“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২০

একটু নিজের কথাই বলি -- ৪ (গ)

।। সাদিক মোহাম্মদ লস্কর।।
০০২ সালে বাগপুরের রহিম উদ্দিন বড়ভূঁইয়া এক প্রস্তাব দিলেন একটি পত্রিকা প্রকাশ করার। সঙ্গে ছিলেন মাসতুতো ভাই রাজু আহমেদ চৌধুরি, বন্ধু কবির আহমেদ লস্কর ও আনোয়ারুল ইসলাম লস্কর। নাম দেওয়া হল ‘আজকের বরাক’। ২০০৩ সালের ১৫ এপ্রিল উন্মোচন করা হল বাঁশকান্দি নেনা মিয়া উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। অতিথি ছিলেন সাময়িক প্রসঙ্গের কর্ণধার তৈমুর রাজা চৌধুরি, উপত্যকার অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, অধ্যাপক আবিদ রাজা মজুমদার, অধ্যাপক আব্দুস সহিদ চৌধুরি, সাহিত্যিক নবদ্বীপ সিংহ, সমাজকর্মী খায়রুন নেসা চৌধুরি, আধিকারিক রণজিত কুমার লস্কর প্রমুখ। বেশ কয়েকটা সংখ্যা বের হয়। কিন্তু বেশিদুর এগোতে পারেনি। কবির তখন যুগশঙ্খ পত্রিকায় কাজ করত। আমি সেদিন তৈমুর রাজা চৌধুরির কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করলাম সাময়িক প্রসঙ্গ-তে সাংবাদিকতা করার। তিনি কয়েকদিন পরে সম্মতি দিলেন। এদিকে সোনার কাছাড় পত্রিকায় যোগ দিল আনোয়ার। তিনজন মিলে কাজ শুরু করলাম। দিন নেই, রাত নেই। সাময়িক প্রসঙ্গ তখন সবেমাত্র দৈনিক হয়েছে। সোনার কাছাড় অন্তিম লগ্নে। স্কুটার চালিয়ে উগ্রপন্থী অধ্যুষিত পয়লাপুল থেকে শুরু করে লাডুমা, হ্মারখৌলিয়েন, শিবস্থান, শিবপুরি, কুমাছড়া, বেকড়া ইত্যাদি স্থানে যেতে হত। দেখেছি উগ্রপন্থী (ডাকাত) আর নিরাপত্তারক্ষীদের বোঝাপড়ার সহাবস্থান। শরীরের লোম খাড়া হয়ে যেত দু’দিকের বন্দুকধারীদের দেখে। ওই সময় ইন্টারনেট ছিল না। সারাদিন ঘুরে খবর সংগ্রহ করে সন্ধ্যায় ঘুরে আসতাম। তারপর শিলচর গিয়ে পত্রিকা অফিসে বসে খবর লিখে ক্যামেরার রিল কেটে ফটো দিয়ে ঝড়-বৃষ্টি-কুয়াশা-ভয়ঙ্কর অন্ধকার ভেদ করে বাড়ি ফিরে আসতাম। মাঝে মাঝে হকার না আসলে নিজে পত্রিকা বিলিও করতাম। তারপর বাঁশকান্দিতে আবুল বড়ভূঁইয়ার দোকানে বলে কয়ে একটা ফ্যাক্স ম্যাশিন আনালাম। ধীরে ধীরে ওই দোকানে ইমেলের ব্যবহার শুরু হলে ফটো পাঠানোর ব্যবস্থাও করা হল। ২০০৫ সালে দু’হাজার টাকা দিয়ে একটা মোবাইল সিম কিনলাম। একটা নোকিয়া ১১০০ মডেলের সেট পেলাম। ২০০৯ সালে সাংবাদিকতাই ছেড়ে দিলাম। ২০১২ সালে প্রান্তজ্যোতি নতুন করে যাত্রা শুরু করার পর সেখানে কিছুদিন ডেস্কে কাজ করেছি মাধব ভট্টাচার্য, সঞ্জয় রায়, অসীম দত্ত, অসীম আচার্যদের তত্ত্বাবধানে। যাতায়াতের অসুবিধা আর আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য না থাকায় সেখানেও বেশিদিন কাজ করতে পারলাম না। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আবার নতুন করে নিজস্ব উদ্যোগে শুরু করেছি আরেক ধরণের সাংবাদিকতা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায় শেষ হলে তাকে বহু উপরে নিয়ে যেতে চাই।

 


বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেছি বেশ কিছু দিন। ইন্স্যুরেন্সে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমি খুব ভালো বিক্রেতা হতে পারিনি ঠিকই। কিন্তু রোজগার নেহাত কম করিনি। আর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল আমার ব্যক্তিত্বকে গড়ে তোলা। নানা প্রশিক্ষণ আমাকে অভ্যাসের জড়তা কাটিয়ে নিজেকে উপস্থাপন করা শিখিয়েছে। হ্যাঁ, কথার বা মেধার বাজারিকরণ আমার পক্ষে তেমন সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু কৈশোরের আঘাতের দগদগে ঘা সারাতে এই সব মানুষের সান্নিধ্য অনেক সাহায্য করেছিল। আনোয়ার, প্রদীপ সিংহ, দেবাশিষ চৌধুরি তাঁদের মধ্যে অগ্রণী। একটা ব্যাপার বড় মজার ছিল। আমি যখন সরকারি আধিকারিক বা প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির কাছে যেতাম কেমন যেন সব বাধা ডিঙিয়ে তাঁরা আমার একেবারে কাছে চলে আসতেন। কেউ একান্ত পারিবারিক বা ব্যক্তিগত ব্যাপারে মন খুলে কথা বলতে শুরু করে দিতেন। আবার কেউ প্রাচুর্যের ঘেরাটোপে নিজের নিঃসঙ্গতার ডায়েরি খুলে যেন আমার সামনে পড়ে শোনানো পছন্দও করতেন। ইন্স্যুরেন্স অ্যাডভাইজার থেকে ব্যক্তিগত পরামর্শদাতা বা আপনজন হয়ে যেতাম অনেকের। বোধ হয় অনেকের ক্ষেত্রেই এমন হয়, আর তাকেই কাজে লাগান তাঁরা। আমার পক্ষে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

 

আরও অনেক কিছু করেছি জীবনে। সব কথা পাঠকের জন্যে নয়। তার মানে এই নয় যে এসব গোপনীয় ব্যাপার। লিখছি না এই কারণেই যে পাঠকের অন্তরের তন্ত্রীতে সুর তুলতে পারবে না এসব। লিখে রাখব অন্য কোথাও। আরেকটা ব্যাপার সুর তুলতে পারে, আমাদের মনে হাসি-কান্নাময় আনন্দের সঙ্গীত বাজাতে পারে। সেটা কিন্তু পেশা নয় – প্রেম। বেশিদিন বাঁচলে বুড়ো বয়েসে লেখব। তখন এসব কারো সোনার সংসারে হানা দিলেও হাস্যকর হবে, ঘর ভাঙবে না।

 

একটা ঘটনার কথা বলি। ২০১২ সালে আমাকে কেউ গার্লফ্রেন্ডের কথা জিজ্ঞেস করত না, এমনকি বিয়ের কথাও না – সরাসরি জিজ্ঞেস করত 'ছেলেমেয়ে ক’টা'। এমনি এক সময়ে দিসপুরের এক লজের রিসেপশনে কে একজন যেন হঠাৎ আমাকে ডাক দিল পেছন থেকে। ঘুরে দেখলাম বছর পঞ্চাশের জিন্স পেন্ট টি-শার্ট পরা এক অসমিয়া ভদ্রলোক। আমাকে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বিয়ে করছ না কেন?’ অপরিচিত এই মানুষটিকে আমি গুরুত্ব না দেওয়ার চেষ্টা করলাম। সে আমাকে পাঁচটা কথা বলে উধাও হয়ে গেল। এর মধ্যে দুটি ছিল তখনকার অতীত বা বর্তমান – হুবহু মিলে গেল। তিনটি ভবিষ্যতের, তার মধ্যে দুটি মিলেই গেছে। রইল শুধু একটা। যা হিসেব করলে ২০২১ সালে হওয়ার কথা। আমি কিন্তু এসবে বিশ্বাস করি না। তবুও মনে একটা সুপ্ত প্রতীক্ষা রয়েছে সেই দিনটির। কোনও ভাবেই এই সম্ভাবনা দেখিনা, কারণ যা সম্ভাবনা ছিল সব করোনার আঘাতে দুমড়ে মুচড়ে পড়েছে।


কোন মন্তব্য নেই: