।। মাসকুরা বেগম।।
--- হ্যালো।
--- হ্যালো।
--- মাধুরী নাকি।
আমি ফাতিমা বলছি। চিনতে পারছিস।
--- ফাতিমা! তুমি
তুমি কি.... তুই কি আমার ছোটবেলার বন্ধু ফা-তি-মা ।
--- হ্যাঁ। তুই ঠিক
ধরতে পেরেছিস। কেমন আছিস রে। কী বলবো খুঁজে পাচ্ছি না। আমি ভীষণ
এক্সাইটেড........।
--- খুব ভালো আছি।
ফাতিমা তুই কেমন আছিস রে। আমি ও কী বলবো খুঁজে পাচ্ছি না। কোথা থেকে শুরু করবো।
কতো জমানো গল্প। এতো বছর পর তোর কণ্ঠস্বরটা শুনতে পাচ্ছি... সেটাই অনেক।
--- হ্যাঁ রে। কালকে
আশুতোষের সাথে দেখা হয়ে যায় ডিসট্রিক্ট অফিসে। তোর নাম্বারটা তার কাছ থেকে
পেয়েছি।
--- ও আচ্ছা। সে তো
হাইলাকান্দি কোনো এক স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্তি পেয়েছে। কোথায় আছিস তুই?
কী রকম চলছে? শিক্ষিকা হয়েছিস কি?
--- হাইলাকান্দি
বিয়ে হয়েছে আমার। হ্যাঁ, আমার শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ
হয়েছে রে।এখানেই এক সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করি। মিঃ মেডিকেল ডিপার্টমেন্টে
চাকুরী করেন। তোর কথা বল।
--- খুব ভালো লাগছে
তোর কথা শুনে। একটা মেডিক্যাল সাব-সেন্টারে এ এন এম নার্স হিসেবে কাজ করছি । আমার শিলচর মানে মামার বাড়ির পাশেই
বিয়ে হয়েছে। মিঃ এখানে পোস্ট অফিসে চাকরি করেন। তোর বাচ্চা-কাচ্চা আছে?
--- হ্যাঁ। দুই
মেয়ে। একজন ক্লাস ওয়ান আর একজন দু বৎসর হবে নেক্সট মাসে। তোর?
--- আমার এক ছেলে,
এক মেয়ে। একজন ক্লাস টু আর একজন ক্লাস নার্সারি।
ইত্যাদি অনেক কথা হলো দুই পুরাতন বান্ধবীর মধ্যে অনেক বছর
পর। আশুতোষ হচ্ছে মাধুরীর ছোট ভাই। তারা তিন বোন, এক ভাই।
ফাতিমারা দুই ভাই, দুই বোন।
মাধুরী আর ফাতিমা মাত্র তিন বৎসর একসাথে স্কুলে পড়তো
একই স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত।
তখন জানুয়ারি মাস। মধুপুর গ্রামের বড় রাস্তার দুপাশে
ছড়িয়ে আছে ধান ক্ষেতের মাঠ । গ্রামের কৃষকরা ধান কেটে তুলে নিয়েছেন নিজ ঘরে। খালি
মাঠ। শিশুরা খেলছে। ছেলেরা খেলছে। গরু ছাগল অবাধে চরছে মাঠে। কোনো কোনো জায়গায় সবজি
চাষ করেছেন কেউ কেউ। সুন্দর মনোরম দৃশ্য। শান্ত পরিবেশ। এই গ্রামেরই জন্ম ফাতিমা আর মাধুরীর।
রাস্তাটা কাঁচা ছিল। তাই গাড়ি ও চলতো না। পা নাহলে সাইকেলই
মানুষের ভরসা যাতায়াতের জন্য। শুকনো দিন ব্যক্তিগত গাড়ি চলতো। কিন্তু বর্ষার দিন
কাঁদা মেড়েই যেতে হয়। গাড়ি নিয়ে রাস্তায় উঠলে তো কথাই নেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে
চলে যেতে হবে সবুজ ধান ক্ষেতের মাঝে। বৃষ্টির সময় কাঁদা, তারপর হাঁটু জল মেড়ে যেতে
হয়। বন্যার সময় নৌকাই ভরসা। মধুবাজার থেকে প্রায় পাঁচ
কিলোমিটার বিস্তৃত গ্রামের রাস্তার অবস্থা এই ছিল। বাজার, স্কুল,
কলেজ, হাসপাতাল যেখানেই যান এভাবেই যেতে হতো।
একসময় মধুপুর গ্রামের এক পাড়ার কিছু লোক মৌমাছি পালন করতেন আর মধুবাজারে বিক্রি করতেন। এর থেকে এই গ্রামের আর
বাজারের নামকরণ বলে জানা যায়। বাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ফাতিমার বাড়ি আর প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে মাধুরীর বাড়ি।
গ্রামের ভিতরে ছিল দুটা পাঠশালা, একটা মক্তব ও একটা এম.ই. স্কুল ও একটা এম.ই.মাদ্রাসা ।
কিন্তু যারা একটু শিক্ষানুরাগী তারা মধুবাজারে অবস্থিত মধুবাজার এম.ই. স্কুলে
নিজের ছেলেমেয়েদের পাঠান । অনেক কষ্ট হয় যাতায়াতে। কিন্তু ঐ স্কুলটার পরিবেশ যে
ভালো।
ফাতিমার বাবা ছিলেন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সমাজসেবী।
নামে নয়, কাজে। শিক্ষার উন্নয়নে আশেপাশের
এলাকায় অনেক কাজ করেছেন। যার জন্য মানুষ যাতায়াতের কষ্ট স্বীকার করে ও শিক্ষা
অর্জনে আগ্রহী। মাধুরীর বাবার সেনাবাহিনীতে চাকুরী। তাই দেশের বিভিন্ন জায়গায়
ঘুরে বেড়াতে হয় ।
সেদিন পঞ্চম শ্রেণিতে নাম ভর্তির জন্য এসেছিল মাধুরী নাথ তার
বাবার সাথে। ছোট্ট, পাতলা গড়নের, মিষ্টি
মেয়ে। প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ আলিম এর সাথে খুব ভালো সম্পর্ক মাধুরীর বাবার। দেখা
করতে নিয়ে গিয়েছিলেন মেয়েকে। ভীষণ খুশি হয়ে উনি বলেছিলেন,
--- দাদা, আমার মেয়ে ও তো ক্লাস ফাইভে ।
বলে ডেকে আনলেন ফাতিমাকে। লম্বাটে, শ্যামলা মেয়ে, মুখে এক সরল হাসি।
--- ফাতিমা এ হচ্ছে
মাধুরী। আর মাধুরী এ হচ্ছে ফাতিমা। তোমরা একই ক্লাসের স্টুডেন্ট। যাও এক সাথে
খেল গিয়ে।
ফাতিমা মাধুরীর হাতটা ধরে নিয়ে গিয়েছিল বাইরে। একদিনেই ভাব জমে গিয়েছিল
দুজনের মধ্যে।
দুজনের স্কুলে যাত্রা শুরু হয়েছিল একসাথে। স্কুলে যাওয়ার
সময় মাধুরী এসে দাঁড়িয়ে থাকত ফাতিমার বাড়ির সামনে। ফাতিমা
অপেক্ষায় থাকত মাধুরীর। বিনা কারণে স্কুল কামাই করত না তারা কোনোদিন। ফাতিমা ছিল
লম্বা, তাই ছাতাটা ও ধরত। এক ছাতার ছায়ায় হয়ে যেত দুজনের।
একজনেরটা বন্ধ করে বই-পত্র কেরি করার এলুমিনিয়ামের বাক্সে রেখে দিত। দুজনে হাতে
বাক্স নিয়ে বিভিন্ন কথা বলতে বলতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কখন যে
পৌঁছে যেত স্কুলে, টেরই পেত না।
একই বেঞ্চে পাশাপাশি তো বসবেই দুজন। পড়াশোনায় দুজনই
মনোযোগী ছিল। আর পড়াশোনায় সহযোগিতা করত একে অপরকে বা অন্যান্য সহপাঠীদের ও। যখন
টিফিনের সময় হতো ছাত্র ছাত্রীদের হৈ-হুল্লোড় সাথে এলুমিনিয়ামের বাক্সগুলোর শব্দে স্কুল মাথার ওপর উঠে যেত ।
ফাতিমা আর মাধুরীর টিফিন ভাগাভাগি তো একটা রুটিন হয়ে গিয়েছিল, নাইলে তো তাদের খাবার হজমই হত না।
নাথপাড়া থেকে আরো ওদের সাথে যারা আসতো স্কুলে, একদিন একজন মাধুরীকে 'টুনটুনি'
বলে ডাক দিয়েছিল। ফাতিমা ঘুরে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘টুনটুনি কে রে?' মেয়েটি বলেছিল, 'কেন তুই জানিস না? মাধুরীর ডাক নাম টুনটুনি।'
একদিন ফাতিমা ডাক দিয়েছিল,
--- ও টুনটুনি...।
কোনো জবাব দেয় নি মাধুরী। মিষ্টি
মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিল তার। চোখ ছলছল করছিল। ফাতিমা তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেলেছিল।
--- কী হয়েছে তোর?
কথা বলেছিস না কেন?
মাধুরী কিন্তু নীরব।
--- আমার উপর অভিমান
হয়েছে নাকি। লক্ষ্মীটি বল না কিছু। কিছু না বললে আমি আর তোর সাথে কথা বলবো না।
বলে পাল্টা রাগ দেখিয়ে ছিল ফাতিমা।
--- তুই ও আমাকে ঐ
নামে ডাকলি।ঐ নামটা আমার একদম পছন্দ না। আমি দেখতে ছোট বলে ঐ নামে ডাকে।
--- কান ধরছি ভাই।
আর কোনো দিন তুই ঐ নামে ডাক শুনবি না।
ফাতিমা
মাধুরীর অজান্তে যারা তাকে টুনটুনি বলে তাদের বুঝিয়ে ছিল। আর কোনো দিন কেউ মাধুরীকে টুনটুনি বলতে শুনা যায় নি
স্কুলে।
সপ্তম শ্রেণির পরীক্ষা শেষে মাধুরীর একমাত্র মামা আর মামী এসে তার মা-বাবাকে ধরেছিলেন যে শিলচরে তাঁদের ঘরের পাশেই স্কুল-কলেজ সব আছে। মামা ব্যবসায়ী। মাধুরীর মামি চাকুরী করেন,
ছোট ছোট দুটা ছেলে, সংসার সব কিছু সামাল দিয়ে তাদের দিদিমার ভালো করে যত্ন করতে পারছিলেন না। তাই তাঁরা মাধুরীকে
সেখানে নিয়ে গিয়ে দিদিমার সাথে রাখতে চান আর অষ্টম শ্রেণিতে নাম ভর্তি করাতে চান। মাধুরীর মা-বাবা খুশি খুশি দিয়ে
দিয়েছিলেন তাকে। মেয়েটার এতো কষ্ট হয় স্কুলে যাতায়াত করতে। শিলচর টাউনে সব
সুবিধাই পাবে পড়াশোনার জন্য। তার ভালোই লাগছিলো, ভাবছিল,
"দিদিমা, মামা-মামি সবাই আদর করবে,
বাপন-পাপনদের সাথে খেলবে........।’
সেখানে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। ঘরের বেশি দূর না
স্কুল, প্রায় আধা কিলোমিটার মাত্র। সে কীসের
যেন এক অভাব অনুভব করছিল।
স্কুলে
গিয়ে ফাতিমাকে খুঁজত তাঁর মন। স্কুল আসা-যাওয়া করতে এই একটুখানি পথ যেন তার শেষ
হতো না। মনে পড়ে কীভাবে এতোটা পথ হেঁটে, কাঁদা মেড়ে, পানি ঠেলে স্কুলে যেতো তারা। বর্ষায়
হাওয়াই চপ্পল পরে কাঁদা মাখা রাস্তা দিয়ে তারা যখন যেত নীল রঙের স্কার্টটা
কাঁদায় প্রিন্টেড হয়ে যেতো। শুকনোর পর একজন আর একজনের স্কার্ট ঝেড়ে দিত। ছাতা
নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে আনন্দে আত্মহারা হয়ে তারা স্কুলে আসা-যাওয়া করতো।
মামাবাড়িতে বড় হয়ে উঠে ছিল মাধুরী। এখানে যে
হাইস্কুলে পড়েছিল সেই স্কুলের একজন শিক্ষক তাঁর একমাত্র পোস্টমাস্টার ছেলের বউ করে নিয়ে যান। মাধুরীর চারিত্রিক গুণাবলী
ও শিক্ষানুরাগ তাঁর খুব ভালো লেগেছিল। সুখী সংসার মাধুরীর।
ফাতিমাও কতো সহপাঠী বন্ধু পায় জীবনে চলার পথে কিন্তু
মাধুরীকে সযত্নে রেখে দেয় তার হৃদয়ের এক কোণে। নিজে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে
শিক্ষকতায় যোগদান করে।
এখন মধুপুরের সেই রাস্তা এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পাকা
হয়ে গেছে। অনবরত চলতে থাকে ই-রিকসা, অটো, টেম্পো, ভ্যান, ম্যাজিক, কার ইত্যাদি। গাড়ির
শব্দে এখন আর সেই শান্ত পরিবেশ নাই। রাস্তার দুপাশে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন পাকা বাড়ী-ঘর।
আর দেখা যায় না সেই বিস্তৃত কৃষি জমি। কৃষি কর্ম ও আগের মতো হয় না, কৃষি কর্মে ছেলেদের অনীহা কিংবা আলস্যের জন্য। ধান কাটার পর শুকনো মাঠে আর
আগের মতো শিশুদের বা ছেলেদের খেলতে দেখা যায় না। এখন অনেকেই ভিডিও গেম নিয়ে
ব্যস্ত, কেউবা টিউশন আর অত্যধিক পড়াশোনার চাপে খেলাধুলার
সময়ই পায় না। সরকারি স্কুলের ঐতিহ্য ও এখন বেসরকারি স্কুলের সম্মুখে ম্লান হয়ে
গেছে। তখন কাঁদা মাখা কাপড়েও যেখানে ছেলে-মেয়েরা বিন্দাস ছিল, আজকাল অল্প কলমের কালির দাগও লেগে গেলেই ছেলে-মেয়েরা হীনমন্যতায় ভোগে। মধুবাজারও
এখন অনেক বিস্তৃত, সমৃদ্ধ, উন্নত।
সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন তো স্বাভাবিক। কিন্তু পরিবর্তন
হয়নি দুটো হৃদয়ের। পাশাপাশি দুই জিলায় বসবাস করার পর ও ফাতিমা ও মাধুরীর মধ্যে
কোনো যোগাযোগ হয়নি। তখন ছিল যোগাযোগ মাধ্যমের অভাব। দুজনই রক্ষণশীল পরিবারের মর্যাদা
দিত। উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন করেনি কোনোদিন। কিন্তু দুজনের
হৃদয়ের মধ্যে ছোটবেলার ছবি, বন্ধুত্ব অম্লান হয়ে আছে। এতো
বছর পর ফাতিমা আর মাধুরী আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় হৃদয়ের মণিকোঠায় গচ্ছিত
প্রিয় জনকে ফোনে পেয়ে। কী যেন এক ভালোলাগা ছুঁয়ে যায় একজন আরেকজনের কন্ঠস্বর
শুনে।