“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ, ২০২১

রাম - রহিম

          ।। মাসকুরা বেগম ।।

                                 (১)

     

(ছবি সৌজ়ন্য  )

   শিমুল পুর গ্রামের অভিজাত বাড়ির কর্তা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পৌত্র দশ বছর বয়সের রাম শহর থেকে মা-বাবার সঙ্গে  এসেছে । ঠাকুরদা, কাকু, কাকিমা আর বাড়ি ভর্তি লোকজন, চাকর-বাকর ইত্যাদি সবাইকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা সে । গ্রামের প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য দেখে পাগল হয়ে গেছে । খাঁচার পাখি যেন ছাড়া পেয়েছে আর উড়ছে মনের সুখে । এক মুহূর্ত যদি এক জায়গায় থাকত ! কী রাঁধুনি, কী  মালি, কী দারোয়ান, কী ড্রাইভার কারোর রেহাই নেই ! যখন যাকে পায় তাকে ধরে গ্রামে ঘুরতে নিয়ে যেতে ।  কী টিলা, কী বাগান, কী জঙ্গল, কী বিল, কী নৌকা, কী ঝুপড়ি - কিছুই যেন বাদ না যায় ! তার মন চায় সারাদিন সবুজ বিশুদ্ধ প্রকৃতির মাঝে চরে বেড়াতে ।

        এই গ্রামের রহিম নামের তারই সমবয়সী ছেলেটির সাথে তার পরিচয় হয় আর সে পরিচয় বন্ধুত্বে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগে নি । সে তাকে গ্রামে নিয়ে ঘুরে বেড়াত । দেখাত নতুন নতুন, কত অজানা, কত অদেখা জিনিস ! মেটাত রামের পিপাসার্ত মনের জিজ্ঞাসা !  গাছে উঠে পাখির বাসা গাছ থেকে নামিয়ে এনে ডিম দেখাত কিংবা ছোট ছোট বাচ্চা দেখাত । আবার রেখে আসত ওদের মা কষ্ট পাবে বলে ! রহিম বিলে নিয়ে যায়, নৌকায় চড়ে। নৌকা বসে হাত বাড়িয়ে পানিতে ভেসে থাকা লতা গুচ্ছ টেনে এনে কি সব  অজানা ফল খেতে দেয় রহিম ! ছোট ছোট তিন দিকে তিনটে কাঁটা, তার মধ্যে থেকে নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে বের করে সাদা সাদা কী মিষ্টি পানিফল শিঙার। আরেকটা গোলাকৃতির পানিফল থেকে খুঁটে খুঁটে বের করে দানা দানা যাকে বলে ভেট । খেতে খুব স্বাদ লাগে রামের ।

         রামের সাথে মা গোপালকে পাঠান । গোপাল খুব ভালো করে চেনে রহিমকে । রহিম কতটা বিশ্বস্ত তাও জানে । তাই সে গাছের নিচে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে । দুই বন্ধু বাগানে বাগানে খুঁজতে থাকে কাঁচা পাকা কুল, কমলালেবু, ভুট্টা, ইত্যাদি আরও কত নাম না জানা ফলমূল । রহিমকে গ্রামের সবাই চেনে । ভালোবাসে । তাই কেউ কিছু বলে না ।

        একদিন রাম বিলে শাপলা ফুল ভাসতে দেখে আত্মহারা হয়ে পানিতে নেমে যায় । রহিমের নিষেধ অমান্য করে রাম  আরও নীচের দিকে নামতে থাকে । ধীরে ধীরে সে তলিয়ে যেতে থাকে । প্রথমে রহিম ভেবেছে রাম ইয়ার্কি করছে । কিন্তু পরে দেখল একী রাম তো উঠতে পারছেনা ! ডুবে যাচ্ছে ! একলাফে পানিতে ঝাঁপ দেয় রহিম ! রামের হাত ধরে পিছন দিকে দিয়ে টেনে তুলে আনে পাড়ে । রাম পানি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে । রহিম তার পেট থেকে পানি বের করে নিজের শ্বাস প্রশ্বাস দিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনে !

       রাম উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরে রহিমকে বলল, - ‘ রহিম ! একেই বলে সত্যিকারের বন্ধুত্ব । তুই আজ আমাকে যমরাজের হাত থেকে কেড়ে এনেছিস ।
- ‘
রাম ! তুই যে বললি তুই সাঁতার জানিস !
- ‘
তা যে সুইমিংপুলের হাঁটু জলে সাঁতার কাটা ! যা হবার হয়েছে । তোর মত বন্ধু থাকতে কিসের ভয়। চল এবার তোকে মায়ের কাছে নিয়ে যাই ।

      রহিম ভীষণ খুশি হয়ে বলল, - ‘ চল চল ! মাকে গিয়ে বলবি আমি তাঁর আরেক ছেলে । নিজের মাকে তো মা বলে ডাকতে পাই নি । আজ মা ডাকতে পারব
- ‘
কেন ! তোর মা কি নেই ! বন্ধু । কোনদিন তো আগে বলিস নি !
- ‘
না ! মায়ের মুখটা আমার মনেই নেই । আমার জন্মের এক বছরের মাথায় মা আমার চির বিদায় নিয়ে চলে গেল...... ।’  উদাস রহিম কেঁদে কেঁদে বলল ওর নিজের কথা। রহিমের বাবা গ্রামের মসজিদের ইমাম ছিলেন । ওকে মানুষ করেছিলেন অনেক কষ্টে । ছেলের অযত্ন হতে পারে ভেবে দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি । কিন্তু তিনি তাঁর এই কলিজার টুকরো ছেলেটিকে ফেলে দুবছর আগে চলে গেছেন ওপারের ডাকে ! রহিম এখন ওর দাদী ও ছোট চাচা - চাচীর সাথে থাকে ।

         রহিমের দুঃখের কাহিনি শুনে কোমলমতি রাম আর অশ্রু ধরে রাখতে পারে না । সে মনে মনে ভাবে  এত দুঃখ বুকে চেপে এত হাসি মুখে থাকে কেমনে রহিম ! সে রহিমের হাত ধরে নিয়ে যায় মায়ের কাছে । - মা মা দেখ কাকে নিয়ে এসেছি ! আমার বন্ধু রহিম । তোমার আরেক ছেলে ।....।বলে আজ যে রহিম তাকে কিভাবে বাঁচিয়েছে ঝটপট করে বলল মাকে । 
        
রহিম মায়ের পা ছুঁতে গেলে মা, -  ‘ছিঃ ছিঃ! আমাকে ছুঁয়ে ফেলবে নাকি ! আমার জাত পাত নষ্ট করে দেবে নাকি !বলে পিছনে সরে যান । রামকে তিরস্কার করতে করতে টেনে নিয়ে ঘরে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে আসেন । রামের মা রমনা শহুরে শিক্ষিত ব্রাহ্মণ নারী । রহিমকে তিরস্কার করতে লাগলেন, - ‘ তুই এক অনাথ ছোট জাতের বাচ্চা হয়ে কীভাবে এত সাহস করলি যে আমার ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করছিস । আমার সহজ সরল ছেলেটিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কি স্বার্থ আদায় করতে চাস । দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে এক্ষুনি ।
- ‘
মা মা ..!করতে থাকে রহিম ।
- ‘
গোপাল এই গর্দভটাকে এক্ষুনি গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দাও ।
গোপাল রহিমকে মেরে খেদিয়ে দেয় ।

      রমনা স্বামী ব্যারিস্টার অসীমকে বললেন, - ‘ এক্ষুনি শহরে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করো । আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে চাই না । ছেলে আমার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এখানে বাজে বখাটে ছেলেদের সঙ্গ দোষে । আমি এজন্য চাই না এসব পাড়া গাঁয়ে আসতে।

     কথামতো সব ঠিক ঠিকঠাক হয়ে গেল । পরেরদিন বিকেলের দিকে শহরে ফিরে যেতে হবে। ভোররাতে গোপালকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে রাম যায় রহিমের কাছ থেকে বিদায় নিতে ।  গিয়ে রহিমকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদে । রহিম ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
- ‘
বন্ধু তুই দুঃখ করিস না । চলে যা শহরে । লেখাপড়া করে অনেক বড় হও । সমাজের গরিব দুঃখী অসহায় মানুষের জন্য কিছু করতে পারবি তুই। তোর এই হৃদয় আছে আর সুযোগ সুবিধা আছে । উপরওয়ালার নিশ্চয়ই আমাদের আবার মিলিয়ে দেবেন
- ‘
বন্ধু তোর কথাগুলো খুব মনে করব । এই আমার লকেটটি তুই রাখ । এটা তোর কাছে থাকলে আমি ঠিক চিনে নেব । মা আর গ্রামে আমাকে নিয়ে আসবেন না ।বলে গলা থেকে ‘RAM’ লিখে কারুকার্য করা লকেটটি রহিমের হাতে দেয় ।
রহিম বলল,
- ‘
তোর দেওয়া এই উপহার কোনোদিন হারিয়ে যেতে দেবো না । যত্ন করে রেখে দেব ......।
     
গোপাল এগিয়ে এসে বলল, ‘ রহিম বাবা আমাকে মাফ করে দাও। আমি মালকিনের হুকুমে কালকে .....! মা টের পেলে আমরা দুজনের কী হবে ভেবেছ ।বলে রামকে টেনে নিয়ে যায় গোপাল।

          (২)

     রহিম এখন প্রাপ্ত বয়স্ক যুবক । জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে এসেছে । বি.এ. পাশ করে চাকরি - বাকরি পায়নি । নিজের চাষাবাদের জমি জমা ও নেই । তাই শহরে এসে একটি অটোরিকশায় চালিয়ে রোজগার করছে । মানুষের বিপদের বন্ধু রহিম ! বস্তির অসহায় মানুষের মাঝে পরিচিত নাম রহিম !

    সূর্যাস্তের সময় অটোরিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শহরের আনন্দ বিহার পার্কের সামনে যাত্রীর আশায় । এক সুঠামদেহী সাহেব যুবক পার্ক থেকে বেরিয়ে এসে একটি দামি গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে । তৎক্ষণাৎ একটি গাড়ি এসে তার পাশে কড়া ব্রেক কষে দাঁড়ায় আর কয়েকজন কালো কাপড়ে মুখ  বাঁধা তাগড়া জোয়ান ওকে ঘিরে ফেলে টানাটানি করতে থাকে । বেগতিক ভালো নয় দেখে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে রহিম । লড়াই করে করে ছত্র ভঙ্গ করে দেয় দলটিকে । ওরা ভয়ে পালিয়ে যেতে রহিম একজনকে ধরে মুখের কাপড় সরাতে চেষ্টা করে । লোকটি তার হাত থেকে রেহাই পেতে নিজের ছুরি বের করে কুপিয়ে দেয় তার কোমরে এবং পালিয়ে যায় গাড়িতে উঠে । নীচে পড়ে যায় রহিম । যুবকটি এগিয়ে এসে তাড়াতাড়ি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় । প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে । একজন লোক এসে রহিমের মানি পার্সটি যুবকটির হাতে দেয় । সে ওটা খুলতেই চমকে উঠে ‘RAM’ লেখা রকেটটি দেখে ! খুশিতে নেচে উঠে মন এ যে রামের রহিম ‘! না এই মুহূর্তে এই অবস্থায় রহিমকে বলবে না নিজের পরিচয় ! ধৈর্য ধারণ করে এইমাত্র বিপদের সম্মুখীন হওয়া রাম ! 

         ডাক্তার বেরিয়ে এসে বললেন, ‘ স্যার রক্ত লাগবে ! হাসপাতালে যে ‘O-’ গ্রুপের রক্ত নেই । কী করব ।
- ‘
চিন্তা করবেন না !  আমার ও রক্তের গ্রুপ ‘O-’  চলুন তাড়াতাড়ি !
    
ডাক্তার চলুনবলতেই  ঘিরে ফেলে সিকিউরিটি দল । পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে ডাক্তারকে ধমক দিতে থামিয়ে দিলেন জেলাধিপতি রাম মুখোপাধ্যায় ! অন্যায়ের সাথে যার আপোষ নেই, প্রাণের ভয় যার অন্তরে নেই তার নাম হচ্ছে এই জেলাধিপতি রাম’ !

     রামের মা ছেলের উপর আক্রমণের খবর পেয়ে দৌড়ে এসে পৌঁছান হাসপাতালে । রাম পাশের বেডের যুবকটিকে দেখিয়ে বলল, - ‘ মা ওই যে রহিমের গায়ে তোমার ছেলে রামের রক্ত বইছে । পারবে পৃথক করতে ? ‘

     মায়ের আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না । দৌড়ে রহিমের পাশে এসে হাত জোড় করে বলতে লাগলেন, - ‘ বাবা রহিম আমাকে ক্ষমা করে দাও । আমি অহংকারে অন্ধ ছিলাম । তোমরা বাচ্চারা অনেক আগেই আমার চোখ খুলে দিতে চেয়েছিলে কিন্তু  আমার হৃদয়টাই যে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল ।
- ‘
না না ! মা এমন করে বলবেন না । ওগুলো তো আমাদের সামাজিক ব্যাধি । হয়তোবা একটু আধটু এই সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন আপনি । মা তাতে আপনার দোষ দেখি না আমি ! আপনি তো এক মায়ের কর্তব্য পালন করেছেন । আজ তার ফল আমাদের চোখের সামনে । রাম  কতটুকু এগিয়ে গেছে ! তাতে কি আপনার অবদান নেই ? অন্যায়ের সাথে আপোষ করে নি বলে আজ তার জীবন সংকটে তবুও তার চোখে আমি দেখতে পাইনি এতটুকু ভয়ের চিহ্ন !’

   বিষয় - ছোটগল্প

   মাসকুরা বেগম । 

   গুয়াহাটি । আসাম ।

 

কোন মন্তব্য নেই: