“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৩ মার্চ, ২০২১

বাতিক বাবু

 

(সৌজন্য:https://joydhakweb.com/)


।। কপোতাক্ষী ব্রহ্মচারী চক্রবর্তী ।।


           বাতিক বাবুর বাতিকটা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যেখানে সেখানে, অস্থানে কুস্থানে তার এই বাতিক প্রদর্শনের অহেতুক বাড়াবাড়িতে তার পরিবার, কর্মস্থলের সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব, সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তারই পরিণামে তিনি তার পিতৃ -প্রদত্ত নামটি হারিয়ে সবার কাছে হয়ে উঠেছেন বাতিক-বাবু’! তার যে স্ত্রী সাত-চড়ে-রা কাড়তেন না,পতি পরম গুরু মেনে তিনকালের শেষ কালে এসে ঠেকেছেন, তিনিও সেদিন সমস্ত কুণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে বলে উঠলেন...

             ‘বাতিক বাবু গেলেন কোথায়? সত্যি এ মানুষ টার বাতিকের জ্বালায় হাড় মাস কালি হয়ে গেলো!

            পতি-পরায়ণা স্ত্রীর এতটা বাক-স্বাধীনতা বাতিক-বাবু কল্পনাও করতে পারেন নি। যাকে তিনি সারাজীবন সংসারের ভালো-মন্দের পাঠ দিয়ে এলেন, আর সে-ও একনিষ্ঠ ছাত্রী হয়ে তার দেওয়া সমস্ত জ্ঞান তদ্গত চিত্তে গ্রহণ করলো, তার মুখে আজ এ কী ভাষা! 

             ‘না:, এ মেনে নেয়া যায় না’...

            অপমান সহ্য করতে না পেরে, রাগে গজগজ করতে করতে, কাউকে কিচ্ছুটি না বলে, বাড়ি থেকে হনহন করে হাঁটা দিলেন বাতিক বাবু! যেতে যেতে, পথে ভুলু-বাবুর সঙ্গে দেখা।  দুনিয়ার সমস্ত নাড়ি-নক্ষত্র যার নখে দর্পণে, এর নাম যে কেন ভুলু...কে জানে! বাতিক বাবুকে দেখেই  ভুলুবাবু একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন--

           ‘আরে বাতিক-বাবু যে! তা এই ভর দুপুরে হনহন করে চললেন কোথায়? মুখটা তো শুকিয়ে একেবারে আমসি!  দুপুরের আহার মনোমতো হয়নি বুঝি? চলুন আমার বাড়ি, পোলাও-মাংস রান্না হয়েছে,  একটু চেখে দেখবেন, আসুন!

           ভুলু বাবুর কথা শুনে বাতিক বাবুর রাগের পারদ চড়ছিল চড়চড় করে, ফাটে ফাটে অবস্থা যখন, পোলাও-মাংসের নাম শুনে পারদটা এক ধাক্কায় অনেকটা নীচে নেমে এলো। মুখে কাষ্ঠ হাসি ফুটিয়ে তিনিও বলে উঠলেন,-

            ‘তা হঠাৎ পোলাও-মাংস! কোনো অনুষ্ঠান বুঝি?’

           -’আরে না মশাই, এমনি একটু স্বাদ-বদল! সে আমাদের প্রায় ই হয়!

            বাতিক-বাবুর বাতিকটা আবার  মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো...

         ‘কী বলেন মশাই!  প্রায়ই খান! বেঁচে আছেন কী করে? দুটোই গুরুপাচ্য, হজম হয় কী করে? উহুঁ... আর খাবেন না, প্রাণ রাখতে এক্ষুনি বাড়ি গিয়ে পাচন গুলে খান!

         আসলে ছোটবেলা থেকেই বাতিক বাবু যেমন পেট-রোগা, তেমনি ভোজন-রসিক! তাই যখনই কোনো লোভনীয় খাবারের কথা শোনেন, তার জিভ লকলক করে  আর পরিণামে গলা অব্ধি গিলে যখন পেটে গুরু গুরু মেঘ গুমরিয়ে ওঠে, তখন উপায়ান্তর না পেয়ে তিনি টোটকা-দাওয়াই সম্বলিত নানা পুঁথি-পত্রের শরণাপন্ন  হন, আর ঝামেলাটা এখান থেকেই শুরু... তিনি নিজের ওপরে যতটা না প্রয়োগ করেন,জ্ঞান-বিতরণে অধিক ব্যস্ত হয়ে পড়েন, নানা বিধি-নিষেধের ঠ্যালায় সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। বাড়িতে সবাইকে বিধি-নিষেধের ঠ্যালায় অস্থির করে তোলার পরেও তার নিজের জন্য চর্ব্য-চোষ্য যেমন চাই, তেমনি ট্যালট্যালে জীয়ল মাছের ঝোল ও মেনুতে একদিন বাদ পড়লে বাড়িতে ঘোরতর অশান্তি শুরু করেন! পতিব্রতা স্ত্রী মুখ বুজে সারাজীবন মেনে নিলেও সবাই তা সহ্য করবে কেন? তাই একদিন তার ই এক সহকর্মী ঠাট্টার ছলে বাতিক-বাবু বলতেই সবাই এই নামটা লুফে নিল! অফিসের বড়বাবু থেকে বেয়াড়া, পাড়ার ঠেকে, ক্রমে হাটে ঘাটে মাঠে সবখানেই তিনি হয়ে গেলেন বাতিক বাবু! মাথাটা চড়চড় করে উঠলেও কিছু বলতে পারেন না! কিন্তু তাই বলে, যার কথা ভেবে সব অপমান তিনি ভুলে থাকেন, তার কাছেও! সবই নারী-স্বাধীনতার ফলস্বগতোক্তি  করতে করতে নিজের বাড়িতে এসেই সটান শুয়ে পড়েন বাতিক বাবু। মনে মনে শপথ নেন, বেঁচে থাকতে অহেতুক আর জ্ঞান দিতে যাবেন না! তাতে যদি পিতৃ -প্রদত্ত নামটা ফিরে পান, তাহলে মরেও শান্তি...

 

            কিছুক্ষণ পর গিন্নী যখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে  ক্ষমা চাইতে এলেন, বাতিক-বাবু তখন চির-নিদ্রার দেশে চলে গেছেন আর সব বাতিকগ্রস্তের শত্তুরের মুখে ধুলো দিয়ে নবজন্ম হয়েছে বটুকবাবুর...

           কোনো বাতিকের কাছেই আর যিনি কখনো হার মানবেন না আর আশ্চর্য,  তার পেটের রোগও কোন যাদুবলে জানি, ভ্যানিশ হয়ে গেছে!

 

কোন মন্তব্য নেই: