(লেখাটি ২০১২ তে 'দৈনিক যুগশঙ্খ' পত্রিকায় প্রকাশিত। ভাসা ভাসা ভাষা-প্রেম নিয়ে বিভিন্ন সময় নিজের ভাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এ লেখাটিও সেভাবেই লেখা। ---মৃন্ময় দেব)
প্যারিসের জেহান রিক্টাস স্কোয়ারের একটি দেয়ালে মানবিক ঐক্যের প্রতীক স্বরূপ ইউনেস্কোর অন্তর্ভুক্ত ও বহির্ভূত বহু দেশের নিজস্ব ভাষায় ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ কথাটি লেখা রয়েছে । দেয়াল জুড়ে পরস্পর অপরিচিত ও অচেনা অক্ষরমালার এমন সহাবস্থান যেন এই কথাই বলতে চায় যে, ‘তুমি আমার ভাষা বলো আমি আনন্দকে দেখি / আমি তোমার ভাষা বলি তুমি আশ্চর্যকে দেখো’ । কিন্তু বাস্তবে এরকম ‘আনন্দে-আশ্চর্যে সাক্ষাৎকার’ তো দূর অস্ত , ‘আমি আমার ভাষা বলি তুমি তোমার ভাষা বলো’-গোছের সহনশীলতার পর্যায়েও পৌঁছতে পারেনি সভ্যতার বড়াই করা এ পৃথিবীর মানুষ । না, একুশ শতকের একটা দশক পাড়ি দিয়েও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ পতাকায় পতাকায় ফের মিল আনবে এমন আশা আমাদের পক্ষে আজো দুরাশা বইকি !
একুশে ফেব্রুয়ারি । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস । ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর ৩০তম অধিবেশনে এই দিনটি উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । তারপর থেকে সদস্য দেশগুলোয় সরকারি-বেসরকারি , প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক নানান উদ্যোগে নানা ভাবে ‘মাতৃভাষা দিবস’ পালিত হয়ে আসছে । ভারতবর্ষেও হচ্ছে অবশ্যই । তবে তা মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সেমিনার , সভা-সমিতি, মিটিং-মিছিল , কিছু সরকারি উদ্যোগ , আর পত্র-পত্রিকার এলোমেলো নিবন্ধাদিতে সীমিত থাকছে । জনসমাজে তার প্রভাব প্রায় নেই বললেই চলে । ভাষা-সচেতনতা বলতে যা বোঝায় তা বস্তুত আমাদের তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তদের মধ্যেও দুর্লভ । ভাসা-ভাসা ভাষা-প্রেম সম্বল করেই তাই নিয়ম-মাফিক চলে ‘একুশে’র বাৎসরিক উদযাপন । ‘শহিদের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ ! না, পারি না ; সারা বছর ভুলে থাকতে পারলেও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ দিনটিতে তা পারি না । বাঙালি অতটা আত্মবিস্মৃত জাতি নয় অবশ্যই । বরাক উপত্যকার বাঙালির কাছে ‘উনিশ’ আর ‘একুশ’ মিলেমিশে একাকার । এই পারে ‘উনিশ’, ওই পারে ‘একুশ’ – ভাষা নদীর দুই কূল জুড়ে একই ইতিহাস ।
গোটা বিশ্বে কম বেশি ছ’হাজার ভাষা রয়েছে , যার হাজার তিনেক এ শতাব্দির শেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে । বিশেষজ্ঞদের এরকমই অভিমত । বিশ্বায়নের জাঁতাকলে অবস্থা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে প্রতিনিয়ত । অঞ্চল বিশেষে এই জটিলতার মাত্রা ও পরিধি কেবল ভিন্ন নয় , প্রায় চরমে পৌঁছে গেছে । হাতের কাছের উদাহরণ আমাদের প্রিয় রাজ্য অসম । কিন্তু এরকম এক জটিল পরিস্থিতিতে , যেখানে প্রতিদিন কোন না কোন ভাষার সলিল সমাধি ঘটছে কিংবা ঘটার উপক্রম হচ্ছে , মাতৃভাষার সুরক্ষা আদৌ সম্ভব কি না সেটাই এক কঠিন জিজ্ঞাসা । এই প্রশ্নচিহ্নের ভূমিতে দাঁড়িয়েই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের’ প্রাসঙ্গিকতা বিচার্য । মাতৃভাষার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার সম্পর্কই বা কি এবং কতটুকু সেটাও বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি । Nobel Laureate Mr. Hallor Laxness-এর মন্তব্য এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য – ‘the world becomes a poorer place whenever an international language swallows up a smaller one, but the international language becomes no richer for doing so... ’ ।
মাতৃভাষা হচ্ছে চিন্তা-চেতনার আঁতুর ঘর । মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে সংস্কৃতির সারস্বত বৃত্তটি । মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা তাই সমগোত্রীয় । ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগ হরিহর আত্মার । সংস্কৃতির বৈচিত্র আসলে বহুরূপে বিশ্বের অবলোকন , জীবন রহস্যের বহুমাত্রিক প্রতিফলন । সংস্কৃতির সমন্বয়ই হল বৈশ্বিক উপলব্ধির একমাত্র পথ । এই সমন্বয় যদি কাঙ্ক্ষিত হয় তাহলে ভাষার মৃত্যু প্রতিরোধ করতেই হবে । মাতৃভাষার অধিকার তারাই দাবি করতে পারে প্রতিটি ভাষাকে যারা বৃহত্তর মানব পরিবারের সম্পদ জ্ঞানে সমমর্যাদা দিতে উৎসুক । ভাষাগত বিভেদ কিংবা সংস্কৃতির সংঘাত নিঃসন্দেহে শান্তি ও মৈত্রীর পরিপন্থী । সে কারণেই ১৯৯৯ সালের উল্লিখিত অধিবেশনে Kofi Annan সময়োচিত মন্তব্য করেছিলেন যে - ‘ the lesson of our age is that languages are not mutually exclusive, but that human beings and humanity itself are enriched by communicating in more than one language .’ ।
বহু ভাষা ও বিবিধ সংস্কৃতির মিলনে গড়ে ওঠা সমাজ (Multilingual multicultural society) ব্যতীত মানব জাতির মুক্তি অসম্ভব । বিভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্রকে স্বীকার করে নিয়েই সৃষ্টি হতে পারে বিশ্বমানবের নয়া বিশ্বসংস্কৃতি । এছাড়া বিশ্বশান্তির অন্যতর সম্ভাবনা আপাতত দৃষ্টিগোচর নয় । ‘সিভিল সোসাইটি’ গুলিকে এ বিষয়ে সচেতন হয়ে কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে । আঞ্চলিক বৈশিষ্ট রক্ষা করার সাথে সাথে বিশ্ব-সংস্কৃতির সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ গড়ে তুলতেও হবে । শেকড়ে থাকবে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির সংহতি , আর শাখার বিস্তারে আন্তর্জাতিকতার বোধ । বিশ্ব-নাগরিক হয়ে ওঠার এই প্রয়াস ব্যতীত বিশ্বশান্তির স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে । অথচ বাস্তবে ঘটছে ঠিক উল্টো । বাচনে ভাষণে যেখানে বিবিধের মাঝে মিলনের এত অসংখ্য অপরূপ বিজ্ঞাপন সেক্ষেত্রে বাস্তবে বিরোধ কেন ? এক কথায় একেবারে সহজ উত্তর একটা দেওয়া যায় অবশ্যই , এবং সেটা একেবারে ভুল উত্তরও নয় । উত্তরটা হল – বিশ্বায়নের বিশ্বজোড়া বিভেদনীতি । যে কোন জাতির ভাষা-সংস্কৃতি যদি কেড়ে নেওয়া যায় তাহলে সেই জাতিকে পদানত করা নিতান্ত সহজ হয় । সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসাবে এই পদ্ধতি বারে বারে যে অনুসৃত হয়েছে সে সাক্ষ্য তো ইতিহাসের পরতে পরতে ছড়ানো । বিশ্বায়নের বাজারকেন্দ্রিক অভিযান তাই সংস্কৃতিহীনতার এক বাতাবরণ তৈরিতে তৎপর । প্রতিটি ভাষাই আজ , এমনকি ইংরেজিও , কোন না কোন ভাবে এই বাজার কর্তৃক আক্রান্ত । পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন ভাষা-সংস্কৃতিকে বেঁচে থাকতে হলে অতি অবশ্যই এই মুনাফা-কেন্দ্রিক বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে । পরিবর্তে গড়ে তুলতে হবে মানুষ-কেন্দ্রিক এক নয়া বিশ্বায়নের চেতনা । এটা সম্ভব হতে পারে কেবল জাতিগুলির সামূহিক ঐক্যের ভিত্তিতে । আর , বলা বাহুল্য , সেরকমের ঐক্য গড়ে তোলার প্রাথমিক শর্তই হল পরস্পরের ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ।
কিন্তু বিশ্বায়নের তুখোড় কৌশুলিরা দুনিয়াটাকে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিতে চায় বাজার দখলের স্বার্থে । মানুষের সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক মানবিক সম্পর্ককে হটিয়ে দিয়ে ওরা চায় ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক বহাল করতে । সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের এটাই মূল নীতি । মুশকিল হচ্ছে , আমাদের সমাজের অনেক জ্ঞানী গুণীও এই বিশ্বায়নের পালে হাওয়া দিয়ে যাচ্ছেন , চার দেয়ালের নিরাপদ ঘেরাটোপে বসে বাতানুকুল তত্ত্ব হাজির করছেন । একদিকে বিশ্বজোড়া ক্রমবর্ধমান দারিদ্র , খাদ্য সংকট , আর আরেক দিকে ভোগ-বিলাস ও অন্যায় অপচয় । বিশ্বের বিক্ষুব্ধ মানুষ শোষণ বঞ্চনার দুর্গে ঐক্যবদ্ধ বিস্ফোরণ না ঘটিয়ে বসে তার জন্যই ভাষা ও ধর্মের নামে দিশাহীন জাতিগোষ্ঠী গুলিকে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার নিকৃষ্ট রাজনীতিকে হাতিয়ার করা হচ্ছে । আর অন্যদিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপনের নাটকীয় আয়োজনের মাধ্যমে মুনাফাখোর মুখগুলিকে খানিকটা মানবীয় আদল দেবার হাস্যকর প্রয়াস নজরে আসছে ।
তবে এও ঠিক যে , ভাষা কেন্দ্রিক বিভেদের রাজনীতি চোখে আঙুল দিয়ে এটাও দেখিয়ে দিচ্ছে যে বহুভাষিক ঐক্য ও বিবিধ সংস্কৃতির সমন্বয় বস্তুত সম্ভব । এই সম্ভাবনার উপলব্ধিটাই খুব জরুরি এসময় । ভাষার সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতির সম্পর্কটাও বুঝতে হবে । বুদ্ধদেব বসু বহুদিন আগে এ বিষয়ে সচেতন হতে বলেছিলেন তাঁর একটি নিবন্ধে । আধুনিক সমাজে ভাষাকে কেবলমাত্র মনের ভাব প্রকাশের উপায় বা মাধ্যম রূপে বিবেচনা করাটা যথার্থ বুদ্ধিমানের কাজ নয় । কেননা , জীবনযাপনের বর্ধিষ্ণু জটিলতা ভাষার ঘাড়ে বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে । মৌলিক ভাবগুলির বিনিময় ভাষার ব্যবহার ব্যতিরেকেও হয়তবা সম্ভব , কিন্তু ‘আমাকে ভোট দিন’ কথাটা বোঝাতে ভাষাটা চাই-ই । এই বাড়তি বোঝা কাঁধে চাপার দরুণ শুরু হল এক নয়া অধ্যায় – অন্যতর প্রয়োজনে ভাষার অ-স্বাভাবিক অ-মানবিক ব্যবহার । প্রকৃত বিচারে ভাষার সংকটের মূল এখানেই । দ্বন্দ্বটা আসলে জনসাধারণের ভাষার জনবিরোধী ব্যবহারের প্রক্রিয়ার মধ্যে নিহিত । রাজনীতির কূট চাল এই দ্বন্দ্বকে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত করে , যার অনিবার্য ফল অর্থহীন হানাহানি , অযথা রক্তপাত । এর হাত থেকে রেহাই পেতে হলে আমাদের ব্যাপক অর্থে ‘ভাষায় এক ভালবাসায় এক মানবতায় এক’ হতেই হবে । বিশ্বের সব ভাষার মানুষই যেন আজ নিজস্ব শব্দমালায় ‘occupy wall street’ কথাটা দেয়ালে দেয়ালে লিখে দিতে চায় । এই প্রেক্ষাপট মনে রেখে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত ও সঙ্কল্প যদি গৃহীত হয় তবেই তা আনুষ্ঠানিক আবেগের মঞ্চ-প্রদর্শনী না হয়ে উপযুক্ত মাত্রা লাভ করতে পারে । নতুবা উনিশের ভূমিতে একুশের চেতনা একদিন নূতন ঊষার সংবাদ বয়ে আনবে সে আশা দুরাশা হয়েই থেকে যাবে!
(C) Picture:ছবি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
লেখাটা ইচ্ছে করলে এখানেও পড়তে পাবেনঃ '
Ekusher Prasongikota ' লেখা অংশে ক্লিক করুন। চলে যাবেন স্ক্রাইবডে। সেখান থেকে এটা নামিয়ে, কিম্বা না নামিয়ে কম্পিটারের পর্দা জুড়ে পড়তে পারবেন।
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
প্যারিসের জেহান রিক্টাস স্কোয়ারের একটি দেয়ালে মানবিক ঐক্যের প্রতীক স্বরূপ ইউনেস্কোর অন্তর্ভুক্ত ও বহির্ভূত বহু দেশের নিজস্ব ভাষায় ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ কথাটি লেখা রয়েছে । দেয়াল জুড়ে পরস্পর অপরিচিত ও অচেনা অক্ষরমালার এমন সহাবস্থান যেন এই কথাই বলতে চায় যে, ‘তুমি আমার ভাষা বলো আমি আনন্দকে দেখি / আমি তোমার ভাষা বলি তুমি আশ্চর্যকে দেখো’ । কিন্তু বাস্তবে এরকম ‘আনন্দে-আশ্চর্যে সাক্ষাৎকার’ তো দূর অস্ত , ‘আমি আমার ভাষা বলি তুমি তোমার ভাষা বলো’-গোছের সহনশীলতার পর্যায়েও পৌঁছতে পারেনি সভ্যতার বড়াই করা এ পৃথিবীর মানুষ । না, একুশ শতকের একটা দশক পাড়ি দিয়েও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ পতাকায় পতাকায় ফের মিল আনবে এমন আশা আমাদের পক্ষে আজো দুরাশা বইকি !
একুশে ফেব্রুয়ারি । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস । ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর ৩০তম অধিবেশনে এই দিনটি উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । তারপর থেকে সদস্য দেশগুলোয় সরকারি-বেসরকারি , প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক নানান উদ্যোগে নানা ভাবে ‘মাতৃভাষা দিবস’ পালিত হয়ে আসছে । ভারতবর্ষেও হচ্ছে অবশ্যই । তবে তা মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সেমিনার , সভা-সমিতি, মিটিং-মিছিল , কিছু সরকারি উদ্যোগ , আর পত্র-পত্রিকার এলোমেলো নিবন্ধাদিতে সীমিত থাকছে । জনসমাজে তার প্রভাব প্রায় নেই বললেই চলে । ভাষা-সচেতনতা বলতে যা বোঝায় তা বস্তুত আমাদের তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তদের মধ্যেও দুর্লভ । ভাসা-ভাসা ভাষা-প্রেম সম্বল করেই তাই নিয়ম-মাফিক চলে ‘একুশে’র বাৎসরিক উদযাপন । ‘শহিদের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ ! না, পারি না ; সারা বছর ভুলে থাকতে পারলেও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ দিনটিতে তা পারি না । বাঙালি অতটা আত্মবিস্মৃত জাতি নয় অবশ্যই । বরাক উপত্যকার বাঙালির কাছে ‘উনিশ’ আর ‘একুশ’ মিলেমিশে একাকার । এই পারে ‘উনিশ’, ওই পারে ‘একুশ’ – ভাষা নদীর দুই কূল জুড়ে একই ইতিহাস ।
গোটা বিশ্বে কম বেশি ছ’হাজার ভাষা রয়েছে , যার হাজার তিনেক এ শতাব্দির শেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে । বিশেষজ্ঞদের এরকমই অভিমত । বিশ্বায়নের জাঁতাকলে অবস্থা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে প্রতিনিয়ত । অঞ্চল বিশেষে এই জটিলতার মাত্রা ও পরিধি কেবল ভিন্ন নয় , প্রায় চরমে পৌঁছে গেছে । হাতের কাছের উদাহরণ আমাদের প্রিয় রাজ্য অসম । কিন্তু এরকম এক জটিল পরিস্থিতিতে , যেখানে প্রতিদিন কোন না কোন ভাষার সলিল সমাধি ঘটছে কিংবা ঘটার উপক্রম হচ্ছে , মাতৃভাষার সুরক্ষা আদৌ সম্ভব কি না সেটাই এক কঠিন জিজ্ঞাসা । এই প্রশ্নচিহ্নের ভূমিতে দাঁড়িয়েই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের’ প্রাসঙ্গিকতা বিচার্য । মাতৃভাষার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার সম্পর্কই বা কি এবং কতটুকু সেটাও বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি । Nobel Laureate Mr. Hallor Laxness-এর মন্তব্য এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য – ‘the world becomes a poorer place whenever an international language swallows up a smaller one, but the international language becomes no richer for doing so... ’ ।
মাতৃভাষা হচ্ছে চিন্তা-চেতনার আঁতুর ঘর । মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে সংস্কৃতির সারস্বত বৃত্তটি । মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা তাই সমগোত্রীয় । ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগ হরিহর আত্মার । সংস্কৃতির বৈচিত্র আসলে বহুরূপে বিশ্বের অবলোকন , জীবন রহস্যের বহুমাত্রিক প্রতিফলন । সংস্কৃতির সমন্বয়ই হল বৈশ্বিক উপলব্ধির একমাত্র পথ । এই সমন্বয় যদি কাঙ্ক্ষিত হয় তাহলে ভাষার মৃত্যু প্রতিরোধ করতেই হবে । মাতৃভাষার অধিকার তারাই দাবি করতে পারে প্রতিটি ভাষাকে যারা বৃহত্তর মানব পরিবারের সম্পদ জ্ঞানে সমমর্যাদা দিতে উৎসুক । ভাষাগত বিভেদ কিংবা সংস্কৃতির সংঘাত নিঃসন্দেহে শান্তি ও মৈত্রীর পরিপন্থী । সে কারণেই ১৯৯৯ সালের উল্লিখিত অধিবেশনে Kofi Annan সময়োচিত মন্তব্য করেছিলেন যে - ‘ the lesson of our age is that languages are not mutually exclusive, but that human beings and humanity itself are enriched by communicating in more than one language .’ ।
বহু ভাষা ও বিবিধ সংস্কৃতির মিলনে গড়ে ওঠা সমাজ (Multilingual multicultural society) ব্যতীত মানব জাতির মুক্তি অসম্ভব । বিভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্রকে স্বীকার করে নিয়েই সৃষ্টি হতে পারে বিশ্বমানবের নয়া বিশ্বসংস্কৃতি । এছাড়া বিশ্বশান্তির অন্যতর সম্ভাবনা আপাতত দৃষ্টিগোচর নয় । ‘সিভিল সোসাইটি’ গুলিকে এ বিষয়ে সচেতন হয়ে কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে । আঞ্চলিক বৈশিষ্ট রক্ষা করার সাথে সাথে বিশ্ব-সংস্কৃতির সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ গড়ে তুলতেও হবে । শেকড়ে থাকবে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির সংহতি , আর শাখার বিস্তারে আন্তর্জাতিকতার বোধ । বিশ্ব-নাগরিক হয়ে ওঠার এই প্রয়াস ব্যতীত বিশ্বশান্তির স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে । অথচ বাস্তবে ঘটছে ঠিক উল্টো । বাচনে ভাষণে যেখানে বিবিধের মাঝে মিলনের এত অসংখ্য অপরূপ বিজ্ঞাপন সেক্ষেত্রে বাস্তবে বিরোধ কেন ? এক কথায় একেবারে সহজ উত্তর একটা দেওয়া যায় অবশ্যই , এবং সেটা একেবারে ভুল উত্তরও নয় । উত্তরটা হল – বিশ্বায়নের বিশ্বজোড়া বিভেদনীতি । যে কোন জাতির ভাষা-সংস্কৃতি যদি কেড়ে নেওয়া যায় তাহলে সেই জাতিকে পদানত করা নিতান্ত সহজ হয় । সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসাবে এই পদ্ধতি বারে বারে যে অনুসৃত হয়েছে সে সাক্ষ্য তো ইতিহাসের পরতে পরতে ছড়ানো । বিশ্বায়নের বাজারকেন্দ্রিক অভিযান তাই সংস্কৃতিহীনতার এক বাতাবরণ তৈরিতে তৎপর । প্রতিটি ভাষাই আজ , এমনকি ইংরেজিও , কোন না কোন ভাবে এই বাজার কর্তৃক আক্রান্ত । পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন ভাষা-সংস্কৃতিকে বেঁচে থাকতে হলে অতি অবশ্যই এই মুনাফা-কেন্দ্রিক বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে । পরিবর্তে গড়ে তুলতে হবে মানুষ-কেন্দ্রিক এক নয়া বিশ্বায়নের চেতনা । এটা সম্ভব হতে পারে কেবল জাতিগুলির সামূহিক ঐক্যের ভিত্তিতে । আর , বলা বাহুল্য , সেরকমের ঐক্য গড়ে তোলার প্রাথমিক শর্তই হল পরস্পরের ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ।
কিন্তু বিশ্বায়নের তুখোড় কৌশুলিরা দুনিয়াটাকে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিতে চায় বাজার দখলের স্বার্থে । মানুষের সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক মানবিক সম্পর্ককে হটিয়ে দিয়ে ওরা চায় ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক বহাল করতে । সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের এটাই মূল নীতি । মুশকিল হচ্ছে , আমাদের সমাজের অনেক জ্ঞানী গুণীও এই বিশ্বায়নের পালে হাওয়া দিয়ে যাচ্ছেন , চার দেয়ালের নিরাপদ ঘেরাটোপে বসে বাতানুকুল তত্ত্ব হাজির করছেন । একদিকে বিশ্বজোড়া ক্রমবর্ধমান দারিদ্র , খাদ্য সংকট , আর আরেক দিকে ভোগ-বিলাস ও অন্যায় অপচয় । বিশ্বের বিক্ষুব্ধ মানুষ শোষণ বঞ্চনার দুর্গে ঐক্যবদ্ধ বিস্ফোরণ না ঘটিয়ে বসে তার জন্যই ভাষা ও ধর্মের নামে দিশাহীন জাতিগোষ্ঠী গুলিকে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার নিকৃষ্ট রাজনীতিকে হাতিয়ার করা হচ্ছে । আর অন্যদিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপনের নাটকীয় আয়োজনের মাধ্যমে মুনাফাখোর মুখগুলিকে খানিকটা মানবীয় আদল দেবার হাস্যকর প্রয়াস নজরে আসছে ।
তবে এও ঠিক যে , ভাষা কেন্দ্রিক বিভেদের রাজনীতি চোখে আঙুল দিয়ে এটাও দেখিয়ে দিচ্ছে যে বহুভাষিক ঐক্য ও বিবিধ সংস্কৃতির সমন্বয় বস্তুত সম্ভব । এই সম্ভাবনার উপলব্ধিটাই খুব জরুরি এসময় । ভাষার সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতির সম্পর্কটাও বুঝতে হবে । বুদ্ধদেব বসু বহুদিন আগে এ বিষয়ে সচেতন হতে বলেছিলেন তাঁর একটি নিবন্ধে । আধুনিক সমাজে ভাষাকে কেবলমাত্র মনের ভাব প্রকাশের উপায় বা মাধ্যম রূপে বিবেচনা করাটা যথার্থ বুদ্ধিমানের কাজ নয় । কেননা , জীবনযাপনের বর্ধিষ্ণু জটিলতা ভাষার ঘাড়ে বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে । মৌলিক ভাবগুলির বিনিময় ভাষার ব্যবহার ব্যতিরেকেও হয়তবা সম্ভব , কিন্তু ‘আমাকে ভোট দিন’ কথাটা বোঝাতে ভাষাটা চাই-ই । এই বাড়তি বোঝা কাঁধে চাপার দরুণ শুরু হল এক নয়া অধ্যায় – অন্যতর প্রয়োজনে ভাষার অ-স্বাভাবিক অ-মানবিক ব্যবহার । প্রকৃত বিচারে ভাষার সংকটের মূল এখানেই । দ্বন্দ্বটা আসলে জনসাধারণের ভাষার জনবিরোধী ব্যবহারের প্রক্রিয়ার মধ্যে নিহিত । রাজনীতির কূট চাল এই দ্বন্দ্বকে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত করে , যার অনিবার্য ফল অর্থহীন হানাহানি , অযথা রক্তপাত । এর হাত থেকে রেহাই পেতে হলে আমাদের ব্যাপক অর্থে ‘ভাষায় এক ভালবাসায় এক মানবতায় এক’ হতেই হবে । বিশ্বের সব ভাষার মানুষই যেন আজ নিজস্ব শব্দমালায় ‘occupy wall street’ কথাটা দেয়ালে দেয়ালে লিখে দিতে চায় । এই প্রেক্ষাপট মনে রেখে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত ও সঙ্কল্প যদি গৃহীত হয় তবেই তা আনুষ্ঠানিক আবেগের মঞ্চ-প্রদর্শনী না হয়ে উপযুক্ত মাত্রা লাভ করতে পারে । নতুবা উনিশের ভূমিতে একুশের চেতনা একদিন নূতন ঊষার সংবাদ বয়ে আনবে সে আশা দুরাশা হয়েই থেকে যাবে!
(C) Picture:ছবি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
লেখাটা ইচ্ছে করলে এখানেও পড়তে পাবেনঃ '
Ekusher Prasongikota ' লেখা অংশে ক্লিক করুন। চলে যাবেন স্ক্রাইবডে। সেখান থেকে এটা নামিয়ে, কিম্বা না নামিয়ে কম্পিটারের পর্দা জুড়ে পড়তে পারবেন।
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন