“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১২

উরুকার রাত ,ভোগালি বিহু~~পৌষসংক্রান্তি

      পৌষ সংক্রান্তির আগের রাত । আসামে  বলে উরুকা । সেই রাতের জন্য হা পিত্যেস করে বসে থাকতাম আমরা সারা বছর  । এক মাস /পনের দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যেত তোড়জোড় । ভেলাঘর তৈরি করার সাজসরঞ্জাম জোগাড় করা চলত অনেকদিন ধরে । শহরে সব কিছুই সংগ্রহ করা বেশ কষ্টকর। কিন্তু ভেলাঘর তৈরি করতে চাই খড় ,বাশ, কলার শুকনো পাতা বা পাচালি। বাঁশ দিয়ে ঘরের খাঁচাটি তৈরি হবে, চাল হবে খড়ের, দেয়াল হবে কলার পাচালি দিয়ে । পাশে হবে মেজি। বিশাল খোলা মাঠে  তৈরি হত । ছেলেদের মধ্যে এই নিয়ে  দারুন প্রতিযোগিতা ।কার ভেলাঘর কত বড়।কার মেজি কত উঁচু ।  মেজি খড় বা কাঠ দিয়ে  তৈরি হত । সিলেটে বলা হত মেড়ামেড়ি। দাদাদের ভেলাঘর ও মেজি ঘর বিশাল কাণ্ডকারখানা ।আমাদের ছোটখাট ব্যাপার  । ছোট্ট একটুখানি ঘর ।মেঝেতে খড় পাতা  ।তাতে হুটপাটি দাপাদাপি ।চেঁচিয়ে গান গাওয়া ,কত রকমের গল্প । বন্ধুদের একসঙ্গে এতক্ষন থাকা ।রাতের  পিকনিকের তোড়জোড় ।
               
               সেদিন টি ছিল চুরিরও রাত। কারোর বাড়ির পাঁচিল বেড়াটি আস্ত থাকতো না ।গোটা বাঁশের বেড়া  হই হই করে তুলে নেয়া হত। এ ছাড়া ফল, সবজি, মুরগি,হাঁস সবই চুরি হত ।    তারপর এল খাওয়াদাওয়া  ।সে কি আনন্দ।নিজের হাতে রান্না করে খাওয়া।রান্নাবাটি খেলা । দাদারা ঘুরে ঘুরে চাঁদা তুলত । আমাদের এর ওর কাছ থেকে চেয়ে চিনতে  সব্জি ,ডিম ,চাল  যোগাড় করা । কখন কখন মুরগির মাংস হত ।নিষিদ্ধ  মাংস । তারপর আবার কায়স্থ বামুনে মাখামাখি । ঠাকুমাকে পুরো ব্যাপারটাই চেপে দেয়া হত ।   মেয়ে বলে খাওয়ার পর বাড়ি ফেরা।রাতে থাকা চলবে না । ছেলেদের অবশ্য সে সব নেই।তাই দাদারা সারারাত ভেলাঘরে থাকত। আমাদের মন খারাপ হত ।ইচ্ছে করত সারারাত বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে কাটাই । তা আর কোথায় । তাই গুটি গুটি পায়ে ঘরে ফেরা ।  পরদিন সক্কাল বেলা চান করেই দৌড় ভেলা ঘরে ।এবার এতদিনে তৈরি করা প্রিয় ঘরটি জ্বালিয়ে দিতে হবে, তাই নিয়ম। ভোরবেলা সূর্য উঠছে আর দিকে দিকে মেজি , ভেলা ঘর পুড়ছে ।আগুন আর সূর্যদেব চোখাচোখি। পৌষের প্রচণ্ড শীতের সকালে কি আরাম !
                   
            ভেলাঘরের চারপাশ ঘিরে মা দের রাতের তৈরী পিঠে খাওয়া । মেজি ঘর জ্বালাবার সময় তিলপিঠে পান-তাম্বুল ও পয়সা দেয়া হত । আগুনকে  ঘিরে  চলত পিঠে খাওয়ার ধুম । গ্রামে এই মেজির পোড়া ছাই ক্ষেতের মাটিতে ছড়িয়ে দেয়া হত। বিশ্বাস তাতে মাটি উর্বর হয়।  আগামি বছরের আরও ভাল ফসলের আশায় ।কারন বিহু আসলে ফসল কাটা ,পুর্ন ভাণ্ডারের  উৎসব। ভোগালি বিহু ভোগের নতুন চালের উৎসব ।যেমন বাংলায় পৌষ  সংক্রান্তি  । মাটির গান। হারভেস্টিং সং । আর আগুন জ্বালিয়ে আসলে অগ্নি উপাসনা করা হয় । তাকে খুশি রাখা । সে আবার অন্য গল্প । আর্য্য প্রভুদের কথা । তারপর সংক্রান্তির দিন সারাদিন হইহুল্লোড় খাওয়া দাওয়া আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে পিঠে পাঠানো বা গিয়ে গিয়ে পিঠে খাওয়া ।যেহেতু তিল সংক্রান্তি তাই তিল পিঠের খুব চল ছিল আসামে এ ছাড়া ছিল ঘিলাপিঠা ,ভাতপিঠা ,খোলাপিঠা ,বরপিঠা।বরাচালের গুড়ি বানিয়ে ভাজা হত ,তাকে বলা হত 'হুরুম' । এ ছাড়া বিরনির চাল। পশ্চিমবঙ্গে এই চাল  দেখিনি । বাশের চোঙ্গের ভেতর অল্প জল দিয়ে উনুনে পোড়ান হত। তাকে বলা হত চুঙ্গাপিঠা ,  খুব জমাট বাধা  দই দিয়ে খাওয়ার রেয়াজ সেটা । এ ছড়া অসমীয়া সমাজে নতুন চালের পিঠা ,তিলের পিঠা, নতুন আলু খাওয়া হয়। আলু না খেলে নাকি পরের জন্মে শুয়োর হয়ে জন্মাতে হবে তেমন বিশ্বাসও আছে গ্রামে গঞ্জে ,মানে এতটাই আলুর মাহাত্ম্য । কারন নতুন আলুতো তখন ভরপুর ।মাছ ,মাংস ,বিশেষত চিতল মাছ খাওয়া হত । তেমনি আসামে থাকা বাঙ্গালীরা বিহু যেমন পালন করতেন পরেরদিন পৌষ  সংক্রান্তি পালিত হত মহা ধুমধাম করে ।বাঙ্গালিদের বাড়িতে হত পাটিসাপটা ,দুধপুলি ,চন্দ্রপুলি ,ছোলারপিঠে ,মুগসলই, জামপিঠে,গোকুল পিঠে ,এলঝেল  আর কত !!দুটো অনুষ্ঠানই গা জড়াজড়ি করে চলত । উৎসবমুখর হয়ে উঠত পরিবেশ ।ভালবাসার আবহটি ও গড়ে উঠত, মজবুত হত  সম্পর্ক । ভোগালি বিহু ও পৌষ সংক্রান্তি ,বড় আদরের ও অপেক্ষার উৎসব । কৃষকের কোলভরা ,মনভরা উৎসব ।

কোন মন্তব্য নেই: