“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

শাইনিং ইন্ডিয়া



         "বিড়ি জ্বালাইলে জিগর সে পিয়া..." কি সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার ভায়া। ঐ কন্যার জিগর থেইক্যা নাকি আগুন জ্বলে ! সেই আগুনে আবার বিড়ি ধরে ! খারাপ না ব্যাপারটা । মনটা খারাপ হইয়া গেল সকাল বেলাতেই গানটা শুনে। ‘আমার প্রিয়ার জিগরে শুধু জল ক্যানে !’
   মুম্বাইইয়ে কি মেয়েদের জিগর থিক্যা আগুন জ্বলে নাকি! আবার কলকাতা কয়, শূন্য এ বুকে...। বাংলাদেশ রেডিও আরও একটু সেন্টু সেন্টু সুরে বাজায়, ‘পাখী মোর আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয়...’।
দূর আজকাল এতো সেন্টু নিয়ে ডাকলে পাখিও পালায়! শুরুটাই করতে হবে আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, দিয়ে। মানে কোন অবস্থাতেই বলা বারণ, তোমার মনের কন্ডিশান। মুখে দাড়ি থাকতে হবেই। না হলে সিকোয়েন্সটা ঠিকঠাক জমবে না। বিড়ি টাইপের কালার হতে হবে শরীরের। কিন্তু ওয়াইল্ড স্টোন রাখতে হবে। পকেটে না বুকে ধরে রাখতে হবে পাথর, বুঝলে ভায়া! পাত্থরেরও নাকি আবার গন্ধ থাকে!

          বিড়ি বেশ সেন্টিমেন্টাল টাইপের হয়। মানে জ্বলে দুমদাম করে। কিন্তু একটু না টানলেই নিভে যায়। একটু অবজ্ঞা মানেই লেপের তলে সিটিয়ে থাকা নতুন বউয়ের নাক ডাকা। সিগারেটের কিন্তু সেই অর্থে এতো সেন্টু নেই। জীবন দিয়ে জ্বলবে। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই... টাইপ। হৃদয় একদম জ্বালাইয়া ছাই কইরা তবে তবে ছাড়ব। একদম কর্পোরেট দের মতো বিহেভ। রিফাইন্ তামাকের গুন নেই। একদম খাটি নেপালি তামাকের সাথে সিগারেটের তামাকের তুলনা চলে! আমার হৃদয় ঐ নেপালি বিড়ির পাতার মতো। সর্বদা শূন্য এ বুকের মতো খাঁ খাঁ করে।

         সকাল সকাল এই গানটা কানে আসতেই কত স্বপ্ন যে দেখে ফেললাম, লেপের তলায় ! সেটা সেন্সর করা। বলা বারণ। স্যরি উসখুস কইরা কোন লাভ নেই। এমন কিছুই ঘটেনি। এটা হিন্দি ফিল্ম   জিসম পার্ট ফোর নয় ভায়া।  মনটা শান্ত থাকা ভীষণ জরুরি পরবর্তী অংশ সহ্য করতে। আজকাল কথায় কথায় গান। সোনালী গানের এই এক সুবিধে সিকোয়েন্স বুঝে বোতাম টিপলেই হলো। সব রঙ্গিন, সব উত্তর হাতের কাছে, সব কিছু চোখের সামনে একদম ফকফকা। এরবেশী বলা বারণ...।
       সেদিন আমি আমার প্রেমিকাকে বললাম আমায় সত্যিই ভালবাস! কেন ভালোবাস? শেষ দু'বছরে প্রেমের এই চতুর্থ অধ্যায়ে এটাই সবচেয়ে বড় সময়ের ইনভেস্টমেন্ট আমার। মানে গোটা দশেক বই, ক্যাডবেরি, সিনেমা, আইসক্রিম খায় না গলায় ব্যাথা আছে, আর প্রেমের অভারঅল অপারেটিং কস্ট সর্বসাকুল্যে হাজার দুয়েক টেনেটুনে। মেয়েরা ভালবাসলে সব মেনে নেয়, তাই আমাদের কপালে প্রেম জোটে। দেখি পাত্তাই দেয়না আমার কথার। কানে মোবাইল ফোনের হেডফোন গুজে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। আবার শুধোলাম, ‘সত্যি বলোনা ভালবাসো আমায় ! কেন ভালবাসো’ ! কেমন জানি একবার চোখ টানটান করে তাকিয়ে আমার ডান কানে হেডফোন গুজে দিল। আবার চোখ বন্ধ করলো। মুখে বলল, ‘চুপ শোন শুধু, কথা বলোনা...’

            ইয়ার্কি পেয়েছে, অনিন্দ্য অনিন্দ্য বলে সকাল সন্ধ্যা কাৎরাচ্ছে আমার সামনে, আর এখন আবার কানেও কালা করে দেয়ার প্রয়াস। কিছুতেই হতে দেব না। আজ জবাব চাই। হেস্তনেস্ত করবোই আজ আমি। রাগে আমি কান থেকে হেড ফোন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গাছের পাতা গুনছি। কোন ভ্রূক্ষেপ নেই তার। গাছের গায়ে একপায়ে হেলান দিয়ে থাকতে থাকতে পা ধরে গেছে। সিগারেট শেষ। চোখ আর খোলেনা আমার দু'বছরের প্রেমিকা।

           রাগে উল্টোমুখো হয়ে পালাবো ভাবছি বিড়ি টানতে। কারণ মেয়েদের সামনে আর যাই হোক বিড়ি টানা যায়না। পকেট ফুটো ধোসার টাকা মিটিয়ে। চোখ খুলেছেন তিনি কাছে না পেয়ে। মেয়েরা বড্ড বেশি ভরসা করে তাদের সঙ্গীকে। আর তাই বোধহয় মেয়েরাও প্রেমে পড়ে কোন কোন সময়। শেষে পেছন থেকে এসে বলল, এতো রেগে যাও কেন! গানটা শুনেও রেগে গেলে!
- আমি কোন গানটান শুনিনি। আমার মন ভালো নেই। যা বলার তা তো বলেই দিয়েছ, আর গান শুনে কি হবে!
- আরে শোন না, অনিন্দ্য...
- মানে তোমার নতুন প্রেমিক!! বাহ কি করে ! ইঞ্জিনীয়ার না ডাক্তার!
- আরে তোমার প্রিয়...
- হ্যাঁ, তোমার যে প্রিয়, তাকে আমাকেও গিলতে হবে ! কেন ! হোম টোম নাকি তোমার অনিন্দ্য!
- আরে শোন না... বলা বারণ... অনিন্দ্য'র গানটা শুনতে বলেছিলাম। মেয়েরা সব কথা মুখে বলতে পারেনা।
- হুম, তা বলবে তো তুমি অনিন্দ্যর গানে আমার কথার উত্তর দিচ্ছ। বেবাট টাইপ হয়ে গেলাম। হাসলে আমায় সত্যিই বেবাট টাইপ লাগে। আমি জানি । ইশ, দুমদাম মন খারাপ করে ফেললাম। তবে এটাও ঠিক, শেষ তিন অধ্যায়ে দেখেছি, চলে যাওয়ার সময় ওড়নায় নখ প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বেশ বলে যেতে পারে মুখেই, বিদায় বন্ধু, ভাগ্যে নেই, তাই তুমি নেই। কি করবো তুমি তো একটা কিছুই করে উঠতে পারোনি এখনও । না বলে এসেছি, বাড়িতে প্রচুর মানুষ। রেন কোট টাইপ ভাগ্য আমার। ভাবি, এই অধ্যায় যদি ভাগ্যে থাকতো, কি যে হতো আমার অবস্থা ! এরচেয়ে অনেক ভালো আমার এই 'চার অধ্যায়'। এই নিয়ে দশবার গেছেন উনি, আর আজ নিয়ে এগারো বার আবার এন্ট্রি নিয়েছেন। উনি এলেই আমি 'শেষের কবিতা'র পাতা চোখে দেখি। চলে গেলে পড়ি জীবনানন্দ।

আমি যে একটু পাগল টাইপের তা আমি জানি। মানে কবি কবি ভাব, কিন্তু কবিতার অভাব। কস্মিনকালেও একটি কবিতা লিখতে পারিনি। তবে সে চলে গেলে কাব্য ভর করে মাথায়। একবার লিখেছিলাম । ক্লাশ টেন এ লিখেছিলাম -
'মাথার উপর নীল আকাশ,
পায়ের নিচে দূর্বাঘাস,
তোমার আমার পেছনে বরাক বাঁশ।'
মানে, বরাক বাশের উপর বসে ছিল মিষ্টি দিদিমণি আর নতুন স্যার। এই স্যারকে দেখলেই আমার পিত্তি জ্বলে যায়। মিষ্টি দিদিমণিকে দেখলেই, আমার মন ভালো হয়ে যেত। মোটেই 'ম্যারা নাম জোঁকার টাইপের' গল্প নয়। সবকিছুতে ঐ গন্ধ না খোঁজাই ভালো ! কী সুন্দর করে হাসতেন, নরম করে কথা বলতেন। ইস্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে দিদিমণির পাশে দাড়িয়ে গান গাইতাম। কী মিষ্টি গন্ধ পেতাম। সারাটা মাস রিহার্সাল চলতো, আমরা সবাই রাজা...
       আমি ভাবতাম একবার যদি দিদিমণির হাতটা ছুঁতে পারতাম! তাই লিখে ফেলেছিলাম ঐ কাব্য। আমার এই কবিতা পড়ে আর মুখ দর্শন করেননি আমার। আমায় দেখলেই ট্যারা করে তাকাতেন। সেই প্রথম ধাক্কা। আমার প্রেমের চার অধ্যায়ের মধ্যে অবশ্য এই দিদিমণিকে আমি ধরি না হাতে। এরপর থেকে আর সেই ছন্দের চেষ্টা করিনি। বাকিটা বলা বারণ। কী করে বুঝবো বল ? তুমি আমার হৃদয়ে সঙ্গীত ফিরিয়ে দিচ্ছ ! দেখুন এই আমার বদ অভ্যাস। সুযোগ পেলেই কাব্য করি। প্রেক্টিকেল হতে হবে, জানি কন্যা, দু'চার দিন বাদে কোন ডাক্তারের বুক জ্বালাইবা তুমি সক্কাল সক্কাল। বিড়ির মতো সেন্টু সেন্টু মুখ করে।

বিড়ি নিয়ে দৌড়াচ্ছি নদী পারের দিকে (হাসির কোন কারণ নাই, এই দেশের ষাট শতাংশ মানুষ এখনও ট্রেন লাইন, ফাঁকা মাঠ আর নদীর পাড়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারেন)। এরপরেও 'সাইনিং ইন্ডিয়া' ডুবে না। আমি তাই আপাতত ভাবছি কম পয়সায় পাকা ল্যাট্রিন বানানোর ব্যাবসা করবো। ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম লোন চাইতে। দেখে বলে দিল ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, ‘ওইটা বাকিতে হইব না’। কষ্ট হবে বুঝলেন ! কোষ্ঠকাঠিন্য ব্যাবসায় ওয়ালমার্ট লগ্নী করবে না। কাগজের তিন নম্বর পেইজটা পড়বেন। বুঝলেন ! ব্যাবসার পাতা । আপনাদের মতো তরুণ ব্যাবসায়ীদের জন্য কতো বড় বাজার ! ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি চায়। কিছু গ্যারান্টি দিতে পারবেন !
- আপনি কি বিবাহিত ! আমার এই প্রশ্নে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার।
- হুম বিবাহিত।
- মেয়ে আছে ! কোন কলেজে পড়ে !
- সুরেন্দ্রনাথে ! ইংলিশ নিয়ে পড়ছে !
- হ্যাঁ তো কেন ! আমার মেয়েকে চেনেন আপনি !
- হ্যাঁ আমার প্রেমিকা । আপনি উনার বাবা। মানে আমার পরবর্তী শ্বশুর।
চিৎকার করছেন ভদ্রলোক। অবস্থা ভালো নয় বুঝতে পারছি। চা তখনো শেষ হয়নি। এক চুমুকে শেষ করলাম। নিজের মেয়ের কথা অধস্তনদের কাছে ফলাও করে বলবে না জানি। চেয়ার থেকে উঠে গিয়েও আবার বসে পড়েছেন। খুব শান্ত হয়ে বললাম, ‘আমার সঙ্গে ক্লাশ টুয়েলভ থেকে প্রেম করছে । লাস্ট টু ইয়ারে আমার সব ইনভেস্টমেন্ট আপনার ঐ মেয়ের কাছে । সেই আমার সিকিউরিটি আপাতত। চলবে’ ?
ভদ্রলোক ঘামছেন । বললেন, ‘তুমি বাড়ি এসো, পরে কথা হবে। গার্ড...’
- লোনটা দেবেন, সিকিউরিটি আমার আপনার ঘরে গচ্ছিত। সত্যি বলছি রিটার্ন পাবেই ব্যাঙ্ক।
- তুমি যাবে !
--‘না’ স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম। ‘লোনটা না পেলে আমি যাবো না। আর বের করে দিলে সবাইকে জানিয়ে যাবো, আপনি আমার পরবর্তী হবু শ্বশুর হয়েও আমাকে বিশ্বাস করেন না। আপনার মেয়ের কাছে আমার সব জমানো গচ্ছিত। এখন সে অনুপমের সঙ্গে প্রেম করছে । আমায় ছেড়ে দিয়েছে । বলেছে আমি নাকি কোন কাজের না। প্রমাণ আছে সব। চিঠি, ইনবক্সে মেসেজ, ফোন কল, ছবি...’।
- তুমি কি পাগল ! ইয়ার্কি মারছো সাত সক্কাল বেলা । কত ইনভেস্ট করেছো টু ইয়ার্সে !
- মানে এমাউন্ট টা কতো ! কেন দিয়েছ !
- টু ইয়ার্সে চারবার। তেত্রিশ লক্ষ ইন্টু চার, মানে ওয়ান ক্রোড়ের কাছাকাছি।
ভদ্রলোকের কপাল থেকে ঘাম এবার দুম করে ঝরে পড়ল আমার প্রজেক্টের উপর। ঘামছে, শুধু ঘামছে ।
- ইয়ার্কি পেয়েছ ! চুরি করো নাকি !
- হ্যাঁ চুরি করেই, আপনার ফ্ল্যাটে দু'বার। আর বন্ধুর ঘরে দু'বার।
- মানে ! আমার ঘরে তো চুরি হয়নি কোনদিন ! তুমি কি পাগল ! উন্মাদ ! যাও বেরিয়ে যাও এখুনি।
- থাক সেই হিসেব করবেন না । লোনটা সেংশান করে দিন । চলে যাচ্ছি ।
- কোনমতেই না ।
- ঠিক আছে । তাহলে ডাকাতিটা আজ সেরেই ফেলি বলুন !
- মানে ? কি ডাকাতি । ভয় দেখাচ্ছ ! গার্ড...
- মানে আজ আমরা পালাবো। আমি আর আপনার মেয়ে । আমার শেষ দুবছরের ইনভেস্টমেন্ট  আর আপনার একুশ বছরের...।
- আমি পুলিশে জানাচ্ছি ।
- জানান, আমরা লিগ্যাল মেরেজ সেরে নিয়েছি। শুধু টাকা নেই তাই লোন চাইতে এসেছি । দেখুন এটা একটা ব্যাবসা শুধু নয়, মানুষের জন্যেও কাজ হবে এতে। কত মানুষ বাঁচবে বলুন। এই যেখানে সেখানে...
- থাক। আর বলতে হবে না । আমার একুশ বছরের ইনভেস্টমেন্ট চুরি করেছ । লোনটা হয়ে যাবে। নেক্সট উইকে এসে একবার দেখা করো। এখানে নয় বাড়িতে আসবে । তোমার বাবাকে নিয়ে আসবে সঙ্গে।
- এই রে। কেন বাবাকে দিয়ে কি হবে?
- আমার মেয়ের গ্যারেন্টার।

ব্যাঙ্ক থেকে যখন বেরিয়ে এলাম, তখন দেখি রাইজিং ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপনটা সত্যিই ঝকঝক করছে। ও দাঁড়িয়েছিল নিচেই। ভয়ে চোখমুখ ফ্যাকাসে। জানতে চাইলো কি বলল বাবা !
বলা বারণ... ইন্ডিয়া শাইনিং । কিন্তু আকাশে মেঘ আজও । জানিনা কপালে কি আছে। মেঘ না রোদ্দুর ! যাই থাক থাক, তুই থাক, শূন্য এ বুকে থেকেই যা তুই ।