“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ১০ জুন, ২০১৩

কবি রণজিৎ দাশের পরিচয়ে আজ আমাদেরও ‘আত্মপরিচয়’


(লেখাটি ১০ জুন, ২০১৩ তারিখে দৈনিক যুগশঙ্খে বেরিয়েছে)
ঠাৎই মানসপটে ভেসে উঠলো উত্তর-পূর্বের এক অন্যতম সুসন্তান প্রয়াত সুজিত চৌধুরীর করিমগঞ্জ শহরের চিত্তরঞ্জন লেনের  বাড়িতে বছর ছয়েক আগের এক ঘরোয়া আড্ডার ছবি । সেই আড্ডায় হঠাৎই সুজিতদা বলে উঠেছিলেন যে রণজিৎ দাশ তাঁর অন্যতম প্রিয় একজন কবি । সেই প্রসঙ্গে তিনি উষারঞ্জন ভট্টাচার্যকে (যিনি নিজেই সেদিন সুজিত চৌধুরীর বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন সঙ্গে ছিলেন সুলেখক মদনগোপাল গোস্বামী এবং গৌতম ভট্টাচার্য) একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন যে রণজিৎ দাশের বহুপঠিত ও সমাদৃত ‘শ্মশান ছবি’ কবিতার সেই বিখ্যাত পঙক্তি—“মায়ের মুখাগ্নি করে সন্তানের অকৃতজ্ঞ হাত” মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর কোন বিখ্যাত লেখকের কোন  পঙক্তি বা কাছাকাছি কিছু মনে পড়ে কিনা । কিছুক্ষণ পরে তিনি নিজেই বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অপরাজিত’-তে অপু যখন তার মায়ের মৃত্যু সংবাদ পায়, সেই মুহূর্তে তার প্রাথমিক মানসিক প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল লেখক তার যে বর্ণনা দিয়েছিলেন এবং তার পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যে রণজিৎ দাশের উপর্যুক্ত পঙক্তিটির মতো বা কাছাকাছি কিছু লেখা হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে তাঁর নিজের সন্দেহ প্রকাশ করে সুজিতদা বলেছিলেন “এরকম আর কোন পঙক্তি আগামীতে বহুদিনের মাঝে বাংলা সাহিত্যে লেখা হবে কিনা সে বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট সন্দেহ আছে । সঙ্গে আরো একটি কথা তিনি বলেছিলেন—“বল দেখি উষা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস-সমূহের মধ্যে রণজিতের সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস কোনটা ?” উপস্থিত যে ক’জন ছিলেন, তাঁরা ভাবছিলেন অনেক কিছুই, কিন্তু কেউই মুখ খুলছিলেন না । কিছুক্ষণ পরে সুজিতদা নিজেই তার জবাব দিলেন “আদর্শ হিন্দু হোটেল”। সবাই খুব চমকিত হয়েছিলেন এইটুকু মনে আছে । সঙ্গে আরো একটি কথা বলেছিলেন যে তাঁর মতে এই মুহূর্তে বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি রণজিৎ দাশ । পরে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘কবিসম্মেলন’ কবিতা পত্রিকায় কবি এবং কবিতা নিয়ে লেখা একটি ধারাবাহিকে দেখেছি লেখক লিখছেন যে “কবি রণজিৎ দাশ এই মুহূর্তে বাংলা কবিতার অহঙ্কার” ।          

    আমাদের অতি প্রিয় আরেকজন কবি আগরতলাবাসী প্রবুদ্ধসুন্দর করের কাছ থেকে ফোনে যখন খবর এলো যে কবি রণজিৎ দে'জ প্রকাশিত 'রণজিৎ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা'র জন্যে  'রবীন্দ্র পুরষ্কার -২০১৩' পাচ্ছেন, তখন আচমকা মনে হচ্ছিল যে সমস্ত জাগতিক ঝুট-ঝামেলা-কূট-কচালির হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা সবাই শুধুই যেন শুধুই রণজিৎ দাশের কবিতার বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছি আর সেই সঙ্গে মনে হচ্ছিল যে এতো শুধু কবি রণজিৎ দাশের সম্মান নয়, তাঁর সঙ্গে বরাক-ব্রহ্মপুত্র-গোমতীর সন্তানরাও এই সম্মানের সমান ভাগীদার ।     

                কবি রণজিৎ দাশের রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্তিতে গত ৩১ মে, শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি সমাজ, গুয়াহাটি  আয়োজিত এক বৈঠকে আনন্দ প্রকাশ করে বিভিন্ন আলোচক কবিকে অভিনন্দন করেন । বৈঠকটিতে সভাপতিত্ব করেন বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি সমাজ-এর কার্যকরী সভাপতি গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ।  

              ২০০৬ সনের ডিসেম্বর মাসের শেষে দ্বিতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনের কালে প্রধান অতিথিরূপে উত্তর-পূর্বের গৌরব কবি রণজিৎ দাশ সস্ত্রীক গুয়াহাটিতে এসেছিলেন । আগের থেকে যোগাযোগ থাকলেও তখন থেকেই এখানকার কবি-সাহিত্যিক-পাঠককূলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দৃঢ়তর হয়ে ওঠে । রণজিতের গৌরবে স্বাভাবিকভাবেই সকলে উদ্দীপ্ত । 

               অভিনন্দন সভা শুরু হয় রণজিৎ দাশের  কয়েকটি কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে । গৌতম ভট্টাচার্য অতি সম্প্রতি প্রকাশিত গুয়াহাটির কাগজ নাইনথ কলামের ১০ম সংখ্যা 'দেশভাগ-দেশত্যাগ--প্রসঙ্গ উত্তর পূর্ব ভারত'-এ প্রকাশিত কবি রণজিৎ দাশের কবিতা ‘আত্মপরিচয়’ আবৃত্তি করেন । এছাড়াও ‘ক্ষত’, ‘শ্মশান ছবি’, ‘বাবুই ঘাসের ন্যূনতম দাম’, ‘পূর্বজ বন্দনা’ এবং ‘এক উন্মাদিনীর কথা’ শীর্ষক একটি গদ্য-কবিতা আবৃত্তি করে শোনান ।     

              কবি রণজিৎ দাশ ও তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে উষারঞ্জন ভট্টাচার্য গত শারদ সংখ্যা ‘ব্যতিক্রম’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁরই লেখা ‘সূরি-সমাচার’ নামক নিবন্ধের অংশ বিশেষ পাঠ করে মেধাবী কবি রণজিৎ দাশের অধ্যয়ন ও সূক্ষ্ম জিজ্ঞাসার একটি অনবদ্য পরিচয় তুলে ধরেন । এক যথার্থ আধুনিকতা-মনস্ক কবি রণজিৎ দাশের রবীন্দ্র অধ্যয়নের বিস্তার ও গভীরতার দিকটি উষারঞ্জনের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে । তিনি বলেন, কবি  রণজিতের এই সম্মান প্রাপ্তি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উদীয়মান সাহিত্যিকদের প্রবলভাবে উদবোধিত করবে । মহানগরের মহাশান্তির সঙ্গে আমাদের মতো প্রান্তবাসীদের এক প্রচ্ছন্ন লড়াই হয়তো বা লেগেই আছে । আজকে আমরা সবাই সেক্ষেত্রে রণজিৎ হয়েছি ।     

                এবার কবি সঞ্জয় চক্রবর্তী আস্তে আস্তে আলোচনায় ডুকে পড়লেন রণজিৎ দাশের বেশ কয়েকটি কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে । এরপর সেইসব কবিতাগুলিকে কেন্দ্র করে তাঁর বিস্তারিত বক্তব্য ডালপালা মেলে দেয় । তাঁর মতে, বিষয় নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রকাশভঙ্গিতে রণজিৎ যে অসামান্য কাব্যরীতি আয়ত্ত করেছেন, সে বোধহয় শুধু তাঁর ক্ষেত্রেই সম্ভব । কাব্যসুরের বিচিত্র এই গায়ন-পদ্ধতির তুলকালাম রোমান্টিক অভিধার জন্যই বোধহয় আজ তিনি কবিদেরও কবি আবার একই সঙ্গে জনসাধারণেরও কবি । যে কথাগুলোর সঙ্গে আমরা বাল্যকাল থকেই অভিন্নভাবে জড়িত, সেই কথাগুলোকে পুনরাবিষ্কার করে তিনি এমন এক উচ্চারণ দিয়েছেন, যা শুধু তিনিই দিতে পারেন । ‘বিনাপ্রেমে নাহি দিব সূচ্যগ্র শরীর’ অথবা ‘সংসার সুখের হয় রমণের গুণে’—কোথাও একটু কেঁপে যাওয়া নেই, একেবারে সুসংবদ্ধ সত্য এবং দৃঢ় উচ্চারণ । একেবারে বুকে লাগা শব্দশর । একই সঙ্গে রণজিৎ দাশ আবার সাংঘাতিক রোম্যান্টিক কবি । তাঁর ভাবজগতে সুন্দর এসেছে অন্যতর সুন্দর হয়ে । কবিতায় একাধারে তিনি সৎ এবং সাহসী । অনেকসময় আমরা সত্যকে দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করতে গিয়ে সোজা কথাকে কাব্যিক সুষমা ও ব্যঞ্জনা দিয়ে অযথা আড়াল করবার চেষ্টা করি, কিন্তু রণজিৎ দাশ তাঁর নিজের কাব্যজগৎকে এর বিপরীতে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করান অথচ এই উচ্চারণ একই সঙ্গে ভীষণ কাব্যময় এবং দ্যুতিময় । এই প্রখর অন্তর্দৃষ্টি ও ভাবজগতের দিকে তাকিয়ে থাকলে বিস্মিত হতে হয় । অনেক মনখারাপের রাতে রণজিৎ দাশের কবিতা তাই আমাদের কাছে এক দুর্মর আনন্দময় উড়ান হয়ে ওঠে।

               কবিতার সঙ্গে আমাদের আরেক বন্ধু রজতকান্তি দাশের সম্পর্ক বেশ কিছুদিন ধরেই অত্যন্ত ক্ষীণ, তাই সসঙ্কোচে আলোচনায়  ঢুকে গিয়ে বলেন যে রণজিৎ দাশের কবিতারাজির সঙ্গে  যদিও তাঁর যথেষ্ট পরিচয় ঘটেনি কিন্তু তাঁর সঙ্গে কবির একান্ত আলাপচারিতার সুযোগ ঘটেছিল ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসের একেবারে শেষের দিকে । কবির সস্ত্রীক শিলং ভ্রমণের সঙ্গী হয়েছিলেন রজতকান্তি । রজত তাঁর নিজের লেখা একটি বিজ্ঞান-বিষয় বই কবিকে এর দুদিন আগে পড়তে দিয়েছিলেন । রজতের আশা ছিলনা যে তিনি বইটি মনযোগ দিয়ে পড়বেন । আর যদিওবা পড়েন তবে হয়তো কোলকাতা গিয়ে উল্টেপাল্টে দেখবেন, এবং যেহেতু বইটির বিষয়বস্তু কবিতার আশেপাশের নয় তাই বইটির স্থান হবে অযত্নে-অবহেলায় ঘরের কোন এক কোণে । কিন্তু বিস্মিত রজত আবিষ্কার করেন যে রণজিৎ দাশ এরই মধ্যে খুঁটিয়ে শুধু বইটি পড়েই ক্ষান্ত হননি, সেই যাত্রায় বইটির বিষয়বস্তু এবং লেখনশৈলী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন । সেই সঙ্গে বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ কীভাবে লিখতে হয় সেই বিষয়ে কিছু উপদেশও দিয়েছিলেন, রজতকান্তির স্বীকারোক্তিতে পরবর্তীকালে সেই উপদেশরাজি লেখালেখির ক্ষেত্রে রজতকান্তির খুব কাজে এসেছিলো । কথায় কথায় কবি রজতকে তাঁর নিজের অত্যন্ত একটি প্রিয় বই সুব্রমনিয়ম চন্দ্রশেখরের লেখা ‘Truth and Beauty, Aesthetics and Motivations in Science’  পড়তে বলেছিলেন । রজতকান্তির হিসাবে কবি রণজিৎ দাশ এই ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যথার্থ উত্তরসূরি কারণ রবীন্দ্র-মানসও বিজ্ঞান ভাবনা থেকে মুক্ত ছিলনা কখনও । সেই হিসাবে কবি রণজিৎ দাশও সেই পথেরই পথিক, কবি হিসাবে যে পথের পথিকৃৎ ছিলেন কবীন্দ্র রবীন্দ্র স্বয়ং ।          

               এরই মাঝে মাঝে আলোচনায় ঢুকে পড়ছিলেন কখনো নিশুতি মজুমদার, কখনো বা  গীতেশ দাস । কোন এক ফাঁকে প্রসূণ বর্মণের মুচকি হাসিও আলোচনায় অন্য মাত্রা নিয়ে আসছিলো আবার কখনও জয়ন্তলাল দাশগুপ্ত তাঁর মুখ বাড়িয়ে দিচ্ছেলেন আর এভাবেই বৈঠক জমে গিয়েছিলো । বৈঠকে স্থির হয় সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সৌমেন ভারতীয়া কবি রণজিৎ দাশকে সংস্থায় উপস্থিত লেখকদের তরফ থেকে একটি অভিনন্দন পত্র প্রেরণ করবেন ।    

               তুমুল বৈঠকী আড্ডার শেষে এবার বাড়ি ফেরার পালা । সবারই মনে গুঞ্জরণ তুলছিলো কবি রণজিৎ দাশের কবিতার কোন না কোন পঙক্তি । মনে পড়ে যাচ্ছিলো কবির সম্পর্কে কিছু পড়া এবং অনেক শোনার টুকরো টুকরো কথা, বিশেষ করে শিলচরের অতন্দ্র গোষ্ঠীর কথা, একদা তাঁর কৈশোরে যে গোষ্ঠীর কনিষ্ঠতম সদস্য ছিলেন আজকের কবি রণজিৎ দাশ । সঙ্গে অগ্রজ, বন্ধু এবং এবং পথপ্রদর্শক-অভিভাবক হিসাবে পেয়েছিলেন বরাক উপত্যকার আর এক স্বনামধন্য শক্তিমান কবি প্রয়াত শক্তিপদ ব্রহ্মচারীকে । সেই টুকরো কথাগুলোকে কুড়িয়ে মালা গাঁথতে গাঁথতে হঠাৎই একসময় নিজেকে আবিষ্কার করি নিজের বাড়ির কলিং বেলে হাত রেখে  দাঁড়িয়ে রয়েছি ।      

গৌতম ভট্টাচার্য

০৬ জুন ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই: