ছায়া অনুবাদ: দেবব্রত আচার্য
( রাইনের মারিয়া রিলকে চিঠিগুলো লিখেছিলেন ২৭ বছর বয়সে, এক কবি যশোপ্রার্থী ১৯ বছরের বালককে। যা Letters to a Young Poet
( মূল জার্মান নাম : Briefe an einen jungen Dichter) নামে ছাপা হয়। নিচে
প্রথম চিঠিটির ছায়া অনুবাদ। এক একে বাকিগুলো ও অনুবাদ করার ইচ্ছে রইল। )
প্যারিস,
ফেব্রুয়ারী ১৭, ১৯০৩
প্রীতিভাজনেষু,
তোমার
চিঠি কিছুদিন আগেই পেয়েছি। আমার ওপর তোমার আস্থার জন্য ধন্যবাদ। আমি একটি
কাজ করতে পারি তোমার জন্য । তোমার কবিতাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারি । সমালোচনা করার
মতো যোগ্যতা আমার নেই। সমালোচনার পরিসরে শিল্পকর্মকে খুব কমই ধরা সম্ভব হয়।
এতে সৃষ্টি হয় অহেতুক ভুল বোঝাবুঝির । সব কিছুর যেমন অবয়ব দেয়া সম্ভব হয়না না
তেমনি ভাষায়ও প্রকাশ করা যায় না। এমন অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে যা প্রকাশ করা
প্রায় অসম্ভব। এই অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের মনোজগতের এমন একটি স্তরে ঘটে, যেখানে
কোন ভাষা এখনও প্রবেশ করতে পারেনি। শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে সেটি আরো বেশি করে
প্রযোজ্য। এই অভিজ্ঞতাগুলোর অস্তিত্ব বেঁচে থাকে শুধু মাত্র আমাদের স্বল্পমেয়াদী জীবনের পরিসরে।
উপরের এই
সংক্ষিপ্ত কথাগুলো কে ভূমিকায় রেখে আমি কি বলতে পারি যে তোমার কবিতায়
নিজস্ব কোন রচনা শৈলি এখনো গড়ে ওঠেনি ।যদিও এতে একান্ত নিজস্ব, সুপ্ত
একটা কিছুর নীরব যাত্রা শুরু রয়েছে বলে মনে হয় । তোমার শেষ কবিতা 'আমার
আত্মা'য় এ
ব্যাপারটি আরো স্পষ্ট করে চোখে পড়ে। সেখানে তোমার নিজস্ব কিছু উপলব্ধি
শব্দ
ও ছন্দ হয়ে উঠতে চাইছে মাত্র। তোমার 'লিওপার্ডীর প্রতি' কবিতায় বিশাল এক নির্জন সত্তার প্রতি তোমার এক রকম সংযোগের প্রকাশ ঘটেছে । কবিতা গুলো
নিজেরা তেমন কিছু হয়ে ওঠেনি। স্বাধীনভাবে এরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে
পারেনি আপন মহিমায় । এমন কি তোমার শেষ কবিতাটি বা 'লিওপার্ডীর প্রতি'
ও নয়। তোমার চিঠিতে তুমি যে ত্রুটি গুলোর কথা উল্লেখ করেছ সেগুলো পড়ার
সময় আমি নিজেও বুঝতে পেরেছি। কবিতার নামগুলো এই মুহূর্তে যদিও মনে করতে
পারছি না ।
তুমি
জানতে চেয়েছ কবিতাগুলো ভালো হয়েছে কিনা। আমাকে যেমনটি জিজ্ঞেস
করেছ, তেমনি অন্যদেরও জিজ্ঞেস করেছ। পত্রিকায় পাঠিয়েছ কবিতাগুলো।
অন্যের কবিতার সাথে তুলনা করেছ। সম্পাদকেরা
তোমার কবিতা বাতিল করে দিয়েছে বলে কখনও মর্মাহত হয়েছ। এখন যখন তুমি
আমার উপদেশ চাইছ তবে তোমাকে আমি একটি অনুরোধ করছি। এগুলো আর দয়া করে করনা ।
তুমি বাইরের দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে আছো। এটি এক্ষুণি তোমায় এড়িয়ে চলা
উচিত। এ
ব্যাপারে অন্য কেউ তোমাকে উপদেশ দিতে বা সাহায্য করতে পারবে না। কেউ না ।
শুধু মাত্র একটি কাজ করতে পারো। নিজের দিকে ফিরে তাকাও। যা তোমাকে বাধ্য
করে লিখতে সেই কারণটি খুঁজে বের করো। খুঁজে দেখ এই কারণটি তোমার হৃদয়ের কত
গভীরে শেকড় ছড়িয়েছে । নিজেকে জিজ্ঞেস করো যদি তোমার জন্য লেখালেখি
নিষিদ্ধ করা হয় তবে তার জন্য প্রাণ দিতে পারবে কিনা। নিজেকে রাতের একান্ত
নির্জনতায় জিজ্ঞেস করো, "আমাকে কি লিখতেই হবে?" নিজের গভীর সত্ত্বার
কাছে
গিয়ে এর উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করো। যদি এই ভাবগম্ভীর প্রশ্নের উওর
আসে
তীব্রতর চিৎকারে, "হ্যা, আমাকে লিখতেই হবে" - তাহলে নিজের জীবনকে এর জন্য
তৈরি
করো। জীবনের প্রতিটা মূহূর্তে উৎসর্গ করো। নগণ্য থেকে
নগণ্যতম সময়গুলোও সাক্ষী থাকুক তোমার তীব্র অন্তর্দহনের । তারপর প্রকৃতির
খুব
কাছে যাও। পৃথিবীর প্রথম মানুষের চোখ নিয়ে দেখ প্রকৃতিকে। বলার চেষ্টা করো , তুমি কী দেখছো, কী অনুভব করছো, কী ভালোবাসতে
পারছো আর কীইবা হারাতে চলেছ ?
প্রেম বা অতি সাধারণ কোন বিষয়ে লিখতে চেষ্টা করো না। এটা খুব কঠিন কাজ । যে বিষয়গুলো নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক চমৎকার কাজ হয়ে গেছে, সেগুলো নিয়ে মৌলিক কিছু লিখতে গেলে প্রচণ্ড রকমের মুন্সিয়ানা চাই। যা আসতে পারে একমাত্র পরিণত হাতের ছোঁয়ায়। তাই এ বিষয়গুলো থেকে দূরে থেকো। লিখতে চেষ্টা করো তোমার দৈনন্দিন যাপিত জীবন। তোমার ছোট ছোট দুঃখ, ইচ্ছে, হঠাৎ করে উড়ে আসা ভাবনা কিংবা সৌন্দর্য সম্পর্কে তোমার নিজস্ব বিশ্বাস। বিনয় ও আন্তরিকতার সাথে লিখে যাও।যখন লিখবে তখন চারপাশের রীতিনীতি, স্বপ্নে দেখা চিত্রকল্প ও স্মৃতির সাহায্য নাও। যদি তোমার যাপিত জীবনকে আপাত পক্ষে দরিদ্র বলে মনে হয় তবে তাকে দোষ দিও না। দোষ নিজেকে দাও। নিজেকে বলো কবি হওয়ার গৌরব সে তোমার নয় । কারণ স্রষ্টার কাছে ধনী দরিদ্র বলে কিছু হয় না । নিজেকে কখনও খুঁজে পাও যদি জেলখানার চার দেয়ালের মাঝে; যেখানে পৃথিবীর অন্য কোন শব্দের প্রবেশ নিষেধ; সেখানেও কি তোমার সাথে থাকবে না শৈশবের অমূল্য সেই সোনালি দিনগুলো? সমস্ত শক্তি দিয়ে সেখানে মনসংযোগ করো। চেষ্টা করো সময়ের অতলে হারিয়ে যাওয়া সেই অনুভূতিগুলোর অনুরণন আবার নুতন করে অনুভব করতে। তাতে তোমার ব্যক্তিত্ব হবে আরো প্রখর। তোমার নির্জনতার পরিধি বিস্তৃততর হয়ে নিজেই পরিণত হবে বিশাল এক জগতে । সে জগতের সন্ধ্যালোকে তুমি নিজেকে খুঁজে পাবে একা। অনেক দূর হতে চেনা অচেনা মানব-মানবীর কোলাহল তোমার কর্ণকুহরে এসে পৌঁছুবে । এই একান্ত নগ্ন নির্জন জগতে হারিয়ে যেতে যেতে যদি কাব্যলক্ষ্মী তোমাকে ধরা দেন তবে ভাববার প্রয়োজন পড়বে না, তা ভাল না মন্দ। তুমি তোমার কাব্যলক্ষ্মীকে তখন আর পত্রিকায় পাঠাবে না । কারণ এটি তোমার সৃজন । তোমার জীবনেরই একটা অংশ। তোমারই কণ্ঠস্বর।
প্রেম বা অতি সাধারণ কোন বিষয়ে লিখতে চেষ্টা করো না। এটা খুব কঠিন কাজ । যে বিষয়গুলো নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক চমৎকার কাজ হয়ে গেছে, সেগুলো নিয়ে মৌলিক কিছু লিখতে গেলে প্রচণ্ড রকমের মুন্সিয়ানা চাই। যা আসতে পারে একমাত্র পরিণত হাতের ছোঁয়ায়। তাই এ বিষয়গুলো থেকে দূরে থেকো। লিখতে চেষ্টা করো তোমার দৈনন্দিন যাপিত জীবন। তোমার ছোট ছোট দুঃখ, ইচ্ছে, হঠাৎ করে উড়ে আসা ভাবনা কিংবা সৌন্দর্য সম্পর্কে তোমার নিজস্ব বিশ্বাস। বিনয় ও আন্তরিকতার সাথে লিখে যাও।যখন লিখবে তখন চারপাশের রীতিনীতি, স্বপ্নে দেখা চিত্রকল্প ও স্মৃতির সাহায্য নাও। যদি তোমার যাপিত জীবনকে আপাত পক্ষে দরিদ্র বলে মনে হয় তবে তাকে দোষ দিও না। দোষ নিজেকে দাও। নিজেকে বলো কবি হওয়ার গৌরব সে তোমার নয় । কারণ স্রষ্টার কাছে ধনী দরিদ্র বলে কিছু হয় না । নিজেকে কখনও খুঁজে পাও যদি জেলখানার চার দেয়ালের মাঝে; যেখানে পৃথিবীর অন্য কোন শব্দের প্রবেশ নিষেধ; সেখানেও কি তোমার সাথে থাকবে না শৈশবের অমূল্য সেই সোনালি দিনগুলো? সমস্ত শক্তি দিয়ে সেখানে মনসংযোগ করো। চেষ্টা করো সময়ের অতলে হারিয়ে যাওয়া সেই অনুভূতিগুলোর অনুরণন আবার নুতন করে অনুভব করতে। তাতে তোমার ব্যক্তিত্ব হবে আরো প্রখর। তোমার নির্জনতার পরিধি বিস্তৃততর হয়ে নিজেই পরিণত হবে বিশাল এক জগতে । সে জগতের সন্ধ্যালোকে তুমি নিজেকে খুঁজে পাবে একা। অনেক দূর হতে চেনা অচেনা মানব-মানবীর কোলাহল তোমার কর্ণকুহরে এসে পৌঁছুবে । এই একান্ত নগ্ন নির্জন জগতে হারিয়ে যেতে যেতে যদি কাব্যলক্ষ্মী তোমাকে ধরা দেন তবে ভাববার প্রয়োজন পড়বে না, তা ভাল না মন্দ। তুমি তোমার কাব্যলক্ষ্মীকে তখন আর পত্রিকায় পাঠাবে না । কারণ এটি তোমার সৃজন । তোমার জীবনেরই একটা অংশ। তোমারই কণ্ঠস্বর।
শিল্পকর্ম
তখনই শিল্পমানে উন্নিত হয় যখন তা অন্তর্নিহিত তাগিদ থেকে সৃষ্টি হয় ।
এই তাগিদ দিয়েই শিল্পকে আলাদা করে চেনা যায় । সুতরাং, আমি তোমাকে অন্য
কোন উপদেশ দিতে অক্ষম। শুধু বলতে পারি নিজেকে জানো। আরো গভীরে প্রবেশ করো।
বোঝতে চেষ্টা করো তোমার জীবন যা থেকে উৎসারিত তার গভীরতা। তোমাকে লিখতে হবে
কিনা, সে প্রশ্নের উত্তরও আছে সেখানেই। সে উওর যেভাবেই আসুক তা মেনে নাও।
তাকে পরিবর্তন করতে যেও না। হয়ত তুমি আবিস্কার করলে একজন কবি হওয়াই তোমার
নিয়তি। তা হলে সেই নিয়তিকে মেনে নিয়েই পথচলা শুরু হোক। তার ভার,
বিশালতা সবই গ্রহন করো, ফলের আশা ছেড়ে। কবির কাছে তার নিজস্ব একটা আশ্চর্য
ভুবন থাকা চাই। কবি তাঁর সৃষ্টির সব উপাদান এই ভুবন থেকেই খুঁজে নেবেন ।
সে ভুবনের প্রতি কবির থাকবে সমস্ত জীবন উৎসর্গিত।
তোমার অন্তপুরের নির্জনতায় প্রবেশ করে হয়তো জানতে পারলে কবি হওয়া তোমার
কর্ম নয় ( যদি এক জন না লিখে বাঁচতে পারে তবে তার লিখার প্রয়োজন নেই )।
তারপরও এই নিজেকে খোঁজার অর্থ মিথ্যে হবে না তোমার । জীবন সেখান থেকেই
সঠিক পথ খুঁজে নিবে। আমি আশা করছি এই নুতন পথও হবে আরো বিস্তৃত। আমার শুভ
কামনা
রইল।
আর কি বলতে পারি বলো? ছোট ছোট টুকরো ঘটনার রয়েছে অসীম
গুরুত্ব ।অবশেষে আর একটা পরামর্শ তোমাকে দিচ্ছি । এগিয়ে যাও নীরবে। খেয়াল রেখো এই এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সব থেকে ক্ষতিকারক হতে পারে তোমার নিজস্ব
সত্ত্বার বাইরে গিয়ে তোমার প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা।। তোমার একান্ত
নির্জন অব্যক্ত অনুভুতির অতলেই লুকানো রয়েছে সে উত্তর।
আমাকে যে কবিতাগুলো পাঠিয়েছিলে, সেগুলো ফেরত পাঠালাম । আমাকে বিশ্বাস করে
প্রশ্নগুলো করার জন্য আবারো তোমাকে ধন্যবাদ। আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি
উত্তরগুলো সততার সাথে দেয়ার। আমার চেষ্টার মাত্রাটা হয়ত একজন অপরিচিত
ব্যাক্তির
থেকে তোমার প্রত্যাশাকে একটু ছাড়িয়েই গেছে ।
তোমার একান্ত,
রাইনের মারিয়া রিলকে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন