(C)IMAGE:ছবি |
মঙ্গলবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২১
অদ্ভুত
রবিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২১
জুনাইদের পিতা
(C)Image:ছবি |
রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১
যে ক'টা দিন পৃথিবীতে ।। ষোড়শ পর্ব
।। ১৬।।
আড় চোখে দেখলাম, রাত দেড়টা প্রায়। আমার শরীরটা ক্রমশ: ভারী হচ্ছে যেন। রাতের ভারী খাবারের পর উঠোনের দশ মিনিট দাড়িয়ে থাকা ছাড়া আর বেশ কসরত হয়নি আমার। বসেই আছি সেই থেকে। অথচ আব্বাকে দেখি এখনও সতেজ, শুরুতে যে অস্বস্তি ছিল সেটাও কেটে গেছে অনেকক্ষণ, একটা দৃঢ় চেতনা নিয়ে বলে যাচ্ছেন যেন এ ইতিহাস জানা দরকার। অন্তত তাঁর দামাদের সে জানা প্রয়োজন!
আব্বার খোলা চোখে ছাদের দিকে করা ধ্যানটা ভাঙাতেই বললাম...
-- সুনীল...
-- হুমম, শুনেছি সেই ড্রাইভারই না-কি কীভাবে সুনীলের নাম্বার পেয়েছে, পকেটে ছিল বোধহয়।
-- তারপর?
-- হুঁ, তারপর, তারপর আর কী, আমাদের সুনীলের ঘরে থাকার কথাটা ছড়িয়ে পড়ল তাঁদের এলাকায়। সুনীলদের উত্ত্যক্ত করা শুরু হল ঘরে বাইরে। প্রায় সপ্তাদিন পরেই একদিন ফজরের নামাজটা পড়েই বেরিয়ে পড়ি আমরা তিনজন। জায়গায় জায়গায় তখন পুলিশের টহল। ভোরের বাতাসে পোড়া গন্ধটা আরও ঝাঁঝিয়ে লাগছে আমাদের নাকে, মুখে। কিছুদূর যেতেই ক'জন পুলিশ আটকাল আমাদের, বলল, কোথায় যাবেন, বললাম শাহপুর। শাহপুর রিফিউজি ক্যাম্পটা তখন এ অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় স্থল। ওরাই গাড়িতে করে পৌঁছে দিল আমাদের সেখানে।
-- মানুষ, হায় মানুষ!
আব্বা আবারও যেন কাঁদো কাঁদো অবস্থায়। আমি বলতে ও পারি না, আব্বা থাক, ঘুমান, পাছে মন আরও খারাপ হয়ে যায়। আসলে মানুষের মন খারাপের কথাগুলো শুনতে হয়, আটকাতে নেই, বেরিয়ে এলেই বোঝাটা হালকা হয়। আব্বা আবার শুরু করলেন...
সেখানে প্রায় দিন পনেরো ছিলাম। কী দুর্বিষহ অবস্থা। প্রিয়জন হারানোর শোকে কেউ কারুর দিকে মনোযোগ দেয়ার মত নেই। কারুর মা, কারুর বোন, কারুর বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সকাল সকাল বেরিয়ে যান নিজ নিজ হারানো স্বজনদের খোঁজে, কেউ খুঁজে পান, কেউ পান না। যারা পান তারা আরও ভেঙে পড়েন। আহমেদাবাদ মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের বর্জ্য বাহী ট্র্যাক্টরে আসে লাশের ঢের, শাহপুর বড় মসজিদের কবরিস্থানে বিশাল সাইজের গর্ত করে একসাথে পনেরো, বিশটা করে লাশ ফেলে মাটি চাপা দেয়া হত। জীবিতের খোঁজে লাশের স্তূপে ভিড় জমাত আধ মরাদের দল।
এবার আমার চোখে পানি। ছোট্ট নাদিয়ার কথা ভেবে বুক ফেটে যাচ্ছে যেন আমার! আব্বাকে বললাম আর নাদিয়া?
নাদিয়ার কান্না হাজারো শিশুর কান্নার সাথে মিশে একাকার। আমরা সবাই এক! আমাদের একমাত্র পরিচয় আমরা রিফিউজি!
-- আর অফিস?
--- হ্যাঁ, অফিস তখন অর্ধ দিন হত। সুনীল আমাদের খোঁজে এফ আই আর দিয়েছে থানায়। একদিন অফিসে দেখেই জড়িয়ে ধরল। কিন্তু আমার কেন জানি আর থাকতে ইচ্ছে করছিল না সেখানে। মনে পড়ে যাচ্ছিল সুনীলের ভূপালের দিনগুলোর কথা। সেদিন তার বুকে বোধহয় এমনই যন্ত্রণা ছিল! কে জানে! সুনীলকে বললাম আমি চাকরি ছাড়ছি। সে পীড়াপীড়ি করতে লাগল, বলল সব ঠিক হয়ে যাবে! এমনকি আমাদের আবার শাহপুর থেকে তার ঘরে নিতে চাইল। কিন্তু অবিশ্বাসের বাতাস তখন কোণায় কোণায়, ওলিমা কিছুতেই শাহপুর ছাড়তে রাজি নয়। বাঁচলে সে সেখানেই বাঁচবে আর মরলে ও সেখানে! সুনীল আমাকে ভূপালে চলে যেতে বলল, সে সব ঠিক করে দেবে! তারপর মার্চের পঁচিশ তারিখ আহমেদাবাদ ছেড়ে সোজা এইখানে!
মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। আল্লাহু আকবার আল্লা হু আকবার...
চুপচাপ বসে আছি দু'জন মানুষ! আব্বা এতো সাহস দেখিয়ে ও যে কথাটি মুখ ফুটে বলার সাহস রাখতে পারলেন না, সে আমি নীরবে বুঝে গেলাম।
নাদিয়া কুরেশি, নাদিম কুরেশি আর আয়েশা কুরেশির সেই আদরের দুলাল!
আমি কান্নায় ভেঙে পড়ছি, আমার দুচোখে অশ্রুর বন্যা!
ক্রমশ:
#যেকটাদিনপৃথিবীতে
বুধবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১
স্বরবর্ণ
(C)Image:ছবি |
বুধবার, ২৫ আগস্ট, ২০২১
বৃক্ষ
॥ পৃথ্বীশ দত্ত ॥
(C)Image:ছবি
সেই ছেলে ও মেয়েটি, কী যেন নাম ? না, তখনও
নাম জানা যায়নি । এখন মেয়েটি উধাও । তবু ছেলেটি রুটিন মেনে যায় ।
ছেলেটি রোজ সেই বৃক্ষের কাছে যায় । তার সাথে কথা বলে । ভাদ্রের তাল পাকা দুপুরে, সূর্যের রৌদ্র শাসনে, তপ্ততা যখন দিগন্তব্যাপী, ছেলেটি তখন অশ্বত্থ ছায়ের শীতলতায় বসে নিঃশব্দে গল্প করে । গল্পের ছলে খেলা করে । বুকের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নামে বেদনার পাথর । একটু হালকা লাগে । আবারও পাথর গড়িয়ে নামে । বার বার । এ যেন বুক ও দহনের নিরন্তর খেলা !
সহস্র প্রসারিত হাতে ছায়া মেলে রাখে অশ্বত্থ গাছ । গাছ নয়, সে বৃক্ষ । সেও কথা বলে ছেলেটির সাথে । তার চপল পল্লব হেসে হেসে প্রমোদ ছড়ায় । ভালো লাগা দিতে চায় পরম আশ্রিতকে ।
কোন মানুষ এখানে আসে না । কোনও প্রয়োজন নেই এখানে আসার । জঙ্গলাকীর্ণ চারপাশ । তবু এই নির্জনতা ভরে আছে কত স্মৃতি, কত কথার গুঞ্জন, কত স্পর্শের উষ্ণতায় । এখানেই ওরা বসত । গল্প করত, গল্প রচিত করত দুজনে । সেই গল্পের ভাষা বৃক্ষটি জানত। সে শুনতে পেত তাদের কথার গভীরে কত স্বপ্নের ধ্যান । আজ ছেলেটি মৌন । তবু কিসের টানে সে বৃক্ষের পদতলে আসে ! স্মৃতি সততই নির্জনতা বিলাসী ।
একদিন সেই বৃক্ষের প্রসারিত শেকড়-চরণে ছেলেটি বসত মেয়েটিকে নিয়ে । সে কোনও একদিন । তরল স্বপ্নের রঙ নিয়ে নিবিড় লোফালুফি খেলত । গল্পের মৃদুভাষ ছড়িয়ে পড়ত বৃক্ষের শরীর জড়িয়ে । কল্পকালির টানে নানা স্বপ্নের কোলাজ এখানেই রচিত হত । এই অশ্বত্থ জানে প্রেমিকের মায়া মেদুরতা । সে জানে প্রেমের কথামালা কেমন করে কাব্য হয়ে ফুটে ওঠে । সে জানে প্রেম ও প্রতারণার অলৌকিক সম্মোহন । রঙ মুছে গেলে ক্যানভাসের পাতাগুলো বারবনিতার মত আরোপিত রূপ নিয়ে পড়ে থাকে ।
ছেলেটি এখন একা । এখন সে অবসাদে নিথর । তার স্বপ্নময় মারীচ হরিণী । তবু সে অশ্বত্থের কাছে যায় । অশ্বত্থই তার প্রেমের সাক্ষী । তার কাছে বসে, তারই কোলে শরীর এলিয়ে স্মৃতি-তর্পণে ডুবে যায় । কত কথা কত গল্প, স্বপ্ন ভাঙার আকুল ঢেউ আছড়ে পড়ে মনতটে । এ বড়োই বেদনাসুধা । এই বৃক্ষের বাকলে এখনো খোদাই করা আছে মেয়েটির নাম l যেন সে মেয়েটির ধারক । জড়িয়ে রাখে বাকলাঙ্গের নীরব মমতায় । গাছেরও প্রাণ আছে । গাছেরও প্রেম আছে । সে ছেলেটিকে নিঃশব্দে ডাকে-- ওরে আয়, আয় আয় !
হঠাৎ একদিন এই নির্জন বৃক্ষের চারপাশ ঘিরে মানুষের ভিড় । পুলিস এলো । এলো এম্বুলেন্স । ছেলেটি সত্যিই গাছ হয়ে গেল । গাছেই বিলীন হল অদৃশ্য আকুতি । কারণ, গাছেরও প্রেম আছে ।
কিন্তু তার শরীরটা চলে গেল লাশকাটা ঘরে । মেয়েটি তখন হ্যানিমুনে মত্ত নৈনিতালে । বরফ ও উষ্ণতা নিয়ে মাখামাখি খেলছে তার নিজস্ব পৃথিবীতে, আপন মানুষের সাথে ।
জানা গেল সেই ছেলেটির নাম আবেগ । মেয়েটি মায়া ।
***
রবিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২১
তোমাকে বলছি, স্বাধীনতা।
বুধবার, ২৮ জুলাই, ২০২১
লিলি
বছর দুয়েক আগের ঘটনা। কোন এক সন্ধ্যায় শহরের ব্যস্ততম এলাকায় সতীশ প্রথমবার স্ট্রিট লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল লিলিকে। ছিমছাম, সাদা সালোয়ার কামিজ পড়ে একটি মেয়েকে এমন অসময়ে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সতীশের কেমন যেন খটকা লাগল। সে এগিয়ে যাবে মেয়েটির সাথে কথা বলতে, হঠাৎ একটি মারুতি ভ্যান এসে থামল লিলির সামনে এবং সে চটপট উঠে পড়ল তাতে। তিনদিন পর সেই একই জায়গায় একই পরিস্থিতিতে অন্য একটি গাড়ি থামিয়ে অপর একজন বলল 'চল'। লিলি তখন এদিক ওদিক তাকিয়ে মিনিট খানেক সময় নিয়ে ইতস্তত করে উঠে পড়ল গাড়িতে। অদূরে চায়ের দোকানে বসে থাকা সতীশের মনে হল লিলি সম্ভবত বুঝতে পেরেছে যে সে লক্ষ করছে তাকে।
সেদিনই চা দোকানীর কাছ থেকে লিলির যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করল সতীশ। মেয়েটির বাবার যকৃতে ক্যান্সার। ছোট্ট দুটি ভাই বোন, মা আর দিদিমাকে নিয়ে তার সংসার। শহরের বৃহত্তম স্লাম এলাকার একসময়ের সচ্ছল পরিবারের মেয়ে ছিল সে। পাঁচটি পেট পালার দায়িত্ব যখন কাঁধে পড়ল তখন সাহস করে পয়সা উপার্জনের সহজ রাস্তায় নেমে পড়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না তার।
এর কিছুদিন পর সতীশ আবার লিলিকে দেখেছিল মিশন প্রাঙ্গণে। সারদা মায়ের জন্মদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বৃদ্ধা দিদিমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল মিশনের এক কোণে। সতীশ এগিয়ে গেল লিলির কাছে এবং টিপ্পনী করল - 'কোন সময় কে কোথায় যে দাঁড়ায় আজকাল বোঝা বড় দায়'। লিলি বুঝতে পেরেছিল সতীশ তাকে উদ্দেশ্য করেই বলছে কথাগুলি। তবুও কোন প্রত্যুত্তর দেয়নি সে। শুধু দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার চোখ থেকে। সমাজে তার পেশা নিষিদ্ধ তবু সেদিন লিলিকে অশুদ্ধ বা অশুচি মনে হয়নি সতীশের। বরং সেদিন নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়েছিল তার।
সংবাদ যাই হোক শিরোনামে চমক থাকা চাই। তাই লিলির নামের আগে 'যৌনকর্মী' শব্দটি জুড়ে দিল ব্যবসাসফল পত্রিকার সুচতুর এডিটর। একবারও ভেবে দেখল না যে লিলি যৌনকর্মী হিসেবে নয় দায়িত্ব পালন করেছে সুযোগ্য কন্যার। তাছাড়া খবরের ভিতরের অংশে পরোক্ষে লিলির জীবনের নেগেটিভ দিকই যেন তুলে ধরা হয়েছে বেশি করে। করোনা সংক্রমণের অজুহাতে ছেলেমেয়েরা যেখানে মা-বাবার মৃতদেহ সমঝে নিতে অস্বীকার করছে সেখানে লিলি কোভিড আক্রান্ত পিতার শব একাই শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করেছে, তাকে তো সামান্য সম্মান দেখানো দরকার।
নিষিদ্ধ পেশায় জড়িয়ে থাকলেও যৌনকর্মীদেরও পরিবার থাকে এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনে ওরা অনেক ব্যতিক্রমী সাহসী - একথা মানুষকে জানাতে হবে। তাই লিলিকে নিয়ে একটা স্টোরি করল সতীশ এবং পাঠিয়ে দিল কয়েকটি দৈনিক কাগজে। কোন কোন কাগজ স্টোরিটি প্রকাশ করে এখন সেটাই দেখার।