সুগ্রীব! না রামায়ণ বা মহাভারতের সেই কাল্পনিক চরিত্র নয়। বানর মুখো শক্তিশালী কোন বীর যোদ্ধাও নয়।
ত্রিপুরার প্রত্যন্ত মিশ্র জনবসতির এক কিশোর। স্রেফ বিস্কুট চুরি করে খেয়েছিল খিদে সহ্য করতে না পেরে। তাই প্রকাশ্যে গণপিটুনি দিয়ে তাকে হত্যা করে কিছু মানুষ।
তাদের মধ্যে কে নেই! যুব ফেডারেশনের কমরেড থেকে শুরু করে কংগ্রেস দলের নেতা, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, এবং এলাকার প্রবীণ নবীন সহ অত্যুতসাহী কিছু মানুষ। তাদের সামনেই ঘটেছে এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড। তাদের উৎসাহেই নৃশংসভাবে নারকীয় উল্লাসে রাতভর তাকে পিটিয়ে মেরেছে কিছু মানুষ।
তখন বেশ ছোট ছিলাম মনে আছে একবার পাউডার দুধ খেয়েছিলাম চুরি করে, ধরা পড়েছিলাম মায়ের হাতে। মারধোর করেননি, তবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এই শেষবার ক্ষমা করে দিলাম। এরপর থেকে আর দুধ খাইনা। আজও খাইনা।
টাইমস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে এবার বিষয় 'দ্য ফেস অব বুদ্ধিস্ট টেররিস্ট' (এক বৌদ্ধ সন্ত্রাসীর মুখ)। গল্প একটাই বৌদ্ধ আর মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের নেপথ্য!
আমার প্রিয় বন্ধু এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। সকাল এগারোটা। আর কোনদিন জেগে না উঠলেও আশ্চর্য হবো না। কারন, কাল এক কলামের নিউজ হবে পাঁচ বা ছয়ের পাতায়। এইটুকুই। এরপর দিন থেকে সবকিছু আবার ঠিকঠাক চলবে।
সুগ্রীব নামে যে কিশোরটি মরে গেছে গণপিটুনিতে সে আর কোনদিন বিস্কুট চাইবে না। অথচ প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ বিস্কুট ডাস্টবিনে যাবে এবং ফ্যাক্টরি তে উৎপন্ন হবে। রামায়ণ মহাভারতের সুগ্রীব চরিত্রটি বানর এবং কাল্পনিক হলেও তিনি পুজিত। আর আমাদের সুগ্রীব জ্যান্ত মানব কিশোর হলেও তার মৃত্যু হয় গণপিটুনিতে।
একটি বিস্কুটের দাম ও নেই সুগ্রীবের জীবনের। ঐ ঘটনার পর আমি বলেছিলাম তোমরা তোমাদের ভগবান কে হত্যা করেছো। সুগ্রীব হিন্দুদের দেবতা। তোমরা সবাই হিন্দু। শুনেছি এরপর সেই এলাকার কিছু মানুষ প্রায়শ্চিত্য করেছে মাথা মুন্ডন করে।
টাইমস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ নিয়ে সে দেশের সরকার চিৎকার করলেও এটাই সত্যি, মিন্দালেই প্রদেশের বৌদ্ধ ভিক্ষু ভিরাতুর সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পর মুসলিম বিরোধী মন্তব্য করেছিলেন, তাই তিনি আজ টেরর অনেকের কাছেই, বিশেষ করে মুসলিম দুনিয়ায়। আর সেই দুনিয়ায় কাগজের বিক্রি বাড়বেই।
এবং এটাও আজ সত্যি আমি আজকাল আর দুধ খাইনা। এক চামচ দুধ আমার জন্য, আমার পরিবারে বরাদ্দ থাকতেই পারতো।
আমিও অনেকদিন দুধ খাইনি, আমিও দেখেছি অনেকেই শিশুর দুধ চুরি করছেন জন্ম হওয়ার আগেই।
আমার যে বন্ধুটি ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে আর জেগে উঠবেনা কোনদিন, তার সাথেও গতকাল রাতে চলেছিল চূড়ান্ত সন্ত্রাস। সভ্য ঘরের আসবাব তার সাক্ষী। যামিনী রায়ের ডুপ্লিকেট ফটো ফ্রেমের কাঁচে সেই সাঙ্ঘাতিক সংঘর্ষের কিছু রঙ এখনও লেগে আছে।
তার স্বামী এখন অফিসে বসে লেবু চা খাচ্ছেন।
ঈশ্বর, হনুমান, সুগ্রীব আর আমি একই দেশের ধর্ম আর নাগরিক। আমাদের মৃত্যু বা হত্যা শেষে প্রায়শ্চিত্য তবু হয়। সন্ত্রাসী কোন ভিক্ষু বা সন্ন্যাসী বা মোল্লার জন্যও হয়ে থাকে বিরোধ বা একটি বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতিবাদ।
কিন্তু আমার বন্ধুটির জন্য তা হয়না। কারন আমার বন্ধুটি দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক এবং তিনি মেয়ে এবং রক্ষনশীল হিন্দু পরিবারের।
কোরান, ত্রিপিটক, রামায়ণ আর বাইবেলে বন্ধুত্বের কোন সংজ্ঞা নেই। মেয়েদের বিপ্লব করারও কোন পথ বাৎলে দেয়া হয়নি।
তাই দুধ চুরি করে আমি খাবোই। বিস্কুট খাও তুমি। টাইমস তুমি চিৎকার করে যাও প্রচ্ছদে, সংঘাত চলবেই, প্রতিটি ধর্মে, রাষ্ট্রে, ঘরে, মন্দিরে, মসজিদে, বৌদ্ধ বিহারে অথবা বেডরুমে, মানুষ আর সন্ত্রাসীদের।
সব ধর্মেই দুধ খাওয়ার কথা বলা আছে। তবুও আমি দুধ খাবোনা, কারন আমি আফিং বনে যাইনা, এই পাহাড়ের কাছেই ধার নেই সভ্যতার, পাঠ নেই ভালোবাসার।
1 টি মন্তব্য:
নামতে নামতে আমরা কোন অতলে নেমে যাচ্ছি? ...
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন