“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১১

অসমের বাঙালির রাজনীতিঃ বহমান বয়ান স্রোতে খানিক অবগাহন


         (লেখাটা সম্প্রতি 'একা এবং কয়েকজনে'র শারদ সংখ্যাতেপ্রকাশিত হয়েছে।)
         দেশজুড়ে চারদিকে যখন অরাজনৈতিকতার জোয়ার, মানুষ ব্যাপক এবং বিশাল গণআন্দোলনে যোগ দিতে দিতে জানান দিচ্ছেন যে তারা রাজনীতি করছেন না, তখন একটি কাগজ অসমের বাঙালির রাজনৈতিক ভাবনাএরকম একটা বিষয় বেছে নেয়াতে মনেই হয় তারা স্রোতের বিরুদ্ধে পা ফেলতে চাইছেন। কিন্তু স্রোতের বিরুদ্ধেও একটা স্রোত রয়েছে--- বলিউড পরিচালকেরাও প্রায়ই উচ্চারণ করে থাকেন জরা হটকেবাঙালির রাজনৈতিক ভাবনা নিয়েও কিন্তু এই জরা হটকেরবড় জটিল জাল ছড়ানো রয়েছে । একে রাজনীতি’, তায় এই জাল’—কথা বলতে বেশ ভয় করেই বটে। তথাপি স্রোতেতো লাশ ভেসে যায়, বিরুদ্ধে দাঁড়ালে অন্তত বোঝা যায় প্রাণটি টিকে আছে। তাই পরিকল্পকেরা ধন্যবাদার্হ ।
মুস্কিল হচ্ছে, অসমের মাটিতে দাঁড়িয়ে এই নিয়ে কথা বলতে গেলে খড়কুটো যত সাহায্য করে, তৈরি নৌকো ততটা মোটেও নয়। অর্থাৎ, চর্চা এতো অল্প যে দুমলাটের বাঁধা বইয়ে পূর্বসূরি পণ্ডিতদের বাড়ানো হাতের সন্ধান খুব অল্প মেলে। অবশ্যি জ্ঞানার্জনে বই পত্তরই একমাত্র সাহায্য করেএই বিশ্বাস এই লেখকের বহু আগেই উড়ে গেছে । তার বাস্তব কারণ বোধ করি এই যে অসমের অসমিয়া ভিন্ন বাঙালি বা অন্যান্য জনগোষ্ঠী নিয়ে বইয়ের সংখ্যা যেমন অপ্রতুল, যেগুলো আছে সেগুলোও কোনো বই বাজারে সাজানো গুছানো করে পাওয়া বড় কঠিন কাজ। শিলচর গুয়াহাটির মতো নগরে যদিও বা কিছু সুবিধে রয়েছে, অন্যান্য শহরে বা গাঁয়ে তাও নেই বিশেষ। সুতরাং আমার বিশ্বাস সেই মাও-ৎসে-তুঙে। জনগণের কাছে যাও, জনগণের থেকে শেখো, জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দাও। এই না করে যত আলাপই করি না কেন, সবই শেষ বিচারে প্রলাপ হতে বাধ্য।
সুজিৎ চৌধুরী সম্ভবত এই সমস্যাগুলো খুব করে অনুভব করতেন, তাই তিনি একটা কথা বারে বারে লিখতেন, শূন্য স্লেটে দাগ কেটেযাবার কথাস্লেটশব্দটা এর জন্যে কি ব্যবহার করতেন , ইচ্ছে করলেই মুছে নতুন দাগ দেয়া যাবে বলে? হবেও বা! আমিও ওই দাগ কেটে যাবার বেশি কিছু করতে পারব বলে মনে হয় না, তা হবে তাঁর মত বিদগ্ধ জনের থেকে অনেক খাটো। তর্ক উঠতেই পারে, তিনি বা তাঁর মতো অনেকে, যেমন অমলেন্দু গুহ বা আরো অনেকে যাদের নামের তালিকা খুব একটা খাটো হবে না, যেটুকু দাগ কেটে গেছেন আমরা কি ওখান থেকে শুরু করব? না তাঁর সমান্তরালে? এইখানে, আমি কিছু শিবের গীত গাইব। কথা যখন স্রোত নিয়েই শুরু হচ্ছিল, সেতো সরল রেখাতে এগোয় না। আমাদের জ্ঞান সরল রেখাতে এগোয়এই বিশ্বাস হচ্ছে আমাদের সব বিশ্বাসের বাড়া । ষোড়শকোনের একটা বইয়ের মধ্যে তাঁকে আবার স্থায়ীভাবে বেঁধে ফেলা যায় এটা আমার কাছে কেমন ঈশ্বরের বিশ্বাসের মতোই অসম্ভব এক বিশ্বাস বলেই মনে হয়। সুতরাং ফাঁক এবং ফাঁকি আমাতেও থাকবেই এবারে, নাস্তিক মন্দিরে পা ফেলতে বাধ্য হলেই যেমন দুরু দুরু বুকে বড় সতর্ক হয়ে যায়, আমার কাছেও বিদ্বজ্জন সমাবেশ তেমনি বড় এক আতঙ্কের বিষয়, তা কোনো সেমিনারেই কথা বলাই হোক , কিম্বা লিটিল মেগে গদ্য লেখা। এই কথাটা আমি আত্মরক্ষার্থে লিখছি মাত্র, কারো বিশ্বাসের সম্মানহানি করা আমার উদ্দেশ্য নয় মোটেও। কেন, কথাটা খুলে বলি। আজকাল ডিকন্সট্রাকশনের কথা হচ্ছে, ‘লেখকের মৃত্যুঘোষিত হয়ে গেছে। আমার কথাগুলোতে সেরকম কিছু কিছু ইঙ্গিত আপনারা পেয়ে থাকবেন। আমি ওই সব ফরাসি পণ্ডিতদের ভক্তও নই। কারণ ওদেশে ঢেউ উঠল তো এখানে এই দেশে হাওয়া বইলএও একরম অপ্রাকৃতিক এবং একরৈখিক জ্ঞানের ধারণা। আলোও শেষ বিচারে সেরকম আচরণ করে না, জল কিম্বা হাওয়াতো মোটেও নয়। এরা, দেখতেই দেখা যায় বড় বিশৃঙ্খল, কিন্তু শেষে গিয়ে ওদেরকেও একটা শৃঙ্খলা না মেনে নিলে কাজ চলে না। কথা হচ্ছে, আপনি কখন, কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন আর কোন দিকে তাকাচ্ছেন। সেই আপনিহতে পারেন ব্যক্তি কিম্বা সমাজ, অঞ্চল, জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায়, বর্ণ, প্রদেশ, রাষ্ট্র, লিঙ্গ ইত্যাদি যা কিছু অগুনতি পরিচিতি আপনি ধারণ করেন তার সম্মিলিত প্রতিনিধিও। মানুষ যখন কথা বলে, কিম্বা কাজ করে তখন সে কেবল একা করে না, তার সঙ্গে করে তার সমগ্র সমাজের স্মৃতি-সত্তা-স্বপ্ন, সে যখন খুবই ব্যক্তিকেন্দ্রিক তখনো
এবারে আমি মোটামোটি আমার কথা বলবার মতো জায়গাতে এসে গেছি। আমিও যে মাওয়ের নির্দেশে জনগণের থেকে শিখে এসে বলছি তা নয়। তবে জনগণের একটা বিশাল অংশ আজকাল কথা বলেন দৈনিক কাগজে । আরেকটা বিশাল অংশ সেখানে বলেনও না । প্রতাপের নিচে ঢাকা পড়ে যাওয়া সেই নীরবতাগুলোও কান পাতলে খানিকটা শোনা যায় বটে, কিন্তু না শোনা অংশটাই বেশি। এই সীমাবদ্ধতার কথা শুরুতেই জানিয়ে নিই। বস্তুত, অসমে বাংলা সংবাদপত্র এবং বৈদ্যুতিন মাধ্যমের প্রচার প্রসার সাম্প্রতিক কালে বাঙালির রাজনৈতিক ভাবনার জগতে এক নতুন মাত্রা নিয়ে এসছে। কেবল এই নিয়েই একটা নিবন্ধ দাঁড় করানো যায়।
প্রসঙ্গঃ অসমের দুই উপত্যকা এবং বাঙালি...............

কোন মন্তব্য নেই: