“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১২

দেশভাগ, ১৯৫০এর গণহত্যা এবং আমার মামার বাড়ির গল্প

এখনকার করিমগঞ্জ বাড়িতে শিব মন্দির এবং বিগ্রহ
দেশভাগ যাদের স্থানান্তরিত করেছিল আমরা অনেকেইতো তাদের উত্তরপ্রজন্ম। তাই, আমাকে যখন বলা হলো তেমন স্থানান্তরিত কাউকে নিয়ে লিখতে হবে, ভাবলাম কেনই বা আমার নিজের পরিবারকে নিয়েই নয়। কিন্তু দেশভাগের পরেওতো আমাদের স্থানান্তরণ ঘটেই চলেছে। ফলে আমিতো আর থাকিনা আমার পরিরারের সঙ্গে। একটা প্রশ্নমালা তৈরি করে পাঠিয়েছিলাম আমার বাবা এবং বড় মামার কাছে। ইচ্ছে ছিল পরিবারের নারী পক্ষদের থেকেও কিছু স্মৃতিকথা বের করে আনা। কিন্তু সে সম্ভব হয় নি। দুজনেই যদিও বা সমবয়সী ( আটাত্তর) প্রায় আমার বাবা শারীরিক ভাবে ইতিমধ্যে এতো দুর্বল যে নিজে থেকে বেশি কিছু লিখতে পারেন না, মামা কিছু নিজে লিখেছেন, বাকিটা শুনে শুনে লিখে দিয়েছে আমার মামাতুতো দাদা প্রবাল কান্তি সেন।সে নিজে করিমগঞ্জের ‘সেবা’ কাগজের সহসম্পাদক । যেভাবে পেয়েছি তাই মনে হলো অনেক।সাধুবাংলাতেই লিখেছেন। আমরা হুবহু বয়ানে তাই আগে তুলে দিই, পরে নিজের কথা লিখছি।
একটি সাক্ষাৎকারঃ 
    নামঃ গোপিকা রঞ্জন সেন।জন্ম তারিখঃ ১৬-০১-১৯৩৪। জন্মস্থানঃনিজ কুরুয়া, থানা ঃ বালাগঞ্জ, জিলাঃশ্রীহট্ট।পিতার নামঃ ৺হরমোহন সেন।পূর্ব পাকিস্তানে থাকা কালীন আপনার পেশাঃ ছাত্র। পূর্ব-পাকিস্তানে থাকা কালীন পিতা/মাতার পেশাঃ গৃহস্থি।দেশভাগের আগে ও পরে আপনার ধর্মঃ হিন্দু।পূর্বপাকিস্তানে আপনার ঠিকানাঃ ঐ। মাতার নাম ও তাঁর পৈত্রিক ঠিকানাঃ ৺নীরদা বালা সেন; গ্রামঃ কেয়ামপুর, সদর সিলেট। মামার নামঃ ৺অধর চন্দ্র দেব।ভারতে আপনার ঠিকানাঃ করিমগঞ্জ। ( ঘাট লাইন, রায়নগর )প্রথম ঠিকানাতে অতিবাহিত সময়ঃ অদ্যাবধি প্রথম ঠিকানাতে আছি। পূর্ব পাকিস্তানে ফেলে আসা সম্পত্তি (ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনও সম্পত্তি বা বস্তু থাকলে তার বিষয়েও লিখুন) ঃ বসত বাড়ী এবং ধানক্ষেতের জমি। ভারত সরকার কর্তৃক বণ্টিত সম্পদঃ X ।ভারতে আপনার আগমনের বিস্তৃত বৃত্তান্তঃ আলাদা ভাবে যুক্ত। আপনার সঙ্গে আর ক’জন বা ক’টি পরিবার যাত্রা শুরু করেঃ আমাদের পরিবার একক ভাবেই আসিয়াছি। পূর্বপাকিস্তানে থেকে যাওয়া আপনার কোনো আত্মীয়ের নাম ও ঠিকানাঃ মামাতুতো ভাইয়েরা বর্তমানে বাংলাদেশে তাদের নিজস্ব বাড়িতেই আছে, কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়া আপনার আত্মীয়দের দেশভাগ –পূর্ব অবস্থা (আর্থিক-সামাজিক)ঃ সম্পন্ন পরিবার। তাদের বর্তমান পরিস্থিতিঃ জানা নাই। আপনার পরিবারের কোনো সদস্য বা কোনো আত্মীয় কি দেশভাগের সময় বা যাত্রাকালে নিহত হয়েছিলেন? সেক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট বর্ণনা করুনঃ না। আপনার পরিচিত অন্য কেউ কি দেশভাগের সময় নিহত হয়েছিলেন? সেক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট বর্ণনা করুন।: না। আপনাদের সাথে কি কোনো সশস্ত্র প্রতিরক্ষা সহচর ছিল (মিলিটারি, পুলিশ বা অন্য কেউ) ? থাকলে নাম ও পদবীঃ না। ভারতে তৎকালীন প্রবেশ স্থলঃ সুতারকান্দি বর্ডার।
        দেশভাগের কথা জানার পর আপনার ব্যক্তিগত কী অনুভূতি হয়েছিল? ঃ দুঃখজনক। সামগ্রিকভাবে দেশভাগ সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী? দেশভাগ কি অনিবার্য ছিল?: দেশভাগ অনিবার্য্য ছিল না, দেশভাগের ফলে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পরিবার স্থায়ী বাড়িঘর ত্যাগ করিয়া নিঃস্ব ও উদবাস্তু হইয়াছে। অনেকে প্রাণ হারাইয়াছে। শত শত হিন্দু রমনীরা ধর্ষিতা হইয়াছে। আপনার মতে কি ভারত , পাকিস্তান, এবং বাংলাদেশ আলাদা আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে বর্তমানে ভালো আছে? ঃ না।দেশভাগের পর আপনার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা কি আগের চেয়ে ভালো হয়েছে?ঃ আমরা সংগ্রাম করিয়া জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করিতেছি। আপনার বন্ধু বান্ধবী, পরিবার-পরিজন বা অন্য কারো সাথে কি আপনি পুনর্মিলিত হতে চান বা তাদের বর্তমান অবস্থা জানতে চান? ঠিকানা বা কোন তথ্য দিতে পারেন? ঃমামাতুতো ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ইচ্ছা অবশ্যই আছে। আপনার কি বর্তমান বাংলাদেশ সরকার থেকে কিছু চাইবার আছে? বিশেষ করে অর্পিত সম্পত্তি আইন উঠে যাবার পর?: আমাদের ফেলে আসা সম্পত্তি উদ্ধারের ব্যাপারে সাহায্য করার যদি কোন সুযোগ থাকে। (সম্পত্তির দলিলাদি আমাদের নিকট আছে।)

১৯৪৭ ইংরেজীতে দেশভাগ এবং আমাদের ভারতে আগমনের বৃত্তান্তঃ
              আমাদের বাড়ি শ্রীহট্ট জিলার সদর মহকুমায় ছিল। শ্রীহট্ট জিলার ৫টি মহকুমা ছিল। যথাক্রমে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলবীবাজার, সদর সিলেট এবং করিমগঞ্জ। দেশভাগের পরে ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা সীমানা চিহ্নিত করার সময় সম্পূর্ণ শ্রীহট্ট জিলাকে পূর্ব্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। করিমগঞ্জ মহকুমার মাত্র ২টি থানা ভারতের সংগে যুক্ত রহিয়াছে।
          দেশভাগের আগে বর্ত্তমান বাংলাদেশে (পূর্ব্ব পাকিস্তান) হিন্দু-মুসলমান শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করিয়া আসিয়াছেন। দেশভাগের আগে পূর্ব্বপাকিস্তানের ( বর্ত্তমান বাংলাদেশ) সংগে রেল, বাস এবং রেল, বাস এবং জলপথে ভারতের সংগে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল।পূর্বপাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে আমি একজন ভূক্তভোগি হিসাবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এখানে তুলিয়া ধরিতেছি।
১৯৫০ ইং ( ১৩৫৭ বাংলা) ফাল্গুন মাসের শেষের দিকে ( তারিখ মনে নাই) আমি এবং আমাদের গ্রামের একটি ছেলে ( আমরা দুইজনই তখন স্কুলের ছাত্র) করিমগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশ্যে By train  শ্রীহট্ট হইতে কোলাউড়া নামক রেল জংশনে আসি। এখান হইতে পৃথক ট্রেইনে করিমগঞ্জ যাইতে হইবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা কোলাউড়া জংশনে পৌঁছিয়া করিমগঞ্জ যাওয়ার কোনো Train পাই নাই। Train না থাকার  কারণে হিন্দুমুসলমান বহুযাত্রী কোলাউড়া জংশনে আটক পড়িয়া যান।
             সন্ধ্যার পরে একজন মুসলমান ব্যক্তি মাইক যোগে ঘোষনা করিতে লাগিল, মুসলমা যাত্রিরা কেহ যেন ঐ দিন করিমগঞ্জ না যান। আমি ঐ ঘোষক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিলাম কেন এই ঘোষণা? সে আমাকে বলিল এই ঘোষণা শুধু মুসলমান যাত্রিদের জন্য।
            আমরা প্লেটফর্মে হাটাহাটি করিতেছি, এমন সময় আমাদের পরিচিত জনৈক মুসলমান কলেজ ছাত্রের সংগে দেখা হইল। তাহাকে আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম করিমগঞ্জ যাওয়ার Train বন্ধ কেন ? সে তখন আমাদিগকে একটু দূরে নিয়া গিয়া প্রকৃত ঘটনা আমাদিগকে বলিল। সকালে একটি Train কোলাউড়া হইয়া করিমগঞ্জ গিয়াছে। ভৈরব নামক স্থানের একটি সেতুর উপর উক্ত Train দাঁড় করাইয়া নৃশংসভাবে অনেক হিন্দু যাত্রিকে খুন করা হইয়াছে এবং মৃতদের লাস নদীতে ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছে। Train এর প্রতিটি কামরা রক্তে লাল ছিল। ঐ Train করিমগঞ্জ পৌছার পর Train এর কামরাগুলিতে রক্ত দেখিয়া করিমগঞ্জের মানুষ উত্তেজিত হইয়াছে। এবং সেখানে কিছু গোলমাল হইয়াছে। Train টিকে সেখানে আটক রাখা হইয়াছে। ঐ Train  ফেরৎ না আসায় এখান হইতে কোন Train করিমগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করিতেছে না। একই কারণে করিমগঞ্জ না যাওয়ার জন্যে মুসলমান যাত্রিদের নিষেধ করা হইতেছে।
           উক্ত ছাত্রটি আমাদিগকে আরো জানাইল যে, সরকারের সমর্থণে সমগ্র পূর্ব্বপাকিস্তান ব্যাপিয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধাইবার একটি পরিকল্পনা রচনা করা হইয়াছে। ভৈরব নামক স্থানে একতি সেতুর উপর Train আটক  করিয়া  যে হিন্দু নিধন যজ্ঞ হইয়াছে তাহা উক্ত পরিকল্পনারই অঙ্গ এবং দাঙ্গা যে সমগ্র দেশ ব্যাপিয়া ছড়াইয়া পড়িবে এই ঘটনা তাহারই ইঙ্গিত বহন করিতেছে।
           আমরা করিমগঞ্জ যাইবার চেষ্টা না করিয়া নিজনিজ বাড়িতে ফিরিয়া যাইবার জন্য সে আমাদিগকে অনুরোধ করিল।আমাদের বাড়ি শ্রীহট্ট শহর হইতে ১০ মাইল দক্ষিণে। আমরা যদি রাতের Train এ বাড়ীতে যাইতে হয় তা হইলে বাড়ীতে পৌছিতে অনেক রাত হইয়া যাইবে। তাই আমরা বাড়ীতে না যাইয়া কোলাউড়া হইতে ২ ঘণ্টার রাস্তা মঙ্গলো বাজারের পাশে আমাদের আত্মীয় বাড়ীতে যাওয়াই যাওয়াই স্থির করি এবং যথাসময়ে Train এ উঠি। উক্ত Train মঙ্গলো বাজার ষ্টেশনে রাত ১১- ৩০ মিনিটে পৌছে। আমরা Train হইতে নামিয়া যাই এবং নির্দ্দিষ্ট সময়ে Train খানা উক্ত ষ্টেশন ছাড়িয়া যায়। ষ্টেশন হইতে আমাদের আত্মীয় বাড়ী পায়ে হাটিয়া যাইতে আধা ঘণ্টা সময় লাগিবে। Train হইতে নামিয়া যাইবার সময় একজন লোক আমাদের Ticket চাহিয়া নিয়া গেল আমরা আত্মীয় বাড়ি যাওয়ার রাস্তা ধরিয়া হাটিতে আড়ম্ভ করিয়াছি এমন  সময় ৮/১০জন লোক লাঠি ছুরি লইয়া আমাদিগকে ঘেরাও করিয়া মারামারি আরম্ভ করিল এবং আমাদের সংগে সমস্ত জিনিস পত্র লুটপাট করিয়া লইল। এই ফাঁকে প্রাণ বাঁচাইবার জন্য আমরা দৌড়াইতে আরম্ভ করিলাম তাহারা আমাদের পিছনে ধাওয়া করিল বটে কিন্তু আমাদিগকে ধরিতে পারে নাই। আমরা রাত প্রায় ১ ঘটিকার সময় আত্মীয় বাড়ী পৌছিয়াছি।
            আমরা সেখানে গিয়া জানিলাম তাহাদের আশেপাশে বাজারে দোকানগুলো ঐদিনই লুটপাট করা হইয়াছে এবং তাহারাও আতঙ্কের মধ্যে রহিয়াছেন। আমরা পরদিন ভোরে একজন মুসলমান লোককে সংগে নিয়া মুসলমান পোষাক পরিধান করিয়া ‘ছনখাইড়’ নামক একটি গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলাম। সেখানে পৌছিয়া জানিলাম যে আগের দিন তাহাদের আশে পাশের বাজারগুলোও লোটপাট হইয়াছে। ঐদিনই সকাল ১০ ঘটিকায় প্রায় ৫০০০ লোক উক্ত ছনখাইড় গ্রাম আক্রমণ করিয়াছে। সকল জিনিষ পত্র লোটপাট করিয়া নিয়া গিয়াছে। এই গ্রামে প্রায় ৫০০ পরিবার হিন্দুর বাস ছিল। গ্রামের মেয়েরা জঙ্গলে যাইয়া লুকাইয়া থাকায় তাহাদের ইজ্জত রক্ষা পাইয়াছে।
            আমরা সেখান হইতে মুসলমান পোষাকে একজন লোক সংগে নিয়া আমাদের বাড়ীতে পৌঁছাই। বাড়ি পৌঁছিয়া জানিলাম আমাদের গ্রাম সহ আশেপাশের অন্যান্য গ্রামগুলাও আক্রান্ত হইয়াছে। দেশের অন্যান্য অংশ হইতেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সংবাদ আসিতে লাগিল।
             করিম গঞ্জ বাজারে আমার বাবার একটি ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। তাই আমি আমার মা ও ভাই বোনকে নিয়া করিমগঞ্জ চলিয়া আসি। আসার সময় সুতারকান্দি বর্ডারে আমার মায়ের সোনা গহনা যাহা ছিল সব তাহারা রাখিয়া দেয়।আমাদের গ্রামের তথা দেশের অন্যান্য অংশের লোকজন বাড়িঘর ত্যাগ করিয়া বিভিন্ন সীমান্ত দিয়া ভারতে প্রবেশ করে। ভারতে আসিয়া অধিকাংশ লোকই আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নেয়। করিমগঞ্জ আশ্রয় শিবির হইতে অনেক লোককে দোহালিয়া নামক জায়গায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পুনর্বাসন দেওয়া হইয়ছিল। সেখানে মেলেরিয় রোগে আক্রান্ত হইয়া অনেক লোক মারা গিয়াছিল।
এখানে একটি কথা উল্লেখ করা আবশ্যক, দাঙ্গার সময়ে পূর্ব্ব পাকিস্তানের সরকার হইতে হিন্দুদের কোন রকম নিরাপত্তা দেওইয়া হয় নাই। বরং হিন্দুদের পক্ষ থেকে থানায় সাহায্য প্রার্থণা করিতে গিয়া গালাগালি শুনিতে  হইয়াছে।
            আমাদের ভারতে আগমন এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমি এখানে তুলিয়া ধরিলাম, তাহা আমার জ্ঞান বিশ্বাস মতে সম্পূর্ণ সত্য!
শ্রী গোপিকা রঞ্জন সেন
০২-০৭-১২
আমাদের সংযোজনঃ
             আমার মামারা তিন ভাই, সবচে’ ছোট আমার মা। গোপিকা রঞ্জন আমার বড় মামা। এর পর থেকে মামা বলেই উল্লেখ করব। সম্ভবত তাঁদের দেশ ছাড়বার বছরে আমার মায়ের বয়েস তিন ছিল। যদিও কোনো একক সাক্ষাৎকার বা স্মৃতিকথা কোনো পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরে না তবু বেশ কিছু আগ্রহব্যঞ্জক তথ্য এখানে পাওয়া যাচ্ছে। যে হাঙ্গামা শুরু হয়েছিল প্রায় তিনমাস আগে ডিসেম্বর ১৯৪৯ থেকে তার সম্পর্কে তিনি কিছুই প্রায় জানতেন না কোলাউড়া স্টেশনে আসবার আগে অব্দি। মুসলমান যাত্রীদের করিমগঞ্জ যেতে মানা করা হচ্ছে শুনে কোন ভয় শংকারও কারণ দেখেন নি। সম্পন্ন গৃহস্থ মানে ধনী কৃষকের ঘরের সন্তান তিনি, করিমগঞ্জে আগে থেকেই আছে পৈত্রিক ব্যবসা। বাবা ওখানেই আছেন। যেতে আসতে কোনো সীমান্ত চৌকি ছিল বা ভিসা পাসপোর্ট দিতে হতো এমন সংবাদ নেই। যিনি ঘোষণা করছেন তাকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করছেন কারণ। পরে যার থেকে জানলেন তিনি কলেজে পড়া ছাত্র মাত্র নয়। দেশের খবরাখবর রাখেন এবং খবরের ভেতরের খবর রাখবার যোগ্যতাও রাখেন। রাষ্ট্র নিজে এটা সংগঠিত করছে এটা বোঝেন এবং বোঝাতে পারেন। তিনি মুসলমান। কিন্তু বক্তা এবং স্রোতার পরস্পরের মধ্যে নিজেদের পরিচিতি নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। নেই সংশয়। অথচ সেদিনই সামান্য দূরে ভৈরব সেতুতে কয়েক শত হিন্দু যাত্রীদের উপর আক্রমণ নেমেছে। তিনি তাদেরকেও বাড়ি ফিরে যাবার পরামর্শ দেন। আত্মীয় বাড়ি যাবার পথেও আক্রান্ত হলেন, গিয়েও জানলেন আশেপাশের বাজারে সেদিন হামলা হয়ে গেছে তারপরেও পরদিন সকালে মুসলমান সঙ্গীকে নিয়ে ছনখাইড় পথ ধরতে অসুবিধে হয় নি। ছনখাইড়ে গিয়ে শুনলেন সেখানেও আগুন জ্বলেছে মেয়েরা জঙ্গলে গিয়ে প্রাণ বাঁছিয়েছে। সেখান থেকেও বাড়ি যাবার নিরাপত্তা পাওয়া গেল আরেক মুসলমান সঙ্গীর থেকে। রাষ্ট্র কী আচরণ করত এসব তাঁর শোনা কথার থেকে কিছু জানা যাচ্ছে। এসব হামলা থেকে বাঁচাবার কোন উদ্যোগই ছিল না। বরং পুলিশে নালিশ করলে গালিগালাজ শুনতে হতো হিন্দুদের। তাদের প্রত্যক্ষ বাজে অভিজ্ঞতাটি এই যে যখন একেবারে চলে আসছিলেন তখন সুতারকান্দি সীমান্তে তাঁর মায়ের সোনা গহনা ‘তাহারা’ রাখিয়া দেয়। আমরা অনুমান করতে পারি ওদিককার সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর কথা বলা হচ্ছে। একেবারে নিরাশ্রয় তারা হলেন না কিন্তু । এ যেন  ওবাড়ি থেকে এবাড়ি চলে আসা। ওবাড়িতে শুধু আর যাবেন না। করিমগঞ্জে ব্যবসা না থাকলে চলে আসতেন কি? জানি না। তাঁর মামারা কিন্তু চলে আসেন নি।  সবটাইতো আর নিরাপত্তাহীনতার গল্প নয়। সেই মুসলমান কলেজ পড়ুয়া ছাত্রটি থেকে শুরু করে বাড়ির পথের মুসলমান সঙ্গীদের আশ্বাস বলে এক বাস্তবতাও ছিল তো? সম্ভবত সেগুলো অনেককে আটকেও রেখেছিল।যেমন তাঁর মামাদের।
             আমি আমার পরিবারের কথা কিছু জানি। আমার বাবা সে অর্থে কোনকালেই বাংলাদেশ থেকে চলে আসেন নি। ১৯৬৪ নাগাদ নাগাল্যাণ্ড সরকারের চাকরি নিয়ে তুয়েনসাং জেলার সামাতুরে চলে যান। সেখানে থাকতেই দেশের বাড়িতে তাঁর বাবা মারা গেলে দূরত্বের জন্যে তিনি আসতে পারেন নি। পরের বছর এসছিলেন। পরের বছর যখন করিমগঞ্জে গিয়ে বিয়ে করেন তখনো দেশের বাড়ি হাত ছাড়া হয় নি। কিন্তু সেখানে গেছেন বলে শুনিনি। কারণ ওখানে মহিলা বলে কেউ নেই। তাঁর মা গত হয়েছিলেন বাবার আগেই। ততদিনে তাঁর বড় তিন বোনেদেরও বিয়ে হয়ে গেছে এবং তাদের পরিবার এসে গেছেন অসমে। ছোট দুই ভাই ছিলেন ,তারাও জীবিকার সন্ধানে শিলচরে এবং গুয়াহাটিতে তখন। বাড়িটি আছেই। সেই বাড়ি নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখান নি বাবা—এই অভিমান পরে অনেক শুনেছি মেজো কাকার কাছে। ১৯৫২ থেকে পাসপোর্ট ব্যবস্থা চালু হলেও মনে হয় না খুব কড়াকড়ি ছিল। আমাদের পরিবারের কারো কোন পাসপোর্ট ছিল না। তার দরকার আছে বলেও মনে হয় না কেউ ভাবতেন। শুধু ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই সমস্ত যোগাযোগ তাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল সে দেশের সঙ্গে। এই তাদের দেশভাগ।
কী হয়েছিল তবে ১৯৫০ এ ঃ
           দেশভাগের তিন বছর পর এই হাঙ্গামা কেন? মুসলমানের দেশে হিন্দুকে মারা হবে--- এ আর বিচিত্র কী কথা! –এভাবে কেউ কেউ ভাবতে পারেন। কিন্তু এ আসলে অতিসরলী করণ হয়ে যাবে। আসলে এটি ছিল ১৯৭১এর মুক্তি যুদ্ধের গর্ভযন্ত্রণা।দু’বছর পরেই কিন্তু ১৯৫২র ভাষা আন্দোলন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি। এটা আমাদের বোঝা ভালো। ১৯৪৯এর ডিসেম্বরে কমিউনিষ্ট দমনের অভিযান দিয়ে শুরু হয়েছিল ঘটনাক্রমের। খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমাতে কালশিরা গ্রামে কমিউনিষ্ট সন্দেহে পুলিশ ধরতে যায় জয়দেব ব্রহ্মকে। তাঁকে না পেয়ে তাঁর স্ত্রীকে ধর্ষণ করবার চেষ্টা করে। তিনি চেঁচালে প্রতিবেশি লোকেরা এসে মেরে পুলিশ তাড়িয়ে দেয়। একজন পুলিশ মারাও গেছিল। তারই প্রতিশোধ নিয়ে পরদিন জেলার পুলিশ সুপার সশস্ত্র পুলিশ এবং আনসার বাহিনী  ( ভারতের হোমগার্ডের মতো অনেকটা) নিয়ে এসে কালশিরা এবং পাশের হিন্দু গ্রামগুলোতে আক্রমণ নামান। সাধারণ মুসলমান গুণ্ডাদের উস্কে রেখেছিলেন লুটপাট এবং ঘরে আগুন দিতে। সেই শুরু। সেই মাসেই প্রায় হাজার ত্রিশেক লোক খুলনা ছেড়ে ভারতে চলে আসেন। জানুয়ারিতে পুলিশ একই রকম তেভাগা আন্দোলনের ঘাটি রাজশাহী জেলার নাচোলে  সাওঁতালদের উপর আক্রমণ নামায়। বিখ্যাত নেত্রী ইলা মিত্রকে তখনই পুলিশ থানাতে নিয়ে গিয়ে অমানবিক অত্যাচার এবং ধর্ষণ করে। ইলা মিত্র চিকিৎসার জন্যে এবং মামলা এড়াতে ১৯৫৪এর জুনে  কলকাতা  চলে এসে থেকে গেলেও অত্যাচারিত  সাঁওতালরা চলে এসছিলেন পাকাপাকি  সেরকম খবর নেই। হয়। ১০ ফেব্রুয়ারিতে প্রাদশিক বিধান সভাতে কংগ্রেস সদস্যরা কালশিরা এবং নাচোলের ঘটনা নিয়ে আলোচনার দাবি জানালে অধ্যক্ষ অনুমতি দেননি। প্রতিবাদে কংগ্রেস সদস্যরা বেরিয়ে আসেন। সেদিনই ঢাকাতে আক্রমণ নামে।  বিমান বন্দরে পলায়নরত যাত্রীদেরকে হত্যা করা বরিশাল , ময়মন সিংহ, নোয়াখালিতেও আক্রমণ নামে।  বরিশালে যে আক্রমণ নামে সেটিই বোধকরি ভয়াবহ ছিল। প্রায় ছ’লাখের উপর মানুষ শুধু সেই জেলা থেকেই পালিয়ে ভারতে এসছিলেন। নোয়াখালিতে আক্রান্ত অধিকাংশই ত্রিপুরাতে প্রবেশ করেছিলেন।
            আমার মামা যে ভৈরব সেতুর কথা উল্লেখ করেছেন সেটির সরকারি নাম ছিল এণ্ডারসন ব্রীজ। সেটি কিন্তু সিলেটের  নয় । এখনকার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ এবং কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব বাজার জংশনকে যুক্ত করে মেঘনা নদীর উপর  এই সেতু প্রায় এক কিলোমিটার থেকেও বেশি দীর্ঘ।  সিলেট জেলা থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে এর অবস্থান।  অসম বেঙ্গল রেলওয়ে অসমের চাবাগানগুলোর সুবেধের জন্যে  ১৮৯১তে  চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেল বসিয়ে ক্রমে কোমিল্লা কোলাউড়া হয়ে লামডিং অব্দি টেনে এনেছিল যে লাইন এই সেতু কিন্তু সেই  লাইনে পড়ে না। আখাউড়া থেকে এর একটা শাখা চলে গেছিল ঢাকা ময়মনসিংহকেও যুক্ত করে। সেই লাইনেই ১৯৩৭এ ঐ সেতু তৈরি হয়। উদ্বোধনের তারিখটি এখন বেশ আগ্রহোদ্দীপক মনে হবে। ৬ ডিসেম্বর। সুতরাং ঠিক ঐ রেলই রক্তধোয়া হয়ে করিমগঞ্জ পৌঁছেছিল কিনা নিশ্চিত জানি না।  সম্ভবত ঢাকা থেকে আখাউড়া হয়ে আসছিল সেই ট্রেন। এখনো ঢাকা সিলেটের রেলপথ এটাই। 
              যাইহোক, সিলেটে তখন দু’শোর উপর গ্রাম আক্রান্ত হয়েছিল। ৫০০র উপর ছোটবড় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। মণিপুরিরাও ব্যাপক আক্রমণের স্বীকার হয়েছিলেন। এই মণিপুরি বা সাঁওতাল বা গারো বা হাজং যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন তাঁরা কেউ কেউ যদিও বা সাময়িক ভাবে সীমান্তের এপারে এসছিলেন পাকাপাকি থেকে গেছিলেন এমন সংবাদ কিন্তু নেই। আর থাকলেও শরণার্থী সংক্রান্ত রাজনৈতিক বয়ানে কিন্তু তারা ভারতে একেবারেই অনুপস্থিত।
              সুতরাং যতটা বলা হয় যে মুসলমানরা ক্ষেপে গিয়ে হিন্দুদের দেশছাড়া করিয়েছিল—এগুলো এতো সরল বাক্য নয়। মুসলমানরা বাঁচিয়েও ছিল, প্রতিরোধও করেছিল। তার প্রথম কারণতো অবহমান সামাজিক ঐক্য। যেমন আমার মামাদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। এর রাজনৈতিক কারণও ছিল। সেও অনেকগুলো। ৮ অক্টোবর ১৯৫০এ আইন এবং শ্রমমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল তাঁর পদত্যাগ পত্রে১ বাঙালি এবং অবাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিরোধ , নিজামুদ্দিন এবং শোহরাবর্দী গোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ, ইন্দো-পাক বাণিজ্যিক সম্পর্কের জটিলতার থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেওয়া এবং দুই বাংলা এক করার লড়াই প্রবল হয়ে উঠার আশঙ্কা ইত্যাদির থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে এই হাঙ্গামা বলে উল্লেখ করেছেন। এগুলো হয়তো সব ঠিকই। কিন্তু এরমধ্যেই ইতিমধ্যে যে এক বাঙালি জাতীয়তাবাদ দানা বাঁধছিল তার ইঙ্গিত আছে। আর তেভাগা আন্দোলনের ভয়তো ছিলই। যার বৌদ্ধিক নেতৃত্ব অবশ্যই ইলা মিত্রের,রণেন মিত্রের মতো বাঙালি বর্ণহিন্দুদের হাতে ছিল। যে লড়াইতে অচিরেই মুসলমানরা যোগ দিতে পারতেন বৃহৎ সংখ্যাতে,আর দিয়েওছিলেন অনেকে। কেননা “বাঙ্গালী মুসলনমান সে সময়ে দেশের সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশের অধিকারী ছিলেন, যখন স্টেট টেন্যান্সি এক্ট ১৯৫১ জারি করা হয় তখনও দেশের ১৫ শতাংশ সম্পদ ও ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রন করতে উচ্চবর্ণের হিন্দু ও মারোয়ারী সম্প্রদায় ।”২ বস্তুত ব্যাপক মুসলমান কৃষক জনতার সঙ্গে বর্ণহিন্দু জমিদার, জোতদার ,ধনীকৃষকদের সংঘাত কাজে লাগিয়ে মুসলমান জনতাকে নমসূদ্র সহ অন্যান্য পিছিয়ে পড়া হিন্দু জনগোষ্টীর বিরুদ্ধেও লেলিয়ে দিতে চাইছিল। যে জনগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মুসলমানের দ্বন্দ্ব ছিল অবৈরি। তাই যোগেন মণ্ডলের মতো নেতা পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু সেই দ্বন্দ্বকে বৈরি দ্বন্দ্বে পরিণত করে ফেলতে চেয়েছিল এবং অনেকটাই পেরেছিল পাকিস্তান নামের নয়াউপনিবেশের  শাসক শ্রেণি। যার গাঁটছড়া তখনো বাঁধা ছিল ব্রিটিশের সঙ্গে, এবং মুখিয়ে ছিল আমেরিকা সহ অন্যান্য পশ্চিমী দেশগুলোর দিকে, যেমন ছিল ভারতীয় শাসকদেরও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রায্যবাদ তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশেই সামন্তশেণী এবং দেশীয় পুঁজিপতিদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে শাসন চালিয়ে যেতে সমর্থ হয় ,কিন্তু পরোক্ষে। পুঁজিবাদী উৎপাদনের সমস্ত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে, সেই সঙ্গে বহাল রাখে উদ্বৃত্ত আহরণের সমস্ত অর্থনীতি বহির্ভূত উপায়সমূহ। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণও সেই স্বার্থেই দরকার পড়ে। পাকিস্তানের কাছে এই উপায়গুলোর একটি ছিল ঊর্দু জাতীয়তাবাদ। এমনিতে ভারত থেকে আলগা হবার পরেই ভারতীয় বর্ণহিন্দুদের সঙ্গে যে বিবাদ তার কার্যকারিতা ফুরিয়ে যাবার কথা ছিল। জিন্না তাই একবার পাকিস্তানে ধর্ম-জাতির নির্বিশেষে কোন বৈষম্য রাখা হবে না বলে ঘোষণা করেন। হয়তো তিনি তা মনের একদিক থেকে চেয়েওছিলেন। কিন্তু অচিরেই তিনি উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র স্বীকৃত ভাষা বলে ঘোষণা দিয়ে বসেন।স্বাধীনতার বছরেই পরের মার্চ মাসে তিনি ঢাকাতে এসে এই ঘোষণা দেন। তার আগের মাসেই পাকিস্তান সংসদে কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান সংসদে দাবি তুলেছিলেন ইংরেজি উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সেখানে সেটি নাকচ হয়ে গেলেও ঢাকাতে ছাত্ররা পথে নামে। অনেকের সঙ্গে গ্রেপ্তার বরণ করেন নবীন ছাত্র নেতা শেখ মুজিবর রহমান। যিনি পরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেবেন। সে বছরের জুন মাসে তিনি মৌলানা ভাসানীর সঙ্গে মিলে গড় তোলেন আওয়ামী লীগ। দুই পাকিস্তানের সবচে’বড় জনগোষ্ঠী ছিল তখন বাঙালিরা। সুতরাং তারা না আলাদা হয়ে যায়, অখণ্ড বাংলার স্বপ্নকে সাকার করবার জন্যে মাঠে নামে এমন এক ভয় জিন্না এবং পরবর্তী শাসকদের কুরে কুরে খাচ্ছিল। সেই সঙ্গে শুধু নাচোল বা তেভাগাই নয় চীন বিপ্লবের ভূতও তাড়া করে ফিরছিল দ্বিখণ্ডিত ভারতের শাসকদের। এগুলো আটকাতে গেলে হিন্দু আর মুসলমানে বিরোধটা চাগিয়ে দিতে হয়। তবে পশ্চিম বাংলাতেও আর কেউ অখণ্ডবাংলার স্বপ্ন দেখার সাহস করে না। ইতিমধ্যে দু’টুকরো সিলেট নিয়ে হয়তো তিনি ভাবেন নি। হয়তো ভেবেছিলেন সিলেটের স্থানীয় পাকিস্তানপন্থীরা, যারা বর্ণহিন্দু আধিপত্যের থেকে মুক্তি চাইছিলেন আর সিলেটি হিন্দুরা তখনো দেশ ছাড়ার নাম নিচ্ছিলেন না। এতোসব কথা আমার মামারা জানতেন না। তাই যেদিন ভৈরবের পুলে গণহত্যা হয় সেদিনও তারা বেরিয়েছিলেন করিমগঞ্জ আসবেন বলে, সেখানে তাদের পৈত্রিক ব্যবসা আছে আগে থেকেই। আর যে ব্যক্তি মুসলমানদের করিমগঞ্জ যেতে মানা করছিল তাঁকে গিয়ে নির্দ্বিধায় জিজ্ঞেস করতে পেরেছিলেন, কারণটা কী?

তথ্যসূত্রঃ

১) আইন এবং শ্রমমন্ত্রীর যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পদত্যাগ পত্র;মুক্তমনা ইয়াহুগ্রুপ
)বাংলা বিভাজন ভবিষ্যত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভাজনের সূচনা করেছিলো হয়তো- ০৩/রাসেল পারভেজ;আমারব্লগ ডট কম;
গ্রন্থসূত্রঃ
১) দেশভাগ –স্মৃতি আর স্তব্ধতা; সম্পাদনা সেমন্তী ঘোষ;গাঙচিল; কলকাতা৭০০১১১।
২)বাংলায় মুসলমানের আটশ বছর;জাহিরুল হাসান;পূর্বা;কলকাতা-৯।


কোন মন্তব্য নেই: