।। দেবাশিস ভট্টাচার্য ।।
(তিনসুকিয়ার থেকে প্রকাশিত উজান পত্রিকার ১৬ শ সংখ্যাতে প্রকাশিত )
এক
প্রাক্-কথন
আসামে অবৈধ
বাংলাদেশী প্রব্রজনের আখ্যান কতটা
কাল্পনিক আর কতটা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং জনবিন্যাস পরিবর্তনে এর প্রভাব কি হতে পারে এই বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই একটা
প্রশ্ন আসে। প্রশ্নটা হলো অবৈধ বাংলাদেশী প্রব্রজনকারী অথবা অভিবাসী কে বা কারা? ভারতবর্ষের মূল নাগরিকত্ব আইনে (১৯৫৫) ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলে কোনো শব্দই ছিল না। ২০০৩ সনে
নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে ধারা ২(১)(খ) সংযোজন করা হয়। এই নূতন ধারা অনুযায়ী অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হলেন সেই সকল বিদেশী -১) যাঁরা পাসপোর্ট অথবা
অন্যান্য বৈধ অনুমতিপত্র ছাড়াই ভারতে প্রবেশ করেছেন, অথবা, ২) পাসপোর্ট বা সেইরকম কোনো বৈধ প্রমাণপত্র নিয়ে প্রবেশ করেছেন কিন্তু নির্দিষ্ট সময়সীমার পরেও ভারতে
বসবাস করছেন।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে আসামে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন হয়। এরপর আন্দোলন সমাপ্ত
হয় আন্দোলনকারীদের সাথে ভারত সরকারের এক চুক্তির মাধ্যমে। এই চুক্তিতে মূলত বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ প্রব্রজনকারীদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করার
জন্য একটা সময়সীমা ঠিক করা হয়। সেই অনুসারে
১৯৮৬ সালে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে ৬এ ধারা সংযোজন করা হয়। এই নতুন ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে
ভারতীয় বংশোদ্ভূত কোনো ব্যক্তি যদি ১ জানুয়ারি, ১৯৬৬
ইংরেজির আগে আসামে অনুপ্রবেশ করেছেন এবং এর পর সাধারণভাবে আসামে বসবাস করছেন তবে
সেই ব্যক্তি ১ জানুয়ারি, ১৯৬৬ ইংরেজি থেকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বিবেচিত
হবেন। আবার কোনো ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি যদি ১৯৬৬ সনের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সনের ২৫ মার্চের আগে বাংলাদেশ থেকে আসামে এসে সাধারণ
বাসিন্দা হিসেবে বসবাস করছেন তবে তিনি বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ১০ বছর পর ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন। কাজেই ২৪ মার্চ, ১৯৭১ তারিখের পর যারা বাংলাদেশ থেকে আসামে এসে
অবৈধভাবে বসবাস করছেন তাদের অবৈধ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বলা হবে।
আসাম চুক্তির পর সবাই ভাবলেন যে বিদেশী সমস্যার বুঝি
একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান হলো। কিন্তু এরপর আবার বিদেশী সমস্যা নিয়ে প্রতিবাদ, আন্দোলন শুরু হয়। এমনকি তথাকথিত বিদেশী সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করা হয় (রিট পিটিশন
(সিভিল) ২৭৪/২০০৯)। সুপ্রিম কোর্ট ১৯৭১ সনের পর আসামে লক্ষ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশী প্রব্রজনের আখ্যান মেনে নিয়ে ১৯৫১ সনের নাগরিকপঞ্জি বা এন আর সি নবীকরণের জন্য আদেশনামা
জারি করেন। মূলত তিনটি
কারণের উপর ভিত্তি করে পুনরায় লক্ষ লক্ষ বিদেশী অনুপ্রবেশের ন্যারেটিভ বা আখ্যান তৈরি হয়েছিল। প্রথমত:, আসামের মোট জনসংখ্যায় হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের আনুপাতিক বৃদ্ধি। ১৯৭১ সনের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী আসামের
মোট জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাত ছিল ২৫ শতাংশ। ১৯৯১ সনে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২৮ শতাংশ। একই সময়কালে হিন্দুদের জনসংখ্যার অনুপাত ১৯৭১ সনে ৭৩
শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ১৯৯১ সনে দাঁড়ায় ৬৭ শতাংশ। দ্বিতীয়ত:, ১৯৭১ সন থেকে
১৯৯১ সন অবধি আসামের মোট জনসংখ্যায় অসমীয়াভাষীদের অনুপাত ৬০.৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে হয় ৫৭.৩
শতাংশ। সেই তুলনায় বাংলাভাষীদের অনুপাত বৃদ্ধি হয় ১৯.৭ শতাংশ থেকে ২১.৫ শতাংশ। তৃতীয়ত:, ২০০১ সনের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী আসামের মোট ছয়টি জেলায় মুসলমানরা সংখ্যা গরিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু ২০১১ সনের
আদমশুমারির পর দেখা যায় যে আসামের মোট নয়টি জেলায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। এই সমস্ত ধর্মীয় এবং ভাষাগত জনবিন্যাস পরিবর্তনের জন্য
মূলত বাংলাদেশী মুসলমান প্রব্রজনকেই দায়ী করা হয়। ফলে আসামের জনমানসে এক আতঙ্কের সৃষ্টি হয় যে অদূর ভবিষ্যতে আসামে অসমীয়াভাষীরা সংখ্যালঘু হয়ে
যাবেন। একই সাথে আসামে বাংলাভাষী এবং ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হিসেবে মুসলমানরা সংখ্যা গরিষ্ঠ হবেন। আসামের তৎকালীন গভর্নর, লে: জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এস কে সিনহার ১৯৯৮ সনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা আছে যে ১৯৭১ সনের পর বাংলাদেশ থেকে
আসামে মূলত মুসলমানরাই এসেছেন (... the illegal migrants coming
into India after 1971 have been almost exclusively Muslims) (১)।
১৯৭১ সনের পর এই লক্ষ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশী প্রব্রজনের
যে আখ্যান তৈরি করা হয়েছে তার গভীর
প্রভাব আসামের রাজনীতি, সমাজ এমনকি অর্থনৈতিক উন্নয়নেও লক্ষ্য
করা যায়। কোনো রাজনৈতিক দলের উত্থান-পতন খুব প্রকটভাবে নির্ভর করে এই তথাকথিত অবৈধ বাংলাদেশী প্রব্রজন জনিত সমস্যা নিয়ে দলের কি নীতি বা
পরিকল্পনা তার উপর। অনেক সময় বন্ধ, আন্দোলন অথবা ধর্নার
জন্য এক সামাজিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এর সঠিক মূল্যায়ন খুব একটা হয়নি। এই
প্রেক্ষাপটে বিদেশী সমস্যা সমাধানের জন্য আসামে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এবং তত্ত্বাবধানে ১৯৫১ সনের রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি বা এন আর
সি নবীকরণ কার্যসূচী গ্রহণ করা হয়। অনেক বছর ধরে, সময় এবং
অর্থ ব্যয় করে, চলল এই প্রক্রিয়া। কিন্তু ২০১৯
ইংরেজির ৩১ আগস্ট আসামে চূড়ান্ত এন আর সি প্রকাশের পর বেশ কিছু ব্যক্তি এবং সংগঠন যারপরনাই অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। এর কারণ, উনাদের ধারণা, চূড়ান্ত তালিকা থেকে
যে ১৯.০৬ লক্ষ আবেদনকারী বাদ পড়েছেন সেটা অনেক কম। এই ১৯.০৬ লাখের মধ্যে আবার যারা দাবি জমা দেয়নি (৩.৭০ লক্ষ)
তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এমনিতেই আসামের এন আর সি-র নিয়মাবলীতে সংবিধান পরিপন্থী বৈষম্য এবং ভুল ভ্রান্তি থাকার গুরুতর
অভিযোগ আছে। যেমন ২৪ মার্চ, ১৯৭১
ইংরেজির পর যাদের ভারতবর্ষে জন্ম হয়েছে তাদের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব অস্বীকার করা
হয়। দ্বিতীয়ত, আসামের মূল বাসিন্দাদের
(Original Inhabitants) ক্ষেত্রে
নাগরিকত্ব প্রমাণের নিয়মাবলী অন্যদের তুলনায় শিথিল করা হয়। এছাড়াও এন আর সি নবীকরণ
প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের ভুল, ভ্রান্তি থাকার জন্য বিশেষ কিছু ভাষা এবং
ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মানুষরা চূড়ান্ত এন আর সি থেকে বাদ পড়েছেন। কিন্তু অনেকেই আশা অথবা আশঙ্কা করছেন যে এর পরবর্তী প্রক্রিয়ায় ফরেনার্স
ট্রাইব্যুনালে চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়া আবেদনকারীদের অনেকেই নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম
হবেন। অনেকেরই ধারণা যে এন আর
সি-ছুট আবেদনকারীদের বেশীরভাগই প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক যারা নিয়মের বৈষম্য এবং সাধারণ কিছু তুচ্ছ
কারণে চূড়ান্ত এন আর সি থেকে বাদ পড়েছেন। এর ফলে এন আর সি থেকে বাদ পড়া আবেদনকারীদের সংখ্যা অনেক কমে যাবে। তাই যারা আশা করছিলেন যে আসামে ৪০-৫০
লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশী আছেন এবং এর সমসংখ্যক আবেদনকারী চূড়ান্ত এন আর সি থেকে অবশ্যই বাদ পড়বেন, তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই অসন্তুষ্ট।
এমতাবস্থায় এন আর সি-তে আশানুরূপ ফল না হওয়ার দরুন
ভবিষ্যতে যে আরো আন্দোলন ইত্যাদি হবেনা তার নিশ্চয়তা আছে কি? পুলিশ এবং বিচার বিভাগ সদ্য প্রকাশিত এন আর সি-কে ভারতীয় নাগরিকত্বের চূড়ান্ত প্রমাণ বলে মেনে নিয়েছেন এরকম মনে
হয় না। কারণ যাদের চূড়ান্ত এন আর সি-তে নাম এসেছে তাদের নামেও বিদেশী নোটিশ জারি করা হচ্ছে। তাহলে বিদেশী সমস্যার সমাধান হলো কোথায়? এদিকে অগণিত বিদেশী অনুপ্রবেশ এবং আগ্রাসনের আখ্যান মেনে নিয়ে ভূমিপুত্রদের জন্য সংরক্ষণ প্রক্রিয়া শুরু করা
হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তথাকথিত বিদেশী সমস্যার পুনঃ নিরীক্ষণ খুবই জরুরি। অর্থাৎ যে তথ্য এবং তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী প্রব্রজনের
আখ্যান তৈরি করা হয়েছে এবং যে আখ্যান সুপ্রিম কোর্টেও মান্যতা
পেয়েছে তা আদৌ গ্রহণযোগ্য কিনা অথবা কতটা গ্রহণযোগ্য সেটা নিয়ে অনুসন্ধান এবং বিশ্লেষণ খুবই প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখেই বর্তমান
লেখার অবতারণা।
দুই
বাংলাদেশী প্রব্রজন নিয়ে সরকারি
বিবৃতি
আসামের কিছু ব্যক্তি, সংগঠন এমনকি
রাজনৈতিক দল যারা গত কয়েক দশক ধরে লক্ষ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশী প্রব্রজনের আখ্যান প্রচার করে আসছেন এবং এই বিশাল প্রব্রজনের
বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন তাঁরা এই দাবির সমর্থনে কিছু সরকারি বিবৃতির
উল্লেখ করে থাকেন। এর মধ্যে একটা
হলো বাংলাদেশী প্রব্রজন নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ২০০৪ সনের ১৪ই জুলাই রাজ্যসভায় তৎকালীন
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শ্রীপ্রকাশ জয় সোয়ালের এক লিখিত বিবৃতি (২)। শ্রী জয় সোয়াল উল্লেখ করেছিলেন যে ২০০১ সনের ৩১ ডিসেম্বর অবধি ভারতে আসা অবৈধ বাংলাদেশী
অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল এক কোটি কুড়ি লক্ষ, যার মধ্যে ৫০
লক্ষ অবৈধ অভিবাসী আসামে ছিলেন। তবে যে তথ্যটি জনসমক্ষে আসেনা সেটা হলো শ্রী জয় সোয়াল কিছুদিনের
মধ্যেই এই বক্তব্য প্রত্যাহার করে রাজ্যসভায় একটি সংশোধিত বিবৃতি পেশ করেছিলেন যেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল যে এই পরিসংখ্যান ভালো অথবা ব্যাপক
কোনো সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি করা
হয়নি। বরঞ্চ বাংলাদেশী প্রব্রজন নিয়ে যে পরিসংখ্যান আগে পেশ করা হয়েছিল সেটা
নেহাত শোনা কথার (hearsay) ভিত্তিতে তৈরি করা
হয়েছে। সুতরাং আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গে অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসীদের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া সম্ভব
নয়। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্য এবং পরিতাপের বিষয় হলো সুপ্রিম কোর্ট আসামে এন আর সি নবীকরণের উদ্দেশ্যে যে আদেশনামা জারি করেছিলেন সেখানে
আসামে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী প্রব্রজনের সপক্ষে আলোচনা করতে গিয়ে জয় সোয়ালের এই প্রত্যাহার করা পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করেছিলেন। এই পরিসংখ্যান
প্রত্যাহার করে জয় সোয়াল পরে যে সংশোধিত বিবৃতি পেশ করেছিলেন তার কোনো উল্লেখ ছিল না সুপ্রিম কোর্টের
আদেশনামায়।
একইভাবে, ভারতবর্ষের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্তা ১৯৯৭ সনের মে
মাসের ৬ তারিখ সংসদে অবহিত
করেছিলেন যে ভারতবর্ষে এক কোটি অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী আছেন (৩)। অবশ্য কিসের
ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি ইন্দ্রজিৎ গুপ্তা। সাময়িক পত্রিকা ইণ্ডিয়া
টুডে-এর এক প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে
এস কে সিনহা তাঁর ১৯৯৮ সনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন যে আসামে ৪০ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী আছেন (৪)। এর আগে, আসামের মুখ্যমন্ত্রী, শ্রী হিতেশ্বর শইকীয়া ১৯৯২ সনে এক বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন যে আসামে ৩০ লক্ষ
অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী রয়েছেন (৫)। কিন্তু কয়েকটি সংগঠনের প্রতিবাদের
মুখোমুখি হওয়ার পর তিনি আগের বক্তব্য প্রত্যাহার করে বলেছিলেন যে আসামে কোনও অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী নেই। আসামে অনুমান ভিত্তিক ৫০ লক্ষ অবৈধ
বাংলাদেশী অভিবাসীদের আখ্যান কতটা ভুল ছিল তা প্রমাণ করতে সাধারণ পাটিগণিতের জ্ঞান যথেষ্ট ।
উদাহরণস্বরূপ, ২০০১ সনের
আদমশুমারি অনুসারে আসামের মোট জনসংখ্যা (২.৬৬ কোটি) থেকে তথাকথিত ৫০
লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসীদের সংখ্যা হ্রাস করলে আসামের সংশোধিত জনসংখ্যা দাঁড়ায় ২.১৬ কোটি। ২০০১ সনের এই
সংশোধিত জনসংখ্যার সাথে ১৯৭১ সনের
জনসংখ্যার (১.৪৬ কোটি) তুলনা করলে দেখা যাবে যে আসামের, অবৈধ অভিবাসীদের বাদ দিয়ে, সামগ্রিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (৪৮ শতাংশ) একই সময়ে
(১৯৭১-২০০১) ভারতবর্ষে যে গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল (১২৩ শতাংশ), তার চাইতে অনেক কম। এমনকি আসামের এই সংশোধিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায়ও
সর্বনিম্ন। ভারতবর্ষের উন্নত রাজ্যগুলোর তুলনায় আসামের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনা করলে এই
ধরনের কম জনসংখ্যা বৃদ্ধি
অবশ্যই অকল্পনীয়। যেমন জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য জন্মের হার বা Crude
Birth Rate (CBR) একটি
গুরুত্বপূর্ণ সূচক। ১৯৭১ সনে স্যাম্পল সার্ভে অব ইণ্ডিয়া (SRS) জন্মহার নিয়ে রাজ্য ভিত্তিক যে তথ্য প্রকাশ করেছিলেন
তাতে দেখা যায় সেই বছর আসামের জন্ম হার (৩৮.৫) ৩১টি রাজ্য থেকে বেশী (৬)। শুধু উত্তরপ্রদেশ (৪৪.৯), হরিয়ানা (৪২.১), গুজরাট (৪০.০) এবং
মধ্য প্রদেশে (৩৯.১) জন্ম হার আসামের তুলনায় বেশি ছিল। একইভাবে ২০১১ সনে আসামের জন্মহার (২২.৮) ছিল দেশের ৩৬
টি রাজ্যের মধ্যে নবম এবং
ভারতবর্ষের গড় জন্মহার-এর (২১.৮) চাইতে বেশি। আবার
মহিলাদের প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টি এফ আর) জনসংখ্যা পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হিসাবে বিবেচিত হয়। সাধারণ ভাবে টি এফ আর হলো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মহিলাদের প্রজননক্ষম
বয়েসে (১৫-৪৯) গড়ে প্রতিজন মহিলা কতজন সন্তান জন্ম দেন তার সংখ্যা। আবারও লক্ষণীয় যে স্যাম্পল সার্ভে অব ইণ্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ১৯৭১ সনে
আসামের টিএফআর (৫.৭) ছিল ১২ টি রাজ্যের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ (৭)। কেবল হরিয়ানা (৭.৭) এবং উত্তর প্রদেশের (৬.১) টি এফ আর আসামের তুলনায় বেশি ছিল।
একই ভাবে ২০১১ সালে আসামের
টিএফআর (২.৪) দেশের মোট ৩৫ টি রাজ্যের মধ্যে নবম ছিল। এই বাস্তবিক পরিপ্রেক্ষিতে আসামে ২০০১ সনে ৫০
লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশী প্রব্রজনকারী আছেন বলে শ্রীপ্রকাশ জয় সোয়াল যে দাবি করেছিলেন তা জনমিতির বিচারে অবশ্যই অবাস্তব ছিল।
বিভিন্ন সময়ে আরও কিছু রাজনীতিবিদ বিবৃতি দিয়ে
বলেছিলেন যে আসামে লক্ষ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী রয়েছেন, অর্থাৎ যারা ২৪ মার্চ, ১৯৭১ সনের পর
আসামে অবৈধভাবে এসে বসবাস করছেন। এই জাতীয় বিবৃতির সপক্ষে কেউ কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দেখাতে
পারেন নি। প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে তৈরি করা লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী প্রব্রজনের আখ্যান কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এরজন্যই পরবর্তী কালে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনেক সময় অবৈধ অভিবাসীদের সংখ্যা নিয়ে তথ্য সরবরাহ করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন ।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে যারা অবৈধ অভিবাসী রয়েছেন তাদের সংখ্যা নিয়ে অনেক সময় সংসদে অনুরূপ
প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল।
সরকার প্রতিটি উপলক্ষে একই কারণ উল্লেখ করে এই জাতীয় তথ্য সরবরাহ করতে অস্বীকার করেছেন। তবে বিদেশী
নাগরিক যারা পাসপোর্ট, ভিসা নিয়ে
ভারতে আসার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভারত ছেড়ে চলে যান না সেইসব অবৈধ
অভিবাসীদের নিয়ে কখনো তথ্য প্রকাশ করেন। যেমন, ২০১৪ সনের ১৫ই
জুলাই সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শ্রী কিরেন রিজিজু জানিয়েছিলেন যে ৩১/১২/২০১২ ইং তারিখে
ভারতবর্ষে এই ধরনের ১৬,৫৩০ জন অবৈধ
অভিবাসী রয়েছেন (৮)।
আসাম সরকার ২০১২ সনে বিদেশী সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য
জানিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেন (৯)। সেই তথ্য অনুযায়ী আসামে ১৯৮৫ সন
থেকে ২০১২ সনের জুলাই অবধি মাত্র ৫৫,১৮৪ জন অভিযুক্তকে বিভিন্ন ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে বিদেশী বলে ঘোষণা করা
হয়। একই সময়কালে ৬,৫৯০ জন 'ডি' ভোটার বা সন্দেহযুক্ত ভোটারদের বিদেশী
ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ প্রায় সাতাশ বছরে আসামের বিভিন্ন ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে ঘোষিত বিদেশীর সংখ্যা ৬১,৭৭৪ জন। এরমধ্যে আবার ৩২,৫৩৭ জন ১৯৬৬-১৯৭১ এই সময়কালে বাংলাদেশ থেকে আসামে এসেছিলেন এবং আইনানুযায়ী এঁদের ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য দশ
বছর সময় দিতে হবে। তার মানে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যাবে এমন বিদেশীর সংখ্যা মাত্র ২৯,২৩৭। উল্লেখযোগ্য যে ১৯৯৮ সন থেকে ২০১২ সনের জুলাই
অবধি 'ডি' ভোটার সংক্রান্ত ৮৮,১৯২ সংখ্যক
মামলা আসামের বিভিন্ন ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হয়েছে। এরমধ্যে ৬,৫৯০ জন 'ডি' ভোটার
বিদেশী বলে ঘোষিত হয়েছেন। অর্থাৎ, ঐ সময়কালে যে
সমস্ত মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল তারমধ্যে মাত্র ৭ শতাংশই বিদেশী বলে ঘোষিত হয়েছিলেন। সুতরাং এইরকম একটা অনুভব
হওয়া স্বাভাবিক যে আসামে
সন্দেহযুক্ত নাগরিক বা 'ডি' ভোটার চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়ায় নিশ্চয়ই কোনো ত্রুটি আছে। আবার ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে ঘোষিত বিদেশী
হাইকোর্টে এবং সুপ্রিম কোর্টে স্বদেশী প্রমাণিত হয়েছেন, এমন উদাহরণও
আছে। তাই আসাম সরকার দ্বারা প্রকাশিত শ্বেতপত্র থেকেও প্রমাণিত হয়না যে ১৯৭১ সনের পর আসামে লক্ষ
লক্ষ বাংলাদেশীর অনুপ্রবেশ হয়েছে।
তিন
১৯৩১ সনের আদমশুমারি এবং সি এস
মুলানের প্রতিবেদন।
আবার অনেকেই অবৈধ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ নিয়ে যে আখ্যান তার স্বপক্ষে ১৯৩১ সনের আদমশুমারিতে প্রকাশিত তদানীন্তন
সেনসাস সুপারিন্টেনডেন্ট সি এস
মুলানের একটি প্রতিবেদনের উল্লেখ করেন। মুলানের তথ্য অনুযায়ী ১৯৩১ ইংরেজিতে আসামে
পূর্ব বঙ্গের ৫ লক্ষ অভিবাসী ছিলেন (১০)। এদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলমান এবং
এসেছিলেন ময়মনসিংহ জেলা থেকে। এই অভিবাসীদের Land-hungry বা জমি-লোভী আখ্যায়িত করে মুলান শঙ্কা প্রকাশ
করেছিলেন যে এরা নিশ্চয়ই অসমীয়া সভ্যতা এবং সংস্কৃতির কাঠামো বিনষ্ট করবে। (Probably
the most important event in the province during the last twenty five years-an
event, moreover, which seems likely to alter permanently the whole future of
Assam and to destroy more surely than did the Burmese invaders of 1820 the
whole structure of Assamese culture and civilization - has been the movement of
a vast horde of land-hungry Bengali immigrants, mostly Muslims, from the
districts of Eastern Bengal and in particular from Mymensing.) (১১)। এমনকি
ময়মনসিংহের এই অভিবাসীদের পিঁপড়া এবং শকুনের সাথেও তুলনা করতে ছাড়েননি। মানুষকে এইভাবে কিট এবং
পশুর সমতুল্য করে দেখানো নিশ্চয়ই সভ্যতার পরিচয় নয় (Wheresoever the carcase, there will the vultures be
gathered together. Where there is waste land thither flock the Mymemsinghias.
In fact the way in which they have seized upon the vacant areas in the Assam
Valley seems almost uncanny. Without fuss, without tumult, without trouble to
the district revenue staffs, a population which must amount to over half a
million has transplanted itself from Bengal to the Assam Valley during the last
twenty five years. It looks like a marvel of administrative organization on the
part of Government but it is nothing of the sort : the only thing I can compare
it to is the vast movement of a large body of ants) (১২)। মুলান আরেক
জায়গায় আশঙ্কা করে লিখেছেন যে এইভাবে ময়মনসিংহের অভিবাসীরা আসতে থাকলে অসমীয়ারা একদিন
শুধুমাত্র শিবসাগর জেলায় স্বস্তিবোধ করবেন (It is sad but by no means
improbable that in another thirty years Sibsagar district will be the only part
of Assam in which an Assamese will find himself at home) (১৩)। তাৎপর্যপূর্ণভাবে
লক্ষণীয় যে একই আদমশুমারির প্রতিবেদনে উল্লেখিত মুলানের তথ্য অনুযায়ী ১৯৩১ সনে আসামে যেসকল চা শ্রমিকদের
মধ্যভারত সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন
স্থান থেকে আনা হয়েছিল তাদের সংখ্যা ছিল ১৪ লক্ষ (প্রাক্তন চা শ্রমিক সহ)। অর্থাৎ ময়মনসিংহের
মূলত মুসলমান অভিবাসীদের তুলনায় তিনগুণ। কিন্তু মুলান এইসব হিন্দু অভিবাসীদের পশুর সাথে তুলনা করে সেনসাস রিপোর্টে কোনো আপত্তিজনক মন্তব্য করেননি।
এমনকি নেপালি অথবা অন্যান্য হিন্দু অভিবাসীদের উদ্দেশ্য করেও মুসলমানদের মত অশালীন উপমা ব্যবহার করেননি।
কিন্তু মূল বিষয় হলো ১৯৩১ সনে মুলান যা লিখেছিলেন সেটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কারণ ময়মনসিংহ এবং আসাম উভয়েই
ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। তাই এইধরনের প্রব্রজন বেআইনি ছিলনা। ঠিক এখন যেভাবে ভারতবর্ষের আর্থিকভাবে
অসচ্ছল রাজ্যগুলো থেকে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, গুজরাট সহ অন্যান্য
রাজ্যে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে প্রচুর পরিমাণে প্রব্রজন হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পরেও ভারতবর্ষে
একইভাবে প্রব্রজন হবে সেটা মুলান কখনও বলেননি। ১৯৩১ ইংরেজিতে সেটা জানার উপায়ও ছিল না। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পর যখন এইধরনের প্রব্রজন বেআইনি বলে
পরিগণিত হলো তখন স্বাভাবিক ভাবেই মুলানের ভবিষ্যৎ
বাণীর কার্যকারিতা আর রইল না। কিন্তু দুঃখের বিষয় আসামে অবৈধ বাংলাদেশী প্রব্রজনের স্বপক্ষে আদালতসহ অনেকেই সি এস মুলানের এইসব
আপত্তিকর মন্তব্য
এখনও ব্যাবহার করে থাকেন।
চার
লে: জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এস কে
সিনহার প্রতিবেদন (১৯৯৮ ইং)
আসামের
তৎকালীন গভর্নর, লে: জেনারেল
(অবসরপ্রাপ্ত) এস কে সিনহা ১৯৯৮ সনে, আসামে অবৈধ বাংলাদেশী প্রব্রজন নিয়ে, ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতিকে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন (১৪)। এই
প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে গত কয়েক দশক থেকে আসামে অবৈধ বাংলাদেশী প্রব্রজনের ফলে এখানকার জনবিন্যাস যথেষ্ট পরিবর্তন হচ্ছে।
এই বিশাল প্রব্রজনের কারণে অসমীয়া জাতির অস্তিত্ব এবং একই সাথে দেশের সুরক্ষা
বিপন্ন হতে চলেছে (Large scale illegal migration from East
Pakistan/Bangladesh over several decades has been altering the demographic
complexion of this state. It poses a grave threat both to the identity of
Assamese people and to our national security. Successive Governments at the
Centre and in the State have not adequately met this challenge)। এরফলে অসমীয়া জাতি নিজের রাজ্যেই সংখ্যালঘু হয়ে
যাওয়ার শঙ্কা আছে (The unabated influx of illegal migrants from
Bangladesh into Assam and the consequent perceptible change in the demographic
pattern of the State, has been a matter of grave concern. It threatens to
reduce the Assamese people to a minority in their own state, as happened in
Tripura and Sikkim)। কিন্তু এস কে সিনহা উক্ত প্রতিবেদনে যে বিশাল সংখ্যক অবৈধ বাংলাদেশী প্রব্রজনের কথা উল্লেখ করেছেন তা কোনো প্রমাণ দিয়ে সাব্যস্ত করতে পারেন নি। বরঞ্চ এই বিশাল সংখ্যক বাংলাদেশী প্রব্রজনের
বিষয়টা যে আদমশুমারির তথ্য দিয়ে প্রমাণ করা যাবে না সেই অক্ষমতাও স্বীকার
করেছেন প্রতিবেদনে (No census has been carried out to determine the
number of these illegal migrants. Precise and authentic figures are not
available but on the basis of estimates, extrapolations and various indicators,
their number runs into millions)। কিন্তু প্রশ্ন হলো তথাকথিত বিশাল সংখ্যক অবৈধ বাংলাদেশী প্রব্রজনের
সপক্ষে যেখানে কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই সেই অবস্থায় শুধুমাত্র
পরোক্ষভাবে অনুমান ভিত্তিক সংখ্যা নির্ধারণ পদ্ধতি কতটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে? আর এইধরনের প্রতিবেদন যদি কোনো জনমিতি বিশেষজ্ঞ (Demographer) তৈরি করতেন তাহলে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারতো। কিন্তু এস কে সিনহার এই ধরনের কোনো যোগ্যতা ছিল না বলেই মনে হয়। এই
অবস্থায় তাঁর প্রতিবেদনে বাংলাদেশী প্রব্রজনকারীদের সংখ্যা নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় ভুল থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়। কিছু উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে।
যেমন তিনি লিখেছেন যে ১৯৭০ সনে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৭.৫ কোটি। কিন্তু ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশের জনসংখ্যা
হ্রাস পেয়ে হয় ৭.১৪ কোটি। এরপর তিনি একটা যুক্তি দেখালেন যে ঐ সময় প্রতি বছর গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩.১ শতাংশ হিসেবে ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশের
জনসংখ্যা হওয়া উচিত ছিল ৭.৭ কোটি। বাস্তবে যে প্রায় ষাট লক্ষ মানুষ জনগণনায় কম পাওয়া গেল এরজন্য
তিনি বাংলাদেশ থেকে বিশাল
সংখ্যক প্রব্রজনকেই দায়ী করলেন। অথচ তিনি জনসংখ্যা নিয়ে যে পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করেছেন সেখানেই বড় ভুল
ছিল। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয় যে ১৯৭০ সনে পাকিস্তানে আদমশুমারির অধীনে জনগণনা হয়নি। ১৯৭১ সনের
মুক্তি যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এরপর ১৯৭১ সনে পাকিস্তানে এবং ১৯৭৪ সনে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম
আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। তবে ১৯৭১ সনের জুলাই মাসে এক টেলিভিশন সাক্ষাতকারে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন যে সেই
সময় বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি (১৫)। সুতরাং এস কে সিনহা ১৯৭০ সনে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা যেটা দেখিয়েছেন (৭.৫
কোটি) তা নিশ্চয়ই সঠিক ছিল না।
আবার ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশের আদমশুমারি অনুযায়ী যে জনসংখ্যা সরকারি ভাবে প্রকাশ করা হয়েছিল সেটা ছিল
৭.১৪ কোটি (১৬)। এস কে সিনহা তাঁর প্রতিবেদনে এই পরিসংখ্যানই দেখিয়েছেন। কিন্তু এই সরকারি পরিসংখ্যানও ভুল ছিল। এখানে বাংলাদেশের
আদমশুমারি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা খুবই প্রয়োজন। সেই বিষয়টি হলো বাংলাদেশের
শুমারির পর যে জনসংখ্যা (Enumerated population) প্রকাশ করা হয়, সেই তথ্য
কতটা ভুল বা শুদ্ধ তা খতিয়ে দেখার জন্য আবার সার্ভে বা পোষ্ট ইনুমারেশন চেক (Post
Enumeration Check) আয়োজন করা
হয়। এই সার্ভে করার পর সংশোধিত জনসংখ্যা (Adjusted population) আবার আলাদা করে প্রকাশ করা হয়। এই সার্ভে অনুযায়ী
১৯৭৪ সনের আদমশুমারিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৪৯ লক্ষ (৬.৮ শতাংশ) কম দেখানো হয়েছিল (১৭)। অর্থাৎ ১৯৭৪
সনে বাংলাদেশের প্রকৃত জনসংখ্যা ছিল ৭.৬৩ কোটি। এই অবস্থায় এস কে সিনহার হিসেবে ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশের জনসংখ্যা যে
পঞ্চাশ বা ষাট লক্ষ কম আসবে তা
বলাই বাহুল্য।
এস কে সিনহা উক্ত প্রতিবেদনে আবার লিখেছেন যে বাংলাদেশের আদমশুমারি থেকে নাকি একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে ১৯৭১
সন থেকে ১৯৮১ সন অবধি হিন্দু জনসংখ্যা ৩৯ লক্ষ হ্রাস পেয়েছে এবং আরো ৩৬ লক্ষ হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে ১৯৮১ সন থেকে ১৯৮৯ সন পর্যন্ত। উল্লেখযোগ্য যে
এই মন্তব্যের সপক্ষে কোনো তথ্য সূত্র বা ব্যাখ্যা তাঁর প্রতিবেদনে নেই। স্বাভাবিক ভাবেই একটা প্রশ্ন আসে যে এই হ্রাস পাওয়া হিন্দু জনসংখ্যার
হিসেবটা তিনি বের করলেন কিভাবে? এই প্রশ্ন
উত্থাপনের কারণ একটাই, সেটা হলো
বাংলাদেশে ১৯৭১ এবং ১৯৮৯ সনে কোনো আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশের আদমশুমারি (১৮) অনুযায়ী ১৯৬১-১৯৭৪, ১৯৭৪-১৯৮১
এবং ১৯৭১-১৯৯১ এই সময়কালে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৩.১ শতাংশ, ৯.৩ শতাংশ এবং ৫.৮ শতাংশ। এখানে অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আদমশুমারিতে প্রকাশিত হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির
হার পোষ্ট ইনুমারেশন চেক বা সার্ভের পর বর্ধিত জনসংখ্যার হিসেবে নিশ্চয়ই আরও বাড়বে। সুতরাং বাংলাদেশের আদমশুমারিতে এমন কোনো ইঙ্গিত নেই
যে হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। তবে ১৯৬১ সনের পর থেকে ১৯৭৪ সন অবধি বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা (Enumerated
population) যে কম বৃদ্ধি হয়েছিল (৩.১ শতাংশ) তার একটা গুরুত্বপূর্ণ
কারণ ছিল ঐ সময়সীমায়
কিছু অস্বাভাবিক মৃত্যু বা গণহত্যা। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় ১৯৭১ সনে মুক্তি যুদ্ধের সময় সংঘটিত হওয়া গণহত্যার
কথা। পাকিস্তানি সেনা এবং ওদের
সহযোগীরা সেই সময় প্রায় ৩০ লক্ষ বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা করেছিল। তিনজন বিচারপতি নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের
ইন্টারনেশনেল ওয়ার ক্রিমিনাল
ট্রাইব্যুনালের এক অক্টোবর, ২০১৩ ইংরেজি
তারিখের যে রায়ে যুদ্ধ-অপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় ঘোষণা
হয়েছিল, সেখানে
এইভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, "On perusal of old documents such as books,
articles, news paper reporting of both local and foreign media, government and
NGO reports, we are led to hold that during the War of Liberation of Bangladesh
in 1971, at least 3 million people were killed by the Pakistan occupation
forces and their Collaborators. This number of of death-roll has been accepted
by the people of Bangladesh as true as it is based on old documents cited
above. The facts of killing 3 million people, torture, rape and genocide of
Bangladesh in 1961 has become a part of world history, a classic instance of a
fact of common knowledge) (১৯)। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ২৪ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী
ছিলেন বলে ধারণা করা হয়, যা ১৯৬১
সনের হিন্দু জনসংখ্যার (৯৩.৮০ লক্ষ) প্রায় এক চতুর্থাংশ (২০)।
শুধু হত্যার
কারণেই মৃত্যু হয়নি। হাজার হাজার মানুষ ভারতবর্ষের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরের দুরবস্থার
জন্য কলেরায় মৃত্যু বরণ করেন (২১)। এছাড়াও বাংলাদেশে ১৯৭৪-৭৫ সনের দুর্ভিক্ষে প্রায় দশ
লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় (২২)। অবশ্য এই ১০ লক্ষের মধ্যে মুসলমান
কতজন এবং হিন্দু কতজন মারা গেছিলেন তার কোনো আলাদা পরিসংখ্যান নেই। তবে যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির ফলে যে আনুমানিক চল্লিশ লক্ষের মতো
মানুষের মৃত্যু হলো, যা
বাংলাদেশের ১৯৬১ সনের জনসংখ্যার হিসেবে প্রায় ৮ শতাংশ, তা নিশ্চয়ই জনসংখ্যা পরিবর্তনের উপর একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে এই সময়কালে (১৯৬১-১৯৭৪)
যে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম ছিল, তার প্রধান কারণ
যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু। এখানে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় যে ১৯৭১ সনের মার্চ মাসে শুরু
হওয়া মুক্তি যুদ্ধের সময়
পাকিস্তানের সেনা এবং তাদের সহযোগীদের অসহনীয় নির্যাতন, অত্যাচার এবং হত্যা-লীলার ফলে হিন্দু, মুসলমান সহ প্রায় ১ কোটি মানুষ পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ এবং আসাম সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের
অন্যান্য রাজ্যে পালিয়ে আসেন। রাষ্ট্রসংঘের অধীনে রিফিউজি এজেন্সির (UNHCR) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী (The
State of The World's Refugees 2000) (২৩) পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম সহ সুদূর
মধ্যপ্রদেশ, বিহার এবং
উত্তর প্রদেশে মোট ৮২৫ টি শরণার্থী শিবিরে ৬৭.৯৭ লক্ষ শরণার্থীদের
থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এছাড়াও ৩১.০২ লক্ষ শরণার্থী এদেশে পালিয়ে আসার পর আত্মীয় অথবা চেনা পরিচিতদের আশ্রয়ে ছিলেন। সবমিলিয়ে ১৯৭১ সনের এপ্রিল
থেকে ডিসেম্বর অবধি ৯৮.৯৯ লক্ষ শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। এর মধ্যে আসামে ৩.৪৭ লক্ষ, ত্রিপুরায় ১৩.৮১ লক্ষ এবং মেঘালয়ে ৬.৬৭ লক্ষ শরণার্থী ছিলেন। শরণার্থীদের বৃহদাংশ
(৭২.৩৫ লক্ষ) ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ৪৮২টি ক্যাম্পে। কিন্তু ভারতবর্ষের
তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এইসব নিপীড়িত শরণার্থীদের স্থায়ীভাবে রাখার
পক্ষপাতী ছিলেন না। এক টেলিভিশন সাক্ষাতকারে তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করেন (২৪)। যুদ্ধ শেষ হবার পর রাষ্ট্রসংঘের মধ্যস্থতায় এবং ভারত
সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগ আর সহযোগিতায় প্রায় সব শরণার্থীরাই স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে যান। রাষ্ট্রসংঘের একই প্রতিবেদনে
উল্লেখ করা হয়েছে যে ২৫ মার্চ, ১৯৭২ ইং তারিখে মাত্র ষাট হাজার
শরণার্থী এদেশে ছিলেন। এই অবশিষ্ট শরণার্থীদেরও নিশ্চয়ই বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিলো। তথাপি
যুদ্ধে আক্রান্ত শরণার্থীদের
কিয়দংশ যদি কোনো কারণে থেকেও যান তবে ওদের সংখ্যা খুব বেশি হবেনা।
যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষ পরোক্ষভাবেও জনসংখ্যা পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় যুদ্ধ
এবং দুর্ভিক্ষের ফলে জন্ম এবং মৃত্যুর হার কিভাবে প্রভাবিত হয় এই বিষয় নিয়ে অনেক অধ্যয়ন এবং গবেষণা হয়েছে। ২০১৪ সনে আমেরিকান ইকনমিক জার্নালে
প্রকাশিত (২৫) এরকম এক গবেষণাপত্রে সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া
ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক গুইলোমে ভেন্ডেনব্রাওকে দেখিয়েছেন যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) ফরাসি দেশের জন্মহার ৫০ শতাংশ কমে গেছিল।
এর ফলে জন্ম সংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ হ্রাস পেয়েছিল যা যুদ্ধের সময় যত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল তার সমসংখ্যক। একই ভাবে রাশিয়ায় কমিউনিজম থেকে
কেপিটেলিজম্-এ যে বিশাল পরিবর্তন হয় (১৯৮৬-১৯৮৮) সেই সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় জন্মের হার ৫৬ শতাংশ কমে যায়। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে
প্রজনন হার বা টি এফ আর নিয়ে ১৯৮৮ ইংরেজিতে চিটাগাং বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম সফিকুল ইসলাম এক গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন (২৬)। তিনি দেখিয়েছেন যে ১৯৭১ সনের পর
বাংলাদেশে টি এফ আর দ্রুত
হ্রাস পায়। এর কারণ হিসেবে বলা যায় যে যুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি মানুষ রিফিউজি হয়ে গেছিলেন। তাই স্বইচ্ছায়
অথবা অনিচ্ছায় বিবাহিত
দম্পতিদের বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হয়। এর ফলে গর্ভধারণ অবশ্যই কম হয়েছিল। যুদ্ধের সময় স্বাভাবিক
কারণেই অনেক বিয়ে স্থগিত হয়ে গেছিল। এছাড়াও একটা চূড়ান্ত মানসিক শঙ্কা এবং অস্থিরতার পরিবেশে অনেকেই নিশ্চয়ই সন্তান ধারণ স্থগিত রাখার জন্য
সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
আবার স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। যেমন
গ্রামাঞ্চলে পরিবার পরিকল্পনা সফল করতে মহিলা এনজিও কর্মী নিয়োগ করা হয়েছিল। এর ফলে বাংলাদেশের
প্রজনন হার বা টি এফ আর
ভারতবর্ষের তুলনায় দ্রুত হ্রাস পায়। এই সফলতার জন্য রাষ্ট্রসংঘ এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের ভূয়সী
প্রশংসা করেছেন। ইউনেস্কোর এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৬ সনে বাংলাদেশী মহিলাদের গড় টি এফ আর (২.১০৪) ভারতীয় মহিলাদের (২.৩২৬) তুলনায়
কম ছিল (২৭)। অথচ ১৯৭২ সনে বাংলাদেশের
টি এফ আর (৬.৯২৮) ভারতবর্ষের (৫.৪৪৪) চাইতে অনেক বেশি ছিল। এটা আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ যার জন্য
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। উপরন্তু বাংলাদেশের আদমশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যা কম দেখানো হয় বলেও
অভিযোগ রয়েছে (২৮)। তবে স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশ থেকে ভারতবর্ষ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রব্রজন অবশ্যই হয়েছে। ভারতবর্ষের
প্রসঙ্গে এই বিষয়ে সরকারি তথ্য নিয়ে এই প্রবন্ধে অন্য জায়গায় আলোচনা করা হয়েছে।
এইসমস্ত বিভিন্ন কারণে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের
জনসংখ্যা, বিশেষ করে
হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে। এস কে সিনহার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা একমাত্র
প্রব্রজনের কারণে নয়।
বিহারি শরণার্থী
বাংলাদেশে আটকে পরা (stranded) বিহারি (মুসলমান) শরণার্থী সম্পর্কে এস কে সিনহা
লিখেছিলেন যে ১৯৭১ সনের পর ৫.১৭ লক্ষ বিহারি শরণার্থী ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশ করেছেন (২৯)। এটা শুধু তাঁর
তথ্য ভিত্তিক অনুমান। আর অনুমান সঠিক হতে গেলে তথ্য সঠিক হওয়া প্রয়োজন। প্রশ্ন হলো তাঁর তথ্য কতটা নির্ভুল
ছিল এবং তিনি সম্পূর্ণ তথ্য
নিয়েছিলেন কি? তিনি দেখিয়েছেন যে ১৯৭১ সনে বাংলাদেশের
বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে ৭.৫ লক্ষ বিহারি শরণার্থী ছিলেন। এরমধ্যে পাকিস্তান সরকার ৩৩ হাজার শরণার্থীদের দায়িত্ব স্বীকার করেন। আর তিনি
প্রতিবেদন লেখার সময় (১৯৯৮ ইং) বাংলাদেশের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বসবাস করা বিহারি শরণার্থীদের সংখ্যা ছিল ২.৫ লক্ষ। সুতরাং, পাটিগণিতের সোজা হিসেব করে তিনি দেখালেন যে বাকি ৫.১৭
লক্ষ বিহারি শরণার্থীরা নিশ্চয়ই ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশ করেছিলেন। তাঁর ধারনা, বিহারি শরণার্থীরা যে বৃহত্তর বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর সাথে অঙ্গীভূত হয়ে গেছেন তার কোনো তথ্য প্রমাণ নেই। কিন্তু
বাস্তবে তাঁর তথ্য কিছুটা ভুল এবং অসম্পূর্ণ ছিল । কারণ রাষ্ট্রসংঘের রিফিউজি এজেন্সি দ্বারা
প্রকাশিত ২০০৯ সনের এক প্রতিবেদন (৩০) অনুযায়ী ১৯৭৩ সন থেকে ১৯৯৩ সন অবধি বাংলাদেশে বসবাস করা ১.৭৮ লক্ষ উর্দুভাষীকে ওদের ইচ্ছে অনুযায়ী
পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল।
প্রায় এক লক্ষ বিহারি শরণার্থীরা নিজের উদ্যোগে পাকিস্তান চলে যান। বিহারি মুসলমানদের মধ্যে আরো
অনেকেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাথে অঙ্গীভূত হয়ে যান। তাই পাঁচ লাখ বিহারি শরণার্থীরা ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশ করেছেন বলে এস কে সিনহা যে অনুমান করেছিলেন তা
সঠিক ছিল না। কারণ তিনি বিহারি শরণার্থী সংক্রান্ত সঠিক এবং সম্পূর্ণ তথ্য পর্যালোচনা করেন নি।
মুসলমান প্রব্রজন (১৯৭১-১৯৯১)
আবার সঠিক এবং পর্যাপ্ত তথ্য বা পরিসংখ্যান থাকলেও তথ্যের ভুল ব্যাখ্যার জন্য অনুমান ভুল হতে পারে। যেমন এস কে
সিনহা একটা তুলনামূলক পরিসংখ্যান দেখিয়ে বলেছিলেন যে ১৯৭১ সন থেকে ১৯৯১ সন অবধি বাংলাদেশ থেকে অনেক মুসলমান আসামে অনুপ্রবেশ করেছেন (৩১)। কারণ, এই সময়কালে (১৯৭১-১৯৯১) ভারতবর্ষে মুসলমানদের যে গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল (৬৫ শতাংশ) তার তুলনায় আসামের
মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (৭৭ শতাংশ) অনেক বেশি ছিল। অথচ একই সময় (১৯৭১-১৯৯১) উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাকি সব রাজ্য সহ ভারতবর্ষের অন্তত ১৬
টি রাজ্যে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির হার আসামের মুসলমানদের চাইতে অনেক বেশি লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গোয়া (১৩২ শতাংশ), পাঞ্জাব (১০৯ শতাংশ), রাজস্থান (৯৮ শতাংশ), হরিয়ানা
(৮৮ শতাংশ) এবং মহারাষ্ট্র (৮০ শতাংশ)। এমনকি, আসামের মুসলমানদের
তুলনায় বেশি ছিল রাজ্যের খ্রিষ্টান (৯৫ শতাংশ) এবং বৌদ্ধদের (১৮৪ শতাংশ) জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার। তাৎপর্যপূর্ণভাবে
১৯৭১ সন থেকে ১৯৯১ সন অবধি পুরো
ভারতবর্ষে খ্রিষ্টান এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৩৮ শতাংশ এবং ৬৮ শতাংশ।
আসামের প্রতিবেশী সবকয়টি রাজ্যেও খ্রিষ্টানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আসামের মুসলমানদের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এ ছাড়াও উত্তর পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু ভাষিক
জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার আসামের মুসলমানদের চাইতে বেশি ছিল যেমন রাভা (১৭২
শতাংশ), বড়ো (১২০ শতাংশ), মিসিং (১১৬ শতাংশ), ডিমাসা (১২১ শতাংশ), মিজো (৯৮
শতাংশ), টিপরা (৮৭ শতাংশ), খাসিয়া (৯০ শতাংশ) ইত্যাদি। কিন্তু অবৈধ বাংলাদেশী বা বিদেশী প্রব্রজনকে ঐ সমস্ত রাজ্যের ধর্মীয় বা ভাষিক
জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে এস কে সিনহা বা অন্য কেউ দেখিয়েছেন কি? নিশ্চয়ই না। কারণ কোনো জাতি বা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর
সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য একমাত্র বিদেশী প্রব্রজনকেই দায়ী করা যায় না। জনমিতির
নিরিখে, যেসব কারণে জনসংখ্যা পরিবর্তন হয়, মূলত জন্ম এবং মৃত্যু, সেসব পর্যালোচনা করার পরেই একটা সঠিক ধারণা করা সম্ভব।
একই সময় (১৯৭১-১৯৯১) ভারতবর্ষের গড় হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (৪৮ শতাংশ) আসামের হিন্দুদের (৪২ শতাংশ)
তুলনায় বেশি ছিল। এস কে সিনহার প্রতিবেদন অনুসারে এর সম্ভাব্য কারণ হলো সেই সময় ছাত্র আন্দোলন এবং সন্ত্রাসবাদের জন্য অসমীয়াভাষী হিন্দুদের বাদ
দিয়ে অন্যান্য হিন্দুরা আসাম ছেড়ে চলে গেছিলেন। অথচ তাঁর দৃষ্টিতে একই পরিস্থিতি মুসলমানদের প্রচুর পরিমাণে বাংলাদেশ থেকে আসার ক্ষেত্রে কোনো
বাধা হয়নি। অন্যভাবে বলা যায় এস কে সিনহার বিবেচনায় আসামের তৎকালীন আন্দোলন এবং সন্ত্রাসবাদ জনিত পরিস্থিতি বাংলাদেশী মুসলমানদের প্রচুর
পরিমাণে আসামে অনুপ্রবেশের জন্য অনুকূল ছিল অথচ অসমীয়াভাষী হিন্দুদের বাদ দিয়ে আসামে বসবাসকারী অন্যান্য হিন্দুদের আসামে থাকার জন্য পরিবেশ প্রতিকুল
ছিল। অথচ বাস্তবে আদমশুমারির তথ্যে আমরা অন্য চিত্র দেখতে পাই। সেটা হলো ১৯৭১ সন থেকে ১৯৯১ সন অবধি আসামে বহিঃ রাজ্য থেকে ২.৯০ লক্ষ প্রব্রজনকারী
এসেছিলেন। এর বিপরীতে ২.৫৯ লক্ষ লোক আসাম থেকে অন্য রাজ্যে গেছেন। অর্থাৎ আসাম থেকে যারা অন্য রাজ্যে গেছেন তাদের তুলনায় বহিঃ রাজ্য থেকে আসামে
বেশী লোক এসেছেন।
আসাম এবং বাংলাদেশের জনবিন্যাস পরিবর্তন হয়েছে বিভিন্ন কারণে। অথচ এস কে সিনহা তাঁর প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন যে
১৯৭১ সনের পর লক্ষ লক্ষ মানুষ, বিশেষ করে
মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা, বাংলাদেশ থেকে আসামে অনুপ্রবেশ করেছেন বলেই
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে এবং আসামে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে। এস কে সিনহার বিবেচনায় প্রব্রজনই জনসংখ্যা পরিবর্তনের
কারণ, জনমিতির তত্ত্বে যা একমাত্র সত্য
নয়।
পাঁচ
২০১১ সনে আদমশুমারি এবং তিনটি নূতন
জেলায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
২০০১ সনের শুমারির পর আসামের কিছু জেলাকে পুনঃ সংগঠিত করে বড়োল্যান্ড স্বায়ত্তশাসিত পরিষদের অধীনে তিনটি
নূতন জেলা গঠন করা হয়। এই জেলাগুলো হচ্ছে উদালগুড়ি, বাকসা এবং চিরাং। এছাড়াও অবিভক্ত কামরূপ
জেলার কিছু অংশ নিয়ে কামরূপ মেট্রোপলিটন নাম দিয়ে আরেকটি নতুন জেলা গঠন করা হয়। এই নূতন চারটি জেলা নিয়ে আসামের মোট জেলার সংখ্যা হয়
সাতাশ। এরপর যখন ২০১১ সনের আদমশুমারি অনুযায়ী ধর্মভিত্তিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয় তখন দেখা যায় যে আসামে নয়টি জেলায় মুসলমান
ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেন। উল্লেখযোগ্য যে ২০০১ সনে আসামের ছয়টি জেলায় মুসলমানরা সংখ্যা গরিষ্ঠ ছিলেন। আসামের বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন এই বিষয়টি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। পত্র, পত্রিকায় বিবৃতি বেরোয়, টেলিভিশনে ঝড় ওঠে। অনেকেই প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে এইভাবে যদি এক দশকেই তিনটি জেলায় মুসলমানরা সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন
করেন তাহলে আগামী কয়েক দশক পর আসামের অবস্থা কি হবে? এবং অবশ্যই সি এস মুলানের ভবিষ্যৎ বাণী
এবং এস কে সিনহার প্রতিবেদন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে এই পরিস্থিতির জন্য একমাত্র বাংলাদেশী প্রব্রজনকেই দায়ী
করা হয়। এই
পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সনের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী আসামের নূতন তিনটি জেলা কি করে মুসলিম
সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো সেটা তলিয়ে দেখা প্রয়োজন।
২০১১ সনের আদমশুমারি অনুযায়ী ধর্মীয় ভিত্তিতে জনসংখ্যার তথ্য প্রকাশ হবার পর দেখা যায় মুসলমানরা প্রথমবারের
মতো বঙ্গাইগাঁও জেলায় সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেন। ২০০১ সনে জেলায় মুসলমানদের জনসংখ্যার অনুপাত ছিল ৩৯ শতাংশ। ২০১১ সনে এই অনুপাত বৃদ্ধি পেয়ে
৫০ শতাংশ হয়। একই সময়কালে (২০০১-২০১১) মোট জনসংখ্যায় হিন্দুদের অনুপাত ৫৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৪৮ শতাংশ হয়। অথচ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো বঙ্গাইগাঁও
জেলায় ২০০১ সন থেকে ২০১১ সন অবধি মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৬ শতাংশ (৩.৪৮ লক্ষ থেকে ৩.৭১ লক্ষ)। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন হয়
মুসলমানদের জনসংখ্যা এত কম বৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও মোট জনসংখ্যায় অনুপাত এত বৃদ্ধি হলো কিভাবে? এর কারণ ২০০৪ সনে বঙ্গাইগাঁও জেলা থেকে একটা হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল নবগঠিত চিরাং জেলার সাথে যুক্ত করা
হয়েছিল। এর ফলে পুনর্গঠিত বঙ্গাইগাঁও জেলায় হিন্দু জনসংখ্যা ২০০১ সনে ৫.৩৪ লক্ষ থেকে কমে ২০১১
সনে ৩.৫৯ লক্ষ হয়ে যায়।
অর্থাৎ ২০০১-২০১১ এই দশকে হিন্দু জনসংখ্যা ৩৩ শতাংশ হ্রাস পায়। সুতরাং বঙ্গাইগাঁও জেলায়
মুসলমানদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা হয় মুখ্যতঃ জেলা বিভক্ত হওয়ার জন্য।
একই ভাবে ২০০৪ সনে দরং জেলা এবং শোনিতপুর জেলা থেকে কিছু অংশ নিয়ে উদালগুড়ি জেলা গঠন করা হয়। বঙ্গাইগাঁও
জেলার মতোই দরং জেলার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা নবগঠিত উদালগুড়ি জেলার সাথে যুক্ত করা হয়। এর ফলে
দরং জেলায় হিন্দু জনসংখ্যা
২০০১ সনে ৮.৫৮ লক্ষ থেকে কমে ২০১১ সনে ৩.২৭ লক্ষ হয়। এই কারণেই নবগঠিত উদালগুড়ি জেলায় হিন্দুরা
সংখ্যা গরিষ্ঠ (৭৫ শতাংশ)। একই সময়কালে (২০০১-২০১১) দরং জেলার মুসলমান জনসংখ্যা ৫.৩৬ লক্ষ থেকে সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৫.৯৭ লক্ষ। সুতরাং
অবিভক্ত দরং জেলা থেকে একটা হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল নবগঠিত উদালগুড়ি জেলায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার
জন্যই পুনর্গঠিত দরং জেলায়
মুসলমানরা সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেন।
এই দশকে (২০০১-২০১১) শুধু মরিগাঁও জেলার কোনো ভাগবাটোয়ারা না হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানরা সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন
করেন। জেলার মোট জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাত ৪৭ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫১ শতাংশ হয়। এর প্রধান কারণ মরিগাঁও জেলার মুসলমান এবং হিন্দু মহিলাদের
প্রজনন হার অথবা টি এফ আর-এর উল্লেখযোগ্য পার্থক্য। ২০১১ সনের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী মরিগাঁও জেলার একজন প্রজননক্ষম মুসলমান মহিলা
গড়ে ৩.৬ জন সন্তানের জন্ম দেন। সেই তুলনায় একজন প্রজননক্ষম হিন্দু মহিলা গড়ে ১.৯ জন সন্তানের
জন্ম দেন। টি এফ আর-এর পার্থক্য এত
বেশি হওয়ার জন্যই মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হিন্দুদের তুলনায় অনেক বেশি। কাজেই মরিগাঁও
ছাড়া বাকি দুই জেলায় (বঙ্গাইগাঁও এবং দরং) শুধুমাত্র পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার জন্যই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়। এর বিপরীতে নূতন করে গঠিত চিরাং, বাকসা, উদালগুড়ি এবং কামরূপ মেট্রোপলিটন, এই চারটি জেলাতেই যে হিন্দুরা সংখ্যা গরিষ্ঠ ছিলেন সেটা কখনোই চর্চার বিষয়
হয়ে ওঠেনি।
ছয়
আদমশুমারিতে প্রব্রজন নিয়ে তথ্য।
ভারতবর্ষে প্রতি দশ বছর অন্তর শুমারি অনুষ্ঠিত হয়। এর পর লোক গণনার ভিত্তিতে জনসংখ্যা ইত্যাদির সাথে প্রব্রজনকারীদের
নিয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়। গেল বছর ২০১১ সনের আদমশুমারির ভিত্তিতে প্রব্রজনকারীদের নিয়ে সরকার
যে পরিসংখ্যান
প্রকাশ করেন তাতে দেখা যায় যে ভারতবর্ষে ৫৪.৯১ লক্ষ বিদেশী প্রব্রজনকারী আছেন। ভারতে বসবাসকারী যাদের পূর্ব
নিবাস বাংলাদেশ ছিল তাদের সংখ্যা সবচাইতে বেশি (২৩.০৪ লক্ষ)। এরপরেই আছে নেপাল (৭.৭৮ লক্ষ) এবং পাকিস্তান (৭.০৭ লক্ষ)। আসামে
সর্বমোট ১.১০ লক্ষ লোক আছেন যাদের পূর্ব নিবাস বিদেশে ছিল। বাংলাদেশে পূর্ব নিবাস ছিল এরকম প্রব্রজনকারীর সংখ্যা ৬৪,১৩৭ জন। অবশ্য এদের মধ্যে কে বৈধ প্রব্রজনকারী আর কে অবৈধ সেই তথ্য আলাদা করে প্রকাশ করা হয় না। কিন্তু বিদেশী প্রব্রজনকারীদের
নিয়ে আদমশুমারিতে প্রকাশিত
পরিসংখ্যানই একমাত্র নির্ভরযোগ্য বিস্তারিত তথ্যসূত্র। আবার এদের অনেকেই প্রাক স্বাধীনতার যুগ থেকেই
ভারতবর্ষে আছেন।
মনে রাখা প্রয়োজন যে আসামে ১৯৮১ সনে শুমারি অনুষ্ঠিত
হয়নি। ১৯৭১ এবং তার পর ১৯৯১, ২০০১ এবং সর্বশেষ ২০১১ সনের আদমশুমারিতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ১৯৭১ সনের পর ৩৮.৭৫ লক্ষ বিদেশী প্রব্রজনকারী
বিভিন্ন কারণে ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশ করে বসবাস করছেন। এরমধ্যে বাংলাদেশ থেকে আগত প্রব্রজনকারীদের
সংখ্যা (১৬.৪৯ লক্ষ) সবচাইতে
বেশি। এরপরেই আছে নেপাল (৮.৪৪ লক্ষ), পাকিস্তান (২.২৩ লক্ষ) এবং শ্রীলঙ্কা (২.০ লক্ষ)। ১৯৭১ সন থেকে ২০১১ সন
অবধি যারা বাংলাদেশ থেকে ভারতবর্ষে এসেছেন, তাদের বেশির ভাগই আছেন পশ্চিমবঙ্গে (১৩.৯৮ লক্ষ)। তবে ১৯৭১ সন থেকে ২০১১ সন
এই চার দশকে বাংলাদেশ থেকে আসামে
মাত্র ৩৩,০৬৭ জন প্রব্রজনকারী এসেছেন যা একই
সময়ে ভারতবর্ষে আসা মোট বাংলাদেশী প্রব্রজনকারীদের তুলনায় মাত্র ২ শতাংশ। নেপাল থেকে একই সময়ে (১৯৭১-২০১১)
৮,৪৯৯ জন প্রব্রজনকারী আসামে
অনুপ্রবেশ করেছেন। সবমিলিয়ে মোট ৫৭,৩৬৪ জন বিদেশী প্রব্রজনকারী
১৯৭১ সনের পর থেকে ২০১১ সন অবধি আসামে এসেছেন। তাই আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী বিগত
চার দশকে (১৯৭১-২০১১) যে অল্প
সংখ্যক বিদেশী প্রব্রজনকারী আসামে অনুপ্রবেশ করেছেন, বৈধ অথবা অবৈধভাবে, তার প্রভাব
আসামের জনসংখ্যায় অতি নগণ্য।
সাত
আসামের জনবিন্যাস পরিবর্তনের
সম্ভাব্য কারণ।
একটা কথা এতক্ষণে স্পষ্ট যে আসামে ১৯৭১ সনের পর তথাকথিত লক্ষ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশী প্রব্রজনের স্বপক্ষে কোনো গ্রহণযোগ্য ভিত্তি বা তথ্য নেই।
আবার দেখা যায়
১৯৭১ সন থেকে ২০১১ সন অবধি আসামের মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (১১৩.৪ শতাংশ) ভারতবর্ষের ২৫ টি রাজ্য থেকে কম। এমনকি
একই সময়কালে ভারতবর্ষের
গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (১২০.৯ শতাংশ) আসামের তুলনায় বেশি ছিল। অর্থাৎ ১৯৭১ সন থেকে ২০১১ সন অবধি আসামের মোট
জনসংখ্যা বৃদ্ধি কোনো ভাবেই
অস্বাভাবিক ছিল না এবং স্পষ্টতই লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী প্রব্রজনের ইঙ্গিত বহন করে না। তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই একটা প্রশ্ন আসে যে আসামে ভাষিক জনগোষ্ঠী হিসেবে অসমীয়া এবং
ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হিসেবে হিন্দুদের মোট জনসংখ্যায় আনুপাতিক হ্রাসের কারণ কি? এই জনবিন্যাস
পরিবর্তনের মুখ্য কারণ হিসেবে বলা যায় আদমশুমারিতে ভাষা পরিবর্তন অথবা সংশোধন এবং আর্থ-সামাজিক বৈষম্য। সীমিত
পরিসরে এইসব গুরুত্বপূর্ণ
কারণ বিশ্লেষণ অসম্ভব। তথাপি সংক্ষেপে কিছুটা না বললে কোথায় যেন একটা অসম্পূর্ণতা অনুভব হয়।
ভাষা নিয়ে পত্র পত্রিকায় যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ এবং পর্যালোচনা হয় তা মূলত আদমশুমারিতে প্রকাশিত তথ্যের উপর
নির্ভরশীল। এখানেই একটা মৌলিক প্রশ্ন আসে। সেটা হলো আদমশুমারিতে প্রকাশিত তথ্যই কি ভাষার প্রশ্নে শেষ কথা? একটা উদাহরণ দিলে এই বিষয়টি কিছুটা পরিষ্কার হবে। যেমন ২০১১ সনের আদমশুমারিতে যাদের মাতৃভাষা বাংলা তাদের সংখ্যা
দেখানো হয়েছে ৯০.২০ লক্ষ। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী আসামের মোট জনসংখ্যায় বাংলাভাষীদের অনুপাত ছিল ২৮.৯০ শতাংশ। কিন্তু বাংলাভাষীদের এই
জনসংখ্যায় বাঙালি ছাড়াও অন্য জাতি, জনগোষ্ঠী আছেন যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়। যেমন রাজবংশী (১.৯১ লক্ষ) এবং হাজং
(২৭ হাজার)। একইভাবে ৪.৮৬ লক্ষ লোক, যাদের ভাষা অসমীয়া নয়, অথচ আদমশুমারিতে মাতৃভাষা অসমীয়া বলে
উল্লেখ করা আছে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি ভাষার ক্ষেত্রেই এই বিষয়টি লক্ষণীয়। যেমন, ২০১১ সনের আদমশুমারিতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী
ভারতবর্ষের ৫৩.৮২ কোটি হিন্দিভাষীদের মধ্যে ২১.৬ কোটি এমন
আছেন যাদের মাতৃভাষা হিন্দি নয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভোজপুরি যাদের সংখ্যা ৫.০৫ কোটি। এরপরেই আছে
রাজস্থানি (২.৫৮ কোটি), ছত্তিশগড়ি (১.৬২ কোটি) এবং মগধি (১.২৭ কোটি)। এরা আবার অনেক বছর
ধরেই স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে
সংবিধানের অষ্টম তফসিলের অধীনে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য দাবি করে যাচ্ছেন। যদি দাবি অনুযায়ী
স্বীকৃতি পায় তখন হিন্দিভাষীদের সংখ্যা এবং অনুপাত অবশ্যই হ্রাস পাবে। এবং এই পরিবর্তনের জন্য
বিদেশী প্রব্রজনকে নিশ্চয়ই
দায়ী করা যাবে না। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ২০০৪ সনে মৈথিলী ভাষাকে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে সংবিধানের
অষ্টম তফসিলের অধীনে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ফলে ২০১১ সনের আদমশুমারিতে মৈথিলী ভাষাকে স্বতন্ত্রভাবে দেখানো হয়। ২০১১ সনের আদমশুমারি অনুযায়ী মৈথিলী
ভাষাগোষ্ঠীর জনসংখ্যা ১.৩৬ কোটি। তার আগে মৈথিলী ভাষাগোষ্ঠীর মাতৃভাষা আদমশুমারিতে হিন্দি বলে দেখানো হতো। তাই ভারতবর্ষের প্রতিটি ভাষাগোষ্ঠীর
মাতৃভাষা নিয়ে যদি সঠিকভাবে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয় তাহলে ভাষা নিয়ে সংখ্যা, অনুপাত ইত্যাদি কি হতে পারে? এইসব জটিল প্রশ্নকে আপাতত সরিয়ে রেখে মূল বিষয়ে ফিরে আসা যাক।
আসামের আদমশুমারিতে ভাষা পরিবর্তনের বিষয়টি জটিল, সংবেদনশীল এবং সুদীর্ঘ। ভাষা সমস্যার ইতিহাস সেই ব্রিটিশ জমানা থেকেই শুরু। তবে স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের আসাম
রাজ্যে ভাষা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় ১৯৫১ সনের আদমশুমারি থেকেই। স্বাধীনতার পর, বিশেষ করে সিলেট রেফারেন্ডামের পর, আসামের যে ভৌগোলিক সীমা দাঁড়িয়েছিল সেখানে ১৯৩১ সন থেকে ১৯৫১ সন অবধি, আদমশুমারিতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অসমীয়াভাষীদের জনসংখ্যা অবিশ্বাস্যভাবে বৃদ্ধি
পেয়েছিল। উল্লেখিত দুই দশকে অসমীয়াভাষীদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৪৯ শতাংশ। অথচ একই সময়কালে আসামের গড় জনসংখ্যা
বৃদ্ধির হার ছিল ৩৮ শতাংশ। এর বিপরীতে বাংলাভাষী সহ সমতলভূমির অন্যান্য প্রায় সকল ভাষাগোষ্ঠীর জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল। তৎকালীন সেনসাস সুপারিন্টেনডেন্ট, ভাঘাইওয়ালা ভাষা পরিবর্তনকে এর মূল কারণ হিসেবে
ব্যাখ্যা করেছিলেন (There is a striking increase in the percentage of
the people who speak Assamese in 1951 (56.7) over those of 1931, which was only
31.4 per cent; there is an equally striking decrease in the percentage of
people speaking Bengali in 1951 which is only 16.5 against 26.8 per cent in
1931. With the solitary exception of Assamese, every single language or
language group in Assam shows a decline in the percentage of people speaking
the same. All this decline has gone to swell the percentage of the people speaking
Assamese in 1951) (৩২)। এরসাথে আরও নানান প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। যেমন ভাষার সাথে উপভাষার প্রশ্ন, আদমশুমারিতে ভাষা পরিবর্তন না ভাষা সংশোধন, সংবিধান স্বীকৃত নয় এবং নিজস্ব লিপি নেই এমন অজস্র
ভাষা আদমশুমারিতে কিভাবে দেখানো হয় ইত্যাদি। সে যাই হোক, আমরা যদি ভাষা নিয়ে ১৯৫১ এবং এর পরের আদমশুমারিতে প্রকাশিত তথ্যাবলির পর্যালোচনা করি তাহলে একটা বিষয় অন্তত:
স্পষ্ট হয় যে অসমীয়াভাষীদের আনুপাতিক হ্রাসের একটা মুখ্য কারণ হলো ১৯৬১ সনের পর থেকে আদমশুমারিতে ভাষা পরিবর্তন অথবা সংশোধন। এর
জলজ্যান্ত উদাহরণ হলো ২০০১ সনের আদমশুমারি। ২০০১ সনের জনগণনার পর দেখা যায় যে আসামের অসমীয়াভাষীদের
জনসংখ্যা বিগত এক দশকে কোনো
পরিবর্তন হয়নি বললেই চলে। ১৯৯১-২০০১ দশকে আসামের অসমীয়াভাষীদের মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয় ১.৬৯ লক্ষ
(১২৮.৪১ লক্ষ থেকে ১৩০.১০ লক্ষ)। বৃদ্ধির হার অবিশ্বাস্যভাবে মাত্র ১.৩১ শতাংশ। একই সময়কালে আসামের মোট জনসংখ্যা ২২৪.১৪ লক্ষ থেকে ১৮.৪৭ শতাংশ হারে
বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৬৫.৫৫ লক্ষ। ১৯৯১-২০০১ এই সময়কালে আসাম থেকে বৃহৎ সংখ্যক অসমীয়াভাষী আসামের বাইরে চলে যাবার কোনো তথ্য নেই। একই দশকে
আসামের যে গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল সেই হিসেবেও ২০০১ সনে অসমীয়াভাষীদের জনসংখ্যা ১৫২.১৬ লক্ষ হওয়া উচিৎ ছিল। এই যে আনুমানিক প্রায় ২২ লক্ষ অসমীয়াভাষী লোক-গণনায় কম পাওয়া গেল তার মূল
কারণ ভাষা পরিবর্তন অথবা সংশোধন ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে কি?
২০০১ সনের আগের আদমশুমারিতেও এই ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ১৯৭১ সন থেকে ১৯৯১ সন অবধি আসামের মোট
জনসংখ্যায় অসমীয়াভাষীদের আনুপাতিক হার ৩.৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। এর বিপরীতে বাংলাভাষীদের আনুপাতিক
হার ১.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। একই
সাথে আসামের মোট জনসংখ্যায় অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর সম্মিলিত আনুপাতিক হার বৃদ্ধি পেয়েছিল ১.৮ শতাংশ। যদি
বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের ফলে অসমীয়াভাষীদের আনুপাতিক হার কমে যেতো তাহলে বাংলাভাষী ছাড়া আসামের বাকি সব ভাষা গোষ্ঠীর আনুপাতিক হারও
নিশ্চয়ই একইভাবে হ্রাস পেতো। কিন্তু বাস্তবে যে অসমীয়াভাষী ছাড়া অন্যান্য সব জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক হার বৃদ্ধি পায় তার একটি সম্ভাব্য কারণ
অবশ্যই ভাষা পরিবর্তন। ১৯৭১-১৯৯১ এই সময়কালে আসামের গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৫৩.৩ শতাংশ। এর
চাইতে কম ছিল অসমীয়াভাষীদের
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (৪৪.২ শতাংশ)। অথচ একই সময়ে আসামের কিছু ভাষাগোষ্ঠীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক
বেশি ছিল যেমন কার্বি/মিকির
(৮৫.৪ শতাংশ), মিরি/মিসিং
(১১৫.৩ শতাংশ), ডিমাসা
(১১৯.৩ শতাংশ), বড়ো (১২০.৫ শতাংশ) এবং রাভা (২৪৬.৯ শতাংশ)। যেহেতু সেই
সময়কালে অন্যান্য রাজ্য থেকে
আসামে বিশাল প্রব্রজনের কোনো তথ্য নেই তাই
কিছু ভাষা গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে
জনসংখ্যার এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ভাষা পরিবর্তন অথবা সংশোধন ছাড়া আর কিভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে? সেই তুলনায় একই সময়কালে বাংলাভাষীদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (৬৭.৩ শতাংশ) তেমন বেশি ছিল না। সুতরাং
আদমশুমারিতে ভাষা পরিবর্তন অথবা সংশোধন শুধুমাত্র একটি ভাষা এবং একটি রাজ্যেই সীমিত ছিল না। ভারতবর্ষে
এবং বিশেষ করে আসামে এই কারণে
ভাষার ক্ষেত্রে জনবিন্যাস পরিবর্তন নিশ্চয়ই প্রভাবিত হয়েছিল। কাজেই বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকে
যেভাবে আসামের মোট জনসংখ্যায় অসমীয়াভাষীদের আনুপাতিক হ্রাসের একমাত্র কারণ হিসেবে দেখানো হয় তা
কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আবার আসামের মোট জনসংখ্যায় ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হিসেবে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের আনুপাতিক বৃদ্ধির জন্যও
একমাত্র বাংলাদেশী প্রব্রজনকে দায়ী করা হয়। কিন্তু জনমিতির তত্ত্বে প্রব্রজনই জনসংখ্যা পরিবর্তন বা বৃদ্ধির
একমাত্র কারণ নয়।
অন্যান্য কারণের মধ্যে মহিলাদের প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট জনসংখ্যা পরিবর্তনকে
গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রভাবিত করে। ২০১১ সনের আদমশুমারির তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে আসামের মুসলমান মহিলাদের টিএফআর (৩.১) হিন্দু মহিলাদের
(১.৭) চাইতে ৮২ শতাংশ বেশি। হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে টিএফআর-এর ক্ষেত্রে এত বৈষম্য বা পার্থক্য (১.৪) ভারতবর্ষের খুব অল্প সংখ্যক
রাজ্যেই দেখা যায়। মাত্র চারটি রাজ্যে এই পার্থক্য আসামের তুলনায় বেশি। এই রাজ্যগুলি হচ্ছে হরিয়ানা (২.৬), মেঘালয় (১.৭), নাগাল্যাণ্ড (১.৬) এবং
জম্মু কাশ্মীর (১.৬)। এটা এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ যার জন্য আসামের মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার
হিন্দুদের তুলনায় অনেক বেশি। হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের বেশি টি এফ আর-এর অনেকগুলি আর্থ-সামাজিক কারণ রয়েছে যেমন স্ত্রী শিক্ষা, বাল্য বিবাহ, মহিলাদের অর্থকরী কর্মসংস্থান, পরিবার পরিকল্পনা, নগরায়ন, দরিদ্রতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে বৈষম্য। উদাহরণ স্বরূপ, ২০১৫-১৬ সনের রাষ্ট্রীয় পরিবার এবং স্বাস্থ্য জরিপের
(NFHS -4) তথ্য অনুযায়ী কিশোরী বয়সে (১৫-১৯
বছর) গর্ভধারণের হার আসামের মুসলমানদের ক্ষেত্রে ২০.৪ শতাংশ, যা হিন্দুদের (৯.৫ শতাংশ) তুলনায় দ্বিগুণের চেয়েও বেশী (৩৩)। বিবাহিত
মুসলমান মহিলাদের মধ্যে গর্ভনিরোধক পদ্ধতির ব্যবহার (৫০ শতাংশ) হিন্দু মহিলাদের (৫৪ শতাংশ)
তুলনায় কম। তবে মহিলাদের প্রজনন হার বেশি বা কম হওয়ার মুখ্য কারণ হচ্ছে শিক্ষা। ২০১১ সনের
আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী আসামে মুসলমান মহিলাদের সাক্ষরতার হার (৫৬.৮%) হিন্দু (৭১.৩%) এবং খ্রিষ্টানদের (৬০.৫%) চাইতে অনেক
কম। মুসলমান অধ্যুষিত জেলাগুলোতে এই পার্থক্য আরও বেশি। এইসমস্ত আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের জন্যই মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হিন্দুদের
তুলনায় অনেক বেশি। এর ফলে আসামের মোট জনসংখ্যায় মুসলমানদের আনুপাতিক হার বৃদ্ধি পায়।
আরেকটা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো হিন্দুদের আনুপাতিক
হ্রাস শুধুমাত্র, উত্তর
পূর্বাঞ্চলের ক্ষেত্রে, আসামেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সমস্ত উত্তর
পূর্বাঞ্চলেই এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ১৯৭১ সন থেকে ২০১১ সন অবধি আসাম ছাড়া উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১১৭
শতাংশ, ২৭৫ শতাংশ, ৩৭৫ শতাংশ এবং ২১৪ শতাংশ। খ্রিষ্টানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হিন্দুদের তুলনায় তিনগুণেরও বেশি। এর একটা
অন্যতম কারণ হলো খ্রিষ্টান মহিলাদের অন্যদের তুলনায় বেশি প্রজনন হার। যেমন মেঘালয়ের খ্রিষ্টান মহিলাদের প্রজনন হার (৩.৮৫) এই অঞ্চলে
সবচাইতে বেশি। আসামের মুসলমান মহিলাদের চাইতেও প্রায় এক চতুর্থাংশ বেশি। মূলত এই কারণেই ১৯৭১ সন
থেকে ২০১১ সন অবধি মেঘালয়ের
মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (১৯৩.৩ শতাংশ) আসামের (১১৩.৪ শতাংশ) তুলনায় অনেক বেশি। আসাম ছাড়া এই
অঞ্চলের প্রায় সব রাজ্যেই একই ধারা লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যের মোট জনসংখ্যায় হিন্দুদের আনুপাতিক হার
৬৬.৩৯ শতাংশ (১৯৭১) থেকে কমে হয় ৫৩.৯৭ শতাংশ (২০১১)। অর্থাৎ ১৯৭১ সন থেকে ২০১১ সন অবধি হিন্দুদের আনুপাতিক হার ১২.৪২ শতাংশ হ্রাস পায়। অন্যদিকে
পুরো জনসংখ্যায় মুসলমানদের আনুপাতিক হার ৪.১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫.৫৭ শতাংশ হয়, অর্থাৎ ১.৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সবচাইতে বেশী বৃদ্ধি হয় খ্রিষ্টানদের, ২৮.৩৪ শতাংশ থেকে বেড়ে হয় ৪৭.৭৭ শতাংশ। অর্থাৎ পুরো
জনসংখ্যায় খ্রিষ্টানদের আনুপাতিক হার ১৯.৪৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যে খ্রিষ্টানদের
অস্বাভাবিক আনুপাতিক বৃদ্ধির জন্য অবৈধ প্রব্রজনকে কারণ হিসেবে দেখানো হয় কি? এখানে খ্রিষ্টানদের উদাহরণ দেখানো হলো এই কারণেই যে দেশের কোনো রাজ্য অথবা অঞ্চলে একটা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মোট
জনসংখ্যায় অস্বাভাবিক আনুপাতিক বৃদ্ধি পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ কারণেও হতে পারে। যদি শুধুমাত্র বাংলাদেশ থেকে মুসলমান প্রব্রজনের ফলে আসামের মোট জনসংখ্যায় হিন্দুদের আনুপাতিক
হার কমে যেতো তাহলে একই
কারণে নিশ্চয়ই অন্যান্য ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর অনুপাতও হ্রাস পেতো। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়
১৯৭১-১৯৯১ এই সময়কালে আসামের মোট জনসংখ্যায় হিন্দুদের আনুপাতিক হার ৫.৩৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল।
এর বিপরীতে মুসলমানদের বৃদ্ধি
হয়েছিল ৩.৮৭ শতাংশ এবং অন্যান্য ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত আনুপাতিক হার বৃদ্ধি পেয়েছিল ১.৫০ শতাংশ। যেহেতু এই
জনবিন্যাস পরিবর্তনের জন্য
বাংলাদেশী খ্রিষ্টান এবং বৌদ্ধ প্রব্রজনকে দায়ী করা হয় না, একই ভাবে মুসলমান প্রব্রজনকেও এর কারণ হিসেবে
ব্যাখ্যা করা সঠিক হবে না।
আট
উপসংহার
রোগ নিরাময়ের জন্য প্রাথমিক প্রয়োজন রোগের সঠিক কারণ নির্ধারণ। রোগের সঠিক কারণ না জানলে অথবা লুকিয়ে রাখলে
কোনো চিকিৎসাই সফল হয় না। ভাষা অথবা ধর্মীয় ক্ষেত্রে আসামের জনবিন্যাস পরিবর্তন নিয়ে যে আখ্যান তৈরি করা হয়েছে সে সম্বন্ধে একই কথা
প্রযোজ্য। আদমশুমারি এবং অন্যান্য সরকারি তথ্য পর্যালোচনা করে এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না যে
আসামে ১৯৭১ সনের পর লক্ষ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ হয়েছে। বৈধ বা অবৈধভাবে যে সমস্ত বাংলাদেশী ১৯৭১ সনের পর ভারতবর্ষে
অনুপ্রবেশ করেছেন তাদের সিংহভাগই অন্যান্য রাজ্যে আছেন। আসামের মোট জনসংখ্যায় অসমীয়াভাষীদের আনুপাতিক হার যে ক্রমশ: হ্রাস পাচ্ছে তার মুখ্য
কারণ ভাষা পরিবর্তন বা সংশোধন এবং এর সাথে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য। ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে হিন্দুদের অনুপাত ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়া এবং এর
বিপরীতে মুসলমান, খ্রিষ্টান এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আনুপাতিক
হার বৃদ্ধি হওয়ার মূল কারণ আর্থ-সামাজিক বৈষম্য। অন্য ধর্মাবলম্বীদের তুলনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অনেক উন্নত।
মূলত এই কারণেই মোট জনসংখ্যায় মুসলমান, খ্রিষ্টান এবং বৌদ্ধ
ধর্মাবলম্বীদের আনুপাতিক বৃদ্ধি। হিন্দুদের আনুপাতিক হ্রাস শুধুমাত্র আসামেই সীমাবদ্ধ নয়। আসাম ছাড়া উত্তর
পূর্বাঞ্চলের মোট জনসংখ্যায়
হিন্দুদের আনুপাতিক হ্রাস আরও বেশী।
আসামের জনবিন্যাস পরিবর্তনের জন্য যে সমস্ত কারণ মুখ্যত:
দায়ী সেইসব কারণকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র
লক্ষ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশী প্রব্রজনকে এর কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করলে তা নিশ্চয়ই
গুরুতরভাবে এক মৌলিক ভুল হবে। সর্বোপরি, অগণিত বাংলাদেশী প্রব্রজন
নিয়ে রাজ্যসভায় শ্রীপ্রকাশ জয় সোয়ালের প্রত্যাহার করা অথবা সংশোধিত বিবৃতি এবং এস কে সিনহার ত্রুটিপূর্ণ
তথ্য এবং ব্যাখ্যা সম্বলিত
প্রতিবেদন কী করে সুপ্রিম কোর্টে মান্যতা পেল এবং এর ভিত্তিতে এন আর সি নবীকরণের জন্য আদেশ জারি করা
হলো তা অবশ্যই ভবিষ্যতের জন্য এক বিশাল প্রশ্ন হয়ে থাকবে।
অন্ত্য-টীকা :
প্রবন্ধে
উল্লেখ করা ভারতবর্ষের জনসংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন পরিসংখ্যান সেনসাস অব ইণ্ডিয়া (https://censusindia.gov.in) ওয়েবসাইট থেকে নেয়া হয়েছে। সেনসাসের ভিত্তিতে টি
এফ আর সহ জনসংখ্যার বিভিন্ন অনুপাত নির্ধারণ লেখকের নিজস্ব।
তথ্যসূত্র :
(১) এস কে
সিনহা, ১৯৯৮,
Report on Illegal Migration into Assam, South Asia Terrorism Portal,
(https://www.satp.org/satporgtp/countries/india/states/assam/documents/papers/illegal_migration_in_assam.htm),
(এক্সেস তারিখ ১০-৪-২০২০)
(২) Lots
of Bangla migrants, how many we don't know: Jaiswal, The Economic Times,
February 20, 2009, (https://economictimes.indiatimes.com/news/politics-and-nation/lots-of-bangla-migrants-how-many-we-dont-know-jaiswal/articleshow/4158018.cms),
(এক্সেস তারিখ : ১৩-৫-২০২০)
(৩)
প্রাগুক্ত, এস কে সিনহা
(১৯৯৮)
(৪) প্রাগুক্ত, এস কে সিনহা (১৯৯৮)
(৫) হিতেশ্বর শইকীয়া, Assam NRC: 19, 30, Or 50L?
Chasing aliens or ghosts?, Times of India, (1-9-2019),
(https://timesofindia.indiatimes.com/india/assam-nrc-19-30-or-50l-chasing-aliens-or-ghosts/articleshow/70930178.cms),
(এক্সেস তারিখ : ২-৬-২০২০)
(৬) Compendium of India's Fertility and Mortality
Indicators, 1971 - 2013, Sample Survey of India,
(https://censusindia.gov.in/vital_statistics/Compendium/Srs_data.html),
(এক্সেস তারিখ : ২৪-৭-২০২০)
(৭) প্রাগুক্ত, Compendium of India's Fertility
and Mortality Indicators, 1971 - 2013
(৮) Lok Sabha, Starred Question No. 119, Illegal
Bangladeshi Migrants, (15-7-2020),
(http://164.100.47.194/Loksabha/Questions/QResult15.aspx?qref=1585&lsno=16),
(এক্সেস তারিখ : ৪-৪-২০২০
(৯) White Paper on Foreigners Issue, 2012,
(http://onlineedistrict.amtron.in/web/home-and-political-department/white-paper),
(এক্সেস তারিখ : ৩-৬-২০২০)
(১০) সি এস মুলান, ১৯৩২, Census of India, 1931, Volume III, Part I. -
Report, পৃঃ ৫২,
(http://lsi.gov.in:8081/jspui/bitstream/123456789/3132/1/33936_1931_REG.pdf),
(এক্সেস তারিখ : ১০-৪-২০২০)
(১১) তদেব, পৃঃ ৪৯-৫০
(১২) তদেব, পৃঃ ৫১
(১৩) তদেব, পৃঃ ৫২
(১৪) প্রাগুক্ত, এস কে সিনহা (১৯৯৮)
(১৫) (https://youtu.be/s9cHUJBt2Sw),
(এক্সেস তারিখ : ১৩-৪-২০২০)
(১৬) Bangladesh Population
Census 1991, Volume I, Analytical Report, 1994, International Household Survey
Network, পৃঃ ৪৩,
(https://catalog.ihsn.org/index.php/catalog/115/download/28901),
(এক্সেস তারিখ : ১৭-৫-২০২০)
(১৭) বাংলাপিডিয়া, আদমশুমারি, ১৫-৬-২০১৪
(http://bn.banglapedia.org/index.php?title=আদমশুমারি), (এক্সেস তারিখ : ৭-৬-২০২০)
(১৮) প্রাগুক্ত, Bangladesh Population Census
1991, পৃঃ ১০১
(১৯) চীফ প্রসিকিউটর বনাম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, বাংলাদেশ ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল-১, রায় (১-১০-২০১৩)
(https://www.ict-bd.org/ict1/ICT1%20Judgment/ICT-BD%20Case%20No.%2002%20of%202011%20Delivery%20of%20judgment%20final.pdf)
(এক্সেস তারিখ : ৭-৭-২০২০)
(২০) (https://www.sundayguardianlive.com/opinion/may-no-hindus-left-bangladesh-30-years),
( এক্সেস তারিখ : ২৩-৬-২০২০)
(২১) The State of The World's
Refugees 2000: Fifty Years of Humanitarian Action, 2000, UNHCR, পৃঃ ৬৪, (https://www.unhcr.org/publications/sowr/4a4c754a9/state-worlds-refugees-2000-fifty-years-humanitarian-action.html),
(এক্সেস তারিখ : ১০-৪-২০২০)
(২২) বাংলাপিডিয়া, দুর্ভিক্ষ, ১৪-১-২০১৫
(http://en.banglapedia.org/index.php?title=Famine)
(এক্সেস তারিখ : ৭-৬-২০২০)
(২৩) প্রাগুক্ত, The State of The World's
Refugees 2000, পৃঃ ৬৫
(২৪) (https://youtu.be/iCkT9deOFm4)
(এক্সেস তারিখ : ১৮-৬-২০২০)
(২৫) Guillaume Vandenbroucke,
Fertility and Wars: The Case of World War I in France,
American Economic Journal: Macroeconomics 2014, 6(2): 108–136 (https://www.aeaweb.org/articles?id=10.1257/mac.6.2.108)
(এক্সেস তারিখ : ৭-৭-২০২০)
(২৬) এস এম সফিকুল ইসলাম,
Fertility Estimates for Bangladesh based on Birth-History Data, Canadian
Studies in population, Vol. 15(1), 1988, pp 101-117,
(https://journals.library.ualberta.ca/csp/index.php/csp/article/view/15731),
(এক্সেস তারিখ : ১৫-৬-২০২০)
(২৭) (http://data.uis.unesco.org),
(এক্সেস তারিখ : ১৭-৬-২০২০)
(২৮) প্রথম আলো, দেশে হিন্দু জনসংখ্যা বেড়েছে : বিবিএস, ২৩-৬-২০১৬, (https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/896800)
(এক্সেস তারিখ : ১৭-৬-২০২০)
(২৯) প্রাগুক্ত, এস কে সিনহা (১৯৯৮)
(৩০) UNHCR, 2009, Note on the
nationality status of the Urdu-speaking community in Bangladesh, (https://www.refworld.org/pdfid/4b2b90c32.pdf),
(এক্সেস তারিখ : ২২-৬-২০২০)
(৩১) প্রাগুক্ত, এস কে সিনহা (১৯৯৮)
(৩২) R B Vaghaiwalla, Census of
India, 1951, Volume XII, Part I-A, পৃঃ ৪১৪
(৩৩) National Family and Health
Survey, 2015-16, Assam, (http://rchiips.org/NFHS/NFHS-4Report.shtml), (এক্সেস তারিখ : ২২-৬-২০২০)
#########