।। মাসকুরা বেগম ।।
(C)Imageঃছবি |
- মা মা মা, বলে বাড়িতে ঢুকছে মুন্না।
- আস্তে আস্তে মা বোধহয় ঘুমাচ্ছেন।
ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসে জবাব দে রহিমা। এক মাস হয়েছে মুন্নার সাথে বিয়ে হয়েছে রহিমার। শান্ত, সুশ্রী মেয়ে। মুন্নার মা-ই পছন্দ করে মেয়ে এনেছেন। তিনি তাকে বউ ভাবতেই পারেন না। নিজের তিন ছেলে। মেয়ে একটা ছিল। পাঁচ বছর বয়সে চলে গেছে বেহেশতে।
- মা তো দিনের বেলা ঘুমান না, কোনো দিন। শরীর খারাপ নাকি। মুন্না বললো।
- মা না খুব আনমনা হয়ে কী যেন ভাবছেন, কী যেন কষ্ট পাচ্ছেন । আমি পাশে গিয়ে বসে জিজ্ঞেস করলাম, ''আম্মা আপনার কি শরীর খারাপ?'' কিছু বলছেন না। যখন আমি বেশি জোর করলাম শুধু 'হায়রে এন আর সি' বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। মা কেন এমন করলেন? কী কষ্ট মায়ের মনে?
মুন্না তখন বলতে শুরু করল। তার মা বেগমকে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ সবাই স্নেহ করতেন। তিনি নিজের গুনে সবাইকে খুব আপন করে নিয়েছিলেন। তার দাদার অনেক কৃষি কর্মের জমি। তাই বাবা আলীকে কৃষি কর্মই করতে হয়েছে। কিন্তু এই কৃষক বাবা আলী খুবই জ্ঞানী ছিলেন। গ্রামের মানুষ খুব শ্রদ্ধা করত। যখন কোনো বিষয়ে বক্তৃতা আরম্ভ করতেন, অনেক শিক্ষিত লোকই লজ্জায় মুখ লুকাতো। গ্রামের মানুষ জোর করে সভাপতি আসনে বসাতো উনাকে। বেগম ও আগলে রেখেছিলেন পরিবার, সম্পত্তি সব কিছুই। আলী ও বেগমের সুখী সংসার।
২০১৫ ইংরাজিতে শুরু হলো এন. আর. সি. প্রক্রিয়া। দৌড় শুরু হলো নথিপত্র যোগাড়ের । বেগম নবম শ্রেণিতে থাকতে বিয়ে হয়ে যায়। স্কুল সার্টিফিকেট ও বের করা হয়নি। বার্থ সার্টিফিকেটটা আজকের মতো তো সঙ্গে সঙ্গে রেজিস্ট্রি হয়নি। স্কুল থেকে সার্টিফিকেট আনলেন তো নামটা ভোটার আইডি কার্ডের সাথে মিলে না। এক জায়গায় করিমা বেগম তো অন্য জায়গায় কারিমা বেগম।বাপ-দাদার লিগ্যাসি, তাও আছে। তারপর বিবাহিত মহিলার নাকি আবার নিজ বাবার গ্রামের পঞ্চায়েত সার্টিফিকেটও আনতে হবে। তাই আনলেন। ২০১৮ ইংরাজিতে ভেরিফিকেশনও হয় গোয়ালপাড়ায়। ২০১৯ আবার ভেরিফিকেশনর ডাক আসে উনারা ভাই-বোনদের সবার করিমগঞ্জ থেকে। যেখানে উনাদের চৌদ্দ গুষ্টির ও কেউ নেই । তারপরও যেতে হবে সরকারি নির্দেশ। আবার না দেশ ছাড়া হতে হয়। রমজান মাসের দিন, কাঠফাটা রোদ। রোজা রেখে রওয়ানা দিলেন কামরূপের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে। এক কিলোমিটার ই-রিকসা, তিন কিলোমিটার টেম্পো তারপর বাসে শরাইঘাট হয়ে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে গুয়াহাটি । এখানে উঠলেন নিজ ভাইয়ের ভাড়াঘরে। তিন বোন, দুই ভাই এক সাথে জড়ো হলেন ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে । ভোরের ট্রেনে গুয়াহাটি পল্টনবাজার রেলস্টেশন থেকে রওয়ানা দিলেন করিমগঞ্জের বদরপুর অভিমুখে।গুয়াহাটি - বদরপুর পাহাড়িয়া রাস্তার সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করলেন কিন্তু ভালো খাবারের ব্যবস্থা হলো না বাচ্চাদের জন্য। জীবনে প্রথম বার এতো দীর্ঘ যাত্রা। বিকেলে বদরপুর পৌঁছে একটি হোটেলে উঠলেন। সবাই ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে একটু রেস্ট করতে লাগলেন। ছোট ভাইটা বেরিয়ে পড়লো ভেরিফিকেশন সেন্টারের খোঁজে। ও পেশায় উকিল। গুয়াহাটি হাইকোর্টে কাজ করে।খোঁজ পেলো সেন্টারটা শহর থেকে ভিতরের দিকে গ্রামে। ফিরে এসে হোটেলে বিশ্রাম নিলো। পরেরদিন ভেরিফিকেশন। এখানে খাবার-দাবার মোটামুটি ভালোই । হোটেল থেকে রাত্রে খাবার নিয়ে রেখে দিলেন সেহরি খাবার জন্য। সেহরি সেরে, ফজরের নামাজ পড়ার পর আর কারো চোখে ঘুম আসলো না। ভোরের আলো দেখা দিলে বেরিয়ে পড়লেন অচেনা গ্রামের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে যে সেন্টারে উপস্থিত হলেন ওরা বললো এই সেন্টার না। গ্রামের অপর প্রান্তে আর একটা সেন্টার আছে সেখানে যেতে হবে। তড়িঘড়ি রওয়ানা দিয়ে পৌঁছলেন সেখানে। দুপুর অবধি অপেক্ষা করার পর ডাক আসলো। তারপর কাজ শেষ করে হোটেলে পৌঁছলেন।ব্যাগ-ট্যাগ গোছালেন । রাত্রে গুয়াহাটি অভিমুখী ট্রেনে করে যাত্রা শুরু করলেন। সারা রাত দুচোখে একটুও ঘুম আসলো না বেগমের। রাত একটা বা দুটোর মধ্যে ছোট ভাইটার ফোনটার রিং বেজে উঠলো। কেন যেন ফোনটা রিসিভ করে হুড়মুড় করে ট্রেনের বার্থ থেকে নেমে গেল। প্রায় পনেরো বা বিশ মিনিট পর চলে এলো। জিজ্ঞেস করলেন, - কী হয়েছে?
- কিছু না, তুমি একটু ঘুমাও বু।
- ঘুম আসছে না, মনটা ভালো লাগছে না ।
কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে পড়লো ভাইটা। বড় ভাই ঘুমাচ্ছিলেন। একবার উঠলেন ওয়াশরুমের দিকে গেলেন। পিছনে ছুটে গেল ছোট ভাইটা। তারপর এসে চুপচাপ শুয়ে পড়লো তারা। কোনো কথা বলছে না। বেগমও কিছু বলতে পারছেন না। নিস্তব্ধ ট্রেন ছুটে চলছে। সকালে গুয়াহাটি পৌঁছলে তারা একটা ভ্যানগাড়ি নিয়ে এসে বললো যে এখনি ফোন এসেছে বেগমের স্বামীর একটু শরীরটা খারাপ লাগছে তাই সবাই মিলে সোজা সেখানে গিয়ে তাঁকে দেখে আসবেন। বেগম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। তারা সান্ত্বনা দিলো - কিছু হয় নি।
গাড়ি ছুটে চলছে। সবাই চুপচাপ বসে আছে। গাড়ি গিয়ে পৌঁছলো বাড়ীর পাশে। বেগম গাড়ি থেকে হুড়মুড়য়ে নেমে যান বাড়ীর সদর দরজায়। উঠোন ভর্তি মানুষ। থমথমে পরিবেশ। পাগলের মত দৌড়ে গিয়ে দেখেন খাটের উপর শুয়ে আছে কেউ যেন, সাদা কাপড়ের নিচে। আর একটু এগিয়ে গিয়ে মুখটা দেখে মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান।
ছেলেরা মাকে দেখে কান্নায় লুটিয়ে পড়ে। আলীর মৃতদেহ পড়ে আছে খাটে। ঐ রাতে ভাত খাবার পর আলীর কী রকম যেন অস্বস্তি অনুভব হয়, বমি হয়। আলীর মা বুঝতে পেরে নাতিদের ডাকেন। রাত বারোটায় হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তার দেখে জানান যে সব শেষ, তার স্ট্রোক হয়েছিল। কতই বা বয়স হয়েছিল আলীর। পঞ্চাশ হবে। পুত্র শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন আলীর মা।তারপর কিছু দিন পর তিনিও চলে যান পরলোকে।
- তখন থেকে মা দুর্বল হয়ে পড়েছেন, আব্বার চলে যাওয়ার মুহূর্তে পাশে থাকতে না পারায় কেমন যেন হয়ে গেছেন। চোখ মুছতে মুছতে মুন্না বললো।
রহিমা সব শুনে শুধু চোখের জল মুছে আর তার মুখ দিয়েও বেরিয়ে আসে,
- হায় রে এন. আর. সি.-র হিয়ারিং!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন