাদের জন্যে চাইছি? আমরাতো আবার সেটা দিয়ে দেবো। বিপন্ন মানুষকে দিলে চাওয়া বলে?” পুতুল বলল, “আমাদের মধ্যে আসলে মেয়েদের বেশি বাইরে বেরুতেও দেয় না। লোকে নানা বাজে কথা বলে কিনা।” আমাদের মধ্যে-- মানে ওর সম্প্রদায়ের কথা বলছিল। নাম নাই বা নিলাম।  এই সব তর্ক করছিল, আর ওদিকে ঈশানীর তৈরি বাক্সে হিন্দি-ইংরেজিতে এটা ওটা লিখে ছবি এঁকে সাজাচ্ছিল। তার কিছু ছবি এখানে রইল।  

 
                 যখন কিছুতেই মানানো গেল না ভেঙ্গে পড়ল পৌষালি। ভেঙ্গে পড়লে যা এখনো করে, প্রথমে ওর মুখ কালো হয়। চোখে জল নামে। কেউ কিছু বললেই, শুরু হয় কেঁদে কুটে তর্ক। গোটা বাড়ি জড়ো হয়ে গেল। ইতিমধ্যে পুতুলের বাবাও এসছেন বাড়িতে। তিনি অনুমতি দিলেন, আশেপাশে আরো কয়েক বাড়ি যাওয়া যাবে। পুতুল বুঝি তখন ওর মাকে গিয়ে বলেই দিল, “তুমি তো দিলে না। বাবা দিয়ে দিয়েছেন।” ওর মা বেচারির আসলেই কোনো দোষ নেই।  গণ্ডিটা আসলে বাবারই তৈরি করা। সে অনেক কথা। সে যাক, তাতে আরো কয়েক বাড়ি যাওয়া হলো। পঞ্চাশ একশর নিচে পাওয়া গেছে খুবই কম। যে মোদ্দা কথাটা না বললে নয়, অধিকাংশ বাড়িতে আসলে উপভোগই করেছে এদের এই অভিযান।
            সামান্য পরে ফিরে এলেও কৌটা পুরণ হয় নি পৌষালির। পাড়াটা আমাদের বেশ বড়। তখনো দুই এক কোনা বাকি পড়ে রইল, যেখানে গেলে ভালোই জুটবে সে জানে। কিন্তুই যাওয়া হলো না।
            আমি বাড়ি ফিরেছি যখন , সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। অন্ধকার। বাড়িতে তালা। ভাবলাম বুঝি মায়ে-মেয়েতে বাজারে গেছে। পুজোর মরশুম। অনেক রাত অব্দি ফিরছিল না। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা নিয়ে এগুবো কিনা জিজ্ঞেস করতে ফোন করে জানলাম, এরা কাছেই আছে। এই এলো বলে। এলোও বটে। ওমা! কোথায় পুজোর বাজার! মাকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে কোটা পুরণ করতে। নইলে মায়ের রক্ষে ছিল না বিকেল ভর।  এ যাত্রা ওর অভিজ্ঞতা সুখকর। বেশ আদর আপ্যায়নও জুটেছে। কেউ কেউ ওর আব্দারেরও মানুষ। তারা মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদও করেছেন। কেউ ঠাট্টা করে বাড়ির সবার নামে আলাদা করে রসিদ কাটিয়েছেন। সে কেটেছে। বাড়ি ফিরে যখন এতো সব বলল, আমিতো তাজ্জব।  আনন্দও হলো। একটা গৌরব বোধও হলো। কিন্তু যা কিছু দুঃখ  গেছে তার জন্যে নিজের মনেও  বিঁধল কাঁটাকিন্তু সব মিলিয়ে মনে হলো, জীবনের একটা নতুন পাঠ শিখল সে।  ওর স্কুল যদি এই সুযোগটা করে না দিত তবে শিখত না। মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম। বললাম, “তোর স্কুলের উপরে আমার রাগ আছে বহু কারণে। কিন্তু এই কাজটা ভালো করেছেএমন কাজেই সমাজের কাছে যাওয়া যায়, সমাজের সঙ্গে জোড়া যায়। ভালো মন্দ মানুষ চেনা যায়। আর এতে মনের স্বাস্থ্য ভালো হয়। সুন্দর হয়          মন। ”
        
    
পৌষালি আর ওর মা সম্পাঃ পুরোনো ছবি
সে বলছিল, “যে দুই একজন বাজে  কথা বলছিলেন, আমি কিন্তু কিছু মনে করিনি। কেন করব বল? তাদের যা মনে হয়েছে বলেছে। আমি কিছু মনে করে আমার কাজ থেকে সরে দাঁড়াবো কেন? ওদের মন ছোট বলে, আমি কেন ছোট করব?” বললাম, “ঠিক।”এবারে মেয়ে চেপে ধরল,  ""এবারে তোমারটা দাও।'' বললাম, “আমি আবার কেন? তুই দিলি, তোর মা দিল। আমি রসিদ ছাপিয়ে দিলাম। আমার খরচা দে!” “এসব হবে না, তুমি দেবে বলেছিলে এবারে দু’শো টাকা তুমি দাও।”
            আমাকে চেপেতো সে ধরেছিল কাল রাত থেকেই। আমি দিই নি। বলেছিলাম, শেষে দেবো। কারণটা ছিল এই যে , সংগ্রহ যদি কম হয় ওর হিসেবটা পুরিয়ে দেবো। তো হিসেব করতে বসা গেল বাপে মেয়েতে। এর মধ্যে কথা ছিল, পুতুল যদি সঙ্গ দেয় ওরও হবে একটা ভাগ। সে আলাদা করে গিয়ে ক্লাসে দেবে। রসিদের হিসেব থেকে সেই ভাগটা কম পড়ল। বাকিটা আমি পুরিয়ে দিলাম। খেয়ে দেয়ে মেয়ে ঘুমিয়ে গেল।
বাকি গল্প শোনা যাবে সোমবার। দুপুরে। যখন স্কুল থেকে ওকে আনতে যাবো। আমি বাইক চালাবো। পেছনে বসে ও আমাকে বলবে, স্কুলে আর কারা কেমন অভিযান চালালো। সারা স্কুল এই ‘নব আনন্দে জাগল’ কতটা! কাশ্মীর কতটা সহব্যথীকে পেল এই শহর থেকে। ওর আশা, যত বেশি পাবে তত বেশি কাশ্মীরও পাশে দাঁড়াবে যখন অসম বিপন্ন হবে। সবাই  লাভের কথা তুলছিল দেখে ঈশানীর তৈরি করা বাক্সে একটা কথা হিন্দিতে লিখেছিল পৌষালি, “भुखे हे हम आहार दॉ हमे।  मदत करेगें  हम भि फिर मुसिबत मे तुम जब आओगे” ( ভুখে হ্যায় হম, আহার দো হমে। মদত করেঙ্গে হম ভি ফির মুসিবতমে তুম জব আওগে। )

***  ***                                     ***   ***

সোমবারে কিছু গল্প জানা গেল। ওদের ক্লাস থেকে দুটোই মাত্র দল বেরিয়েছিল। যারা বেরোয় নি, তাদের অনেকে নিজের অনুদান নিয়ে এসেছিল। পৌষালির হাতে বাক্স দেখে, সেখানেই ভরে দিল। ওর মোট পরিমাণ প্রায় তিনগুণ বেড়ে গেল।  মঙ্গলবারে জানা গেল এই একদিনের অভিযানে ওদের স্কুল বাডিং বাডস সিনিয়র সেকেণ্ডারি স্কুল থেকে সংগৃহীত হয়েছে মোট ১ লক্ষ, ৭০ হাজার, ৩শত ৪০ টাকা। কম নয়। 


         



কোন মন্তব্য নেই: