(লেখাটা আজ ২৩শে জুন, ২০১৩ শিলচরের দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গে বেরুলো)
।।মৃন্ময় দেব।।
(c)সাময়িক প্রসঙ্গ |
বাংলা চলচ্চিত্রের প্রায় দু’দশকের ‘ম্যাটিনি আইডল’ ঋতুপর্ণ ঘোষ-এর অকাল মৃত্যু বাঙালি নাগরিক মানসকে প্রায় বিবর্ণ বিবশ করে দিয়ে গেছে বলা যায়। অন্তত বিভিন্ন গণমাধ্যমের বয়ান সেরকমই। বিগত প্রায় দু দশক জুড়ে চলচ্চিত্রের অন্তর ও বাহির মহলে প্রয়াত ঋতুপর্ণের তুমুল উপস্থিতি অনস্বীকার্য নিশ্চয়। এমন নয় যে মানুষটি হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। তবে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় যে জুড়ে বসেছিলেন সেকথা অস্বীকারের মানে হয় না কোনও। ঊনিশটি সিনেমা তৈরি করে বারোটি জাতীয় পুরস্কার, চাট্টিখানি ব্যাপার নয় নিশ্চয়ই। এর আড়ালের রহস্য ও রসায়ন নিয়ে ভাবতে গেলেই ধন্দ লাগে, সন্দেহ জাগে। বাঙালি দর্শক তবে কি রাতারাতি এতটা দীক্ষিত হয়ে উঠল যে ঋতুপর্ণকে প্রায় নগদ মূল্যেই অভিবাদন জানাতে এগিয়ে এলো। খটকা লাগে বৈকি! লাগে, কারণ তিনি তো আবার ‘সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল’-এর যথার্থ উত্তরসূরী বলে কোন কোন মহলে স্বীকৃত ও প্রচার-প্রাপ্ত। এমনতর প্রচারে তাঁর নিজেরও যে ভূমিকা তুচ্ছ ছিল তা নয়, বরং তাঁর সচেতন প্রশ্রয় এজাতীয় প্রয়াসকে উসকে দিয়েছে। সন্তান পিতৃসদৃশ হবে, সেটাই বাঞ্ছনীয় –এরকম মন্তব্য শুনেছি তাঁর মুখে, (অথচ তিনি নাকি সিনেমায় নারীর ‘নাড়ির যন্ত্রণা’ প্রকাশে তৎপর ছিলেন) এবং এও বলেছেন যে সত্যজিৎ রায়-ই তাঁর চলচ্চিত্র-গুরু, থুড়ি অভিভাবক । অর্থাৎ, সাদৃশ্য যা তা ‘বাপ-বেটা’র (চেহারার) মিলের মতোই। এই দর্পিত আত্মপ্রচারের আড়ালে এই অসতর্ক স্বীকারোক্তিও বুঝি রয়ে গেছে, যে, মিলটুকু শুধু বহিরঙ্গেই, অন্তরঙ্গে নয়। সত্যজিৎ-ঋত্বিক তো বহুদূর, মৃণাল সেনের ‘দায়বদ্ধ সিনেমা’ নির্মাণের ব্যর্থ প্রয়াস সমূহের সঙ্গেও কি ঋতুপর্ণ কোনও ভাবেই তুলনীয়?
প্রশ্নটা পাঠকের দরবারে আপাতত পেশ করা গেল শুধু। পরবর্তী অংশে এর উত্তর মিলবে তেমন দুরাশা, শ্রদ্ধেয় পাঠক, না করাই সমীচীন। কেননা, এ নিবন্ধকার আদৌ সমালোচক কিংবা শিল্পবোদ্ধা নন এবং এ নিবন্ধের উদ্দেশ্যও তা নয়। এর উত্তর কেবল দিতে পারে ভবিষ্যৎ , দেবেও হয়ত। আমরা বরং বাংলা চলচ্চিত্রে খুব দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা এই সদ্য প্রয়াত পরিচালকের চলচ্চিত্র-পরিক্রমার প্রেক্ষিতটি অনুধাবনে প্রয়াসী হব। তাঁর নির্মাণের নেপথ্যের চাবিকাঠিটি ঠিক কী ছিল যার দৌলতে এমন ঈর্ষণীয় গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা হাসিল করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি! এখানে একটা বিষয় স্মরণ রাখা ভালো যে, সিনেমা নির্মাণের যে কলাকৌশল (technicalities) সেটা ঋতুপর্ণ আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন কম বয়সেই, পিতার কর্মসূত্রেই। যে কারণে অনায়াসে বলেছেনও যে সিনেমা বানানোটা তেমন কিছু কঠিন বলে মনে হত না তাঁর। (জানিনা, ‘সিনেমা বানানো’ নিয়ে এরকম ভাবনার সময় ‘শোলে’ আর ‘পথের পাঁচালী’র মৌলিক প্রভেদ বিষয়ে তিনি কতটা সচেতন ছিলেন! সাতবার ‘শোলে’ আর পাঁচবার ‘পথের পাঁচালী’ দেখার মধ্যে একটা ফারাক তো নিশ্চয়ই রয়েছে)। সে যা হোক, নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিচালক হিসেবে, অন্তত বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে তিনি যে প্রায় একশ’ শতাংশ পেশাদারিত্বের দাবি করতে পারেন সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ মাত্র নেই। এই পেশাদারিত্ব (professionalism) বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে নেহাৎ আনকোরা, এবং ঋতুপর্ণের দ্বারাই আমদানীকৃত সে বিষয়ে সন্দেহ মাত্র নেই। এর যতটা সুফল কুড়নো সম্ভব টলিউড তা কুড়িয়েছেও। ঋতুপর্ণের আবির্ভাব তাই টলিউড ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রীর কাছে ছিল সত্যি সত্যিই এক ‘শুভ মহরৎ’। তবে বাংলা সিনেমায় ঋতুপর্ণীয় ঋতুবদল নিয়ে কিছু চিন্তা-ভাবনা জরুরি বলেই মনে হয় আমাদের। এ লেখার কৈফিয়ত কেবল এটুকুই।
ঋতু-র প্রথম ফিল্ম হীরের আংটি’ (১৯৯২), দ্বিতীয় ফিল্ম ‘উনিশে এপ্রিল’ (১৯৯৪) এবং দারুণ ‘হিট’। সময়টা লক্ষ্য করুন, উত্তমকুমারের প্রয়াণ ঘটে গেছে, সত্যজিত-ঋত্বিক লিগ্যাসি ফিকে হয়ে আসছে,–সবকিছু মিলিয়ে আশির দশককে বাংলা সিনেমার খরার দশক বলা যায় অনায়াসে। ‘শ্বশুর বাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’দের দাপটে বাংলা ফিল্মের ঘর-বার জেরবার, নাভিশ্বাস উঠছে। অন্যদিকে, নব্বুইয়ের দশক থেকেই আমরা বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রেও এক পট পরিবর্তনের সাক্ষী। গ্লোবেলাইজেশন-এর তোড়ে পালটে যাচ্ছে ধ্যান-ধারণা, জীবনযাপনের ধরন- ধারণ, আধুনিকতার বাণের তোড়ে যৌথ-পরিবার ভেঙেছে আগেই, এবারে নয়া-সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও পরিকল্পনা পরিবারকেও টুকরো করে ফেলতে উদ্যোগী হয়ে ভোগবাদী দর্শনের পাশাপাশি নিয়ে এল এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ। বলা বাহুল্য, চলচ্চিত্রে তার করাল ছায়া অনিবার্য ছিল। পুঁজিবাদ যে নাগরিক শ্রেণীর জন্ম দিয়েছিল তার বিনোদনের প্রয়োজন মেটানোর স্বার্থে ও তাগিদেই মুখ্যত উদ্ভব হয়েছিল প্রযুক্তি নির্ভর সিনেমার। নয়া ‘উদারনীতি’ পুরনো মূল্যবোধকে হটিয়ে দিতে নিয়ে এল আত্মভুক এক ভোগবাদ -‘খাও-পিয়ো-মৌজ মানাও’। মতাদর্শের প্রশ্ন-টশ্ন হাসির খোরাক হয়ে পড়ল উত্তর-আধুনিক ডামাডোলে। পালে হাওয়া যোগালো হরেক প্রচার মাধ্যম। সিনেমা সে প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা নেবে তা নিতান্ত স্বাভাবিক। আর এই তত্ত্ব চালান করার উপযুক্ত কাউকে দরকার হয়ে পড়েছিল টলিউডেরও। ঋতুপর্ণের আবির্ভাব সেই মাহেন্দ্র ক্ষণে, বিজ্ঞাপনের জন্য ভিস্যুয়াল নির্মাণের অভিজ্ঞতার পুঁজি নিয়ে। সামান্য প্রারম্ভিক সতর্কতা অবলম্বন ব্যতীত বিশেষ বেগ পেতে হয়নি তাঁকে। মাঠ ফাঁকা ছিল, গোলটা করা গেল সহজেই। উনিশে এপ্রিল, দহন, অসুখ, বাড়িওয়ালি’র মত ফিল্মগুলি সেই সতর্ক নির্মাণের সাক্ষী। পরিচালক মাপজোখ- করা হালকা ঝুঁকি নিয়েই উপোষী দর্শকের হাততালি কুড়িয়ে নিলেন। বিষয় কিংবা গল্প বলার অভিনবত্বে ততটা নয়, যতটা ‘চাহিদা পূরণের সুপরিকল্পিত আয়োজনে, কারিগরি দক্ষতায়’। ন্যাকা-ন্যাকা সংলাপ ও দৃশ্যের বদলে ফিল্মে এল স্মার্ট কথাবার্তা, ভিস্যুয়াল ইত্যাদি। জায়গাটা পাকা হল, জাতীয় পুরস্কার আর আন্তর্জাতিক উৎসবের ছোঁয়ায় একলাফে ‘সেলিব্রিটি’, ক্যারিয়ার গ্রাফ তারপর নিম্নগামী হয়নি আর।
তবে কি তিনি গল্প বলার ধরণে কোন নতুনত্ব আমদানি করেছিলেন ? না, বরং বাঙালি দর্শক ফিল্মের যে ন্যারেটিভে চিরকাল অভ্যস্ত ঋতুপর্ণ তা থেকে এক পা-ও সরে আসেন নি, বরং সচেতন ও সতর্ক ভাবে সেই অভ্যস্ত ন্যারেটিভের উপর নির্ভরশীল থেকেছেন। বিষয়বস্তুতেও তো নূতনত্ব দেখিনা সে অর্থে, তাহলে! হ্যাঁ, একটা নতুনত্ব অবশ্যই আমদানি করেছেন ঋতুপর্ণ, আর তা হল যৌনতা। বাংলা সিনেমায় যৌনতার এই অভিষেক এক কথায় অভূতপূর্ব। যৌনতা ‘শিল্পের বিষয় হতে পারে না বা হওয়া উচিত নয়’- মার্কা ছুঁৎমার্গিতা আমাদের অবশ্যই নেই। যৌন- জীবন জীবনেরই অংশ, কাজেই তা শিল্পসাহিত্যের বিষয় হতেই পারে, হওয়া দরকারও। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও স্মরণ থাকা প্রয়োজন যে শরীরী সঙ্গম অথবা সংঘর্ষই জীবনের সার কথা নয়, শেষকথা নয়। শরীর ঘিরে সংস্কার হয়ত স্বাস্থ্যকর নয়, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে উদোম-শরীর মানেই সংস্কারমুক্তি। যে শরীরী সম্পর্ককে ঘিরে ‘আবহমান’ কাল ধরে বিবর্তিত হয়েছে মানুষ-মানুষীর সম্পর্ক, প্রবাহিত ও প্রভাবিত হয়েছে সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্রোতস্বিনী তা নিয়ে শিল্প- সৃষ্টি বড় একটা সহজ কাজ নয়। অথচ এই দুরূহতম কাজটিই ঋতুপর্ণ করতে চেয়েছেন অবলীলায়, ‘খেলা’চ্ছলে। ঋতুপর্ণ কী নিয়ে সিনেমা করেন সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যেতে পারে দ্বিধাহীন দুটি মাত্র শব্দে - নারী এবং যৌনতা। এতে তাঁর একান্ত অনুরাগী কেউও আপত্তি করবেন বলে মনে হয় না।
আসলে ঋতুপর্ণের ক্যামেরা যে গল্প বলে তার কেন্দ্রে থাকে নারী, আরো সঠিক ভাবে যদি বলি তাহলে বলতে হয় নারীর যৌন-কামনা (sexual desire) -ই তাঁর ফিল্মের বিষয়বস্তু। আর যে গল্প তিনি বলেন তার সারাৎসার তো এই যে, নারী মাত্রই পিতৃতন্ত্রের দ্বারা পিষ্ট, আর পরিচালক সে নারীদের মুক্ত ও স্বাধীন বিচরণের জন্য একটা ‘স্পেস’ (space) তৈরি করে দিতে চান (যদিও সেই ‘স্পেস’টা যে কী, তার স্বরূপ সম্পর্কে সামান্য ধারণা তিনি দিতে চেষ্টা করেন না কখনোই, প্রয়োজনও বোধ করেন না ), আর সে জন্যই তিনি যৌন-স্বাধীনতার দাবি তোলেন এবং সেই সূত্রে ও অবকাশে যৌনতার অভিষেক ঘটান। বলা বাহুল্য, ভারতীয় বাণিজ্যিক ফিল্মে নারীর যে আদল প্রতিষ্ঠিত সে আদল ভাঙতে চেয়ে তিনি ‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বঁধু...’ সম্বোধনে আপ্লুত হলেন বটে, কিন্তু বিকল্প সম্বোধনের অবর্তমানে নাম-গোত্র-হীন এই নব্য নারীদের যৌন-বাজারে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। খোলা বাজারে খোলা শরীর নিয়ে খোলামেলা বিচরণের (?স্বাধীন) ‘স্পেস’ তৈরি করে দিলেন। ‘খুলে দে মা লুটে পুটে খাই’ নীতির পরিপূরক ‘শিল্প’ প্রয়াস। তথাকথিত ভদ্র-শিক্ষিত-মার্জিত-রুচিবান-আধুনিক (নাকি উত্তর-আধুনিক!) বাঙালি আহ্লাদে আটখানা হল। আর্ট সিনেমার(?) বোদ্ধা কিংবা শিল্পিত দর্শক সেজে হলিউডি যৌনতার সস্তা টলিউডি-সংস্করণের আস্বাদে মাতোয়ারা হল - ‘সাবানের সঙ্গে শেভিং ক্রীম ফ্রী’ পাওয়ার আনন্দে। মন্দ নয় অবশ্যই।
কাজটা ঋতুপর্ণ করেছেন চরম চাতুর্যের সাথে। বাঙালি দর্শক সে অর্থে ততটা সাহসী নয়, আধুনিক সাজ পরিধানের পশাপাশি ঐতিহ্যের পিছুটানও তার কম নয়। আসলে আমাদের আধুনিকতার গোড়াতেই রয়ে গেছে গলদ। আমাদের আধুনিকতার ধার-করা-ধারণাটির জন্ম পুঁজিবাদের ঔরসে সামন্তবাদের গর্ভে। ঋতুপর্ণ তা বিলক্ষণ জানতেন, তাই স্লো ডোজ দিয়ে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হয়েছে তাঁকে – উনিশে এপ্রিল, দহন, অসুখ, তিতলি-র মত ফিল্ম দিয়ে শুরু করে। পরবর্তী পর্যায়ের ঋতুময়তায় পৌছনোর আগে ‘অ্যাসিড টেস্ট’ সেরে নিতে হয়েছে ‘চোখের বালি’ নামিয়ে, বাঙালি দর্শকের চোখ কতটা কচকচ করে অথবা আদৌ করে কি না তার আন্দাজ পেতে। তবে রিস্ক নেন না মোটেই, ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন রবীন্দ্রনাথকে, আবার বাজার মাত করতে ব্যবহার করেন ঐশ্বর্য রাই-এর শরীরী আবেদনকে। আর খাপ খাইয়ে নিতে ‘নয়া উদারনীতি’ অনুসরণে ফিল্মের পরিণতিকে উপন্যাসের পরিণতি থেকে পৃথক করতেও পিছপা হন না (এই যুক্তিতে যে, উপন্যাসের পরিণতি নিয়ে রবিঠাকুর পরবর্তীতে তাঁর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। তা হয়ত করেছিলেন, কিন্তু সংশোধন করেন নি, সে দায়িত্বও বোধহয় কাউকে দিয়ে যান নি)। সে যা হোক, এ অবধি দর্শকের মেনে নিতে অসুবিধে হয়নি তেমন। একটা নয়নসুখকর মোড়কে নারীমুক্তির বিজ্ঞাপন সহকারে যৌনতাকে বাজারজাত করার ক্ষেত্রে এ পর্যায়ে মোটামুটি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তিনি। বাণিজ্যিকরণের জরুরি অনুষঙ্গ হিসেবে সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছেন ‘আনন্দলোক’ মার্কা গসিপ ম্যাগাজিনের, মগজ ধোলাইয়ের পন্থা হিসেবে ‘কলাম লিখিয়ে’ সেজেছেন, প্রচারমাধ্যমকে ব্যবহার করতে ও প্রচারের আলোয় থাকতে টিভি চ্যানেলের অ্যাঙ্কর নিয়োজিত করেছেন নিজেকে – এসব কিছুর মধ্যে যোগসূত্র তো এই যে, এগুলো সবই বাজারের সংজ্ঞায় ‘প্রোমোশন্যাল অ্যাক্টিভিটি’ মাত্র। প্যাকেজিং-এর মতই প্রয়োজনীয় ভীষণ। এই দারুণ ‘প্যাকেজিং’এর জন্যই দর্শকের বাহবা যেমন পেয়েছেন, প্রচার মাধ্যমের পিঠ চাপড়ানোও উপভোগ করেছেন। বলিউড স্টারদের নেকনজরে থেকেছেন। আর সেটাই কাল হয়েছে, ক্রমশ ‘দুঃসাহসী’ হয়ে উঠেছেন তার পর থেকে।
বাজার দখল করে ফেলার পর বিজ্ঞাপন একটা নিয়মমাফিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ঋতুপর্ণের বেলায়ও তাই ঘটেছে। নারীমুক্তির মহানাগরিক বৌদ্ধিক আচ্ছাদন আস্তে আস্তে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, ঘোমটা খসে পড়ার পর জমে ওঠে যৌনতার ভরপুর আসর, ‘অন্তরমহল’-এ বাঙালি দর্শকদের একাংশ মেতেছেন সে ‘উৎসব’-এ। সমালোচনাও করেছেন অবশ্য কেউ কেউ। সেখান থেকে ‘চিত্রাঙ্গদা’ পর্যন্ত একই চিত্র, একই পরিভ্রমণ। বিষয় কেবল যৌনতা, যৌনতাই কেবল । বিষয় হিসেবে ‘বিষ’ নয় হয়ত, কিন্তু যৌনতা ‘অবসেশন’-এ পরিণত হয়ে পড়ায় পরিবেশটা বিষাক্ত হয়ে যায়। যৌনতা প্রদর্শনের জন্য নারীচরিত্রের প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে এল এরপর। স্বাভাবিক যৌনতার পরিবর্তে এবার হাজির করলেন অস্বাভাবিক যৌনতা। বিষয় হিসেবে উঠে এল সমকামীতা। হবে না-ই বা কেন, বারাক ওবামা পর্যন্ত যখন ক্ষমতাবান আসনটি অক্ষত রাখতে সমলিঙ্গ-বিবাহের সমর্থনে প্রকাশ্যে বয়ানবাজি করছেন, দিল্লি হাইকোর্টের রায়ে এদেশেও যখন সমকামীতার অপরাধমুক্তি (decriminalization of homosexuality) ঘটছে (যদিও সমস্যাটি আইনি নয় মোটেই) সে সময় ঋতুপর্ণের মত তুখোড় পরিচালকেরা যে ‘যৌনগন্ধী রুমাল’ শুঁকিয়ে দর্শকদের বুঁদ করে ফেলার সুযোগ লুফে নেবেন সে আর আশ্চর্য কী!
এবারে দেখা যাক ঋতুপর্ণের নির্মাণে যৌনতার প্রকাশ কীভাবে ঘটেছে ও সিনেমাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে। ভারতীয় জাতিয়তাবাদী চিন্তাচর্চায় নারী-পুরুষ (female-male) বিভাজনের সামাজিক প্রতিরূপটি হচ্ছে ঘর-বাহির (home-world)-এর বিভাজন, আর সে বিভাজনে নারীর স্থান নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট হয়েছে গৃহকোণে, অন্দরমহলে। যৌনতার ভাল-মন্দও (good sex-bad sex) এসেছে সেই সূত্রে - বাণিজ্যিক সিনেমায় ‘হিরোইন-ভ্যাম্প’ মেরুকরণের মাধ্যমে যার প্রকাশ স্পষ্ট। বাণিজ্যিক ফিল্মের good sex হচ্ছে নায়িকা বা হিরোইনের সেই (যৌন)ধর্ম, যা বস্তুত পিতৃতন্ত্রের কাছে সমর্পণ ছাড়া কিছু নয়। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে যৌনতাকে ব্যবহার করতে গিয়ে ঋতুপর্ণ এই সরল সমীকরণটিকে উলটে দেন ও প্রোটাগোনিস্ট নারীচরিত্রকে জুড়ে দেন বাণিজ্যিক সিনেমার মন্দ-যৌনতার (bad sex) সাথে, যা আসলে কামনার (desire) প্রতীক এবং ভ্যাম্পদের বৈশিষ্ট। শুধু তাই নয়, কৌশলে দর্শকের সমর্থন আদায়ের জন্য এক নারী-দৃষ্টিকোণও আমদানী করেন কাহিনি-বিন্যাসে। নারী চরিত্রের সঙ্গে যৌনতার সংযুক্তি (association) ঋতুপর্ণের ফিল্মে এক আপাত বিদ্রোহের আবহ তৈরি করে মাত্র, যেহেতু পিতৃতন্ত্রের গণ্ডির মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকে। পিতৃতন্ত্রকে প্রত্যাহবান করে না কদাচ। বরং অন্তিমে পিতৃতন্ত্রের কাছেই সমর্পণ করে বহু ক্ষেত্রে। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতিরোধ (resist) করার প্রয়াস করে মাত্র এবং তার ভেতর দিয়ে আরেকটু বাড়তি স্পেসের জন্য দর কষাকষি (negotiate) করে কেবল। সেও ওই আরেকটু প্রশস্ত গৃহকোণের (domestic space) আকাঙ্ক্ষায়, ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখতেও বস্তুত অপারগ এই ‘বিদ্রোহী’ নারীচরিত্ররা। (‘ঘরে বাইরে’র বিমলাকে মনে পড়ে!)। বাণিজ্যিক সিনেমায় নারীর যে আদল (woman ideal) তার সঙ্গে যেমন বাস্তবের নারীর (real woman) মিল নেই, একই সরলীকরণের পথ বেয়ে উঠে আসা ঋতুপর্ণের নারীচরিত্রগুলোও সেরকম অবাস্তব। আর সে কারণেই মনে হয়, যৌনতার এই উপস্থাপনার মূলে শিল্পের দায় যত না বাণিজ্যিক প্রয়োজন তার চেয়ে অধিক। একারণেই চরিত্রকে ছাপিয়ে ওঠে যৌনতা, voyeurism-এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়।
স্মরণ করুন,‘চোখের বালি’-র সেই দৃশ্য যেখানে সাদা থান পরিহিত সালঙ্কারা বিনোদিনী হাজির হয়েছে বিহারীর দুয়ারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে (বিবাহ নামক পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ করে পিতৃতন্ত্রের ধারক ও বাহক পুরুষের কাছে শরীর সঁপে দিতে), পরিচালকের ব্যাখ্যায় অলঙ্কারগুলো অবদমিত কামনার প্রতীক, এর সঙ্গে মিলিয়ে নিন অনুরূপ সাজে পরিচালকের আত্ম-প্রদর্শনী। ‘রীল লাইফ’ তবে বদলে দিচ্ছে ‘রিয়াল’ লাইফকেও! নাকি লিঙ্গ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ঋতু নিজেই তাড়িত হচ্ছিলেন কোন ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’-এ! হয়ত তাই, হয়ত নয়, কিন্তু অবসেশনে যে ভুগছিলেন সে অবধারিত। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ কিংবা ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’এ অভিনয়ের সূত্রে কে জানে নিজের সঙ্গে নিজেই যুদ্ধে মেতেছিলেন কি না, কোন এক অন্তিম বোঝাপড়ার আশায়! একটা অস্থিরতা যে ছিল তা বহুক্ষেত্রে ফিল্মের ট্রিটমেন্ট লক্ষ্য করলেও বোঝা যায়। আর সে কারণেই বোধহয় মাঝখানে ‘রেনকোট’, ‘নৌকাডুবি’-র রিলিফ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। নতুবা ‘চোখের বালি’-র পর ‘নৌকাডুবি’তে প্রত্যাবর্তনের মানে হয় না। পরিচালক নিজেও তা স্বীকার করেছেন। অবশেষে ‘চিত্রাঙ্গদা’-পর্ব, তাঁর নির্মাণপর্বের(!) পূর্ণাহুতি, যৌন চিন্তনেরও। তা আত্মজৈবনিক কি না সে তর্ক অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক। ব্যক্তি ঋতুপর্ণের ‘নারীসুলভ’ আচরণ নিয়ে কানাঘুষো ছিল, এবারে শুরু হল সচেতন ভাবে নিজেকে পূর্ণ(?) নারী করে তোলার বিবিধ আয়োজন –সাজসজ্জা থেকে সালঙ্কারা বিচরণ, মায় ‘হরমোন থেরাপি’ পর্যন্ত। চিত্রাঙ্গদা রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী, তাই যোদ্ধা যু্বকের সাজে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল তাঁকে, আর ফিল্মে সব রকম যৌনতার সপক্ষে বৌদ্ধিক ও শৈল্পিক যুক্তি হাজির করতে ঋতুপর্ণকে ভিন্নবেশ ভিন্নসাজ ধারণ করতে হয়েছে। ক্ষমতার স্বার্থে চিত্রাঙ্গদাকে পুরুষোচিত করে তোলার প্রয়াস, আর শিল্পের বাণিজ্যিকরণের স্বার্থে ঋতুপর্ণ নিজেই বাজারে এসে দাঁড়ান শরীর ‘সম্বল’ করে। পরিণতি? ট্র্যাজিক তো বটেই, স্রষ্টা এবং সৃষ্টি দুয়ের ক্ষেত্রেই।
সিনেমা শেষ পর্যন্ত technical art , কিন্তু তার মানে এই নয় যে একজন দক্ষ technician আর স্রষ্টার মধ্যে পার্থক্য নেই। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, পর্যবেক্ষণক্ষমতা, চিত্রনাট্য রচনা থেকে শুরু করে গল্প বলা সহ ফিল্মের যাবতীয় শৈলী আয়ত্তাধীন থাকা সত্বেও ঋতুপর্ণ শেষ পর্যন্ত ‘কারিগর’ ও ‘শিল্পী’-র মধ্যবর্তী আলপথ ধরেই বরাবর হেঁটে গেলেন, অন্য কোন কৌণিকতায় পা বাড়াবার সযত্ন প্রয়াস করলেন না। এক সময় মার্গো সাবানের বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিলেন ঋতুঃ ‘দেখতে খারাপ, মাখতে ভালো’। বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রেও ঋতুপর্ণ তার চেয়ে বেশিদূর এগোতে পারলেন না। সাধ্য ছিল না এমন নয়, সে সাধ তাঁর ছিল না। ‘He had blurred the distinction between commercial and art cinema’ - ঋতুপর্ণের বহু গুণগ্রাহী এমন প্রশংসাবাণী বিলিয়েছেন বিভিন্ন সময়। এতে আমরা দ্বিমত পোষন করি না মোটেই, হালের বাজারকেন্দ্রিক মূল্যায়নের এটাই রীতি। তবে মুড়ি-মুড়কির এক দর সাব্যস্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় কি না তা অবশ্যই বিবেচ্য। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির পরিবর্তে সাহিত্য কিংবা ইতিহাস নিয়ে পড়লে সিনেমা পরিচালক হিসেবে লাভবান হতেন বেশি - এরকম কথা বলেছিলেন একটি সাক্ষাৎকারে। অর্থনীতি নিয়ে পড়লেও নয়ের দশকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংস্কার-জনিত সামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণে অসমর্থ হয়েছেন তিনি। একটি পরিবর্তনশীল সময়ে শিল্পীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে সংশয় ছিল হয়ত, আক্রান্ত সময়ে প্রতিরোধের যথার্থ পথ খুঁজে পাননি। তাই চিন্তা ও মননের দৈন্য এবং যাপনের আত্মঘাতী রীতি ও প্রবণতা তাঁর শারীরিক মৃত্যুকেই কেবল ত্বরান্বিত করেনি, যাবতীয় শিল্প-সম্ভাবনারও করুণ পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ‘সতর্কীকরণের চিহ্ন’ হিসেবেই নিশ্চয় সনাক্ত হবে।
প্রশ্নটা পাঠকের দরবারে আপাতত পেশ করা গেল শুধু। পরবর্তী অংশে এর উত্তর মিলবে তেমন দুরাশা, শ্রদ্ধেয় পাঠক, না করাই সমীচীন। কেননা, এ নিবন্ধকার আদৌ সমালোচক কিংবা শিল্পবোদ্ধা নন এবং এ নিবন্ধের উদ্দেশ্যও তা নয়। এর উত্তর কেবল দিতে পারে ভবিষ্যৎ , দেবেও হয়ত। আমরা বরং বাংলা চলচ্চিত্রে খুব দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা এই সদ্য প্রয়াত পরিচালকের চলচ্চিত্র-পরিক্রমার প্রেক্ষিতটি অনুধাবনে প্রয়াসী হব। তাঁর নির্মাণের নেপথ্যের চাবিকাঠিটি ঠিক কী ছিল যার দৌলতে এমন ঈর্ষণীয় গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা হাসিল করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি! এখানে একটা বিষয় স্মরণ রাখা ভালো যে, সিনেমা নির্মাণের যে কলাকৌশল (technicalities) সেটা ঋতুপর্ণ আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন কম বয়সেই, পিতার কর্মসূত্রেই। যে কারণে অনায়াসে বলেছেনও যে সিনেমা বানানোটা তেমন কিছু কঠিন বলে মনে হত না তাঁর। (জানিনা, ‘সিনেমা বানানো’ নিয়ে এরকম ভাবনার সময় ‘শোলে’ আর ‘পথের পাঁচালী’র মৌলিক প্রভেদ বিষয়ে তিনি কতটা সচেতন ছিলেন! সাতবার ‘শোলে’ আর পাঁচবার ‘পথের পাঁচালী’ দেখার মধ্যে একটা ফারাক তো নিশ্চয়ই রয়েছে)। সে যা হোক, নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিচালক হিসেবে, অন্তত বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে তিনি যে প্রায় একশ’ শতাংশ পেশাদারিত্বের দাবি করতে পারেন সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ মাত্র নেই। এই পেশাদারিত্ব (professionalism) বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে নেহাৎ আনকোরা, এবং ঋতুপর্ণের দ্বারাই আমদানীকৃত সে বিষয়ে সন্দেহ মাত্র নেই। এর যতটা সুফল কুড়নো সম্ভব টলিউড তা কুড়িয়েছেও। ঋতুপর্ণের আবির্ভাব তাই টলিউড ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রীর কাছে ছিল সত্যি সত্যিই এক ‘শুভ মহরৎ’। তবে বাংলা সিনেমায় ঋতুপর্ণীয় ঋতুবদল নিয়ে কিছু চিন্তা-ভাবনা জরুরি বলেই মনে হয় আমাদের। এ লেখার কৈফিয়ত কেবল এটুকুই।
ঋতু-র প্রথম ফিল্ম হীরের আংটি’ (১৯৯২), দ্বিতীয় ফিল্ম ‘উনিশে এপ্রিল’ (১৯৯৪) এবং দারুণ ‘হিট’। সময়টা লক্ষ্য করুন, উত্তমকুমারের প্রয়াণ ঘটে গেছে, সত্যজিত-ঋত্বিক লিগ্যাসি ফিকে হয়ে আসছে,–সবকিছু মিলিয়ে আশির দশককে বাংলা সিনেমার খরার দশক বলা যায় অনায়াসে। ‘শ্বশুর বাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’দের দাপটে বাংলা ফিল্মের ঘর-বার জেরবার, নাভিশ্বাস উঠছে। অন্যদিকে, নব্বুইয়ের দশক থেকেই আমরা বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রেও এক পট পরিবর্তনের সাক্ষী। গ্লোবেলাইজেশন-এর তোড়ে পালটে যাচ্ছে ধ্যান-ধারণা, জীবনযাপনের ধরন- ধারণ, আধুনিকতার বাণের তোড়ে যৌথ-পরিবার ভেঙেছে আগেই, এবারে নয়া-সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও পরিকল্পনা পরিবারকেও টুকরো করে ফেলতে উদ্যোগী হয়ে ভোগবাদী দর্শনের পাশাপাশি নিয়ে এল এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ। বলা বাহুল্য, চলচ্চিত্রে তার করাল ছায়া অনিবার্য ছিল। পুঁজিবাদ যে নাগরিক শ্রেণীর জন্ম দিয়েছিল তার বিনোদনের প্রয়োজন মেটানোর স্বার্থে ও তাগিদেই মুখ্যত উদ্ভব হয়েছিল প্রযুক্তি নির্ভর সিনেমার। নয়া ‘উদারনীতি’ পুরনো মূল্যবোধকে হটিয়ে দিতে নিয়ে এল আত্মভুক এক ভোগবাদ -‘খাও-পিয়ো-মৌজ মানাও’। মতাদর্শের প্রশ্ন-টশ্ন হাসির খোরাক হয়ে পড়ল উত্তর-আধুনিক ডামাডোলে। পালে হাওয়া যোগালো হরেক প্রচার মাধ্যম। সিনেমা সে প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা নেবে তা নিতান্ত স্বাভাবিক। আর এই তত্ত্ব চালান করার উপযুক্ত কাউকে দরকার হয়ে পড়েছিল টলিউডেরও। ঋতুপর্ণের আবির্ভাব সেই মাহেন্দ্র ক্ষণে, বিজ্ঞাপনের জন্য ভিস্যুয়াল নির্মাণের অভিজ্ঞতার পুঁজি নিয়ে। সামান্য প্রারম্ভিক সতর্কতা অবলম্বন ব্যতীত বিশেষ বেগ পেতে হয়নি তাঁকে। মাঠ ফাঁকা ছিল, গোলটা করা গেল সহজেই। উনিশে এপ্রিল, দহন, অসুখ, বাড়িওয়ালি’র মত ফিল্মগুলি সেই সতর্ক নির্মাণের সাক্ষী। পরিচালক মাপজোখ- করা হালকা ঝুঁকি নিয়েই উপোষী দর্শকের হাততালি কুড়িয়ে নিলেন। বিষয় কিংবা গল্প বলার অভিনবত্বে ততটা নয়, যতটা ‘চাহিদা পূরণের সুপরিকল্পিত আয়োজনে, কারিগরি দক্ষতায়’। ন্যাকা-ন্যাকা সংলাপ ও দৃশ্যের বদলে ফিল্মে এল স্মার্ট কথাবার্তা, ভিস্যুয়াল ইত্যাদি। জায়গাটা পাকা হল, জাতীয় পুরস্কার আর আন্তর্জাতিক উৎসবের ছোঁয়ায় একলাফে ‘সেলিব্রিটি’, ক্যারিয়ার গ্রাফ তারপর নিম্নগামী হয়নি আর।
তবে কি তিনি গল্প বলার ধরণে কোন নতুনত্ব আমদানি করেছিলেন ? না, বরং বাঙালি দর্শক ফিল্মের যে ন্যারেটিভে চিরকাল অভ্যস্ত ঋতুপর্ণ তা থেকে এক পা-ও সরে আসেন নি, বরং সচেতন ও সতর্ক ভাবে সেই অভ্যস্ত ন্যারেটিভের উপর নির্ভরশীল থেকেছেন। বিষয়বস্তুতেও তো নূতনত্ব দেখিনা সে অর্থে, তাহলে! হ্যাঁ, একটা নতুনত্ব অবশ্যই আমদানি করেছেন ঋতুপর্ণ, আর তা হল যৌনতা। বাংলা সিনেমায় যৌনতার এই অভিষেক এক কথায় অভূতপূর্ব। যৌনতা ‘শিল্পের বিষয় হতে পারে না বা হওয়া উচিত নয়’- মার্কা ছুঁৎমার্গিতা আমাদের অবশ্যই নেই। যৌন- জীবন জীবনেরই অংশ, কাজেই তা শিল্পসাহিত্যের বিষয় হতেই পারে, হওয়া দরকারও। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও স্মরণ থাকা প্রয়োজন যে শরীরী সঙ্গম অথবা সংঘর্ষই জীবনের সার কথা নয়, শেষকথা নয়। শরীর ঘিরে সংস্কার হয়ত স্বাস্থ্যকর নয়, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে উদোম-শরীর মানেই সংস্কারমুক্তি। যে শরীরী সম্পর্ককে ঘিরে ‘আবহমান’ কাল ধরে বিবর্তিত হয়েছে মানুষ-মানুষীর সম্পর্ক, প্রবাহিত ও প্রভাবিত হয়েছে সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্রোতস্বিনী তা নিয়ে শিল্প- সৃষ্টি বড় একটা সহজ কাজ নয়। অথচ এই দুরূহতম কাজটিই ঋতুপর্ণ করতে চেয়েছেন অবলীলায়, ‘খেলা’চ্ছলে। ঋতুপর্ণ কী নিয়ে সিনেমা করেন সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যেতে পারে দ্বিধাহীন দুটি মাত্র শব্দে - নারী এবং যৌনতা। এতে তাঁর একান্ত অনুরাগী কেউও আপত্তি করবেন বলে মনে হয় না।
আসলে ঋতুপর্ণের ক্যামেরা যে গল্প বলে তার কেন্দ্রে থাকে নারী, আরো সঠিক ভাবে যদি বলি তাহলে বলতে হয় নারীর যৌন-কামনা (sexual desire) -ই তাঁর ফিল্মের বিষয়বস্তু। আর যে গল্প তিনি বলেন তার সারাৎসার তো এই যে, নারী মাত্রই পিতৃতন্ত্রের দ্বারা পিষ্ট, আর পরিচালক সে নারীদের মুক্ত ও স্বাধীন বিচরণের জন্য একটা ‘স্পেস’ (space) তৈরি করে দিতে চান (যদিও সেই ‘স্পেস’টা যে কী, তার স্বরূপ সম্পর্কে সামান্য ধারণা তিনি দিতে চেষ্টা করেন না কখনোই, প্রয়োজনও বোধ করেন না ), আর সে জন্যই তিনি যৌন-স্বাধীনতার দাবি তোলেন এবং সেই সূত্রে ও অবকাশে যৌনতার অভিষেক ঘটান। বলা বাহুল্য, ভারতীয় বাণিজ্যিক ফিল্মে নারীর যে আদল প্রতিষ্ঠিত সে আদল ভাঙতে চেয়ে তিনি ‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বঁধু...’ সম্বোধনে আপ্লুত হলেন বটে, কিন্তু বিকল্প সম্বোধনের অবর্তমানে নাম-গোত্র-হীন এই নব্য নারীদের যৌন-বাজারে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। খোলা বাজারে খোলা শরীর নিয়ে খোলামেলা বিচরণের (?স্বাধীন) ‘স্পেস’ তৈরি করে দিলেন। ‘খুলে দে মা লুটে পুটে খাই’ নীতির পরিপূরক ‘শিল্প’ প্রয়াস। তথাকথিত ভদ্র-শিক্ষিত-মার্জিত-রুচিবান-আধুনিক (নাকি উত্তর-আধুনিক!) বাঙালি আহ্লাদে আটখানা হল। আর্ট সিনেমার(?) বোদ্ধা কিংবা শিল্পিত দর্শক সেজে হলিউডি যৌনতার সস্তা টলিউডি-সংস্করণের আস্বাদে মাতোয়ারা হল - ‘সাবানের সঙ্গে শেভিং ক্রীম ফ্রী’ পাওয়ার আনন্দে। মন্দ নয় অবশ্যই।
কাজটা ঋতুপর্ণ করেছেন চরম চাতুর্যের সাথে। বাঙালি দর্শক সে অর্থে ততটা সাহসী নয়, আধুনিক সাজ পরিধানের পশাপাশি ঐতিহ্যের পিছুটানও তার কম নয়। আসলে আমাদের আধুনিকতার গোড়াতেই রয়ে গেছে গলদ। আমাদের আধুনিকতার ধার-করা-ধারণাটির জন্ম পুঁজিবাদের ঔরসে সামন্তবাদের গর্ভে। ঋতুপর্ণ তা বিলক্ষণ জানতেন, তাই স্লো ডোজ দিয়ে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হয়েছে তাঁকে – উনিশে এপ্রিল, দহন, অসুখ, তিতলি-র মত ফিল্ম দিয়ে শুরু করে। পরবর্তী পর্যায়ের ঋতুময়তায় পৌছনোর আগে ‘অ্যাসিড টেস্ট’ সেরে নিতে হয়েছে ‘চোখের বালি’ নামিয়ে, বাঙালি দর্শকের চোখ কতটা কচকচ করে অথবা আদৌ করে কি না তার আন্দাজ পেতে। তবে রিস্ক নেন না মোটেই, ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন রবীন্দ্রনাথকে, আবার বাজার মাত করতে ব্যবহার করেন ঐশ্বর্য রাই-এর শরীরী আবেদনকে। আর খাপ খাইয়ে নিতে ‘নয়া উদারনীতি’ অনুসরণে ফিল্মের পরিণতিকে উপন্যাসের পরিণতি থেকে পৃথক করতেও পিছপা হন না (এই যুক্তিতে যে, উপন্যাসের পরিণতি নিয়ে রবিঠাকুর পরবর্তীতে তাঁর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। তা হয়ত করেছিলেন, কিন্তু সংশোধন করেন নি, সে দায়িত্বও বোধহয় কাউকে দিয়ে যান নি)। সে যা হোক, এ অবধি দর্শকের মেনে নিতে অসুবিধে হয়নি তেমন। একটা নয়নসুখকর মোড়কে নারীমুক্তির বিজ্ঞাপন সহকারে যৌনতাকে বাজারজাত করার ক্ষেত্রে এ পর্যায়ে মোটামুটি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তিনি। বাণিজ্যিকরণের জরুরি অনুষঙ্গ হিসেবে সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছেন ‘আনন্দলোক’ মার্কা গসিপ ম্যাগাজিনের, মগজ ধোলাইয়ের পন্থা হিসেবে ‘কলাম লিখিয়ে’ সেজেছেন, প্রচারমাধ্যমকে ব্যবহার করতে ও প্রচারের আলোয় থাকতে টিভি চ্যানেলের অ্যাঙ্কর নিয়োজিত করেছেন নিজেকে – এসব কিছুর মধ্যে যোগসূত্র তো এই যে, এগুলো সবই বাজারের সংজ্ঞায় ‘প্রোমোশন্যাল অ্যাক্টিভিটি’ মাত্র। প্যাকেজিং-এর মতই প্রয়োজনীয় ভীষণ। এই দারুণ ‘প্যাকেজিং’এর জন্যই দর্শকের বাহবা যেমন পেয়েছেন, প্রচার মাধ্যমের পিঠ চাপড়ানোও উপভোগ করেছেন। বলিউড স্টারদের নেকনজরে থেকেছেন। আর সেটাই কাল হয়েছে, ক্রমশ ‘দুঃসাহসী’ হয়ে উঠেছেন তার পর থেকে।
বাজার দখল করে ফেলার পর বিজ্ঞাপন একটা নিয়মমাফিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ঋতুপর্ণের বেলায়ও তাই ঘটেছে। নারীমুক্তির মহানাগরিক বৌদ্ধিক আচ্ছাদন আস্তে আস্তে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, ঘোমটা খসে পড়ার পর জমে ওঠে যৌনতার ভরপুর আসর, ‘অন্তরমহল’-এ বাঙালি দর্শকদের একাংশ মেতেছেন সে ‘উৎসব’-এ। সমালোচনাও করেছেন অবশ্য কেউ কেউ। সেখান থেকে ‘চিত্রাঙ্গদা’ পর্যন্ত একই চিত্র, একই পরিভ্রমণ। বিষয় কেবল যৌনতা, যৌনতাই কেবল । বিষয় হিসেবে ‘বিষ’ নয় হয়ত, কিন্তু যৌনতা ‘অবসেশন’-এ পরিণত হয়ে পড়ায় পরিবেশটা বিষাক্ত হয়ে যায়। যৌনতা প্রদর্শনের জন্য নারীচরিত্রের প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে এল এরপর। স্বাভাবিক যৌনতার পরিবর্তে এবার হাজির করলেন অস্বাভাবিক যৌনতা। বিষয় হিসেবে উঠে এল সমকামীতা। হবে না-ই বা কেন, বারাক ওবামা পর্যন্ত যখন ক্ষমতাবান আসনটি অক্ষত রাখতে সমলিঙ্গ-বিবাহের সমর্থনে প্রকাশ্যে বয়ানবাজি করছেন, দিল্লি হাইকোর্টের রায়ে এদেশেও যখন সমকামীতার অপরাধমুক্তি (decriminalization of homosexuality) ঘটছে (যদিও সমস্যাটি আইনি নয় মোটেই) সে সময় ঋতুপর্ণের মত তুখোড় পরিচালকেরা যে ‘যৌনগন্ধী রুমাল’ শুঁকিয়ে দর্শকদের বুঁদ করে ফেলার সুযোগ লুফে নেবেন সে আর আশ্চর্য কী!
এবারে দেখা যাক ঋতুপর্ণের নির্মাণে যৌনতার প্রকাশ কীভাবে ঘটেছে ও সিনেমাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে। ভারতীয় জাতিয়তাবাদী চিন্তাচর্চায় নারী-পুরুষ (female-male) বিভাজনের সামাজিক প্রতিরূপটি হচ্ছে ঘর-বাহির (home-world)-এর বিভাজন, আর সে বিভাজনে নারীর স্থান নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট হয়েছে গৃহকোণে, অন্দরমহলে। যৌনতার ভাল-মন্দও (good sex-bad sex) এসেছে সেই সূত্রে - বাণিজ্যিক সিনেমায় ‘হিরোইন-ভ্যাম্প’ মেরুকরণের মাধ্যমে যার প্রকাশ স্পষ্ট। বাণিজ্যিক ফিল্মের good sex হচ্ছে নায়িকা বা হিরোইনের সেই (যৌন)ধর্ম, যা বস্তুত পিতৃতন্ত্রের কাছে সমর্পণ ছাড়া কিছু নয়। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে যৌনতাকে ব্যবহার করতে গিয়ে ঋতুপর্ণ এই সরল সমীকরণটিকে উলটে দেন ও প্রোটাগোনিস্ট নারীচরিত্রকে জুড়ে দেন বাণিজ্যিক সিনেমার মন্দ-যৌনতার (bad sex) সাথে, যা আসলে কামনার (desire) প্রতীক এবং ভ্যাম্পদের বৈশিষ্ট। শুধু তাই নয়, কৌশলে দর্শকের সমর্থন আদায়ের জন্য এক নারী-দৃষ্টিকোণও আমদানী করেন কাহিনি-বিন্যাসে। নারী চরিত্রের সঙ্গে যৌনতার সংযুক্তি (association) ঋতুপর্ণের ফিল্মে এক আপাত বিদ্রোহের আবহ তৈরি করে মাত্র, যেহেতু পিতৃতন্ত্রের গণ্ডির মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকে। পিতৃতন্ত্রকে প্রত্যাহবান করে না কদাচ। বরং অন্তিমে পিতৃতন্ত্রের কাছেই সমর্পণ করে বহু ক্ষেত্রে। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতিরোধ (resist) করার প্রয়াস করে মাত্র এবং তার ভেতর দিয়ে আরেকটু বাড়তি স্পেসের জন্য দর কষাকষি (negotiate) করে কেবল। সেও ওই আরেকটু প্রশস্ত গৃহকোণের (domestic space) আকাঙ্ক্ষায়, ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখতেও বস্তুত অপারগ এই ‘বিদ্রোহী’ নারীচরিত্ররা। (‘ঘরে বাইরে’র বিমলাকে মনে পড়ে!)। বাণিজ্যিক সিনেমায় নারীর যে আদল (woman ideal) তার সঙ্গে যেমন বাস্তবের নারীর (real woman) মিল নেই, একই সরলীকরণের পথ বেয়ে উঠে আসা ঋতুপর্ণের নারীচরিত্রগুলোও সেরকম অবাস্তব। আর সে কারণেই মনে হয়, যৌনতার এই উপস্থাপনার মূলে শিল্পের দায় যত না বাণিজ্যিক প্রয়োজন তার চেয়ে অধিক। একারণেই চরিত্রকে ছাপিয়ে ওঠে যৌনতা, voyeurism-এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়।
স্মরণ করুন,‘চোখের বালি’-র সেই দৃশ্য যেখানে সাদা থান পরিহিত সালঙ্কারা বিনোদিনী হাজির হয়েছে বিহারীর দুয়ারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে (বিবাহ নামক পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ করে পিতৃতন্ত্রের ধারক ও বাহক পুরুষের কাছে শরীর সঁপে দিতে), পরিচালকের ব্যাখ্যায় অলঙ্কারগুলো অবদমিত কামনার প্রতীক, এর সঙ্গে মিলিয়ে নিন অনুরূপ সাজে পরিচালকের আত্ম-প্রদর্শনী। ‘রীল লাইফ’ তবে বদলে দিচ্ছে ‘রিয়াল’ লাইফকেও! নাকি লিঙ্গ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ঋতু নিজেই তাড়িত হচ্ছিলেন কোন ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’-এ! হয়ত তাই, হয়ত নয়, কিন্তু অবসেশনে যে ভুগছিলেন সে অবধারিত। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ কিংবা ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’এ অভিনয়ের সূত্রে কে জানে নিজের সঙ্গে নিজেই যুদ্ধে মেতেছিলেন কি না, কোন এক অন্তিম বোঝাপড়ার আশায়! একটা অস্থিরতা যে ছিল তা বহুক্ষেত্রে ফিল্মের ট্রিটমেন্ট লক্ষ্য করলেও বোঝা যায়। আর সে কারণেই বোধহয় মাঝখানে ‘রেনকোট’, ‘নৌকাডুবি’-র রিলিফ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। নতুবা ‘চোখের বালি’-র পর ‘নৌকাডুবি’তে প্রত্যাবর্তনের মানে হয় না। পরিচালক নিজেও তা স্বীকার করেছেন। অবশেষে ‘চিত্রাঙ্গদা’-পর্ব, তাঁর নির্মাণপর্বের(!) পূর্ণাহুতি, যৌন চিন্তনেরও। তা আত্মজৈবনিক কি না সে তর্ক অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক। ব্যক্তি ঋতুপর্ণের ‘নারীসুলভ’ আচরণ নিয়ে কানাঘুষো ছিল, এবারে শুরু হল সচেতন ভাবে নিজেকে পূর্ণ(?) নারী করে তোলার বিবিধ আয়োজন –সাজসজ্জা থেকে সালঙ্কারা বিচরণ, মায় ‘হরমোন থেরাপি’ পর্যন্ত। চিত্রাঙ্গদা রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী, তাই যোদ্ধা যু্বকের সাজে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল তাঁকে, আর ফিল্মে সব রকম যৌনতার সপক্ষে বৌদ্ধিক ও শৈল্পিক যুক্তি হাজির করতে ঋতুপর্ণকে ভিন্নবেশ ভিন্নসাজ ধারণ করতে হয়েছে। ক্ষমতার স্বার্থে চিত্রাঙ্গদাকে পুরুষোচিত করে তোলার প্রয়াস, আর শিল্পের বাণিজ্যিকরণের স্বার্থে ঋতুপর্ণ নিজেই বাজারে এসে দাঁড়ান শরীর ‘সম্বল’ করে। পরিণতি? ট্র্যাজিক তো বটেই, স্রষ্টা এবং সৃষ্টি দুয়ের ক্ষেত্রেই।
সিনেমা শেষ পর্যন্ত technical art , কিন্তু তার মানে এই নয় যে একজন দক্ষ technician আর স্রষ্টার মধ্যে পার্থক্য নেই। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, পর্যবেক্ষণক্ষমতা, চিত্রনাট্য রচনা থেকে শুরু করে গল্প বলা সহ ফিল্মের যাবতীয় শৈলী আয়ত্তাধীন থাকা সত্বেও ঋতুপর্ণ শেষ পর্যন্ত ‘কারিগর’ ও ‘শিল্পী’-র মধ্যবর্তী আলপথ ধরেই বরাবর হেঁটে গেলেন, অন্য কোন কৌণিকতায় পা বাড়াবার সযত্ন প্রয়াস করলেন না। এক সময় মার্গো সাবানের বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিলেন ঋতুঃ ‘দেখতে খারাপ, মাখতে ভালো’। বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রেও ঋতুপর্ণ তার চেয়ে বেশিদূর এগোতে পারলেন না। সাধ্য ছিল না এমন নয়, সে সাধ তাঁর ছিল না। ‘He had blurred the distinction between commercial and art cinema’ - ঋতুপর্ণের বহু গুণগ্রাহী এমন প্রশংসাবাণী বিলিয়েছেন বিভিন্ন সময়। এতে আমরা দ্বিমত পোষন করি না মোটেই, হালের বাজারকেন্দ্রিক মূল্যায়নের এটাই রীতি। তবে মুড়ি-মুড়কির এক দর সাব্যস্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় কি না তা অবশ্যই বিবেচ্য। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির পরিবর্তে সাহিত্য কিংবা ইতিহাস নিয়ে পড়লে সিনেমা পরিচালক হিসেবে লাভবান হতেন বেশি - এরকম কথা বলেছিলেন একটি সাক্ষাৎকারে। অর্থনীতি নিয়ে পড়লেও নয়ের দশকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংস্কার-জনিত সামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণে অসমর্থ হয়েছেন তিনি। একটি পরিবর্তনশীল সময়ে শিল্পীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে সংশয় ছিল হয়ত, আক্রান্ত সময়ে প্রতিরোধের যথার্থ পথ খুঁজে পাননি। তাই চিন্তা ও মননের দৈন্য এবং যাপনের আত্মঘাতী রীতি ও প্রবণতা তাঁর শারীরিক মৃত্যুকেই কেবল ত্বরান্বিত করেনি, যাবতীয় শিল্প-সম্ভাবনারও করুণ পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ‘সতর্কীকরণের চিহ্ন’ হিসেবেই নিশ্চয় সনাক্ত হবে।
৩টি মন্তব্য:
একটাই প্রার্থনা - পরের বার কোন সমালোচনা লেখার আগে লেখকের সিনেমা সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ হউক! আর স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক যৌনতা নির্ধারণের সংজ্ঞাটা কি?
তুমিই যদি দূরে দূরে থাকো শোভন, তবে আর জ্ঞান লাভ হবে কী করে! কে আছে বলো, যে জ্ঞান দিতে পারে! :)
অসাধারণ লেখাটি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন